কল্পকাহিনীর বর্ণনাকারীগণ

0 373

 

কল্পকাহিনীর বর্ণনাকারীগণ

বিগত বারোশ’ বছর১ যাবত ঐতিহাসিকগণ আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’ সংক্র্রান্ত কল্পকাহিনী বর্ণনা করে আসছেন। সময় যতই সামনে এগিয়ে যাচ্ছে ততই এ কল্পকাহিনী অধিকতর বিখ্যাত হচ্ছে ও অধিকতর ব্যাপ্তি লাভ করছে। ফলে বর্তমানে কদাচিৎ নযরে পড়ে যে, কোন লেখক ছাহাবীগণ সম্পর্কে লিখছেন অথচ সে প্রসঙ্গে এ কল্পকাহিনী টেনে আনছেন না। হ্যা, অতীতের ও বর্তমান যুগের লেখকদের মধ্যে পার্থক্য এখানে যে, অতীতের লেখকগণ এ কল্পকাহিনীকে বানানো হাদীছ ও রেওয়াইয়াতের আবরণে পেশ করেন, আর বর্তমান কালের লেখকগণ এর ওপরে গবেষণার রং লেপন করে উপস্থাপন করছেন।
এ কারণে আমরা যদি সত্যিকারের গবেষণা মূলক দৃষ্টিকোণ থেকে এ বিষয় নিয়ে আলোচনা ও পর্যালোচনা করতে চাই তাহলে আমাদের জন্যে এ কল্পকাহিনীর সূচনা ও উৎপত্তি এবং সেই প্রথম যুগ থেকে শুরু করে বর্তমান কাল পর্যন্ত এর (গুরুত্বপূর্ণ) বর্ণনাকারীগণের জীবনেতিহাসের ওপর আলোকপাত করা ছাড়া গত্যন্ত নেই। তাহলে সুস্পষ্ট হয়ে যাবে যে, কারা এবং কোন্‌ দলীলের ভিত্তিতে এ কল্পকাহিনী বর্ণনা করেছেন। এরপর আমরা মূল কাহিনী নিয়ে আলোচনা করবো।

১) সাইয়েদ রাশীদ রেযা (ওফাত ১৩৫৬ হিঃ)
সামপ্রতিক কালীন লেখকদের মধ্যে সাইয়েদ রাশীদ রেযা লিখেছেন ঃ
“শিয়া মতবাদ চতুর্থ খলীফা আলী ইবনে আবি তালেব (রাঃ)-এর নামে সূচিত হয় এবং উম্মাতে মুহাম্মাদীর মধ্যে দ্বীনী ও রাজনৈতিক বিভেদ সৃষ্টি করে। সর্বপ্রথম আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’ নামে জনৈক ইয়াহূদী শিয়া মতবাদের মূলনীতি সমূহ রচনা করে; সে প্রতারণার উদ্দেশ্যে ইসলাম গ্রহণের ভান করে। সে লোকদেরকে আলী (কার্‌রামাল্লাহু ওয়াজ্‌হাহ্‌) সম্পর্কে বাড়াবাড়ি মূলক আক্বিদাহ্‌ পোষণের জন্যে আহ্বান জানায়; এভাবে সে এ উম্মাতের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে এবং তাদের ইহকাল ও পরকালকে বিনষ্ট করে দেয়।”২
সাইয়েদ রাশীদ রেযা আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’ সংক্রান্ত কল্পকাহিনীর বিস-ারিত বর্ণনা দেয়ার পর এ কাহিনীর দালীলিক ভিত্তি সম্বন্ধে এভাবে উল্লেখ করেছেন, “কেউ যদি তারীখে ইবনে আছীরের ৩য় খণ্ডের ৯৫ থেকে ১০৫ পৃষ্ঠা পর্যন- জঙ্গে জামালের ঘটনা সম্বন্ধে অধ্যয়ন করে তাহলে সে দেখতে পাবে যে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ক্ষেত্রে সাবাঈরা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল এবং কত দক্ষতার সাথে তারা এ ভূমিকায় অভিনয় করেছিল এবং সন্ধি স্থাপিত হওয়া প্রতিহত করেছিল।”
