ঐশী আতিথ্যের মাস-রমজান

0 437
ঐশী আতিথ্যের মাস-রমজান
১ম পর্ব
ফামান শাহিদা মিনকুমুশ্‌ শাহরা ফাল্‌ইয়াসুমহু
” কাজেই তোমাদের মাঝে যে মাসটি পাবে, সে যেন রোযা রাখে।”

সূরা বাকারার ১৮৫ নম্বর আয়াত এটি। এই একটি মাত্র আয়াত থেকেই প্রমাণিত হয় যে, সাওম বা রোযা সবার জন্যেই অবশ্য পালনীয় একটি ইসলামী বিধান। ইসলামের মৌলিক পাঁচটি বিধানের একটি হলো রোযা। তবে এই বিধানটি কেবল আমাদের জন্যেই নয় বরং আমাদের পূর্ববর্তী নবী রাসূলগণের উম্মাতদের জন্যেও অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হিসেবে বিধিবদ্ধ করা হয়েছিল। যেমনটি কোরআনেই বলা হয়েছে, ‘কামা কুতিবা আলাল লাজিনা মিন ক্বাবলিকুম’ অর্থাৎ ‘যেমনটি তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপরও সিয়ামকে ফরয করা হয়েছিল।’
অশোধিত তেলকে যেমন পরিশোধন করেই জ্বালাতে হয়, ব্যবহার করতে হয়, তেমনি মানুষের মন ও আত্মাকেও যথার্থভাবে কাজে লাগানো বা ব্যবহার করার জন্যে বছরে একবার তাকে পরিশোধন করে নিতে হয়। নইলে অশোধিত তেলের মতো ময়লাযুক্ত আত্মা কিংবা মনে খোদায়ী নূর জ্বলবে না। পবিত্র রমযান মাস হলো অন্তরাত্মাকে পরিশোধন করার শ্রেষ্ঠ সময়। ব্যক্তিগত বিচিত্র ভুলের কারণে শয়তানীর যতো আচ্ছাদন পড়েছে মানুষের অন্তরের আয়নায়, যতো মরিচা ধরেছে তাতে অন্যায় আচরণ আর অনৈতিকতার চর্চার কারণে, সেগুলোকে ধুয়ে মুছে পূত-পবিত্র করে মনের ঘরে আধ্যাত্মিকতার প্রদীপ জ্বালানোর সর্বোত্তম সময় রমযান। পবিত্র কোরআনের সূরা যুমারে আল্লাহ বলে দিয়েছেন, ‘ইন্নামা ইউয়াফফাস সাবিরুনা আজরাহুম বিগাইরি হিসাব’ অর্থাৎ যারা প্রবৃত্তির রিপুগুলোকে দমন করে সঠিক পথে অটল থাকবে, তাদেরকে অগণিত সওয়াব প্রদান করা হবে। আর রমযান মাসটিই হলো তার অনুশীলনের শ্রেষ্ঠ ও যথার্থ সময়।

এই মাসটি যেন রোযাদারের জন্যে মেহমানীর মাস। রোযাদার হলেন আল্লাহর মেহমান আর মেহমানের সামনে যে দস্তরখান আল্লাহ বিছিয়ে দিয়েছেন তাতে রয়েছে রহমত, তাতে রয়েছে বরকত এবং তাতে রয়েছে মাগফেরাতের বিচিত্র ভোজের রেসিপি। এখন যারা এইসব ঐশী ভোজে নিজেকে তৃপ্ত-পরিতৃপ্ত করতে চান তারা কোনোরকম কার্পণ্য না করে, কোনোরকম অবহেলা কিংবা কালক্ষেপন না করে নিজেকে সমৃদ্ধ করবেন-এটাই স্বাভাবিক। ইবাদাত আর আধ্যাত্মিকতার সুগন্ধি দিয়ে নিজেদের অন্তরাত্মাকে মৌ মৌ করে তুলবেন-সেই সুবর্ণ সময় এসেছে আজ। মৌলাভি যেমনটি বলেছেন,

সত্যের সুগন্ধি শীতল সমীর
এ সময় নিয়ে আসে ঐশী পাঠ
অপূর্ব এ উপহার থেকে সন্তর্পনে
যতো পারো করে যাও লুটপাট।

রহমতের সমীরণ এসে আবার চলে যায়
যাকে ইচ্ছে তাকে সে প্রাণবায়ু দিয়ে যায়

আবার এসেছে আজ সেই মাহেন্দ্রক্ষণ
প্রস্তুতি নাও হে গোলাম, করো অবগাহন।

হিজরী পঞ্জিকার বারোটি মাসের মধ্যে একটি মাসের নাম হলো রমযান। অথচ মজার ব্যাপার হলো পবিত্র কোরআনে কেবলমাত্র এই রমযান মাসেরই নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকেই বিশ্লেষকমহল মনে করছেন যে, আল্লাহর কাছে এ মাসটির অসামান্য মর্যাদা রয়েছে। যেমনটি আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজেই বলেছেন, ‘আস সাওমু লি, অ-আনা আজযি বিহী’ অর্থাৎ ‘রোযা আমার জন্যে রাখা হয এবং আমিই তার প্রতিদান দেবো।’ পরকালে যে তিনি কী পুরস্কার দেবেন তার কিছুটা ইঙ্গিত নবী কারিম (সাঃ) আমাদের দিয়েছেন। সে থেকে রোযাদারগণ নিশ্চয়ই পরিতৃপ্ত হবার আনন্দ পাবেন। রাসূলে খোদা বলেছেন, ‘রমযান এমন একটি মাস যে মাসে আল্লাহ তোমাদের জন্যে রোযা রাখাকে ফরজ করে দিয়েছে। অতএব যে ব্যক্তি ঈমান সহকারে আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় রোযা রাখবে, তার জন্যে রোযার সেই দিনটি হবে এমন যেন সবেমাত্র সে মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নিয়েছে, অর্থাৎ রোযাদার তার সকল গুণাহ থেকে মুক্তি পেয়ে নিষ্পাপ শিশুটির মতো হয়ে যাবে।

আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর বান্দাদের প্রতি এ যে কতো বড়ো রহমত, কতো বড় বিশাল এক অনুগ্রহ তা বোঝানো সম্ভব নয়। কেবল অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করার বিষয় এটি। নবী কারিম (সাঃ) বলেছেন, যখনই রমযানের শুভাগমন ঘটে, তখনি আল্লাহর রহমতের দরোজাগুলো খুলে যায় আর জাহান্নামের দরোজাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। সেইসাথে শয়তানকে লোহার জিঞ্জীর বা শেকলে আবদ্ধ করা হয়। এই হাদিস থেকে যে বিষয়টি আমাদের উপলব্ধি করতে হবে তাহলো, রমযান ব্যতীত এগারোটি মাসেও আমরা আল্লাহর ইবাদাত-বন্দেগী করার চেষ্টা করে থাকি। কিন্তু শয়তানের প্ররোচনার কারণে অনেক সময় ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ইবাদাত করা হয়ে ওঠে না। এই মাসে যেহেতু শয়তানকে আটকে রাখা হয়, তাই তার মাধ্যমে প্ররোচিত হবার কোনো আশঙ্কা নেই ফলে যতো খুশি ইবাদাত করার সুযোগ রয়েছে এই মাসে। সুবর্ণ এই সুযোগকে আমরা যেন কোনোভাবেই কাজে লাগাতে ব্যর্থ না হই-সেদিকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে। কিন্তু কী কর্মসূচি থাকতে পারে এই মাসে, এবার সেই প্রসঙ্গে অলী-আওলিয়াদের সংক্ষিপ্ত দিক-নির্দেশনা তুলে ধরা যাক। আহলে বাইতের মহান ইমামগণ রমযানের দৈনন্দিন করণীয় সম্পর্কে চমৎকার দিক-নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। এমনকি কীভাবে আল্লাহর দরবারে ক্ষমা চাইতে হবে-তারও নির্দেশন রেখে গেছেন তাঁরা।

বেহেশত হলো আল্লাহর ইবাদাত বা আনুগত্যকারীদের পুরস্কার। রোযাও আল্লাহর দেয়া অবশ্য পালনীয় দায়িত্বগুলোরই একটি। রমযান মাসের এই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আরো কিছু ইবাদাত অন্তর্ভূক্ত রয়েছে। যেমন- কোরআন তেলাওয়াত করা, এহসান বা দয়াপরবশ হওয়া, দান-খয়রাত করা, তওবা এস্তেগফার করা এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কার লাভে যোগ্য সকল গঠনমূলক ইবাদাত এ মাসের অবশ্য করণীয় কিছু দায়িত্ব। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর সন্তুটিষ্ট অর্জন করার এবং নৈতিক চরিত্র গঠন করার সৌভাগ্য দিন। যেমনটি হযরত আলী (আঃ) বলেছেন, ‘ আল্লাহ আমাদের ওপর রোযা ফরজ করেছেন, নৈতিক চরিত্র গঠনে শিক্ষা দেয়ার জন্যে। সেই শিক্ষা যাতে আমরা পেতে পারি এবং তা কাজে লাগাতে পারি সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। #

২য় পর্ব

রমযান মাস হলো আল্লাহর রহমত ও দয়ার হিমেল বায়ুপ্রবাহের মাস। মানুষের মন এবং আত্মার ওপর দিয়ে বিশেষ করে যাঁরা আল্লাহর রহমতের কাঙ্গাল তাদেঁর দেহ-মন-আত্মার উপর দিয়েই রহমতের এ বায়ু প্রবাহিত হয়। এখন মানুষ কতোটা ধারণ করবে বা করতে চেষ্টা চালানো উচিত তা নির্ভর করছে বরকতপূর্ণ এই মাসের মর্যাদা কে কতটুকু উপলব্ধি করতে পেরেছে-তার ওপর। আল্লাহ আমাদেরকে এই মহান মাসটির মর্যাদা ও গুরুত্ব উপলব্ধি করার তৌফিক দিন-এই কামনায় শুরু করছি রহমতের অতিথির আজকের আয়োজন।

রাসুলে খোদার একটি হাদিস দিয়ে শুরু করবো আজকের আলোচনা। রাসূল ( সা ) বলেছেন,”তুমি যদি চাও তোমার বুকের ভেতরের অশান্তি কমে যাক তাহলে রমযানের রোযা এবং প্রতিমাসে তিনটি করে রোযা রাখো।”হযরত আলী ( আ ) ও বলেছেন,”প্রতিমাসে তিনটি রোযা এবং রমযান মাসের রোযা বুকের ভেতরকার জটিলতা এবং পেরেশানীগুলো দূর করে দেয়।” প্রতিমাসের রোযার দিনগুলোরও উল্লেখ করেছেন তিনি। দিনগুলো হলো মাসের প্রথম এবং শেষ বৃহস্পতিবার এবং মাসের মধ্যবর্তী বুধবার। দেহ এবং আত্মার ওপরে এই যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে-এটাও রোযার অন্যতম একটা ফযীলত,বড়ো ধরনের বৈশিষ্ট্য।
আসলে রমযানের এই বাহ্যিক উপকারিতার কথা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান বহু আগেই প্রমাণ করেছে। এ বিষয়টি এখন সর্বজনগ্রাহ্য একটি বাস্তবতা। আল্লাহ যেহেতু আমাদের জন্যে এই বিধানটি দিয়েছেন,ফলে এতে যে অবশ্যই কল্যাণ নিহিত থাকবে-তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশই নেই। কী কী বাহ্যিক কল্যাণ রয়েছে রোযার মধ্যে-সেসব আবিষ্কারের বিষয়। আবিষ্কৃত হলে ভালো,আর আবিষ্কৃত না হলে বিশ্বাসে কোনোরকম কমতি হওয়াটা দুর্বল ঈমানের পরিচায়ক। আমরা তাই সেদিকে না গিয়ে রোযার আধ্যাত্মিকতার দিকেই অগ্রসর হবার চেষ্টা করবো।

