ইমাম হুসাইনের (আ.) সংক্ষিপ্ত জীবনী

0 568

শহীদকূল শিরোমণি হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) ছিলেন হযরত ইমাম আলী (আ.) ও হযরত ফাতিমা (আ.)-এর দ্বিতীয় সন্তানতিনি চতুর্থ হিজরীতে জন্ম গ্রহণ করেনবড় ভাই হযরত ইমাম হাসানের শাহাদতের পর তিনি মহান আল্লাহর নির্দেশে এবং ইমাম হাসান (আ.)-এর ওসিয়ত ক্রমে ৩য় ইমাম হিসেবে মনোনীত হন[1] হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ইমামতকাল ছিল দশ বছর


[1] | ÔwKZveyj Bikv`Õ (†kBL gywd`) 179 bs c„ôv| ÔBm&evZzj û`vn&Õ 5g LÛ, 158 I 212 bs c„ôv| ÔBmevZzj Iqvwmqvn&Õ (gvmD`x) [1320 wnRix‡Z †Zniv‡b gyw`ªZ] 125 bs c„ôv|

তাঁর ইমামতের শেষ ৬মাস ছাড়া বাকী সমগ্র ইমামতকালই মুয়াবিয়ার খেলাফতের যুগেই কেটেছিলতাঁর ইমামতের পুরো সময়টাতেই তিনি অত্যন্ত কঠিন দূর্যোগপূর্ণ ও শ্বাসরূদ্ধকর পরিবেশে জীবন যাপন করেনকারণ, ঐযুগে ইসলামী আইন-কানুন মর্যাদাহীন হয়ে পড়েছিলতখন খলিফার ব্যক্তিগত ইচ্ছাই আল্লাহ্‌ ও তার রাসুল (সা.)-এর ইচ্ছার স্থলাভিষিক্ত হয়ে পড়েমুয়াবিয়া ও তার সঙ্গীসাথীরা পবিত্র আহলে বাইতগণ (আ.) ও শীয়াদের ধ্বংস করা এবং ইমাম আলী (আ.) ও তাঁর বংশের নাম নিশ্চিহ্ন করার জন্যে এমন কোন প্রকার কর্মসূচী নেই যা অবলম্বন করেনিশুধু তাই নয় মুয়াবিয়া স্বীয় পুত্র ইয়াযিদকে তার পরবর্তী খলিফা হিসেবে মনোনীত করার মাধ্যমে স্বীয় ক্ষমতার ভিত্তিকে আরও শক্তিশালী করে তোলেকিন্তু ইয়াযিদের চরিত্রহীনতার কারণে একদল লোক তার প্রতি অত্যন্ত অসন্তুষ্ট ছিলতাই মুয়াবিয়া এ ধরণের বিরোধীতা রোধের জন্যে অত্যন্ত কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ করেইচ্ছাকৃতভাবে হোক আর অনিচ্ছাকৃত ভাবেই হোক, হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-কে এক অন্ধকারাচ্ছান্ন দূর্দিন কাটাতে হয়েছেমুয়াবিয়া ও তার অনুচরদের পক্ষ থেকে সর্বপ্রকার মানসিক অত্যাচার তাঁকে নিরবে সহ্য করতে হয়েছিলঅবশেষে হিজরী ৬০ সনের মাঝামাঝি সময়ে মুয়াবিয়া মৃত্যুবরণ করেতার মৃত্যুর পর তদীয় পুত্র ইয়াযিদ তার স্থলাভিষিক্ত হয়[1] সে যুগে বাইয়াত (আনুগত্য প্রকাশের শপথ গ্রহণ) ব্যবস্থা আরবদের মধ্যে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রথা হিসেবে প্রচলিত ছিলবিশেষ করে রাষ্ট্রীয়কার্য পরিচালনার দায়িত্বে নিযুক্তির মত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে বাইয়াত গ্রহণ করা হতবিশেষ করে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের পক্ষ থেকে রাজা বাদশা বা খলিফার প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশের জন্যে অবশ্যই বাইয়াত গ্রহণ করা হতবাইয়াত প্রদানের পর তার বিরোধীতা করা বিরোধী ব্যক্তির জাতির জন্যে অত্যন্ত লজ্জাকর ও কলঙ্কের বিষয় হিসেবে গণ্য করা হতএমনকি মহানবী (সা.)-এর জীবনাদর্শে ও স্বাধীন ও ঐচ্ছিকভাবে প্রদত্ত বাইয়াতের নির্ভরযোগ্যতার অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিলমুয়াবিয়াও তার জাতীয় প্রথা অনুযায়ী তার পরবর্তী খলিফা হিসেবে জনগণের কাছ থেকে স্বীয়পুত্র ইয়াযিদের জন্যে বাইয়াত সংগ্রহ করেকিন্তু মুয়াবিয়া এ ব্যাপারে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর বাইয়াত গ্রহণের ব্যাপারে তাঁকে কোন প্রকার চাপ প্রয়োগ করেনিশুধু তাই নয়, মৃত্যুর পূর্বে সে ইয়াযিদকে বিশেষভাবে ওসিয়াত করে গিয়েছিল[2] যে, ইমাম হুসাইন (আ.) যদি তার (ইয়াযিদ) আনুগত্য স্বীকার (বাইয়াত) না করে, তাহলে সে (ইয়াযিদ) যেন এ নিয়ে আর বেশী বাড়াবাড়ি না করেবরং নীরব থেকে এ ব্যাপারটা যেন সে এড়িয়ে যেতে চেষ্টা করেকারণঃ মুয়াবিয়া এ ব্যাপারে অদ্যোপান্ত চিন্তা করে এর দুঃসহ পরিণাম সম্পর্কে উপলব্ধি করতে পেরেছিল

