সূরা বাকারা

0 880

আমরা জানি বর্তমান উন্নত বিশ্বে কিছু তৈরী করা হলে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ক্রেতাকে যন্ত্রের সাথে একটি নির্দেশিকা পুস্তিকাও সরবরাহ করে থাকে। ঐ পুস্তিকায় যন্ত্রের খুটিনাটি দিক, বৈশিষ্ট্য, ব্যবহারের নিয়মাবলী, যন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন দিক বলে দেয়া হয়; যাতে ক্রেতা ঐ যন্ত্র ব্যবহার করতে পারে এবং এমন কোন কাজ না করে যাতে দ্রুত ঐ যন্ত্রটি নষ্ট হয়ে যায়। আমি, আপনি, আমরা সব মানুষ এক ধরনের অত্যাধুনিক যন্ত্র, যাদেরকে এক মহা ক্ষমতাবান সত্ত্বা সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু আমাদের দেহ, আত্মা ও মনের মধ্যে নানা দুর্বলতা ও অজানা সব জটিলতার কারণে আমরা নিজেদের সম্পর্কে ভালোভাবে জানিনা এবং সৌভাগ্য ও কল্যাণের পথ আমাদের জানা নেই। তাছাড়া আমরা কি টেলিভিশন কিংবা রেফ্রিজারেটরের চেয়ে নগণ্য কিছু? যে কারণে এ সব যন্ত্রের নির্মাতারা এসবের সাথে নির্দেশিকা পুস্তিকা দেবেন অথচ আমাদের স্রষ্টা আমাদের জন্য কোন বই বা পুস্তিকা লিখে দেবেন না?

আমাদের দৈহিক ও আত্মিক বৈশিষ্ট্যের বর্ণনাকারী এবং আমাদের যোগ্যতা, প্রতিভা ও ক্ষমতার বর্ণনাদানকারী কোন নির্দেশিকা বইয়ের কি কোন প্রয়োজন নেই? মানুষ কোন পথে চলবে এবং কোন পথে কি ভাবে তার শক্তি ও যোগ্যতা কাজে লাগাবে, সেসবের বর্ণনা ও দিক নির্দেশনার কি কোন প্রয়োজন নেই? যেসব বিষয় মানুষের দেহ, মন ও আত্মার জন্য ক্ষতিকর এবং তাকে অকল্যাণের দিকে পরিচালিত করে সেসবের বর্ণনার কি কোন দরকার নেই? যে মহান স্রষ্টা তার অসীম জ্ঞান, ভালোবাসা ও দয়া দিয়ে আমাদের সৃষ্টি করেছেন তিনি আমাদেরকে এমনিই ছেড়ে দেবেন-এটা কি হতে পারে? না, এমনটি হতে পারে না। তাই আল্লাহপাক মানবজাতির পথ-নির্দেশনার জন্য সর্বশেষ আসমানী গ্রন্থ পবিত্র কোরআন পাঠিয়েছেন। যার মধ্যে মানুষ কিভাবে সুখী হতে পারে এবং কি কারণে সে দুর্দশাগ্রস্ত হবে ও ধ্বংসের মুখে পড়বে তার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনে সুস্থ সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্ক, মানুষের নৈতিকতা, অধিকার, দেহ ও আত্মার খোরাক, ব্যক্তিগত ও সামাজিক দায়িত্ব, সমাজের সঠিক ও ভুল রীতি-নীতি, অর্থনৈতিক দিক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এছাড়াও ব্যক্তি ও সমাজের সুখ-সমৃদ্ধি এবং অকল্যাণের সাথে জড়িত বহু বিষয় এই আসমানী গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে বিভিন্ন অতীত জাতির কাহিনী, যুদ্ধ-সংঘাত, বিভিন্ন নারী-পুরুষের জীবন পদ্ধতি তুলে ধরা হলেও এটি কোন গল্পের বই নয় বরং এটি আমাদের বর্তমান জীবনের জন্য এক মহা শিক্ষণীয় বই।

তাইতো এই গ্রন্থের নাম কোরআন অর্থাৎ পাঠযোগ্য বই। এ বইটিকে তেলাওয়াত করতে হবে। অবশ্য শুধু মুখে মুখে তেলাওয়াত করলেই চলবেনা। কারণ এ ধরনের পড়াতো ছোটদের পড়া। বরং গভীর চিন্তা-ভাবনার সাথে পাঠ করতে হবে। অবশ্য পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক নিজেই এ ধরনের তেলাওয়াত করতে বলেছেন।

আমরা জানি পবিত্র কোরআনে ১১৪ টি সূরা রয়েছে এবং প্রত্যেক সূরায় রয়েছে বেশ কয়েকটি আয়াত। পবিত্র কোরআনের প্রথম সূরাটিকে ফাতেহাতুল কিতাব বলা হয় যা কিনা সাধারণত: সূরা হামদ নামে পরিচিত। এই সূরাটি দিয়ে কোরআন শুরু হয়েছে বলে একে ফাতেহাতুল কিতাব বা সূরা ফাতেহা বলা হয়। সাত আয়াত বিশিষ্ট এ সূরার গুরুত্ব সম্পর্কে শুধু এতটুকুই বলতে হয় যে প্রতিদিন নামাজে দশ বার এই সূরা পড়া ফরজ এবং এছাড়া নামাজ শুদ্ধ হবে না। ঐশী কিতাবের সূচনাকারী এই সূরাটি এমন এক আয়াত দিয়ে শুরু হয়েছে, যার মাধ্যমে কোন কাজ করলে ঐ কাজের পরিণতি শুভ হয়। এবারে এ আয়াতটির উপর আলোকপাত করব। সূরা ফাতেহার প্রথম আয়াতটি হলো-

” বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” অর্থাৎ পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লার নামে।

অতীতকাল থেকে মানুষের চিরাচরিত রীতি ছিল তাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজ কোন মহৎ ও বিশিষ্ট ব্যক্তির নামে শুরু করা, যাতে ঐ কাজটি সফল হয় এবং এর বরকত বাড়ে। যেমন মূর্তিপূজকেরা তাদের পূজনীয় কোন মূর্তির নাম আওড়ায় কাজের সফলতার জন্য। আজকাল রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তির নামে বা তার উপস্থিতিতে বিভিন্ন কাজের উদ্বোধন করা হয়। কিন্তু সব কিছুর উপরে এবং সর্বশক্তিমান হলেন, মহান আল্লাহ্‌। তাঁরই ইচ্ছায় অসি-ত্বের শুরু এবং বিশ্বজাহানের সবকিছু সৃষ্টি হয়েছে। শুধু বিশ্ব প্রকৃতি নয় বরং শরীয়ত অর্থাৎ কোরআন সহ সকল আসমানী গ্রন্থ তাঁরই নামে শুরু হয়েছে। এছাড়াও ইসলামে ছোট-বড় সব কাজ, খাওয়া-পরা, লেখা-জোখা, ভ্রমণ, ঘুমানো, ইত্যাদি যে কোন কিছু শুরুর আগে আমাদেরকে বিসমিল্লাহ্‌ বলতে বলা হয়েছে। কোন পশু যদি আল্লার নাম উচ্চারণ করা ছাড়া জবাই করা হয় তাহলে তার গোশ্‌ত খেতে নিষেধ করা হয়েছে। বিসমিল্লাহ্‌ শুধু ইসলাম ধর্মের নির্ধারিত কিছু নয়। কারণ পবিত্র কোরআনেই দেখা যায় হজরত নূহ(আ:)এর কিশ্‌তীর যাত্রা শুরু হয়েছিল বিসমিল্লাহ্‌ দিয়ে। হজরত সোলায়মান(আ:)ও সারা রাজ্যের রানী বিলকিসকে যে চিঠি লিখেছিলেন তা শুরু করেন বিসমিল্লাহ বলে। আমাদের বিশ্বাস-বিসমিল্লাহ একটি পূর্ণাঙ্গ আয়াত এবং সূরা ফাতেহার অংশ। কারণ রাসূলে খোদা(সা:)এর আহলে বাইত বা নবী বংশের সদস্যরা নামাজে কাউকে বিসমিল্লাহ্‌ পড়তে দেখলে কিংবা নি:শব্দে বিসমিল্লাহ্‌ বলতে দেখলে রাগ করতেন। তাঁরা নিজেরা সব নামাজে এই আয়াতটি জোরে শব্দ কোরে পড়তেন।

বিসমিল্লাহ্‌ থেকে আমাদের কয়েকটি প্রধান শিক্ষণীয় বিষয় হলো-প্রথমত: বিসমিল্লাহ্‌ ও খোদার নাম উচ্চারণ থেকে আল্লাহর প্রতি ভরসা ও তাঁর কাছ থেকে সাহায্য প্রার্থনার বিষয়টি বোঝা যায়। আল্লাহর নাম প্রত্যেক কাজে বরকতের উৎস। দ্বিতীয়ত: বিসমিল্লাহ্‌ আয়াতটি প্রত্যেক কাজকে আল্লাহর রঙে রঞ্জিত করে এবং মানুষের কাজকে শিরক বা অংশীবাদ থেকে দূরে সরিয়ে রাখে। তৃতীয়ত: বিসমিল্লাহ্‌ মানে-হে আল্লাহ্‌ আমি তোমাকে ভুলিনি, তুমিও আমাকে ভুলো না। যে ব্যক্তি বিসমিল্লাহ্‌ বলে সে নিজেকে আল্লাহর অসীম শক্তি ও অপার করুণার সাথে সংযুক্ত করে। #

সুপ্রিয় পাঠক , কোরআনের আলোর গত পর্বে আমরা সূরা ফাতেহার তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা করেছিলাম এবং এই সুরার প্রথম আয়াত “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম” এর ব্যাখ্যা দিয়েছিলাম। এবারে আমরা এই সূরার দ্বিতীয় থেকে ৫ম আয়াত নিয়ে আলোচনা করবো। সূরা ফাতেহার দ্বিতীয় আয়াত হলো ‘‘আলহামদুলিল্লাহে রাব্বিল আলামীন”। অর্থাৎ সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর যিনি জগতসমুহের প্রতিপালক।

আল্লাহর নাম ও তাঁকে স্মরণ করার পর আমাদের প্রথম বাক্য হলো আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন। জগতের সকল বৃদ্ধি, প্রতিপালন সবই তাঁর হাতে। আসমান-জমিনের সকল জীব-জন্তু, গাছ-পালা ও জড়বস্তু তাঁরই নিয়ন্ত্রণে। হ্যাঁ, আল্লাহই মৌঁমাছিকে শিক্ষা দিয়েছেন কিভাবে খাবার সংগ্রহ করতে হবে এবং কিভাবে মধুর চাক তৈরী করতে হবে। তিনি পিঁপড়াকে শীতের খাদ্য জমা করার শিক্ষা দিয়েছেন। তিনিই একটি ধান থেকে অসংখ্য ধানের শীষের জন্ম দেন এবং আপেলের ক্ষুদ্র বীজ থেকে আপেল গাছ তৈরী করেন। তিনিই এই বিস্তীর্ণ আকাশ সৃষ্টি করেছেন এবং আসমানের প্রতিটি গ্রহ-নক্ষত্রের কক্ষপথ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এই আল্লাহ আমাদেরকে দূর্গন্ধময় পানি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং মাতৃগর্ভে ধীরে ধীরে পরিপুষ্ট করে তুলেছেন। জন্মের পর আমাদের জন্য বেড়ে ওঠার উপকরণ দান করেছেন। আমাদের দেহকে এমন ভাবে তৈরী করেছেন যাতে অসুখ-বিসুখের মোকাবেলা করতে পারে কিংবা হাড় ভেঙ্গে গেলে জোড়া লাগাতে পারে এবং দেহে রক্তের প্রয়োজন হলে পুণরায় রক্ত উৎপাদন করতে পারে। আল্লাহর হাতে যে শুধু আমাদের দৈহিক বৃদ্ধি ও লালন-পালনই নির্ভর করছে তাই নয়, আমাদের আত্মিক ও মানসিক গঠন, বিকাশ ও পথপ্রদর্শন তাঁরই হাতে। তিনি আমাদেরকে বিবেক-বুদ্ধি দান করেছেন এবং আমাদেরকে গড়ে তোলার জন্য প্রেরণ করেছেন আসমানী গ্রন্থ ও নবী-রাসূল। যাই হোক সূরা ফাতেহার এই আয়াত থেকে আমরা যে শিক্ষা লাভ করি তা হলো শুধু জন্ম ও সৃষ্টির ক্ষেত্রেই আমরা আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীল নই বরং আমাদের প্রতিপালনও তাঁর হাতে। সৃষ্টির সাথে তাঁর সম্পর্ক চিরস্থায়ী ও অবিচ্ছেদ্য। তাই আমাদেরও উচিত তাঁর নিয়ামতের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা। আরেকটি বিষয় হলো শুধু দুনিয়াতেই নয়, কেয়ামতের দিনও বেহেশতবাসীদের কথা হবে-“আলহামদুলিল্লাহে রাব্বিল আলামীন”। অর্থাৎ সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর যিনি জগতসমূহের প্রতিপালক।

এবারে ৩য় আয়াত নিয়ে আলোচনা করব। “আর রাহমানির রাহিম” অর্থাৎ যিনি পরম করুণাময় অসীম দয়ালু। আমরা যে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখি, তিনি হলেন-দয়ালু, ক্ষমাপরবশ ও পরম দয়াময়। আমাদের জন্য তিনি যে অশেষ নিয়ামত সৃষ্টি করেছেন সে সবের মধ্যে প্রতিনিয়ত তাঁর দয়া ও ভালোবাসা দেখতে পাই। সুন্দর ও সুগন্ধি ফুল, সুস্বাদু ফল-মূল, মজার মজার খাবার, রং-বেরঙের পোশাক এ সব কিছু আমাদের জন্য আল্লাহর দান। সন্তানের প্রতি মায়ের ভালবাসাকে তিনি মায়েদের মন ও প্রাণে সঁপে দিয়েছেন এবং তিনি আমাদের প্রতি যে কোন মায়ের চেয়ে দয়ালু। আল্লাহর যে শাস্তি ও ক্রোধ তা কেবল গুনাহগার বান্দাদেরকে সাজা দেয়ার জন্য। কোন রকম বিদ্বেষ বা প্রতিহিংসাবশত: নয়। তাই আমরা যদি তওবা করি এবং অতীতের অপরাধ পুষিয়ে নেই তাহলে তিনি আমাদের গুনাহ ও পাপকাজ ক্ষমা করে দেন এবং আমাদের দোষ ত্রুটি ঢেকে রাখেন। সূরা ফাতেহার তৃতীয় আয়াত থেকে আমাদের জন্য কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো: আল্লাহপাক তাঁর সৃষ্টিকে দয়া ও ভালোবাসা দিয়ে প্রতিপালন করেন। কারণ রাব্বিল আলামীনের আগে এবং পরে তিনি আররাহমানির রাহিম হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়েছেন। অর্থাৎ প্রতিপালনকে দুই দয়ার মাঝে স্থান দিয়েছেন। প্রতিপালন ও শিক্ষাদান দয়া ও ক্ষমা দিয়ে শুরু হয়েছে এবং দয়া ও ক্ষমা দিয়েই সম্পন্ন হয়। তাই সমাজের শিক্ষক ও পথপ্রদর্শকরা যদি সফল হতে চান, তাহলে তাদেরকেও প্রেম, দয়া ও ভালবাসা নিয়ে কাজ করতে হবে।

এবারে সূরা ফাতেহার ৪র্থ আয়াত নিয়ে আলোচনা করব। “মালিকি ইয়াওমিদ্দিন” অর্থাৎ বিচার দিনের মালিক। আরবী দ্বীন শব্দটির অর্থ ধর্ম ও মতবাদ। এ শব্দটি পুরস্কার ও প্রতিদান অর্থেও ব্যবহৃত হয়। এখানে ইয়াওমিদ্দিন এর অর্থ হলো পুনরুত্থান দিবস। যে দিন সব কাজের হিসাব-নিকাশ, প্রতিদান, শাস্তি ও পুরস্কার দেয়া হবে। অবশ্য এখানে একটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা দরকার, আর সেটি হলো আল্লাহপাক দুনিয়ারও প্রভু আবার আখেরাতেরও প্রভু। কিন্তু কেয়ামতের দিন তার মালিকানা ও প্রভুত্বের রুপ ভিন্ন সে দিন কেউ কোন কিছুর মালিক নয়। অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন কিছুই নিজের বলে থাকবে না। বন্ধু-বান্ধব এবং আত্মীয়-স্বজনও কোন কাজে আসবে না। এমনকি নিজ দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উপরও মানুষের কোন অধিকার থাকবে না। না মুখ ও জিভ কোন অজুহাত দেখাতে পারবে, না মস্তিস্ক চিন্তার সুযোগ পাবে। একমাত্র আল্লাহই হবেন সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান ও নিয়ন্ত্রণকারী।

এই আয়াতটি থেকে আমাদের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো: পূর্বের আয়াতে আল্লাহর অশেষ দয়ার প্রতি আশাবাদী হবার পাশাপাশি কেয়ামতের দিনের বিচার ও হিসাব-নিকাশের ব্যাপারেও চিন্তা করতে হবে। বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাস থাকায় আমাদের ভয় ও শঙ্কার কিছু নেই। কারণ দুনিয়ার সব ভালো কাজের পুরস্কার ও প্রতিদান ঐ দিন দেয়া হবে। এ আয়াতের আরেকটি শিক্ষণীয় দিক হলো আল্লাহপাক আমাদের ভালো-মন্দ সব কাজ সম্পর্কে পূর্ণ অবগত এবং সে সব মন্দ কাজের শাস্তি ও ভালো কাজের পুরস্কার দানে সক্ষম।

সূরা ফাতেহার পঞ্চম আয়াতটি হলো। “ইয়্যাকা নাবুদু ওয়া ইয়্যাকানাস্তাইন”। অর্থাৎ আমরা শুধু তোমারই উপাসনা করি এবং একমাত্র তোমার কাছ থেকে সাহায্য চাই।

পূর্বের আয়াতগুলোয় আমরা আল্লাহর কিছু গুণ সম্পর্কে জানতে পেরেছি। আমরা জেনেছি যে তিনি “রহমান”, “রাহীম”, “রাব্বুল আলামিন” এবং বিচার দিনের মালিক। এ ছাড়াও এ অন্তহীন বিশ্বজগত এবং আমাদের প্রতি তাঁর প্রশংসা জ্ঞাপন করে বলেছি “আলহামদুলিল্লাহে রাব্বিল আলামীন”।

তাই আমাদের কর্তব্য হলো তাঁর দরবারে গিয়ে নিজের অক্ষমতা ও দূর্বলতা তুলে ধরে বলা যে-আমরা একমাত্র তোমারই বান্দা এবং একমাত্র তোমার নির্দেশ ছাড়া অন্য কারো কাছে বা নির্দেশের সামনে মাথা নত করবো না। আমরা দুনিয়ার ধন দৌলতের পূজারী নই এবং শোষক ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিরও গোলাম নই। ব্যক্তিগত ও সামাজিক ধর্ম ইসলামের সর্বশেষ উপাসনা নামাজ জামাতে আদায় করা হয়। তাই মুসলমানরা একই কাতারে একই সাথে, এক বাক্যে বলে “ইয়্যাকা নাবুদু ওয়া ইয়্যাকা নাস্তাঈন”। অর্থাৎ হে পরওয়ারদেগার! শুধু আমি নই, আমরা সবাই তোমার বান্দা এবং তোমার কাছ থেকেই সাহায্য কামনা করি। হে আল্লাহ! এমনকি আমাদের এবাদতও তোমার সাহায্যে করছি। তুমি আমাদের সাহায্য না করলে অন্যদের গোলাম ও দাসে পরিণত হবো।

সূরা ফাতেহার ৫ম আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় এবার তুলে ধরছি।

এ আয়াতের প্রথম শিক্ষণীয় দিক হলো-আমরা সৃষ্টি জগতে যে একটি ব্যবস্থা বিরাজ করছে তা স্বীকার করি। তবে মনে করি এ হলো আল্লাহর প্রজ্ঞার নিদর্শন এবং এসব তারই ইচ্ছার অধীন। তাই আমরা আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পন করি; প্রকৃতির হাতে বন্দী নই। আর এমনকি বস্তুগত বিষয়েও তার সাহায্য প্রার্থনা করি। এ আয়াত থেকে আরেকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো, প্রত্যেক নামাজে যদি আমরা গভীর উপলদ্ধির সাথে বলি যে, আমরা কেবল তোমারই বান্দা; তাহলে আমাদের মধ্য থেকে গর্ব, অহঙ্কার ও ঔদ্ধত্য দূর হয়ে যাবে। #

কোরআনের আলোর গত দুই পর্বে আমরা সূরা হামদের এক থেকে ৫ম আয়াত নিয়ে আলোচনা করেছি। তাতে আল্লাহপাক নিজেকে পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু, প্রতিপালক ও সব কিছুর মালিক বলে পরিচয় দিয়েছেন এবং তিনি আমাদের ভালো ও মন্দ কাজের উপযুক্ত প্রতিদান দেবেন। আর আমরাও ঘোষণা দিয়েছি যে আমরা একমাত্র তাঁর কাছে মাথা নত করি, কেবল তাঁর উপর নির্ভর করি এবং তাঁরই উপর ভরসা করি।

এবারে আমরা এ সূরার ৬ষ্ঠ ও ৭ম আয়াত নিয়ে আলোচনা করবো। সূরা হামদের ছয় নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-অর্থাৎ “হে আল্লাহ্‌! আমাদেরকে সরল সঠিক পথে পরিচালিত কর।” মানুষের জীবন যাপনের জন্য বিভিন্ন পথ রয়েছে। ব্যক্তি তার নিজস্ব চাহিদা ও প্রয়োজন অনুযায়ী পথ বেছে নিতে পারে। সমাজ ও জনগণের চলার পথ, পূর্বপুরুষদের অনুসৃত পথ, জনগণের জন্য অত্যাচারী শাসক ও তাগুতী শক্তির পক্ষ থেকে নির্ধারিত পথ। একটি পথ হলো দুনিয়ার যাবতীয় রং, রুপ ও সৌন্দর্য উপভোগ করা। আবার অন্য একটি পথ হলো সমাজ জীবন থেকে বেরিয়ে একাকিত্ব ও নি:সঙ্গতা বেছে নেয়া। এত সব পথের মধ্যে সঠিক পথ বেছে নেয়ার জন্য মানুষের কি পথপ্রদর্শকের প্রয়োজন নেই? আল্লাহ পাক মানুষের পথপ্রদর্শনের জন্য নবী রাসূল ও আসমানী কিতাব পাঠিয়েছেন। তাই মানুষ যদি পবিত্র কোরআন, রাসূলে খোদা(সা:) ও আহলে বাইতের অনুসরণ করে তাহলে সঠিক পথের সন্ধান পাবে। তাইতো আমরা প্রত্যেক নামাজে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি যাতে তিনি আমাদেরকে সরল, সঠিক পথে পরিচালিত করেন যে পথে কোন ক্ষতি ও বিভ্রান্তি নেই, তিনি যাতে ঐ পথে আমাদেরকে পরিচালিত করেন। সরল পথ হলো মধ্যম পথ। সরল পথ মানে সব কাজে মধ্যপন্থা অবলম্বন এবং যেকোন ধরনের বাড়াবাড়ি বর্জন। অনেকে মূলনীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির শীকার হয় এবং অনেকে কর্মক্ষেত্রে ও নৈতিক ক্ষেত্রে ভুল পথে চলে যায়। অনেকে আবার সব কাজের জন্য আল্লাহকে দায়ী করে; যেন পরিণতির ব্যাপারে মানুষের কোন হাত নেই। কেউ আবার সব কাজে নিজের ক্ষমতাকে চূড়ান্ত মনে করে যেন সৃষ্টি জগতের কাজ-কর্মে আল্লাহর কোন হাত নেই। অনেক কাফের আল্লাহর প্রেরিত পুরুষ নবী-রাসূলদেরকে সাধারণ মানুষ এমনকি পাগল বলেও আখ্যায়িত করেছিল। অনেক বিশ্বাসী ব্যক্তি আবার হজরত ঈসা(আ:)এর মত নবীকে খোদার পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল। এ ধরনের চিন্তা ও আচরণের অর্থ হলো রাসূল এবং তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের নির্দেশিত পথ থেকে বিচ্যূত হওয়া। পবিত্র কোরআন আমাদেরকে আর্থ-সামাজিক কাজ-কর্ম ও এবাদতের ক্ষেত্রে মধ্যপন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়েছে। যেমন সূরা আঁরাফের ৩১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ “তোমরা খাও এবং পান করো। তবে অপব্যয় করোনা।” সূরা আসরা বা বনী ইসরাইলের ১১০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে অর্থাৎ “নামাজে স্বর উঁচুও করো না আবার অতিশয় ক্ষীণও করো না। বরং এ দুইয়ের মধ্য পন্থা অবলম্বন কর। একই ভাবে সূরা ফুরকানের ৬৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, অর্থাৎ “মুমিন ব্যক্তিরা যখন দান করে তখন তারা অপব্যয় করে না আবার কার্পণ্যও করে না। বরং তারা এ দুইয়ের মধ্যপন্থা অবলম্বন করে। ইসলাম ধর্মে পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণের উপর অত্যন্ত জোর দেয়া হয়েছে এবং বলা হয়েছে, “পিতা-মাতার প্রতি উত্তম আচরণ করো।” আবার সেখানে এও বলা হয়েছে যে, “তারা যদি তোমাকে মিথ্যা পথে পরিচালিত করতে চায় তবে তাদের আনুগত্য করবে না।” যারা কেবল সমাজ থেকে বেরিয়ে একাকি এবাদত-বন্দেগীতে মশগুল হয় কিংবা শুধু মানব সেবাকে এবাদত বলে, তাদের ধারনার জবাবে পবিত্র কোরআন নামাজ ও জাকাতকে পাশাপাশি বর্ণনা দিয়ে বলেছে, ” তোমরা নামাজ কায়েম কর এবং জাকাত আদায় কর।” এর একটি স্রষ্টার সাথে সম্পর্কিত এবং অন্যটি মানুষের সাথে সম্পর্কিত এবাদত। প্রকৃত মুমিন হলো তারা- যাদের আকর্ষণও রয়েছে এবং বিকর্ষণও রয়েছে।সূরা ফাতেহার শেষ আয়াতে বলা হয়েছে, “মোহাম্মদ রাসূলুল্লাহ (সা:) এবং তাঁর অনুসারীরা সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল। সূরা ফাতেহার ৬ নম্বর আয়াত থেকে যে বিষয়গুলো শিক্ষণীয় রয়েছে , তাহলো-সিরাতে মুস্তাকিম বা সরল পথই হলো কল্যাণের পথ। কারণ আল্লাহর সরল পথ অপরিবর্তনিয় কিন্তু মানব রচিত পথগুলো প্রতিদিন পরিবর্তীত হয়। অন্যদিকে দুটি বিন্দুর মধ্যে সবচেয়ে নিকটবর্তী পথ হলো সরল পথ এবং এই পথ একাধিক নয়। সরল সোজা পথে কোন বাঁক নেই এবং সবচেয়ে কম সময়ে এ পথ তাকে গন্তব্যে পৌঁছে দিতে পারে। আর সুরা “হামদ” এর ৬ নম্বর আয়াতের শেষ শিক্ষা হলো-সরল সঠিক পথ নির্বাচন এবং এ পথে টিকে থাকার জন্য আল্লার কাছে সাহায্য চাওয়া। কারণ আমরা বিভ্রান্তির মধ্যে পড়তে পারি। এ যাবত জীবন চলার পথে কোন বিভ্রান্তির মধ্যে না পড়লেও এটা কখনোই ভাবা ঠিক নয় যে পরবর্তী জীবনেও সঠিক চলতে পারবো। আমাদের মধ্যে এমন কত লোকই না আছে যারা সারা জীবন মুমিন ছিলেন কিন্তু যখন অর্থ-সম্পদ বা কোন পদ লাভ করেছেন তখন খোদাকে ভুলে গেছে। সরল সঠিক পথ চেনা কঠিন কাজ। তাই পরবর্তী আয়াতে এ পথের বাস্তব আদর্শ এবং যারা ঐ পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে তাদের পরিচয় আমাদের সামনে তুলে ধরে। সূরা ফাতেহার ৭ম আয়াত হলো- হে আল্লাহ! আমাদেরকে ঐ ব্যক্তিদের পথে পরিচালিত কর, যাদের তুমি অনুগ্রহ দান করেছো। তাদের পথে নয় যারা ক্রোধের শিকার এবং পথভ্রষ্ট।

