আল্লাহ পরিচিতি

0 510

 

 

allah

দ্বীন এর অর্থ কি?
দ্বীনের ধারণাঃ
এ বইয়ের উদ্দেশ্য হল, ইসলামী মতবিশ্বাসের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা যাকে পারিভাষিক অর্থে “দ্বীনের মূলনীতি” বলা হয়ে থাকেফলে দ্বীন শব্দটি ও এতদসম্পর্কিত অন্যান্য পরিভাষাসমূহের উপর সর্বাগ্রে সংক্ষিপ্তরুপে আলোকপাত করার চেষ্টা করবোকারণ, যুক্তিশাস্ত্রের মতে কোন বিষয়ের সংজ্ঞাসমূহের স্থান সর্বশীর্ষে

দ্বীন একটি আরবী শব্দ যার শাব্দিক অর্থ হল অনুসরণ, প্রতিদান ইত্যাদি

পরিভাষাগত অর্থে, মানুষ ও বিশ্বের জন্যে একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন বলে বিশ্বাস এবং এ বিশ্বাস সম্পর্কিত যাবতীয় বিধি-নিষেধ হলদ্বীন”

দ্বীনের এই সংজ্ঞানুসারে, যারা সম্পূর্ণরূপে সৃষ্টিকর্তায় অবিশ্বাসী এবং সৃষ্টিসমূহের সৃষ্টিকে সাংঘর্ষিক অথবা শুধুমাত্র প্রকৃতি ও পদার্থসমূহের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফল বলে মনে করেন, তারা বিধর্মী বলে পরিচিতআর যারা বিশ্বের সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করেন, তাদের মতাদর্শ ও ধর্মানুষ্ঠানগুলো যতই সবিচ্যুতি ও কুসংস্কারাচ্ছন্নই হোক না কেন, তারা সধর্মী বলে পরিগণিতএ মূলনীতির ভিত্তিতে মানুষের মধ্যে প্রচলিত ধর্মসমূহকে সত্যধর্ম ও মিথ্যাধর্মে বিভক্ত করা যায়
অতএব সত্যধর্ম বলতে বুঝায়ঃ যে ধর্ম সত্যানুসারে ও সঠিক মতবিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং যে সকল আচার-ব্যবহার পর্যাপ্ত যুক্তি-প্রমাণের ভিত্তিতে সঠিক ও আস্থাশীল বলে পরিগণিত সে সকল আচার-ব্যবহারের সুপারিশ ও গুরুত্ব প্রদান করে
দ্বীনের মৌলাংশ ও গৌণাংশঃ
দ্বীনের পারিভাষিক ধারণার ভিত্তিতে স্পষ্টতঃই প্রতীয়মান হয় যে, প্রতিটি দ্বীনই কমপক্ষে দুটি অংশ নিয়ে গঠিতঃ
যে সকল বিশ্বাসের উপর দ্বীনের মূলভিত্তি প্রতিষ্ঠিত সে সকল
ঐ মূলভিত্তিসমূহের ভিত্তিতে প্রণীত কর্মসূচী

অতএব যথার্থই বলা যায় যে, ‘মতবিশ্বাসহল, দ্বীনের মূল অংশ এবং বিধি-নিষেধ হল দ্বীনের গৌণ অংশযেমনঃ ইসলামী পণ্ডিতগণ এ দুটি পরিভাষাকে ইসলামী মতবিশ্বাস ও বিধি-নিষেধের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন

বিশ্বদৃষ্টি ও মতাদর্শ এ পরিভাষাগুলো প্রায় একই অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকেসাধারণতঃ বিশ্বদৃষ্টি বলতে বুঝায়ঃ ব্শ্বি ও মানুষ সম্পর্কিত একশ্রেণীর সামগ্রিক বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গিঅর্থাৎ সামগ্রিকভাবে অস্তিত্ব সম্পর্কে একশ্রেণীর সামগ্রিক বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গিআর মতাদর্শ বলতে বুঝায়ঃ মানুষের আচার-ব্যবহার সম্পর্কে এক শ্রেণীর সামগ্রিক মতামত
উপরোল্লিখিত অর্থানুসারে কোন দ্বীনের মৌলিক ও বিশ্বাসগত বিষয়গুলোকে ঐ দ্বীনের বিশ্বদৃষ্টি এবং দ্বীনের সামগ্রিক বিধি-নিষেধগত বিষয়গুলোকে ঐ দ্বীনের মতাদর্শ বলে মনে করা যেতে পারেঅনুরূপ ঐগুলোকে দ্বীনের মৌলাংশ ও গৌণাংশ রূপে বর্ণনা করা যেতে পারেকিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে, মতাদর্শ পরিভাষাটি আংশিক বিধি-নিষেধের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়সে রূপ বিশ্বদৃষ্টিও আংশিক বিশ্বাসসমূহকে সমন্বয় করে না
উল্লেখ্য, মতাদর্শ” শব্দটি কখনো কখনো সাধারণ অর্থে ব্যবহার করা হয়তখন বিশ্বদৃষ্টিও এর অন্তর্ভূক্ত বলে পরিগণিত হয়
ঐশ্বরিক বিশ্বদৃষ্টি ও বস্তুগত বিশ্বদৃষ্টিঃ
মানুষের মধ্যে বিভিন্ন বিশ্বদৃষ্টি বিদ্যমান ছিল এবং এখনও বর্তমানতবে অতিপ্রাকৃতিক বিষয়কে গ্রহণ ও বর্জনের উপর ভিত্তি করে এগুলোকে দুভাগে বিভক্ত করা যায়ঃ ঐশ্বরিক বিশ্বদৃষ্টি এবং বস্তুবাদী বিশ্বদৃষ্টি
পূর্বে বস্তুবাদী বিশ্বদৃষ্টির অনুসারীদেরকে প্রকৃতিবাদী, এ্যাথিষ্ট (Atheist) কখনো কখনো দ্বৈতবাদী (Dualist) ও নাস্তিক বলা হতবর্তমানে তাদেরকে বস্তুবাদী বা Materialism নামে অভিহিত করা হয়ে থাকেবস্তুবাদের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা রয়েছেতবে অধুনা এগুলোর মধ্যে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ (Dialectic Materialism) সর্বাধিক পরিচিত, যা মার্কসিজমের দর্শনকে রূপদান করেছে
ইতিমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে যে, বিশ্বদৃষ্টির পরিধি দ্বীনের বিশ্বাসগত অংশ অর্থাৎ আকায়েদ অপেক্ষা বিস্তুততরকারণ, তা নাস্তিক্যবাদী ও বস্তুবাদী বিশ্বাসকেও সমন্বিত করে থাকে অনুরূপ, মতাদর্শ পরিভাষাটিও শুধুমাত্র দ্বীনের সমগ্র বিধি-নিষেধের জন্যেই ব্যবহৃত হয় না  

ঐশী ধর্মসমূহ ও তাদের মূলনীতিসমূহঃ
বিভিন্ন ধর্মের উৎপত্তির স্বরুপ সম্পর্কে ঐতিহাসিক, সমাজবিজ্ঞানী ও নৃবিজ্ঞানীদের মধ্যে মতানৈক্য বিদ্যমান তবে, ইসলামী উৎস থেকে যতটুকু জানা সম্ভব, তার ভিত্তিতে বলা যায়ঃ মানুষের আর্বিভাবের সাথে সাথেই ধর্মের আবির্ভাব ঘটেছিল এবং মানব জাতির প্রথম সদস্য হযরত আদম (আঃ) স্বয়ং আল্লাহর নবী, তাওহীদের প্রবক্তা এবং একেশ্বরবাদী ছিলেনআর অংশীবাদী ধর্মসমূহ সর্বদা বিচ্যুতি এবং সামষ্টিক ও ব্যক্তিগত লোভ-লালসার ফলে উৎপত্তি লাভ করেছিল
বিচ্যুতির উদাহরণ স্বরূপ আমরা বলতে পারি, কোন কোন দ্বীনের অনুসারীরা অত্যাচারী ও প্রভাবশালীদের সন্তুষ্টির জন্য দ্বীনকে শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তার সাথে মানুষের সম্পর্ক এবং দ্বীনের আহকামকে শুধুমাত্র ধর্মীয় কিছু আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করেছেনবিশেষ করে রাজনৈতিক ও সামাজিক কার্যকলাপকে ধর্মবহির্ভূত কর্ম বলে বর্ণনা করেছেনঅথচ প্রতিটি ঐশী ধর্মই মানুষের ইহ ও পরকালের কল্যাণের জন্যে সামাজিক ক্ষেত্রে ঐ সমাজের জনগণের দিকনির্দেশনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেতবে মানুষ তার সীমাবদ্ধ জ্ঞানে ইহা অনুধাবণ করতে অপারগএ বিষয়টি ব্যাখ্যা যথাস্থানে বর্ণিত হবে সর্বশেষ নবী, যিনি মহান প্রভূ কর্তৃক প্রেরিত হয়েছেন, সঙ্গত কারণেই বিশ্বজগতের অন্তিম লগ্ন পর্যন্ত মানুষের জন্যে প্রয়োজনীয় আদেশ-নিষেধ ও পরিচিতি, তার (সর্বশেষ নবী) নিকট প্রেরণ করেছেনআর এ কারণেই ইসলামী শিক্ষা একটা বিশেষ অংশ জুড়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আলোচনার গুরুত্ব বিদ্যমান
একেশ্বরবাদী ধর্মসমূহ, যেগুলো প্রকৃতপক্ষে ঐশ্বরিক ধর্মসমূহও বটে, সেগুলো সত্যধর্ম বলে পরিচিতএ ধর্মগুলো তিনটি সামগ্রিক মূলে অভিন্নযথা-
(
১) একক প্রভূর প্রতি বিশ্বাস
(
২) প্রতিটি মানুষের জন্যে পরকালীন অনন্ত জীবন আছে বলে বিশ্বাস ও পার্থিব কর্মের জন্যে অর্জিত কর্মফল গ্রহণের (দিবসের) প্রতি বিশ্বাস স্থাপন
(
৩) পরম উৎকর্ষ সাধন এবং ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণের পথে মানুষকে পরিচালনার জন্যে মহান প্রভূর নিকট থেকে নবীগণ প্রেরিত হয়েছেন বলে বিশ্বাস স্থাপন
এ মূলত্রয় প্রকৃতপক্ষে তিনটি মৌলিক প্রশ্ন, যা প্রত্যেক বিবেক সম্পন্ন মানুষের বিবেকেই বিদ্যমান তারই জবাব মাত্রপ্রশ্নত্রয় নিম্নরূপঃ
(
ক) অস্তিত্ব দান করেন কে?
(
খ) জীবনের শেষে কি রয়েছে?
(
গ) কিরূপে জীবনের সর্বোকৃষ্ট কর্মসূচীর পরিচয় পাওয়া যেতে পারে?
প্রসঙ্গতঃ ওহীর মাধ্যমে জীবন কর্মসূচীর যে বিষয় বস্তু নিশ্চিতরুপে লাভ করেছে সত্যিকার অর্থে তাই হল সে ধর্মীয় মতাদর্শ যা ঐশ্বরিক বিশ্বদৃষ্টির উপরে প্রতিষ্ঠিত
অপরিহার্য বিষয়সমূহ, অবিচ্ছেদ্য বিষয়সমূহ, নির্ভরশীল বিষয়সমূহ, সংশ্লিষ্ট ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসমূহ, যেগুলি সামগ্রিকভাবে দ্বীনের বিশ্বাস সমষ্টিকে রূপায়িত করে সেইগুলির সমন্বয়ে মৌলিক মতবিশ্বাস গঠিতআর বিশ্বাসসমূহের বৈসাদৃশ্যই হল একাধিক ধর্ম, ধমীয় দল-উপদল ও মাজহাবের উৎপত্তির কারণযেমনঃ কোন কোন নবীগণের (আঃ) নবুয়্যতের ব্যাপারে মতানৈক্যের কারণেই ইহুদী, খৃষ্টান ও ইসলাম ধর্মের মধ্যে এবং তাদের মতবিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে বৈসাদৃশ্য পরিলক্ষিত হচ্ছেএমনকি কোন কোন বিষয়, মৌলিক মতবিশ্বাসের (প্রকৃত) অসঙ্গতি সৃষ্টি করেছেযেমনঃ খৃষ্টানদের ত্রিত্ববাদ, একেশ্বরবাদের সাথে পুরোপুরি সঙ্গতিহীন; যদিও তারা এর ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্ঠা করেনঅনুরূপ রাসূল (সাঃ) এর উত্তরসূরী নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষথেকে নির্বাচিত হবেন, না জনগণ নির্বাচন করবে?’ এ বিষয়ের উপর মতবিরোধের ফলেই শিয়া ও সুন্নী মাজহাবের মধ্যে বৈসাদৃশ্য সৃষ্টি হয়েছে
উপসংহারে বলা যায় তাওহীদ, নবুয়্যত এবং পুরুথ্থান দিবস, এই তিনটি হচ্ছে প্রত্যেক ঐশ্বরিক ধর্মেরই মৌলিকতম বিশ্বাসতবে এই মূলত্রয়ের বিশ্লেষণের ফলে অর্জিত অথবা তাদের অধিনস্থ অন্যান্য বিশ্বাসসমূহকেও বিশেষ পারিভাষিক অর্থে মৌলিক বিশ্বাসরূপে গণনা করা যেতে পারেযেমনঃ আল্লাহর অস্তিত্বের বিশ্বাসকে একটি মৌলিক বিশ্বাস এবং তার একত্বকে অপর একটি মৌলিক বিশ্বাস হিসেবে মনে করা যেতে পারেঅথবা নবুয়্যতের বিশ্বাসকে সকল ধর্মেরই মৌলাংশ এবং সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর নবুয়্যতের বিশ্বাসকে ইসলামের অপর একটি মৌলিক বিশ্বাসরূপে গণনা করা যেতে পারেযেমনঃ কোন কোন শিয়া পণ্ডিত ন্যায়পরায়ণতাকে (العدل) একটি স্বতন্ত্র মূল হিসাবে মনে করেনযদিও এটা তাওহীদেরই একটি শাখাঅনুরূপ, নবুয়্যতের অধিন হওয়া সত্বেও ইমামতকে আলাদা একটি মৌলিক বিশ্বাসরূপে গণনা করে থাকেনপ্রকৃতপক্ষে এ ধরণের বিশ্বাসের ক্ষেত্রেমৌলিকশব্দটির ব্যবহার একান্তই পারিভাষিক ও পারস্পরিক সম্মতিভিত্তিকফলে, এ ব্যাপারে বিতর্কের কোন অবকাশ নাই
অতএব, দ্বীনেরমৌলাংশশব্দটিকে সাধারণ ও বিশেষ এই দুটি অর্থে ব্যবহার করা যেতে পারে। “মৌলাংশ” পরিভাষাটির সাধারণ অর্থ “দ্বীনের গৌণাংশ” অর্থাৎ বিধি-নিষেধ অংশের বিপরীতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে এবং নির্ভরযোগ্য সকল মতবিশ্বাসকে সমন্বয় করে থাকেআর তার বিশেষ অর্থটি দ্বীনের মৌলিকতম বিশ্বাসের ক্ষেত্রে নির্ধারিত হয়ে থাকেঅনুরূপ, মৌলিক বিশ্বাসত্রয়ের মত সকল ঐশী ধর্মের অভিন্ন বিশ্বাসকে ( তাওহীদ, নবুয়্যত, পুনরুথ্থান দিবস) দ্বীনের মৌলাংশ (নিরঙ্কুশভাবে) এবং তাদের সাথে অপর এক বা একাধিক মৌলিক বিশ্বাসের সমন্বয়েদ্বীনের বিশেষ মৌলাংশঅথবা এক বা একাধিক বিশ্বাস, যেগুলো মাজহাব বা ফেরকার বিশেষত্ব, সেগুলোর সংযোজনের মাধ্যমে কোন মাজহাবের মৌলিক বিশ্বাসরূপে গণনা করা হয়