কিন্তু ইয়াযিদ তার চরম অহংকার ও দুঃসাহসের ফলে পিতার ওসিয়তের কথা ভুলে বসলতাই পিতার মৃত্যুর পর পরই সে মদীনার গর্ভণরকে তার (ইয়াযিদ) পক্ষ থেকে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কাছ থেকে বাইয়াত গ্রহণের নির্দেশ দিলশুধু তাই নয়, ইমাম হুসাইন (আ.) যদি বাইয়াত প্রদানে অস্বীকৃতি জানায়, তাহলে তক্ষণা তাঁর কর্তিত মস্তক দামেস্কে পাঠানোর জন্যেও মদীনার গর্ভণরের কাছে কড়া নির্দেশ পাঠানো হয়[3]

মদীনার প্রশাসক হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-কে যথা সময়ে ইয়াযিদের নির্দেশ সম্পর্কে অবহিত করেনইমাম হুসাইন (আ.) ঐ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করে দেখার জন্যে কিছু অবসর চেয়ে নিলেনআর ঐ রাতেই তিনি স্বপরিবারে মক্কার উদ্দেশ্যে মদীনা নগরী ত্যাগ করেন

মহান আল্লাহ্‌ ঘোষিত মক্কার হারাম শরীফের নিরাপত্তার বিধান অনুযায়ী তিনি সেখানে আশ্রয় নেনসময়টা ছিল হিজরী ৬০ সনে রজব মাসের শেষ ও শাবান মাসের প্রথম দিকেইমাম হুসাইন (আ.) প্রায় চার মাস যাব মক্কায় আশ্রিত অবস্থায় কাটানআর ধীরে ধীরে এ সংবাদ তদানিন্তন ইসলামী বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েমুয়াবিয়ার অত্যাচারমূলক ও অবৈধ শাসনে ক্ষিপ্ত অসংখ্য মুসলমান ইয়াযিদের এহেন কার্যকলাপে আরও অসন্তুষ্ট ও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলতারা সবাই ইমাম হুসাইন (আ.)-এর প্রতি নিজেদের সহমর্মিতা প্রকাশ করলপাশাপাশি ইরাকের বিভিন্ন শহর থেকে, বিশেষ করে ইরাকের কুফা শহর থেকে সেখানে গমনের আমন্ত্রনমূলক চিঠির বন্যা মক্কায় ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কাছে প্রবাহিত হতে লাগলঐসব চিঠির বক্তব্য ছিল একটাই আর তা হল, ইমাম হুসাইন (আ.) যেন অনুগ্রহপূর্বক ইরাকে গিয়ে সেখানকার জনগণের নেতৃত্বের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন এবং অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ব্যাপারে যেন তাদের নেতৃত্ব প্রদান করেনএ বিষয়টি ইয়াযিদের জন্যে অবশ্যই অত্যন্ত বিপদজনক ব্যাপার ছিলমক্কায় ইমাম হুসাইন (আ.)-এর অবস্থান হজ্জ মৌসুম শুরু হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকেসারা বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে মুসলমানরা দলে দলে হজ্জ উপলক্ষে মক্কায় সমবেত হতে লাগলহাজীরা সবাই হজ্জপর্ব সম্পন্নের জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেইতিমধ্যে গোপন সূত্রে ইমাম হুসাইন (আ.) অবগত হলেন যে, ইয়াযিদের পক্ষ থেকে বেশ কিছু অনুচর হাজীর বেশে মক্কায় প্রবেশ করেছেইহ্‌রামের কাপড়ের ভেতর তারা অস্ত্র বহন করছেতারা হজ্জ চলাকালীন সময়ে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-কে তাদের ইহ্‌রামের কাপড়ের ভেতর লুকানো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করবে[4]