জীবন চলার পথ বেছে নেয়ার ক্ষেত্রে মানুষ ৩টি দলে বিভক্ত। এক দল আল্লাহর পথ বেছে নেয় এবং আল্লাহর দেয়া জীবন-বিধান অনুযায়ী নিজেদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন পরিচালনা করে। এ দল সবসময় আল্লাহর রহমত, অনুগ্রহ ও দয়া লাভ করে। প্রথম দলের বিপরীতে আরেকটি দল রয়েছে যারা সত্য চেনার পরও আল্লাহকে ছেড়ে গায়রুল্লাহকে বেছে নিয়েছে এবং নিজের কামনা-বাসনা, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-পরিজন ও সমাজের ইচ্ছাকে আল্লাহর ইচ্ছার উপর প্রাধান্য দেয়। এ দলের লোকদের মধ্যে তাদের কৃতকর্মের প্রভাব ধীরে ধীরে গেঁড়ে বসে এবং তারা সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়। তারা আল্লাহর সান্নিধ্য এবং দয়া লাভের পরিবর্তে ধ্বংসের অতল গহ্বরে পতিত হয়, আর আল্লাহর গজবের মধ্যে পড়ে। এই আয়াতে এ দলকে “মাগদুবি আলাইহিম” বা ক্রোধ নিপতিত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তৃতীয় আরেকটি দল রয়েছে যাদের কোন সুনির্দিষ্ট পথ নেই এবং কোন্‌ পথে চলবে তা ঠিক করতে পারেনি। তারা দিকভ্রান্ত এবং বিভ্রান্ত । এ আয়াতে তাদেরকে “দা’ল্লিন” বা পথভ্রষ্ট হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তারা প্রতিদিন একেক পথ বেছে নেয় কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছতে পারে না। আমরা প্রত্যেক নামাজে যে বলি- “হে আল্লাহ! আমাদেরকে সরল পথ প্রদর্শন কর, তাদের পথ যাদেরকে তুমি অনুগ্রহ দান করেছো। নবী-রসূল, ওলী-আওলীয়া ও সৎ কর্মশীলদের পথে। তাদের পথে আমাদেরকে পরিচালিত করোনা যারা মানবতা থেকে দূরে সরে গেছে, তোমার ক্রোধের শিকার, দিক-ভ্রান্ত এবং একেক দিন একেক রুপ ধারণ করে। এখানে একটি প্রশ্ন জাগে, তাহলো-ক্রোধের শিকার ও পথভ্রষ্ট কারা? এর উত্তর হলো পবিত্র কোরআনে বহু দল ও ব্যক্তিকে পথভ্রষ্ট ও ক্রোধের শিকার বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আমরা এখানে একটি স্পষ্ট উদাহরণ পেশ করবো।

কোরআনে বনি ইসরাইলের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে এবং হজরত মূসা(আ:) কিভাবে তাদেরকে ফেরাউনের নির্যাতনের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছেন তারও বিশদ বর্ণনা দেয়া হয়েছে। বনী ইসরাইল বংশের লোকেরা আল্লাহর নির্দেশ মেনে চলায় আল্লাহ তাদেরকে ঐ যুগের সব মানুষের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেন। এ সম্পর্কে সূরা বাকারার ৪৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“আমি তোমাদেরকে বিশ্বে সবার উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি।” কিন্তু এই বনী ইসরাইল জাতিই তাদের আচরণের জন্য আল্লাহর ক্রোধের শিকার হয়। পবিত্র কোরআনে এ বিষয়ে বলা হয়েছে- “তারা আল্লাহর গজবের শিকার হয়েছে”। কারণ ইহুদী পুরোহিতরা আসমানী গ্রন্থ তৌরাতের বিধান বিকৃত করেছিল। তাদের মধ্যে যারা ব্যবসায়ী ও ধনী তারা সুদ গ্রহণ ও হারাম ব্যবসায় নিয়োজিত হয়েছিল। এত সব বিকৃতি ও অন্যায় সত্ত্বেও বনী ইসরাইল জাতির ভালো লোকেরা নিরবতা অবলম্বন করে এবং কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। তাই শেষ পর্যন্ত এ জাতি সম্মান ও মর্যাদার শীর্ষ থেকে অপমান ও ধ্বংসের মধ্যে পতিত হয়। #

কোরআনের আলোর গত কয়েক পর্বে আমরা পবিত্র কোরআনের সূরা ফাতেহা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। এবারে পবিত্র কোরআনের দ্বিতীয় সূরা বাকারা নিয়ে আলোচনা করা যাক।

সূরা বাকারা বিশেষ আঙ্গিকে শুরু হয়েছে। কয়েকটি অক্ষর দিয়ে শুরু হওয়া এ সূরাটি যে কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করে। একটি শব্দ সাধারণত কয়েকটি অক্ষর নিয়ে গড়ে ওঠে এবং এর অর্থ আছে। অর্থহীন অক্ষর সমষ্টিকে শব্দ হলা হয় না। কিন্তু আল্লাহ পাক পবিত্র কোরানের ১১৪টি সূরার মধ্যে ২৯টি শুরু করেছেন কয়েকটি অক্ষর দিয়ে, কোন শব্দ দিয়ে নয়। ঐ অক্ষরগুলো প্রত্যেকটি আলাদাভাবে উচ্চারিত হয়। যেমন সূরা বাকারার প্রথম আয়াতটি আমরা “আলাম” পড়ি না বরং পড়ি আলিফ-লাম-মিম। এ ধরনের ভঙ্গিমা আরবী ভাষায় সম্পূর্ণ নতুন এবং নজীরবিহীন। কোরআন বিশ্লেষকগণ একে “হরুফে মুকাত্বায়া” বলেন। অর্থাৎ এ সব অক্ষর বিচ্ছিন্ন এবং আলাদা আলাদা ভাবে উচ্চারিত হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব অক্ষরের পর আয়াত এসেছে, যাতে কোরআনের অলৌকিকত্ব ও মহত্ত্ব তুলে ধরা হয়েছে। যেমন সূরা শুরায় বলা হয়েছে- “এভাবে আল্লাহ পাক আপনার উপর এবং আপনার পূর্ববর্তী পয়গম্বরদের উপর অহী নাযিল করেন।” যেন আল্লাহ পাক বলতে চান-আমি আমার অলৌকিক গ্রন্থকে এই সব বর্ণমালা দিয়েই সাজিয়েছি। কোন অপরিচিত বর্ণমালা, শব্দ বা অক্ষর দিয়ে নয়। যারা দাবী করে যে কোরআন অলৌকিক এবং মোজেযা নয়, তারা পারলে এই বর্ণমালা দিয়েই কোরআনের মত গ্রন্থ রচনা করুক; যা বাক্য, শব্দ ও বিষয় বস্তুর দিক থেকে হবে নজীরবিহীন।

হ্যাঁ এটি সম্পূর্ণ আল্লাহর ক্ষমতা। তিনি সাধারণ বর্ণমালা দিয়েই এমন কিতাব রচনা করেছেন যার একটি সূরার মত কেউ কিছু রচনা করতে পারবে না। যেমন আল্লাহ পাক প্রাণহীন মাটি থেকে অসংখ্য গাছ-পালা, ফল-মূল সৃষ্টি করেন, অথচ ঠিক এই মাটি থেকেই মানুষ তৈরী করে ইট, বাসন-কোসন। এ সূরাতেও সূরা শুরার মতো আল্লাহ পাক বিচ্ছিন্ন বর্ণের পর বলেন- “এটি সেই গ্রন্থ যাতে কোন সন্দেহ নেই এবং খোদা ভীরু পরহেযগারদের জন্য এটি পথ নির্দেশক।” অতীতের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ হলো বই। বর্তমান যুগের মানুষের জন্য এ বই নিরব ভাষায় সর্বোৎকৃষ্ট ভাব ও জ্ঞান পৌঁছে দেয়। কোরআন কোন গ্রন্থ আকারে নাযিল হয়নি। কিন্তু রাসূলে খোদা ঐশী বাণীকে যে কোন বিকৃতির হাত থেকে রক্ষা করার জন্যে, তাঁর উপর যা কিছুই অবতীর্ণ হতো, তা-ই পড়ে শোনাতেন। লেখকরা তা লিখে নিত এবং অনেকেই মুখস্ত করে নিত। মানুষ যদি এই ঐশী গ্রন্থ অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়ে, বিষয়বস্তু উপলদ্ধি করে, তাহলে বিশ্বাস করতে বাধ্য হবে যে এই কিতাব আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে। কোন মানুষের পক্ষে এ ধরনের বক্তব্য পেশ করা সম্ভব নয়। তাও আবার ১৪শ’ বছর আগের একটি মূর্খ সমাজে বসবাসকারী কোন ব্যক্তির পক্ষে অসম্ভব।

যেমনটি আমরা কোরআনের আলো অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে বলেছি, পবিত্র কোরআন মানুষকে সৌভাগ্য ও সফলতার দিকে পরিচালিত হবার সব উপায় বলে দিয়েছে। কাজেই যে ব্যক্তি সফলকাম হতে চায় তাকে অবশ্যই স্রষ্টার কাছ থেকে প্রেরিত দিক নির্দেশনার শরণাপন্ন হতে হবে। যে সব জিনিস তার দেহ কিংবা মনের জন্য ক্ষতিকর সেগুলো থেকে দূরে থাকতে হবে। সূরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন- “পবিত্র কোরআন মানুষকে পথ প্রদর্শনের জন্য নাযিল করা হয়েছে।” তবে এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে, এ ঐশী গ্রন্থ থেকে কেবলমাত্র তারাই উপকৃত হবে, যারা সত্যকে বুঝতে চায় এবং সত্যকে গ্রহণ করার জন্য প্রস’ত থাকবে। গোঁড়া ও সংকীর্ণমনা ব্যক্তিরা কখনও সত্যকে গ্রহণ করতে চায় না। সত্য তাদের কাছে প্রমাণিত হলেও তারা তা অস্বীকার করে। কোরআনের শিক্ষা তাদের কোন উপকারে আসে না। কাজেই কোরআনের পথনির্দেশনা তাদের মধ্যেই প্রভাব বিস্তার করে, যাদের মনে খোদা ভীতি রয়েছে। সুতরাং এ আয়াতে বলা হয়েছে-“কোরআন খোদা ভীতি ও পরহেযগার লোকদের জন্য পথ নির্দেশক।” এবারে দেখা যাক এ আয়াতে কী কী শিক্ষণীয় বিষয় আছে।

প্রথমত: রাসূলে খোদা(সা:) এর সঙ্গী-সাথীরা পবিত্র কোরআন লেখা এবং এর রক্ষণাবেক্ষণের ব্যাপারে ভীষণ সতর্ক ছিলেন। কাজেই আল্লাহর কাছ থেকে অবতীর্ণ আয়াতগুলো এখন গ্রন্থাকারে আমাদের মাঝে রয়েছে। এ ঐশী গ্রন্থের পবিত্রতা রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার।

দ্বিতীয়ত: পবিত্র কোরআন মানব জাতির পথ প্রদর্শক। এটি বিশেষ কোন শ্রেণীর মানুষের জন্য অবতীর্ণ হয়নি। কাজেই পবিত্র কোরআনে পদার্থ বিদ্যা, রসায়ন কিংবা গণিতের বিষয়বস্তু খোঁজা অর্থহীন।

তৃতীয়ত: পবিত্র কোরআনের জ্যোতি কেবল তখনই আমাদের অন্তরকে প্রভাবিত করবে যখন আমরা সত্যকে গ্রহণ করার জন্য তৈরী হব। মাটি কিংবা ময়লার মধ্যে আলোর বিকিরণ ঘটেনা, আলো কেবল স্বচ্ছ আয়নার মধ্যেই প্রতিফলিত হয়। #

কোরআনের আলোর আজকের পর্বেও আমরা সূরা বাকারা নিয়ে আলোচনা করব। এর আগের পর্বে এই সূরার প্রথম ও দ্বিতীয় আয়াত নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। এবারে এ সূরার তৃতীয় ও চতুর্থ আয়াতের ব্যাখ্যা তুলে ধরবো।

সূরা বাকারার দ্বিতীয় আয়াতে কোরআনের পথনির্দেশনা ও হেদায়েতকে মুত্তাকী ও পরহেযগারদের জন্য বলে মন্তব্য করা হয়েছে। পরের আয়াতগুলোয় ঐ পরহেযগারদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। তৃতীয় আয়াতে বলা হয়েছে- “মুত্তাকী ও পরহেযগার তারাই যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে, নামাজ কায়েম করে এবং তাদেরকে যে জীবিকা দেয়া হয়েছে তা থেকে দান করে।” পবিত্র কোরআন বিশ্বজগতকে দুটি ভাগে বিভক্ত করেছে। একটি অদৃশ্য জগত যা আমরা চর্মচক্ষুতে দেখতে পাইনা, আর অপরটি হচ্ছে দৃশ্যমান জগত। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা যে জগত অনুভব করি; সেই বস্তুগত জগত কেবলমাত্র চোখে দেখা যায়, কানে শোনা যায় এবং পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুভব করা যায় এমন সব বিষয়ের অস্তিত্ব স্বীকার করে। অথচ আমাদের সীমাবদ্ধ ইন্দ্রিয়ের পক্ষে সমস্ত সৃষ্টিজগত অনুভব করা সম্ভব নয়। যেমন আমরা নীচের দিকে বস্তুর পতন থেকে বুঝি যে পৃথিবীর আকর্ষণ শক্তি রয়েছে। অর্থাৎ আকর্ষণ শক্তিকে আমরা এর প্রভাব থেকে বুঝি। এমন অনেক লোক আছে যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করার জন্য তাঁকে চোখে দেখতে চায়। যেমন বনি ইসরাইল গোত্র হজরত মূসা(আ:) কে বলেছিল-“আল্লাহকে স্পষ্টভাবে না দেখা পর্যন্ত আমরা তোমার প্রতি ঈমান আনবো না।” অথচ আল্লাহপাক কোন বস্তুগত কিছু নন যে তাঁকে দেখা যাবে। তবে আমরা সৃষ্টিজগতে বিরাজমান অসংখ্য নিদর্শন থেকে তাঁর অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হই এবং তাঁর প্রতি ঈমান আনি। সত্য অনুসন্ধানী ও তাকওয়া সম্পন্ন ব্যক্তিরা শুধু এই বস্তুগত জগতের মধ্যেই তাদের দৃষ্টি সীমাবদ্ধ রাখেননি। তারা অদৃশ্য জগত অর্থাৎ আল্লাহপাক, ফেরেশতাকুল, আখেরাত যা পঞ্চ-ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করা যায় না তার প্রতিও বিশ্বাস রাখেন। অবশ্য ঈমান জ্ঞানের উর্দ্ধে। ঈমান হলো এমন পর্যায় যাতে মানুষের অন্তর ও আত্মাও কোন কিছুর অস্তিত্ব স্বীকার করে, তার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করে, ভালবাসে। এটা স্পষ্ট যে এ ধরনের ঈমান ও বিশ্বাস থেকে সৎ কাজ উৎসারিত হবে। মূলত: ইসলামের দৃষ্টিতে আমল বা বাস্তব কর্ম ছাড়া শুধু ঈমান দিয়ে মানুষের বিকাশ ও অগ্রগতি অর্জিত হবে না। এই আয়াতে বলা হয়েছে মুত্তাকী ও পরহেযগার ব্যক্তিরা অদৃশ্যে বিশ্বাস রাখেন। তারা নামায পড়েন এবং দান-খয়রাত করেন। নামাযের মাধ্যমে তারা আল্লাহকে স্মরণ করেন, নিজেদের মন ও আত্মার প্রয়োজন পূরণ করেন এবং লাভ করেন অনাবিল প্রশান্তি। অপরপক্ষে নিজেদের উপার্জিত অর্থ-সম্পদের একটি অংশ অভাবগ্রস্তদের হাতে তুলে দিয়ে সমাজের চাহিদা পূরণ করেন, যাতে সমাজেও শান্তি ও স্বাচ্ছন্দ্য বিরাজ করে। অবশ্য কেবল নামায পড়া যথেষ্ট নয় বরং নামায কায়েম করতে হবে। অর্থাৎ নিজেও নামায পড়তে হবে অপরকেও নামাযের প্রতি আহ্বান জানাতে হবে। আযানের পরপরই উত্তম সময়ে নামায পড়তে হবে এবং নামায আদায় করতে হবে মসজিদে জামাতবদ্ধ হয়ে। এভাবে সমাজে নামায প্রতিষ্ঠা করতে হবে। দানের ক্ষেত্রেও শুধু আর্থিক দানই ইসলামের উদ্দেশ্য নয়। লক্ষ্য রাখতে হবে কোরআনে বলা হয়েছে-” যা কিছু তোমাদেরকে দেয়া হয়েছে তা থেকে দান কর।” ধন-সম্পদ, শক্তি, ক্ষমতা, জ্ঞান, বুদ্ধি এবং আল্লাহর দেয়া সব কিছু এঅন্তর্ভূক্ত।

সূরা বাকারার ৩ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক এবার তুলে ধরা যাক।

প্রথমত: এই বিশ্বজগত কেবল বস্তুজগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং এমন বহু বিষয় আছে যা আমাদের দৃষ্টির আড়ালে। তবে আমাদের অন্তর ও বিচারবুদ্ধি সেসবের অস্তিত্ব স্বীকার করে। তাই সেসব অদৃশ্যের প্রতি আমাদের বিশ্বাস করা উচিৎ।

দ্বিতীয়ত: ঈমান কর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। মুমিন ও বিশ্বাসী ব্যক্তি কাজের লোক। অবশ্য ঐসব কাজ যার নির্দেশ আল্লাহ তাকে দিয়েছেন।

তৃতীয়ত: নামাজ হলো ঈমানদার ব্যক্তিদের কাজের কেন্দ্রবিন্দু।

চতুর্থত: আমাদের যাকিছু আছে সবই আল্লাহর। তাই এর কিছু অংশ আল্লাহর জন্য দান করবো। আর আল্লাহও দুনিয়া এবং আখেরাতে আমাদেরকে এর উত্তম প্রতিদান দেবেন।

সূরা বাকারার এ আয়াতের আরেকটি শিক্ষণীয় দিক হলো-ইসলামকে সামাজিক ধর্ম হিসেবে তুলে ধরা। ইসলাম সমাজ পরিচালনার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ ধর্ম। এ ধর্ম আল্লাহর সাথে সম্পর্কের কথাও বলে, আবার মানুষের সাথে সম্পর্কের কথাও বলে। একই সাথে সমাজের প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রাখার নির্দেশ দেয়।

এবারে কোরআনের ভাষায় মুমিন ব্যক্তিদের আরো কিছু বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানা যাক। সূরা বাকারার ৪র্থ আয়াতে বলা হয়েছে-“মুত্তাকী ও পরহেযগার তারাই যারা তোমার উপর এবং তোমার আগের পয়গম্বরদের উপর যা অবতীর্ণ হয়েছে সেগুলোর প্রতি বিশ্বাস রাখার পাশাপাশি, পরকালের প্রতিও পরিপূর্ণ বিশ্বাসী। আল্লাহকে চেনার একটি পথ হলো অহী। আর তাই তাকওয়া সম্পন্ন ব্যক্তিরা অহীতে বিশ্বাস করেন। এর আগের আয়াতে যেমনটি বলেছি উপলদ্ধি ক্ষমতা শুধু মানুষের ইন্দ্রিয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং বস্তুগত জগতের উর্দ্ধেও ভিন্ন জগত রয়েছে যার অস্তিত্বকে মানুষের আক্‌ল বা বিচারবুব্ধি প্রবলভাবে সমর্থন করে। তবে এই আক্‌লও নিখুঁতভাবে ঐ জগত উপলদ্ধিতে অক্ষম। আর এ জন্যে আল্লাহপাক অহী পাঠিয়ে আমাদের ক্ষমতাকে পূর্ণ করেছেন। আমাদের আক্‌ল বা বিচারবুদ্ধি বলে-একজন স্রষ্টা আছেন। কিন্তু অহী আমাদেরকে ঐ স্রষ্টার গুণ ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা দেয়। আমাদের বিচারবুদ্ধি বলে, মানুষকে উপযুক্ত পুরস্কার বা শাস্তি দেয়ার জন্য মহাবিচারের ব্যবস্থা থাকতে হবে। আর অহী আমাদেরকে বলে, কেয়ামতের মাধ্যমেই হবে সেই মহাবিচার। অতএব দেখা যাচ্ছে, বিচারবুদ্ধি ও অহী একে অন্যের পরিপূরক, আর ঈমানদার ব্যক্তিরা উভয় পন্থা ব্যবহার করেন। অহী শুধু মহানবী মোহাম্মদ (স:) এর উপরই নাযিল হয়নি, বরং সব নবীর উপরই নাযিল হয়েছে আল্লাহর প্রত্যাদেশ বা অহী। তাই পরহেযগার ও খোদাভীরু লোকদের অযৌক্তিক কোন বিদ্বেষ নেই। তারা পূর্ববর্তী নবীদের অস্বীকার করেন না, বরং নবীজীর পাশাপাশি তারা আল্লাহর সব পয়গম্বর এবং তাদের উপর নাযিলকৃত অহীতে বিশ্বাস করেন। এ ছাড়াও সূরা বাকারার ৪ নম্বর আয়াতে মুমিনদের আরেকটি বিশ্বাসের কথা বলা হয়েছে। আর তা হলো আখেরাত। পরকালও একটি অদৃশ্য বিষয়। পরকাল সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হলে অহীর উপর ভরসা করা ছাড়া উপায় নেই। এর ভিত্তিতে মুমিন ব্যক্তিরা কেয়ামতে পূর্ণ বিশ্বাস রাখেন এবং মৃত্যুকে মানুষের জীবনের চূড়ান্ত পরিসমাপ্তি বলে মনে করেন না। সূরা বাকারার এ আয়াতটি থেকে আমাদের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো:

প্রথমত: সকল নবী রাসূলের উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন। তাই সব আসমানী গ্রন্থের প্রতি ঈমান রাখা প্রয়োজন।

দ্বিতীয়ত: ঐশী গ্রন্থগুলোর উত্তরাধিকারী হলো মুসলিম উম্মাহ। তাই মুসলমানদের আসমানী কিতাব সংরক্ষণের চেষ্টা চালাতে হবে। #