দ্বীনের অনুসন্ধানের গুরুত্বঃ
স্পষ্টতঃই প্রতীয়মান হয় যে, একদিকে বাস্তবতাকে চিনার জন্যে ফিতরাতগত চাহিদা, অপর দিকে স্বার্থসিদ্ধি ও লভাবান হওয়ার, ক্ষতির হাত থেকে নিরাপদে থাকার প্রবণতা হল চিন্তা করার জন্যে এবং গভীর জ্ঞানার্জনের জন্যে শক্তিশালী উদ্দীপকঅতএব, কোন ব্যক্তি অবহিত হল যে, যুগ যুগ ধরে একশ্রেণীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ দাবী করেছেন যে, “আমরা ইহ ও পরকালীন কল্যাণের দিকে মানুষকে পথ প্রদর্শনের জন্যে বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তার নিকট থেকে প্রেরিত হয়েছি” সত্যের বাণী পৌঁছানোর পথে ও মানুষকে পথ প্রদর্শনের ক্ষেত্রে তারা কোন প্রকার চেষ্টা করা থেকে বিরত হন নি এবং যে কোন প্রকার দুঃখ- কষ্টকে সহ্য করেছেন; এমনকি এ পথে তারা নিজ জীবনও উৎসর্গ করেছেনতখন ঐ ব্যক্তি পূর্বোল্লিত উদ্দপকদ্বয়ের দ্বারা দ্বীন সম্পর্কে অনুসন্ধানের জন্যে উদ্দীপ্ত হয়ে জানতে চেষ্টা করে যে, পয়গাম্বরগণের দাবী কতটা সত্য এবং কতটা যুক্তিযুক্তবিশেষ করে কোন ব্যক্তি জানতে পারলো যে, তাদের (নবীগণের) আহ্বান অনন্ত সুখ ও বৈভবের সুসংবাদ এবং অনন্ত দুঃখ-দুদর্শা ও শাস্তির ভীতি প্রদর্শন সংশ্লিষ্টঅর্থাৎ তাদের আহ্বানে সাড়া দেয়ার মধ্যে চিরন্তন সুখ-সম্মৃদ্ধির সম্ভবনা বিদ্যমানআর তাদের আহ্বানে বিরোধীতা করার মধ্যে অনন্ত ক্ষতির সম্ভাবনা বিদ্যমানতবে ঐ ব্যক্তি কোন্ অজুহাতে দ্বীন সম্পর্কে উদাসীনতা ও শৈথিল্য প্রদর্শন করবে এবং অনুসন্ধান ও গবেষণার জন্যে উদ্যোগী হবে না?

হ্যাঁ, সম্ভবতঃ কেউ অলসতা ও আরামপ্রিয়তার কারণে গবেষণা ও অনুসন্ধানের কাজে নিজেকে পরিশ্রান্ত করতে চান না অথবা দ্বীন গ্রহণ করার কারণে কিছু সীমাবদ্ধতা বা বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হবে এবয়ং তার কিছু কিছু স্বেচ্ছাচারী কর্ম থেকে তাকে বিরত বাখবে, এ কারণে দ্বীনের অনুসন্ধান থেকে সে নিজেকে দূরে রাখে
কিন্তু এ ধরনের ব্যক্তিরা অচিরেই এ অলসতা ও স্বেচ্ছাচারিতার শোচনীয় পরিণতি দেখতে পাবে এবং পরিশেষে অনন্ত শাস্তি ও অপরিসীম দুদর্শায় পতিত হবে
এ ধরণের ব্যক্তির অবস্থা অসুস্থ ঐ নির্বোধ শিশুর চেয়েও খারাপ যে ঔষধের তিক্ততার ভয়ে চিকিৎসকের নিকট যায় না এবং নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে নিজেকে ঠেলে দেয়কারণ ভাল-মন্দের পার্থক্য বুঝার মত যথেষ্ট বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ উক্ত শিশুর ঘটেনিতবে চিকিৎসকের পরামর্শের বিরোধীতা করার ফলে শুধুমাত্র ক্ষণস্থায়ী এ জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ থেকে বঞ্চিত হওয়া বৈ কিছু নয়কিন্তু একজন বয়ঃপ্রাপ্ত ও সচেতন মানুষ, যে লাভ-লোকসান সম্পর্কে ভাবতে পারগ, সে তো স্বল্পস্থায়ী সুখের বিনিময়ে অনন্ত শাস্তিই ক্রয় করে থাকে
এ কারণেই, পবিত্র কোরআনে এ ধরণের উদাসীন মানুষকে চতুষ্পদ জন্তুর চেয়েও অধম বলে বর্ণনা করেছেনকোরআনে একশ্রেণীর লোক সম্পর্কে বলা হচ্ছে-
তারা চতুষ্পদ জন্তুর মত বরং তা থেকেও অধম; তারাই হচ্ছে উদাসীন। (সুরা-আরাফের এর ১৭৯নং আয়াতাংশ)
অপর একস্থানে কোরআন তাদেরকে নিকৃষ্টতম প্রাণীরূপে পরিচয় করিয়ে বলেছে-
নিঃসন্দেহের আল্লাহর নিকট সমস্ত প্রাণীর তুলনায় তারাই নিকৃষ্টতম জীব যারা বধির, বোবা ও যারা বিবেকহীন। (সূরা আনফাল এর ২২নং আয়াতাংশ)

এ প্রসঙ্গে স্মরণযোগ্য যে, কোন কোন মনোবিজ্ঞানী ও মনোসমীক্ষক বিশ্বাস করেন যে, খোদাভীরুতা হল মানুষের একটি প্রত্যক্ষ ফিতরাতগত চাহিদা এবং তার উৎসকে ধর্মানুভূতি নামকরণ করতঃ তাকে অনুসন্ধিৎসা, কল্যাণানুভূতি ও সৌন্দর্যানুভূতির পাশাপাশি চতুর্থ আত্মিক বৈশিষ্টরূপে গণনা করেছেনতারা তাদের ধারণার স্বপক্ষে যুক্তি প্রদর্শনের জন্যে ইতিহাস ও প্রত্মতত্বের শরণাপন্ন হয়েছেন এবং বলেছেন যে, খোদাভীরুতা সর্বদা কোন না কোনভাবে সর্বযুগের মানুষের মধ্যে প্রচলিত ছিলআর এ সার্বজনীনতা ও চিরন্তনতাই খোদাভীরুতার ফিতরাতগত হওয়ার সপক্ষে প্রমাণ বহন করেতবে ফিতরাতগত (সহজাতগত) চাহিদার সার্বজনীন অর্থ এ নয় যে, এটা সর্বদা সর্বজনের মধ্যে জাগ্রত ও সজীব থাকবে এবং মানুষকে সতর্কতার সাথে আপন যাঞ্চার দিকে উদ্বুদ্ধ করবেবরং তা পারিপার্শিক পরিবেশ ও ত্রুটিপূর্ণ পরিচর্যার কারণে নিস্প্রভ ও নিস্ক্রিয়ও হয়ে যেতে পারে কিংবা আপন সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে যেতে পারে, যেমনি করে অন্যান্য সহজাত প্রবণতার ক্ষেত্রে এ ধরণের নিস্প্রভতা, বিচ্যুতি ও অবদমিত অবস্থা কমবেশী পরিলক্ষিত হয়
এ মতবাদ অনুসারে, দ্বীনের অনুসন্ধানের উদ্দীপক হল প্রত্যক্ষভাবে ফিতরাতগত এবং যুক্তি-প্রমাণের ভিত্তিতে এর অপরিহার্যতা প্রতিষ্ঠার কোন প্রয়োজন নেই
মতবাদকে দ্বীনের ফিতরাতগত হওয়া সম্পর্কিত কোরআনের আয়াত এবং রাসূলে (সাঃ) হাদিসের উদ্বৃতির মাধ্যমে প্রমাণ করা যেতে পারেতবে এ ফিতরাতগত চাহিদা অবচেতন অবস্থায় প্রকাশ পায়এ ধারণার উপর ভিত্তি করে কেউ কেউ তর্ক-বিতর্কের খাতিরে নিজের মধ্যে এ ধরণের প্রবণতার অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পারেতাই আমরা শুধুমাত্র এ যু্ক্তিতেই তুষ্ট হব না এবং দ্বীনের অনুসন্ধানের গুরুত্ব প্রমাণ করতে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রমাণের আশ্রয় গ্রহণ করবো
দ্বীনের অনুসন্ধানের গুরুত্বঃ  

স্পষ্টতঃই প্রতীয়মান হয় যে, একদিকে বাস্তবতাকে চিনার জন্যে ফিতরাতগত চাহিদা, অপর দিকে স্বার্থসিদ্ধি ও লভাবান হওয়ার, ক্ষতির হাত থেকে নিরাপদে থাকার প্রবণতা হল চিন্তা করার জন্যে এবং গভীর জ্ঞানার্জনের জন্যে শক্তিশালী উদ্দীপকঅতএব, কোন ব্যক্তি অবহিত হল যে, যুগ যুগ ধরে একশ্রেণীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ দাবী করেছেন যে, “আমরা ইহ ও পরকালীন কল্যাণের দিকে মানুষকে পথ প্রদর্শনের জন্যে বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তার নিকট থেকে প্রেরিত হয়েছি” সত্যের বাণী পৌঁছানোর পথে ও মানুষকে পথ প্রদর্শনের ক্ষেত্রে তারা কোন প্রকার চেষ্টা করা থেকে বিরত হন নি এবং যে কোন প্রকার দুঃখ- কষ্টকে সহ্য করেছেন; এমনকি এ পথে তারা নিজ জীবনও উৎসর্গ করেছেনতখন ঐ ব্যক্তি পূর্বোল্লিত উদ্দপকদ্বয়ের দ্বারা দ্বীন সম্পর্কে অনুসন্ধানের জন্যে উদ্দীপ্ত হয়ে জানতে চেষ্টা করে যে, পয়গাম্বরগণের দাবী কতটা সত্য এবং কতটা যুক্তিযুক্তবিশেষ করে কোন ব্যক্তি জানতে পারলো যে, তাদের (নবীগণের) আহ্বান অনন্ত সুখ ও বৈভবের সুসংবাদ এবং অনন্ত দুঃখ-দুদর্শা ও শাস্তির ভীতি প্রদর্শন সংশ্লিষ্ট অর্থাৎ তাদের আহ্বানে সাড়া দেয়ার মধ্যে চিরন্তন সুখ-সম্মৃদ্ধির সম্ভবনা বিদ্যমান আর তাদের আহ্বানে বিরোধীতা করার মধ্যে অনন্ত ক্ষতির সম্ভাবনা বিদ্যমানতবে ঐ ব্যক্তি কোন্ অজুহাতে দ্বীন সম্পর্কে উদাসীনতা ও শৈথিল্য প্রদর্শন করবে এবং অনুসন্ধান ও গবেষণার জন্যে উদ্যোগী হবে না?