অতএব, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, সাইয়েদ রাশীদ রেযা এ কল্পকাহিনী বর্ণনার ক্ষেত্রে যে তথ্যসূত্রের আশ্রয় নিয়েছেন তা হচ্ছে ইবনে আছীরের লেখা ইতিহাস গ্রন’ “আল-কামেল”।
২) আবূল ফিদা’ (ওফাত ৭৩২ হিঃ)
আবূল ফিদা’ তাঁর লিখিত ইতিহাস গ্রন্থ “আল-মুখতাছার্‌”-এ এ কল্পকাহিনীকে অন্য একটি অসত্য কাহিনীর সাথে জুড়ে দিয়েছেন। তিনি তাঁর গ্রনে’র ভূমিকায় তাঁর গ্রন্থের সূত্র সমূহের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, “আমি ইবনে আছীর জায্‌রী নামে সমধিক পরিচিত শেখ ইয্‌যুদ্দীন আলী লিখিত “তারীখে কামেল” গ্রন্থের ভিত্তিতে আমার এ গ্রন্থ রচনা করেছি; আমি এখানে ইবনে আছীরের বক্তব্যকে সংক্ষিপ্ত আকারে উপস্থাপন করেছি।”
অতএব, দেখা যাচ্ছে যে, রাশীদ রেযা ও আবূল ফিদা’ উভয়ই এ ব্যাপারে ইবনে আছীরের লেখা ইতিহাস গ্রনে’র ওপর আস্থা স্থাপন করেছেন। তাই দেখা দরকার যে, ইবনে আছীর এ কল্পকাহিনীকে কোথা থেকে সংগ্রহ করেছেন।
৩) ইবনে আছীর (ওফাত ৬৩০ হিঃ)
ইবনে আছীর তাঁর লেখা ইতিহাস গ্রন্থ “তারীখে কামেল”-এ হিজরী ৩০ থেকে ৩৬ সালের ঘটনাবলীর বর্ণনায় এ কল্পকাহিনী বর্ণনা করেছেন, কিন্তু তিনি এ কাহিনীর তথ্যসূত্র সম্বন্ধে কিছু উল্লেখ করেন নি। তবে তিনি তাঁর গ্রন্থের ভূমিকায়৩ বলেছেন ঃ
“এ গ্রন্থের বিষয়বস্তু প্রথমতঃ ইমাম আবু জা‘ফার মুহাম্মাদ ত্বাবারী লিখিত বিশাল ইতিহাস গ্রন্থ থেকে গ্রহণ করেছি। কারণ, এটি হচ্ছে সর্বসাধারণের নিকট গ্রহণযোগ্য একমাত্র ইতিহাস গ্রন্থ। কোন ঐতিহাসিক বিষয়ে মতপার্থক্য সৃষ্টি হলে লোকেরা এ গ্রন্থের আশ্রয় নিয়ে তা নিরসন করে থাকে। আমিও উক্ত গ্রন্থের রেওয়াইয়াত (বর্ণনা) সমূহ কোনটি বাদ না দিয়ে উদ্ধৃত করেছি; পার্থক্য কেবল এই যে, তিনি অধিকাংশ ঘটনার ব্যাপারেই অনেক রেওয়াইয়াত উদ্ধৃত করেছেন, কিন্তু আমি একই ঘটনা সংক্রান্ত সবগুলো রেওয়াইয়াতকে সমন্বিত করে একটি বর্ণনা আকারে উদ্ধৃত করেছি। ফলে তাতে একটি ঘটনার ব্যাপারে বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে যে সব বর্ণনা উদ্ধৃত করা হয়েছে আমি তাকে একটি বর্ণনায় পেশ করেছি। … কিন্তু ছাহাবীগণের সাথে সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলীর ক্ষেত্রে আবু জা‘ফার যা উদ্ধৃত করেছেন আমি তার সাথে কোন কিছুই সংযোজন করি নি; তবে ক্ষেত্র বিশেষে কোথাও ব্যাখ্যা সংযোজন করেছি, বা কারো নামের বর্ণনা দিয়েছি বা সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়েছি।”