কোরআনের আলোর এ পর্বে আমরা সূরা বাকারার ৫ম, ৬ষ্ঠ ও ৭ম আয়াত নিয়ে আলোচনা করবো। এর আগের আয়াতগুলোয় মুত্তাকীদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করা হয়েছে। সূরা বাকারার ৫ম আয়াতে বলা হয়েছে-“ঐ মুমিন ব্যক্তিরা তাদের প্রতিপালকের নির্দেশিত পথে রয়েছে এবং তারাই সফলকাম।” এই আয়াতে পরহেযগার ব্যক্তিদের পরিণাম “সফলতা” বলে বর্ণনা করা হয়েছে। তারা আল্লাহর নির্দেশিত পথে চলেই এ সফলতায় পৌঁছায়।

সফলতা মানে প্রবৃত্তির কামনা-বাসনা থেকে মুক্ত হওয়া এবং নৈতিক উৎকর্ষ অর্জন। আরবী ভাষায় কৃষককে বলা হয় “ফাল্লাহ্‌”। কারণ কৃষক তার পরিশ্রমের মাধ্যমে মাটির তলদেশ থেকে বীজের অঙ্কুরোদ্‌গম এবং ফসল বেড়ে ওঠার ব্যবস্থা করে। সফলতা মানুষের পূর্ণতার সর্বোচ্চ পর্যায়। কারণ কোরআনের আয়াত অনুযায়ী সৃষ্টিজগত মানুষের জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। মানুষ এবাদতের জন্য এবং এবাদত হলো তাকওয়ায় পৌঁছার জন্য। আর এ আয়াতে বলা হয়েছে মুত্তাকী ও পরহেযগার ব্যক্তিরা সফলকাম হবেন। এ আয়াত আমাদেরকে দুটি প্রধান বিষয় শিক্ষা দেয়। প্রথমত: কল্যাণ ও সৌভাগ্যবান হতে হলে আল্লাহর নির্দেশিত পথ অনুযায়ী চলতে হবে। আর দ্বিতীয়ত: চেষ্টা ছাড়া কল্যাণ অর্জন সম্ভব নয়। জ্ঞান ও বিশ্বাসের যেমন দরকার আছে তেমনি কাজ ও উত্তম আমলেরও প্রয়োজন আছে।

সূরা বাকারার ৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“যারা সত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছে, তুমি তাদেরকে সতর্ক কর বা না কর, তাদের পক্ষে উভয়ই সমান। তারা ঈমান আনবে না।”মুত্তাকী ও পরহেযগার ব্যক্তিদের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরার পর এই আয়াতে কাফেরদের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। সত্য প্রত্যাখ্যানকারী কাফেররা বিরুদ্ধাচরণ করতে করতে এমন বিদ্বেষী হয়ে পড়ে যে সত্য কথা তাদের মধ্যে কোন প্রভাব ফেলে না এবং তারা ঈমান আনে না। আরবী ভাষায় ‘কুফর’ শব্দের অর্থ হলো ঢেকে ফেলা, উপেক্ষা করা। সুতরাং কাফের মানে ঐ ব্যক্তি যে সত্য গোপন করে এবং সত্যকে উপেক্ষা করে। আল্লাহ যদি চাইতেন তাহলে সব মানুষ ঈমান আনতে বাধ্য হতো। কিন্তু চাপিয়ে দেয়া বিশ্বাসের কোন মূল্য নেই। আল্লাহই চান মানুষ যাতে স্বেচ্ছায় ঈমান আনে। তাই সব মানুষ পরহেযগার, ঈমানদার ও মুত্তাকী হয়ে যাবে-এমনটি আশা করা আমাদের উচিৎ নয়। সূরা বাকারার ৬ নম্বর আয়াত থেকে আমরা যে কয়েকটি বিষয়ে শিক্ষা লাভ করছি তা হলো-প্রথমত: কুফরী, বিদ্বেষ- মানুষকে পাথরের মত কঠিন করে ফেলে। তাই কোন উপদেশ বা ভালো কথাও তার মধ্যে কোন প্রভাব ফেলেনা। আর দ্বিতীয়ত: যদি মানুষ সত্য গ্রহণে ইচ্ছুক না হয় তাহলে নবীদের আহ্বান কাজে আসবে না। নবীদের আহ্বান হলো বৃষ্টির মত। যদি উর্বর মাটিতে পড়ে তাহলে ফুল ফোটে, আর যদি নোনা ও শক্ত মাটিতে পড়ে তাহলে জংলী আগাছা আর কাঁটাযুক্ত ঝোপঝাড় জন্মায়। তৃতীয়ত: যদিও আমরা জানি যে কাফেররা ঈমান আনবে না, কিন্তু তবুও আমাদের দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে এবং তাদেরকে সদুপদেশ দিতে হবে।

সূরা বাকারার ৭ম আয়াতে বলা হয়েছে-“আল্লাহ তাদের হৃদয় ও কান মোহর করে দিয়েছেন। তাদের চোখের উপর আবরণ আছে এবং তাদের জন্য রয়েছে মহা শাস্তি।” মানুষ হিসাবে কাফেরদেরও বিবেক-বুদ্ধি, চোখ ও কান আছে। কিন্তু খারাপ কাজ, অযৌক্তিক বিদ্বেষ, একগুঁয়ে ও হিংসার কারণে এমন পর্দা সৃষ্টি হয় যে তারা সত্য দেখা, শোনা ও উপলদ্ধির শক্তি হারিয়ে ফেলে। এটি হলো দুনিয়াতেই আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের জন্য নির্ধারিত শাস্তি। আর তাছাড়া কেয়ামতে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে কঠিন শাস্তি। এখানে একটি প্রশ্ন দেখা দেয়, আর তা হলো আল্লাহ যদি নিজেই কাফেরদের চোখ,কান বন্ধ করে দেয় তাহলে খোদাদ্রোহিতার ক্ষেত্রে তাদেরতো কোন দোষ নেই? কারণ তারা বাধ্য হয়েই কাফের হয়েছেন। এ প্রশ্নের উত্তর খোদা কোরআনেই স্পষ্টভাবে দিয়েছে। সূরা মুমিনের ৩৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“আল্লাহ প্রত্যেক উদ্ধত ও অত্যাচারী ব্যক্তির হৃদয় মোহর করে দেন।” সূরা নিসার ১৫৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“সত্য প্রত্যাখ্যানের জন্য আল্লাহ তাদের হৃদয় মোহর করে দিয়েছেন। প্রকৃত পক্ষে এসব আয়াতে মানুষ সম্পর্কে আল্লাহর নির্ধারিত নিয়ম বর্ণনা করা হয়েছে। যদি মানুষ সত্যের সামনে ঔদ্ধত্য, গর্ব ও একগুঁয়েমি দেখায় তাহলে শেষ পর্যন্ত তার সত্যকে চেনার শক্তি লোপ পাবে, সত্যকে সে উল্টো দেখতে পাবে এবং দুনিয়া ও আখেরাতে কঠিন পরিণতির শিকার হবে।

সূরা বাকারার ৭ম আয়াতের দুটি প্রধান শিক্ষণীয় বিষয় হলো-কেউ জেনে শুনে সত্য প্রত্যাখ্যান করলে আল্লাহপাকও তার অন্তর্চক্ষু ঢেকে দেন এবং এটি আল্লাহর শাস্তি। এছাড়াও জীব-জন্তুর উপর মানুষের মর্যাদার কারণ হলো তার বিবেক-বুদ্ধি, উপলদ্ধি ক্ষমতা এবং সঠিক দৃষ্টিভঙ্গী। কিন্তু মানুষ সত্য প্রত্যাখ্যান এবং আল্লাহ ও তার নিদর্শনাবলী অবিশ্বাসের মাধ্যমে এই মর্যাদা হারিয়ে ফেলে। #

কোরআনের আলো অনুষ্ঠানের এ পর্বে আমরা সূরা বাকারার ৮, ৯ ও ১০ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করব। সূরা বাকারার ৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- “মানুষের মধ্যে এমন লোক আছে যারা বলে-আমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী। অথচ তারা বিশ্বাসী নয়।” হেদায়েত বা পথপ্রদর্শনের গ্রন্থ কোরআন আমাদের জন্য মুমিন, কাফের ও মুনাফেকদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছে। যাতে আমরা নিজেদের সম্পর্কেও জানতে পারি যে, কোন দলে আছি এবং অন্যদেরকেও চিনতে পারি। এ ভাবে সচেতনভাবে আমরা সমাজের সদস্যদের সাথে উপযুক্ত আচরণ করতে পারি।

সূরা বাকারার প্রথম থেকে এ পর্যন্ত ৪টি আয়াতে মুমিনদের এবং দুটি আয়াতে কাফেরদের পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে। এ আয়াত এবং পরবর্তী আয়াতগুলোয় তৃতীয় একটি দলের পরিচয় বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথম দলের সদস্যদের মধ্যে যে ঈমানী নূর রয়েছে তাও এ দলের সদস্যদের মধ্যে নেই। আবার দ্বিতীয় দলের সদস্যদের মতো ঔদ্ধত্য এদের মধ্যে নেই। এ তৃতীয় দলের সদস্যদের অন্তরে কোন ঈমান নেই এবং মুখেও এরা খোদাদ্রোহিতামূলক কিছু প্রকাশ করে না। এরা ভীতু মুনাফিক যারা কিনা অন্তরের অবিশ্বাস ও কুফরী গোপন করে রাখে এবং বাহ্যিকভাবে ইসলামের দাবী করে।

ইসলামের নবী হজরত মোহাম্মদ(সা:) মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের পর বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মুশরিকরা এ যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে পরাজয় বরণ করার পর মক্কা ও মদীনার কিছু লোক ইসলামে বিশ্বাস না করলেও জান-মাল রক্ষা কিংবা মুসলমানদের মধ্যে কোন উঁচু পদে আসন হবার জন্য বাহ্যিকভাবে ইসলামের প্রতি বিশ্বাসের দাবী করে। তারা বাহ্যিকভাবে আচার-আচরণে নিজেদেরকে অন্যদের সাথে মিশিয়ে ফেলে। এটা স্পষ্ট যে এ ধরনের লোকেরা ভীতু এবং কাফেরদের মত প্রকাশ্যে ইসলামকে অস্বীকারের সাহস তাদের মধ্যে নেই। যেকোন সামাজিক পরিবর্তন ও বিপ্লবের মধ্যে বহুরূপী ও দ্বিমুখী চরিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। তাই যারা মুখে ঈমানের কথা বলে, তারা অন্তরেও যে একই ধরনের বিশ্বাস পোষণ করে সে কথা ভাবা ঠিক নয়। এমন বহু লোক আছে যারা বাহ্যিকভাবে ধর্ম পরায়ণ মুসলমান,অথচ সবার অলক্ষ্যে তারা ইসলামের উপর আঘাত হানে। সূরা বাকারার এই ৮ নম্বর আয়াতের প্রধান শিক্ষণীয় বিষয় হলো-ঈমান অন্তরের ব্যাপার, মৌখিক কিছু নয়। তাই কোন ব্যক্তিকে চেনার জন্য শুধু তার মৌখিক ব্যক্তব্যকে যথেষ্ঠ মনে করা উচিৎ নয়।

সূরা বাকারার ৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- “তারা আল্লাহ ও বিশ্বাসীদেরকে প্রতারিত করতে চায়। অথচ তারা যে নিজেদেরকে ছাড়া কাউকে প্রতারিত করেনা তা বুঝতে পারে না।” মুনাফিকদের ধারনা তারা অত্যন্ত চালাক এবং তাদের চালাকি কেউ ধরতে পারে না। তারা নিজেদেরকে ঈমানদার হিসাবে প্রকাশ করে মনে করে মুসলমানদের মতো বিভিন্ন সুবিধা ভোগ করতে পারবে এবং আল্লাহকে ধোকা দিতে পারবে। তারা পয়গম্বর ও মুমিনদেরকে ধোকা দিয়ে মোক্ষম সময়ে ইসলামের উপর আঘাত হানতে চায়। কিন্তু আল্লাহ তাদের অন্তরের বিশ্বাস অবিশ্বাস এবং দ্বিমুখী চরিত্র সম্পর্কে জানেন। উপযুক্ত সময়ে তিনি তাদের মুখোশ উন্মোচিত করেন এবং মুমিনদের কাছে এদের কদর্য চেহারা প্রকাশ করে দেন। কোন অসুস্থ লোক যদি চিকিৎসকের দেয়া ব্যবস্থাপত্র মেনে না চলে চিকিৎসককে মিথ্যা কথা বলে তাহলে সে নিজেকেই ধোকা দিল। যদিও সে ভাবে যে সে মিথ্যা বলে চিকিৎসককে ধোকা দিয়েছে। কোরআনে বর্ণিত মুনাফিকরাও এরকম। এই বহুরুপী লোকেরা মনে করে তারা আল্লাহকে ধোকা দিয়েছে। আসলে তারা নিজেরাই নিজেদেরকে প্রতারিত করে থাকে। সূরা বাকারার ৯ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় এবার তুলে ধরা যাক।

প্রথমত: মুনাফিকরা ধোকাবাজ। মানুষের বাহ্যিক চেহারা ও আচরণ দেখে যাতে ধোকা না খায়, সে জন্য সতর্ক থাকতে হবে।

দ্বিতীয়ত: অন্যদের সাথেও প্রতারণা করা থেকে আমাদের বিরত থাকতে হবে। কারণ প্রতারণার কুফলে খোদ প্রতারকই আক্রান্ত হয়।

তৃতীয়ত: মুনাফিকরা ইসলামের সাথে যে ধরনের আচরণ করে তাদের প্রতি ইসলামের ব্যবহারও সেরকম। অর্থাৎ বাহ্যত: মুনাফিকরা মুসলমান হওয়ার ভাব দেখায়, তাই ইসলামও বাহ্যিকভাবে তাকে মুসলমান হিসাবেই জানে। তার অন্তরে ঈমানের লেশমাত্র নেই, তাই কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে কাফেরদের মত শাস্তি দেবেন।

চতুর্থত: মুনাফিক ব্যক্তি নিজেকে খুব চালাক বলে মনে করে, অথচ সে নির্বোধ। সে জানে না যে তার প্রতিপক্ষ আল্লাহ সবার মনের গোপন খবর রাখেন।

সূরা বাকারার ১০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- “তাদের অন্তরে রোগ আছে। এরপর আল্লাহ তাদের রোগ বৃদ্ধি করেন। তাদের মিথ্যাবাদিতার কারণে তাদের জন্য রয়েছে কষ্টদায়ক শাস্তি।”

অন্তরের অসুস্থতার যদি চিকিৎসা করা না হয় তাহলে ক্রমেই তা বৃদ্ধি পায় এবং এক সময় তার মনুষ্যত্ব ধ্বংস করে দেয়। ‘নিফাক’ বা কপটতা আত্মার অন্যতম বিপদ জনক ব্যাধি যা আমাদের সবার মন ও আত্মার জন্য হুমকির সৃষ্টি করে। সুস্থ ব্যক্তি বহুরূপী নয়। তার দেহ ও আত্মার মধ্যে রয়েছে পূর্ণ সমন্বয়। মনে যা আছে তাই সে বলে এবং তার চিন্তার সাথে আচরণের মিল থাকে। কপটতার রোগ অন্য বেশ কিছু আত্মার রোগ সৃষ্টি করে। ব্যক্তির মধ্যে হিংসা, লোভ, কৃপণতা এসব কিছু সহজেই দেখা যায় কপটতা থেকে। এই কপটতা ক্যান্সারের মত দিন দিন মুনাফিক ব্যক্তির মনে-প্রাণে ছড়িয়ে পড়ে। পবিত্র কোরআন মিথ্যাচারকে ‘কপটতা’ রোগের মূল উৎস বলে অভিহিত করে। মিথ্যা থেকেই এ কপটতা শুরু হয় এবং মিথ্যার মাধ্যমেই তা অব্যাহত থাকে। আর মিথ্যা বলা থেকে তারা নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কোন মৃত দেহ যখন পানিতে পড়ে থাকে তখন সেটা থেকে ভীষণ দুর্গন্ধ বের হতে থাকে। বৃষ্টির পানিতে ঐ লাশের দুর্গন্ধ মোটেও কমে না বরং পঁচে গলে ঐ লাশ থেকে আরো বিকট গন্ধ বের হতে থাকে। নিফাককে ঠিক লাশের সাথে তুলনা করা যায়। এই নিফাক বা কপটতা যদি কোন ব্যক্তির মনে শিকড় গেড়ে বসে তাহলে আল্লাহর পক্ষ থেকে যত হুকুম নাযিল হোক না কেন কোন লাভ হবে না। বরং মুনাফিক ব্যক্তি নিজেকে পরিশুদ্ধ করার পরিবর্তে বাহ্যিকভাবে ভালো ও সৎ ব্যক্তির মত আচরণ করে। ফলে তার কপটতা বাড়তে থাকে এবং এটি তার মনের মধ্যে স্থায়ী আসন গেড়ে নেয়। নিফাক শব্দটির অর্থ বেশ ব্যাপক, মানুষের কথা ও কাজের মধ্যে যে কোন ধরনের অসংগতিও এই শব্দের আওতায় পড়ে। একজন মুমিন ব্যক্তির মধ্যেও এ ধরনের অসামঞ্জস্য থাকতে পারে। ইবাদতের মধ্যেও নিফাক কপটতা থাকতে পারে। যদি কোন লোক আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্যে ইবাদত করে সেটাও এক ধরনের নিফাক। রাসূলে খোদা(সা:) বলেছেন কোন ব্যক্তি যত নামাজ রোজাই করুক না কেন তিনটি বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হলে সেই হবে মুনাফিক। আমানতের খিয়ানত করা, মিথ্যা কথা বলা এবং প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা। এ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে-

প্রথমত: নিফাক হচ্ছে এক ধরনের মানসিক রোগ। সে পুরোপুরি সুস্থও নয় আবার মৃতও নয়। মুমিনও নয় আবার কাফেরও নয়।

দ্বিতীয়ত: নিফাক ক্যান্সারের মতো সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। যদি এর চিকিৎসা না হয় তাহলে মানুষের পুরো অস্তিত্ব হুমকিগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

তৃতীয়ত: মিথ্যাই হচ্ছে নিফাকের উৎস। মুনাফিকদের সাধারণ বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে মিথ্যা বলা। #

কোরআনের আলোর এ পর্বে সূরা বাকারার ১১, ১২, ও ১৩ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। ১১ ও ১২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“তাদেরকে যখন বলা হয়-পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করো না, তখন তারা বলে আমরাতো কেবল সংস্কার সাধনকারী। জেনে রাখ এরাই অশান্তি সৃষ্টিকারী। কিন্তু তারা তা বুঝতে পারে না।” নিফাক বা কপটতা এক ধরনের সংক্রামক রোগ। যদি এ রোগের চিকিৎসা করা না হয়, তাহলে এ রোগে সমাজের বহু মানুষ আক্রান্ত হবে। সমাজ কলুষিত হয়ে পড়বে ভণ্ডামী, তোষামোদী, মিথ্যা বলা, পরচর্চা, কুৎসা রটনার মত নানা রকম ব্যাধিতে। মুনাফিক যেহেতু নিজে ধর্মীয় নির্দেশ মেনে চলেনা, তাই চায় মুমিন ব্যক্তিরাও তার মত হয়ে যাক। বিভিন্নভাবে সে মুমিনদেরকে প্রভাবিত করার চেষ্টা চালায়। আল্লাহর নির্দেশকে অবিরাম তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে মানুষকে তাদের কর্তব্যের প্রতি অমনোযোগী করে তোলে। মুনাফিকদের এ ধরনের অন্যায় আচরণের কিছু উদাহরণ পবিত্র কোরআনের সূরা তওবায় উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে তুলে ধরা হয়েছে কিভাবে এ মুনাফিকরা ইসলামের দুশমনদের সাথে লড়াইয়ের সময় যুদ্ধ থেকে পালিয়ে যেত। মুজাহিদদের মনোবল দুর্বল করতো কিংবা দানের ক্ষেত্রে মুনাফিকদেরকে উপহাস করতো। সমাজে সব রকম অপরাধের উৎসই হলো নিফাক। কিন্তু মুনাফিক সত্যকে দেখার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। তাই সে নিজের অন্যায় অপরাধকে সংস্কার বলে মনে করে। কপট ব্যক্তির দৃষ্টিতে শত্রুর সাথে আপোষ এবং রক্তপাতের বিরোধিতার মধ্যে সমাজের মঙ্গল নিহিত। তাই যেভাবেই হোক যুদ্ধ-বিগ্রহ যাতে না বাধে সে ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য যদি মুসলমানরা দুর্বল হয়ে পড়ে তাতেও মুনাফিকের কিছু আসে যায় না। সূরা বাকারার ১১ ও ১২ নম্বর আয়াতের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা এবার তুলে ধরছি।

প্রথমত: নিফাকের প্রভাব শুধু ব্যক্তির মধ্যেই নয় বরং সমাজের উপরও এর প্রভাব পড়ে এবং সমাজকে নিয়ে যায় অশান্তির দিকে।

দ্বিতীয়ত: নিফাকের একটি বৈশিষ্ট্য হলো আত্মগর্ব। মুনাফিকরা বলে-আমরাই কেবল উপযুক্ত ব্যক্তি এবং সংস্কার সাধনকারী, অন্য কেউ নয়।

তৃতীয়ত: কোন ব্যক্তির অন্তরে যদি নিফাক অনুপ্রবেশ করে তাহলে তার উপলব্ধি ক্ষমতা লোপ পায় এবং সত্য কথা শুনতে ও দেখতে চায় না।

চতুর্থত: মুনাফিকদের বাহ্যিক চাকচিক্যময় অথচ অন্ত:সারশূণ্য বক্তব্য সম্পর্কে মুমিনদেরকে সতর্ক থাকতে হবে। যাতে মুনাফিকদের ধোকায় তারা না পড়ে।

পঞ্চমত: যে চালাকী সত্য পথে এবং সমাজের কল্যাণের জন্য নিবেদিত নয় তা মূলত: বোকামী ও নির্বুদ্ধিতা।

সূরা বাকারার ১৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- “যখন মুনাফিকদেরকে বলা হয় অন্যান্যদের মত তোমরাও ঈমান আনো, তখন তারা বলে আমরাও কি নির্বোধদের মত ঈমান আনবো? জেনে রাখ এরা নিজেরাই নির্বোধ, কিন্তু এরা তা বুঝতে পারে না।”

গর্ব, অহঙ্কার অন্য মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা এ সবই নিফাকের বৈশিষ্ট্য। তারা নিজেদেরকে বুদ্ধিমান, প্রজ্ঞাবান ও চালাক মনে করে। আর মুমিনদেরকে ভাবে নির্বোধ, সহজ-সরল ও বোকা। তাই কপট বা মুনাফিক ব্যক্তিদেরকে যখন বলা হয় কেন তোমরা নিজেদেরকে অন্যান্য মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছ এবং তাদের মত ঈমান আনোনা। তখন তারা ঈমানদার ও বিশ্বাসীদেরকে বোকা বলে অভিহিত করে। যে মুমিন ব্যক্তিরা সুখ-দু:খ, যুদ্ধ-বিগ্রহ, ঝড়-ঝঞ্ঝা সর্বাবস্থায় তাদের ধর্ম ও নেতার পাশে অতন্দ্র প্রহরীর মতো দায়িত্ব পালন করে, তাদেরকে মুনাফিকরা নির্বোধ বলে মনে করে। আর পবিত্র কোরআন তাদের এ ধরনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথার জবাবে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলে-তোমরা যারা মুমিনদেরকে নির্বোধ মনে কর, তারাই আসল নির্বোধ। তবে সমস্যা হলো তারা তাদের এই মূর্খতা ও নির্বুদ্ধিতা সম্পর্কে জানেনা। তারা তাদের অজ্ঞতা সম্পর্কেই কিছু জানে না। তাই তারা ভাবে অন্যরা কেউ কিছু জানেনা আর তারা সব কিছু জানে বোঝে।

সূরা বাকারার ১৩ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় এবার তুলে ধরছি।

প্রথমত: মুমিনদের খাটো করা, অপমান করা মুনাফিকদের একটি পন্থা। এভাবে তারা নিজেদেরকে অন্যদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করতে চায়।

দ্বিতীয়ত: অহঙ্কারী ব্যক্তির সাথে তার মতো আচরণ করা উচিৎ। যে ব্যক্তি মুমিনদের হেয় করে তাকেও সমাজে হেয় করতে হবে যাতে তার মিথ্যা অহঙ্কার ও দর্প চূর্ণ হয়।

তৃতীয়ত: উপহাস ও হেয় করা নির্বোধের কাজ। বুদ্ধিমান ব্যক্তি যুক্তির ভাষায় কথা বলে, আর নির্বোধ ব্যক্তি কথা বলে উপহাসের ভাষায়।

চতুর্থত: আল্লাহপাক মুনাফিকদেরকে এ দুনিয়াতেই অপদস্ত করেন। এবং তাদের কদর্য চেহারা উন্মোচিত করেন। #

কোরআনের আলোর আজকের পর্বে আমরা সূরা বাকারার ১৪, ১৫ ও ১৬ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করব। সুরা বাকারার ১৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- “মুনাফিকরা যখন ঈমানদারদের সংস্পর্শে আসে তখন তারা বলে-আমরাও বিশ্বাস করি। কিন্তু যখন তারা তাদের শয়তান সহযোগীদের সাথে গোপনে মিলিত হয় তখন তারা বলে-আমরাতো তোমাদের সাথে রয়েছি।

