রাসুল (সা.)-এর উত্তরাধিকার ও জ্ঞানগত নেতৃত্বের বিষয়

0 539

ইসলামের শিক্ষা থেকে দ্বাদশ ইমাম পন্থীরা যে জ্ঞান লাভ করেছিল, তাতে তারা বিশ্বাস করত যে, যে বিষয়টি সমাজের জন্যে সর্বপ্রথম জরুরী তা হল, ইসলামের শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে সবার সুস্পষ্ট ধারণার অধিকারী হওয়া[1] আর পরবর্তী পর্যায়ে সেই ইসলামী শিক্ষা সমূহকে পূর্ণ ভাবে সমাজে প্রয়োগ করাঅন্য কথায়,


[1] পবিত্র কুরআন, রাসুল (সা.) এবং পবিত্র আহলে বাইতগণ (আ.) জ্ঞার্নাজনের প্রতি অতিশয় গুরুত্ব আরোপ ও উসাহ প্রদান করতেনজ্ঞানার্জনের প্রতি অনুপ্রেরণা প্রদান করতে গিয়ে এক পর্যায়ে মহা নবী (সা.) বলেনঃ জ্ঞান অর্জন প্রতিটি মুসলমানের জন্যেই ফরজ। (বিহারুল আনোয়ার, ১ম খন্ড, ১৭২ নং পৃষ্ঠা)

প্রথমতঃ সমাজের প্রত্যেককেই এ পৃথিবী ও মানব জাতিকে বাস্তব দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে একজন মানুষ হিসেবে নিজ দায়িত্ব সমন্ধে অবগত এবং তা পালনে ব্রত হওয়া উচিতএমন কি তা যদি তার ইচ্ছার বিরোধীও হয় তবুও তা পালন করা উচিত

 

দ্বিতীয়তঃ একটি ইসলামী শাসন ব্যবস্থাই সমাজে ইসলামের প্রকৃত বিধি বিধান সমূহকে সংরক্ষণ ও বাস্তবায়ন করবেযাতে করে ঐ সমাজের কেউই যেন আল্লাহ‌ ছাড়া অন্য কারো উপাসনা না করে এবং সবাই পূর্ণ স্বাধীনতাসহ ব্যক্তি ও সামাজিক ন্যায়বিচার ভোগ করতে পারেআর এদুটি মহান লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্যে এমন এক ব্যক্তির প্রয়োজন, যে সরাসরি আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে নিস্পাপ হওয়ার মত গুণের অধিকারী হবেঅন্যথায় হয়ত এমন কোন লোক সেই শাসন ব্যবস্থা ও জ্ঞানগত নেতৃত্বের আসনের অধিকারী হয়ে বসবে, যে তার ঐ গুরুদায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে চিন্তাগত পথভ্রষ্টতা বা বিশ্বাসঘাতকতার সম্ভবনা থেকে মুক্ত নয়এর ফলে তখন ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতা ব্যহত হবে ও ইসলামী শাসন ব্যবস্থা একটি অত্যাচারী একনায়ক বা রাজতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হবেতখন ইসলামের পবিত্র জ্ঞানভান্ডার পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মের মতই স্বেচ্ছাচারী ও স্বার্থান্বেষী পন্ডিত মহলের দ্বারা বিকৃতির স্বীকার হবেবিশ্বনবী (সা.)-এর সাক্ষ্য অনুযায়ী একমাত্র যে ব্যক্তি কথায় ও কাজে এ পদের জন্যে উপযুক্ত ছিল এবং যার পদ্ধতি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহ্‌র পবিত্র কুরআন ও রাসুল (সা.)-এর সুন্নাতের অনুরূপ ছিল, তিনি হচ্ছেন হযরত আলী (আ.)[1]

যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠদের বক্তব্য ছিল এই যে, ‘কুরাইশরাখেলাফতের ব্যাপারে হযরত আলী (আ.)-এর ন্যায্য অধিকার প্রাপ্তির বিরোধীতারপরও তাদের উচিত ছিল বিরোধীদেরকে সত্যের দিকে ফিরে আসতে বাধ্য করা এবং বিদ্রোহীদেরকে দমন করাঠিক যেমনটি যাকাত প্রদানে অস্বীকারকারীদের সাথে করা হয়েছিলএমনকি তাদের সাথে যুদ্ধও করা হয়েছিলতবুও যাকাত আদায় থেকে তারা বিরত হয়নিতাই কুরাইশদের বিরোধীতার ভয়ে সত্য প্রতিষ্ঠার কাজ থেকে হাত গুটিয়ে সত্যকে হত্যা করা তাদের কখনও উচিত হয়নিনির্বাচিত খেলাফতকে সম্মতি প্রদান থেকে যে কারণটি শীয়াদের বিরত রেখে ছিল, তা হচ্ছে এ ঘটনার অনাকাংখিত পরিণতি, যা ইসলামী শাসন ব্যবস্থার জন্যে বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসত এবং ইসলামের সুমহান শিক্ষার ভিত্তিকে ধ্বংস করে দিতবাস্তবিকই পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে ক্রমেই এ ধারণার সত্যতা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়এর ফলে শীয়াদের এ সংক্রান্ত বিশ্বাস আরও দৃঢ়তর হতে থাকেযদিও প্রাথমিক পর্যায়ে শীয়ারা বাহ্যত হাতে গোনা অল্প কয়েক জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, যা বৃহত্তর জনসমুদ্রে হারিয়ে গিয়েছিল, তথাপি পবিত্র আহলে বাইতগণ (আ.) গোপনে ইসলামের শিক্ষাদান কর্মসূচী এবং নিজস্ব পদ্ধতিতে ইসলাম প্রচারের ব্যাপারে নিরন্তন চেষ্টা চালিয়ে যানঅন্যদিকে এর পাশাপাশি ইসলামী শক্তির উন্নতি ও সংরক্ষণের বৃহত্তর স্বার্থে তাঁরা শাসক গোষ্ঠীর সাথে প্রকাশ্য বিরোধীতা থেকে বিরত থাকেনএমন কি শীয়ারা সংখ্যাগরিষ্ঠদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সকল জিহাদেও অংশ গ্রহণ করতেন এবং গণ-স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে প্রয়োজনে হস্তক্ষেপও করতেনস্বয়ং হযরত আলী (আ.) ইসলামের স্বার্থে সংখ্যাগরিষ্ঠদের পথ নির্দেশনা দিতেন[2]

 

নির্বাচিত খেলাফতের রাজনীতি ও

শীয়াদের দৃষ্টিভঙ্গী

 

শীয়া মাযহাবের অনুসারীরা বিশ্বাস করতেন যে, ইসলামের ঐশী আইন বা শরীয়ত, যার উস পবিত্র কুরআন ও বিশ্বনবী (সা.)-এর সুন্নাত তা কেয়ামত পর্যন্ত সম্পূর্ণ অক্ষুন্ন ও অপরিবর্তীত অবস্থায় এবং স্বীয় মর্যাদায় টিকে থাকবে[3] ইসলামী আইনসমূহের পূর্ণ বাস্তবায়নের ব্যাপারে এতটুকু টাল-বাহানা করার অধিকার ইসলামী সরকারের নেইইসলামী সরকারের একমাত্র দায়িত্ব হচ্ছে পরামর্শ সভার পরামর্শ ও সমসামায়িক পরিস্থিতি অনুযায়ী ইসলামী শরীয়তের (আইন) ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণকিন্তু রাসুল (সা.)-এর মৃত্যুপূর্ব অসুস্থ অবস্থার সময়ে সেই ঐতিহাসিক কাগজ কলম আনার ঘটনা খলিফা নির্বাচন ও রাজনৈতিক বাইয়াত গ্রহণসহ ইত্যাদি ঘটনা তদানিন্তন খেলাফতের উদ্দেশ্যকে স্পষ্ট করে তোলেএ ব্যাপারটি পরিষ্কার হয়ে যায় যে, নির্বাচিত খেলাফতের মূল ব্যক্তিবর্গ ও সমর্থকগণ পবিত্র কুরআনকে কেবল মাত্র একটি সংবিধান হিসাবে সংরক্ষণে বিশ্বাসীকিন্তু রাসুল (সা.)-এর সুন্নাত ও আদর্শকে তারা অপরিবর্তনীয় বলে মনে করত নাবরং তাদের ধারণা ছিল ইসলামী সরকার নিজ স্বার্থের প্রয়োজনে রাসুল (সা.)-এর সুন্নাত বাস্তবায়ন থেকেও বিরত থাকতে পারেতদানিন্তন খেলাফততন্ত্রের এ দৃষ্টি ভঙ্গীর প্রমাণ পরবর্তীতে রাসুল (সা.)-এর বহু সাহাবীদের কথা ও কাজে পরিলক্ষিত হয় (সাহাবীরা মুজতাহিদইজতিহাদ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যদি সত্যে উপনীত হন, পুরস্কৃত হবেনআর যদি ভুল করেন, ক্ষমা প্রাপ্ত হবেন)এর স্পষ্ট উদাহরণ জনৈক সাহাবী ও সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদের ঐতিহাসিক ঘটনায় পাওয়া যায়কোন এক রাতে খালিদ বিন ওয়ালিদ জনাব মালিক বিন নুওয়াইরা নামক জনৈক গণ্যমান্য মুসলমানের বাড়ীতে আকস্মিকভাবে অতিথি হনখালিদ বিন ওয়ালিদ তাঁকে অপ্রত্যাশিতভাবে হত্যা করেন এবং তাঁর কর্তিত মাথা চুলোর আগুনে পুড়িয়ে ফেলেন