রমযান মাসে আল্লাহর রহমতের দ্বার অবারিত হয়ে যায়। রহমত মানে আল্লাহর অনুগ্রহ। অনুগ্রহ ছোট্ট একটি শব্দ। কিন্তু এর তাৎপর্য ব্যাপক। আল্লাহ আমাদের যতো কাজের যোগ্যতা দিয়েছেন,শারীরিক সুস্থতা দিয়েছেন,ভাববার মতো চেতনা দিয়েছেন,উদ্ভাবন করার শক্তি দিয়েছেন,কথা বলা,কাজ করা,চিন্তা-ভাবনা করার সামর্থ দিয়েছেন,মেধা দিয়েছেন মনন দিয়েছেন,আত্মা দিয়েছেন,সেগুলোকে ব্যবহার করে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির মর্যাদায় উন্নীত হবার সুযোগ দিয়েছেন-এ সবই আল্লাহর অনুগ্রহ। আবার অনুগ্রহ মানে ক্ষমা। এগারো মাসব্যাপী যতোরকম অন্যায়-অমূলক-অসঙ্গত আর অসমীচীন কাজ করে আল্লাহর দরবারে আসামী হয়েছি,সেই আসামীকে আল্লাহ যে মাফ করে দেবেন বলে কথা দিয়েছেন-এটা তো বিশাল এক অনুগ্রহ। আর সেই মাফ করে দেওয়ার ঘটনাটি ঘটবে এই রমযান মাসে।

এ জন্যেই রোযাকে বলা হয়েছে জুন্নাহ বা ঢালস্বরূপ। কারণ রোযার মাধ্যমে আল্লাহর বান্দারা দোযখের আগুন থেকে রক্ষা পায়,মুক্তিও পায়। রাসূলে খোদা বলেছেন এ মাসের প্রতি রাতে আল্লাহ তায়ালা জাহান্নাম থেকে বহু মানুষকে মুক্তি দান করেন। তাহলে রোযা যেমন জাহান্নামে যাবার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে,তেমনি জাহান্নামে যাবার পরও সেখান থেকে মুক্তি লাভ করার সুযোগ সৃষ্টি করে। আল্লাহর এতো বড়ো রহমতের বিষয়টিকে যে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হবে-তারচেয়ে হতভাগ্য আর কে থাকতে পারে!আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদের সবাইকে রমযানের তাৎপর্য উপলব্ধি করার তৌফিক দিন।

একটি হাদীসে এসেছে,রাসূল ( সা ) বলেছেন-রোযা এবং কোরআন কিয়ামতের দিন বান্দার জন্যে সুপারিশ করবে। রোযা বলবে-হে রব!আমি তাকে পানাহার ও কুপ্রবৃত্তি থেকে বিরত রেখেছি। সুতরাং তুমি তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ গ্রহণ করো।এটা যে কতো বিশাল প্রাপ্তি-তা কল্পনাই করা যায় না। কেননা আপনারা জানেন যে,কিয়ামতের দিন গুনাহগার বান্দারা আল্লাহর দরবারে তার জন্যে সুপারিশ করার লক্ষ্যে নবীরাসূলদের শরণাপন্ন হবে। কিন্তু তাদেঁর অনেকেই বিনয়বশত কিংবা আল্লাহর সামনে নিজেদেরকে তুচ্ছ বলে প্রমাণ করার জন্যে কারো পক্ষে সুপারিশ করতে অপারগতা প্রকাশ করবেন। কঠিন সেই মুহূর্তে রোযা এবং কোরআন যদি সুপারিশ করার জন্যে এগিয়ে আসে-সেটা যে কতো বড়ো প্রাপ্তি হবে তা একবার কল্পনা করে দেখুন তো। কিন্তু রোযা এবং কোরআন কখন আপনার জন্যে সুপারিশ করবে? যখন আপনি তাদের সুপারিশ পাবার যোগ্যতা অর্জন করবেন,তখন।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে,রমযান মাস আসলেই কেবল কোরআনের মাহাত্ম্য বা মর্যাদা নিয়ে আমরা কথা বলি,কিংবা কোরআন পাঠ বা চর্চা করি। বাকি মাসগুলোতে কোরআনকে ভুলে যাই।আর রমযান আসলে আমরা নিজেদেরকে সংযত রাখার চেষ্টা করি,রমযান চলে গেলেই আমরা পুনরায় উদ্ধত হয়ে পড়ি।ফলে এগারো মাস কাউকে ভুলে থেকে একটিমাত্র মাসে তার সেবা খেদমত করলে সে যে কতোটা তুষ্ট হবে-তা কিন্তু ভেবে দেখার বিষয়। তবুও চেষ্টা করতে হবে রমযানের মাসটিকে সবোর্চ্চ গুরুত্ব দিয়ে সর্বাধিক অর্জন করার এবং রমযানের সময়কার ইবাদাত চর্চাকে অন্যান্য মাসেও অব্যাহত রাখার। তবে রমযান মাসকে যেহেতু আল্লাহ নিজের বলে ঘোষণা দিয়েছেন,সেহেতু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে এ মাসকে যথার্থভাবে কাজ লাগাতে হবে। আল্লাহ যেহেতু রাহমান এবং রাহীম,সেহেতু তিনি সন্তুষ্ট হলে তাঁর রহমতের বারি দিয়ে জাহান্নামের আগুনকে আপনার জন্যে নিভিয়ে দিলেও দিতে পারেন। এই সুযোগটাও কিন্তু আল্লাহর পক্ষ থেকে বিরাট একটা রহমত।

