অসাধারণ মানুষ

0 654

 

হিজরী রজব মাসের ১৩ তারিখ একটি ঐতিহাসিক দিন,আনন্দঘন দিন,খুশির দিন। কেননা এই দিন পৃথিবীর বুকে জন্ম নিয়েছিলেন ন্যায়-নীতি,সততা, মানবিকতা,আধ্যাত্মিকতার মূর্ত প্রতীক হযরত আলী ইবনে আবু তালিব (আ)।

 

১৩ ই রজব , দিনটি ছিল শুক্রবার। নবী করিম (সাঃ) নবুয়্যত লাভ করার ১০ বছর আগে ফাতেমা বিনতে আসাদ কাবা ঘরের পাশে এলেন। আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করলেন। ফাতেমা বিনতে আসাদ ছিলেন তৌহিদে বিশ্বাসী, হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর নীতির অনুসারী ছিলেন তিনি। যাই হোক তিনি আস্তে আস্তে কাবাঘর প্রদক্ষিণ করছিলেন। গভীর আন্তরিকতার সাথে ফিসফিস করে তিনি আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করছিলেন। তাঁর মোনাজাতের মাঝেই প্রসব বেদনা অনুভব করলেন। লোকজনের ভিড়ে তিনি নিরাপদ একটি আশ্রয়স্থল খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন না আল্লাহ তাঁর জন্যে এবং তাঁর সন্তানের জন্যে কী সৌভাগ্যটাই না রেখেছেন।

 

তিনি কাবা প্রদক্ষিণ করতে লাগলেন আর মনে মনে নিরাপদ স্থান কামনা করছিলেন। বেহেশতের নির্মল বাতাস যেন কাবাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিলো। এমন সময় আল্লাহর ঘর কাবার দেয়াল এই মহিয়সী নারীর জন্যে ফেটে গেল। জনগণের বিস্ময়ের মাঝে তিনি কাবার ভেতরে গেলেন। আল্লাহর ঘরের ভেতর আল্লাহর আশ্রয়েই তিনি মা হলেন। হযরত আলী (আঃ) এভাবেই মক্কার মতো পবিত্র শহরে,আল্লাহর ঘর কাবার মতো পবিত্র ঘরে, জুমার মতো একটি পবিত্র দিনে পৃথিবীতে এলেন। জন্মলগ্ন থেকেই হযরত আলী (আঃ) এর মর্যাদা ও স্থান আল্লাহ অনেক উর্ধ্বে স্থাপন করেছেন।

তিনিই সত্য , স্বয়ং সত্য যাঁর নিত্য সহগামী
পৃথিবীর পবিত্রতম গৃহে জন্ম নিয়ে যিনি অনন্য
যাঁর জ্ঞানের দরোজা পেরিয়ে যেতে হয় নগরে
রাসূলের জ্ঞান-ধ্যানের পবিত্র আলোয় ধন্য
যে নগর জাহেলি পৃথিবীকে দিয়েছে আলোর দিশা
শ্বাশ্বত যে আলোয় কেটে গেছে কালের অমানিশা।

হযরত আলী (আঃ) ছিলেন রাসূলে খোদার চাচাতো ভাই। সেই ছোট বেলা থেকেই হযরত আলী (আঃ) নবুয়্যত লাভের আগে রাসূলের (সাঃ) ঘনিষ্ট সাহচর্য লাভ করার মতো সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। হযরত আলী (আঃ) কখনোই তৎকালীন সমাজে প্রচলিত সামাজিক ভুল আচার-অনুষ্ঠান বা রীতিনীতির প্রভাবে কলুষিত হন নি। ইতিহাসবিদগণ লিখেছেন হযরত আলী (আঃ) কখনো মূর্তিপূজা করেন নি কিংবা তাদেরকে সেজদাহ করেন নি। সেই শৈশব থেকেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে,মানব জীবনের জটিল ও কঠিন রহস্যাবলী প্রাণহীন মূর্তির কাছে বর্ণনা করার কোনো মানে হয় না। তিনি আল্লাহর কিতাব ভালোভাবে যাচাই-বাছাই করে তৌহিদের মর্ম উপলব্ধি করার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন।