অতঃপর ঐ রাতেই নিহতের স্ত্রীকে ধর্ষণ করেনকিন্তু, সামরিক বাহিনীর জন্যে খালিদ বিন ওয়ালিদের মত সুযোগ্য সেনাপতির প্রয়োজনএই স্বার্থে খলিফা এ ধরণের জঘণ্য ও নৃশংস হত্যা কান্ডের বিচার ও প্রয়োজনীয় শাস্তি, খালিদ বিন ওয়ালিদের উপর প্রয়োগ থেকে বিরত থাকলেন[4] একইভাবে খলিফার প্রশাসন মহানবী (সা.)-এর আত্মীয়-স্বজন ও পবিত্র আহলে বাইতগণের (আ.) প্রতি নিয়মিত প্রদত্ত খুমস্‌ বন্ধ করে দেন[5]  রাসুল (সা.)-এর হাদীস লেখা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়যদি কখনও লিপিবদ্ধ কোন হাদীস কোথাও কারো কাছে পাওয়া যেত তাহলে সাথে সাথেই তা বাজেয়াপ্ত করা হত এবং পুড়িয়ে ফেলা হত[6]  হাদীস লিপিবদ্ধকরণ নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি সমগ্র খোলাফায়ে রাশেদীনেরযুগে অব্যাহত ছিলআর তা উমাইয়া খলিফা ওমর বিন আব্দুল আজিজের শাসন আমলে (হিঃ ৯৯ – ১০২ হিঃ) পর্যন্ত বলব থাকে[7] দ্বিতীয় খলিফা ওমরের সময় (হিঃ ১৩ – ২৫ হিঃ) খেলাফত প্রশাসনের এ রাজনৈতিক পদক্ষেপটি আরও সুস্পষ্ট হয়ে ওঠেএ সময় দ্বিতীয় খলিফা ওমর ইসলামী শরীয়তের বেশ কিছু আইনের পরিবর্তন সাধন করেনযেমনঃ হজ্জে তামাত্তু’ ‘মুতাহ্‌ বিবাহ্‌ এবং আযান হাইয়্যা আলা খায়রিল আমালবাক্যটির ব্যবহার তিনি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন[8]  তিনিই একই বৈঠাকে তিন তালাকসহ এজাতীয় আরো অনেক নীতির প্রচলন শুরু করেন[9]

দ্বিতীয় খলিফা ওমর সর্ব প্রথম বাইতুল মালের অর্থ জনগণের মধ্যে বন্টনের সময় বৈষম্যের সৃষ্টি করেন[10] এ বিষয়টি পরবর্তীতে মুসলমানদের মাঝে আশ্চর্যজনক শ্রেণীবৈষম্য এবং ভয়ংকর ও রক্তাক্ত সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটায়দ্বিতীয় খলিফা ওমরের খেলাফতের সময়েই মুয়াবিয়া সিরিয়ায় রাজপ্রাসাদে বসে শাসনকার্য পরিচালনার মাধ্যমে রাজতন্ত্রের সূচনা করেনদ্বিতীয় খলিফা ওমর তাকে আরবের কাসরা’ (জনৈক বিখ্যাত পারস্য সম্রাটের উপাধি) বা বাদশাহ্‌ বলে ডাকতেনতিনি কখনো মুয়াবিয়ার এধরণের কাজের প্রতিবাদ করেননি

দ্বিতীয় খলিফা ওমর হিজরী ২৩ সনে জনৈক পারসিক ক্রীতদাসের হাতে নিহত হনমৃত্যুর পূর্বে খলিফা ওমরের নির্দেশে ৬ সদস্য বিশিষ্ট খলিফা নির্বাচন কমিটি গঠিত হয়এ কমিটির সংখ্যাধিক্যের মতামতের ভিত্তিতে তৃতীয় খলিফা র্নিবাচিত হন ও তার শাসনভার গ্রহণ করেনতৃতীয় খলিফা ওসমান তার শাসন আমলে উমাইয়া বংশীয় আপন আত্মীয় স্বজনদের ব্যাপক হারে প্রশাসনে নিযুক্ত করার মাধ্যমে উমাইয়াদেরকে জনগণের উপর প্রভুত্ব বিস্তারে সহায়তা করেনহিজাজ (বর্তমান সৌদি আরব) ইরাক ও মিশরসহ অন্যান্য ইসলামী প্রদেশগুলোর শাসনভার তিনি উমাইয়া বংশের লোকজনের উপর অর্পণ করেন[11] এরা সবাই প্রকাশ্যভাবে অন্যায়-অত্যাচার, দূর্নীতি, ইসলামী নীতিমালা লংঘন ও পাপাচার প্রচলনের মাধ্যমে ইসলামী প্রশাসনে চরম অরাজকতার সূত্রপাত ঘটায়[12] কালীন ইসলামী বিশ্বের চর্তুদিক থেকে জনগণের অভিযোগ ওসমানের কাছে পৌঁছতে লাগলকিন্তু খলিফা ওসমান উমাইয়া বংশীয় ক্রীতদাসী এবং বিশেষ করে জনাব মারওয়ান বিন হাকামের (খলিফার চাচাতো ভাই এবং প্রধানমন্ত্রী) দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবান্বিত ছিলেনফলে জনগণের অভিযোগকে তিনি কখনই গুরুত্ব দিতেন না

শুধু তাই নয়, মাঝে মাঝে তিনি অভিযোগকারীদের শায়েস্তা করার নির্দেশ জারী করতেন[13] অবশেষে হিজরী ৩৫ সনে জনগণ খলিফার বিরূদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেখলিফা ওসমানের বাড়ী বেশ কদিন ঘেরাও রাখা হয় এবং কিছু সংর্ঘষের পর তারা খলিফাকে হত্যা করেসিরিয়ার শাসনকর্তা মুয়াবিয়া ছিলেন উমাইয়া বংশের লোক এবং তৃতীয় খলিফা ওসমানের ঘনিষ্ট আত্মীয়ওসমান তার শাসন আমলে সিরিয়ার প্রশাসনকে অধিক শক্তিশালী করেনপ্রকৃতপক্ষে খেলাফতের গুরুভার ক্রমেই সিরিয়ায় কেন্দ্রীভূত হতে থাকেযদিও রাষ্ট্র পরিচালনার কাঠামোগত কেন্দ্র ছিল মদীনাতবে তা একটি বাহ্যিকরূপ ছাড়া আর কিছুই ছিল না[14]