আমাদের মাঝে নববর্ষ সংস্কৃতির একটা প্রচলন আছে। সাধারণত মনে করা হয় যে বছরের শুরুটা যেভাবে আনন্দ-আয়োজনের মধ্য দিয়ে উদযাপন করা হয়,বাকি মাসগুলোতে তার প্রভাব পড়ে। এটা একান্তই লোকবিশ্বাস। এর সাথে দ্বীন বা বিজ্ঞানের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু এই বিশ্বাসটাকে ইতিবাচক অর্থে ধরে নিয়ে বলা যায় ইবাদাতের জন্যে,আত্মশুদ্ধির জন্যে,পরকালীন মুক্তির জন্যে রমযান হলো আধ্যাত্মিকতা চর্চার নববর্ষ। তাই রমযান মাসটিকে আমরা যেভাবে ইবাদাত-বন্দেগীর মধ্য দিয়ে কাটাই,সেভাবে রমযানকে ইবাদাত বর্ষের সূচনা বলে ধরে নিয়ে যেন বাকি মাসগুলোতে রমযানের কর্মসূচিগুলোকে অব্যাহত রাখার চেষ্টা করি।

পবিত্র কোরআনে আল্লাহহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন নিঃসন্দেহে মুমিনরা পরস্পরে ভাই-ভাই। সুতরাং তোমাদের ভাইদের মধ্যে তোমরা শান্তিস্থাপন করবে। আর তোমরা পরহেজগার হবে অর্থাৎ আল্লাহকে ভয়-ভক্তি করবে,যাতে আল্লাহ তোমাদের ওপর তাঁর রহমত বা অনুগ্রহ বর্ষণ করেন। প্রকৃতপক্ষে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ এই পরিবেশটা কেবলমাত্র রমযান মাসেই কিছুটা অনুভব করা যায়। বলাবাহুল্য,পৃথিবী জুড়ে বর্তমানে যতো অরাজকতা আর জুলুম-নির্যাতন দেখা যাচ্ছে,তার মূলে রয়েছে মানুষের সাথে মানুষের ভ্রাতৃসুলভ সম্পর্কের অভাব। তাই রমযান মাসের ভ্রাতৃত্বপূর্ণ পরিবেশটাকে যদি সারা বছর ধরে বজায় রাখা যায়,তাহলে পৃথিবীটা হয়ে উঠবে ইহজাগতিক বেহেশত। রমযান এদিকে থেকেও আল্লাহর বান্দাদের জন্যে তাঁর এক অসাধারণ রহমত বা অনুগ্রহ।

৩য় পর্ব

রাসূলে কারিম ( সা ) বলেছেন, আমার অনুসারীদের মধ্যে যারা বেহেশতে যাবে তাদের মধ্যে বেশিরভাগই যাবে দুটি কারণে,একটি হলো আল্লাহকে ভয় করা এবং অপরটি হলো সদাচার বা সদ্ব্যবহার করা।আল্লাহকে ভয় করার মানেই হলো তাকওয়াবান হওয়া। আর তাকওয়াবান তারাই যাদের বিবেক-বুদ্ধি,মেধা-বিচক্ষণতার ক্ষেত্রে পূর্ণতা রয়েছে। আর যাদের মধ্যে এই গুণাবলীগুলো রয়েছে তারা অন্যান্যদের তুলনায় অনেক বেশি সংযত,সুসংহত এবং পরিশীলীত আচার-আচরণ করবেন-এটাই স্বাভাবিক।রমযান এলেই মানুষের মাঝে এই গুণাবলীগুলো অন্য সময়ের তুলনায় একটু বেশিই লক্ষ্য করা যায়। কেননা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন নিজেই ঘোষণা করেছেন, তোমাদের ওপর এবং তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের ওপর রোযা ফরয করার উদ্দেশ্য হলো তোমাদের মাঝে তাকওয়া সৃষ্টি করা। হযরত আলী ( আ ) এর একটি বাণী এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি বলেছেন,সদাচার এবং প্রশস্ত ও উদার দৃষ্টিভঙ্গি মানুষের আয়-উপার্জন বাড়িয়ে দেয়। দারিদ্র্যক্লিষ্ট জনগোষ্ঠির জন্যে হযরত আলী ( আ ) এর এই বাণীটি অনুশীলনযোগ্য।

ব্রিটিশ মনীষী প্রখ্যাত স্যামুয়েল স্মাইলস বলেছেন,পৃথিবীকে গতিময়তার দিকে পরিচালিত করার মতো যতো শক্তি রয়েছে তার মধ্যে উন্নত আচার-আচরণ একটি।প্রকৃতপক্ষে আদব-কায়দা হচ্ছে মানুষের স্বভাবেরই চূড়ান্ত বহিপ্র্রকাশ। কিন্তু এইসব চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্য জন্মগত নয়,বরং এইসব গুণাবলী অর্জন করতে হয়। আর তা অর্জন করার শ্রেষ্ঠ সময় হলো রমযান মাস। কারণ রোযা নষ্ট হয়ে যায়-এই ভয়ে রোযাদারকে বহু ধরনের প্রবৃত্তি তাড়িত কাজকর্ম থেকে বিরত থাকতে হয়।কেননা মিথ্যাকথা বলা,পরনিন্দা করা,কুটনামি করা,মিথ্যা শপথ করা,কামভাবের সাথে কারো দিকে তাকানো-এগুলো রোযা নষ্ট করে দেয়।তাই সংযমী হতে হয় রোযাদারকে।আর এই যে সংযম-তা একান্তই আল্লাহর জন্যে। কেননা হাদীসে এসেছে,আল্লাহ নিজেই বলেছেন ‘ইয়াদুড়্ শাহওয়াতাহু ওয়া ত্বোড়ামাহু মিন আজলি’অর্থাৎ রোযাদার আমারই কারণে,আমারই নির্দেশ পালনে এবং আমারই সন্তোষ বিধানের উদ্দেশ্যে তার প্রবৃত্তিকে দমন করে,পানাহার পরিহার করে।রমযান তাই মানুষকে সংযম এবং সদাচার শিক্ষা দেয়।