হ্যাঁ, সম্ভবতঃ কেউ অলসতা ও আরামপ্রিয়তার কারণে গবেষণা ও অনুসন্ধানের কাজে নিজেকে পরিশ্রান্ত করতে চান না অথবা দ্বীন গ্রহণ করার কারণে কিছু সীমাবদ্ধতা বা বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হবে এবয়ং তার কিছু কিছু স্বেচ্ছাচারী কর্ম থেকে তাকে বিরত বাখবে, এ কারণে দ্বীনের অনুসন্ধান থেকে সে নিজেকে দূরে রাখে
কিন্তু এ ধরনের ব্যক্তিরা অচিরেই এ অলসতা ও স্বেচ্ছাচারিতার শোচনীয় পরিণতি দেখতে পাবে এবং পরিশেষে অনন্ত শাস্তি ও অপরিসীম দুদর্শায় পতিত হবে
এ ধরণের ব্যক্তির অবস্থা অসুস্থ ঐ নির্বোধ শিশুর চেয়েও খারাপ যে ঔষধের তিক্ততার ভয়ে চিকিৎসকের নিকট যায় না এবং নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে নিজেকে ঠেলে দেয়কারণ ভাল-মন্দের পার্থক্য বুঝার মত যথেষ্ট বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ উক্ত শিশুর ঘটেনিতবে চিকিৎসকের পরামর্শের বিরোধীতা করার ফলে শুধুমাত্র ক্ষণস্থায়ী এ জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ থেকে বঞ্চিত হওয়া বৈ কিছু নয়কিন্তু একজন বয়ঃপ্রাপ্ত ও সচেতন মানুষ, যে লাভ-লোকসান সম্পর্কে ভাবতে পারগ, সে তো স্বল্পস্থায়ী সুখের বিনিময়ে অনন্ত শাস্তিই ক্রয় করে থাকে
এ কারণেই, পবিত্র কোরআনে এ ধরণের উদাসীন মানুষকে চতুষ্পদ জন্তুর চেয়েও অধম বলে বর্ণনা করেছেনকোরআনে একশ্রেণীর লোক সম্পর্কে বলা হচ্ছে-
তারা চতুষ্পদ জন্তুর মত বরং তা থেকেও অধম; তারাই হচ্ছে উদাসীন (সুরা-আরাফের এর ১৭৯নং আয়াতাংশ)
অপর একস্থানে কোরআন তাদেরকে নিকৃষ্টতম প্রাণীরূপে পরিচয় করিয়ে বলেছে-
নিঃসন্দেহের আল্লাহর নিকট সমস্ত প্রাণীর তুলনায় তারাই নিকৃষ্টতম জীব যারা বধির, বোবা ও যারা বিবেকহীন। (সূরা আনফাল এর ২২নং আয়াতাংশ)

একটি ভুল ধারণার অপনোদনঃ
হয়ত কেউ কেউ এমন কোন বাহানা দাঁড় করাতে পারেন যে, কোন সমস্যা সমাধানে মানুষ তখনই প্রচেষ্টা চালায়, যখন তা সমাধানের কোন পথ খুঁজে পাবার আশা থাকেকিন্তু আমরা দ্বীন ও দ্বীন সম্পর্কিত কোন বিষয়ের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করে, কোন ফল পাবার ব্যাপারে খুব একটা আশাবাদী নইফলে সে সকল কর্মের পিছনে আমাদের সময় ও শ্রম ব্যয় করায় প্রাধান্য দিব, যেগুলো থেকে ফল পাওয়ার ব্যাপারে আমরা অপেক্ষাকৃত বেশী আশাবাদী
জবাবে এ ধরণের লোকদেরকে বলতে হয়ঃ
প্রথমতঃ দ্বীনের মৌলিক বিষয়গুলোর সমাধানের প্রত্যাশা কোনভাবেই অন্য সকল বৈজ্ঞানিক বিষয়বস্তুর সমাধানের চেয়ে কম নয়আমরা জানি যে, এমন অনেক বৈজ্ঞানিক বিষয় আছে যে, কয়েক দশক অবিরাম প্রচেষ্টার পর সেগুলোর সমাধান সম্ভব হয়েছে
দ্বিতীয়তঃ সম্ভাবনার (probablity) গুরুত্ব কেবলমাত্র এক নির্বাহীর (সম্ভাবনার পরিমাণ) উপরই নির্ভর করে না, বরং সম্ভাব্যতার (probable) পরিমাণও বিবেচনা করতে হয়উদাহরণতঃ যদি কোন একটি ব্যবসায় লাভের সম্ভাবনা ৫% এবং অপর একটিতে সম্ভাবনা ১০% হয়; কিন্তু যদি প্রথম ব্যবসায় সম্ভাব্য লাভের পরিমাণ ১০০০ টাকা এবং দ্বিতীয় ব্যবসায় সম্ভাব্য লাভের পরিমাণ ১০০ টাকা হয়, তবে প্রথম ব্যবসাটি দ্বিতীয় ব্যবসার উপর পাঁচগুণ বেশী গুরুত্ব পাবে, যদিও প্রথম ব্যবসায় সম্ভাবনার পরিমাণ ৫% ছিল যা দ্বিতীয় ব্যবসার সম্ভাবনার (১০%) অর্ধেক
যেহেতু দ্বীনের অনুসন্ধানে সম্ভাব্য লাভের পরিমাণ অসীম, সুতরাং চুড়ান্ত ফল লাভের সম্ভাবনা যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন তার সম্পর্কে অনুসন্ধান প্রচেষ্টার গুরুত্ব অন্য যে কোন বিষয়ের চেয়ে বেশীকারণ, ঐগুলোর ফল সীমাবদ্ধ
অতএব, একমাত্র তখনই দ্বীন সম্পর্কে অনুসন্ধান থেকে বিরত থাকা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে, যখন মানুষ দ্বীনের অসারতা সম্পর্কে অথবা দ্বীন সম্পর্কিত বিষয়সমূহ সমাধানযোগ্য নয় বলে নিশ্চিত হবেকিন্তু এ ধরণের নিশ্চয়তা কোথা হতে অর্জিত হবে?

প্রকৃত মানুষ হওয়ার শর্তঃ
ভূমিকাঃ
ইতিপূর্বে আমরা দ্বীনের অনুসন্ধানের গুরুত্ব এবং সত্য ধর্মকে চেনার জন্যে প্রচেষ্টা করার প্রয়োজনীয়তাকে সরল বর্ণনার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেছি, যা লাভবান হওয়ার ফিতরাতগত বা সহজাতগত চাহিদা এবং ক্ষতি থেকে দূরে থাকার প্রবণতার উপর নির্ভরশীল ছিল৷ এ প্রবণতা প্রত্যেকেরই আভ্যন্তরে বিদ্যমান এবং পারিভাষিক অর্থে, নির্ভূল প্রত্যক্ষ জ্ঞান সম্বলিত৷
উল্লিখিত প্রমাণটির কৌশলগত প্রক্রিয়াঃ যদি লাভবান হওয়ার ও সমূহ ক্ষতি থেকে বেঁচে থাকার প্রবণতা মানুষের ফিতরাতগত বা সহজাতগত চাহিদা হয়ে থাকে, তবে যে দ্বীন অফুরন্ত লাভের এবং অসীম ক্ষতি থেকে রক্ষার নিশ্চয়তা দেয়ার দাবিদার, সে দ্বীন সম্পর্কে গবেষণা করা অপরিহার্য (অনিবার্যতা হল কিয়াসের ভিত্তিতে কার্যেও অসম্পূর্ণ কারণ)৷ কিন্তু লাভবান হওয়ার এবং ক্ষতি থেকে নিরাপদে থাকার প্রবণতা মানুষের ফিতরাতগত বা সহজাতগত চাহিদা৷ অতএব, এহেন দ্বীন সম্পর্কে গবেষণা করা অপরিহার্য৷
এ প্রমাণটি ব্যতিক্রমী যুক্তি পদ্ধতিতে বর্ণনা করা হয়েছে, বিশেষ যৌক্তিক বিচার-বিশ্লেষণের উপর নির্ভরশীল৷ আর এ বিশেষ যৌক্তিক বিশ্লেষণ হল, বুদ্ধিবৃত্তিক কার্যকরী বিধি-বিধান এবং তাদের মূল, কিয়াসের ভিত্তিতে অপরিহার্যতা বা কার্যের (কাঙ্খিত ফল) কারণ (ঐচ্ছিক কর্ম) সম্পর্কিত৷
আমাদের বিষয়বস্তুর আলোচনার ব্যবহৃত প্রমাণটিকেও এরূপে বর্ণনা করা যেতে পারেঃ যদি মানবীয় উৎ‍কর্ষে পৌঁছা মানুষের সহজাতগত চাহিদা হয়ে থাকে, তবে যে বিশ্বদৃষ্টি মানুষের আত্মিক বিকাশের জন্যে প্রয়োজনীয় শর্ত, তার মূলনীতি শনাক্তকরণ অপরিহার্য৷ কিন্তু উৎকর্ষ সাধন সহজাতগত চাহিদার অন্তর্ভূক্ত৷ অতএব, উল্লেখিত মূলনীতির শনাক্তকরণ অপরিহার্য
এখন আমরা ঐ বিষয়টিকে অন্যভাবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করব৷ তবে এ প্রমাণটি যথার্থ ভূমিকাসমূহের উপর নির্ভরশীল৷ ঐ ভূমিকাসমূহের অবশেষ হল এরূপঃ
যদি কেউ দ্বীন সম্পর্কে না ভাবে এবং সঠিক বিশ্বদৃষ্টি ও মতাদর্শের প্রতি বিশ্বাস পোষণ না করে তবে মানবিক উৎ‍কর্ষে পৌঁছাতে পারবে না৷ এমনকি তাকে মূলতঃ প্রকৃত মানুষরূপেও মনে করা যাবে না৷ অর্থাৎ প্রকৃত মানুষ হওয়ার শর্ত হল সঠিক বিশ্বদৃষ্টি এবং মতাদর্শের অনুসারী হওয়া৷
এ প্রমাণটি তিনটি ভূমিকার উপর নির্ভরশীল৷ যথাঃ
ক) মানুষ, এমন এক অস্তিত্ব, যে উৎকর্ষে পৌঁছতে চায়৷
খ) মানুষের উৎকর্ষ বুদ্ধিবৃত্তি নির্ভর ঐচ্ছিক আচার-ব্যবহারের মাধ্যমে অর্জিত হয়ে থাকে৷
গ) বুদ্ধিবৃত্তি নির্ভর কার্যকরী বিধি-বিধান বিশেষ তাত্ত্বিক পরিচিতির আলোকে রূপ লাভ করে৷ এগুলোর মধ্যে বিশ্বদৃষ্টির মূলনীতিত্রয় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ৷ অর্থাৎ অস্তিত্বের উত্‍স, জীবনের পরিণতি (পুনরুত্থান) এবং কল্যাণকামী কর্মসূচী লাভের জন্যে অনুমোদিত পথের (নবুয়্যত) শনাক্তকরণ৷ অর্থাৎ অস্তিত্ব পরিচিতি, মানব পরিচিতি, পথ পরিচিতি৷

এখন আমরা উপরোক্ত ভূমিকাত্রয়ের প্রত্যেকটি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব৷
মানুষ, উৎকর্ষ সাধনে ইচ্ছুকঃ
যে কেউ তার আভ্যন্তরীণ ও আত্মিক প্রবণতাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবে, সে দেখতে পাবে যে, এগুলোর অধিকাংশের মূলে রয়েছে উৎকর্ষ সাধন৷ প্রকৃতপক্ষে কেউই পছন্দ করে না যে, তার অস্তিত্বে কোন প্রকার ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকুক৷ আর তাই সে নিজ থেকে সকল প্রকার স্বল্পতা, অপূর্ণতা ও ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করে কাঙ্খিত উৎকর্ষে পৌঁছাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করে এবং ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত অন্যের কাছ থেকে তা গোপন করে রাখে৷
মানুষের এ প্রবণতা যখন আপন সহজাতের পথে পরিচালিত হয় তখন তা তার সকল প্রকার বস্তুগত ও আত্মিক বিকাশের কারণ রূপে প্রতীয়মান হয়৷ আর যদি কোন কারণে বা অবস্থার প্রেক্ষিতে মানুষের এ প্রবণতা বিচ্যুতির পথে পতিত হয় তবে তা অহংকার, অপরের তুলনায় নিজেকে বড় করে রাখা, প্রসংশাপাগল ইত্যাদি কুবৈশিষ্ট্যসমূহ প্রকাশের কারণে পরিণত হয়৷
যা হোক, উৎকর্ষ সাধনেচ্ছা হল মানব আত্মার গহীনে অবস্থিত এক শক্তিশালী ফিতরাতগত (সহজাতগত) কারণ৷ অধিকাংশ সময়ই এর বা এর শাখাসমূহের স্বরূপ সচেতনভাবে বিবেচ্য হয়ে থাকে৷ কিন্তু কিঞ্চিৎ চিন্তা করলেই স্পষ্টতঃই প্রতীয়মান হবে যে, এদের সকলেরই মূলে রয়েছে উৎকর্ষ অনুসন্ধিত্‍সা৷