ইসলামের প্রথম খলিফা সাহাবীদের দ্বারা নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হনদ্বিতীয় খলিফা, প্রথম খলিফার ওসিয়াত নামার মাধ্যমে মনোনয়ন লাভ করে ক্ষমতায় আসেনআর তৃতীয় খলিফা, দ্বিতীয় খলিফার দ্বারা মনোনিত ছয় সদশ্য বিশিষ্ট কমিটির মাধ্যমে মনোনীত হনঐ কমিটির র্নিবাচনের নীতিমালাও পূর্ব থেকেই দ্বিতীয় খলিফার দ্বারা র্নিধারিত হয়েছিলযাই হোক, ইসলামের প্রথম তিন খলিফা, যাদের শাসনকাল প্রায় পঁচিশ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়েছিল প্রশাসনিক ক্ষেত্রে তাদের গৃহীত রাজনীতির স্বরূপ এটাই ছিল যে, তারা নিজস্ব ইজতিহাদ’(গবেষণা) অনুসারে প্রয়োজনীয় যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত নিবেন এবং সমাজে তা প্রয়োগ করবেনইসলামী জ্ঞান ও সংস্কৃতি প্রসারের ব্যাপারে তাদের নীতি ছিল এই যে, পবিত্র কুরআন, তাফসির (ব্যাখ্যা) বা গবেষণা ছাড়াই পঠিত হবেআর রাসুল (সা.) এর হাদীস অলিখিত ভাবে প্রচারিত হবে এবং অবশ্যই তা মৌখিক বর্ণনা ও শ্রবণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবেপবিত্র কুরআনের অনুলিপি তৈরী করণ অত্যন্ত সীমিত ও সুনিয়ন্ত্রিত ছিলআর হাদীস লিখন ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ[15] হিজরী ১২ সনে সংঘটিত ইয়ামামার যুদ্ধ পর্যন্ত এ অবস্থা বলব ছিলঐ যুদ্ধে বেশ কিছু সাহাবী নিহত হন যারা কুরআনের ক্বারী ও হাফেজ ছিলেনতখন দ্বিতীয় খলিফা ওমর, প্রথম খলিফা আবুবকরকে সমগ্র কুরআনকে গ্রন্থবদ্ধ আকারে এক যায়গায় সংগৃহীত করার জন্য প্রস্তাব দেনদ্বিতীয় খলিফা ওমর বিন খাত্তাব বলেন, ভবিষ্যতে যদি এ ভাবে কুরআনের আরও হাফিজ নিহত হন, তাহলে অদুর ভবিষ্যতে আমাদের মধ্যে আর কুরআনের অস্তিত্ব থাকবে নাসুতরাং কুরআনের সব আয়াত গুলো এক যায়গায় সংগ্রহ করে পুস্তক আকারে লিপিবদ্ধ করা প্রয়োজন[16]

এ সিদ্ধান্ত শুধু কুরআনের ক্ষেত্রেই গৃহীত হয়অথচ রাসুল (সা.)-এর হাদীস, কুরআনের পরই যার অবস্থান, তাও একই বিপদের সম্মুখীন ছিলকারণ, রাসুল (সা.)-এর হাদিসের ভাবার্থ মুলক বর্ণনা তার পরির্বতন, পরির্বধন সংকোচন, বিস্মৃতি, বিকৃতি ও জালকৃত হওয়ার হাত থেকে আদৌ নিরাপদ ছিল নাকিন্তু রাসুল (সা.)-এর হাদীস সংরক্ষণের ব্যাপারে আদৌ কোন গুরুত্ব দেয়া হয়নিএমন কি যেখানেই লিপিবদ্ধ কোন হাদীস পাওয়া যেত, সাথে সাথেই তা পুড়িয়ে ফেলা হতপরিণতিতে অবস্থা এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছালো যে, খুব অল্প দিনের মধ্যেই নামায, রোযা…. ইত্যাদির মত ইসলামের অতীব প্রয়োজনীয় ও গুরুত্ব পূর্ণ বিষয়গুলোর ব্যাপারেও পরস্পর বিরোধী মতামতের সৃষ্টি হলএকইভাবে এ যুগে ইসলামী জ্ঞানবিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাগুলোর উন্নয়নের ব্যাপারেও আদৌ কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নিঅথচ, পবিত্র কুরআনে ও হযরত রাসুল (সা.)-এর হাদীসে, জ্ঞান অর্জন ও তার প্রসারের ব্যাপারে যে প্রশংসা, অনুপ্রেরণা ও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, খেলাফতের যুগে এসে তা সস্পূর্ণ নিস্ক্রীয় ও স্থবির হয়ে পড়েঅধিকাংশ মুসলমানই তখন একের পর এক রাজনৈতিক বিজয় নিয়ে মেতে ছিলআর তখন তাদের যুদ্ধলব্ধ গণিমতের সীমাহীন সম্পদের স্রোত সমগ্র আরব সাম্রাজ্যের দিকে ধাবিত হয়েছিলযার ফলে নবীবংশের পবিত্র জ্ঞানের ঝর্ণাধারা থেকে উপকৃত হওয়ার ব্যাপারে মুসলমানরা আদৌ কোন গুরুত্ব দেয়নিঐ পবিত্র জ্ঞানধারার উসমুখ ছিলেন হযরত ইমাম আলী (আ.) তাঁর ব্যাপারে মহানবী (সা.) বলেছেন যে, হযরত আলী (আ.)-ই ইসলাম এবং পবিত্র কুরআন সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সর্বাধিক জ্ঞানী ব্যক্তিএমন কি কুরআন সংগ্রহের সময়ও খেলাফত প্রশাসন হযরত আলী (আ.)-কে সে ব্যাপারে কোন প্রকার হস্তক্ষেপ করার অধিকার দেয়নিশুধু তাই নয়, এ ব্যাপারে তাঁর নামটাও তারা উচ্চারণ করেনি সেদিনঅথচ খেলাফত প্রশাসন এটা ভাল করেই জানতেন যে, রাসুল (সা.)-এর মৃত্যুর পর হযরত আলী (আ.) বহুদিন পর্যন্ত নিজেকে ঘরে আবদ্ধ করে রাখেনআর ঐ সময়ে তিনি কুরআনের সমগ্র লিপিসমূহকে একত্রিত ভাবে সংগ্রহ করে ছিলেন[17] খেলাফত প্রশাসনের এমনই ধরণের আরও অনেক কর্মকান্ড হযরত আলী (আ.) এর ভক্ত ও অনুসারীদের বিশ্বাসকে অধিকতর সূদৃঢ় এবং সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিতি সম্পর্কে সর্তক হতে সাহায্য করেছিলএর ফলে দিনের পর দিন তাদের কার্যক্রমের গতিও বহু গুণে বৃদ্ধি পেতে থাকেওদিকে ব্যাপক ভাবে গণ-প্রশিক্ষণের সুযোগ না থাকায় হযরত আলী (আ.) ব্যক্তিগত পর্যায়ে লোক তৈরীর কাজ চালিয়ে যানএই দীর্ঘ ২৫ বছরের মধ্যে হযরত আলী (আ.)-এর অত্যন্ত গুরুত্ব পূর্ণ চারজন শিষ্য ও আপ্রাণ সহযোগীর তিনজনই পরলোক গমন করেনযারা ছিলেন হযরত সালমান ফারসী (রা.), হযরত আবুযার গিফারী (রা.) এবং হযরত মিকদাদ (রা.)কিন্তু ইতিমধ্যেই আরও বহু সংখ্যক সাহাবী এবং হেজাজ (বর্তমান সৌদি আরব), ইয়ামান, ইরাক সহ বিভিন্ন স্থানের অসংখ্য তাবেয়ীন (যারা রাসুলের সাহাবীদের সাক্ষাত লাভ করেছেন) হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর অনুসারীতে পরিণত হনযার ফলে তৃতীয় খলিফা নিহত হওয়ার পর প্রশাসন রাজ্যের চর্তুদিক থেকে গণসমর্থনের জোয়ার হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর দিকে ধাবিত হয়সকলে গণভাবে হযরত আলী (আ.)-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন এবং তিনি খলিফা হিসেবে নির্বাচিত হন

 

হযরত আলী (আ.)-এর খেলাফত ও

তার প্রশাসনিক পদ্ধতি

 