আর এই সংযম যদি পালন করা না হয়,তাহলে রোযাদার কেবল উপোসই করবে শুধু,ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কষ্টই পাবে শুধু,তার রোযা তার জন্যে কোনো ফল বয়ে আনবে না। কেননা হাদীসে পাকে বলা হয়েছে অনেক রোযাদার আছে,ক্ষুধা-তৃষ্ণার কষ্ট ছাড়া তাদের রোযা থেকে আর কোনো ফল লাভ হয় না। সুতরাং রোযাকে অযথা অসংযমের কারণে নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না। তাই আচার-আচরণ সুন্দর করতে হবে। মিথ্যাবাদিতার চর্চা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। বিশেষ করে ছেলেমেয়েদের সামনে মিথ্যা বলা বা সত্যের বিরোধী আচরণ পরিহার করা অথ্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ ছেলেমেয়েরা তাদের পরিবার এবং চারদিকের লোকজনের কাছ থেকেই আচার-আচরণ,কথাবার্তা,কাজকর্ম ইত্যাদি শেখে। এই শিক্ষা এবং এই উপলব্ধি আমরা রমযান মাসে পেয়ে থাকি। তবে এই গুণাবলীগুলো আমাদের শিক্ষা দেয় আল-কোরআন। তাই রোযা রাখার পাশাপাশি বেশি বেশি করে কোরআন পড়া খুবই জরুরী। কোরআন বুক শেল্ফ থেকে জায়নামাযের রেহেলে পঠিত হোক-এই কামনা করছি।

আলোচনার এ পর্যায়ে রোযাদারদের জন্যে কিছু খুশির খবর দিচ্ছি। এমনিতেই রমযান মাস এলে প্রকৃত রোযাদারগণ বা মুসলমানেরা আনন্দ প্রকাশ করে থাকেন। এ আনন্দ অনাবিল,স্বতস্ফূর্ত এবং প্রকাশ্য। রমযানের সূচনাতেই খুশির একটা আমেজ সর্বত্র লক্ষ্য করা যায়। এটা আল্লাহর একটা বিশেষ রহমত। পবিত্র কোরআনের সূরা ইউনূসের ৫৮ নম্বরে আয়াতে যেমনটি আল্লাহ বলেছেন,বল!এটা আল্লাহর অনুগ্রহ এবং তাঁর দয়ায়। সুতরাং এতে তারা আনন্দিত হোক। তারা যা সঞ্চয় করে,এটা তার চেয়েও উত্তম। পার্থিব কোনো সম্পদের সাথে তো আল্লাহর রহমতের তুলনা চলে না। রাসূল বলেছেন,যে ব্যক্তি রমযান মাসের কল্যাণ ও রহমত থেকে বঞ্চিত হলো,সেমূলত সকল কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত হলো। সুখরটি হলো-

রাসূলে খোদা বলেছেন,রাইয়্যান নামে বেহেশতের একটি দরোজা আছে। কিয়ামতের দিন ঐ দরোজা দিয়ে কেবলমাত্র রোযাদাররাই প্রবেশ করবে। রোযাদারদেরকে ডেকে ডেকে বেহেশতে প্রবেশ করানোর পর ঐ দরোজাটি বন্ধ হয়ে যাবে। অন্যত্র বলা হয়েছে যে লোকই সেই দ্বারপথে প্রবেশ করবে,সে-ই পান করবে। আর যে-ই পান করবে,সে আর কোনোদিন পিপাসার্ত হবে না। এই হাদীসে উল্লেখিত রাইয়্যান শব্দটির অর্থই হলো সদাপ্রবহমান প্রস্রবণ। অতএব রোযাদার বন্ধুরা!ক্ষুধা-তৃষ্ণাকে উপেক্ষা করে সিয়াম সাধনায় আত্মনিয়োগ করুন-আর পরকালে ব্যতিক্রমধর্মী পুরস্কার ও মর্যাদা লাভের সৌভাগ্য অর্জন করুন।

সবশেষে হযরত সালমান ফারসি ( আ ) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসের অংশ বিশেষ উদ্ধৃত করছি। রাসূলে খোদা বলেছেন…. রমযান সবর,ধৈর্য ও তিতীক্ষার মাস।আর সবরের প্রতিফল হলো আল্লাহর কাছ থেকে জান্নাত প্রাপ্তি।এটা পারস্পরিক হৃদ্যতা এবং সৌজন্য প্রদর্শনের মহিমা। এ মাসে মুমিনের রেযক বাড়িয়ে দেওয়া হয়। যে ব্যক্তি রোযাদারকে ইফতার করাবে আল্লাহ তার গুনাহ মাফ করে দেবেন এবং জাহান্নাম থেকে নিষ্কৃতি দেবেন।তাকে আসল রোযার সওয়াব দেওয়া হবে কিন্তু সেজন্যে রোযাদারের সওয়াব কমানো হবে না।……….. আর যে ব্যক্তি এই মাসে নিজের অধীন লোকদের শ্রম-মেহনত হাল্কা বা হ্রাস করে দেবে,আল্লাহ তায়ালা তাকেঁ ক্ষমা করে দেবেন এবং তাকে দোযখ থেকে মুক্তি দেবেন। এই সুসংবাদ কেবল রোযাদারদের জন্যে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই সুসংবাদের অধিকারী করে তুলুন। সবশেষে আসুন মোনাজাত করি,আল্লাহর দরবারে দোয়া করি।

৪র্থ পর্ব

( লক্ষ্যস্থির ও দৈনন্দিন কর্মসূচি )