আমরা শুধু ঈমানদারদের সাথে ঠাট্টা-তামাশা করে থাকি। নিফাক বা কপটতার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মুনাফিকের কোন নিজস্ব স্বাধীন ও দৃঢ় ব্যক্তিত্ব নেই। মুনাফিকরা যে পরিবেশে যায় সেই পরিবেশের রং ধারন করে। তারা যখন মুমিনদের মাঝে যায়, তখন মুমিনের ভাব দেখায়। আবার যখন ইসলামের নেতা ও মুমিনদের দুশমনদের সাথে মিলিত হয়, তাদের সাথে কণ্ঠে কণ্ঠ মেলায়, মুমিনদের বিরুদ্ধে কথা বলে এবং তাদের সুনজরে পড়ার জন্য মুমিনদেরকে নিয়ে উপহাস ও ঠাট্টা-তামাশা করে। এই আয়াতও আমাদেরকে সতর্ক করে দেয় যাতে লোকজনের বাহ্যিক আচরণে আমরা ধোকা না খাই। ঈমানের দাবী করলেই তাকে মুমিন ভাবা ঠিক নয় এবং দেখতে হবে ঈমানের দাবীদার ব্যক্তি কাদের সাথে ওঠা বসা করে এবং তার বন্ধুই বা কারা। কেউ মুমিন হবে আবার ইসলামের নেতাদের শত্রু ও ধর্মের দুশমনদের বন্ধু হবে-এটা মেনে নেয়া যায় না।

ঈমান, ইসলামের শত্রুদের সাথে আপোষ এবং বন্ধুত্বের পরিপন্থী। ঈমানের আবশ্যিক দিক হলো আল্লাহর দুশমনদের সাথে শত্রুতা। সূরা বাকারার ১৪ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো-

প্রথমত: শয়তান শুধু জ্বীন জাতির শয়তান নয় বরং যেসব মানুষ অন্যদেরকে বিভ্রান্ত করে তারাও শয়তান এবং তাদেরকে পরিহার করতে হবে।

দ্বিতীয়ত: সত্য ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গোপন বৈঠক ও শলা-পরামর্শের অর্থ হলো মত প্রকাশে সাহসিকতার অভাব। মুনাফিকরা যারা বিশ্বাসীদেরকে উপহাস ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে, তারা ভীতু ও দুর্বল চিত্তের অধিকারী।

তৃতীয়ত: মুনাফিকরা হলো সমাজে দুশমনদের হাতিয়ার এবং তাদেরই ইচ্ছা অনুযায়ী চলে। তাদেরকে বলে “ইন্না মাআকুম”- আমরা তোমাদের সাথে আছি, মুমিনদের সাথে নয়।

এবারে সূরা বাকারার ১৫ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। এ আয়াতে বলা হয়েছে- “আল্লাহও তাদেরকে উপহাস করেন এবং তাদেরকে তাদের অবাধ্যতায় বিভ্রানে-র মত ঘুরে বেড়ানোর অবকাশ দেন। রাসূলে খোদার আহলে বাইতের সদস্য ইমাম মূসা রেজা(আ:) বলেন-“আল্লহপাক ধোকাদানকারী বা উপহাসকারী নন। কিন্তু দুশমনদের ধোকা ও উপহাসের শাস্তি তিনি দেন।” মুনাফিকরা যে বিভ্রান্তি ও হৃদয়ের অন্ধত্বের শিকার হয় তার চেয়ে বড় শাস্তি আর কী হতে পারে? আল্লাহর নিয়ম হলো তিনি অত্যাচারী পাপীদের সময় দেন। এ সময়টিকে যদি মানুষ তওবা ও অনুশোচনার জন্য ব্যবহার করে তাহলে তা হবে তার জন্য রহমত। তা না হলে তারা আরো পাপের মধ্যে ডুবে যাবে এবং শেষ পর্যন্ত ধ্বংস হয়ে যাবে। মুনাফিকদের জন্য আল্লাহর শাস্তি হলো তাদেরকে নিজেদের অবস্থায় ছেড়ে দেয়া। এর ফলে তাদের মধ্যে বিভ্রান্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। তাদের নেই কোন লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং নেই কোন শান্তি। সূরা বাকারার ১৫ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো-

প্রথমত: মানুষের গুনাহ্‌ যেরকম, আল্লাহর শাস্তিও সেরকম। তাই উপহাসের শাস্তিও উপহাস।

দ্বিতীয়ত: আমাদেরকে যে সময় দেয়া হয়েছে তাতে অহঙ্কারী হওয়া উচিত নয়। হয়তো এটিও আল্লাহর এক ধরনের রহমত।

তৃতীয়ত: আল্লাহপাক মুমিনদের সাহায্যকারী। মুনাফিকরা যদি মুমিনদের উপহাস করে তাহলে আল্লাহও তাদেরকে উপহাস করবেন এবং শাস্তি দেবেন।

এবারে সুরা বাকারার ১৬ নম্বর আয়াত। এ আয়াতে বলা হয়েছে- “এরাই সৎ পথের বিনিময়ে ভ্রান্ত পথ কিনে নিয়েছে। কিন্তু তাদের ব্যবসা লাভজনক হয়নি এবং তারা সৎ পথও পায়নি।” আমরা যে দুনিয়ায় বাস করছি, তা একটি বাজারের মত। আমাদের সবাইকে ব্যবসায়ী হিসাবে নিজেদের সম্পদ বিক্রি করতে হয়। যৌবন, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা জ্ঞান, শক্তি, জীবন এবং আল্লাহর দেয়া সব যোগ্যতাকে সম্পদ হিসাবে বিক্রি করতে হয়। এ বাজারে একদল মুনাফা অর্জন করে, অন্যদল দেউলিয়া হয়ে পড়ে। যারা দেউলিয়া হয়ে পড়ে, তারা লাভতো দূরের কথা এমনকি মূলধন পর্যন্ত হারিয়ে ফেলে। এ যেন অনেকটা বরফ বিক্রেতার মত। বরফ বিক্রেতা যদি তার জিনিস বিক্রি না করে তা হলে মুনাফাতো নয়ই বরং তার মূলধন পানি হয়ে যাবে এবং সে তার সর্বস্ব হারাবে।

আল্লাহপাক কোরআনের বিভিন্ন স্থানে মানুষের ভালো ও মন্দ কাজকে ব্যবসার সাথে তুলনা করেছেন। যেমন সূরা সাফের ১০ ও ১১ নম্বর আয়াতে ঈমান ও জেহাদকে লাভজনক ব্যবসা আখ্যায়িত করে বলা হয়েছে- “হে ঈমানদারগণ! আমি কি এমন এক ব্যবসার সন্ধান দেব যা তোমাদেরকে কঠিন শাস্তি থেকে রক্ষা করবে? আর তা হলো-তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন কর এবং তোমাদের ধন-সম্পদ ও জীবন দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম কর।”

এ আয়াতে মুনাফিকদেরকে এমন বিক্রেতা হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে যারা হেদায়েত বিক্রি করে ভ্রান্তি কিনে নিয়েছে। সম্ভবত: এ আয়াত থেকে বোঝানো হচ্ছে যে- আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমতা ও প্রকৃতিগত প্রবণতার মাধ্যমে মানুষ সঠিক পথে পরিচালিত হতে পারে। কিন্তু মুনাফিকরা কপটতা ও পাপ কাজে অভ্যস- হয়ে আল্লাহর দেয়া ক্ষমতা হাত ছাড়া করে। কারণ মুনাফিকরাতো হেদায়াতেরই অধিকারী নয় যে তারা তা হাত ছাড়া করবে এবং এর বিনিময়ে ভ্রান্তি কিনে নেবে। এই ব্যবসায় তারা কোন মুনাফা অর্জন করেনি এবং অশুভ লক্ষ্যেও পৌঁছতে পারেনি বরং ইসলাম আরো সুদৃঢ় হয়েছে এবং তারা অপদস- হয়েছে। সূরা বাকারার ১৬ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো-

প্রথমত: কেবল বস্তুগত লাভ-লোকসানের কথা ভাবা ঠিক নয় বরং দেখতে হবে আমাদের মন-প্রাণ ও আত্মাকে কোথায় বিক্রি করছি এবং এর বিনিময়ে কী অর্জন করছি? এই বেচা-কেনা থেকে সৌভাগ্যবান হচ্ছি নাকি বিভ্রান্তির স্বীকার হচ্ছি?

দ্বিতীয়ত: হেদায়াত এবং বিভ্রান্তি আমাদের নিজেদেরই কর্মফল। আল্লাহর পক্ষ থেকে চাপিয়ে দেয়া কিছু নয় কিংবা তাঁর ইচ্ছা, মর্জি বা তকদির নয় বরং তাতে আমাদের কর্মের প্রভাব রয়েছে।

তৃতীয়ত: নিফাক বা ভণ্ডামীর শেষ পরিণতি হলো বিভ্রান্তি ও ধ্বংস। অপর পক্ষে ঈমান বা বিশ্বাস মানুষকে কল্যাণ ও সৌভাগ্যের দিকে নিয়ে যায়। #

কোরআনের আলোর আজকের পর্বে আমরা সূরা বাকারার ১৭, ১৮ ও ১৯ নম্বর আয়াতের সহজ ব্যাখ্যা তুলে ধরব। সূরা বাকারার ১৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- “এ মুনাফিকদের দৃষ্টান্ত তাদের মত-যেমন কেউ আগুন জ্বালালো, ঐ আগুন যখন তাদের চারদিক আলোকিত করল তখন আল্লাহ তাদের জ্যোতি সরিয়ে নিলেন এবং তাদেরকে এমন ঘোর অন্ধকারের মধ্যে ফেললেন যাতে তারা কিছুই দেখতে না পায়।” এর আগের আয়াতগুলোয় মুনাফিকদের কথা ও আচরণের কিছু দৃষ্টান্ত বর্ণনা করা হয়েছিল। এ আয়াতে তাদেরকে অন্ধকার প্রান্তে অগ্নী প্রজ্জ্বলনকারী ব্যক্তির সাথে তুলনা করে বলা হয়েছে-মুনাফিকদের ঈমানের আলো আগুনের আলোর মত দুর্বল, অস্থায়ী এবং এতে রয়েছে ধোঁয়া, ছাই ও অন্তর্জ্বালা। মুনাফিকরা ঈমানের আলোর বহি:প্রকাশ ঘটায়। কিন্তু তাদের ভেতর রয়েছে কুফরী বা খোদাদ্রোহিতার আগুন। এই দুর্বল আলো মানব প্রকৃতিতে দেয়া আল্লাহর সেই পবিত্র নূরেরই অংশ। কিন্তু হিংসা-বিদ্বেষ ও একগুঁয়েমির কারণে ঐ নূর ক্রমেই নিষপ্রভ হয়ে আসে। এ ভাবে ধীরে ধীরে একসময় অজ্ঞতা ও অন্ধকারের পর্দায় তা আচ্ছাদিত হয়ে যায় এবং মুনাফিকদের সমস্ত অস্তিত্ব ছেয়ে পড়ে কুফুরী বা খোদাদ্রোহিতার নিকষ কালো অন্ধকারে। মুনাফিকরা কপটতার পথ বেছে নিয়ে মনে করে নরকবাসী কাফেরদের খুশী রাখতে পারবে এবং একই সাথে বেহেশতবাসী মুমিনদেরও সন’ষ্ট করতে পারবে। কাফেরদের দুনিয়া থেকেও লাভবান হবে এবং মুমিনদের পরকাল থেকেও বঞ্চিত হবে না। তাই কোরআন মুনাফিকদেরকে এমন ব্যক্তির সাথে তুলনা করেছে যে আগুন জ্বালিয়ে আগুন ও আলো অর্থাৎ সত্য ও মিথ্যার সমন্বয় ঘটায় যাতে এ দুটো থেকেই লাভবান হতে পারে। কিন্তু জীবন হলো অন্ধকার প্রান্তরের মত। এ দুর্গম প্রান্তর অতিক্রম করে নিশ্চিন্তে গন্তব্যে পৌঁছার জন্য উজ্জ্বল ও স্থায়ী আলোর প্রয়োজন। কারণ ঝড়-ঝঞ্ঝা যে কোন দুর্বল আলোর শিখা নিভিয়ে দেয় এবং মানুষকে নিমজ্জিত করে গভীর অন্ধকারে।

সূরা বাকারার ১৭ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো-

প্রথমত: মুনাফিকের আলো আগুনের আলোর মত অস্থায়ী এবং দুর্বল।

দ্বিতীয়ত: মুনাফিকের অস্তিত্ব হলো অশান্তি ও আগুনের উৎস।

তৃতীয়ত: মুনাফিকরা সত্যিকার আলো বা হকে পৌঁছবার জন্য আগুন ব্যবহার করে। কিন্তু এর ফলে জ্বালা-পোড়া, ছাই আর ধোঁয়া ছাড়া অন্য কিছু পায় না।

চতুর্থত: শেষ পর্যন্ত আল্লাহপাক মুনাফিককে পর্যুদস্ত করেন এবং তাদের বাহ্যিক জ্যোতিও ছিনিয়ে নেন।

পঞ্চমত: মুনাফিকদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার এবং তাদের মুক্তির কোন আশা নেই।

ষষ্ঠত: আল্লাহর সামনে তাদের কপটতা ও দ্বিমুখী আচরণ তাদের বুদ্ধিমত্তার বহি:প্রকাশ নয় বরং তাদের এ আচরণ তাদের জন্য বয়ে আনে অন্ধকার ও ধ্বংস।

এবারে সুরা বাকারার ১৮ নম্বর আয়াত। এ আয়াতে বলা হয়েছে- “তারা মূক, বধির ও অন্ধ। সুতরাং তারা প্রত্যাবর্তন করবে না।”

অন্যান্য মানুষের মত মুনাফিকদেরও চোখ, কান ও মুখ আছে। কিন্তু তাদের চোখ যেহেতু সত্য দেখতে ও উপলদ্ধি করতে প্রস’ত নয়, তাদের কান যেহেতু সত্য কথা শুনতে রাজী নয় এবং তাদের জীভ যেহেতু সত্য কথা বলা থেকে বিরত থাকে তাই কোরআন তাদেরকে এমন ব্যক্তিদের সাথে তুলনা করেছে যারা কথা বলতে পারে না, চোখে দেখে না এবং কানে শোনে না। বিদ্বেষ ও অন্ধ অনুসরণের পরিণতি হলো সত্য উপলব্ধির ক্ষমতা হাতছাড়া করা। মুনাফিকের অভ্যন্তরীণ কুফরী ও অবিশ্বাস তার চোখ, কান ও বাক শক্তিকে এমন ভাবে ঢেকে দেয় এবং সত্যকে আচ্ছাদিত করে যে, সে কাফেরের মতই সত্যকে উল্টো দেখতে পায়। সত্যকে মিথ্যা থেকে পৃথক করার শক্তি হারিয়ে ফেলে। এর আগের আয়াতে বলা হয়েছে যে ঈমানের আলো সরে যাওয়ার পর অবিশ্বাসের অন্ধকার মুনাফিকদের সমস্ত অস্তিত্ব এমন ভাবে ঢেকে ফেলে যে তারা দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলে। আর এ আয়াতে বলা হচ্ছে যে তারা শুধু দৃষ্টিশক্তিই নয় একই সাথে শ্রবন ও সত্য কথা বলার শক্তিও হারিয়ে ফেলে। অন্ধকারের মধ্যে তাদের পথ চলার পরিণতি ধ্বংস ছাড়া আর কিছু নয় এবং এ থেকে ফিরে আসার কোন পথ নেই।

এবারে সূরা বাকারার ১৯ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। এ আয়াতে বলা হয়েছে- “কিংবা তাদের মত যারা আকাশ থেকে মুষলধারে ভারী বৃষ্টির সময় ঘোর অন্ধকার, বজ্রধ্বনিও বিদ্যুৎ চমকের মধ্যে আক্রান্ত। তারা বজ্রের শব্দে মৃত্যুভয়ে কানে আঙ্গুল দেয়। কিন্তু আল্লাহ কাফেরদেরকে পরিবেষ্টন করে আছেন। সূরা বাকারার ১৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক মুনাফিকদেরকে এমন দিগভ্রান্তদের সাথে তুলনা করেছেন যারা তাদের পথের আলো হারিয়ে ফেলেছে এবং নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে উদ্‌ভ্রান্তের মত পথ হাতড়াচ্ছে। কিন্তু তাদের সঠিক পথ পাওয়ার কোন আশা নেই, আশা নেই প্রত্যাবর্তনের।

কিন্তু এই ১৯ নম্বর আয়াতে বলা হচ্ছে যে, মুনাফিকরা কাদার মধ্যে আটকে আছে, আর মুষলধারে বৃষ্টি, অন্ধকার, রক্তহিম করা বজ্রপাতের শব্দ চোখ ধাঁধানো বিদ্যুৎ চমকানী এবং ভয়ঙ্কর মৃত্যুভয় তাদেরকে ঘিরে রেখেছে। কিন্তু বৃষ্টি থেকে নিজেদেরকে রক্ষার কোন আশ্রয়স’ল তাদের নেই এবং অন্ধকার, বিদ্যুৎ ঝলক, বজ্রপাতের শব্দ থেকেও তাদের নিস্তার নেই।

সূরা বাকারার ১৯ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে-

প্রথমত: মুনাফিকরা সমস্যায় জর্জরিত এবং সন্ত্রস্ত। এ দুনিয়াতে ভয় ও শঙ্কায় সব সময় তারা আক্রান্ত।

দ্বিতীয়ত: মৃত্যুভয়ে মুনাফিকরা সব সময় শঙ্কিত। এই ভয় ও আশঙ্কার কারণে তাদের আত্মায় শান্তি নেই।

তৃতীয়ত: আল্লাহপাক মুনাফিকদেরকে ঘিরে রেখেছেন এবং তাদের ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেন।

চতুর্থত: নিফাক বা কপটতার ফলে শেষ পর্যন্ত কুফুরী বা অবিশ্বাসের জন্ম হয়।

পঞ্চমত: আকাশ থেকে বর্ষিত বৃষ্টি থেকে মুনাফিকদের ভাগ্যে কেবল বজ্রপাতই জোটে। কোরআন মানবজাতির জন্য আল্লাহর রহমত। কিন্তু মুনাফিকের জন্য এই কোরআন হলো বিপদ ঘন্টা এবং অপমানের উৎস। #

কোরআনের তাফসীর বিষয়ক অনুষ্ঠান কোরআনের আলোর ১১তম পর্বে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। আজ সূরা বাকারার ২০, ২১, ও ২২ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। ২০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“বিদ্যুৎ চমক তাদের দৃষ্টি শক্তি প্রায় কেড়ে নেয়। আসমানের বিদ্যুৎ যখন অন্ধকার প্রান্তরে তাদের জন্য আলো নিয়ে আসে, তখন তারা কয়েক কদম অগ্রসর হয়। কিন্তু যখন অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়, তখন তারা থমকে দাঁড়ায়। আল্লাহ চাইলে তাদের শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি কেড়ে নিতেন। নিশ্চয়ইই আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান। আকাশের বিদ্যুৎ চমক আর বজ্রপাতের শব্দ বৃষ্টির আলামত। এ হলো পৃথিবীবাসীদের জন্য নব প্রাণ, সবুজ ও সজীবতার আগমনী বার্তা। কিন্তু এই আগমনী বার্তা সবার জন্য সুসংবাদ নয়। বরং তাদের জন্য শুভবার্তা যারা আল্লাহর এই রহমত থেকে উপকৃত হতে প্রস্তুত। তাহলে ঐ উদ্ভ্রান্ত যাত্রীর কি অবস্থা হবে? উদ্ভ্রান্ত যাত্রী বা মুনাফিক অন্ধকার প্রান্তরে যে আগুন জ্বালিয়েছে তার দুর্বল আলো এবং আকাশের বিদ্যুৎ চমকানীর চোখ ধাঁধাঁনো আলোর কোনটাই তাকে জীবন চলার পথে সঠিক রাস্তা দেখাতে পারবে না। কারণ আগুনের আলো হলো অস্থায়ী, আর বিদ্যুৎ চমকের ফলে যে আলো সৃষ্টি হয় তা বৃষ্টির বার্তা বয়ে আনে এবং এতে মুনাফিকদের জন্য দু:খ ছাড়া আর কিছু নেই। আল্লাহর অহী হলো আসমানের চোখ ধাঁধাঁনো বিদ্যুৎ ঝলকের মত। এটি দেখার সাধ্য ও ক্ষমতা মুনাফিকদের নেই। তারা পয়গম্বরদের কাছ থেকে আগত আল্লার ওহী থেকে উপকৃত হওয়ার চেষ্টা করে না। যদিও মুনাফিকরা বাহ্যিকভাবে ঈমানদার হওয়ার দাবী করে এবং এই নূর থেকে উপকৃত হতে চায়। কিন্তু বিদ্যুৎ চমক তাদের দৃষ্টি শক্তি কেড়ে নেয়, তাদের জন্য এগুবার পথ বন্ধ করে দেয়। মুনাফিকদেরকে কোরআন এমনভাবে অপদস্থ করে যে তারা মুনাফিকদের সাথে পথ চলা অব্যাহত রাখতে পারে না। তাদের সামনের দিকে যাওয়ার যেমন পথ থাকেনা তেমনি পিছু হটারও কোন উপায় থাকেনা। তারা পথ হারিয়ে উদ্ভ্রান্তের মত উদ্বেগ উত্তেজনায় পথ হাতড়াতে থাকে। এসব হলো আল্লাহ এবং মুমিনদের সাথে কপটতার দুনিয়াবী ফল। আল্লাহ যদি তাদেরকে শাস্তি দিতে চান তাহলে তারা শুধু চলার শক্তিই হারাবে না একই সাথে দৃষ্টি ও শ্রবণ শক্তিও হারিয়ে বসবে।

সূরা বাকারার ২০ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো-
প্রথমত: আল্লাহর নূর দেখার শক্তি মুনাফিকদের নেই। আল্লাহর বাণী আকাশের বিদ্যুৎ চমকের মত তাদের দৃষ্টি শক্তি হরণ করে নেয়।
দ্বিতীয়ত: মুনাফিকদের নিজস্ব কোন আলো নেই তাই তারা মুমিনদের আলোয় পথ চলার চেষ্টা করে।
তৃতীয়ত: মুনাফিকরা অনেক সময় কয়েক কদম অগ্রসর হলেও মূলত: অগ্রসর হতে পারে না এবং অবশেষে থমকে দাঁড়ায়।
চতুর্থত: মুনাফিকরা তাদের অপকর্মের কারণে যে কোন সময় আল্লাহর গজবের শিকার হতে পরে।
পঞ্চমত: মুনাফিকরা আল্লাহকে ধোকা দিতে পারবে না এবং আল্লাহর শাস্তি থেকেও পালাতে পারবেনা। কারণ আল্লহপাক সর্বশক্তিমান এবং কোন কাজই তার অসাধ্য নয়।

এবারে সূরা বাকারার ২১ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। এ আয়াতে বলা হয়েছে-“হে মানুষ! তোমরা তোমাদের সেই প্রতিপালকের এবাদত কর, যিনি তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে সৃষ্টি করেছেন যাতে তোমরা মুত্তাকী ও পরহেজগার হও।” সূরা বাকারার আগের ২০টি আয়াতে আল্লাহপাক তিন শ্রেণীর মানুষের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করেছেন। এই তিন শ্রেণী হলো-পরহেজগার, কাফের ও মুনাফিক। এই তিন শ্রেণীর লোকদের বৈশিষ্ট্য, চিন্তাধারা ও আচরণ তুলনা করার পর এই আয়াতে কল্যাণ ও মুক্তির পথনির্দেশ করে বলা হয়েছে-প্রথম দলের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার জন্য এবং তাকওয়া বা খোদাভীরুতার অধিকারী হওয়ার জন্য কেবল একটি পথ রয়েছে। আর তা হলো সব কিছু থেকে মুক্ত হয়ে একমাত্র আল্লাহর প্রতি আসক্ত হওয়া, যে আল্লাহ আমাদেরকে এবং আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে সৃষ্টি করেছেন। অন্যদের দাসত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য একমাত্র তারই দাসত্ব করতে হবে। এমন অনেক মানুষ আছে যারা আল্লাহকে বিশ্ব জগত ও মানুষের স্রষ্টা বলে স্বীকার করে, কিন্তু নিজের ও সমাজ জীবনের দিকনির্দেশনা ও জীবনাদর্শ গ্রহণ করে অন্যদের কাছ থেকে। যেন আল্লাহ তাদেরকে সৃষ্টি করে দুনিয়ায় ছেড়ে দিয়েছেন যাতে তারা তাদের খুশীমত চলে। এই আয়াতে এ ধরণের চিন্তা-ভাবনার জবাবে বলা হয়েছে-“তোমাদের স্রষ্টা, তোমাদের প্রতিপালকও বটে। তোমাদের বিকাশ ও বেড়ে ওঠার জন্য কিছু দায়িত্ব ও কর্মসূচী নির্ধারণ করেছে এবং একটি নির্দিষ্ট নীতিমালা ও ব্যবস্থা ঠিক করে দিয়েছে। আইন ও বিধান দেয়ার অধিকার একমাত্র আল্লাহর যিনি কিনা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন।”
অতএব একমাত্র তারই উপাসনা করতে হবে, তার আনুগত্য করতে হবে এবং তার দেয়া বিধান মেনে চলতে হবে। স্রষ্টা ও প্রতিপালকের আনুগত্য এবং তার দেয়া আইন মেনে চললে মানুষেরই লাভ। এর ফলে মানুষ মন্দ ও অকল্যাণ থেকে মুক্তি পাবে এবং উত্তম ও কল্যাণের অধিকারী হবে। সূরা বাকারার ২১ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো-
প্রথমত: সত্য ও কল্যাণের দিকে পয়গম্বরদের আহ্বান সার্বজনীন। কোন বিশেষ শ্রেণী, জাতি বা গোত্রের জন্য নির্ধারিত নয়। তাই পবিত্র কোরানে প্রায় ২০ বার সব মানুষকে উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে-“ইয়া আইয়ুহান্নাস”।
দ্বিতীয়ত: আল্লাহর এবাদত ও উপাসনার একটি অন্যতম উদ্দেশ্য হলো আমাদের প্রতি এবং আমাদের পূর্ব পুরুষদের প্রতি আল্লাহপাকের অশেষ নেয়ামতের প্রতি শোকর আদায় করা।
তৃতীয়ত: আমাদেরকে সৃষ্টি করা হলো আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের জন্য সর্বপ্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত। এ মহান নেয়ামতের বিনিময়ে আল্লাহর নির্দেশের সামনে আমাদের পূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শন করা উচিত।
চতুর্থত: তাকওয়া ও নিষ্কলুষতার উৎস হলো এবাদত। যদি কোন এবাদত আমাদের মধ্যে তাকওয়া ও সংযমের বৃদ্ধি না ঘটায় তাহলে তা এবাদতই নয়।
পঞ্চমত: আমাদের পূর্ব পুরুষদের আচার-আচরণ ও বিশ্বাসকে আল্লাহর নির্দেশের উপর প্রাধান্য দেয়া উচিত হবেনা। কারণ তারাও আল্লাহর সৃষ্টি। তাদেরকে অনুসরণ করতে গিয়ে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করা চলবে না।
ষষ্ঠত: আমাদের এবাদত-বন্দেগী ও উপাসনার কোন প্রয়োজন আল্লাহর নেই। আমাদের নামাজ-রোজা ও অন্যান্য এবাদত আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বকে বৃদ্ধি বা হ্রাস করে না। বরং নিজেদের বিকাশ ও পূর্ণতার জন্যেই আমাদেরকে তার এবাদত করতে হবে এবং তাঁর পূর্ণ অনুগত থাকতে হবে।
সপ্তমত: লক্ষ্য রাখতে হবে নিজেদের এবাদতের কারণে অহঙ্কারী না হয়ে পড়ি। মুত্তাকী ও পরহেজগার হওয়ার পথে বড় বাধা হচ্ছে অহঙ্কার ও লোক দেখানো এবাদত।