যখন হযরত আলী (আঃ) নবীজীর মাঝে আল্লাহর নূরের অস্তিত্ব টের পেলেন এবং নবুয়্যতের তাজাল্লি মুহাম্মাদ (সাঃ) এর আচার-ব্যবহারে দেখতে পেলেন, তখন থেকে নবীজীর প্রতি আলী (আঃ) এর আগ্রহ এবং আকর্ষণ আরো বেড়ে গেল। তিনি মাত্র ১০ বছর বয়সেই সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর ওপর ঈমান আনার মতো সৌভাগ্য অর্জন করেন। আরেকটি কথা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন তা হলো,হযরত আলী (আঃ) ই হলেন রাসূলের ওপর ঈমান আনয়নকারী সর্বপ্রথম মুসলমান। সত্য এবং বাস্তবতার গভীর উপলব্ধি থেকে যেই প্রেম এবং ভালোবাসা তিনি অনুভব করতেন,সেই ভালোবাসার ভিত্তি থেকেই তিনি ঈমান এনেছিলেন। অর্থাৎ জেনে, বুঝে, দেখে এবং উপলব্ধি করে ভালোবেসেই তিনি রাসূলের ওপর ঈমান এনেছিলেন। সে কারণেই তিনি জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ইসলামের ওপর সুস্থির এবং অনড় ও অবিচল ছিলেন। কোনোরকম ঘটনা-দুর্ঘটনাই তাঁকে বিন্দুমাত্র বিচলিত করতে পারে নি। নাহজুল বালাগার ৩৭ নম্বর খোৎবায় তিনি আত্মপরিচয় সম্পর্কে বলেন : “যখন সবাই লুকিয়ে ছিলো, আমি সদর্পে ময়দানে এগিয়ে এসেছি। যখন সবাই চুপ করে ছিলো, আমি তখন মুখ খুলেছি। সবাই যখন থমকে গিয়েছিলো,আমি তখন আল্লাহর নূরের পথ-নির্দেশনায় যাত্রা শুরু করেছিলাম। কথাবার্তা বলার সময় আমার কণ্ঠ ছিলো অন্যদের তুলনায় স্বল্পপ্রাণ এবং সংযত। কিন্তু রনাঙ্গনে বা কর্মক্ষেত্রে ছিলাম সর্বাগ্রে। যখন আমি দায়িত্বভার গ্রহণ করলাম তখন এমন পাহাড়ের মতো অটল থেকেছি যেই পাহাড় কঠিন ঝড়-তুফানেও অনড় থাকে।

হযরত আলী ( আ ) ছিলেন সবসময়ই জনপ্রিয়। তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যই তাঁকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। খেলাফতের দায়িত্বভার গ্রহণ করার প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সত্য ও ন্যায়নীতি বাস্তবায়ন এবং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজে একনিষ্ঠ ছিলেন। এই ন্যায়নীতি কায়েমের স্বার্থেই তিনি দায়িত্বভার কাঁধে তুলে নিতে রাজি হয়েছিলেন,তা নাহলে ক্ষমতা বা শাসনভার তাঁর কাছে পুরোণো জুতোর মতোই মূল্যহীন ছিল।

খাওয়ারেযমি লিখেছেন, নবী করিম ( সা ) বলেছেন, আমার পরে আমার উম্মতের মধ্যে সবচে বড়ো জ্ঞানী হলেন আলী ইবনে আবি তালিব। জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ আনসারীও বর্ণনা করেন, “একদিন নবীজী উচ্চস্বরে বললেন, আমি হলাম জ্ঞান ও বিজ্ঞানের শহর আর আলী হলেন সেই শহরের দরোজা। তাই যে-ই জ্ঞন অর্জন করতে ইচ্ছুক সে যেন এই শহরের দরোজার কাছে যায়।”
আসলেই, হযরত আলী (আঃ) যে জ্ঞানী ছিলেন তাঁর নাহজুল বালাগা-ই তার প্রমাণ। ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনের বিচিত্র সমস্যার নৈয়ায়িক সমাধান যারা চায়, সেইসব ন্যায়-নীতিবান মানুষদের জন্যে নাহজুল বালাগাহ একটি চমৎকার গাইড লাইন।