বৃক্ষরাজির পূর্ণতা লাভ, পারিপার্শিক অবস্থা ও বাহ্যিক কারণের উপর নির্ভরশীল এবং অপরিহার্যরূপে ঘটে থাকে৷ কোন উদ্ভিদই স্বাধীনভাবে বিকশিত হতে পারে না এবং আপন ইচ্ছানুযায়ী ফল দিতে পারে না৷ কারণ তারা জ্ঞান ও প্রত্যয়ের অধিকারী নয়৷
প্রাণীদের পূর্ণতা লাভের ক্ষেত্রে প্রত্যয় ও পছন্দের কিছুটা স্থান রয়েছে৷ তবে এ প্রত্যয় প্রাণীর সীমাবদ্ধ পারিপার্শিক চাহিদা ও অন্ধ সহজাত প্রবৃত্তির উপর নির্ভরশীল এবং প্রত্যেক প্রাণীরই ইন্দ্রিয়ানুভূতি অনুযায়ী স্বল্প বোধশক্তির আলোকে তা পরিগ্রহ করে থাকে৷
কিন্তু মানুষ উদ্ভিজ্জ ও প্রাণীজ বৈশিষ্ট্য ছাড়াও দুটি স্বতন্ত্র আত্মিক বিশেষত্বের অধিকারী৷ অর্থাত্‍ একদিকে মানুষের সহজাতগত চাহিদা শুধুমাত্র পারিপার্শিক আস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, অপরদিকে তা মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তির উপর নির্ভরশীল৷ মানুষ তার বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তিকে ব্যবহার করে আপন জ্ঞানের পরিধিকে অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত করতে পারে৷ আর এ স্বতন্ত্র আত্মিক বিশেষত্বের উপর ভিত্তি করে মানুষের প্রত্যয় সীমাবদ্ধ প্রাকৃতিক সীমানাকে ছাড়িয়ে অসীমে পৌঁছে যেতে পারে৷
যেমনি করে উদ্ভিদের বিশেষ উদ্ভিজ্জ শক্তির মাধ্যমে তার বিশেষ উত্‍কর্ষ সাধিত হয়; যেমনি করে প্রাণিজ উত্‍কর্ষ তার স্বভাবজাত প্রত্যয় এবং ইন্দ্রিয়ানুভূতির আশ্রয়ে ঘটে থাকে; তেমনি মানুষের বিশেষ মানবীয় উত্‍কর্ষ যা প্রকৃতপক্ষে তার আত্মিক বিকাশ, তাও তার সচেতন প্রত্যয়ের আশ্রয়ে এবং বুদ্ধিবৃত্তির আলোকে অর্জিত হয়ে থাকে৷ আর মানুষের এ বুদ্ধিবৃত্তি মানুষের চাহিদার বিভিন্ন স্তরকে শনাক্ত করতে পারে এবং একাধিক চাহিদার সমাহারে, সর্বোত্‍কৃষ্টকে প্রাধান্য দিতে পারে৷ অতএব, আচার-আচরণ, মানবীয় হওয়ার অর্থ হল, মানবীয় বিশেষ ঐচ্ছিক প্রত্যয়ের ভিত্তিতে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক দিক নির্দেশনায় কার্যকর হওয়া৷ আর মানুষের যে সকল আচরণ পাশবিক প্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে সম্পাদিত হয়, সে সকল আচরণ পাশবিক আচরণরূপে পরিগণিত হয়৷ যেমনঃ গতিশক্তির প্রভাবে মানুষের শরীরে যে গতির সঞ্চার হয়, তা শারীরিক শক্তিরূপে বহিঃপ্রকাশ লাভ করে থাকে৷
বৃদ্ধিবৃত্তিক প্রসূত বিধি-বিধান তাত্ত্বিক ভিত্তির উপর নির্ভরশীলঃ
ঐচ্ছিক কর্ম হল, কাঙ্খিত ফলে উপনীত হওয়ার জন্য একটি মাধ্যম৷ আর তার ঐচ্ছিক মূল্যমান বিবেচিত উদ্দেশ্যের কাম্যতার মর্যাদা এবং আত্মিক উত্‍কর্ষের ক্ষেত্রে প্রভাবের মাত্রার অনুগামী৷ অনুরূপ যদি কোন কর্ম আত্মিক উত্‍কর্ষহীনতার কারণ হয়, তবে ঐ কর্মের মূল্যমান হবে নেতিবাচক৷
অতএব, বু্দ্ধিবৃত্তি কেবলমাত্র তখনই ঐচ্ছিক কর্ম সম্পর্কে বিচার ও তার মূল্যমান নির্ধারণ করতে পারবে যখন মানুষের উত্‍কর্ষ ও এর বিভিন্ন স্তর সম্পর্কে অবগত থাকবে৷ অর্থাত্‍ যখন জানবে যে, মানুষ কীরূপ অস্তিত্ব? তার জীবন-পরিধির বিস্তৃত কতটুকু? সে উত্‍কর্ষের কোন স্তরে পৌঁছতে সক্ষম? জানবে যে, মানুষের অস্তিত্বের স্বরূপ কী এবং তার সৃষ্টির পিছনে কী উদ্দেশ্য বিদ্যমান?
অতএব, সঠিক মতাদর্শের (অর্থাত্‍ ঐ মূল্যমান ব্যবস্থা যা ঐচ্ছিক কর্মসমূহের মূল্যমান নির্ধারণ করে থাকে) অনুসরণ সঠিক বিশ্বদৃষ্টি ও তার বিভিন্ন বিষয়ের সমাধানের উপর নির্ভর করে৷ আর যতক্ষণ পর্যন্ত এ বিষয়গুলো (অর্থাত্‍ সঠিক বিশ্বদৃষ্টির বিষয়সমূহ) সমাধান না করতে পারবে, ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষের আচার-আচরণের মূল্যমান নির্ধারণের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারবে না৷ যেমনঃ গন্তব্য জ্ঞাত না হওয়া পর্যন্ত তার জন্যে কোন পথ নির্ধারণ করাও অসম্ভব৷
অতএব, তাত্ত্বিক পরিচিতিসমূহ যেগুলো বিশ্বদৃষ্টির মৌলিক বিষয়সমূহকে রূপায়িত করে থাকে, প্রকৃতপক্ষে সেগুলো, মূল্যমান ব্যবস্থা ও বুদ্ধিবৃত্তি প্রসূত বিধি-বিধানের ভিত্তিরূপে পরিগণিত৷
উপসংহারঃ
এখন আমরা উপরোক্ত আলোচনার আলোকে দ্বীনের অনুসন্ধানের এবং সঠিক বিশ্বদৃষ্টি ও মতাদর্শকে খুঁজে বের করার জন্যে, প্রচেষ্টার গুরুত্বকে নিম্নরূপে প্রতিষ্ঠা করতে পারিঃ

মানুষ ফিতরাতগতভাবেই স্বীয় উৎকর্ষ পিয়াসূ এবং নিজ কর্মের মাধ্যমে প্রকৃত উৎকর্ষে পৌঁছতে ইচ্ছুককিন্ত যে কর্মগুলো তাকে কাঙ্খিত উদ্দেশ্যের নিকটবর্তী করবে, সেগুলো সম্পর্কে জানার জন্যে সর্বপ্রথমে তাকে আপন চূড়ান্ত উৎকর্ষকে চিনতে হবেআর এ চূড়ান্ত উৎকর্ষের পরিচিতি, আপন অস্তিত্বের স্বরূপ এবং তার শুরু ও শেষ সম্পর্কে জানার উপর নির্ভর করেঅনুরূপ, বিভিন্ন কর্মের মধ্যে ইতিবাচক ও নেতিবাচক সম্পর্ক ও উৎকর্ষের বিভিন্ন স্তরকে চিহ্নিত করতে হবে, যাতে স্বীয় মানবীয় উৎকর্ষ সাধনের জন্যে সঠিক পথকে বেছে নিতে পারেআর যতক্ষণ পর্যন্ত সে এ তাত্ত্বিক পরিচিতি (বিশ্বদৃষ্টির মূলনীতি) সম্পর্কে অবহিত না হবে ততক্ষণ পর্যন্ত সঠিক আচার ও রীতি ব্যবস্থাকে (মতাদর্শ) গ্রহণ করতে পারবে নাঅতএব, সত্যধর্মকে শনাক্ত করার প্রচেষ্টা অতি গুরুত্বপূর্ণ, যা সঠিক বিশ্বদৃষ্টি ও মতার্দশকেও সমন্বয় করে থাকে এবং এটি ব্যতিরেকে মানবীয় উৎকর্ষে পৌঁছা অসম্ভবঅনুরূপ যে সকল আচার-ব্যবহার উপরোল্লিখিত মূল্যবোধ ও লক্ষ্যের ভিত্তিতে সম্পূর্ণ না হয়, সে সকল আচার-ব্যবহার মানবীয় বলে পরিগণিত হতে পারে নাযারা সত্য ধর্মকে শনাক্তকরণের ব্যাপারে উদ্যোগী হতে চেষ্টা করেন না অথবা শনাক্তকরণের পরও আক্রোশ ও অবাধ্যতাবশতঃ অস্বীকার করার চেষ্টা করেন এবং শুধুমাত্র পাশবিক চাহিদা ও ক্ষণস্থায়ী বস্তুগত আকর্ষণেই তুষ্ট থাকেন, প্রকৃতপক্ষে তারা পশু বৈ কিছুই নন
যেমন পবিত্র কোরান এদের সমপর্কে বলেঃ
চতুষ্পদ প্রাণীর মত ভোগ ও ভক্ষণ করে (সুরা মুহাম্মদ (সঃ) – ১২)। “
যেহেতু এ ধরনের ব্যক্তিরা আপন মানবীয় যোগ্যতাসমূহের বিনাশ ঘটিয়ে থাকে, সেহেতু তারা যথোপযুক্ত কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হবে পবিত্র কোরানের ভাষায়ঃ
তাদের ভোগ ও ভক্ষণ করতে দাও এবং পার্থিব যত স্বাধ-আকাঙ্খা পূরণ করতে দাও, অচিরেই তারা (এর পরিণাম ) দেখতে পাবে (সুরা হিজর-৩ )