হিজরী ৩৫ সনের শেষ ভাগে হজরত আলী (আ.)-এর খেলাফত কাল শুরু হয়প্রায় ৪ বছর ৫মাস পর্যন্ত এই খেলাফত স্থায়ী ছিলহযরত আলী (আ.) খেলাফত পরিচালনার ব্যাপারে হযরত রাসুল (সা.)-এর নীতির অনুসরণ করেন[18] তাঁর পূর্ববর্তী খলিফাদের যুগে যেসব (ইসলামী নীতি মালার) পরিবর্তন ঘটানো হয়েছিল, তিনি সেগুলোকে পুনরায় পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসেনখেলাফত প্রশাসনে নিযুক্ত অযোগ্য লোকদের তিনি দায়িত্ব থেকে অপসারণ করেন[19] তাঁর এসব পদক্ষেপে প্রকৃতপক্ষে এক বৈপ্লবিক আন্দেলন ছিল, যা পরবর্তিতে প্রচুর সমস্যারও সৃষ্টি করেছেহযরত ইমাম আলী (আ.) খেলাফতের প্রথম দিনে জনগণের উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দিয়ে ছিলেন সেখানে তিনি বলেনঃ হে জনগণ! জেনে রেখো নবুয়াতের যুগে যে সমস্যায় তোমরা ভুগেছিলে আজ আবার সেই সমস্যাতেই জড়িয়ে পড়লেতোমাদের মধ্যে একটা ব্যাপক পরির্বতন ঘটবেযে সকল মহ ব্যক্তিরা এতদিন পিছিয়ে ছিলেন তাঁরা এখন সামনের সারিতে চলে আসবেনএকইভাবে যেসব অযোগ্য লোক এতদিন সামনের সারিতে অবস্থান নিয়েছিল আজ তারা পিছনে চলে যাবে। (সত্য ও মিথ্যা বিদ্যমান এবং এতদুভয়ের প্রত্যেকেরই অনুসারীও রয়েছেতবে সবারই উচিত সত্যকে অনুসরণ করা) মিথ্যার পরিমাণ যদি অধিকও হয়, সেটা এমন নতুন কিছু নয়সত্যের পরিমাণ যদি কমও হয়, হোক না! অনেক সময় কমওতো সবার চেয়ে অগ্রগামী হয়ে থাকেআর উন্নতির আশাও এতে রয়েছেতবে এমনটি খুব কমই দেখা যায় যে, যা একবার মানুষের হাতছাড়া হয়ে গেছে তা পুনরায় তার কাছে ফিরে এসেছে[20]

এ ভাবে হযরত আলী (আ.) তাঁর বৈপ্লবিক প্রশাসনকে অব্যাহত রাখেনকিন্তু বৈপ্লবিক আন্দোলন সমূহের স্বাভাবিক পরিণতি হচ্ছে, এই আন্দোলনের ফলে যাদের স্বার্থ বিঘ্নিত হয়, তারা এ ধারার বিরোধী হয়ে ওঠেআমরা দেখতে পাই হযরত আলী (আ.)-এর খেলাফতের বৈপ্লবিক নীতি বহু স্বার্থেন্বেষী মহলকে আঘাত করেছিলতাই শুরুতেই সারা দেশের যত্রতত্র থেকে আলী (আ.)-এর খেলাফতের বিরোধী সূর বেজে ওঠেবিরোধীরা তৃতীয় খলিফার রক্তের প্রতিশোধের ষড়যন্ত্র মুলক শ্লোগানের ধুঁয়ো তুলে বেশ কিছু রক্তাক্ত যুদ্ধের অবতারণা করেএ জাতীয় গৃহযুদ্ধ হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর সমগ্র খেলাফতকালব্যাপী অব্যাহত ছিলশীয়াদের দৃষ্টিতে ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধার ছাড়া এসব যুদ্ধের সূচনাকারীদের অন্য কোন উদ্দেশ্যই ছিল না

তৃতীয় খলিফার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের শ্লোগান ছিল সম্পূর্ণরূপে গণপ্রতারণামূলক একটি রাজনৈতিক হাতিয়ারএমনকি কোন ভুল বোঝা বুঝির এখানে অবকাশ নেই[21]

হযরত আলী (আ.)-এর যুগে সংঘটিত প্রথম যুদ্ধ যা জংগে জামালনামে পরিচিত, তা শুধুমাত্র শ্রেণী বৈষম্যগত মত পার্থক্যের জঞ্জাল বৈ আর কিছুই ছিল নাঐ মতর্পাথক্য দ্বিতীয় খলিফার দ্বারা বাইতুল মালেরঅর্থ বন্টনের শ্রেণীগত বৈষম্য সৃষ্টির ফলে উদ্ভত হয়েছিলহযরত ইমাম আলী (আ.) খলিফা হওয়ার পর ঐ সমস্যার সমাধান ঘটান এবং তিনি জনগণের মধ্যে সমতা ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে বাইতুল মালেরঅর্থের সুষম বন্টন করেন[22] আর এটাই ছিল হযরত রাসুল (সা.)-এর জীবনার্দশকিন্তু হযরত আলী (আ.)-এর এ পদক্ষেপ তালহা ও যুবাইরকে অত্যন্ত ক্রোধান্বিত করেছিলযার ফলে তারা হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বিরোধীতা করতে শুরু করেনতারা যিয়ারতের নাম করে মদীনা ছেড়ে মক্কায় গেলেনউম্মুল মুমেনীন হযরত আয়েশা তখন মক্কায় অবস্থান করছিলেনতারা এটা ভাল করেই জানতেন যে, ইমাম আলী (আ.)-এর সাথে উম্মুল মুমেনীন আয়েশার সর্ম্পকের টানা পোড়ন চলছেএ অবস্থাকে তারা আপন স্বার্থে কাজে লাগান এবং নবীপত্মী আয়েশাকে খুব সহজেই হযরত আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে নিজপক্ষে টেনে নিতে সমর্থ হনঅতঃপর তৃতীয় খলিফার হত্যার বিচারের দাবীর শ্লোগানে আন্দোলন গড়ে তোলেনঅবশেষে জংগে জামালনামক এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনা করেন[23] অথচ এই প্রসিদ্ধ সাহাবীদ্বয় তাল্‌হা ও যুবায়ের বিপ্লবীদের দ্বারা ওসমানের বাড়ী ঘেরাওকালীন মুহুর্তে মদীনাতেই ছিলেনকিন্তু তৃতীয় খলিফা ওসমানকে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষার ব্যাপারে এতটুকু সাহায্যও তারা করেননি[24] এমনকি খলিফা ওসমান নিহত হওয়ার পর মুহাজিরদের পক্ষ থেকে সর্ব প্রথম তিনিই হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর হাতে বাইয়াতগ্রহণ করেন[25] ওদিকে নবীপত্নী আয়েশাও স্বয়ং ওসমানের বিরোধীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেনতিনি ওসমানকে হত্যার ব্যাপারে সব সময়ই বিরোধীদেরকে উদ্বুদ্ধ করতেন[26] নবীপত্নী আয়েশা ওসমানের নিহত হওয়ার সংবাদ শোনা মাত্রই তার প্রতি অপমান সূচক শব্দ উচ্চারণ করেন এবং আনন্দ প্রকাশ করেনতৃতীয় খলিফাকে হত্যার ব্যাপারে মূলত রাসুল (সা.)-এর সাহাবীরাই জড়িত ছিলেনতারা মদীনার বাইরে বিভিন্ন স্থানে চিঠি পাঠানোর মাধ্যমে জনগণকে খলিফার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করেন

হযরত আলী (আ.)-এর খেলাফতের যুগে দ্বিতীয় যে যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল, তাহচ্ছে সিফফিনের যুদ্ধদীর্ঘ দেড়টি বছর এ যুদ্ধ অব্যাহত থাকেএ যুদ্ধটি ছিল কেন্দ্রীয় খেলাফত প্রসাশন দখলের জন্যে মুয়াবিয়ার চরম লালসার ফসলতৃতীয় খলিফার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের ছলনাময়ী শ্লোগানের ছত্রছায়ায় তিনি এ যুদ্ধের অবতারণা করেনএ যুদ্ধে প্রায় এক লক্ষেরও বেশী লোক অন্যায়ভাবে নিহত হনএ যুদ্ধে মুয়াবিয়াই ছিলেন প্রথম আক্রমনকারীএটা কোন আত্মরক্ষামুলক যুদ্ধ ছিল নাবরং এটা ছিল মুয়াবিয়ার পক্ষ থেকে একটি আক্রমনাত্মক যুদ্ধকারণ, প্রতিশোধ গ্রহণমূলক যুদ্ধ কখনই আত্মরক্ষামূলক হতে পারে নাএ যুদ্ধের শ্লোগান ছিল তৃতীয় খলিফার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণঅথচ তৃতীয় খলিফা তার জীবনের শেষ দিনগুলোতে দেশের রাজনৈতিক অরাজকতা ও বিশৃংখলা দমনে মুয়াবিয়ার কাছে সাহায্য চেয়ে পাঠানমুয়াবিয়াও তার সেনাবাহিনীসহ সিরিয়া থেকে মদিনার দিকে অগ্রসর হনকিন্তু মুয়াবিয়া উদ্দেশ্যমুলক ভাবে পথিমধ্যে এত বেশী দেরী করেন যে, ততদিনে তৃতীয় খলিফা বিপ্লবীদের হাতে নিহত হনএ সংবাদ পাওয়া মাত্রই মুয়াবিয়া তার বাহিনী সহ সিরিয়ায় ফিরে যানএর পর সিরিয়ায় ফিরে গিয়ে তিনি তৃতীয় খলিফার হত্যার বিচারের দাবীতে বিদ্রোহ শুরু করেন[27] সিফ্‌ফিন্তু যুদ্ধের পর নাহরাওয়ান্তু যুদ্ধ সংঘটিত হয়রাসুল (সা.)-এর বেশ কিছু সাহাবীও এ যুদ্ধে জড়িত ছিলেনএকদল লোক যারা সিফফিনেরযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিল, তারাই পরবর্তিতে আবার মুয়াবিয়ার প্ররোচণায় হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেতারা তদানিন্তন ইসলামী খেলাফত বা রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে থাকেতারা হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর অনুসারী বা সমর্থকদের সন্ধান পাওয়া মাত্রই তাদেরকে হত্যা করতএমন কি গর্ভবতী মহিলাদের পেট চিরে গর্ভস্থ সন্তানকে বের করে তাদের মাথা কেটে হত্যা করত[28]