রমযান মাস হলো সকল পাপ-পঙ্কিলতাকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছাইভস্ম করে ফেলার মাস। রমযান মাস শেষে একজন রোযাদার সম্পূর্ণ নিষ্পাপ শিশুর মতো নতুন জীবনের অধিকারী হয়ে উঠবেন-এটাই এ মাসের দাবী। রমযান শব্দটির মূল ধাতু বিশ্লেষণ করলেও তাই দাঁড়াবে। রমযান একটি আরবি শব্দ। এর শব্দমূল হলো রা-মিম-দোয়াদ বা রাময।আরবি ভাষায় এর অর্থ হচ্ছে অতিরিক্ত গরম,কঠোর সূর্যতাপ,দহন,জ্বলন,তৃষ্ণা এবং গলে যাওয়া।রমযান মাসে যেহেতু নেক আমলের কারণে বিগত গুনাহ বা পাপগুলো বিমোচিত হয়ে যায় কিংবা গলে গলে নিঃশেষ হয়ে যায় সেজন্যেই এ মাসের নাম হলো রমযান।

এ-ও বলা হয় যে রোযা রাখার কারণে ক্ষুৎ-পিপাসার তীব্রতায় রোযাদারের পেট জ্বলতে থাকে। এ অবস্থা বোঝাবার জন্যেও আরবি ভাষায় বলা হয় আসসায়েমু ইউরমাযু অর্থাৎ রোযাদার দগ্ধ হয়।রমযান তার শব্দমূলের দাবী অনুযায়ী আমাদের জীবনের সকল গুনাহ-খাতা জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে-গলিয়ে নিঃশেষ করে দিক, নিষ্পাপ এক নতুন জীবনের সতেজতা নিয়ে আসুক প্রতিটি রোযাদারের জন্যে-এই প্রত্যাশায় শুরু করছি আজকের আলোচনা।

আমরা রমযানের রহমত পর্ব অতিক্রম করছি এখন। রহমত মানে হলো আল্লাহর অনুগ্রহ। পুরো রমযান মাসই আল্লাহর একটা বিশেষ অনুগ্রহ তাঁর বান্দাদের ওপর। সারা রমযান জুড়ে আমরা যেন গুনাহের কালিমাগুলো মুছে ফেলার চেষ্টা করি। কম্পিউটার যারা ব্যবহার করেন তারা নিশ্চয়ই জানেন যে, কোনো একটা প্রোগ্রাম বা সফটওয়্যার ইনস্টল করতে গেলে বেশ কিছুটা সময় লেগে যায়। যিনি ইনস্টল করবেন তাকেঁ ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করতে হয় কখোন শেষ হবার জন্যে। মাঝপথে কিংবা শেষ দিকে এসে যদি কেউ অধৈর্য হয়ে ইনস্টল করার চলমান প্রক্রিয়াটি বন্ধ করে দেন অর্থাৎ ইনস্টলেশান যদি ক্যানসেল করে দেন তাহলে কিন্তু কোনো লাভ হবে না। অযথা সময় নষ্ট হবে, এবং আপনার কম্পিউটারও পূর্বাবস্থাতেই থেকে যাবে। তাই রমযানের অর্জনগুলোকে কার্যকর করার জন্যে এ মাসের কাজগুলোকে রমযানের পরেও অব্যাহতভাবে চালিয়ে যেতে হবে।

রহমতের মাস রমযান আসলে আল্লাহর বান্দাদের জন্যে বিশেষ একটি কর্মশালার মাস। একমাস ব্যাপী এই কর্মশালায় রোযাদারকে বহু বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সারা বছর জুড়ে বাস্তব জীবনের ব্যবহারিক কার্যক্রমগুলো কীভাবে করতে হবে,কীভাবে আল্লাহর প্রতি আস্থা ও ঈমান রাখতে হবে,কীভাবে নিজেকে সংশোধন করতে হবে,ঘুষ খাওয়া,অপরের হক নষ্ট না করা,ব্যক্তিগত অসৎ গুণাবলী থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা এবং সৎ গুণাবলী অর্জন বিশেষ করে কীভাবে চরিত্র গঠন করতে হবে হবে-সেসব শিক্ষা এ মাসে পাওয়া যায়।তাই রমযান মাস হলো আত্মগঠনের মাস ব্যাপী কর্মশালা।

জীবনের লক্ষ্য স্থির করার মাসও রমযান। সারা বছর ধরে আপনি হয়তো শরীয়ত পরিপন্থী অনেক কাজ করেছেন। এখন এই রমযান মাসে এসে চিন্তা করছেন আপনি কি আপনার আগের ভূমিকাতেই অটল থাকবেন,নাকি আল্লাহর দরবারে তওবা করে তাঁর সাথে অঙ্গীকারে আবদ্ধ হবেন যে কখনো আর শরীয়ত পরিপন্থী কাজে নিজেকে লিপ্ত করবেন না। যদি আপনি আপনার ভুল স্বীকার করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নতুন জীবনের লক্ষ্যে আত্মশুদ্ধির পথ বেছে নেন,তাহলে আল্লাহও আপনাকে সাহায্য করবে,আত্মোন্নয়নে সহযোগিতা করবে। এই মাসে আপনাকে সেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আত্মশুদ্ধির পথ বেছে নেওয়াই হলো ভবিষ্যত জীবনের লক্ষ্য স্থির করে নেওয়া। আপনি যদি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নেন তাহলে আপনাকে আরো বেশি তৎপর হতে হবে। আল্লাহকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে রমযান মাস চলে যাবার পর পুনরায় পূর্বের কর্মকাণ্ডে ফিরে যাওয়াটা হবে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা। আর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা ঈমানের পরিচায়ক নয়।