বিশ্বদৃষ্টি মৌলিক সমস্যাসমূহের সমাধান
ভূমিকাঃ
যখনই মানুষ বিশ্বদৃষ্টির মৌলিক সমস্যাগুলোর সমাধান এবং সত্য ধর্মের মূলনীতির পরিচিতি সম্পর্কে জানতে চাইবে, প্রথমেই এ প্রশ্নের সম্মুখীন হবে যে, কোন্ পথে এ বিষয়গুলোর সমাধান করতে হবে এবং কিরূপে সঠিক মৌলিক পরিচিতি সম্পর্কে জানা যেতে পারে? মূলতঃ পরিচিতির জন্যে কী কী উপায় বিদ্যমান? এদের কোনটিকে পরিচিতিসমূহ সম্পর্কে অবগত হওয়ার জন্যে নির্বাচন করতে হবে ?
এ বিষয়টির কৌশলগত ও পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা ও পর্যালোচনার দায়িত্ব দর্শনের পরিচিতি বিজ্ঞান (Epistemology) বিভাগেরদর্শনের ঐ বিভাগে মানুষের বিভিন্ন পরিচিতি সম্পর্কে আলোচনা করতঃ এদের মূল্যমান নির্ধারণ করা হয়ে থাকেএদের সবগুলো সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে আমরা আমাদের লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যাবসুতরাং আমাদের আলোচনাসংশ্লিষ্ট যে বিষয়গুলো প্রয়োজনীয়, শুধুমাত্র সেগুলোর উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হবতবে ঐ বিষয়গুলো সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা ও পর্যলোচনা যথাস্থানে করা হবে
পরিচিতির প্রকারভেদঃ
পরিচিতিসমূহকে এক দৃষ্টিকোণ থেকে চার ভাগে বিভক্ত করা যায়ঃ
অভিজ্ঞতালব্ধ ও বৈজ্ঞানিক পরিচিতি (বিশেষ পারিভাষিক অর্থে)ঃ এধরনের পরিচিতি ইন্দ্রিয়ানুভূতির সাহায্যে লাভ করা যায়তবে বুদ্ধিবৃত্তি ও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বোধসমূহের বিমূর্তন (Abstraction) এবং সম্প্রসারণের (Generalization) ক্ষেত্রে স্বীয় ভূমিকা পালন করে থাকেঅভিজ্ঞতালব্ধ ও বৈজ্ঞানিক পরিচিতি বৈজ্ঞানিক বিষয়সমূহে যেমনঃ পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ণ বিজ্ঞান এবং জীব বিজ্ঞানে ব্যবহৃত হয়ে থাকে
বুদ্ধিবৃত্তিক পরিচিতিঃ এধরনের পরিচিতি নির্বস্তুক ধারণার মাধ্যমে রূপ
পরিগ্রহ করে এবং এ পরিচিতিতে বুদ্ধিবৃত্তি মূল ভূমিকা পালন করে থাকেতবে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও পরীক্ষালব্ধ কোন কোন বিষয়, ধারণা লাভের উৎস অথবা যুক্তিপদ্ধতির কোন কোন প্রতিজ্ঞারূপে ব্যবহৃত হতে পারেযুক্তিবিদ্যা, দর্শনশাস্ত্র ও গণিতশাস্ত্র, পরিচিতির অন্তর্ভুক্ত
ধর্মবিশ্বাসগত পরিচিতিঃ এধরনের পরিচিতি দ্বিস্তর বিশিষ্টবিশ্বস্ত উৎসের পূর্ব পরিচিতির ভিত্তিতে এবং বিশ্বস্ত বর্ণনাকারীর বর্ণনা থেকে এধরনের পরিচিতি অর্জিত হয়ে থাকেযে সকল বিষয়সমূহ সকল ধর্মের অনুসারীগণ ধর্মীয় নেতাগণের বক্তব্যের ভিত্তিতে গ্রহণ করে থাকেন, সে সকল বিষয়সমূহ এ পরিচিতির অন্তর্ভুক্তকখনো কখনো এধরনের বিষয়বস্তর বিশ্বস্ততা, ইন্দ্রিয় ও পরীক্ষালব্ধ বিষয় বস্ত অপেক্ষা অধিকতর
প্রত্যক্ষ অনুভূতিভিত্তিক পরিচিতিঃ এধরনের পরিচিতি পূর্ববর্তী সকল পরিচিতির ব্যতিক্রম এবং কোন প্রকার মস্তিষ্ক প্রসূত অনুধাবন ও আকৃতির মাধ্যম ব্যতীত অবিকল জ্ঞেয় সত্তার সাথেও সম্বন্ধ স্থাপন করে থাকেএধরনের পরিচিতিতে কোন প্রকার ভুল-ত্রুটির স্থান নেইতবে প্রত্যক্ষ অনুভূতিভিত্তিক ও আধ্যাত্মিকতা ভিত্তিক পরিচিতি বলে যা সাধারণতঃ বর্ণিত হয়ে থাকে, প্রকৃতপক্ষে তা হল এধরনের পরিচিতির মস্তিষ্কে অংকিত ব্যাখ্যারূপ যা ভুল-ত্রুটি বর্জিত নয়
বিশ্বদৃষ্টির প্রকারভেদঃ
ইতিপূর্বে পরিচিতির যে শ্রেণী বিভাগ করা হয়েছে, তার ভিত্তিতে বিশ্বদৃষ্টিকে নিম্নরূপে বিভক্ত করা যেতে পারেঃ
বৈজ্ঞানিক বিশ্বদৃষ্টিঃ অর্থাৎ মানুষ অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের ভিত্তিতে সামগ্রিকভাবে অস্তিত্ব সম্পর্কে অবগত হয়
দার্শনিক বিশ্বদৃষ্টিঃ যা যুক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে অর্জিত হয়ে থাকে
ধর্মীয় বিশ্বদৃষ্টিঃ যা ধর্মীয় নেতাগণের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন ও তাদের বক্তব্যকে গ্রহণের মাধ্যমে অর্জিত হয়ে থাকে
এরফানী বা আধ্যাত্মিক বিশ্বদৃষ্টিঃ যা উদ্ভাবন, অন্তর্জ্ঞান ও এশরাক্বীয় পথে অর্জিত হয়ে থাকে
এখন, দেখতে হবে যে, বিশ্বদৃষ্টির মৌলিক বিষয়গুলোকে কি সত্যিকার অর্থে উল্লিখিত চার উপায়ে সমাধান করা সম্ভব? অতঃপর দেখতে হবে, এদের কোন একটির বিশেষত্ব ও অগ্রাধিকারের প্রশ্ন বিবেচনার পালা আসে কিনা ?

সমালোচনা ও ত্রুটি নিদের্শঃ
ইন্দ্রিয় ও অভিজ্ঞতালব্ধ পরিচিতি বস্তুগত ও প্রাকৃতিক বিষয়বস্তুর সীমানায় কার্যকরফলে স্পষ্টতঃই প্রতীয়মান হয় যে, শুধুমাত্র অভিজ্ঞতার মাধ্যমে অর্জিত বিষয়বস্তুর আলোকে বিশ্বদৃষ্টির মূলনীতিসমূহ ও তৎসংক্রান্ত বিষয়াদির শনাক্তকরণ সম্ভব নয়কারণ, এধরনের বিষয়গুলো অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের সীমাবহির্ভূত এবং কোন অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানই এ বিষয়গুলোর সম্পর্কে ইতিবাচক বা নেতিবাচক মন্তব্য করতে পারে নাযেমনঃ খোদার অস্তিত্বকে পরীক্ষাগারে পরীক্ষার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা বা বর্জন (আল্লাহ আমাদেরকে এ থেকে রক্ষা করুন) করা অসম্ভবকারণ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতার হস্ত এত ক্ষুদ্র যে, অতিপ্রকৃতির আঁচলকে ষ্পর্শ করতে অপারগ এবং আপন বস্তুগত বিষয়ের সীমাবহির্ভূত কোন কিছুকে প্রতিষ্ঠা বা বর্জন করতে অক্ষম
অতএব, অভিজ্ঞতালব্ধ ও বৈজ্ঞানিক বিশ্বদৃষ্টি (পারিভাষিক অর্থে বিশ্বদৃষ্টি, যা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে) মরীচিকা বৈ কিছুই নয়সুতরাং প্রকৃত অর্থে একে বিশ্বদৃষ্টি নামকরণ করা যায় না
তবে সর্বোপরি একে বস্তুজগত পরিচিতি বলা যেতে পারেএছাড়া এধরনের পরিচিতি বিশ্বদৃষ্টির মৌলিক প্রশ্নসমূহের জবাবদানেও অক্ষম
কিন্তু যে সকল পরিচিতি ধর্মবিশ্বাসের মাধ্যমে অর্জিত হয় (যেমনটি ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে) সেগুলো দ্বি-স্তর বিশিষ্ট এবং পূর্বেই ঐগুলোর উৎস বা উৎসসমুহের উপর আস্থা স্থাপন করতে হয়অর্থাৎ প্রথমে কারো নবুওয়াত প্রাপ্তি সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে; অতঃপর তার বাণী বৈধ বলে পরিগণিত হবেতবে সর্বাগ্রে বাণী প্রেরক অর্থাৎ মহান আল্লাহর অস্তিত্বকে প্রমাণ করতে হবে আর এটা সুস্পষ্ট যে, বাণী প্রেরকের মূল অস্তিত্ব এবং তদনুরূপ বাণী বাহকের নবুওয়াতকে বানী নির্ভর দলিলের মাধ্যমে প্রমাণ করা যায় নাযেমনঃ বলা যাবে না যে, যেহেতু কোরআন বলে আল্লাহ আছেন সেহেতু তাঁর অস্তিত্ব প্রমাণিত হলতবে আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণিত হওয়ার পর এবং ইসলামের নবীর শনাক্তকরণ ও কোরআনের সত্যতা প্রমাণিত হওয়ার পর, অন্যান্য গৌণ বিশ্বাসসমূহকে প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারেঅনুরূপভাবে কার্যকরী বিধি-নিষেধ সমূহও বিশ্বস্ত সংবাদদাতা ও বিশ্বস্তসূ্ত্রের মাধ্যমে গৃহীত হতে পারেকিন্তু মৌলিক বিশ্বাসমূহকে তৎপূর্বে অন্য কোন উপায়ে সমাধান করতে হবে
অতএব, ধর্মবিশ্বাসগত পরিচিতিও বিশ্বদৃষ্টির মৌলিক বিষয়সমূহের সমাধানে অক্ষমতবে এরফানী ও এশরাক্বী পদ্ধতির ব্যাপারে অনেক বক্তব্য রয়েছেঃ
প্রথমতঃ বিশ্বদৃষ্টি হল এক প্রকার পরিচিতি, যা মস্তিষ্কপ্রসূত ভাবার্থসমূহ থেকে রূপ
পরিগ্রহ করেকিন্তু অন্তর্জ্ঞানের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কপ্রসূত বোধদ্বয়ের কোন স্থান নেইঅতএব এধরনের ভাবার্থসমূহকে অন্তর্জ্ঞানের বরাত দেয়া উদাসীনতা ও এর নামান্তর বৈ কিছুই নয়
দ্বিতীয়তঃ অন্তর্জ্ঞানের ব্যাখ্যা এবং ভাষা ও ভাবার্থের কলেবরে তাদের বর্ণনা বিশেষ মানস-দক্ষতার উপর নির্ভরশীল, যা সুদীর্ঘ সময়ের বুদ্ধিবৃত্তিক অভিজ্ঞতা এবং দার্শনিক বিশ্লেষণ ব্যতিরেকে অসম্ভবযারা এধরনের অভিজ্ঞতার অধিকারী নন প্রকৃতপক্ষে তারা সদৃশ শব্দ ও ভাবার্থকে ব্যবহার করে থাকেন যা বিচ্যুতি ও বিপথগামিতার এক বৃহত্তর কারণ
তৃতীয়তঃ প্রকৃতপক্ষে যা অন্তর্জ্ঞানের মাধ্যমে উদ্ভাবিত হয়, তা মস্তিষ্কে অংকিত তার কল্পিত চিত্র ও বর্ণনা এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা এমনকি স্বয়ং অন্তর্জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তির জন্যেও ত্রুটিযুক্ত হয়ে থাকে
চতুর্থতঃ ঐ সকল বাস্তবতা, যাদের মস্তিষ্কপ্রসূত ব্যাখ্যা বিশ্বদৃষ্টি বলে পরিচিত; তাতে উপনীত হওয়ার জন্যে বর্ষপরমপরায় এরফানী সাধনার প্রয়োজনআর গভীর সাধনালব্ধ এ প্রক্রিয়ার (যা বাস্তব পরিচিতিসমূহের অন্তর্ভূক্ত) অনুমোদন, তাত্তিক ভিত্তি ও বিশ্বদৃষ্টির মৌলিক বিষয়সমূহের উপর নির্ভরশীলঅতএব, সাধনার প্রারম্ভেই এ বিষয়গুলোর সমাধান অনিবার্য আর এ প্রক্রিয়ার শেষ পর্যায়ে অন্তর্জ্ঞানগত পরিচিতি অর্জিত হয়ে থাকেমূলতঃ প্রকৃত এরফান তার জন্যেই প্রযোজ্য, যিনি মহান সৃষ্টিকর্তার দাসত্বের পথে বিনীতভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে পারেনআর এধরনের প্রচেষ্টা প্রভুর পরিচিতি, তাঁর দাসত্ব ও আনুগত্যের উপর নির্ভরশীল
সিদ্ধান্তঃ
উপরোক্ত আলোচনা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, বিশ্বদৃষ্টির মৌলিক
বিষয়সমূহের সমাধান যারা খুঁজে থাকেন তাদের জন্যে একমাত্র উন্মুক্ত পথ হল বুদ্ধিবৃত্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক উপলব্ধির পথফলে এর আলোকে বলতে হয়, দার্শনিক বিশ্বদৃষ্টিই হল প্রকৃত বিশ্বদৃষ্টি
তবে মনে রাখা উচিৎ যে, উল্লিখিত বিষয়সমূহের সমাধানকে বুদ্ধিবৃত্তিক পথে সীমাবদ্ধকরণ ও দার্শনিক বিশ্বদৃষ্টিকেই একমাত্র বিশ্বদৃষ্টিরূপে পরিগণনের অর্থ এ নয় যে, সঠিক বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি লাভের জন্যে সকল দার্শনিক বিষয়েরই সমাধান করতে হবেবরং কয়েকটি সরল দার্শনিক বিষয় যেগুলো প্রায় স্বতঃসিদ্ধ সেগুলোর সমাধানই আল্লাহর অস্তিত্ব (যা বিশ্বদৃষ্টির মৌলিকতম বিষয় বলে পরিগণিত) প্রমাণের জন্যে যথেষ্টতবে এ ধরনের বিষয়সমূহের উপর পারদর্শিতা এবং সকল প্রকার সমস্যা ও দ্বিধার উত্তরদানের ক্ষমতা অর্জনের জন্যে অধিকতর দার্শনিক পর্যালোচনার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে
আবার মৌলিক সমস্যাসমূহ সমাধানের জন্যে অর্থপূর্ণ পরিচিতিকে বুদ্ধিবৃত্তিক পরিচিতিতে সীমাবদ্ধকরণের অর্থ এ নয় যে, অন্যান্য জ্ঞাত বিষয়সমূহ, এ বিষয়গুলোর সমাধানের ব্যাপারে ব্যবহৃত হবে নাবরং অধিকাংশ বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তির ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ জ্ঞান, ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকে প্রতিজ্ঞারূপে প্রয়োগ করা যেতে পারেযেমনঃ দ্বিতীয় পর্যায়ের বিষয়সমূহ ও গৌণ বিশ্বাসগত বিষয়সমূহের সমাধানের ক্ষেত্রে ধর্মবিশ্বাসগত পরিচিতিকে ব্যবহার করা যেতে পারে এবং এগুলোকে কিতাব ও সুন্নতের (দ্বীনের বিশ্বস্ত উৎস) বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে প্রমাণ করা যেতে পারে
পরিশেষে, সঠিক বিশ্বদৃষ্টি ও মতাদর্শে উপনীত হওয়ার পর গভীর আধ্যাত্মিক সাধনার
পর্যায়সমূহ অতিক্রম করতঃ উদঘাটন ও পর্যবেক্ষণের (অন্তর্চক্ষু) স্তরে পৌঁছা যায় এবং বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণিত এমন অধিকাংশ বিষয় সম্পর্কে, মস্তিষ্কগত ভাবার্থসমূহের সাহায্য ব্যতীতই অবগত হওয়া সম্ভব