অতএব, দেখা যাচ্ছে যে, আবূল ফিদা’ ও সাইয়েদ রাশীদ রেযা আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’ সংক্রান্ত কল্পকাহিনী যে ইবনে আছীর থেকে উদ্ধৃত করেছেন তিনি তা ত্বাবারী থেকে উদ্ধৃত করেছেন। আর, ইবনে আছীরের উল্লেখ অনুযায়ী, যেহেতু তিনি ছাহাবীদের সাথে সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলী তুলে ধরার ক্ষেত্রে ত্বাবারীর বর্ণনার সাথে কিছুই যোগ করেন নি, বরং ত্বাবারী থেকে হুবহু উদ্ধৃত করেছেন, অতএব এখানে ত্বাবারীই হচ্ছেন তাঁদের সকলের মূল তথ্যসূত্র।
৪) ইবনে কাছীর (ওফাত ৭৭৪ হিঃ)
ইবনে কাছীর তাঁর “আল-বিদাইয়্যাহ্‌ ওয়ান্‌-নিহাইয়্যাহ্‌” নামক ইতিহাস গ্রন্থের সপ্তম খণ্ডে ত্বাবারী থেকে এ কল্পকাহিনী উল্লেখ করেছেন। তিনি তাঁর গ্রনে’ লিখেছেন৪ ঃ “সাইফ ইবনে ওমর বলেছে যে, ওসমানের বিরুদ্ধে লোকদের বিদ্রোহের কারণ ছিল এই যে, আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’ নামক জনৈক ইয়াহূদী বাহ্যতঃ ইসলাম গ্রহণ করেছিল এবং সে মিসরে গিয়ে লোকদেরকে মনগড়া জিনিস শিক্ষা দেয়, …।”
এরপর তিনি আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’ সংক্রান- কল্পকাহিনী পুরোপুরি উদ্ধৃত করেন এবং এভাবে তাঁর বর্ণনা শেষ করেন ও বলেন৫ ঃ “এই হল আবু জা‘ফার ইবনে জারীর (রাহেমাহুল্লাহ্‌) কর্তৃক উদ্ধৃত বর্ণনার সংক্ষিপ্তসার।”
৫) ইবনে খালদূন
দার্শনিক ও ঐতিহাসিক ইবনে খালদূন তাঁর ইতিহাস গ্রন্থ আল্‌-মুব্‌তাদা’ ওয়াল্‌-খাবার্‌”-এ একই পথ অনুসরণ করেছেন। তিনিও ওসমান হত্যা ও জঙ্গে জামাল প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’ সংক্রান্ত কল্পকাহিনী টেনে এনেছেন। তিনি তাঁর গ্রন্থে বলেন৬ ঃ “এই হল জঙ্গে জামালের ঘটনা যা আমি আবু জা‘ফার ত্বাবারীর গ্রন্থ থেকে সংক্ষেপে উদ্ধৃত করেছি। আমি এ কারণে এ ব্যাপারে ত্বাবারীর ওপর আস্থা স্থাপন করেছি যে, ত্বাবারী স্বয়ং নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি এবং ইবনে কুতাইবাহ্‌ ও অন্যান্য ঐতিহাসিকদের গ্রন্থে যেসব ত্রুটি আছে তা থেকে তাঁর গ্রন্থ মুক্ত।”
তিনি এরপর লিখেছেন৭ ঃ