এবারে সূরা বাকারার ২২ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। এ সুরায় বলা হয়েছে-” প্রতিপালক পৃথিবীকে আমাদের জন্য বিছানা ও আকাশকে ছাদ করেছেন, এবং আকাশ থেকে পানি বর্ষন করে তা দিয়ে তোমাদের জন্য ফল-মূল উৎপাদন করেন। সুতরাং জেনে শুনে কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ দাঁড় করিও না।”
এ আয়াতে আল্লাহপাক বেশ কিছু নেয়ামতের কথা উল্লেখ করেছেন, যে নেয়ামতগুলো আবার অন্য বেশ কিছু নেয়ামতের উৎস। আল্লাহ পৃথিবীকে মানুষের জন্য বিছানার মত করে সৃষ্টি করেছেন। এই পৃথিবীর পাহাড় প্রান্তর, মাটি, পানি, মাটির ওপর ও ভেতরকার হরেক রকমের খনিজ ও প্রাকৃতিক দ্রব্য সব কিছু মানুষের বেঁচে থাকার জন্য উত্তম ব্যবস্থায় সৃষ্টি করেছে। আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে চমৎকার সমন্বয়ের ফলে বৃষ্টি ঝরে পড়ে, বেড়ে ওঠে গাছ-পালা, ফল-মূল। এভাবে মানুষ খাদ্য ও জীবিকা লাভ করে। এ সব কিছুই সংঘটিত হয় আল্লাহর অসীম শক্তি ও ক্ষমতার বলে। তাই অন্যরা যখন তাদের বেঁচে থাকার জন্য আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীল তখন কিভাবে তাদেরকে আল্লাহর সমকক্ষ বিবেচনা করবো? কি করে আল্লার নির্দেশ বাদ দিয়ে তাদের নির্দেশ মানা সম্ভব? সূরা বাকারার ২২ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হলো-
প্রথমত: আল্লাহকে চেনা, তাঁর আনুগত্য করা এবং আল্লাহর এবাদতের সর্বোত্তম উপায় হলো তাঁর নেয়ামতের প্রতি লক্ষ্য করা। তাই এর আগের আয়াতে আল্লাহর উপাসনার নির্দেশ দেয়ার পর এ আয়াতে মানুষের প্রতি আল্লাহর কিছু নেয়ামতের কথা তুলে ধরা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত: আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যকার চমৎকার সমন্বয় ও শৃংখলা হলো এক মহা ক্ষমতাবান ও জ্ঞানী স্রষ্টার অস্তিত্বের সেরা দলিল।
তৃতীয়ত: এ আয়াত থেকে বোঝা যায় আল্লাহপাক সৃষ্টি জগতকে মানব জাতির জন্য সৃষ্টি করেছেন। অন্য সব কিছু সৃষ্টি করেছেন মানুষের জন্য।
চতুর্থত: সৃষ্টি জগতের প্রত্যেক অংশের মধ্যে বিরাজমান সমন্বয় ও শৃংখলা থেকে এক খোদার অস্তিত্ব বোঝা যায়। এ দিকে লক্ষ্য রেখে আমাদেরকে হতে হবে একত্ববাদী এবং কোন কিছুকে আল্লাহর সমকক্ষ দাঁড় করানো চলবে না।
চতুর্থত: আল্লাহকে জানা এবং তার উপাসনা করা মানুষের সহজাত বিষয়। প্রত্যেক মানুষের অন্তরে এ দুই অনুভূতির অস্তিত্ব রয়েছে। তাই সূরা বাকারার ২২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“তোমরা নিজেরাই জানো।”
পঞ্চমত: পানি ও মাটি হলো গাছ-পালা বেড়ে ওঠার মাধ্যম। কিন্তু এ সবের বিকাশ-বৃদ্ধি সব আল্লার হাতে। তাই আল্লাহপাক বলেছেন-“তিনিই তোমাদের জন্য ফল-মূল উৎপাদন করেন।#

কোরআনের আলো অনুষ্ঠানে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। আজকের পর্বে আমরা সূরা বাকারার ২৩ ও ২৪ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করবো। ২৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“আমি আমার বান্দার প্রতি যা অবতীর্ণ করেছি তাতে তোমাদের কোন সন্দেহ থাকলে তোমরা তার মত কোন সূরা আনো। আর যদি সত্যবাদী হও তাহলে এ কাজের জন্য আল্লাহ ছাড়া তোমাদের সব সাক্ষীকে আহ্বান কর। প্রত্যেক নবীকে তার নবুয়্যত প্রমাণ করার জন্য মুজিযা আনতে হয়। মুজিযা অর্থাৎ এমন অলৌকিক কাজ তাকে দেখাতে হয় যা অন্যদের পক্ষে দেখানো সম্ভব নয়। ইসলামের নবী হজরত মোহাম্মদ (সা:)এর মুজিযা হলো পবিত্র কোরআন। মানব জাতি ভাষা কিংবা অর্থের দিক থেকে কোরআনের মত গ্রন্থ সৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অক্ষম। আল্লাহপাক ইসলাম বিরোধীদের প্রতি বহুবার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেছেন-“তোমরা যদি কোরআনকে আল্লাহর কিতাব বলে মনে না করো এবং একে মানব রচিত গ্রন্থ বলে মনে করো তাহলে আমার মতো একটি গ্রন্থ নিয়ে আসো।” মজার ব্যাপার হলো কোরআন দুশমনদেরকে বার বার তার চ্যালেঞ্জের শর্ত সহজ করে দিয়েছে। একবার বলেছে-কোরআনের মত কোন গ্রন্থ নিয়ে আসো। আরেক জায়গায় বলেছে-কোরআনের মত দশটি সূরা নিয়ে আসো। আর এ আয়াতে বলছে-কোরআনের মত অন্তত একটি সূরা নিয়ে আসো। এ ছাড়াও কোরআন ইসলাম বিদ্বেষীদেরকে এ চ্যালেঞ্জে অবতীর্ণ হবার জন্য উৎসাহিত করে বলে এ কাজের সহায়তার জন্য তোমরা সারা বিশ্বে তোমাদের সব সাহায্যকারী ও সমমনা ব্যক্তিদেরকে ডাক দাও। কিন্তু জেনে রাখো যে এ কাজ করার সাধ্য তোমাদের নেই।
আল্লাহর সব নবীরই মুজিযা ছিল। কিন্তু মহানবী (সা:)এর মুজিযা অর্থাৎ কোরআনের বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য এখানে তুলে ধরছি। প্রথম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এ মুজিযা হলো সবাক। অর্থাৎ অন্যান্য নবীদের মুজিযার নিজস্ব কোন ভাষা ছিল না এবং মুজিযার অধিকারী পয়গম্বরদেরকে এর সাথে থেকে বলতে হয় যে এটি আমার মুজিযা। কিন্তু কোরআনকে কারো পরিচয় করিয়ে দেবার প্রয়োজন পড়ে না। বরং কোরআন নিজেই অবিশ্বাসীদের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় এবং তাদেরকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। কোরআন নিজেই আইন এবং নিজেই আইনের ভিত্তি। কোরআনের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো এটি চিরন্তন। অন্যান্য নবীদের মুজিযা একটি বিশেষ সময়ে সংঘটিত হয়েছে এবং শুধু ঐ যুগের মানুষই তা দেখেছে ও শুনেছে। কিন্তু কোরআন শুধু রাসূলে খোদা (সা:)এর যুগের জন্য মুজিযা নয় বরং সর্ব যুগের জন্য এটি মুজিযা। কালের পরিক্রমায় এ ঐশী গ্রন্থ নির্জীব তো হবেই না বরং দিন দিন এর বিষয়বস্তু আরো স্পষ্ট ও বিকশিত হবে। রাসূলে খোদার মুজিযা পবিত্র কোরআনের তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হলো এর বিশ্বজনীনতা। কোরআন যেমন কোন কালের গণ্ডীতে সীমাবদ্ধ নয় তেমনি কোন বিশেষ ভূখণ্ড বা স্থানের জন্য নির্ধারিত নয়। কোরআন যাদেরকে উদ্দেশ্য করে কথা বলেছে, তারা শুধু আরবভাষী হিজাবের অধিবাসী নয় বরং পৃথিবীর সকল জাতি, বর্ণ, গোত্র সবাইকে উদ্দেশ্য করে কোরআন কথা বলেছে। তাই এ আসমানী কিতাবের একটি জায়গাতেও “হে আরব জাতি” কথাটি আসেনি। বরং পৃথিবীর সব মানুষকে উদ্দেশ্য করে কোরআন বলেছে “হে মানব জাতি”। মুজিযা হিসাবে কোরআন মজিদের ৪র্থ বৈশিষ্ট্য হলো এর আধ্যাত্মিকতা। অন্যান্য নবীদের মুজিযা ছিল দৈহিক ও বস্তুগত। সেসব অলৌকিক ঘটনা মানুষের চোখ কানকে বিস্মিত করত। কিন্তু কোরআন সাধারণ বর্ণমালা দিয়ে রচিত হলেও মানুষের অন্তরের মধ্যে এত গভীর প্রভাব ফেলে যে খুব সহজেই তা মানুষের জ্ঞানকে বিস্ময়ে অভিভূত করে এবং তার মন ও আত্মাকে বিমোহিত করে ফেলে। সূরা বাকারার ২৩ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় এবার একে একে তুলে ধরছি।
প্রথমত: পয়গম্বরগণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো তারা আল্লাহর পূর্ণ অনুগত এবং একমাত্র তাঁরই দাসত্ব করেন। তাই কোরআনের বহু জায়গায় নবীদেরকে “আমার বান্দা বলে অভিহিত করা হয়েছে। যেমনটি এ আয়াতে বলা হয়েছে “কোরআনকে আমি আমার বান্দার উপর নাযিল করেছি।”
দ্বিতীয়ত: কোরআন হলো যুক্তির গ্রন্থ। এ গ্রন্থ কোন সন্দেহ বা সংশয়ের আবকাশ রাখে না। তাই বলা হয়েছে “যদি তোমরা সন্দেহ কর তাহলে” অর্থাৎ কোরআনের মত অনুরূপ একটি সূরা নিয়ে আসো।
তৃতীয়ত: কোরআন হলো আল্লাহর চিরন্তন ও সার্বজনীন মুজিযা। এটি প্রত্যেক যুগেই মানুষের প্রতি তার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে।
চতুর্থত: ইসলাম চিরন্তন ও বিশ্বজনীন ধর্ম। কারণ ইসলামের মুজিযা কোরআন এ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী।
পঞ্চমত: আমাদের ধর্মের মূল নীতির ব্যাপারে আমাদের মধ্যে যাতে কোন সন্দেহ বা সংশয় না থাকে। সংশয়ের উদ্রেক হলে কাল বিলম্ব না করে তা দূর করা উচিৎ। যাতে আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাস নড়বড়ে না হয়ে যায়।
ষষ্ঠত: সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক হলো বিবেক। এ আয়াতে বলা হয়েছে যে তোমাদের সমমনা লোকেরাও যদি সাক্ষী দেয় যে তোমাদের আনা বিষয়টি কোরআনের মত তাহলেও আমি তা মেনে নেব। অর্থাৎ আল্লাহ স্বয়ং মানুষকেই বিচারক হিসেবে নির্ধারণ করেছেন।
সপ্তমত: কোরআনের সত্যতা এত অকাট্য যে বিরুদ্ধবাদীরা কোরআনের মত একটি সূরাও যদি আনতে পারে তাহলে আমরা সেটিকে সমগ্র কোরআনের স্থলে গ্রহণ করে নেব।

এবারে সূরা বাকারার ২৪ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। এ আয়াতে বলা হয়েছে-“যদি তোমরা না আনো যা কিনা কখনই পারবেনা, তাহলে সেই আগুনকে ভয় করো, যার ইন্ধন হবে মানুষ এবং পাথর। সেই আগুন প্রস্তুত রয়েছে কাফেরদের জন্য।” এর আগের আয়াতে কোরআন বিরুদ্ধবাদীদেরকে একটি সূরা নিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছে। আর এ আয়াতে বলছে এ কাজ কখনোই সম্ভব নয়। যারা রাসূলের কথা ও বাচনভঙ্গীর সাথে পরিচিত এবং তার যুগে বসবাস করেছে তারা যেমন কোরআনের মত একটি সূরা তৈরী করতে পারবেনা, তেমনি ভবিষ্যতেও এ কাজ অসম্ভব। এরপর কোরআন অবিশ্বাসীদেরকে দোজখের আগুনের ব্যাপারে হুশিয়ারী করে দিয়ে বলে জাহান্নামের আগুনের উপকরণ হিসাবে অপরাধীদের দেহ পাথরের পাশাপাশি জ্বলবে। এ আয়াতে ‘পাথর’ বলতে পীট কয়লা বোঝানো হচ্ছে যা দোজখের আগুন সৃষ্টি করে, কিংবা পাথরের মূর্তি বোঝানো হচ্ছে । যেসব মূর্তিকে রাসূলে খোদার দুশমনরা উপাসনা করতো, আল্লাহ তাদের অপরাধের প্রমাণ হিসাবে পাথরের ঐ মূর্তিগুলোকে কেয়ামতের সময় হাজির করবেন। যাতে মূর্তি পূজকেরা তাদের কৃতকর্মের কথা অস্বীকার করতে না পারে। সূরা বাকারার ২৪ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে-
প্রথমত: নিজেদের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে বিরুদ্ধবাদীদের সাথে দৃঢ়তার সাথে কথা বলতে হবে এবং ইসলামের প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস রাখতে হবে। এ আয়াতে বিরুদ্ধবাদীদের প্রতি উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে-‘তোমরা কোরআনের মত কোন সূরা আনতে পারোনি এবং কখনও তা পারবেও না।
দ্বিতীয়ত: মানুষ অবিশ্বাসের ফলে পাথর ও জড় পদার্থের কাতারে গিয়ে ঠাঁই করে নেয়। এ আয়াতে বলা হয়েছে-‘দোযখের আগুনের জ্বালানী হলো মানুষ ও পাথর।
তৃতীয়ত: যে অন্তর পাথরের মত শক্ত হয়ে গেছে এবং কোরআনের বাণী গ্রহণ করে না, কেয়ামতের দিন সেই অন্তরের পুনরুত্থান হবে পাথরের সাথে।
চতুর্থত: কোরআন কেবল রাসূলের যুগের জন্যেই মুজিযা নয় এবং এ আসমানী গ্রন্থ সব যুগের জন্য মুজিযা। তাই বলা হয়েছে-“ভবিষ্যতেও কোরআনের মত কিছু রচনা করতে পারবে না।#

কোরআনের আলো অনুষ্ঠানের আজকের পর্বে আমরা সূরা বাকারার ২৫ ও ২৬ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করব। সূরা বাকারার ২৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“যারা বিশ্বাস করে এবং সৎ কাজ করে তাদের সুসংবাদ দাও যে তাদের জন্যই বেহেশত যার তলদেশে নদী প্রবাহিত। যখনই তাদের তা হতে ফল-মূল খেতে দেওয়া হবে, তখনই তারা বলবে আমাদের পূর্বে জীবিকা হিসাবে যা দেওয়া হতো এতো তাই-ই। তাদেরকে অনুরূপ ফলই দেয়া হবে এবং সেখানে তাদের জন্য পবিত্র সঙ্গিনী রয়েছে, তারা সেখানে স্থায়ী হবে।” আগের আয়াতে কাফেরদেরকে জাহান্নামের আগুনের ভয় দেখানোর পর, এ আয়াতে মুমিনদের প্রতিফল বর্ণনা করা হয়েছে। যাতে করে কাফের ও মুমিনদের পরিণতি যাচাইয়ের পর সত্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অবশ্য ঈমান সৎ কাজ ছাড়া ফলপ্রসূ হবে না। শুধু ঈমান বা শুধু ভালো কাজ কোনটিই একক ভাবে মানুষের সৌভাগ্য নিশ্চিত করতে পারে না। ঈমান হচ্ছে গাছের মূল বা শিকড়ের মত আর ভালো কাজ হচ্ছে বৃক্ষের ফল স্বরুপ। গাছের সুমিষ্ট ও ভালো ফল, ঐ গাছের সুস্থ ও সবল মূলের প্রমাণ দেয়। আর সবল ও সুস্থ মূলের গাছই ভালো ফল দিতে পারে। অবিশ্বাসী বা কাফেররাও অনেক সময় ভালো কাজ করে, কিন্তু তাদের অন্তরে ঈমানের মজবুত ভিত না থাকায়, সে সব কাজ স্থায়ী হয় না। কেয়ামত বা শেষ বিচারের দিন মুমিন ব্যক্তিদের স্থান হবে বেহেশত। বেহেশতের বাগানগুলো চির সবুজ এবং ফলে-ফুলে ভরা। কেননা সজীবতার উৎস পানির নহর গাছগুলোর নীচ দিয়ে সবসময় বয়ে যাচ্ছে। বেহেশতের ফলগুলো দেখতে বাহ্যত: এ দুনিয়ার মতো যাতে বেহেশবাসীরা সেগুলো দেখেই চিনতে পারে। ফলগুলো যেন তাদের কাছে অদ্ভুত বা অপরিচিত মনে হয় না। তবে স্বাদ ও গন্ধের দিক থেকে সেগুলো অনেক ভিন্ন।
বেহেশতে কেউ জন্ম গ্রহণ করে না। তবে মানুষ যেহেতু সঙ্গী বিহীন থাকতে পারে না তাই বেহেশতবাসীদের জন্য সেখানে সঙ্গীনীর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পুত-পবিত্রতা তাদের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। যদিও পবিত্র কোরআনের অনেক আয়াতে বস্তুগত অনেক নেয়ামত, যেমন বাগান, প্রাসাদ, সঙ্গীনী প্রভৃতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু আবার অনেক আয়াতে এগুলোর সাথে বেহেশতে আধ্যাত্মিক নেয়ামতের কথাও বলা হয়েছে। যেমন সূরা তওবার ৭২ নম্বর আয়াতে বেহেশতের বস্তুগত বা বৈষয়িক নেয়ামতের কথা উল্লেখ করার পর বলা হয়েছে-“আল্লাহর সন্তুষ্টিই সর্বশ্রেষ্ঠ”। সূরা বায়্যেনার ৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“মহান আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট।” পবিত্র কোরানে বেহেশতী নেয়ামত ও ঐশ্বর্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে বেহেশতবাসীদের স্থান ও আবাসস্থল সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘এটাই তাদের একমাত্র পুরস্কার নয়।’ এ ছাড়াও পয়গম্বর, ওলি-আউলিয়া এবং মানব ইতিহাসের সবচেয়ে ভালো ও সৎ ব্যক্তিদের মাঝে অবস্থান তাদের আত্মিক প্রশান্তি বয়ে আনবে এবং এটা তাদের জন্য স্বর্গীয় উপহার। এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে-
প্রথমত : সঠিক প্রশিক্ষণের জন্য হুমকি ও ভয়-ভীতি দেখানোর পাশাপাশি উৎসাহেরও প্রয়োজন আছে। কাফেরদেরকে জাহান্নামের ভয় দেখানোর পর এ আয়াতে মুমিনদেরকে বেহেশতের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে।
দ্বিতীয়ত : ঈমানের বাহ্যিক রূপ হচ্ছে ভালো কাজ। এজন্য পবিত্র কোরানে এ দুটি অর্থাৎ ঈমান ও সৎ কাজ সব সময় এক সাথে এসেছে।
তৃতীয়ত : পবিত্র কোরআনের দৃষ্টিতে ভালো কাজ সেটাই যা আল্লাহর উদ্দেশ্যে করা হবে। সুতরাং সামাজিক সেবা বা সম্পূর্ণ নিজস্ব ইচ্ছায় ভালো কাজ করলে সেটা কোরআনের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা ঈমান আনার পর সৎ কাজ করলে সেটাই কেবল গ্রহণযোগ্য। এ দুনিয়ায় হালাল হারাম বাছতে গিয়ে মুমিন ব্যক্তিকে অনেক কিছু বর্জন করতে হয়। তবে বেহেশতে এ সব কিছু পুষিয়ে দেয়া হবে।
চতুর্থত : দুনিয়ার ঐশ্বর্য ও সুখ-সমৃদ্ধি ক্ষণিকের জন্যে এবং তা অস্থায়ী। কাজেই মানুষ তা হাতছাড়া করলে দু:খ পায় এবং উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। কিন্তু আখেরাত বা পরকালের ঐশ্বর্য ও সুখ-সমৃদ্ধি চিরন্তন ও তা সব সময় স্থায়ী থাকবে। কাজেই তা হারাবার ভয় থাকবে না। আর এ জন্যেই এই আয়াতে বলা হয়েছে-‘বেহেশতবাসীরা সেখানে স্থায়ীভাবে বাস করবে।’
পঞ্চমত : উপযুক্ত সঙ্গীনী তাকেই বলা যায় যে সর্ব দিক থেকেই পবিত্র, বাহ্যিক কাজ-কর্ম ও অন্তরে যার কোন কলুষতা নেই।

সূরা বাকারার ২৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“নিশ্চয়ইই মহান আল্লাহ মশা কিংবা তারচেয়ে বড় উপমা দিতে সংকোচ বোধ করেন না। সুতরাং যারা বিশ্বাসী তারা জানে যে, এ সত্য উপমা তাদের প্রতিপালকের কাছ থেকে এসেছে এবং যারা অবিশ্বাস করে তারা বলে এই উপমাতে আল্লাহর অভিপ্রায় কি? এর দ্বারা তিনি অনেককেই বিভ্রান্ত করেন, আবার বহু লোককে সৎ পথে পরিচালিত করেন। কিন্তু অসৎ লোক ছাড়া তিনি কাউকে বিভ্রান্ত করেন না।”