আল্লাহ পরিচিতি
ভূমিকাঃ
ইতিপূর্বে আমরা জেনেছি যে, দ্বীনের মূলনীতিগুলো বিশ্ব-সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বে বিশ্বাস থেকে রূপ পরিগ্রহ করে এবং ঐশ্বরিক বিশ্বদৃষ্টি ও বস্তুবাদী বিশ্বদৃষ্টির মধ্যে মূল পার্থক্যও এ বিশ্বাসের (সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব) উপস্থিতি ও অনুপস্থিতির উপর নির্ভর করে
অতএব, সত্যানুসন্ধিৎসু ব্যক্তির জন্যে সর্বপ্রথমেই যে প্রশ্নটি উপস্থাপিত হয় এবং সর্বাগ্রেই যার সঠিক উত্তর জানতে হয় তা হল, আল্লাহর অস্তিত্ব আছে কিনা? আর এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্যে (যা পূর্ববর্তী পাঠে আলোচিত হয়েছে) বুদ্ধিবৃত্তিকে প্রয়োগ করতে হবে, যাতে করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায়-চাই তার ফল হোক ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক
যদি এ অনুসন্ধানের ফল ইতিবাচক হয়, তবে আল্লাহ সংক্রান্ত গৌণ বিষয়গুলোকে (একত্ব, ন্যায়বিচার এবং আল্লাহর অন্যান্য বৈশিষ্ট্য) বিবেচনার পালা আসে অনুরূপভাবে যদি অনুসন্ধানের ফল নেতিবাচক হয় তবে বস্তুবাদী বিশ্বদৃষ্টি প্রতিষ্ঠিত হবেআর তখন দ্বীন সংশ্লিষ্ট অন্যান্য গৌণ বিষয়গুলোকে বিবেচনা করার প্রয়োজনীয়তা থাকবে না
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পরিচিতিঃ
মহান আল্লাহ সম্পর্কে দুধরনের পরিচিতির ধারণা পাওয়া যায়ঃ একটি হল প্রত্যক্ষ পরিচিতি এবং অপরটি হল পরোক্ষ পরিচিতি
আল্লাহর প্রত্যক্ষ পরিচিতি বলতে বুঝায়-মানুষ মস্তিষ্কগত ভাবার্থের সাহায্য ব্যতিরেকেই এক ধরনের অন্তর্জ্ঞান ও আভ্যন্তরীণ অনুভূতির মাধ্যমে আল্লাহর সাথে পরিচিত হয়
এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, যদি কেহ আল্লাহ সম্পর্কে সচেতন অন্তর্জ্ঞানের অধিকারী হয়ে থাকে (যেরূপ অনেক উচ্চপর্যায়ের আরেফগণ (আধ্যাত্মিক ব্যক্তিগণ) দাবী করে থাকেন তবে বুদ্ধিবৃত্তিক কোন যুক্তি-প্রমাণের প্রয়োজন হয় নাকিন্তু (যেমনটি ইতিপূর্বে উল্লিখিত হয়েছে ) এধরনের প্রত্যক্ষজ্ঞান ও অন্তর্জ্ঞান সাধারণ কোন ব্যক্তির (তবে ব্যতিক্রম কোন ব্যক্তি যিনি সচেতন অন্তর্জ্ঞানের অধিকারী, তাকে অস্বীকার করা যায় না যেমনঃ পবিত্র নবীগণ (আঃ) ও ইমামগনের (আঃ) সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাস যে, শৈশবেও এ ধরনের অন্তর্জ্ঞানের অধিকারী ছিলেনএমনকি তাঁদের কেউ কেউ মাতৃগর্ভেও এ ধরনের পরিচিতির অধিকারী ছিলেন) জন্যে কেবলমাত্র তখনই সম্ভব, যখন সে আত্মগঠন ও আধ্যাত্বিক সাধনার পর্যায়গুলো অতিক্রম করবেতবে এর দুর্বল পর্যায় সাধারণ মানুষের মধ্যে উপস্থিত থাকলেও যেহেতু সচেতন অবস্থায় নেই, সেহেতু তা সচেতন বিশ্বদৃষ্টি সম্পর্কে ধারণা লাভের জন্যে যথেষ্ট নয়
পরোক্ষপ পরিচিতি বলতে বুঝায় যে, মানুষ সামগ্রিক ভাবার্থের (সৃষ্টিকর্তা, অমুখাপেক্ষী,
সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞা) মাধ্যমে মহান আল্লাহ সম্পর্কে মস্তিষ্কগত পরিচিতি ও এধরনেরঅদৃশ্যগতঅর্থ অনুধাবন করে থাকেআর এভাবে সে বিশ্বাস করে যে, এধরণের অস্তিত্ব বিদ্যমান (যিনি এ জগৎকে সৃষ্টি করেছেন )অতঃপর, অন্যান্য পরোক্ষ পরিচিতি এর সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে বিশ্বদৃষ্টির সাথে সংগতিপূর্ণ একশ্রেণীর বিশ্বাস প্রবর্তিত হয়ে থাকেযা সরাসরি বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যবেক্ষণ ও দার্শনিক যুক্তি-প্রমাণের মাধ্যমে অর্জিত হয় তা-ই হল পরোক্ষ পরিচিতিকিন্তু যখন এধরণের পরিচিতি অর্জিত হয় কেবলমাত্র তখনই মানুষের জন্যে সাবগতিক প্রত্যক্ষ পরিচিতি অর্জিত হয়ে থাকে
ফিতরাতগত পরিচিতিঃ
ধর্মীয় নেতাগণ, আরেফগণ এবং মনীষীগণের অধিকাংশ বক্তব্যেই আমরা খুঁজে পাই যে, আল্লাহ পরিচিতি ফিতরাতগত, অর্থাৎ মানুষ ফিতরাতগতভাবেই আল্লাহকে চিনে থাকেসুতরাং উপরোক্ত বিবরণসমূহের সঠিক অর্থ খুঁজে পাওয়ার নিমিত্তেফিতরাতশব্দটির ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন মনে করি
ফিতরাত, একটি আরবী শব্দ যার অর্থ হলসৃষ্টি প্রকরণএবং কোন বিষয় ফিতরাত
সংশ্লিষ্ট (ফিতরাতের সাথে সম্বন্ধযুক্ত) বলে পরিগণিত হবে তখনই , যখন বিদ্যমান সৃষ্টি এদেরকে ধারণ করবেসুতরাং এদের জন্যে তিনটি বিশেষত্ব বিবেচনা করা যেতে পারেঃ
প্রত্যেক শ্রেণীর ফিতরাগত বিশেষত্ব ঐ শ্রেণীর সকল সদস্যের মধ্যে পাওয়া যায়, যদিও তীব্রতা ও ক্ষীণতার দৃষ্টিকোণ থেকে এদের মাত্রাভেদ পরিলক্ষিত হয়
ফিতরাতগত বিষয়সমূহ তাদের ইতিহাস পরিক্রমায় সর্বদা স্থির এবং এমন নয় যে,
ইতিহাসের একাংশে সৃষ্টির ফিতরাত এক বিশেষত্ব বিশিষ্ট, আর অন্য অংশে অপর এক বিশেষত্ব বিশিষ্ট
ফিতরাতগত বিষয়সমূহ যে দৃষ্টিকোণে ফিতরাতসম্বন্ধীয় এবং সৃষ্টিপ্রকৃতি কর্তৃক ধারণকৃত সে দৃষ্টিকোণে শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা নেই, যদিও এদের দৃঢ়ীকরণ ও দিকনির্দেশনার ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে
মানুষের ফিতরাতগত বিশেষত্বকে দুশ্রেণীতে বিভক্ত করা যেতে পারেঃ
ক) ফিতরাতগত পরিচিতি, যার সাথে প্রত্যেক মানুষই কোন প্রকার শিক্ষা_দীক্ষা ব্যতিরেকেই পরিচিত হয়ে থাকে
খ) ফিতরাতগত প্রবণতা ও চাহিদা যা সৃষ্টির প্রত্যেক সদস্যের মধ্যেই বিদ্যমান
অতএব, যদি এমন এক ধরনের আল্লাহ পরিচিতি প্রত্যেকের মধ্যেই থেকে থাকে যে, প্রশিক্ষণ
ও আয়ত্তকরণের প্রয়োজন নেই তবে, তাকে “ফিতরাতগত আল্লাহ পরিচিতি” নামকরণ করা যেতে পারেআর যদি, আল্লাহর প্রতি এবং আল্লাহর উপাসনার প্রতি এক ধরনের প্রবণতা প্রত্যেক মানুষের মধ্যে থাকে, তবে তাকেআল্লাহর ফিতরাতগত উপাসনাবলা যেতে পারে
দ্বিতীয় পাঠে আমরা উল্লেখ করেছি যে, অধিকাংশ পন্ডিতগণ দ্বীন এবং আল্লাহর প্রতি মানুষের প্রবণতাকে মানুষের মানসিক বৈশিষ্ট্য বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং একেধর্মানুভূতিবাধর্মানুরাগনামকরণ করেছেনএখন আমরা সংযোজন করব যে, আল্লাহ পরিচিতিও মানুষের ফিতরাতগত চাহিদারূপে জ্ঞাত হয়েছেকিন্তু “আল্লাহর ফিতরাতগত উপাসনাযেমন সচেতন প্রবণতা নয় তেমনি “ফিতরাতগত আল্লাহ পরিচিতিও” সচেতন পরিচিতি নয় যে, কোন সাধারণ ব্যক্তিকে আল্লাহর
শনাক্তকরণের জন্যে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রচেষ্টা থেকে অনির্ভরশীল করবে
তবে এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, যেহেতু প্রত্যেকেই অন্ততঃ এক ক্ষীণ মাত্রায়
ফিত্রাতগত প্রত্যক্ষ পরিচিতির অধিকারী সেহেতু সামান্য একটু চিন্তা ও যুক্তির অবতারণাতেই আল্লাহর অস্তিত্বকে স্বীকার করে থাকে এবং পর্যায়ক্রমে অবচেতন স্তরের অন্তর্জ্ঞান ভিত্তিক পরিচিতিকে সুদৃঢ় করে সচেতন স্তরে পৌঁছাতে পারে
উপসংহারে বলা যায়ঃ আল্লাহ পরিচিতি ফিতরাতগত হওয়ার অর্থ হল এই যে, মানুষের অন্তর আল্লাহর সাথে পরিচিত এবং তার আত্মার গভীরে আল্লাহর সজ্ঞাত পরিচিতির জন্যে এক বিশেষ উৎস বিদ্যমান, যা অঙ্কুরিত ও বিকশিত হতে সক্ষমকিন্তু এ ফিতরাতগত উৎস সাধারণ ব্যাক্তিবর্গের মধ্যে এমন অবস্থায় নেই যে, তাদেরকে চিন্তা ও বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তি থেকে অনির্ভরশীল করবে