ইমাম হুসাইন (আ.) ইয়াযিদের গোপন ষড়যন্ত্রের ব্যাপার টের পেয়ে স্বীয় কর্মসূচী সংক্ষিপ্ত করে মক্কা ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেনএ সিদ্ধান্তের পর হজ্জ উপলক্ষে আগত বিশাল জনগোষ্ঠীর সামনে তিনি সংক্ষিপ্ত এক বক্তব্য পেশ করেন[5] ঐ বক্তব্যে তিনি ইরাকের পথে যাত্রা করার ব্যাপারে নিজ সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করেনএকই সাথে তাঁর আসন্ন শাহাদত প্রাপ্তির কথাও তিনি ঐ জনসভায় ব্যক্ত করেনআর তাঁকে ঐ মহান লক্ষ্যে (অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ) সহযোগিতা করার জন্যে উপস্থিত মুসলমানদেরকে আহ্‌বান জানানউক্ত বক্তব্যের পরপরই তিনি কিছু সংখ্যক সহযোগীসহ স্বপরিবারে ইরাকের পথে যাত্রা করেন

হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) কোন ক্রমেই ইয়াযিদের কাছে ‘বাইয়াত’ প্রদান না করার জন্যে সুদৃঢ় সিদ্ধান্ত নেনতিনি ভাল করেই জানতেন যে, এ জন্যে তাকে প্রাণ বিষর্জন দিতে হবেতিনি এটাও জানতেন যে, বনি উমাইয়াদের বিশাল ও ভয়ংকার যোদ্ধা বাহিনীর দ্বারা তাঁকে সম্পূর্ণ রূপে নিশ্চিহ্ন করা হবেঅথচ, ইয়াযিদের ঐ বাহিনী ছিল সাধারণ মুসলমানদের, বিশেষ করে ইরাকী জনগণেরই সর্মথনপুষ্টকেননা, সে যুগের সাধারণ মুসলমানদের বেশীর ভাগই গণদূর্নীতি, সিদ্ধান্ত গ্রহণে দূর্বলতা এবং চিন্তা ও চেতনাগত অধঃপতনে নিমজ্জিত ছিল

 শুধুমাত্র সে যুগের অল্প ক’জন গণ্যমান্য ব্যক্তি হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর শুভাকাংখী হিসাবে ইরাক অভিমুখে যাত্রার ব্যাপারে তাকে বিরত রাখার চেষ্টা করেনতারা ইমাম হুসাইন (আ.)-এর ঐ যাত্রা ও আন্দোলনের বিপজ্জনক পরিণতির কথা তাকে স্মরণ করিয়ে দেনকিন্তু তাদের প্রতিবাদের উত্তরে ইমাম হুসাইন (আ.) বলেন, আমি কোন অবস্থাতেই ইয়াযিদের বশ্যতা শিকার করব নাঅত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীকে আমি কোন ক্রমেই সমর্থন করব নাআমি যেখানেই যাই না কেন, অথবা যেখানেই থাকি না কেন, তারা আমাকে হত্যা করবেইআমি এ মূহুর্তে মক্কা নগরী এ কারণেই ত্যাগ করছি যে, রক্তপাত ঘটার মাধ্যমে আল্লাহ ঘরের পবিত্রতা যেন ক্ষুন্ন না হয়[6]