সিফফিন যুদ্ধের পর মুয়াবিয়ার প্ররোচণায় সংঘটিত এ-বিদ্রোহও হযরত ইমাম আলী (আ.) দমন করেনকিন্তু এর কিছুদিন পরই একদিন কুফা শহরের এক মসজিদে নামাযরত অবস্থায় ঐসব খাওয়ারেজদেরহাতেই তিনি শাহাদ বরণ করেন

 

ইমাম আলী (আ.)-এর

পাঁচ বছরের খেলাফতের ফসল

 

হযরত আলী (আ.) তাঁর ৪ বছর ৯ মাসের শাসন আমলে খেলাফত প্রশাসনের স্তুপীকৃত অরাজকতা ও বিশৃংখলাকে সম্পূর্ণরূপে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে যদিও সমর্থ হননি তবুও এ ক্ষেত্রে তিনটি মৌলিক সাফল্য অর্জিত হয়েছিল

নিজের অনুসৃত ন্যায়পরায়ণতা ভিত্তিক জীবনাদর্শের মাধ্যমে জনগণকে এবং বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে মহানবী (সা.)-এর পবিত্র ও আকর্ষনীয় জীবনাদর্শের সাথে পরিচিত করেনমুয়াবিয়ার চোখ ধাঁধানো রাজকীয় জীবন যাপন পদ্ধতির সমান্তরালে তিনি জনগণের মাঝে অতি দরিদ্রতম জীবন যাপন করতেনতিনি কখনো নিজের বন্ধু-বান্ধব, পরিবার বা আত্মীয় স্বজনকে অন্যায়ভাবে অন্যদের উপর অগ্রাধিকার দেননিঅথবা ধনীকে দরিদ্রের উপর বা সক্ষমকে অক্ষমের উপর কখনো তিনি অগ্রাধিকার দেননি

পর্বতসম সমস্যাকীর্ণ দিনগুলো অতিবাহিত করা সত্ত্বেও জনগণের মাঝে তিনি ইসলামের সত্যিকারের অমূল্যজ্ঞান সম্ভার বা সম্পদ রেখে গেছেন

হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বিরোধীরা বলত, ইমাম আলী (আ.) একজন মহাবীর ছিলেনতিনি কোন রাজনীতিবিদ ছিলেন নাকেননা, তিনি বিরোধীদের সাথে সাময়িক বন্ধুত স্থাপন ও তেলমর্দনের মাধ্যমে তিনি পরিতিকে শান্ত করে, নিজের খেলাফতের ভিত্তিকে শক্তিশালী করতে পারতেনঅতঃপর সময় বুঝে তাদের দমন করতে পারতেন

কিন্তু বিরোধীরা একথাটি ভুলেগেছে যে হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর খেলাফত ছিল এক বৈপ্লবিক আন্দোলনআর যে কোন বৈপ্লবিক আন্দোলনকেই সব ধরণের তৈল মর্দন ও মেকী আচরণ নীতিগুলো বর্জন করতে হয়ঠিক একই পরিতি মহানবী (সা.)-এর নবুয়ত প্রাপ্তির যুগেও পরিলক্ষিত হয়মহানবী (সা.)-কে মক্কার কাফের ও মুশরিকরা বহুবার আপোষের প্রস্তাব দিয়ে ছিলতাদের প্রস্তাব ছিল, মহানবী (সা.) যেন তাদের খোদা গুলোর ব্যাপারে প্রকাশ্য বিরোধীতা না করেন, তাহলে তারাও মহানবী (সা.)-এর ইসলাম প্রচারের ব্যাপারে কোন বাধা দেবে নাকিন্তু মহানবী (সা.) তাদের এই প্রস্তাব আদৌ মেনে নেননিঅথচ নবুয়তের চরম দূর্যোগপূর্ণ সেই দিনগুলোতে তৈলমর্দন ও আপোষমুখী নীতি গ্রহণের মাধ্যমে তিনি নিজের রাজনৈতিক অবস্থানকে সুদৃঢ় করতে পারতেনঅতঃপর সময় সুযোগ মত শত্রুদের দমন করতে পারতেনকিন্তু সত্যিকারের ইসলাম প্রচার নীতি কখনই একটি সত্যকে হত্যার মাধ্যমে অন্য একটি সত্যকে প্রতিষ্ঠা বা একটি মিথ্যাকে দিয়ে অন্য একটি মিথ্যাকে অপসারণ করার অনুমতি দেয় নাএ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াত উল্লেখযোগ্য[29]

আবার অন্য দিকে হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর শত্রুরা তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য চরিতার্থের জন্যে যে কোন ধরণের অন্যায় অপরাধ এবং ইসলামের সুস্পষ্ট নীতিলংঘনের ব্যাপারেও কুন্ঠিত হয়নিশুধু তাই নয়, নিজেদের চারিত্রিক কলঙ্ক গুলোকে সাহাবীবা মুজতাহীদ’ (ইসলামী গবেষক) উপাধি দিয়ে আড়াল করার প্রয়াস পেয়েছেনঅথচ হযরত ইমাম আলী (আ.) সব সময়ই ইসলামী নীতিমালার পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণের ব্যাপারে ছিলেন বদ্ধ পরিকর

হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর দ্বারা বর্ণিত জ্ঞান্তবিজ্ঞান, বুদ্ধিবৃত্তিক প্রজ্ঞা এবং সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ক প্রায় এগারো হাজার অমূল্য সংক্ষিপ্ত হাদীস সংরক্ষিত হয়েছে[30] তিনি ইসলামের সুগভীর জ্ঞানরাজীকে অত্যন্ত শুদ্ধ ও উন্নত অথচ প্রাঞ্জল ভাষার বক্তৃতামালায় বর্ণনা করেছেনতিনিই সর্বপ্রথম আরবী ভাষার ব্যাকারণ ও সাহিত্যের মূলনীতি রচনা করেনতিনিই সর্বপ্রথম ব্যক্তি যিনি ইসলামের উচ্চতর দর্শনের সুদৃঢ় ভিত্তিস্থাপন করেন এবং উন্মুক্ত যুক্তি-বিন্যাস ও যৌত্তিক প্রত্যক্ষ প্রমাণের মাধ্যমে ইসলামকে ব্যাখার নীতি প্রচলন করেনসে যুগের দার্শনিকরা তখনও যেসব দার্শনিক সমস্যার সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়ে ছিলেন, তিনি সেসব সমস্যার সমাধান দিয়ে ছিলেনএমন কি এ ব্যাপারে তিনি এতবেশী গুরুত্বারোপ করতেন যে, যুদ্ধের ভয়াবহ ডামাডোলের মাঝেও সুযোগ মত ঐসব জ্ঞানগর্ভ মুলক পর্যালোচনার প্রয়াস পেতেন

হযরত ইমাম আলী (আ.) ব্যাপক সংখ্যক লোককে ইসলামী পন্ডিত ও বিশেষজ্ঞ হিসেবে গড়ে তোলেনইমাম আলী (আ.)-এর কাছে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ঐসব জ্ঞানী-পন্ডিতদের মাঝে হযরত ওয়ায়েস কারানী (রা.), হযরত কুমায়েল বিন যিয়াদ (রা.), হযরত মিসাম তাম্মার (রা.) ও রশীদ হাজারীর (রা.) মত অসংখ্য সাধুপুরুষও ছিলেনযারা ইতিহাসে ইসলামী ইরফানের (আধ্যাত্মবাদ) উস হিসেবে পরিচিতইমাম আলী (আ.)-এর শিষ্যদের মধ্যে আবার অনেকেই ইসলামী ফিকাহ (আইন শাস্ত্র), কালাম (মৌলিক বিশ্বাস সংক্রান্ত শাস্ত্র), তাফসীর, কিরাআত (কুরআনের শুদ্ধপঠন শাস্ত্র) ও অন্যান্য বিষয়ের মুল উস হিসেবে পরিচিত