আল্লাহ পরিচিতির সরল উপায়
আল্লাহকে চিনার উপায়সমূহঃ
মহান প্রভুকে চিনার জন্যে একাধিক উপায় বিদ্যমানদর্শনের বিভিন্ন বইয়ে, কালামশাস্ত্রে, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দদের বিভিন্ন ভাষ্যে এবং ঐশী কিতাবসমূহেও এ গুলোর (উপায়)সস্পর্কে ইঙ্গিত করা হয়েছেএ যুক্তি-প্রমাণসমূহ বিভিন্ন দৃষ্টি কোণ থেকে পারস্পরিকভাবে বৈসাদৃশ্যপূর্ণযেমনঃ কোন কোন ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও অভিজ্ঞতালব্ধ বিষয়সমূহ প্রতিজ্ঞা হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে; যেখানে অন্য কোন ক্ষেত্রে খাঁটি বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়সমূহ ব্যবহৃত হয়েছেআবার কেউ কেউ সরাসরি প্রজ্ঞাবান প্রভুর অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টা করেন; যেখানে অন্যান্যরা শুধুমাত্র এমন এক অস্তিত্বময়কে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করেন যার অস্তিত্ব অপর কোন অস্তিত্বময়ের উপর নির্ভরশীল নয় (অর্থাৎ অবশ্যম্ভাবী অস্তিত্ব)এবং তার বৈশিষ্ট্যসমূহকে চিহ্নিত করার জন্যে অপর শ্রেণীর যুক্তির অবতারণা করে থাকেন
এক দৃষ্টি কোণ থেকে আল্লাহ পরিচিতির যুক্তি-প্রমাণসমূহকে কোন এক নদী পারাপারের জন্যে বিদ্যমান বিভিন্ন পথের সাথে তুলনা করা যেতে পারেএ গুলোর কোন কোনটি কাঠের তৈরী সাধারণ পুল যা নদীর উপর দিয়ে চলে গিয়েছে এবং লঘু ভারবিশিষ্ট কোন ব্যক্তি খুব সহজেই একে অতিক্রম করে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবেআবার কোন কোনটি হল প্রস্তর নির্মিত সুদৃঢ় এবং সুদীর্ঘ পুলের মত যার অতিক্রান্ত পথের দৈর্ঘ্য অপেক্ষাকৃত বেশীকোন কোনটি আবার আঁকাবাঁকা,উঁচু-নীচু এবং সুদীর্ঘ টানেল বিশিষ্ট রেল পথের মত, যা গুরুভারের ট্রেনের জন্যে তৈরী করা হয়েছে
যে সকল ব্যক্তি মুক্ত মস্তিষ্কের অধিকারী,তারা অত্যন্ত সহজ উপায়েই আপন প্রভুকে চিনে তাঁর (প্রভুর) উপাসনায় নিয়োজিত হতে পারেকিন্তু যদি কেউ সন্দেহের গুরুভার স্কন্ধে ধারণ করে, তবে তাকে প্রস্তর নির্মিত পুল অতিক্রম করতে হবেআবার যদি কেউ সন্দেহ ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের বোঝা বহন করে চলে, তবে তাকে এমন কোন পথ নির্বাচন করতে হবে যা শত উঁচু-নীচু ও আঁকা-বাঁকা সত্বেও মজবুত ও দৃঢ় ভিত্তির উপর নির্মিত
আমরা এখানে সর্ব প্রথমে আল্লাহ-পরিচিতির সরল পথের প্রতি ইঙ্গিত করবঅতঃপর কোন একটি মাধ্যম সম্পর্কে বর্ণনা করবকিন্তু দর্শনের মৌলিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত আঁকা-বাঁকা পথটি শুধুমাত্র তাদেরকেই অতিক্রম করতে হবে, যাদের মস্তিষ্ক অসংখ্য সন্দেহের দ্বারা সন্দিগ্ধ হয়ে আছে
অথবা তাদের মস্তিষ্ককে সন্দেহ মুক্তকরণের মাধ্যমে পশ্চাদ্ধাবন ও পথভ্রষ্টতার হাত থেকে মুক্তি দেয়ার চেষ্টা করতে হবে
সরল উপায়ের বৈশিষ্ট্যসমূহ
আল্লাহ-পরিচিতির সরল পথের একাধিক বিশেষত্ব ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে যে গুলির মধ্যে নিম্ন লিখিত গুলো গুরুত্বপূর্ণঃ
এ পথ কোন প্রকার জটিল ও কৌশলগত প্রতিজ্ঞার উপর নির্ভরশীল নয়
এবং সরলতম বক্তব্যসমূহই এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা যেতে পারে ফলে, যে কোন স্তরের ব্যক্তিবর্গের পক্ষেই অনুধাবনযোগ্য
এ পথ প্রত্যক্ষভাবে প্রজ্ঞাবান ও পরাক্রমশালী সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর দিকে পরিচালিত করে থাকে, যা অনেক দার্শনিক ও কালামশাস্ত্রগত যুক্তি-পথের ব্যতিক্রম সকল কালামশাস্ত্রও দার্শনিক যুক্তিতে সর্ব প্রথমেইঅনিবার্য অস্তিত্বনামে এক অস্তিত্বময় বিষয়কে প্রতিষ্ঠিত করা হয় এবং তারপর তার জ্ঞান,শক্তি ,প্রজ্ঞা, সৃজন ক্ষমতা, প্রতিপালকত্ব এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্যসমূহকে অপর কোন যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ করা আবশ্যক
এ পথ, অন্য সকল কিছুর চেয়ে ফিতরাতকে জাগ্রত করা ও ফিতরাতগত জ্ঞানের অবহিতকরণের ব্যাপারে ভূমিকা রাখেএ(ফিত্রাতগত জ্ঞানের অবহিতকরণ) বিষয়গুলোর উপর চিন্তার ফলে এমন এক ইরফানী অবস্থা মানুষের দিকে হস্ত প্রসারিত করে যেন আল্লাহর হস্তকে বিভিন্ন জাগতিক বিষয়ের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে অবলোকন করে থাকে -সেই হস্ত যার সাথে তার ফিতরাত পরিচিত
উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যসমূহের কারণে ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ এবং ঐশী ধর্ম সমূহের প্রবক্তাগণ এ পথকে সাধারণ জনসমষ্টির জন্যে নির্বাচন করেছেন এবং সকলকে এ পথ অতিক্রম করার জন্যে আহবান জানিয়েছেন; আর অন্যান্য পদ্ধতিসমূহকে, হয় বিশেষ কোন ক্ষেত্রের জন্য একান্তভাবে বরাদ্দ করেছেন, অথবা নাস্তিক্যচিন্তাবিদ ও বস্তুবাদী দার্শনিকদের সাথে তর্কবিতর্কের সময় প্রয়োগ করেছেন
পরিচিত নিদর্শনসমূহঃ
আল্লাহ পরিচিতির সরল পথ হল, এ বিশ্বে বিদ্যমান আল্লাহর নিদর্শনসমূহ সম্পর্কে চিন্তা করা এবং কোরআনের ভাষায় “আল্লাহর আয়াতসমূহ সম্পর্কে চিন্তাকরণ”বিশ্বব্রহ্মান্ডের সকল বিষয়বস্তু এবং মানব অস্তিত্বে উপস্থিত বিষয়গুলো যেন পরিচিতির কাঙ্খিত নিদর্শন এবং মানব মানসের সূচক, সে অস্তিত্বের কেন্দ্র বিন্দুর দিকে পথনির্দেশ করে, যে অস্তিত্ব সর্বদা সর্বস্থলে উপস্থিত
পাঠকমন্ডলী, যে বইটি এখন আপনাদের হস্তে রয়েছে তাও তাঁর (আল্লাহর)নিদর্শনসমূহেরই একটিযদি তা-ই না হবে তবে কেন এ বইটি পড়ার সময় এর সচেতন ও অভিপ্রায়ী লেখক সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারছেন? কখনো কি এটা সম্ভব বলে মনে করেছেন যে, এ বইটি এক শ্রেণীর বস্তুগত, উদ্দেশ্যহীন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ফলে অস্তিত্বে এসেছে এবং এর কোন অভিপ্রায়ী লেখক নেই?
এটা ভাবা কি বোকামী নয় যে, কোন একটি ধাতব খণিতে বিস্ফোরণের ফলে ধাতব কণিকাগুলো বর্ণ মালায় রূপান্তরিত হয়েছে এবং ঘটনাক্রমে পত্রপৃষ্ঠে সন্নিবেশিত হয়ে লিখনের সৃষ্টি হয়েছে; অতঃপর অপর একটি বিস্ফোরণের মাধ্যমে সুশৃঙ্খলিত ও বাঁধাইকৃত হয়ে একশত খণ্ডের একটি
বিশ্বকোষের উৎপত্তি হয়েছে?
কিন্তু জ্ঞাত ও অজ্ঞাত রহস্যময় ও পান্ডিত্যপূর্ণ এ মহাবিশ্বের উৎপত্তির ঘটনাকে নিছক দুর্ঘটনা বলে মনে করা উপরোল্লিখিত বিশ্বকোষের উৎপত্তির ঘটনার চেয়ে সহস্রবার বোকামীর শামিল হ্যাঁ, প্রতিটি পরিকল্পিত বিন্যাস ব্যবস্থাই তার পরিকল্পনাকারীর নিদর্শন স্বরূপআর এ ধরনের বিন্যাস ব্যবস্থা পৃথিবীর সর্বত্র পরিলক্ষিত হয় এবং সর্বদা এমন এক সামগ্রিক শৃঙ্খলাই প্রকাশ করে যে, এক প্র জ্ঞাবান সৃষ্টিকর্তা একে অস্তিত্বে এনেছেন এবং সর্বাবস্থায় তিনি এর পরিচালনায় নিয়োজিত
ফুলগুলো যে পুষ্পকাননে ফুটেছে, আর মাটি কর্দমার মাঝে রঙ বেরঙ সাজে ও সুগন্ধি নিয়ে আত্মপ্রকাশ করছে; ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বীজ থেকে ফলবৃক্ষ যে অঙ্কুরিত হচ্ছে এবং প্রতিবছর অজস্র সংখ্যক সুবর্ণ ,সুগন্ধ ও সুস্বাদু ফল ধারণ করছে; তদ্রূপ নানা বর্ণ ,নানা বিশেষত্ব ও নানা রূপের অন্যান্য বৃক্ষরাজি ইত্যাদি সকল কিছুই তাঁরই (আল্লাহর )অস্তিত্বের প্রমাণ বহন করে থাকে
অনুরূপ, পুষ্পশাখায় বুলবুলি যে গান গেয়ে যাচ্ছে; ডিম থেকে বের হয়ে মুরগীছানা যে পৃথিবীতে বিচরন করছে; নবজাতক গোবৎস যে মাতৃস্তন চোষণ করছে; দুগ্ধ মাতৃস্তনে নবজাতকের পানের জন্যে যে সঞ্চিত হচ্ছে ইত্যাদি সর্বদা এক সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বেরই প্রমাণ বহণ করে থাকে
সত্যিই, কি এক আশ্চয্য যোগসূত্র ও বিস্ময়কর অভিসন্ধি রয়েছে যুগপৎ শিশুজন্ম ও মাতৃস্তনে দুগ্ধ সঞ্চারের মধ্যেমৎসসমূহ যে প্রতিবছর ডিম পাড়ার জন্যে শত শত কিলোমিটার পথ প্রথম বারের মত অতিক্রম করে; সামুদ্রিক প্রাণীসমূহ যে অসংখ্য সামুদ্রিক উদ্ভিদের মাঝে আপন নীড়কে চিনে নেয়, এমনকি একবারের জন্যেও ভুলবশতঃ অপরের বাসায় প্রবেশ করে না, মৌমাছি যে, প্রত্যহ প্রাতে মৌচাক থেকে বের হয়ে যায় আর সুগন্ধযুক্ত ফুলে-ফলে বিচরণ করার জন্যে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করার পর গোধুলী লগ্নে যে পুনরায় স্বগৃহে প্রত্যাবর্তন করে ইত্যাদি তাঁরই নিদর্শন
বিস্ময়ের ব্যাপার হল, যেমনি মৌমাছিরা তেমনি দুগ্ধবতী গাভী ও ছাগলরা প্রত্যেকেই সর্বদা নিজের প্রয়োজনের চেয়েও অধিক মধু ও দুগ্ধ উৎপাদন করে থাকে, যাতে করে মানুষ এ সুস্বাদু উপাদেয় থেকে উপকৃত হতে পারে!
কিন্তু পরিহাস,অকৃতজ্ঞ মানুষ নিজবৈভবের পরিচিত মালিককে অপরিচিত বলে মনে করে এবং তাঁর সম্পর্কে তর্কবিতর্কে লিপ্ত হয়!
স্বয়ং এ মানব দেহেও বিস্ময়কর ও সুনিপূন কীর্তির প্রকাশ পরিলক্ষিত হয়সংশ্লিষ্ট অঙ্গের মাধ্যমে শরীরীয় সংগঠন; সংশ্লিষ্ট উপাঙ্গের মাধ্যমে অঙ্গসংগঠন; সংশ্লিষ্ট মিলিয়ন মিলিয়ন বিশেষ জীবন্ত কোষের মাধ্যমে উপাঙ্গ সংগঠন; প্রয়োজনীয় উপাদানসমূহের নির্দিষ্ট পরিমাণের সমন্বয়ে কোষ সংগঠন; শরীরের যথাস্থানে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহের সংস্থাপন; অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহের অভিপ্রেত কর্ম তৎপরতা
যেমনঃ ফুসফুসের মাধ্যমে অক্সিজেন গ্রহণ ও লোহিত রক্ত কণিকার মাধ্যমে তা দেহের বিভিন্ন কোষে সঞ্চালন, যকৃতের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পরিমাণ গ্লুকোজ উৎপাদন, নূতন কোষসমূহের সরবরাহের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্থ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গসমূহের নিরাময় সাধন; শ্বেত কোষের মাধ্যমে আক্রমণকারী ব্যাক্টেরিয়া ও রোগজীবাণুকে প্রতিহতকরণ; একাধিক গ্রন্থি থেকে বিভিন্ন হরমোনের নিঃসরণ, যেগুলো প্রাণীর শরীরের বিভিন্ন অংশের কর্ম তৎপরতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে ইত্যাদি সকল কিছু তাঁরই অস্তিতের প্রমাণ বহন করে থাকে
এই যে বিস্ময়কর বিন্যাস ব্যবস্থা যার সঠিক রহস্য উদঘাটনে শতসহস্র সংখ্যক বিজ্ঞানী কয়েক দশকাব্দী পথ অতিক্রম করার পরও ব্যর্থ হয়েছে -কার মাধ্যমে তা সৃষ্টি হয়েছে?
প্রতিটি কোষই একটি ক্ষুদ্র ব্যবস্থার সংগঠনে অংশগ্রহণ করে থাকে এবং এক শ্রেণীর কোষসমষ্টি উপাঙ্গসমূহের সংগঠনে অংশ নেয়, যা অপেক্ষাকৃত এক বৃহৎ ব্যবস্থার সংগঠনে অংশ নেয়; অনুরূপ এ ধরনের একাধিক জটিল ব্যবস্থার সমন্বয়ে অভিপ্রেত শারীরিক সামগ্রিক ব্যবস্থা রূপ পরিগ্রহ করেকিন্তু এখানেই এ ঘটনার শেষ নয়, বরং অগণিত প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ অস্তিত্বের সমন্বয়ে বিশ্বপ্রকৃতি নামে অশুল-প্রান্তহীন এক বৃহত্তম ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়, যা একক পান্ডিত্যপূর্ণ পরিকল্পনার ছায়াতলে পরিপূর্ণ শৃঙ্খলা ও সমন্বয়ের মাধ্যমে পরিচালিত হয়
অতএব কিভাবে তোমরা সত্য হতে বিচ্যুত হও (সূরা আনআম-৯৫)!
এটা নিশ্চিত যে, মানুষের জ্ঞানের পরিধি যতই বিস্তার লাভ করবে এবং প্রকৃতির বিভিন্ন বিষয় বস্তুর মধ্যে সমন্বয় ও নীতি যতই আবিস্কৃত হবে, ততই সৃষ্টির রহস্য উন্মেচিত হতে থাকবেতবে প্রকৃতির এ সরল সৃষ্টিসমূহ ও সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ সম্পর্কে চিন্তা করাই নিষ্কলুষ ও নির্মল হৃদয়ের জন্যে যথেষ্ট