আপনি যদি মুমিন হয়ে থাকেন তাহলে আল্লাহকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি পালনার্থে আপনাকে অনেক বেশি কর্মতৎপর হতে হবে। কেননা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ঘোষণা করেছেন ইন্নাল্লাহা লা ইউগায়্যিরু মা বি কাউমিন হাত্তা ইউগায়্যিরু মা বিআংফুসিহিম অর্থাৎ আল্লাহ নিশ্চয়ই ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো জাতির পরিবর্তন করেন না,যতোক্ষণ না তারা নিজেরা নিজেদেরকে পরিবর্তন করে নেয়।তার মানে হলো আত্মসংশোধনের ঘোষণা দিলেই চলবে না,বরং আত্মসংশোধনের জন্যে সকল প্রকার চেষ্টা-প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এই চেষ্টা চালানোর প্রক্রিয়াটির কোনো সময়সীমা নেই। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তা চালিয়ে যেতে হবে। কেননা আল্লাহ নিজেই বলেছেন ওয়াবুদ রাব্বাকা হাত্তা ইয়া’তিকাল ইয়াকীন অর্থাৎ মৃত্যু পর্যন্ত তোমার রবের ইবাদাত করো। এ প্রসঙ্গে নবী করীম ( সা ) বলেছেন কুল আ-মানতু বিল্লাহি ছুম্মাসতাকাম অর্থাৎ বলো,ঈমান আনলাম আল্লাহর ওপর,তারপর অবিচল থাকো। অতএব রমযান মাস হলো আল্লাহর ওপর অবিচল থাকা এবং ব্যক্তিজীবনের লক্ষ্য নির্ধারণের মাস।

রমযান মাসের শুরুতেই তাই আপনাকে পুরো মাসের একটা কর্মসূচি তৈরী করে ফেলতে হবে। এই কর্মসূচিতে দিনের এবং রাতের ইবাদাতের সময় ঠিক করে নিতে হবে। কর্মসূচিগুলোর মধ্যে যা যা থাকা জরুরী তার একটা সংক্ষিপ্ত নির্দেশনা দেওয়া যাক। প্রথমেই আপনাকে সাহরি এবং ইফতারের সুনির্দিষ্ট সশয় নির্ধারণ করে নিতে হবে। অর্থসহ বেশি বেশি কোরআন তিলাওয়াত করতে হবে। সেইসাথে ইসলামী সাহিত্য বেশি বেশি পড়তে হবে।বেশি বেশি ইবাদাতের স্বার্থে কম খাওয়ার চেষ্টা করতে হবে এবং কম ঘুমানোর চেষ্টা করতে হবে।

রাত জেগে ইবাদাত করার চেষ্টা করতে হবে।গরীব-দুখি-অসহায়দের খোজ-খবর নিতে হবে এবং তাদের প্রতি যথাসম্ভব উদার-সহানুভূতিশীল ও দয়াবান হতে হবে। দুনিয়াবি ব্যস্ততা কমিয়ে আখেরাতের চিন্তা বেশি করতে হবে। রোযাদারকে ইফতার করানোর চেষ্টা করতে হবে। দোয়া-দরুদ,জিকির-আজকার বেশি বেশি করে আল্লাহর দরবারে তওবা-ইস্তেগফার করতে হবে। আল্লাহর কাছে গুনাহ মাফ চেয়ে বেশি বেশি মোনাজাত দিতে হবে।দৈনন্দিন এই কর্মসূচিগুলো যথার্থভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।

৫ম পর্ব

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উযমা খামেনেয়ী বলেছেন,রমযান মাস প্রতি বছরই আসে বেহেশতের আমেজ নিয়ে।  আমাদেরকে সুযোগ দেয় এ মাসের ঐশীভোজে নিজেদেরকে তৃপ্ত করার মধ্য দিয়ে যেন বেহেশতে প্রবেশ করি। কেউ কেউ সেই ত্রিশ দিন বেহেশতের ঐশী আমেজ উপভোগ করেন,কেউ আবার ঐ ত্রিশ দিনের বরকতে পুরো বছর জুড়েই,যেন বেহেশতের মধ্যেই কাটান কেউবা কাটান সারাজীবন। তারি পাশে আবার কেউ কেউ’রোযার ব্যাপারে উদাসীন থেকে অপূরণীয় ক্ষতির মধ্যে নিজেদেরকে নিমজ্জিত করেন,যা একেবারেই দুঃখজনক একটি ঘটনা।’

আয়াতুল্লাহিল উযমা খামেনেয়ী রহমত ও বরকতপূর্ণ এই মাসের প্রাণসঞ্চারী কিছু আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন,এই মাস রোযার মাস,কোরআন অবতীর্ণ হবার মাস, ইবাদাতের মাস, ইবাদাতের আত্মা বা প্রাণ-দোয়ার মাস,মুনাজাতের মাস, তওবা-এস্তেগফারের মাস,অপছন্দনীয় পথ থেকে ফিরে আসার মাস এবং খোদাভীতি অর্জন বা তাকওয়ার মাস….. নফস বা প্রবৃত্তির সাথে জেহাদ করার মাস,শয়তানের সাথে এবং আল্লাহর শত্রুদের সাথে সংগ্রাম করার মাস, আত্মীয়-স্বজন এবং দ্বীনী ভাইদের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করার মাস, তাকওয়া সঞ্চয় করার জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণের মাস। একইভাবে এই মাস ইসলামের সাথে সুপরিচিত হবার সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয়। পুরো বছর জুড়ে দ্বীনী কাজকর্ম আঞ্জাম দেওয়ার জন্যে যে শক্তি-সামর্থের প্রয়োজন,তার জন্যে যথাযথ বিনিয়োগ করার মহাসুযোগ এনে দেয় রমযান। আমরা যেন অবহেলা করে এই সুযোগ নষ্ট না করি।