[1] আল্‌ বিদায়াহ্‌ ওয়ান্‌ নিহায়াহ্‌, ৭ম খন্ড, ৩৬০ নং পৃষ্ঠা

[2] তারীখে ইয়াকুবী, ১১১, ১২৬, ও ১২৯ নং পৃষ্ঠা

[3] মহান আল্লাহ্‌ পবিত্র কুরআনে বলেছেনঃ পবিত্র কুরআন একটি সম্মানিত গ্রন্থ, যার সামনে ও পিছন থেকে কখনই মিথ্য অনুপ্রবেশ করতে পারবে না। –সুরা ফুসসিলাত, ৪১ও ৪২ নং আয়াত

মহান আল্লাহ্‌ আরও বলেছেনঃ একমাত্র আল্লাহ্‌ ব্যতীত নির্দেশ দেয়ার অধিকার আর কারও নেই । –সুরা আল ইউসুফ, ৬৭ নং আয়াত

শরীয়ত বা ইসলামী বিধি বিধানের একমাত্র প্রতিভু আল্লাহ্‌ই, যা নবীর মাধ্যমে জনগণের কাছে পৌঁছানো হয়েছে

এ ব্যাপারে আল্লাহ্‌ বলেনঃ বরং তিনি আল্লাহ্‌র রাসুল এবং সর্বশেষ নবী। –সুরা আল আহযাব, ৪০ নং আয়াতএ আয়াতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ্‌ নবুয়ত ও শরীয়তের (খোদায়ী বিধান) সমাপ্তি ঘোষণা করেছেন

মহান আল্লাহ্‌ আরও বলেনঃ যারা আল্লাহ্‌র অবতীর্ণ বিধান অনুসারে নির্দেশনা প্রদান করে না, তারাই কাফের” –সুরা আল মায়েদা, ৪৪ নং আয়াত

[4] তারীখে ইয়াকুবী, ২য় খন্ড, ১১০ নং পৃষ্ঠাতারীখে আবিল ফিদা, ১ম খন্ড, ১৫৮ নং পৃষ্ঠা

[5] দুররূল মানসুর, ৩য় খন্ড, ১৮৬ নং পৃষ্ঠাতারীখে ইয়াকুবী, ৩য় খন্ড ৪৮ নং পৃষ্ঠাএ ছাড়া পবিত্র কুওআনেও আবশ্যকীয় বিধান সুস্পষ্টযেমনঃ খুম্‌স সম্পর্কিত কুরআনের আয়াতঃ জেনে রাখ! যা কিছু তোমরা লাভ কর তা থেকে এক পঞ্চামাংশ আল্লাহ্‌র, রাসুলের ও রাসুলের আত্মীয় স্বজনের প্রাপ্য। (-সুরা আল্‌ আনফাল, ৪১ নং আয়াত।)

[6] প্রথম খলিফা আবু বকর তার খেলাফত কালে প্রায় পাঁচ শত হাদীস সংগ্রহ করেনউম্মুল মুমিনীন আয়েশা বর্ণনা করেনঃ এক দিন ভোর পর্যন্ত সারা রাত আমার পিতাকে মানসিক অস্থিরতায় ভুগতে দেখেছিসকালে তিনি আমাকে বললেনঃ রাসুল (সঃ)-এর হাদীসগুলো নিয়ে এসোঅতঃপর তিনি আনীত ঐ হাদীসগুলো পুড়িয়ে ফেলেন। (কানযুল উম্মাল, ৫ম খন্ড, ২৩৭ নং পৃষ্ঠা। )

দ্বিতীয় খলিফা ওমর প্রতিটি শহরে লিখিতভাবে এই মর্মে নির্দেশনামা পাঠান যে, যার কাছেই রাসুল (সঃ)-এর হাদীস রয়েছে সে যেন অতি সত্তর তা পুড়িয়ে ফেলে। (-কানযুল উম্মাল, ৫ম খন্ড, ২৩৭ নং পৃষ্ঠা।) মুহাম্মদ বিন আবু বকর বলেনঃ দ্বিতীয় খলিফা ওমরের যুগে রাসুল (সঃ)-এর অসংখ্য হাদীস সংগৃহীত হয়েছিলঐগুলো যখন তার কাছে আনা হল তখন তিনি ওগুলো সব পুড়িয়ে ফেলার র্নিদেশ দেন। (তাবাকাতে ইবনে সা, ৫ম খন্ড, ১৪০ পৃষ্ঠা।)

[7] তারীখে ইবনে আবিল ফিদা, ১ম খন্ড, ১৫১ পৃষ্ঠা, ও অন্যান্য গ্রন্থ সমূহ

[8] মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) তাঁর বিদায় হজের সময় যেসব হাজীরা দূর-দূরান্ত থেকে মক্কায় প্রবেশ করত, তাদের জন্য বিশেষ আইন প্রণয়ন করেন যার উস ছিল পবিত্র কুরআনের এই আয়াত. আর তোমাদের মধ্যে যারা হজ্জ ও ওমরাহ্‌ একত্রে একইসাথে পালন করতে চাও …..’(-সুরা আল্‌ বাকারা -১৯৬ নং আয়াত।) কিন্তু দ্বিতীয় খলিফা তার খেলাফতের যুগে দূর থেকে আগত হাজীদের জন্যে হজ্জের ঐ আইনটি (হজ্জে তামাত্তু) বাতিল ও নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করেনমোতাহ্‌ বা সাময়িক বিবাহ্‌যা আল্লাহ্‌র রাসুল (সঃ)-এর যুগে প্রচালিত ছিল, তাও দ্বিতীয় খলিফা ওমর নিষিদ্ধ ঘোষণা করেনআর তিনি তার নির্দেশ অমান্যকারীদের পাথর মেরে হত্যার বিধান জারী করেনএকইভাবে হযরত রাসুল (সঃ)-এর যুগে, ‘হাইয়্যা আলা খাইরিল আমালঅর্থা উত্তম কাজের (নামাজের) দিকে ধাবিত হওবাক্যটি আযানের মধ্যে উচ্চারিত হত কিন্তু দ্বিতীয় খলিফা ওমর তার শাসন আমলে বলেনঃ এ বাক্যটি জনগণকে জিহাদে অংশ গ্রহণ থেকে বিরত রাখতে পারে! তাই তিনি তার খেলাফতের যুগে আযানে ঐ বাক্যটি উচ্চারণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেনহযরত রাসুলের (সা.) যুগে তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী মাত্র এক বৈঠকে একটির বেশী তালাকপ্রদান বৈধ বলে গৃহীত হত নাকিন্তু দ্বিতীয় খলিফা ওমর তার শাসন আমলে একই বৈঠকে তিনটি তালাকপ্রদান জায়েয বলে ঘোষণা দেন!! একই বৈঠকে তিন তালাক গৃহীত হওয়ার বৈধতা তিনিই প্রথম ঘোষণা করেনউল্লেখিত বিষয় গুলো, হাদীস গ্রন্থ ও শীয়া এবং সুন্নী মাযহাবের ফেকাহ্‌ ও কালামশাস্ত্রের গ্রন্থে অত্যন্ত প্রসিদ্ধ

[9] তারীখে ইয়াকুবী ২য় খন্ড, ১৩১ নং পৃষ্ঠাতারীখে আবিল ফিদা, ১ম খন্ড, ১৬০ নং পৃষ্ঠা

[10] উসদুল গাবা, ৪র্থ খন্ড, ৩৮৬ নং পৃষ্ঠাআল-ইসাবাহ, ৩য় খন্ড দ্রষ্টব্য

[11] তারীখে ইয়াকুবী, ২য় খন্ড, ১৫০ নং পৃষ্ঠাতারীখে আবিল ফিদা, ১ম খন্ড, ১৬৮ নং পৃষ্ঠাতারীখে তাবারী, ৩য় খন্ড, ৩৭৭ নং পৃষ্ঠা

[12] তারীখু ইয়াকুবী, ২য় খন্ড, ১৫০ নং পৃষ্ঠাতারীখে তাবারী, ৩য় খন্ড, ৩৯৮ নং পৃষ্ঠা