অনিবার্য অস্তিত্বের প্রমাণকরণ

ভূমিকাঃ
পূর্ববর্তী পাঠে আমরা আলোচনা করেছিলাম যে, ঐশী দার্শনিকগণ এবং কালামশাস্ত্রবিদগণ
আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণের জন্যে অসংখ্য যুক্তির অবতারণা করেছেন, যা দর্শন ও কালামশাস্ত্রে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছেআমরা ঐগুলোর মধ্যে যে প্রমাণটি অপেক্ষাকৃত কম ভূমিকার প্রয়োজন এবং সহজবোধ্য সেটিকে নির্বাচন করতঃ তার ব্যাখ্যা প্রদান করবতবে একথা স্বরণযোগ্য যে, এ প্রমাণটি আল্লাহর অস্তিত্বকে শুধুমাত্র অনিবার্য অস্তিত্ব শিরোনামে প্রমাণ করে-অর্থাৎ যাঁর অস্তিত্ব অত্যাবশ্যকীয় এবং কোন অস্তিত্ব প্রদানকারীর উপর নির্ভরশীল নয়অনিবার্য অস্তিত্বকে প্রমাণ করার পর তার হ্যাঁ বোধক বৈশিষ্ট্য ও না বোধক বৈশিষ্ট্যকে অপর এক যুক্তির মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবেহ্যাঁ-বোধক বৈশিষ্ট্যের উদাহরণ হল জ্ঞান, শক্তি ইত্যাদি এবং না-বোধক বৈশিষ্ট্যের উদাহরণ হল অশরীরীয় হওয়া, নির্দিষ্ট স্থানে ও কালে সীমাবদ্ধ না হওয়া

প্রমাণের বিষয়বস্তু:

অস্তিত্বশীল বিষয়সমূহ, (বুদ্ধিবৃত্তিক মতে) হয় অনিবার্য অস্তিত্ব না হয় সম্ভাব্য অস্তিত্ব এবং কোন অস্তিত্বশীল বিষয়ই বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে এ দুধারণার বর্হিভূত হতে পারে নাসকল অস্তিত্বশীল বিষয়ই সম্ভাব্য অস্তিত্ব হতে পারে না কেননা, সম্ভাব্য অস্তিত্ব কারণের মুখাপেক্ষীসুতরাং যদি সমস্ত কারণসমূহ সম্ভাব্য অস্তিত্ব হয়ে থাকে, তবে প্রত্যেকটি কারণকেই অপর এক কারণের মুখাপেক্ষী হতে হবেফলে কখনোই কোন অস্তিত্বশীল বিষয় বাস্তব রূপ লাভ করবে নাঅন্যভাবে বলা যায় ঃ কারণের ধারাবাহিকতা অসম্ভবঅতএব অস্তিত্বশীল বিষয়সমূহের কারণসমূহ ধারাবাহিকভাবে এমন এক অস্তিত্বশীল বিষয়ে উপনীত হয়, যা স্বয়ং অপর অস্তিত্বশীল বিষয়ের ফলশ্রুতি নয় অর্থাৎ যা হবে অনিবার্য অস্তিত্বএ প্রমাণটি আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণের জন্যে দর্শনের একটি সরলমত প্রমাণ, যা কয়েকটি খাঁটি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিজ্ঞা দ্বারা রূপ লাভ করেছে এবং কোন প্রকার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল নয় তবে যেহেতু এ প্রমাণটিতে দার্শনিক পরিভাষা ও ভাবার্থসমূহ ব্যবহৃত হয়েছে, সেহেতু যে সকল প্রতিজ্ঞা ও পরিভাষার মাধ্যমে, উল্লেখিত প্রমাণটি রূপ পরিগ্রহ করেছে তাদের সমপর্কে আলোকপাত করা অনিবার্য

সম্ভাব্যতা ও অনিবার্যতা ঃ
প্রতিটি প্রতিজ্ঞাই (যতই সরল হোক না কেন) কমপক্ষে দুটি মদলিক ভাবার্থ যথাঃ উদ্দেশ্য ও বিধেয় নিয়ে গঠিত হয়যেমনঃ সূর্য্য উজ্জল এ প্রতিজ্ঞাটিতে সূর্য হল উদ্দেশ্য আর উজ্জ্বল হল বিধেয় এবং প্রতিজ্ঞাটি সূর্যের জন্যে উজ্জ্বলতাকে প্রতিপাদন করে থাকে

উদ্দেশ্যের জন্যে বিধেয়ের প্রতিপাদন তিনটি অবস্থার ব্যতিক্রম হতে পারে না হয় অসম্ভব যেমনঃ ৪ অপেক্ষা ৩ বড়, অথবা অনিবার্য যেমন ঃ ৪ এর অর্ধেক হল ২ নতুবা অসম্ভব বা অনিবার্য এ দুয়ের কোনটি নয় যেমন ঃ সূর্য আমাদের মাথার উপর অবস্থান করছে
যুক্তিবিদ্যার পরিভাষায় উপরোক্ত প্রথম ক্ষেত্রে প্রতিজ্ঞার সম্পর্ককে নিষিদ্ধ, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে প্রতিজ্ঞার সম্পর্ককে অনিবার্য বা আবশ্যকীয় তৃতীয় ক্ষেত্রে প্রতিজ্ঞার সম্পর্ককে সম্ভাবনা (বিশেষ অর্থে) গুণসম্বলিত বলা হয়ে থাকে
দর্শনে অস্তিত্বশীল বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়ে থাকেযা কিছু নিষিদ্ধ ও অসম্ভব তা কখনোই বাস্তব রূপ লাভ করে না (তাই এ বিষয়ের আলোচনা দর্শনের অন্তর্ভুক্ত হয় না)ফলে দর্শনশাস্ত্র, অস্তিত্বশীল বিষয়সমূহকে বুদ্ধিবৃত্তির ভিত্তিতে অনিবার্য অস্তিত্ব ও সম্ভাব্য অস্তিত্ব এ দুভাগে বিভক্ত করেছে
অনিবার্য অস্তিত্ব বলতে বুঝায়, যে অস্তিত্বশীল বিষয় নিজ থেকেই অস্তিত্বশীল এবং তার এ অস্তিত্বের জন্যে অপর কোন অস্তিত্বশীল বিষয়ের উপর নির্ভরশীল নয়ফলে স্বভাবতঃই এ ধরনের অস্তিত্ব অনাদি ও অনন্ত হবেকারণ, কোন এক সময় কোন কিছুর অনুপস্থিতির অর্থ হল তার অস্তিত্ব নিজ থেকে নয় এবং অস্তিত্বে আসার জন্যে অপর এমন কোন অস্তিত্বশীলের উপর নির্ভর করতে হয় যে তার উপস্থিতি হল (এর উপস্থিতির জন্যে) শর্ত ও কারণ স্বরূপ; আর তার অনুপস্থিতিতে এর অস্তিত্ব থাকে না
সম্ভাব্য অস্তিত্ব হল তা, যা নিজ থেকে অস্তিত্বশীল নয় এবং যার অস্তিত্বশীলতার জন্যে অপর কোন অস্তিত্বের উপর নির্ভর করতে হয়
অস্তিত্বের এ শ্রেণীবিভাগ বুদ্ধিবৃত্তির ভিত্তিতে করা হয়েছে এবং সংগত কারণেই তা নিষিদ্ধ অস্তিত্বকে অস্বীকার করেতবে বাস্তব অস্তিত্বসমূহ এ দুবিভাগের (অনিবার্য অস্তিত্ব ও সম্ভাব্য অস্তিত্ব) কোনটির অন্তর্ভুক্ত সে সম্পর্কে কোন দিকনির্দেশনা নাইঅন্য কথায়, এ ব্যাপারটিকে তিন ভাবে অনুধাবণ করা যেতে পারেযথাঃ
প্রথমতঃ সকল অস্তিত্বই হল অনিবার্য অস্তিত্ব
দ্বিতীয়তঃ সকল অস্তিত্বই হল সম্ভাব্য অস্তিত্ব
তৃতীয়তঃ কোন কোনটি হল অনিবার্য অস্তিত্ব আবার কোন কোনটি হল সম্ভাব্য অস্তিত্ব
প্রথম ও তৃতীয় ধারণায় অনিবার্য অস্তিত্ব বিদ্যমানঅতএব এ ধারণাটিকেই (দ্বিতীয়) আলোচনার বিষয়বস্তু রূপে স্থান দিতে হবে যে, সকল অস্তিত্বই কি সম্ভাব্য অস্তিত্ব হওয়া সম্ভব, না কি অসম্ভব? আর এ ধারণাটির অপনোদনের মাধ্যমেই অনিবার্য অস্তিত্বের ধারণা চূড়ান্তরূপে প্রতিষ্ঠিত হয় যদিও তার একত্ব এবং অন্যান্য গুণকে প্রতিপাদনের জন্যে অন্য কোন প্রমাণের উপর নির্ভর করা আবশ্যক

অতএব, দ্বিতীয় ধারণাটিকে পরিত্যাগ করার জন্যে অপর একটি প্রতিজ্ঞাকে উল্লেখিত প্রমাণের সাথে সংযুক্ত করতে হবেআর তা হল এই যে, সকল অস্তিত্বই সম্ভাব্য অস্তিত্ব হওয়া অসম্ভবতবে এ প্রতিজ্ঞাটি স্বতঃসিদ্ধ নয়এ কারণে একে নিম্নরূপে প্রমাণ ও প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক ঃ সম্ভাব্য অস্তিত্ব কারণের উপর নির্ভরশীল এবং কারণের অসীম ধারাবাহিকতা অসম্ভবঅতএব কারণসমূহ তাদের ধারাবাহিকতায় এমন এক অস্তিত্বে গিয়ে পৌছাতে হবে যা কারণের উপর নির্ভরশীল নয়আর তা-ই হলঅনিবার্য অস্তিত্বসুতরাং সকল অস্তিত্বই সম্ভাব্য অস্তিত্ব নয়আর এখান থেকেই অপর এক দার্শনিক বিষয়ের সূত্রপাত ঘটে, যার ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন (চলবে) 

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.