ইসলামের বিরুদ্ধবাদী কাফেররা যখন পবিত্র কোরআনের অনুরুপ একটি গ্রন্থ রচনা করতে ব্যর্থ হলো, তখন তারা কোরআনের উপমাগুলোকে বাহানা হিসাবে ব্যবহার করতে লাগল। তারা বললো, এ সব উপমা থেকে মহান সৃষ্টিকর্তার স্থান অনেক উর্ধ্বে। সৃষ্টিকর্তা মশা, মাছি ও মাকড়সার মত তুচ্ছ উপমা দিতে পারেন না, এসব মানুষেরই কাজ। আসলে ইসলামে অবিশ্বাসী কাফেররা আল্লাহ বা সৃষ্টিকর্তাকেই বিশ্বাস করতো না। এ সব কথা বলার পেছনে তাদের উদ্দেশ্য ছিল কোরআন ও পয়গম্বরের উপর মুসলমানদের বিশ্বাসকে নড়বড়ে করে দেয়া এবং তাদের ঈমানকে দুর্বল করে দেয়া। তা ছাড়া পবিত্র কোরআনের সব উপমাই এ ধরণের নয়। যেমন এর আগে মুনাফিক বা কপট ব্যক্তিদেরকে অন্ধকারে আলোহীন বিপদ সংকুল পথে আটকে পড়া পথিকের সাথে তুলনা করা হয়েছে। আর উদাহরণ বা উপমা ব্যবহারের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাস্তব অবস্থাকে সুস্পষ্ট করে তোলা। যখন কেউ দুর্বল প্রতিপক্ষের বর্ণনা দিতে চায়, তখন কোন দুর্বল বস্তু বা প্রাণীর উপমা দিয়ে তার বর্ণনা তুলে ধরে। যেমন পবিত্র কোরআনের সুরা হজ্জ্বের ৭৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের উপাসনা কর তারা তো কখনও একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না, এমনকি এ উদ্দেশ্যে তারা সবাই একত্রিত হলেও। এবং মাছি যদি কিছু নিয়ে চলে যায় তাও তারা তার কাছ থেকে তা উদ্ধার করতে পারবে না।”
সূরা বাকারার ২৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“আল্লাহপাক মাছি বা তারচেয়ে ছোট প্রাণীকে উপমা হিসাবে ব্যবহার করতে সংকোচ বোধ করেন না। কেননা উপমাতো কেবল বাস্তব অবস্থাকে সুস্পষ্ট করে বোঝাবার জন্য। তাই মানুষের জন্য অধিক বোধগম্য বিষয়কেই উপমা হিসাবে ব্যবহার করা উচিৎ। উপমা বা উদাহরণের ক্ষেত্রে মশা বা বিশাল হাতির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। যেটা বিষয়বস্তুর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তাই ব্যবহার করা উচিৎ। অবশ্য পবিত্র কোরআনের উপমাগুলো সম্পর্কে দুই ধরণের দৃষ্টিভঙ্গী সম্পন্ন মানুষ দেখা যায়। এর মধ্যে যারা সত্য সন্ধানী এবং কোরআনের উপমাগুলোর নিগূঢ় তত্ত্ব উপলদ্ধি করতে সক্ষম তারা এ সব উপমা থেকে সত্যের সন্ধান লাভ করেন এবং বস্তুজগতের নিগূঢ় তত্ত্ব তাদের সামনে উদ্ভাসিত হয়। অপর দিকে যাদের অন্তর পবিত্র কোরআন ও ইসলামের মহান নবীর প্রতি হিংসা বিদ্বেষ ও শত্রুতায় পূর্ণ তারা পবিত্র কোরআনের অর্থ উপলদ্ধি করতে ব্যর্থ হয় এবং কোরআন ও পয়গম্বরের ব্যাপারে দোদুল্যমনার কারণে ঐশী পথ নির্দেশনা থেকে বঞ্চিত হয়ে পথভ্রষ্ট হয়ে পড়ে।
এ আয়াত দুটি থেকে কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে-কোন গুরুত্বপূর্ণ ও কঠিন বিষয় সব সময় সহজ ভাষায় বর্ণনা করা উচিৎ যাতে সাধারণ মানুষও ভালো করে বুঝতে পারে এবং মহান আল্লাহর ক্ষেত্রেও এ কাজ দোষণীয় নয়। পবিত্র কোরানে অত্যন্ত বাস্তব ভিত্তিক উপমা ব্যবহার করা হয়েছে। এ জন্য কখনো কোন প্রাণীকে, আবার কখনো প্রকৃতির কোন ঘটনা যেমন বৃষ্টি ও বজ্রপাতকে উপমা হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে। গুনাহ বা পাপ মানুষকে সত্য উপলদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করে এবং বিভ্রান্তি ও বিপথগামীতায় নিমজ্জিত করে। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে যা অবতীর্ণ হয়েছে সবই সত্য ও বাস্তব। সৎ পথ প্রাপ্তি বা বিপথগামীতা ঐ মহা সত্যের ব্যাপারে মানুষের প্রতিক্রিয়ার ফল।#

কোরআনের আলো অনুষ্ঠানের এ পর্বে আমরা সূরা বাকারার ২৭ও ২৮ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করব। তো চলুন প্রথমেই সূরা বাকারার ২৭ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। এ আয়াতে বলা হয়েছে-“যারা আল্লাহর অঙ্গীকারে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ হওয়ার পর তা ভঙ্গ করে এবং আল্লাহ যা অক্ষুন্ন রাখতে আদেশ করেছেন তা ছিন্ন করে এবং সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”
আগের আয়াতে ফাসেক লোকদের বিভ্রান্তির কথা বলা হয়েছিল, আর এ আয়াতে ফাসেকদের তিনটি বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রথমত: তারা আল্লাহর অঙ্গীকার ভঙ্গ করে এবং নিজেদের কামনা বাসনা ও প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। এ আয়াতে আল্লাহর অঙ্গীকার বলতে মানুষের অন্তরে ঐশী বিশেষ প্রেরণার কথা বোঝানো হয়েছে। মহান আল্লাহ প্রতিটি মানুষকে এই সহজতর ঐশী প্রবণতাসহ সৃষ্টি করেছেন। এর মাধ্যমে মানুষ ভালো-মন্দ ও সত্য-মিথ্যা বিচার করতে পারে এবং নবীদের আহ্বানে সাড়া দিতে পারে। দ্বিতীয়ত: মহান আল্লাহ যে সব অঙ্গীকার রক্ষা করতে বলেছেন ফাসেক ব্যক্তি তা ভঙ্গ করে। এসব অঙ্গীকার নবী রাসূলদের সাথে ধর্মীয় অঙ্গীকারই হোক বা অপরাপর মুমিন ব্যক্তিদের সাথে সামাজিক কিংবা আত্মীয় স্বজনদের সাথে পারিবারিক প্রতিশ্রুতিই হোক। মন্দ কাজও অনাচারের বি¯তৃতি ঘটায়। তারা মনে করে তাদের পাপের প্রতিফল কেবল তারাই ভোগ করবে, অথচ তারা জানে না পাপের সামাজিক প্রভাব ব্যক্তিক প্রভাবের চেয়ে অনেক বেশী। পাপ ও অনাচার সমাজকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। এটা অত্যন্ত স্পষ্ট, যে ব্যক্তি এশী অঙ্গীকার এবং মানুষের সাথে তার প্রতিশ্রুতি ও সম্পর্কের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে না এবং নিজের খেয়াল খুশীমত কাজ করে, সে নিজেরই ক্ষতি বয়ে আনে। কারণ সে তার পার্থিব এবং ঐশী সম্পদ দুটিই হাত ছাড়া করে এবং পরিণামে অপমান ও অপদস্থ হয়। সূরা বাকারার ২৭ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে-
প্রথমত: অঙ্গীকার ভঙ্গ করা ইসলামের দৃষ্টিতে একটি অপছন্দনীয় কাজ। মুমিন ব্যক্তি কখনও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেনা, এমনকি কাফেরদের সাথেও সে তার অঙ্গীকার রক্ষার ব্যাপারে সচেষ্ট। আল্লাহর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার কথা সে চিন্তাও করেনা।
দ্বিতীয়ত: বিচারবুদ্ধি ও বুদ্ধিবৃত্তির রায়কে উপেক্ষা করলে মানুষ সাধারণতঃ পাপে লিপ্ত হয় এবং সমাজ পাপ-পঙ্কিলতায় ভরে ওঠে। ইসলামের বিধি-বিধান ও সহজাত ঐশী প্রবণতাকে উপক্ষা করলে, মানুষ চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

সূরা বাকারার ১২৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে- ” আমার প্রতিশ্রুতি, অত্যাচারীদের উপর পড়ে না।” এ আয়াত অনুযায়ী ঐশী নেতৃত্ব ও ইমামত হচ্ছে আল্লাহর অঙ্গীকার। এ আয়াতে বলা হয়েছে ফাসেক লোকদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এ ধরণের অঙ্গীকার ভঙ্গ করা। ইসলাম, মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা বা বিভেদ চায় না। আর এ জন্যেই আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী এবং বিশেষ করে পিতামাতার সাথে দেখা-সাক্ষাৎ এবং সম্পর্ক জোরদার করার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। ইসলাম পরিবার বা সমাজ থেকে দূরে থাকার বিরোধী। ইসলাম চায় মুসলমানরা দলদ্ধভাবে থাকুক। এজন্য জুমার নামাজ এবং জামাতে নামাজ পড়ার উপর গুরুত্ব দিয়েছে। এ ছাড়া অসুস্থদের দেখতে যাওয়া দুঃস্থদের সাহায্য এবং প্রতিবেশীদের বিপদে আপদে সাহায্যের জন্য এগিয়ে যাওয়া, ইসলামের দৃষ্টিতে খুবই পছন্দনীয় কাজ। ইসলামে আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এবারে এ প্রসঙ্গে কয়েকটি হাদীস উল্লেখ করা যাক। হাদীস শরীফে এসেছে, তোমরা আত্মীয়-স্বজনের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করবে। এতে করে দরিদ্রতা দূর হবে, জীবিকা বৃদ্ধি পাবে এবং জীবন হবে বরকতময়। অন্য একটি হাদীসে রয়েছে, রক্তের সম্পর্ক রক্ষার জন্য আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করবে, যদিও তারা তোমাকে উপেক্ষা করে এবং সৎলোক না হয়।
এ সম্পর্কে আরো কয়েকটি হাদীস হচ্ছে-প্রথমত: রক্তের সম্পর্ক রক্ষার জন্য এক বছর ধরে হাটার প্রয়োজন হলে কিংবা সালাম দেয়া অথবা পানি পান করাবার মত সামান্য সময়টুকু থাকলেও তা পালন কর। দ্বিতীয়ত: যে ব্যক্তি আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করবে মৃত্যু এবং পরকালের হিসাব তার জন্য সহজ হবে এবং বেহেশতে বিশেষ মর্যাদায় আসীন হবে।

এবারে সূরা বাকারার ২৮ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। এ আয়াতে বলা হয়েছে- ” কিভাবে তোমরা আল্লাহকে অস্বীকার কর, অথচ তোমরা ছিলে প্রাণহীন, তিনিই তোমাদের জীবিত করেছেন আবার তোমাদের নির্জীব করবেন। পূনরায় তোমাদের জীবিত করবেন, অবশেষে তারই দিকে তোমরা ফিরে যাবে।”
আল্লাহকে চেনার সর্বোত্তম উপায় হলো বিশ্বজগত এবং মানব সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করা। জীবন ও মৃত্যু নিয়ে চিন্তাভাবনার মাধ্যমে মানুষ এ সত্য উপলদ্ধি করতে পারে যে, আমি যদি নিজেই আমার স্রষ্টা হতাম তাহলে অবশ্যই চিরঞ্জীব ও চিরস্থায়ী হতাম। কিন্তু একসময় আমরা ছিলাম না, পরে অস্তিত্ব লাভ করেছি এবং পূনরায় মৃত্যুবরণ করতে করতে হবে। কাজেই এই প্রাণ বা জীবনই হচ্ছে আমাদের জন্য মহান আল্লাহর সবচেয়ে বড় অনুগ্রহ বা নেয়ামত। মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞানে এত অগ্রসর হবার পরও এখন পর্যন্ত এই প্রাণের স্বরূপ উপলদ্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছে। মানুষের জন্ম ও মৃত্যু পুরোপুরি আল্লাহর হাতে। আমরা নিজের ইচ্ছায় আসিনি, কাজেই নিজ ইচ্ছায় যেতেও পারব না। স্রষ্টা আমাদের অস্তিত্ব দিয়েছেন এবং তিনিই আমাদের মৃত্যু ঘটাবেন। আমল বা কাজই হচ্ছে আমাদের একমাত্র সম্বল। সুতরাং যে স্রষ্টার হাতে আমাদের শুরু এবং শেষ, তার অস্তিত্বকে আমরা কিভাবে অস্বীকার করবো? অথবা মৃত্যুর পর মানুষের পুনরুত্থানকে আমরা কিভাবে অস্বীকার করবো? কেননা পুনরুত্থান বা মৃত্যুর পর পূনরায় জীবিত করা প্রথমবার সৃষ্টির করার চেয়ে অনেক সহজ কাজ। যে স্রষ্টা আমাদেরকে অস্তিত্বহীন অবস্থা থেকে, অস্তিত্ব বা প্রাণ দিয়েছেন, তিনি কি মৃত্যুর পর মানুষকে পূনরায় জীবিত করতে পরবেন না? এ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে-
প্রথমত: মানুষকে হেদায়েতের জন্য কুরআনের একটি বিশেষ পন্থা হচ্ছে, মানুষের বুদ্ধি বিবেক এবং সহজাত প্রবৃত্তির কাছে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া। যাতে চিন্তার মাধ্যমে মানুষ সত্যকে উপলদ্ধি করতে পারে।
দ্বিতীয়ত: মানুষের জীবন আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ বহন করে, আর মৃত্যু পুনরুত্থান দিবসের ইঙ্গিত বহন করে।
তৃতীয়ত: নিজেকে জানা, খোদাকে চেনারই ভূমিকা মাত্র। আত্মপরিচয় লাভের মাধ্যমে মানুষ স্রষ্টাকেও চিনতে পারে। কেননা সে বুঝতে পারে তার নিজস্ব বলতে কিছুই নেই, সব কিছু মহান আল্লাহর।
চতুর্থত: মানুষের পূর্ণতার সর্বশেষ পর্যায় হচ্ছে, মহান প্রতিপালকের কাছে প্রত্যাবর্তন করা।
পঞ্চমত: মৃত্যুই মানব জীবনের সমাপ্তি নয়, বরং এর মাধ্যমে নতুন জীবনের সুচনা হয়।
ষষ্ঠত: মৃত্যুকে অস্বীকার করার পেছনে কাফেরদের কোন যুক্তি-প্রমাণ ছিলো না। তাই তারা মৃত্যু পরবর্তী জীবন সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপন করে সন্দেহ সৃষ্টির চেষ্টা করতো। পবিত্র কোরআন মানুষের সর্বপ্রথম সৃষ্টি সম্পর্কে প্রশ্ন করে, তাদের সব প্রশ্নের যথাযথ জবাব দিয়েছে।#

কোরআনের আলো অনুষ্ঠানে আমরা সূরা বাকারার ২৯ ও ৩০ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করবো। সূরা বাকারার ২৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই তিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন। এরপর তিনি আকাশের দিকে মনোযোগ দেন এবং তা সপ্ত আকাশে বিন্যস্ত করেন। তিনি সব বিষয়ে সবিশেষ অবহিত। মহান আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করার পর, আমাদের আরাম আয়েশের জন্য সব উপকরণের ব্যবস্থা করেছেন। তিনি আসমান ও জমিন সৃষ্টি করে তা, মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছেন। কেননা মানুষই হচ্ছে খোদার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। কাজেই জমিন ও আসমানের সকল জীব-জন্তু, গাছপালা এবং সব জড় বস্তুকে মানুষের কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। আর এ জন্যই পবিত্র কোরানে বলা হয়েছে-“এ ভূপৃষ্ঠের সব কিছুই মানুষের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে।” এছাড়া সুরা জাসিয়ার ১৩ নম্বর আয়াতেও বলা হয়েছে-“মহান আল্লাহ আসমান ও জমিনের সমস্ত কিছু তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন।”
মহান আল্লাহর একত্ববাদের একটি অন্যতম দলিল হচ্ছে, আকাশের অত্যন্ত জটিল ও সুসমন্বিত গঠন প্রকৃতি। বিজ্ঞানীরা আকাশের এ জটিল সৃষ্টি রহস্য উদ্ঘাটনের ব্যাপারে অক্ষমতা প্রকাশ করেছেন। এ ভূপৃষ্ঠ যেখানেই নানা রকম উদ্ভিদ, গাছপালা, জীব-জন্তু, হাজার রকমের ফল-ফলাদি ও বহু ঐশ্বর্যের সমাহার দেখা যায়, তা হচ্ছে অতি ক্ষুদ্র একটি গ্রহ। পবিত্র কোরআন এ ক্ষেত্রে এক বচন (আল আরদ্) শব্দটি ব্যবহার করেছে। তবে আসমানের ক্ষেত্রে কোরআনের বহু আয়াতে বহু বচনের প্রয়োগ দেখা যায়। যেমন একটি আয়াতে রয়েছে-“মহান আল্লাহ বিশেষ প্রজ্ঞা ও শক্তির মাধ্যমে সপ্ত আসমান সৃষ্টি করে, তা মানুষের অধীন করে দিয়েছেন।” পবিত্র কোরআনের মতে আকাশ হিসাবে মানুষ যা দেখতে পায় তা মূলত: আকাশের সবচেয়ে নীচের স্তর। আকাশের অন্য একটি স্তর মানুষের নাগালের বাইরে। এ আয়াতের শিক্ষণীয় কয়েকটি বিষয় হচ্ছে-
প্রথমত: মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। এ বিশ্বজগত মূলত: মানুষের জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত: মহান আল্লাহ এ সৃষ্টিজগতকে আমাদের অধীন করে দিয়েছেন, কাজেই আমাদের উচিত একমাত্র আল্লাহর আনুগত্য করা।
তৃতীয়ত: এ বিশ্বপ্রকৃতির কোন কিছুই অযথা সৃষ্টি করা হয়নি বরং প্রতিটি বস্তুকে মানুষের কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে, যদিও এর অনেক কিছুর উপকারীতা সম্পর্কে মানুষ এখনও অজ্ঞ।
চতুর্থত: এ পৃথিবী মানুষের জন্য। মানুষকে পৃথিবীর জন্য সৃষ্টি করা হয়নি। এ পৃথিবী লক্ষ্যস্থল নয় বরং এটি অতিক্রম করার স্থান মাত্র।
পঞ্চমত: প্রকৃতির যে কোন ঐশ্বর্যকে কাজে লাগাতে কোন বাধা নেই। তবে ঐশী বিধান কিংবা মানুষের বিবেক বুদ্ধি যদি কোন কিছুকে মানুষের জন্য অকল্যাণকর মনে করে, তবে তা ব্যবহার করা বৈধ নয়।

এবারে সূরা বাকারার ৩০ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। এ আয়াতে বলা হয়েছে-“যখন তোমার প্রতিপালক ফেরেশতাদেরকে বললেন নিশ্চয়ইই আমি পৃথিবীতে প্রতিনিধি সৃষ্টি করবো, তারা বললো আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন যারা অশান্তি সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে? আমরাইতো আপনার প্রশংসা ও পবিত্রতা ঘোষণা করি। তিনি বললেন আমি যা জানি, তোমরা তা জান না।”

আগের আয়াতে মহান আল্লাহ মানুষের জন্য অফুরন্ত বস্তুগত ঐশ্বর্য্য প্রেরণার কথা বলেছেন। আর এ আয়াতে মানুষ যে বিশেষ মর্যাদার কারণে এতসব নেয়াতম ও সুযোগ সুবিধার অধিকারী হয়েছে তা বর্ণনা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করার পর ফেরেশতাদেরকে আদমের বিশেষ মর্যাদা ও গুণাবলী সম্পর্কে অবহিত করে এবং জানায় যে মানুষকে পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি করা হয়েছে। কিন্তু এ কথা শুনে ফেরেশতারা উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে বলে, যার সন্তানরা পৃথিবীতে রক্তপাত ঘটাবে এবং অশান্তি সৃষ্টি করবে, তাকে কিভাবে আল্লাহর প্রতিনিধি বানানো যাবে?
ফেরেশতাদের প্রস্তাব ছিল, মহান আল্লাহ যদি একান্তই পৃথিবীতে তার প্রতিনিধি পাঠাতে চায় তাহলে এমন একজনকে নির্বাচন করা উচিৎ যে সব ধরণের পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত এবং আল্লাহর একান্ত অনুগত হবে। আর এ জন্যই আদম বা মানুষের কথা শুনে ফেরেশতারা বিষ্মিত হয়। কারণ মানুষের প্রবণতা এবং সহজাত গুণাবলী সম্পর্কে তারা অবহিত ছিল। আর এ কারণেই ফেরেশতারা যারা সর্বক্ষণ আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকেন তাদের পরিবর্তে কেন মানুষকে এ মর্যাদা দেয়া হলো, তারা তা জানতে চান। ফেরেশতাদের প্রশ্নের উত্তরে মহান আল্লাহ বলেন-“তোমরা কেবল দুর্বল দিকগুলো দেখেছো, মানুষের মর্যাদা ও বিশেষ গুণাবলী সম্পর্কে তোমরা অজ্ঞ। আমি যা জানি তোমরা তা জানো না। তোমরা ফেরেশতারা সর্বক্ষণ আমার ইবাদত ও প্রশংসায় মশগুল থাকার কারণে যদি নিজেদেরকে আমার প্রতিনিধি হবার যোগ্য মনে কর, তবে জেনে রাখো মানুষের মধ্যেও এমন অনেকে রয়েছেন যারা তোমাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ এবং মর্যাদা লাভের যোগ্য।”
তবে এ বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট যে, প্রতিটি মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি নয়। আল্লাহর প্রতিনিধি হবার অর্থ হচ্ছে মহান আল্লাহ যিনি মানুষের মধ্যে নিজ রুহ ফুঁকে দিয়েছেন, তাকে এমনভাবে সৃষ্টি করেছেন, যার মধ্যে আল্লাহর প্রতিনিধি হবার সব ধরণের যোগ্যতা ও সামর্থ রয়েছে। এ পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধির শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হলো নবী-রাসূল, ইমামগণ, শুহাদা এবং সৎ ব্যক্তিরা। এমন অনেক ব্যক্তি রয়েছেন যারা এ ঐশী প্রেরণাকে পুরোপুরি ধ্বংস করে, মানবতার সর্বনিু স্তরে গিয়ে পৌঁছায়। পবিত্র কোরআন এ ধরণের লোকদের সম্পর্কে বলেছে-“তারা হচ্ছে চতুষ্পদ জন্তুর মতো, এমনকি তার চেয়ে নীচু ও নিকৃষ্ট। মানুষকে পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসাবে নির্ধারণ করার অর্থ এই নয় যে, মহান আল্লাহ এ পৃথিবী নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করতে অক্ষম বরং এর মাধ্যমে মানুষের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব ফুটে ওঠে। মহান আল্লাহ নিজেই এ পৃথিবীর সকল কাজ পরিচালনা করতে সক্ষম হলেও তিনি বিভিন্ন সরঞ্জামের মাধ্যমে তা সম্পন্ন করেন। যেমন ফেরেশতাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে-“এ বিশ্বজগত পরিচালনার দায়িত্ব তাদের, অথচ মহান আল্লাহই হচ্ছেন প্রকৃত পরিচালক।” এ আয়াতের শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে-
প্রথমত: সৃষ্টিজগতে মানুষের মর্যাদা এত উপরে যে মহান আল্লাহ মানুষের সৃষ্টি বা মানুষকে তার প্রতিনিধি বানাবার বিষয়টি ফেরেশতাদের কাছে উত্থাপন করেছেন।
দ্বিতীয়ত: প্রতিনিধি নিয়োগের পুরো দায়িত্ব মহান আল্লাহর অন্য কারো নয়।
তৃতীয়ত: কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বর্ণনার ক্ষেত্রে সর্বোত্তম পন্থা হলো, প্রশ্ন উত্থাপন করা এবং পরে তার বর্ণনা দেয়া। মহান আল্লাহ মানব সৃষ্টি এবং মানুষকে তার প্রতিনিধি বানাবার ক্ষেত্রে এ পন্থা প্রয়োগ করেছেন এবং এ সম্পর্কে ফেরেশতাদের অজ্ঞতা দূর করেছেন।
চতুর্থত: শাসক বা ঐশী প্রতিনিধিকে ন্যায় বিচারক হতে হবে। ফাসেক বা কলুষিত ব্যক্তি এ মর্যাদার উপযুক্ত নয়। আর এ জন্যই ফেরেশতারা বলেছিলো, রক্তপাত ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী মানুষ কি করে পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি হতে পারে?
পঞ্চমত: নিজেকে অন্যদের সাথে তুলনা করার সময়, অপরের কেবল দোষ-ত্রুটি ও দুর্বল দিক, আর নিজের ভালো দিকটাই দেখা ঠিক নয়।
ষষ্ঠত: ইবাদত কেবল মর্যাদা বা শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি নয়। ফেরেশতারা আল্লাহর ইবাদত ও প্রশংসা জ্ঞাপনের ক্ষেত্রে মানুষের চেয়ে অগ্রগামী হওয়া সত্ত্বেও, পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি হতে পারেনি।
সপ্তমত: কিছু লোকের অনিষ্টতা ও বিভ্রান্তির কারণে, অন্যদের বিকাশ লাভের পথ রুদ্ধ করে দেয়া ঠিক নয়। মহান আল্লাহ এটা ভালো করেই জানতেন যে, এক শ্রেণীর মানুষ ভুল পথে চলবে, কিন্তু তারপরও তিনি মানুষকে তার প্রতিনিধিত্বের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করেননি।
অষ্টমত: কোন কিছু সম্পর্কে জানার জন্য প্রশ্ন করতে দোষ নেই। ফেরেশতারা আল্লাহর কাজের প্রতিবাদ জানাবার জন্য প্রশ্ন করেননি বরং নিজেদের ধারণা আরো স্পষ্ট করার জন্যই প্রশ্ন করেছিলেন।#

কোরআনের আলোর এ পর্বে আপনাদের স্বাগত জানাচ্ছি। আজকের পর্বে সূরা বাকারার ৩১, ৩২ ও ৩৩ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করব। সূরা বাকারার ৩১ ও ৩২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“মহান আল্লাহ আদমকে সমস্ত নাম শিক্ষা দিলেন। এরপর ফেরেশতাদের সামনে হাজির করলেন এবং বললেন যদি তোমরা সত্যবাদী হও, এই সমস্তের নাম আমাকে বল। তারা বলল আপনি পরম পবিত্র, আপনি যা শিক্ষা দিয়েছেন তা ছাড়া আমাদের কোন জ্ঞান নেই।”