অতঃপর ইমাম হুসাইন (আ.) ইরাকের কুফা শহরের অভিমুখে রওনা হনকুফা শহরে পৌঁছাতে তখনও বেশ ক’দিনের পথ বাকী ছিলএমন সময় পথিমধ্যে তাঁর কাছে খবর পৌঁছাল যে, ইয়াযিদের পক্ষ থেকে নিযুক্ত কুফার প্রশাসক ইমাম হুসাইন (আ.)-এর প্রেরিত বিশেষ প্রতিনিধিকে হত্যা করেছেএকই সাথে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জনৈক জোরালো সর্মথক এবং কুফা শহরের একজন বিখ্যাত ব্যক্তিকেও হত্যা করা হয়েছেএমনকি হত্যার পর তাদের পায়ে রশি বেঁধে কুফা শহরের সকল বাজার এবং অলি গলিতে টেনে হিছড়ে বেড়ানো হয়েছে[7] এছাড়াও সমগ্র কুফা শহর ও তার পার্শ্বস্থ এলাকায় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছেঅসংখ্য শত্রু সৈন্য ইমাম হুসাইন (আ.)-এর আগমনের প্রতিক্ষায় দিন কাটাচ্ছেসুতরাং শত্রু হস্তে নিহত হওয়া ছাড়া ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জন্যে আর কোন পথই বাকী রইল নাতখন সবকিছু জানার পর ইমাম সুদৃঢ় ও দ্বিধাহীনভাবে শাহাদত বরণের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং কুফার পথে যাত্রা অব্যাহত রাখলেন[8]

কুফা পৌঁছার প্রায় ৭০ কিঃ মিঃ পূর্বে কারবালা নামক মরুভুমিতে ইমাম পৌঁছলেনতখনই ইয়াযিদের সেনাবাহিনী ইমাম হুসাইন (আ.)-কে ঐ মরু প্রান্তরে ঘেরাও করে ফেললোইয়াযিদ বাহিনী আটদিন পর্যন্ত ইমাম হুসাইন (আ.) ও তার সহচরদের সেখানে ঘেরাও করে রাখলপ্রতিদিনই তাদের ঘেরাওকৃত বৃত্তের পরিসীমা সংকীর্ণ হতে থাকেআর শত্রু সৈন্য ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে লাগলঅবশেষে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) তাঁর স্বীয় পরিবারবর্গ ও অতি নগণ্য সংখ্যক সহচরসহ তিরিশ হাজার যুদ্ধাংদেহী সেনাবাহিনীর মাঝে ঘেরাও হলেন[9]  হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) আটকাবস্থায় ঐ দিনগুলোতে স্বীয় অবস্থান সুদৃঢ় করার কাজে আত্মনিয়োগ করেননিজের সহচরদের মধ্যে শুদ্ধিঅভিযান চালানরাতের বেলা তাঁর সকল সঙ্গীদেরকে বৈঠকে সমবেত করেনঐ বৈঠকে সমবেতদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত সংক্ষিপ্ত ভাষণে তিনি বলেনঃ মৃত্যু ও শাহাদত বরণ ছাড়া আমাদের সামনে আর কোন পথ নেইআমি ছাড়া আর অন্য কারো সাথেই এদের (ইয়াযিদ বাহিনী) কোন কাজ নেইআমি তোমাদের কাছ থেকে গৃহীত আমার প্রতি বাইয়াত (আনুগত্যের শপথ) এ মূহুর্ত থেকে বাতিল বলে ঘোষণা করছিতোমাদের যে কেউই ইচ্ছে করলে রাতের এ আঁধারে এ স্থান ত্যাগ করার মাধ্যমে এই ভয়ংকার মৃত্যুকূপ থেকে নিজেকে মুক্তি দিতে পারেইমামের ঐ বক্তৃতার পর শিবিরের বাতি নিভিয়ে দেয়া হলতখন পার্থিব উদ্দেশ্যে আগত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর অধিকাংশ সঙ্গীরাই রাতের আধাঁরে ইমামের শিবির ছেড়ে পালিয়ে গেলযার ফলে হাতে গোনা ইমামের অল্পকিছু অনুরাগী এবং বনি হাশেম গোত্রের অল্প ক’জন ছাড়া ইমামের আর কোন সঙ্গী বাকী রইল নাইমামের ঐসব অবশিষ্ট সঙ্গীদের সংখ্যা ছিল প্রায় ৪০ জনঅতঃপর ইমাম হুসাইন (আ.) পুনরায় তাঁর অবশিষ্ট সঙ্গীদেরকে পরীক্ষা করার জন্যে সমবেত করেনসমবেত সঙ্গী ও হাশেমীয় গোত্রের আত্মীয় স্বজনদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) বলেনঃ আমি ছাড়া তোমাদের কারো সাথে এদের কোন কাজ নেইতোমাদের যে কেউ ইচ্ছে করলে রাতের আধাঁরে আশ্রয় গ্রহণের (পালিয়ে যাওয়া) মাধ্যমে নিজেকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পার