[13] মিসরবাসীদের একটি দল তৃতীয় খলিফা ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেখলিফা এতে বিপদের আশংকা করলেনতিনি এ ব্যাপারে হযরত আলী (আঃ)-এর সহযোগিতা প্রার্থনা করেন এবং কৃতকর্মের জন্যে অনুশোচণা প্রকাশ করেনতখন হযরত আলী (আঃ) মিসরবাসীদের উদ্দেশ্যে বলেনঃ তোমরাতো সত্যের বিজয়ের জন্যেই বিদ্রোহ করেছআর ওসমানও তার কুর্কমের জন্য অনুতপ্ত এবং তওবা করেছেনতিনি বলেছেনঃ আমি আমার অতীত কৃতর্কম থেকে হাত গুটিয়ে নিচ্ছিআগামী তিন দিনের মধ্যেই তোমাদের দাবী-দাওয়া আমি বাস্তবায়ন করব এবং সকল অত্যাচারী প্রশাসকদের বরখাস্ত করবএর পর হযরত আলী (আঃ) তৃতীয় খলিফা ওসমানের পক্ষ হয়ে একটি সন্ধিপত্র প্রসত করেনঅতঃপর বিদ্রোহীরা নিজ নিজ স্থানে ফিরে যায় কিন্তু বিদ্রোহীরা বাড়ী ফেরার পথে তৃতীয় খলিফা ওসমানের জনৈক ক্রীতদাসকে তাঁরই উটে চড়ে মিশরের দিকে যেতে দেখলবিদ্রোহীরা সন্দিহান হয়ে ঐ ক্রীতদাসকে থামিয়ে তল্লাশী চালায়ঘটনাক্রমে ঐ ক্রীতদাসের কাছে মিশরের প্রশাসককে লেখা তৃতীয় খলিফা ওসমানের একটি চিঠি তারা উদ্ধার করেঐ চিঠিতে এ ভাবেই লেখা ছিলঃ আল্লাহ্‌র নামে শুরু করছিযখন আব্দুর রহমান বিন উদাইস্‌ তোমার নিকট পৌঁছবে, তাকে ১০০টি চাবুক মারবেতার চুল ও দাড়ি কামিয়ে ফেলবে এবং সুদীর্ঘ কারাবাসে নিবদ্ধ করবেআর ওমর বিন আল- হামাক, সুদান বিন হামরান, এবং উরওয়া বিন নাবার ব্যাপারেও একই নির্দেশ জারী করবেবিদ্রোহীরা অত্যন্ত ক্ষিপ্ত অবস্থায় ঐ চিঠি সহ ওসমানের কাছে ফিরে এসে বললঃ আপনি আমাদের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করেছেনকিন্তু ওসমান ঐ চিঠির বিষয়টি সম্পূর্ণ অস্বীকার করেনজবাবে বিদ্রোহীরা বললোঃ আপনার ক্রীতদাসই এই চিঠিটার বাহকওসমান বললেনঃ সে আমার বিনা অনুমতিতে এ কাজ করেছে”! তারা বললঃ সে আপনার উটেই চড়ে যাচ্ছিলতিনি বললেনঃ সে আমার উট চুরি করেছে’! তারা বললোঃ চিঠিতো আপনার ব্যক্তিগত সেক্রেটারীর লেখাতিনি বললেনঃ সে আমাকে অবহিত না করেই এ কাজ করেছে’! তারা বললোঃ তাহলে তো খেলাফতের কাজ পরিচালনা করার মত যোগ্যতা আদৌ আপনার নেইশিগ্‌গীর ইস-ফা দিনকারণ যদি প্রকৃতপক্ষে এ কাজ আপনার দ্বারাই ঘটে থাকে, তাহলে অবশ্যই খিয়ানত করেছেনআর যদি এসব গুরুত্বপূর্ণ কাজ আপনার বিনা অনুমতিতে হয়ে থাকে তবে খেলাফতের ব্যাপারে আপনার অযোগ্যতা ও ব্যর্থতাই প্রমাণিত হলসুতরাং ইস্তফা দিন, তানাহলে অত্যাচারী প্রশাসকদের বরখাস্ত করুনএর উত্তরে ওসমান বললেনঃ আমাকে যদি তোমাদের কথা মেনে চলতে হয়, তাহলে তো তোমরাই আমার শাসনকর্তাসেখানে আমি কোন জন? তৃতীয় খলিফার এধরণের উত্তরে বিদ্রোহীরা চরমভাবে রাগান্বিত হয়ে ওঠে এবং বৈঠক ত্যাগ করে। (তারীখে তাবারী, ৩য় খন্ড ৪০২- ৪০৯ নং পৃষ্ঠাতারীখে ইয়াকুবী, ২য় খন্ড ১৫০- ১৫১ নং পৃষ্ঠা।)

[14] তারীখে তাবারী, ৩য় খন্ড, ৩৭৭ নং পৃষ্ঠা

[15] সহীহ্‌ বুখারী, ৬ষ্ঠ খন্ড, ৮৯ নং পৃষ্ঠাতারীখে ইয়াকুবী, ২য় খন্ড, ১১৩ নং পৃষ্ঠা

[16] তারীখে ইয়াকুবী, ২য় খন্ড, ১১১ নং পৃষ্ঠাতারীখে তাবারী, ৩য় খন্ড, ১২৯-১৩২ নং পৃষ্ঠা

[17] তারীখে ইয়াকুবী, ২য় খন্ড ১১৩ নং পৃষ্ঠাশারহু ইবনি আবিল হাদীদ, ১ম খন্ড, ৯ নং পৃষ্ঠাইতিহাসে পাওয়া যায় যে, প্রথম খলিফা আবুবকর খেলাফতের বাইয়াতপ্রাপ্তির পর পরই হযরত আলী (আঃ)-এর নিকট থেকে তাঁর বাইয়াতপ্রাপ্তির জন্য লোক পাঠানকিন্তু হযরত আলী (আঃ) উত্তর দিলেন, “আমি প্রতিজ্ঞা করেছি যে, কেবল মাত্র নামায ছাড়া আর অন্য কোন কারণে বাড়ীর বাইরে যাব না, যাতে করে আমি কুরআন সংগ্রহের কাজ সম্পন্ন করতে পারিইতিহাসে আরও পাওয়া যায় যে, রাসুল (সঃ)-এর মৃত্যুর প্রায় ছয় মাস পর তিনি আবু বকরের বাইয়াতগ্রহণ করেন

এ ঘটনাটি কুরআন সংগ্রহের কাজ সমাপ্ত হওয়ার একটি প্রমাণ স্বরূপঅতঃপর হযরত আলী (আঃ) নিজ সংগৃহীত কুরআনকে উটের পিঠে করে জনগণের নিকট নিয়ে তাদেরকে দেখানঅথচ ইয়মামারযুদ্ধের পর যখন কুরআন সংগ্রহের কাজ শুরু করা হয় সেটা ছিল প্রথম খলিফা আবু বকরের খেলাফতের দ্বিতীয় বছরএ সমস্ত ঘটনা ইসলামের ইতিহাস সহ বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে

[18] তারীখে ইয়াকুবি, ২য় খন্ড, ১৫৪ নং পৃষ্ঠা

[19] তারীখে ইয়াকুবি, ২য় খন্ড, ১৫৫ নং পৃষ্ঠামুরুযুয্‌ যাহাব, ২য় খন্ড, ৩৬৪ নং পৃষ্ঠা