মহান আল্লাহ ফেরেশতাদের কাছে মানুষের মর্যাদা তুলে ধরার জন্য উভয় দলকেই পরীক্ষা করেন। মানুষ ও ফেরেশতা উভয়কেই তিনি জ্ঞান শিক্ষা দেন এবং পরে এ সম্পর্কে তাদের প্রশ্ন করেন। তবে এই জ্ঞান কী ধরনের ছিল সে সম্পর্কে কোরআন কিছু বলেনি। তবে অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে, মহান আল্লাহ সৃষ্টির শুরুতেই এ বিশ্বজগত ও প্রকৃতি সম্পর্কে মানুষকে ধারণা দিয়েছেন এবং এগুলোর নামের সাথে তাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। আর এটাই হচ্ছে মানুষের সহজাত জ্ঞান, যার মাধ্যমে মানুষ কোন বস্তুকে চিনতে পারে। যেহেতু ফেরেশতারা ভেবেছিল ইবাদতের কারণে তারা মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ তাই মহান আল্লাহ প্রথমে তাদেরকেই পরীক্ষা করেন এবং বলেন, যদি তোমরা নিজেদের দাবী সম্পর্কে নিশ্চিত হও তাহলে আমি তোমাদেরকে যেসব বিষয় শিক্ষা দিয়েছি সেগুলো এবার বল। ফেরেশতাদের ভুল ভাঙ্গে এবং তারা বুঝতে পারে কেবল ইবাদতই আল্লাহর প্রতিনিধি হবার জন্য যথেষ্ট নয় বরং এর জন্য উন্নত জ্ঞানের অধিকারী হওয়া প্রয়োজন। কাজেই আল্লাহর প্রশ্নের জবাবে তারা বললো- আপনি পরম পবিত্র, নিশ্চয়ইই মানব জাতিকে পৃথিবীতে আপনার প্রতিনিধি হিসাবে নির্ধারণ করার পেছনে বিশেষ কোন যুক্তি বা বৃহৎ স্বার্থ রয়েছে। আর এ কারণেই আপনি আদমকে সৃষ্টি করেছেন। হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে যা শিক্ষা দিয়েছেন তার বাইরে কোন কিছুই আমরা জানি না। মানুষের বিশেষ ক্ষমতা ও যোগ্যতা সম্পর্কে আমরা অজ্ঞ ছিলাম। হে মহান প্রতিপালক! আপনি সর্ব বিষয়ে জ্ঞানী এবং প্রতিটি কাজ যুক্তি ও জ্ঞানের আলোকে সম্পন্ন করেন। সূরা বাকারার ৩১ ও ৩২ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে-
এক : মহান স্রষ্টাই হলেন মানব জাতির প্রথম শিক্ষক। কেননা তিনিই মানুষকে সত্য উপলব্ধির ক্ষমতা ও যোগ্যতা দিয়েছেন। জ্ঞান-বিজ্ঞানে চরম উৎকর্ষের জন্য মানুষ এ ঐশী প্রেরণার কাছে ঋণী।
দুই : মানুষ এ বিশ্বজগতের সকল রহস্য উদ্ঘাটন করার ক্ষমতা রাখে, যদিও এ ব্যাপারে এখনও সে তেমন অগ্রসর হতে পারেনি।
তিন : ফেরেশতা সহ অন্যান্য সকল সৃষ্টির উপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব Ñ তার জ্ঞান, বুদ্ধিবৃত্তি ও চিন্তা শক্তির কারণে।
চার : ঐশী প্রতিনিধি হবার জন্য ইবাদতের চেয়ে জ্ঞান ও প্রজ্ঞার বেশী প্রয়োজন। আর এ জন্যই মহান আল্লাহ মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য তার জ্ঞান ও বুদ্ধি-বিবেকের কথা উল্লেখ করেছেন।
পাঁচ : মহান আল্লাহই হচ্ছেন প্রকৃত শিক্ষক। বইপত্র কিংবা শিক্ষক হচ্ছে জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম মাত্র।
ছয় : অশোভনীয় বা অনুচিত কথা বলার পর, সাথে সাথে মাফ চেয়ে নেয়া ঐশী রীতি। কেননা ফেরেশতারা যখনই তাদের ভুল উপলব্ধি করলো, তখনই সুবহানাকা শব্দটি উচ্চারণ করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
সাত : অজ্ঞতা প্রকাশে কুণ্ঠা বোধ করা ঠিক নয়। কারণ এতে লজ্জার কোন কারণ নেই। আল্লাহর ফেরেশতারা খুব সহজেই নিজেদের অজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।
আট : অনুশোচনা বা ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে মানুষ মুক্তি পেতে পারে। ফেরেশতারা ভেবেছিলো ইবাদতের কারণে তারা মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। কিন্তু প্রকৃত সত্য উপলব্ধি করার পরপরই তারা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন এবং মহান আল্লাহও তাদের ক্ষমা করে দিলেন। কিন্তু শয়তান আগুন থেকে সৃষ্টি হবার কারণে নিজেকে মাটির তৈরী মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে দাবী করে। এ ব্যাপারে গোঁড়ামী ও একগুঁয়েমির কারণে শয়তান মহান আল্লাহর দরবার থেকে বহি®কৃত হয়।
এবারে সূরা বাকারার ৩৩ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। এ আয়াতে বলা হয়েছে-“মহান আল্লাহ বললেন হে আদম! এদের সবার নাম বলে দাও। যখন সে তাদের এসব নাম বলে দিল, তিনি বললেন-আমি কি তোমাদের বলিনি যে নিশ্চয়ই আমি আকাশ ও পৃথিবীর অদৃশ্য বিষয়ে অবগত আছি এবং তোমরা যা প্রকাশ কর ও গোপন কর তাও আমি জানি।”
আল্লাহর পরীক্ষায় আদম সফলভাবে উত্তীর্ণ হলেন এবং ঐশী শিক্ষার আলোকে সৃষ্টিজগতের সকল রহস্য ফেরেশতাদের কাছে বর্ণনা করলেন। ফলে ফেরেশতারা বুঝতে পারলেন যে, মহান আল্লাহ মানুষকে শিক্ষার যোগ্যতা ও ক্ষমতা দিয়েছেন, আর তারা এ যোগ্যতা থেকে বঞ্চিত। এ পরীক্ষা শেষ হবার পর, মহান আল্লাহ ফেরেশতাদের উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমরা ভেবেছিলে ঐশী প্রতিনিধিত্ব পাবার পুরোপুরি যোগ্য কেবল তোমরাই। তোমরা এ ধারণা মনের মধ্যে লালন করছিলে। কিন্তু কখনও তা প্রকাশ করোনি। জেনে রাখো মহান আল্লাহ যেমনিভাবে তোমাদের প্রকাশ্য বিষয় সম্পর্কে জানেন, তেমনি তোমাদের অন্তরের কথাও তিনি জানেন। সৃষ্টি জগতের সব কিছুই তারই আওতাধীন। মহান আল্লাহ মানুষ ও প্রতিটি বস্তুর প্রকাশ্য ও গোপন দিক সম্পর্কে ভালোভাবে অবগত। এ আয়াতে এ বিষয়ের উপর গুরুত্বারোপ করার উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষ যেহেতু বিশ্ব প্রকৃতির গূঢ় রহস্য সম্পর্কে অবহিত নয় এবং শুধু মাত্র বাহ্যিক দিকটিই দেখতে পায় কাজেই আল্লাহর সিদ্ধান্তে সে যেন অযথা বিচলিত না হয় এবং কোন বিরুপ মনোভাব পোষণ না করে। কেননা মহান আল্লাহ সীমাহীন জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী এবং সে মোতাবেক প্রতিটি কাজ করেন। এ বিশ্ব জগতের কোথাও যদি মানুষের কাছে কোন কিছু অসামঞ্জস্য মনে হয়, তা মূলত মানুষের অজ্ঞতা প্রসূত। আল্লাহর কাজে কোন খুঁত নেই। এ আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে-
প্রথমত: মানুষ জ্ঞান ও শিক্ষার দিক থেকে ফেরেশতাদের উর্ধ্বে। মানুষের শেখার ক্ষমতা রয়েছে, কিন্তু ফেরেশতাদের এ বৈশিষ্ট্য নেই। ফলে আদম(আঃ) যে সব কথা বলতে পেরেছিলেন, ফেরেশতারা তা বলতে পারেননি।
দ্বিতীয়ত: যোগ্যতা ও দক্ষতা প্রমাণের জন্য পরীক্ষার প্রয়োজন। মহান আল্লাহ মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সত্ত্বেও মানুষের কাছে তা প্রমাণ করার জন্য পরীক্ষার আয়োজন করেছেন।
তৃতীয়ত: ফেরেশতারা অদৃশ্য জগত সম্পর্কে ঠিক ততটুকুই জানেন, মহান আল্লাহ তাদের যতটুকু ক্ষমতা দিয়েছেন। কেননা আগের একটি আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-“আমি যা জানি তোমরা তা জানো না।” আর এ আয়াতে বলেছেন-“আমি পৃথিবী ও আকাশের অদৃশ্য বিষয় সম্পর্কে অবগত আছি।
চতুর্থত: মানুষের প্রতিভা বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষেত্র তৈরী করা উচিত। মহান আল্লাহ পরীক্ষার আয়োজন করে আদম(আঃ)এর সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়েছেন যাতে মানুষ তার যোগ্যতা সম্পর্কে অবগত হয় এবং অন্যরাও তা বুঝতে পারে।#

কোরআনের আলো অনুষ্ঠানে আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি। আজ আমরা সূরা বাকারার ৩৪ ও ৩৫ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করব। সূরা বাকারার ৩৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“যখন ফেরেশতাদেরকে বললাম তোমরা আদমের প্রতি সিজদা কর, ইবলিশ ছাড়া সবাই সিজদা করলো, সে অমান্য ও অহংকার করলো এবং অবিশ্বাসীদের অন্তর্ভূক্ত হল।”
আগের আয়াতগুলোতে মানুষের প্রতি মহান আল্লাহর বৈষয়িক ও আধ্যাত্মিক নেয়ামত এবং সুযোগ সুবিধার কথা এক এক করে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে মানুষের বিশেষ মর্যাদার করণেই তাকে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব দেয়া হয়েছে। আর এ আয়াতে মানুষের জন্য একটি মর্যাদা বা শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলা হয়েছে। আর সেটা হচ্ছে আদমের প্রতি ফেরেশতাদের সিজদার বিষয়টি। যেমনটি সূরা স্বোয়াদ এবং সূরা হেজরে রয়েছে, মহান আল্লাহ মানুষ সৃষ্টির সময় ফেরেশতাদের সম্বোধন করে বলেছেন-“যখন আমি মানুষকে সুগঠিত করবো, তখন তার মধ্যে স্বীয় প্রাণ সঞ্চার করবো। এরপর তোমরা তার সামনে সেজদাকারীরূপে প্রণত হইও। কাজেই বোঝা যাচ্ছে, পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধিত্বের জন্য ফেরেশতারা মানুষকে সেজদা করেননি, বরং মানব হিসাবে সৃষ্টির কারণেই তাকে সিজদা করেছিলেন। আদমের উপর ঐশী প্রতিনিধিত্ব অর্পন করার পর যদি মহান আল্লাহ সেজদার নির্দেশ দিতেন তাহলে সেটা ফেরেশতাদের জন্য গৌরবের কারণ হতো না। কারণ তখন তারা আদমের বিশেষ মর্যাদার কারণেই তার সামনে মস্তক অবনত করতেন। আল্লাহর নির্দেশ পালন করাটা তাদের জন্য মূখ্য হয়ে উঠতো না। সূরা কাহাফের ৫০ নম্বর আয়াতের আলোকে বলা যায়, জ্বীন সম্প্রদায়ের ইবলিস একনিষ্ঠ ইবাদতের কারণেই ফেরেশতাদের অন্তর্ভুক্ত হতে পেরেছিল। কিন্তু অহংকার ও আত্মম্ভরীতার কারণে সে আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে। সে ভেবেছিলো সৃষ্টির দিক থেকে সে আদমের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বা মর্যাদাবান। কাজেই আদমকে সেজদা করা তার জন্য মোটেই শোভনীয় নয় বরং আদমের উচিত তাকে সেজদা করা। ইবলিস কেবল কাজের ক্ষেত্রেই আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে পাপ করেনি। বরং ধর্মীয় বিশ্বাসের দিক থেকেও সে আল্লাহর নির্দেশকে ইনসাফহীন ও অবিবেচনা প্রসূত ভেবে কুফরী করেছে এবং ইমান হাতছাড়া করেছে। ফেরেশতারা উপাসনার উদ্দেশ্যে আদমকে সিজদা করেননি। কারণ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উপাসনা করা বৈধ নয়। বরং তারা আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্য আদমের সম্মানার্থে সিজদা করেছেন। কাজেই ফেরেশতারা মূলত আল্লাহকেই সেজদা করেছেন। এবারে সূরা বাকারার ৩৪ নম্বর আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো তুলে ধরছি।
প্রথমত: আল্লাহর নির্দেশ পালনের জন্য কোন কাজ করাই প্রকৃত ইবাদত। আল্লাহর যে নির্দেশ বা বিধান মানুষের মনপুত: হবে, তা পালনের মাধ্যমে ইবাদত সম্পন্ন হয় না। ইবলিস কয়েক শতাব্দী ধরে আল্লাহর সামনে মস্তক অবনত করতে প্রস্তুত ছিলো, কিন্তু আদমের সামনে মূহুর্তের জন্যও সেজদা করতে রাজি হয়নি।
দ্বিতীয়ত: সমস্ত ফেরেশতা মানুষকে সিজদা করবে অথচ মানুষ আল্লার সামনে সেজদা করবে না, এটা মোটেও যুক্তিসঙ্গত নয়।
তৃতীয়ত: স্রষ্টার সামনে অহঙ্কার ও আত্যম্ভরীতা করলে মানুষ বেঈমান ও ধর্মহীন হয়ে পড়ে।
চতুর্থত: আল্লাহর নির্দেশে অন্য কারো সামনে সেজদা করা শিরক তো নয়ই বরং ইবাদতের শামিল।
পঞ্চমত: বয়স এবং পূর্ব অভিজ্ঞতার চেয়ে যোগ্যতা ও ক্ষমতা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ ফেরেশতারা যুগ বা কালের দিক থেকে অনেক পুরনো হওয়া সত্ত্বেও আদমকে সিজদা করেছেন।
ষষ্ঠত: আদমকে সেজদার উদ্দেশ্য কেবল ব্যক্তি আদমকে সেজদা করা নয় বরং মানব জাতির সামনে নত হওয়া। যেমন সূরা আরাফের ১১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি, তারপর তোমাদের রূপদান করি, অতপর ফেরেশতাদের বলেছিলাম আদমকে সেজদা কর।”

এবারে সূরা বাকারার ৩৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“আমি বললাম হে আদম! তুমি ও তোমার সঙ্গিনী জান্নাতে বসবাস কর এবং সেখান থেকে যা ইচ্ছা তাই খাও। কিন্তু এই বৃক্ষের নিকটবর্তী হয়োনা, অন্যথায় তোমরা অন্যায়কারীদের অন্তর্ভুক্ত হবে। মহান আল্লাহ পৃথিবীতে তাঁর প্রতিনিধিত্বের জন্য মানুষকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং পৃথিবীতে জীবন ধারণের জন্য প্রথমেই তার জন্য সঙ্গিনীও সৃষ্টি করেন। যাতে আদমের প্রশান্তির পাশাপাশি পৃথিবীতে মানবজাতির বংশ বিস্তার ঘটে। তিনি তাদের জন্য সুন্দর দুটি বাগানও তৈরী করেন, যাতে সেখানে তারা বসবাস করতে পারেন এবং নানা রকম খাদ্যেরও সংস্থান হয়। এভাবে মহান প্রতিপালক হযরত আদমের জন্য পৃথিবীতে সব ধরণের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করেন যাতে ধীরে ধীরে তারা এসবের ব্যবহার করতে শেখে। সব খাবার দাবারই মানুষের জন্য উপকারী নয়। তাই মহান আল্লাহ, বিশেষ কিছু খাবার দাবার বর্জনের নির্দেশ দিয়েছেন। কেননা এসব ফল-মূল বা খাবার খেলে দেহের ক্ষতির পাশাপাশি, মানুষের আত্মারও ক্ষতির আশঙ্কা ছিল। এমনকি বেহেশত থেকে বহিস্কারের সম্ভাবনা ছিল। কাজেই বোঝা যাচ্ছে হযরত আদম যে বেহেশতে ছিলেন সেটা পরকালের প্রতিশ্রুত বেহেশত নয়। কেননা ঐ বেহেশত মূলত: ভলো কাজের প্রতিদান দেবার জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে। আর তাছাড়া হযরত আদম(আ:) তখনও কোন ভালো কাজ করেননি তাই প্রতিদান পাওয়ার অর্থই হয়না। যেমন সূরা আল ইমরানের ১৪২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন-“তোমরা কি মনে কর যে তোমরাই বেহেশতে প্রবেশ করবে এবং যারা জিহাদ করে এবং যারা ধৈর্যশীল, আল্লাহ তোমাদের মধ্য থেকে এখনও তাদেরকে প্রকাশ করেননি?”
যারা প্রতিশ্রুত বেহেশতে প্রবেশ করবেন তারা সেখান থেকে বহিস্কৃত হবেন না। যেমনটি সূরা হিজরের ৪৮ নম্বর আয়াতে রয়েছে-“তারা জান্নাত থেকে বহিস্কৃত হবেন না।” এছাড়া প্রতিশ্রুত বেহেশতে নিষিদ্ধ গাছের কোন অস্তিত্ব নেই। সেখানকার সবকিছু হালাল এবং বৈধ। পৃথিবীর বিভিন্ন সবুজ শ্যামল বাগানের ক্ষেত্রেও মহান আল্লাহ ‘জান্নাত’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। কাজেই কেবলমাত্র পরকালের প্রতিশ্রুত বেহেশতের জন্যই ‘জান্নাত’ শব্দটির ব্যবহার হয়না। সূরা ক্বালামের ১৭ নম্বর আয়াতে রয়েছে-“আমি ওদের পরীক্ষা করবো, যেভাবে পরীক্ষা করেছিলাম উদ্যান অধিপতিদেরকে” সূরা বাকারার ৩৫ নম্বর আয়াতের শিক্ষনীয় বিষয়গুলো হচ্ছে-
প্রথমত: স্ত্রী, বাসস্থান, ও খাদ্য হচ্ছে পৃথিবীতে মানুষের আরাম-আয়েশ ও প্রশান্তির জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে নেয়ামত স্বরূপ।
দ্বিতীয়ত: গৃহে নারী, পুরুষের অধীন। এ আয়াতে সব ক্ষেত্রে হযরত আদম ও হাওয়াকে উদ্দেশ্য করে সব কিছু বলা হয়েছে। কিন্তু বাসস্থানের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র হযরত আদমকে সম্বোধন করা হয়েছে, আর তার স্ত্রী হাওয়াকে তার সাথে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে, হে আদম আপনি নিজ সহধর্মিনীর সাথে জান্নাতে বসবাস করুণ।
তৃতীয়ত: কোন জিনিস নিষিদ্ধ ঘোষণা করার আগে সেই প্রয়োজন মেটাবার সঠিক পথ দেখিয়ে দিতে হবে। মানুষের খাদ্যের প্রয়োজন। এজন্যই মহান আল্লাহ প্রথমে হযরত আদম ও বিবি হাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যের ব্যবস্থা করার পর তাদেরকে একটি বিশেষ বৃক্ষের ফল গ্রহণ করতে নিষেধ করেন।
চতুর্থত: গুনাহ বা পাপ এত বিপদ জনক যে, তা থেকে দূরে থাকা উচিত। আর এজন্যই মহান আল্লাহ, এ বিশেষ বৃক্ষটি খেয়োনা এর পরিবর্তে বলেন অর্থাৎ এ বৃক্ষের কাছে যেয়ো না।
পঞ্চমত: আল্লাহর নিষিদ্ধ কোন কাজ করলে তার ক্ষতি মূলত: মানুষেরই হয়। আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করা নিজের উপর জুলুম করারই শামিল। এর ফলে মানুষকে আল্লাহর নেয়ামত থেকে বঞ্চিত হতে হয়।
ষষ্ঠত: খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেত্রেও মানুষকে পুরোপুরি আল্লাহর অনুগত হতে হবে। আল্লাহ যেসব খাবার মানুষের জন্য উপকারী ও বৈধ করেছেন তাই খাওয়া উচিত। আর যেসব খাবার নিষিদ্ধ করেছেন, সেসব বর্জন করা উচিত। #

কোরআনের আলো অনুষ্ঠানে আপনাদের সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি। আজকের পর্বে আমরা সূরা বাকারার ৩৬ ও ৩৭ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করব। সূরা বাকারার ৩৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“এরপর শয়তান, আদম ও তার স্ত্রীকে পথভ্রষ্ট করলো এবং তারা যে বেহেশতে ছিল সেখান থেকে তাদেরকে বহিস্কৃত করল। সে সময় তাদেরকে বললাম তোমরা নীচে নেমে যাও একে অন্যের শত্র” হিসাবে। পৃথিবীতে কিছুকালের জন্য তোমাদের বসবাস ও জীবিকা রইল। গত পর্বেও আমরা হজরত আদম(আঃ) এর সৃষ্টির ঘটনা নিয়ে আলোচনা করেছি। তখন বলেছিলাম আল্লাহপাক হজরত আদম ও বিবি হাওয়ার জন্য বেহেশতের মত একটি বাগানে বসবাসের ব্যবস্থা করেছিলেন। সেখানে তাদের জন্য সব ধরণের খাবার ও ফলমূলের ব্যবস্থা করা হয়। শুধু নিষেধ করা হয় একটি বিশেষ গাছের ফল খেতে। কারণ ঐ ফল ছিল তাদের জন্য ক্ষতিকর এবং তাদের আত্মার উপর জুলুমের শামিল।
কিন্তু আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করে শয়তান হযরত আদমকে সেজদা না করায় আল্লাহ তাকে তার দরবার থেকে বহিষ্কার করেন। আর এজন্য শয়তান প্রতিহিংসা পরায়ন হয়ে উঠে। তার সব রোষ গিয়ে পড়ে হযরত আদম(আঃ)এর উপর। শয়তান প্রতিশোধ নেয়ার চিন্তায় অস্থির হয়ে ওঠে। যেভাবেই হোক হযরত আদমকে শান্তিপূর্ণ ও আরামের স্থান থেকে বহিষ্কার করবে বলে ঠিক করলো। যেমন ভাবা তেমন কাজ। শয়তান নানা কূটবুদ্ধি, ওয়াস-ওয়াসা ও চাল চেলে বুঝালো সে হযরত আদম আর বিবি হাওয়ার মঙ্গল চায়। ঐ নিষিদ্ধ ফলের সীমাহীন প্রশংসা আর উপকারীতা বর্ণনার ফলে একসময় সত্যি সত্যিই হযরত আদম আর বিবি হাওয়া শয়তানের ফাঁদে পা দিয়ে ফেললেন। শেষ পর্যন্ত শয়তানের কুমন্ত্রনায় তারা ঐ নিষিদ্ধ ফল খেলেন। হযরত আদম(আঃ) এবং বিবি হাওয়ার অবশ্য আল্লাহর নির্দেশ আমান্য করার কোন উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু তাদের অবস্থা ছিল অনেকটা ঐ শিশুর মত, যারা কিনা মিথ্যা, ধোকাবাজি ও কুটকৌশলের কোন অভিজ্ঞতাই নেই। শিশু যেমন সবাইকে সৎ সত্যবাদী মনে করে তেমনি সৃষ্টির প্রথম মানব হযরত আদম ও প্রথম মানবী বিবি হাওয়া শয়তানকে সত্যবদী ভেবে বসল। শয়তান যখন কসমের পর কসম খেয়ে তাদেরকে নিষিদ্ধ করার ফলে উপকারীতা ও গুনাগুন বর্ণনা করলো তখন তারা তাকে সরল শিশুর মত বিশ্বাস করে ধোকা খেল। আল্লাহর নির্দেশ অমান্য করার ফলে তারা বেহেশত থেকে বহি®কৃত হলো। আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশ এলো তোমরা আল্লাহর দরবার থেকে নীচে নেমে যাও। শয়তান ও তোমরা শত্র”তে পরিণত হয়েছো এবং নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোমাদেরকে পৃথিবীতে বসবাস করতে হবে। আদমকে সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবীতে তার খেলাফত বা প্রতিনিধিত্ব করা। তাই হযরত আদমকে পৃথিবীতে আসতেই হতো। এজন্য আল্লাহপাক প্রথমে তার জন্য সমস্যামুক্ত শান্তিপূর্ণ একটি স্থানে বসবাসের ব্যবস্থা করলেন, যাতে তিনি পৃথিবীতে আগমনের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পরেন। পৃথিবীর অবস্থার সাথে পরিচিত হন এবং প্রকৃত শত্র” অর্থাৎ শয়তানকে ভালোভাবে চিনতে পারেন।
সূরা বাকারার ৩৬ নম্বর আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে-
প্রথমত:শয়তানের আনুগত্য মানুষকে শুধু আল্লাহর কাছ থেকেই দুরে সরিয়ে নেয়না, একই সাথে মানুষকে প্রকৃত শান্তি থেকেও বঞ্চিত করে এবং তাকে নানা দুঃখ-কষ্টের মধ্যে ফেলে। যেমনটি হযরত আদম ও বিবি হাওয়ার জীবনে লক্ষ্য করা যায়।
দ্বিতীয়ত: মানুষের সাথে শয়তানের শত্রুতার ইতিহাস অতি প্রাচীন এবং সৃষ্টির সূচনা থেকে শুরু হয়ে এখনও তা চলছে।
তৃতীয়ত: পৃথিবী মানুষের অস্থায়ী আবাস। তাই বেহেশতে স্থায়ী আবাস গড়ার চিন্তায় ব্যস্ত থাকতে হবে।
চতুর্থত: আল্লাহর দেয়া অশেষ যোগ্যতা ও প্রতিভার কারণে প্রত্যেক মানুষই বেহেশতী। কিন্তু স্রষ্টার নির্দেশ অমান্য করার ফলে সে অতল গহ্বরে গিয়ে পড়ে।
পঞ্চমত: কোন মানুষ পাপ ও ভ্রান্তি থেকে মুক্ত নয়। যদি না আল্লাহ তাকে হেফাজত করেন। যে আদম পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফা এবং ফেরেশতাদের সাহচায লাভ করেছেন সেই হজরত আদম(আঃ) মুহূর্তের গাফলতীর জন্য আল্লাহর দরবার থেকে বহি®কৃত হন। অবশ্য হজরত আদম(আঃ) এর এই ভুল ছিল তার নবুয়্যত লাভের আগের ঘটনা।