“উপসংহারে উল্লেখ করতে চাই যে, ইসলামী খেলাফত, মুরতাদদের ঘটনাবলী, বিজয় সমূহ, যুদ্ধ এরং এরপর মুসলমানদের মধ্যকার ঐসব ঘটনা ও মিলন [অর্থাৎ মু‘আবিয়ার সাথে ইমাম হাসান (আঃ)-এর সন্ধি] সম্পর্কিত সব কিছু ইমাম আবু জা‘ফার ত্বাবারীর বিশাল ইতিহাস গ্রন্থ থেকে সংক্ষেপে উদ্ধৃত করেছি। কারণ, এ গ্রন্থ অন্য যে কোন ইতিহাস গ্রন্থ থেকে অধিকতর নির্ভরযোগ্য এবং এ গ্রন্থে এ উম্মতের বুযুর্গদের প্রতি, বিশেষ করে ছাহাবী ও তাবে‘ঈগণের প্রতি কটাক্ষ ও সংশয় আরোপ এবং তাঁদের উত্তম চরিত্র ও ন্যায়পরায়ণতাকে প্রশ্নবিদ্ধকারী বিষয়াবলীর উদ্ধৃতি পরিহার করা হয়েছে।”
৬) ফারীদ ভাজ্‌দী
ফারীদ্‌ ভাজ্‌দী তাঁর “দায়েরাতুল্‌ মা‘আরেফ্‌” (বিশ্বকোষ)-এর সপ্তম খণ্ডে عثم শব্দের অধীনে ও জঙ্গে জামালের বর্ণনায় হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (আঃ)-এর বর্ণনা দিতে গিয়ে উক্ত কল্পকাহিনীও বর্ণনা করেছেন। তিনি এ ক্ষেত্রে তাঁর তথ্যসূত্র হিসেবে তারীখে ত্বাবারীর কথা উল্লেখ করেছেন।৮
৭) বোস-ানী (ওফাত ১৩০০ হিঃ)
বোস-ানী তাঁর “দায়েরাতুল মা‘আরেফ্‌”-এ ”আবদুল্লাহ্‌ বিন্‌ সাবা” শিরোনামে এ কল্পকাহিনী বর্ণনা করেছেন। তিনি এখানে যা বর্ণনা করেছেন তা ইবনে কাছীর থেকে গ্রহণ করেছেন।
৮) আহ্‌মাদ আমীন
সমকালীন লেখকদের মধ্যে যারা ঐতিহাসিক ঘটনাবলীকে বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা সহকারে উপস্থাপন ও যে কোন ঘটনার মূল উদ্ঘাটনের জন্যে সচেষ্ট তাঁদের মধ্যে আহ্‌মাদ আমীন অন্যতম। তিনি তাঁর গ্রন্থ “ফাজ্‌রুল্‌ ইসলাম”-এ ইরানীগণ ও ইসলামের ওপর তাদের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে, তাঁর ভাষায়, ইসলামে যরথুস্ত্রী ধর্মের প্রভাব সম্পর্কে গ্রন্থে ৯ মায্‌দাক্‌ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তাঁর বক্তব্যের সারসংক্ষেপ হচ্ছে ঃ
“মায্‌দাকী আদর্শের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাওয়াত হচ্ছে তাঁর উপস্থাপিত সমাজতন্ত্রের দাওয়াত। মায্‌দাক্‌ বলতেন, মানুষ অভিন্নরূপে দুনিয়ায় আগমন করে, অতএব, তাদেরকে অভিন্নভাবে জীবন যাপন করতে হবে। এ সাম্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়ে সাম্য বজায় রাখা প্রযোজন তা হচ্ছে সম্পদ ও নারী। কারণ, এ দু’টি বিষয়ই মানুষের মধ্যে শত্রুতা ও যুদ্ধবিগ্রহের কারণ। অতএব, দুশমনীর মূলোৎপাটনের লক্ষ্যে এ দু’টি বিষয়ে সকলকে অংশীদার করা প্রয়োজন। তিনি ধনীদের সম্পদ গরীবদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়াকে অপরিহার্য গণ্য করতেন। নিঃস্ব লোকেরা একে বিরাট সুযোগ মনে করে মায্‌দাকের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়। শেষ পর্যন্ত তিনি এতই শক্তিশালী হয়ে ওঠেন যে, কারো পক্ষেই তাঁর মোকাবিলা করা সম্ভব ছিল না। তিনি লোকদের বাড়ীঘরে হামলা করতেন এবং তাদের ধনসম্পদ ও নারীদের প্রতি হাত বাড়াতেন। … ফলে না পিতা তার সন্তানকে চিনতে পারত, না সন্তান পিতাকে চিনতে পারত, না কারো জন্যে কোন ধনসম্পদ অবশিষ্ট থাকত …।”