[20] নাহজুল বালাগা, ১৫ নং বক্তৃতা

[21] মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর পর হযরত আলী (আ.)-এর অনুসারী মুষ্টিমেয় কিছু সাহাবী খলিফার বাইয়াত’ (আনুগত্য প্রকাশ) গ্রহণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেনএই সংখ্যালঘু গোষ্ঠির শীর্ষে ছিলেন হযরত সালমান ফারসী (রা.), হযরত আবুযার (রা.), হযরত মিকদাদ (রা.) এবং হযরত আম্মার (রা.)একই ভাবে স্বয়ং হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর খেলাফতের সময়ও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কিছুলোক তার বাইয়াতগ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়এ সব বিরোধীদের মধ্যে সবচেয়ে কঠোরপন্থীরা ছিলেন, জনাব সাইদ বিন আস, ওয়ালিদ বিন উকবা, মারওয়ান বিন হাকাম, ওমর বিন আস, বাসার বিন এরাদা, সামার নিজান্দা, মুগাইরা বিন শুআবা ও আরো অনেকেখেলাফতের যুগের এ দুই বিরোধী পক্ষের লোকদের সবার ব্যক্তিগত জীবনী এবং তাদের ঐতিহাসিক কার্যকলাপ যদি আমরা সুক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা করি, তাহলে তাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য আমাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবেপ্রথম বিরোধী পক্ষের সদস্যরা সবাই ছিলেন হযরত রাসুল (সা.)-এর বিশেষ সাহাবী বৃন্দতাঁরা সংযম সাধনা, ইবাদত, আত্মত্যাগ, খোদা ভীরুতা, ইসলামী চেতনার দিক থেকে রাসুল (সা.) এর বিশেষ প্রিয় পাত্রদের অন্তরভূক্ত ছিলেনমহানবী (সা.) এঁদের সর্ম্পকে বলেছেনঃ মহান আল্লাহ্‌ আমাকে অবগত করেছেন যে চারজন ব্যক্তিকে তিনি ভাল বাসেনআর আমাকে আদেশ দিয়েছেন, আমিও যেন তাঁদেরকে ভাল বাসিসবাই ঐ ব্যক্তিদের নাম জিজ্ঞেস করলে, এর উত্তরে পর পর তিনবার তিনি প্রথম আলী (আ.) অতঃপর সালমান (রা.), আবুযার (রা.) ও মিকদাদের (রা.) নাম উচ্চারণ করেন” (সুনানে ইবনে মাজা, ১ম খন্ড, ৬৬ নং পৃষ্ঠা।) হযরত আয়েশা (রা.) বলেনঃ হযরত রাসুল (সা.) বলেছেনঃ ‘‘যে দুটি বিষয় আম্মারের (রা.) প্রতি উপস্থাপিত হবে, আম্মার (রা.) অবশ্যই ঐ দুক্ষেত্রে সত্যকেই বেছে নেবে’’ (ইবনে মাজা ১ম খন্ড, ৬৬ নং পৃষ্ঠা। )

মহানবী (সা.) বলেছেনঃ ‘‘আকাশ ও পৃথিবীর মাঝে আবুযারের (রা.) চেয়ে অধিকতর সত্যবাদী আর কেউ নেই’’ (ইবনে মাজা, ১ম খন্ড, ৬৮ নং পৃষ্ঠা।) এদের কারও জীবন ইতিহাসেই শরীয়ত বিরোধী একটি কাজের উল্লেখ পাওয়া যায় নাএরা কেউ অন্যায়ভাবে কোন রক্তপাত ঘটাননিঅন্যায়ভাবে কারও অধিকার কখনও হরণ করেননিকারও অর্থসম্পদ কখনও ছিনিয়ে নেননিজনগণের মাঝে তারা কখনই দূর্নীতি ও পথ ভ্রষ্টতার প্রসারে লিপ্ত হননিকিন্তু দ্বিতীয় বিরোধী পক্ষের ব্যক্তিদের জঘণ্য অপরাধ ও ধ্বংসাত্বক কর্মকান্ডের অসংখ্য সাক্ষীতে ইতিহাস পরিপূর্ণইতিহাসে অন্যায়ভাবে প্রচুর রক্তপাত তারা ঘটিয়েছেনমুসলমানদের ধনসম্পদ লুন্ঠন করেছেনএতসব লজ্জাকর কান্ড তারা ঘটিয়েছেন যে, তা গুনে শেষ করাও কঠিনতাদের ঐ সব ঐতিহাসিক অপরাধের আদৌ কোন যুক্তিপূর্ণ অজুহাত খুঁজে পাওয়া যায় নাতাদের ঐ সব কুকর্মের মোকাবিলায় শুধুমাত্র এটা বলেই সান্তনা দেয়া হয় যে, তারা যত অপরাধই করুক না কেন, আল্লাহ্‌ তো তাদের প্রতি সন্তুষ্ট (রাদিয়াল্লাহু আনহু)কুরআন বা সুন্নায় উল্লেখিত ইসলামী আইন অন্যদের জন্য, ওসব সাহাবীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়!!

[22] মুরুযুয্‌ যাহাব, ২য় খন্ড, ৩৬২ নং পৃষ্ঠানাহজুল বালাগা, ১২২ নং বক্তৃতাতারীখে ইয়াকুবী, ২য় খন্ড, ১৬০ নং পৃষ্ঠাশারহু্‌ ইবনি আবিল হাদীদ, ১ম খন্ড, ১৮০ নং পৃষ্ঠা

[23] তারীখে ইয়াকুবী, ২য় খন্ড, তারীখে আবিল ফিদা, ১ম খন্ড, ১৭২ নং পৃষ্ঠামুরুযুয্‌ যাহাব, ২য় খন্ড, ৩৬৬ নং পৃষ্ঠা

[24] তারীখে ইয়াকুবী, ২য় খন্ড, ১৫২ নং পৃষ্ঠা

[25] মুরুযুয্‌ যাহাব, ২য় খন্ড, ৩৬২ নং পৃষ্ঠানাহজুল বালাগা, ১২২ নং বক্তৃতাতারীখে ইয়াকুবী, ২য় খন্ড, ১৬০ নং পৃষ্ঠাশারহু্‌ ইবনি আবিল হাদীদ, ১ম খন্ড, ১৮০ নং পৃষ্ঠা

[26] তারীখে ইয়াকুবী, ২য় খন্ড, তারীখে আবিল ফিদা, ১ম খন্ড, ১৭২ নং পৃষ্ঠামুরুযুয্‌ যাহাব, ২য় খন্ড, ৩৬৬ নং পৃষ্ঠা

[27] তৃতীয় খলিফা যখন বিপ্লবীদের দ্বারা নিজ বাড়ী ঘেরাও অবস্থায় কাটাচ্ছিলেনতখন এ অবস্থার নিরসন কল্পে সাহায্য চেয়ে তিনি মুয়াবিয়ার কাছে পত্র পাঠানমুয়াবিয়া উক্ত পত্র পেয়ে প্রায় বারো হাজার সৈনের একটি সেনাবাহিনীকে অস্ত্রেশস্ত্রে সুসজ্জিত করেনতিনি ঐ সেনাবাহিনী সহ সিরিয়া থেকে মদীনার দিকে রওনা দেনকিন্তু এর পরই তিনি আপন সেনাবাহিনীকে সিরিয়া সীমান্তে অবস্থান করার নির্দেশ দেনঅতঃপর সেনাবাহিনী ঐ অবস্থায় রেখে তিনি একাই মদীনায় গিয়ে তৃতীয় খলিফার সাথে সাক্ষাত করেন এবং খলিফাকে সাহায্যের জন্যে তার প্রয়োজনীয় সামরিক প্রস্ততি চুড়ান্তের প্রতিবেদন পেশ করেনতৃতীয় খলিফা এর প্রত্যুত্তরে বলেনঃ তুই উদ্দেশ্য-মুলকভাবে সেনাবাহিনীর অভিযান থামিয়ে রেখে এসেছিস, যাতে করে আমি নিহত হই আর আমার হত্যার প্রতিশোধের বাহানায় তুই বিদ্রোহ করার সুযোগ পাসতাই নয় কি? (তারীখে ইয়াকুবী, ২য় খন্ড, ১৫২ নং পৃষ্ঠামুরুযুয যাহাব, ৩য় খন্ড ২৫ নং পৃষ্ঠাতারীখে তাবারী, ৪০২ নং পৃষ্ঠা’)

[28] মুরুযুয যাহাব, ২য় খন্ড ৪১৫ নং পৃষ্ঠা

[29] পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেছেনঃ তাদের কতিপয় বিশিষ্ট ব্যক্তি একথা বলে প্রস্থান করে যে, তোমরা চলে যাও এবং তোমাদের উপাস্যদের পুজায় দৃঢ় থাক’’(-সুরা আস্‌ সোয়াদ, ৬ নং আয়াত।)

আল্লাহ আরও বলেছেনঃ ‘‘আমি আপনাকে দৃঢ়পদ না রাখলে আপনি তাদের প্রতি প্রায় কিছুটা ঝুকে পড়তেন’’(-সুরা আল ইসরা, ৭৪ নং আয়াত।)

মহান আল্লাহ বলেছেনঃ ‘‘তারা চায় যে, তুমি নমনীয় হও, তাহলে তারাও নমনীয় হবে’’(-সুরা আল কালাম, ৯ নং আয়াত।) উপরোক্ত আয়াত গুলোর হাদীস ভিত্তিক তাফসির দ্রষ্টব্য

[30]কিতাবুল গারার ওয়াদ দারার আমাদি, ও মুতাফাররিকাতু জাওয়ামিউ হাদীস

Leave A Reply

Your email address will not be published.