কিন্তু এবার ইমামের অনুরাগী ভক্তরা একে একে সবাই দৃঢ় কন্ঠে জবাব দিলতারা বললো, “আমরা অবশ্যই সে সত্যের পথ থেকে বিমুখ হব না, যে পথের নেতা আপনিআমরা কখনোই আপনার পবিত্র সাহচর্য ত্যাগ করবো নাআমাদের হাতে যদি তলোয়ার থাকে, তাহলে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ পর্যন্ত আপনার স্বার্থ রক্ষার্থে যুদ্ধ করে যাব[10]

ইমাম (আ.)-কে প্রদত্ত অবকাশের শেষ দিন ছিল মহররম মাসের ৯ তারিখআজ ইমাম হুসাইন (আ.) কে ইয়াযিদের বশ্যতা স্বীকারের (বাইয়াত) ঘোষণা প্রদান করতে হবে অথবা ইয়াযিদ বাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতে হবেশত্রু বাহিনীর পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে ইমামের জবাব চেয়ে পাঠানো হলপ্রত্যুত্তরে ইমাম (আ.) ঐ রাতে (৯ই মহরমের দিবাগত রাত) সময় টুকু শেষ বারের মত ইবাদত করার জন্যে অবসর প্রদানের আবেদন করলেনআর পর দিন ইয়াযিদ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবর্তীণ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন[11]