এবারে সূরা বাকারার ৩৭ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। এ সূরা বলা হয়েছে-“এরপর আদম তার প্রতিপালকের কাছ থেকে কিছু শিক্ষা লাভ করল। এরপর আল্লাহ তাকে ক্ষমা করলেন। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল দয়াময়।”
সেই শান্তিময় স্থান থেকে বহি®কৃত হয়ে কষ্টকর পৃথিবীতে নেমে আসার পর আদম তার ভুল এবং শয়তানের ধোকা বুঝতে পারলেন। তাই তিনি অনুশোচনা করতে লাগলেন এবং কিভাবে তওবা করা যায় সে পথ খূজতে লাগলেন। এখানেও আল্লাহপাক হজরত আদমকে অসহায়ভাবে ছেড়ে দিলেন না। তিনি হজরত আদমকে তওবা এবং অনুশোচনা করার ভাষা শিক্ষা দিলেন। সেই বাণী সূরা আরাফের ২৩ নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। বলা হয়েছে-“তারা বলল হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের প্রতি অন্যায় করেছি। যদি তুমি আমাদের ক্ষমা না কর, তবে আমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভক্ত হবো।”
এই ভাষা কেবল হযরত আদম(আঃ) এর তওবার জন্যেই নির্দিষ্ট নয় বরং হযরত ইউনুস ও হযরত মুসা(আঃ)এর ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। যেমন কোরানে হযরত মুসা(আঃ) সম্পর্কে বলা হয়েছে-“তিনি বললেন-হে আমার প্রতিপালক,আমি আমার নিজের উপর জুলুম করেছি। তুমি আমায় ক্ষমা কর।”
অবশ্য হযরত আদম(আঃ) তার তওবা কবুল হওয়ার জন্য আল্লাহর শিখিয়ে দেয়া শাফায়াতকারীদের নাম উচ্চারন করেন। এ সম্পর্কে বিখ্যাত আলেম আল্লামা সুয়ূতি(রঃ) তার লেখা দোরুল মানসুর তাফসীর গ্রন্থের প্রথম খন্ডের ৬০ পৃষ্ঠায় বেশ কিছু হাদীস উল্লেখ করেছেন। সেসব হাদিসে এসেছে যে হযরত আদম(আঃ) আল্লাহর কাছে তার তওবা কবুল হওয়ার জন্য হযরত মোহাম্মদ(সাঃ) এবং তার বংশধরদেরকে উসিলা হিসাবে উপস্থাপন করে। হজরত ইবনে আব্বাস(রঃ) বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে-“আদম(আঃ) আল্লাহর কাছে হজরত মোহাম্মদ(সাঃ) এবং তার আহলে বাইতকে উসিলা হিসাবে তুলে ধরেন যাতে তার তওবা কবুল হয়।” শাব্দিকভাবে তওবার অর্থ প্রত্যাবর্তন। এ শব্দটি যখন মানুষ সম্পর্কে ব্যবহৃত হয়, তখন তার অর্থ হলো পাপ কাজ থেকে প্রত্যাবর্তন। আর যখন তওবা শব্দটি আল্লা সম্পর্কে ব্যবহৃত হয় তখন তার অর্থ হলো আল্লাহর দয়া ও রহমত ফিরে আসা। অর্থাৎ মানুষের পাপ কাজের কারণে আল্লাহ তার দয়া ফিরিয়ে নেয়ার পর মানুষ যখন পাপ কাজ থেকে প্রত্যাবর্তন করে তখন আল্লাহ পুনরায় দয়া ফিরিয়ে দেন। আল্লাহপাক নিজে তাওয়াব বা ক্ষমাশীল। যেমন সূরা বাকারার ২২২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“তাই আল্লাহর দয়া সম্পর্কে মানুষের নিরাশ হওয়ার কোন কারণ নেই। তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনাকারীরা থাকলে আল্লাহর দয়া করুণার ধারাও থাকবে অবিরাম।
সূরা বাকারার ৩৭ নম্বর আয়াতের শিক্ষণীয় করেকটি বিষয় হচ্ছে-
প্রথমত: মানুষের তওবা করার তওফিক যেমন আল্লাহর হাতে তেমনি কিভাবে তওবা করা উচিত সেই পথও পেতে হবে আল্লাহর কাছ থেকে। তাই এ আয়াতে হজরত আদম(আঃ)এর তওবা সম্পর্কে বলা হয়েছে তওবার ভাষা ও শব্দ আল্লা তাকে শিখিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত: মানুষের তওবা যদি সত্যিকার তওবা হয় তাহলে আল্লাহ তা কবুল করবেন। কারণ তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াময়।
তৃতীয়ত: আল্লাহপাকের ক্ষমা হলো দয়া ও ভালোবাসায় সিক্ত। এতে নেই কোন অপমান এবং নেই কোন ভৎর্সনা।
চতুর্থত: যদি আমরা কোন সময় তওবা করে তা ভঙ্গ করি এবং পুনরায় পাপে লিপ্ত হই, তারপরও আল্লাহর করুনা থেকে নিরাশ হতে নেই। কারণ তিনি তাওয়াব বা তওবা গ্রহণকারী। যদি আবারও আমরা তওবা করি তাহলে তিনি আমাদের তওবা কবুল করে নেবেন।#

কোরআনের আলোর আজকের পর্বে আমরা সূরা বাকারার ৩৮ ও ৩৯ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করব। সূরা বাকারার ৩৮ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“আমি বললাম তোমরা এখান থেকে নীচে নেমে যাও। পরে যখন আমার কাছ থেকে তোমাদের কাছে পথ নির্দেশনা আসবে তখন যারা আমার উপদেশ অনুসরণ করবে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিত হবেনা।”
আল্লাহর কাছে হযরত আদম(আঃ)এর তওবা কবুল হওয়ার পর নির্দেশ এলো নীচে নেমে যাও, যাতে এ রকম বিভ্রান্তির সৃষ্টি না হয় যে তওবা কবুল হওয়ার ফলে তিনি পুনরায় বেহেশতে ফিরে আসবেন। আল্লাহর ক্ষমার ফলে শাস্তি লাঘব হয় কিন্তু গুনার ফলে যে প্রভাব পড়ে তার অবসান হয়না। নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার স্বাভাবিক পরিণতি ছিল হযরত আদম ও বিবি হাওয়ার বেহেশত থেকে বহি®কৃত হওয়া। তওবার ফলে এই স্বাভাবিক প্রভাব দূর হয়নি। তাই হযরত আদম(আঃ) ও বিবি হাওয়া বেহেশত থেকে বেরিয়ে আল্লাহর নির্দেশে পৃথিবীর সুযোগ সুবিধাবিহীন একটি স্থানে বসবাস করতে লাগলেন। বেহেশত থেকে হযরত আদম ও বিবি হাওয়ার বেরিয়ে যাওয়ার ফলে তাদের সন্তানেরাও বেহেশতের বাইরে পৃথিবীতে বসবাস করবে বলে ঠিক হয়। তবে একই সাথে উল্লেখ করা হয় মানবজাতির পথ নির্দেশনার বিষয়টি। আল্লাহপাক বলেন আমি তোমাদের জন্য সঠিক পথে চলার উপকরণ পাঠাবো। পথপ্রদর্শনের জন্য কিতাব এবং রাসূল প্রেরণের অঙ্গীকার করেন। কিন্তু মানুষ দুটি দলে বিভক্ত। একদল আল্লাহর আদেশ নিষেধ অনুসরণ করে এবং অপর দল হলো অবিশ্বাসী ও কাফের। আল্লাহপাক সৃষ্টির শুরুতেই তাবত দুনিয়ার সকল সত্তা, সৃষ্টি ও সব কিছুর নাম হযরত আদমকে শিখিয়ে দেন। তার সত্তায় সপে দেন জ্ঞান অর্জনের অফুরন্ত ক্ষমতা। আর এই জ্ঞানই হলো ফেরেশতাদের উপর তার মর্যাদার মূল কারণ। কিন্তু উপলদ্ধি ক্ষমতা ও বিচার-বুদ্ধি তাকে শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে রক্ষা করতে পারেনি। তাই সেই শুরুতেই হযরত আদম(আঃ) ধোকা খেলেন এবং পড়ে গেলেন বিভ্রান্তিতে। তাই আল্লাহপাক হযরত আদম(আঃ)এর তওবা কবুল করে তাকে পৃথিবীতে পাঠানোর পর তার জন্য পথনির্দেশনার ব্যবস্থা করলেন। যাতে তিনি সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করতে পারেন, চিনতে পারেন ভালো-মন্দ এবং ভুল পথে পা না বাড়ান। আল্লাহপাক মানব জাতিকে বিচার-বুদ্ধি বা আকল দেয়ার পাশাপাশি দ্বিতীয় যে মহান নেয়ামত দিয়েছেন তাহলো অহী। নবীদের মাধ্যমে অহী নাজিল এবং মানুষের পথ প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করা আল্লাহর জন্য অবশ্যকীয় বিষয়। তবে হেদায়েত লাভ করা সম্পূর্ণ মানুষের ইচ্ছার অধীন। মানুষ চাইলে সঠিক পথের অধিকারী হবে আর না চাইলে আল্লাহ তাকে জোর করে সঠিক পথে পরিচালিত করবেন না। মানুষ তার পথ নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্বাধীন এবং এ ব্যাপারে আল্লাহর কোন জোর জবরদস্তি নেই। মানুষের সবচেয়ে বড় উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা হলো তার ভবিষ্যৎ নিয়ে। মানুষ নিজে অতীত জীবনের দিকে তাকালে হতাশ হয়ে পড়ে। সুযোগ ও সম্ভাবনা কাজে না লাগানোর বেদনায় সে মুষড়ে পড়ে। তাই নিজের অজান্তেই ভবিষ্যৎ নিয়ে তার মধ্যে বারবার আশঙ্কার জন্ম হয়। তবে যে আল্লাহর পথনির্দেশনা অনুযায়ী চলবে আল্লাহ নিজেই তার ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করবেন। তখন তার মধ্যে থাকবে না কোন উদ্বেগ, কোন শঙ্কা, অতীত নিয়ে সে যেমন বেদনায় ভোগে সেরকম বেদনায় সে ভুগবে না। কারণ সে তার দায়িত্ব অনুযায়ী কাজ করছে। তার কাজের ফলাফল এখন পাওয়া না গেলেও তা কি রকম হবে সে ব্যাপারে সে নিশ্চিত এবং আশাবাদী।
সূরা বাকারার ৩৮ নম্বর আয়াতের কয়েটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে-

প্রথমত: কখনো একটি ভুলের জন্য গোটা জাতিকে এর ফল ভোগ করতে হয়। হযরত আদম(আঃ) কেবল একটি ভুল করেছিলেন । কিন্তু ঐ একটি ভুলের ফলে তিনি ও তার ভবিষ্যৎ বংশধর বেহেশত থেকে বহি®কৃত হয়।
দ্বিতীয়ত: আল্লাহ তার অপার দয়া ও রহমত থেকে কখনোই মানুষকে বঞ্চিত করেন না। হযরত আদম(আঃ)এর অবাধ্যতা সত্ত্বেও আল্লাহপাক তাকে তওবার পথ দেখিয়ে দিলেন এবং হেদায়েতের উপকরণও তাকে দিলেন।
তৃতীয়ত: মানুষ পৃথিবীতে বসবাস শুরু করার সাথে সাথেই আল্লাহর পথনির্দেশনা আরম্ভ হয়। আর প্রকৃত পথ নির্দেশনার মালিক একমাত্র আল্লাহ।
চতুর্থত: মানুষের একটি বৈশিষ্ট্য হলো সে নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্বাধীন। আল্লাহর দেয়া দিক নির্দেশনা মেনে চলতে সে বাধ্য নয়। তাই মানব জাতির একটি অংশ মুমিন এবং অপর অংশ কাফের হয়ে যায়।
পঞ্চমত:হেদায়েত লাভকারী ব্যক্তি প্রকৃত শান্তিতে বসবাস করেন। তার মধ্যে থাকেনা কোন উদ্বেগ, থাকেনা কোন উৎকণ্ঠা।
এবারে সূরা বাকারার ৩৯ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। এ আয়াতে বলা হয়েছে, “যারা অবিশ্বাস করে ও আমার নিদর্শন সমূহকে মিথ্যা আখ্যায়িত করে তারা দোজখের অধিবাসী। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে।”
এদের বিপরীতে যারা স্বেচ্ছায় আল্লাহর দিক-নির্দেশনা মেনে নেয় তারা অবশেষে সৌভাগ্যের অধিকারী হবে। এ আয়াতে যেমনটি বলা হয়েছে সমাজে একদল লোক আছে যারা অবিশ্বাস ও বিদ্বেষের কারণে আল্লাহর নিদর্শন উপেক্ষা করে এবং সেগুলোকে মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করে। সঠিক পথে চলার জন্য আল্লাহ যে উপকরণ দিয়েছেন, সেগুলো তার স্পষ্ট নিদর্শন। তবে কেউ যদি আবিশ্বাস আর সত্যকে ঢাকা দেয়ার মন মানসিকতা নিয়ে আল্লাহর নিদর্শনাবলীর দিকে তাকায়, তাহলে ঐ নিদর্শনগুলো মেনে নেয়াতো দূরের কথা সেগুলোর সত্যতাও অস্বীকার করবে। আখ্যায়িত করবে সেগুলোকে মিথ্যা হিসাবে। পরকালে এধরণের লোকদের স্থান হলো দোজখের আগুন। কারণ বিদ্বেষ ও একগুয়েমী তাদের চিরাচরিত স্বভাব এবং তাদের এ স্বভাব পরিবর্তন হবে না। তাই দোজখ হবে তাদের চিরকালীন আবাসস্থল।
সূরা বাকারার ৩৯ নম্বর আয়াতের শিক্ষণীয় দিকটি হচ্ছে, আল্লাহপাক কাফেরদের জন্যও হেদায়েতের উপকরণ দিয়েছেন। কিন্তু তারা নিজেরাই সঠিক পথে চলতে চায় না। এভাবে তারা নিজ হাতে দোজখের আগুন ক্রয় করেছে।#

কোরআনের আলোর আজকের পর্বে আমরা সূরা বাকারার ৪০,৪১,৪২ ও ৪৩ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করব। সূরা বাকারার ৪০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-“হে বনী ইসরাইল, আমি তোমাদের যে সুখ ও সম্পদ দান করেছি তা স্বরণ কর এবং আমার অঙ্গীকার পূরণ কর। আমিও তোমাদের অঙ্গীকার পূরণ করব। আর তোমরা শুধু আমাকেই ভয় কর। আল্লাহকে দেয়া অঙ্গীকার ভুলে যাওয়ায় হযরত আদম(আঃ)এর বেহেশত থেকে বহি®কৃত হওয়া এবং পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব লাভ সম্পর্কে কাহিনী বর্ণনার পর, এই আয়াতে আল্লাহপাক আরেকটি কাহিনীর বর্ণনা দেন। হযরত আদম(আঃ)এরই সন্তান অর্থাৎ বনী ইসরাইল গোত্র কি পরিণতির শিকার হয়েছিলো সেকথাই এখানে বলা হয়েছে। হযরত ইয়াকুব (আঃ)এর অপর নাম ছিলো ইসরাইল। বনী ইসরাইল বলতে তারই সন্তান-সন্ততি ও বংশধরদের বুঝানো হচ্ছে। ইতিহাসে এই গোত্রের রয়েছে দীর্ঘ চড়াই-উৎরাইয়ের কাহিনী। কোরআনের বহু আয়াতে এই গোত্রের কাহিনী বলা হয়েছে। এই আয়াতে তিনটি নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যা আল্লাহ প্রদত্ত সকল কর্মসূচীর উৎস। প্রথমত: আল্লাহর দেয়া নেয়ামতের কথা স্বরণ করতে হবে। এতে মানুষের মধ্যে শোকর আদায়ের অনুভূতি সৃষ্টি হয় এবং আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা ও তার আনুগত্যের স্পৃহা জেগে ওঠে। দ্বিতীয়ত: আল্লাহর দেয়া নেয়ামত ও সুখ-সম্পদ শর্তহীনভাবে দেয়া হয়নি। একই সাথে আল্লাহ মানুষের কাছ থেকে অঙ্গীকার নিয়েছেন। তাই মানুষের বিশেষ কিছু দায়িত্ব আছে। সে যদি আল্লাহ নির্দেশিত পথে চলে তাহলে আল্লাহর দেয়া দয়া ও অনুগ্রহ থেকে পুরোপুরি লাভবান হতে পারবে। এই আয়াতের তৃতীয় নির্দেশ হলো আল্লাহর দেয়া দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোন শক্তিকে ভয় পেলে চলবে না। শত্রুদের হুমকী ও প্রচারণা যাতে মানুষের মধ্যে কোন প্রভাব ফেলতে না ফেলে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
এবারে সূরা বাকারার ৪১ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। এ আয়াতে বলা হয়েছে-“তোমাদের কাছে যা আছে তার সমর্থক হিসাবে আমি যা অবতীর্ণ করেছি তাতে ঈমান আনো। আর তোমরাই এর প্রথম প্রত্যাখ্যানকারী হয়োনা এবং আমার আয়াতকে স্বল্প মূল্যে বিক্রি করো না। তোমরা শুধু আমাকেই ভয় করবে।”
এই আয়াতে ইহুদী পন্ডিতদের প্রতি উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে তোমরা তওরাতের সুসংবাদ অনুযায়ী ইসলামের নবীর আগমনের প্রতীক্ষায় ছিলে। এখন তার গ্রন্থ কোরআন যা কিনা তোমাদের তওরাতের সাথে সংগতিপূর্ণ তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করো। নিজেদের অবস্থান জানার জন্য তওরাতের যেসব বাণীতে ইসলামের নবীর বিভিন্ন নিদর্শন উল্লেখ করা হয়েছে তা গোপন করোনা এবং পার্থিব সম্পদের বিনিময়ে ধর্মকে বিক্রি করোনা। কিংবা কোরআনকে তোমরা প্রথম অবিশ্বাস করোনা। তাহলে অন্য ইহুদীরা তোমাদের অনুসরণে ইসলাম গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাবে। মুসলিম ব্যক্তি সকল আসমানী গ্রন্থ ও পূর্ববর্তী নবীদের প্রতি বিশ্বাস রাখে। কিন্তু ইসলাম ধর্ম হলো সর্বশেষ ধর্ম। এর আগের সব ঐশী গ্রন্থ বিকৃতির শিকার হয়েছে। তাই একজন মুসলমান শুধু মাত্র ইসলামের নবী হযরত মুহাম্মদ(সাঃ)এর অনুসারী। এজন্যে কোরআন পূর্ববর্তী ধর্মের অনুসারীদেরকে কোরআনের প্রতি ঈমান আনতে বলে। একই সাথে একথাও বলে যে, কোরআনের বিষয়বস্তু পূর্ববর্তী ধর্মগুলোর সাথে সংগতিপূর্ণ। পার্থক্য হলো পবিত্র কোরআন বিকৃতির উর্দ্ধে। মহাগ্রন্থ কোরআনের প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের ক্ষেত্রে অন্য কাউকে নয় বরং শুধু আল্লাহর নির্দেশের প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে।
এবারে সূরা বাকারার ৪২ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। এ আয়াতে বলা হয়েছে,”তোমরা সত্যকে মিথ্যা দিয়ে আড়াল করো না এবং জেনেশুনে সত্য গোপন করো না।”
পন্ডিত ব্যক্তিদের যে বিষয়টি তাদের জাতি ও ধর্মকে হুমকীগ্রস্ত করে তাহলো সত্য গোপন করা কিংবা নিজেদের খেয়াল খুশী মত সত্য ও মিথ্যা বর্ণনা দেয়া। এর ফলে জনগণ অজ্ঞতা, মূর্খতা কিংবা বিভ্রান্তি ও সংশয়ের মধ্যে পড়ে। একটি জাতির পন্ডিত ও শীর্ষ ব্যক্তিরা যেসব অপরাধ করে তার মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য অপরাধ হলো এটি। আমিরুল মুমিনিন হযরত আলী(আঃ) নাহজুল বালাগা গ্রন্থের ৪৯ নম্বর বাক্যে এ সম্পর্কে বলেন, মিথ্যা যদি সরাসরি বর্ণনা করা হয়, তাহলে ভয়ের কিছু নেই। কারণ মানুষ ঐ বিষয়টি যে ভুল তা বুঝতে পারবে এবং নিজেরাই সেটি বর্জন করবে। আর যদি সত্য সরাসরি এবং অবিকৃতভাবে বর্ণনা করা হয়, তাহলে বিরোধীদের মুখ বন্ধ হয়ে যাবে এবং জনগণও তা মেনে নেবে। বিপদ ঘটে তখনই যখন সত্য-মিথ্যা মিশিয়ে বর্ণনা করা হয়। ঐ অবস্থায় শয়তান সহজেই মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারে।
এবারে সূরা বাকারার ৪৩ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। এ আয়াতে বলা হয়েছে,”তোমরা নামাজ কায়েম কর, জাকাত দাও এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু কর। শুধু সত্যকে চেনা ও জানাই যথেষ্ট নয়। বরং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ব্যক্তিকে কাজের লোক হতে হবে। আর সর্বোত্তম কাজ হলো আল্লাহর এবাদত এবং তার সৃষ্টির সেবা করা।”
কোরআনের অধিকাংশ আয়াতে নামাজ ও জাকাতের বিষয়টি পাশাপাশি এসেছে। এর অর্থ হলো নামাজ ও এবাদতের পাশাপাশি একজন মুসলমানকে মানুষের প্রতি সেবা ও দরিদ্রদের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করতে হবে। এমনকি নামাজ পড়ার পদ্ধতি সম্পর্কে বর্ণনায় জনগণের মধ্যে উপস্থিত হওয়ার উপর জোর দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে জামাতে নামাজ পড়বে এবং অন্যান্য মুসলমানদের সাথে রুকু ও সেজদা করবে। এর কারণ হলো সমাজে নিঃস্বঙ্গ জীবন-যাপনকে ইসলাম অনুমোদন করে না। সূরা বাকারার ৪০, ৪১,৪২ ও ৪৩ নম্বর আয়াতের কয়েকটি প্রধান শিক্ষনীয় বিষয় হচ্ছে-
প্রথমত: আল্লাহপাক আমাদের পরিবার ও সমাজকে যে সব নেয়ামত দিয়েছেন সেগুলো সব সময় স্মরণ করতে হবে। আল্লাহর নেয়ামতের কথা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে হবে, যাতে আল্লাহর শোকর আদায় এবং তাকে অনুসরণ ও ভালোবাসার স্পৃহা জন্ম নেয়।
দ্বিতীয়ত: দায়িত্ব পালনের জন্য আল্লাহপাক আমাদের ফিতরাত বা প্রকৃতি কিংবা ঐশী বিধানের মাধ্যমে আমাদের যে অঙ্গীকার নিয়েছেন সেই অঙ্গীকার আমাদের মেনে চলতে হবে। আর মনে রাখতে হবে আল্লাহর বিশেষ দয়া পেতে হলে তার নির্দেশিত পথে চলতে হবে।
তৃতীয়ত: আল্লাহর বিধান মেনে চলার ক্ষেত্রে কোন শক্তিকে ভয় পাওয়া চলবে না। এ ছাড়াও শ্রেফ ধন-সম্পদ ও নিজেদের মর্যাদার জন্য আল্লাহর বাণী প্রত্যাখ্যানকারীদের মধ্যে যাতে অগ্রীম না হই সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
চতুর্থত: মানুষের প্রত্যেক অঙ্গ বিশেষ কিছু পাপ করার ক্ষমতা রাখে জিভের একটি প্রধান পাপকাজ হলো জেনে শুনে সত্য বলা থেকে বিরত থাকা। ঈমান আমল থেকে পৃথক কিছু নয়। সকল ঐশী ধর্মের প্রথম নির্দেশ হলো নামাজ।
ষষ্ঠত: নামাজ মূলত: জামাতে পড়া উচিত। এটি মুসলমানদের একটি ধর্মীয় দায়িত্ব।

Leave A Reply

Your email address will not be published.