রোযা সম্পর্কে গত কদিন ধরে আমরা যতো আলোচনা করলাম,তা থেকে একটি বিষয় অন্তত স্পষ্ট হয়েছে যে, রহমতের এই বসন্তের মাসে রোযা রাখতে পারাটা মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের জন্যে এক অপরিশোধ্য করুণা। আমরা যদিও আল্লাহ প্রদত্ত দায়িত্ব বলেই রোযা রাখি,আসলে এই দায়িত্ব পালনের মধ্যে লুকিয়ে আছে খোদায়ী নেয়ামত। তাই যিনি এ মাসে রোযা রাখতে পারছেন,তাঁর জন্যে মাসটি আল্লাহর পক্ষ থেকে মহামূল্যবান এবং সুবর্ণ এক সুযোগ। অবশ্য রোযা রাখার মধ্যে কষ্ট যে নেই তা নয়। বেশ কষ্ট আছে। উত্তম এবং পুণ্যের যতো কাজ আছে,সকল কাজই কষ্টের। কষ্টবিহীন কোনো পুণ্যের কাজ নেই। কেননা মানুষ কষ্ট না করে কোনো একটি পর্যায়ে উপনীত হতে পারে না। রোযা রাখার মধ্যেও যে কষ্টটুকু রয়েছে,তা রোযা থেকে অর্জিত মুনাফার মোকাবেলায় খুবই সামান্য। রোযার কষ্টটা হলো স্বল্প পুঁজি বিনিয়োগ করে বেশি মুনাফা লাভ করার মতো একটি বিষয়।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা রমযান মাসের রোযাকে খোদায়ী তৌফিক বলে মনে করেন। তাঁর ভাষায়-রোযা ফরয করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমার , আপনার , সবার জন্যে এ মাসে আত্মগঠন করার উপযুক্ত একটা ক্ষেত্র তৈরী করে দিয়েছেন। আসলে রমযান মাসের সবচে বড়ো যে শিক্ষা তাহলো আত্মগঠন করা। আর এই আত্মগঠন করার পথে সর্বপ্রথম যে পদক্ষেপ তা হলো মানুষ তার নিজের আচার-ব্যবহার,নীতি-নৈতিকতা ইত্যাদি সবকিছুকেই নিজস্ব দৃষ্টি দিয়ে দেখবে এবং ঐ আত্মদৃষ্টিটি হবে সমালোচনামূলক। অর্থাৎ মানুষ নিজেই নিজের ভুল-ত্রুটি দেখবে,সেগুলো নিয়ে গভীরভাবে ভাববে এবং সেগুলোকে কীভাবে দূর করা যায় সেই চেষ্টায় নিয়োজিত হবে। পরের সমালোচনা না করে এইরকম আত্মসমালোচনার মধ্য দিয়ে মানুষ আত্মগঠন করতে পারে। রমযান মাস আমাদের জন্যে আত্মগঠন করার মহাসুযোগ এনে দেয়। এই সুযোগকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো উচিত।

যে কেউই নিজের সমালোচনা নিজে করতে বসবে,সে ই নিজেকে গঠন করতে পারবে। কেননা নিজের ভুল-ত্রুটিগুলো নিজেই যখন দেখতে পাবে, তখনই সে বুঝতে পারবে,উপলব্ধি করতে পারবে যে,তার ভেতরে কতো অপূর্ণতা রয়েছে,কতো ত্রুটি-বিচ্যুতি রয়েছে। এইসব অপূর্ণতা,এইসব ত্রুটি-বিচ্যুতি কাটিয়ে ওঠার জন্যে তাই সে বিনয়ী হয়ে উঠবে। উদ্ধত আচার-আচরণ আর তার মধ্যে থাকবে না। অপরের সামনে নিজেকে বড়ো করে তুলে ধরার মতো অহংকার দেখাবে না। রমযান মাস হলো এইসব সৎগুণাবলী চর্চার উপযুক্ত সময়। কেননা এ মাসে মানুষ আল্লাহর রহমতে যতোই পুণ্যকাজ করতে চাইবে,করতে পারবে। শয়তান তার নেক আমলের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার সুযোগ পাবে না।

তবে হ্যাঁ,আল্লাহর দরবারে নিজেকে তুচ্ছ হিসেবে তুলে ধরার ক্ষেত্রে সবিনয় হতে হবে। অর্থাৎ তওবা-এস্তেগফার করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। মনে রাখতে হবে এই পথ থেকে বিচ্যুত হলেই কিন্তু অহমবোধ চলে আসবে মনে। আর অহমিকা হলো নিজেকে ধ্বংস করার শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। অহমিকা প্রবণ মানুষেরা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করার চেষ্টার পরিবর্তে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টায় লিপ্ত থাকে সারাক্ষণ। তারা কেবল পার্থিব জগতের অপূরণীয় চাহিদা পূরণের চেষ্টায় মগ্ন থাকেন। এরা বস্তুতান্ত্রিক পৃথিবীর বেহেশতেই নিজস্ব চাহিদা চরিতার্থ করে আত্মতৃপ্তি লাভ করেন। তাদের আচার-আচরণ তাই পাশবিক হয়ে ওঠে। পবিত্র কুরআনের সূরা মুহাম্মাদে বলা হয়েছে,নিঃসন্দেহে যারা ঈমান এনেছে,সৎকাজ করেছে,আল্লাহ তাদের প্রবেশ করাবেন এমন জান্নাতে যার নীচে রয়েছে প্রবহমান ঝর্ণাধারা। আর যারা অবিশ্বাস পোষণ করে তারাজন্তু জানোয়ারের মতো খায়দায় ভোগ-বিলাস করে,আগুনই তাদের বাসস্থান। আল্লাহ আমাদেরকে অবিশ্বাসী,উদ্ধত,ভোগ-বিলাসীদের কাতার থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখুন,বিনয়ীদের কাতারে শামিল করুন,আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনকারীদের সমাবেশে যুক্ত করুন। #

Leave A Reply

Your email address will not be published.