হিজরী ৬১ সনের ১০ই মহররম আশুরার দিন, ইমাম হুসাইন (আ.)-এর বাহিনীর সদশ্য সংখ্যা ৯০ জনের চেয়েও কমযাদের মধ্যে ৪০ জনই ইমামের পুরানো সঙ্গীআর আনুমানিক ৩০ জনেরও কিছু বেশী সৈন্য এক’দিনে (১লা মহররম থেকে ১০ই মহররম পর্যন্ত) ইয়াযিদের বাহিনী ত্যাগ করে ইমাম হুসাইন (আ.)-এর বাহিনীতে যোগদান করেছেনআর অবশিষ্টরা ইমামের হাশেমী বংশীয় আত্মীয় স্বজন, ইমামের ভাই বোনেরা ও তাদের সন্তানগণ, চাচাদের সন্তানগণ এবং তাঁর নিজের পরিবারবর্গইয়াযিদের বিশাল বাহিনীর মোকাবিলায় ইমাম হুসাইন (আ.) তাঁর ঐ অতি নগন্য সংখ্যক সদস্যের ক্ষুদ্র বাহিনীকে যুদ্ধের জন্যে বিন্যস্ত করলেনঅতঃপর যুদ্ধ শুরু হলসেদিন আশুরার সকাল থেকে শুরু করে সারাদিন যুদ্ধ চললোইমামের হাশেমী বংশীয় সকল যুবকই একের পর এক শাহাদত বরণ করলেনইমামের অন্যান্য সাথীরা একের পর এক সবাই শহীদ হয়ে গেলেনঐ সকল শাহাদত প্রাপ্তদের মাঝে ইমাম হাসান (আ.)-এর দু’জন কিশোর পুত্র এবং স্বীয় ইমাম হুসাইন (আ.)-এর একজন নাবালক পুত্র ও একটি দুগ্ধ পোষ্য শিশু ছিলেন[12]  যুদ্ধ শেষে ইয়াযিদ বাহিনী ইমাম হুসাইন (আ.)-এর পরিবারের মহিলাদের শিবির লুটপাট করার পর তাঁদের তাবুগুলোতে অগ্নি সংযোগ করে তা জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয়তারা ইমামের বাহিনীর শহীদদের মাথা কেটে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেশহীদদের লাশগুলোকে তারা বিবস্ত্র করেদাফন না করেই তারা লাশগুলোকে বিবস্ত্র অবস্থায় মাটিতে ফেলে রাখেএরপর ইয়াযিদ বাহিনী শহীদদের কর্তিত মস্তকসহ ইমাম পরিবারের বন্দী অসহায় নারী ও কন্যাদের সাথে নিয়ে কুফা শহরের দিকে রওনা হলঐসব বন্দীদের মাঝে ইমাম পরিবারের পুরুষ সদস্যের সংখ্যা ছিল মাত্র অল্প ক’জনএদের একজন ছিলেন চরমভাবে অসুস্থ তিনি হলেন, হযরত ইমাম হুসাইনের ২২ বছর বয়স্ক পুত্র হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.)ইনিই সেই চর্তুথ ইমামঅন্য একজন ছিলেন ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.)-এর ৪ বছর বয়স্ক পুত্র মুহাম্মদ বিন আলীইনিই হলেন পঞ্চম ইমাম হযরত বাকের (আ.)আর তৃতীয় জন হলেন, হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জামাতা এবং হযরত ইমাম হাসান (আ.)-এর পুত্র হযরত হাসান মুসান্না (রহঃ)তিনি চরমভাবে আহত অবস্থায় শহীদের লাশের মাঝে পড়ে ছিলেনতখনও তাঁর শ্বাসক্রিয়া চলছিলশহীদদের মাথা কাটার সময় ইয়াযিদ বাহিনীর জনৈক সেনাপতির নির্দেশে তাঁর মাথা আর কাটা হয়নিঅতঃপর তাঁকেও সেখান থেকে উঠিয়ে নিয়ে বন্দীদের সাথে কুফার দিকে নিয়ে যাওয়া হলতারপর কুফা থেকে সকল বন্দীকে দামেস্কে ইয়াযিদের দরবারে নিয়ে যাওয়া হয়

ইমাম পরিবারের নারী ও কন্যাদেরকে বন্দী অবস্থায় এক শহর থেকে অন্য শহরে ঘুরিয়ে বেড়ানো হয়পথিমধ্যে আমিরুল মুমিনীন ইমাম আলী (আ.)-এর কন্যা হযরত জয়নাব (আ.) ও ইমাম জয়নুল আবেদীন (আ.) জনগণের উদ্দেশ্যে কারবালার ঐ মর্মান্তিক ঘটনার ভয়াবহ বর্ণনা সম্বলিত মর্মস্পর্শী বক্তব্য রাখেন

কুফা ও দামেস্কে তাঁদের প্রদত্ত ঐ হৃদয়বিদারক গণভাষণ উমাইয়াদেরকে জনসমক্ষে যথেষ্ট অপদস্থ করেযার ফলে মুয়াবিয়ার বহু বছরের অপপ্রচারের পাহাড় মূহুর্তেই ধুলিস্যা হয়ে যায়এমনকি শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়ালো যে, ইয়াযিদ তার অধীনস্থদের এহেন ন্যক্কারজনক কার্যকলাপের জন্যে বাহ্যিকভাবে জনসমক্ষে অসন্তুষ্টি প্রকাশে বাধ্য হয়েছিলকারবালার ঐ ঐতিহাসিক মর্মান্তিক ঘটনা এতই শক্তিশালী ছিল যে, অদূর ভবিষ্যতে তারই প্রভাবে উমাইয়া গোষ্ঠী তাদের শাসনক্ষমতা থেকে চিরতরে উখাত হয়ে যায়ঐতিহাসিক কারবালার ঘটনাই শীয়া সমপ্রদায়ের মূলকে অধিকতর শক্তিশালীভাবে প্রতিষ্ঠিত করেশুধু তাই নয়, কারবালার ঐ ঘটনাকে কেন্দ্র করে একের পর এক বিদ্রোহ, বিপব এবং ছোট বড় অনেক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ও সংঘাত ঘটতে থাকেএ অবস্থা প্রায় বার বছর যাব অব্যাহত ছিলশেষ পর্যন্ত ইমাম হুসাইন (আ.)-কে হত্যা করার সাথে জড়িত একটি ব্যক্তিও জনগণের প্রতিশোধের হাত থেকে প্রাণ নিয়ে পালাতে সক্ষম হয়নি

হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর জীবন ইতিহাস, ইয়াযিদ এবং তকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে যার সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জ্ঞান রয়েছে, তিনি নিঃসন্দেহে জানেন যে, সে দিন হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)-এর সামনে শুধুমাত্র একটা পথই খোলা ছিলআর তা ছিল শাহাদত বরণকেননা, ইয়াযিদের কাছে বাইয়াত প্রদান, প্রকাশ্যভাবে ইসলামকে পদদলিত করারই নামান্তরতাই ঐ কাজটি ইমামের জন্যে আদৌ সম্ভব ছিল নাকারণ, ইয়াযিদ যে শুধুমাত্র ইসলামী আর্দশ ও ইসলামী আইন কানুনকে সম্মান করত না, তাই নয়; বরং সে ছিল উচ্ছৃংখল চরিত্রের অধিকারীএমনকি ইসলামের পবিত্র বিষয়গুলো এবং ইসলামী বিধানকে প্রকাশ্যে পদদলিত করার মত স্পর্ধাও সে প্রদর্শন করতঅথচ, ইয়াযিদের পূর্ব পুরুষরা ইসলামের বিরোধী থাকলেও তারা ইসলামী পরিচ্ছদের অন্তরালে ইসলামের বিরোধীতা করতকিন্তু প্রকাশ্যভাবে তারা ইসলামকে সম্মান করততারা প্রকাশ্যে মহানবী (সা.)-কে সহযোগিতা করত এবং ইসলামের গণ্যমান্য ও উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের সম্পর্কে বাহ্যত গর্ববোধ করতকারবালার ইতিহাসের অনেক বিশ্লেষকই বলে থাকেন যে, ঐ দুই ইমামের [ইমাম হাসান (আ.) ও ইমাম হুসাইন (আ.)] মতাদর্শ ছিল দু’ধরণের যেমনঃ ইমাম হাসান (আ.) প্রায় ৪০ হাজার সেনাবাহিনীর অধিকারী হয়েও মুয়াবিয়ার সাথে সন্ধি করেনআর ইমাম হুসাইন (আ.) মাত্র ৪০ জন অনুসারী নিয়েই ইয়াযিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবর্তীণ হনকিন্তু ইতোপূর্বের আলোচনা থেকে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, এ ধরণের মন্তব্য সম্পূর্ণ ভিত্তিহীনকারণ, ইমাম হুসাইন (আ.), যিনি মাত্র একটি দিনের জন্যেও ইয়াযিদের বশ্যতা স্বীকার করেননি, সেই তিনিই ইমাম হাসান (আ.)-এর পরপর র্দীঘ দশ বছর যাব মুয়াবিয়ার শাসনাধীনে সন্ধিকালীন জীবন যাপন করেনঐ সময় তিনি প্রকাশ্যে প্রশাসনের বিরুদ্ধে কোন বিদ্রোহ করেননিপ্রকৃতপক্ষে, ইমাম হাসান (আ.) এবং ইমাম হুসাইন (আ.) যদি সেদিন মুয়াবিয়ার সংগে যুদ্ধে অবর্তীণ হতেন, তাহলে অবশ্যই তাঁরা নিহত হতেনআর এর ফলে ইসলামের এক বিন্দু মাত্র উপকারও হত নাকেননা, মুয়াবিয়ার কপটতাপূর্ণ রাজনীতির কারণে, বাহ্যত তাকেই সত্য পথের অনুসারী বলে মনে হতএছাড়া মুয়াবিয়া নিজেকে রাসুল (সা.)-এর সাহাবী, ওহী’ লেখক এবং মু’মিনদের মামা (মুয়াবিয়ার জনৈকা বোন রাসুলের স্ত্রী ছিলেন) হিসেবে জনসমক্ষে প্রচার করে বেড়াতআপন স্বার্থ উদ্ধারের প্রয়োজনে এমন কোন চক্রান্ত নেই যা সে অবলম্বন করেনিএমতাবস্থায় মুয়াবিয়ার এহেন প্রতারণামূলক রাজনীতির মোকাবিলায় ইমাম হাসান (আ.) বা ইমাম হুসাইন (আ.)-এর কোন কর্মসূচীই ফলপ্রসু হত না