ইমাম আলী (আঃ) এর অপর বৈশিষ্ট্যটি হলো বিস্ময়কর ইবাদাত বন্দেগী। রাসূলে খোদা (সাঃ) এর পর হযরত আলী (আঃ) উম্মাতে মুহাম্মাদির মধ্যে সবচে বেশি ইবাদাতকারী ব্যক্তি। নামায পড়ার সময় তাঁর একাগ্রতার কথাটি সর্বজনবিদিত। যুদ্ধে তাঁর পায়ে যে তীর বিদ্ধ হয়েছিল, নামাযে দাঁড়ানোর পরই সেই তীর তাঁর পা থেকে খোলা হয়েছিল। নামাযে তিনি কতোটা মনোনিবিষ্ট হলে তীর খোলার ব্যাপারটি টের পান নি-একবার ভেবে দেখুন। আমাদেরকে এই একাগ্রতা থেকে শিক্ষা নিতে হবে।

নামাযের প্রতি তাঁর আকর্ষণ সম্পর্কে আরেকটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে। কোনো এক যুদ্ধে শত্র”পক্ষ অর্থাৎ কাফেররা তীর ছুঁড়ছিল। সেই তীর হযরত আলী ( আ ) এর এপাশ-ওপাশ দিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু তিনি নামাযে দাঁড়ালেন এবং বললেন, ” আমরা কাফেরদের সাথে কেবল নামায এবং আল্লাহর ইবাদাতের জন্যেই যুদ্ধ করি।” আলী (আঃ) এর নাম শুনলেই কাফেররা থরথর করে কাঁপতো। অথচ এই আলী (আঃ) ই কোনো এতিম শিশুর কান্না দেখে নিজেও কষ্টকাতর হয়ে পড়তেন।

কোনো এক যুদ্ধে শত্র”রা আলী (আঃ) এর সেনাদের জন্যে পানি সরবরাহ বন্ধ করে দিলো। এর কিছুক্ষণ পর শত্র”পক্ষ পিছু হটতে বাধ্য হলো। ফলে পানির নিয়ন্ত্রণ আলী (আঃ) এর সেনাদের হাতে এসে গেল। ইমামের সঙ্গীরা তখন শত্র”দের মতোই পানি সরবরাহ তাদের জন্যে বন্ধ করে দিতে চাইলো। কিন্তু আলী (আঃ) একাজ থেকে তাঁর সেনাদের বিরত রাখলেন এবং বললেন, আমি কখনোই এভাবে বিজয় লাভ করতে চাই না। কেননা এই বিজয়ের মধ্যে মুসলমানিত্বের কোনো চিহ্ন নেই।”

হযরত আলী ( আ ) ছিলেন সুন্দর বাচনভঙ্গির অধিকারী। তাঁর বক্তব্যও ছিল ভীষণরকম অর্থপূর্ণ। আমরা তাঁর দুটি বাণী উল্লেখ করে আজকের এ আয়োজন শেষ করবো। তিনি বলেছেন, “মন মাঝে মাঝে দুঃখ ভারাক্রান্ত হয় এবং শরীরের মতোই ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে পড়ে। মনের এই শ্রান্তি দূর করার জন্যে জ্ঞান ও বিজ্ঞানময় সুন্দর সুন্দর কথা খুঁজে বেড়াও।”

তিনি অন্যত্র বলেছেন-“আল্লাহ যেসব নিয়ামত তোমাকে দিয়েছেন, সেগুলোকে গুনাহের কাজে ব্যবহার করো না”

Leave A Reply

Your email address will not be published.