মুয়াবিয়া এতই চতুর ছিল যে, সে অতি সহজেই লোক লাগিয়ে ইমামদের হত্যা করতআর সে নিজেই নিহত ইমামদের জন্যে প্রকাশ্যে শোক অনুষ্ঠানের নেতৃত্ব দিতকেননা, একই কর্মসূচী সে তৃতীয় খলিফার ক্ষেত্রেও বাস্তবায়িত করেছিল


[1]| ÔwKZveyj Bikv`Õ (†kBL gywd`) 182 bs c„ôv| ÔZvixLy BqvKyexÕ 2q LÛ, 226- 228 bs c„ôv| Ôdzmyjyj gywn¤§vn&Õ 153 bs c„ôv|

[2]| ÔgvbvwKey Be‡b kvn‡i AvïeÕ 4_© LÛ, 88 bs c„ôv|

[3]| ÔgvbvwKey Be‡b kvn‡i AvïeÕ 4_© LÛ, 88 bs c„ôv| ÔwKZveyj Bikv`Õ (†kBL gywd`) 182 bs c„ôv| ÔAvj Bgvgvn& Iqvm& wmqvmvn&Õ 1g LÛ, 203 bs c„ôv| ÔZvixLy BqvKyexÕ 2q LÛ, 229 bs c„ôv| Ôdzmyjyj gywn¤§vn&Õ 153 bs c„ôv| ÔZvhwKivZzj LvIqvm&Õ 235 bs c„ôv|

[4]| ÔwKZveyj Bikv`Õ (†kBL gywd`) 201 bs c„ôv|

[5]| ÔgvbvwKey Be‡b kvn‡i AvïeÕ 4_© LÛ, 89 bs c„ôv|

[6]| ÔwKZveyj Bikv`Õ (†kBL gywd`) 201 bs c„ôv| Ôdzmyjyj gywn¤§vn&Õ 168 bs c„ôv|

[7]| ÔwKZveyj Bikv`Õ (†kBL gywd`) 204 bs c„ôv| Ôdzmyjyj gywn¤§vn&Õ 170 bs c„ôv| ÔgvKvwZjyZ& ZvwjwebÕ 2q ms¯‹iY, 73 bs c„ôv|

[8]| ÔwKZveyj Bikv`Õ (†kBL gywd`) 205 bs c„ôv| Ôdzmyjyj gywn¤§vn&Õ 171 bs c„ôv| ÔgvKvwZjyZ& ZvwjwebÕ 2q ms¯‹iY, 73 bs c„ôv|

[9]| ÔgvbvwKey Be‡b kvn‡i AvïeÕ 4_© LÛ, 89 bs c„ôv|

[10]| ÔgvbvwKey Be‡b kvn‡i AvïeÕ 4_© LÛ, 99 bs c„ôv| ÔwKZveyj Bikv`Õ (†kBL gywd`) 214 bs c„ôv|

[11]| ÔgvbvwKey Be‡b kvn‡i AvïeÕ 4_© LÛ, 89 bs c„ôv| ÔwKZveyj Bikv`Õ (†kBL gywd`) 214 bs c„ôv|

[12]| Ôwenviƒj Av‡bvqviÕ 10g LÛ, 200, 202 I 203 bs c„ôv `ªóe¨|

Leave A Reply

Your email address will not be published.