আহ্‌মাদ আমীন এরপর লিখেছেন যে, মায্‌দাকের এ আদর্শ ইসলামের প্রসারের যুগেও বানী উমাইয়াহ্‌র খেলাফতের শেষ সময় পর্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী কতক ইরানীর মধ্যে অবশিষ্ট ছিল।
এরপর তিনি লিখেছেন ঃ “আমরা ধনসম্পদের ক্ষেত্রে আবু যার ও মায্‌দাকের মতামতের মধ্যে মিল দেখতে পাই। কারণ, ত্বাবারী বলেছেন যে, আবু যার্‌ শামে অভ্যুত্থান করেন এবং তিনি এই বলে শ্লোগান দেন ঃ “হে ধনী লোকেরা! তোমরা তোমাদের ধনসম্পদ নিঃস্বদের সাথে সমানভাবে ভাগ করে নাও।” তিনি (লোকদের উদ্দেশে) এ আয়াত পড়ে শুনাতেন ঃ “আর যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য জমা করে রাখে এবং তা আল্লাহ্‌র রাস্তায় ব্যয় করে না (হে রাসূল!) তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দিন। সেদিন তা জাহান্নামের আগুনে উত্তপ্ত করা হবে এবং তা দ্বারা তাদের কপাল, পাঁজর ও পিঠকে দগ্ধ করা হবে।”১০ তিনি এ শ্লোগানের এতই পুনরাবৃত্তি করেন যে, গরীব লোকেরা একে তাদের বাহানায় পরিণত করে এবং ধনী লোকদের জন্যে সাম্যের নীতি অনুসরণকে অপরিহার্য গণ্য করে। ধনী লোকেরা তাদের এ দৌরাত্ম্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। পাছে তিনি জনগণকে বিদ্রোহী করে তোলেন এ ভয়ে মু‘আবিয়াহ্‌ তাঁকে মদীনায় খলীফার কাছে পাঠিয়ে দেন।
“ওসমান আবু যারকে জিজ্ঞেস করলেন ঃ লোকেরা তোমার উস্কানি মূলক কথাবার্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে কেন?
“এ ঘটনাবলী থেকে সুস্পষ্ট যে, ধনসম্পদের প্রশ্নে আবু যারের চিন্তাধারা মায্‌দাকের চিন্তাধারার খুবই কাছাকাছি ছিল। এখানে এ প্রশ্ন আসে যে, আবু যার এ ধরনের চিন্তাধারা কার কাছ থেকে শিখেছিলেন?
“আমরা ত্বাবারীর লেখায় এ প্রশ্নের জবাব পাই। তিনি লিখেছেন ঃ ইবনে সাওদা’ (আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’) আবু যারের সাথে সাক্ষাত করে ও তাঁকে এ কাজে প্ররোচিত করে। আর এই ইবনে সাওদা’ আবু দার্‌দা’ ও ‘ইবাদাহ্‌ বিন্‌ ছামেতের১১ নিকটও আসে। কিন্তু তাঁরা তার প্রতারণার শিকার হন নি এবং তার কথা শুনতে প্রস’ত হন নি। এরপর ‘ইবাদাহ্‌ ইবনে সাওদা’কে পাকড়াও করে মু‘আবিয়ার কাছে নিয়ে যান এবং বলেন ঃ “আল্লাহ্‌র শপথ, এই হচ্ছে সেই লোক যে আবু যারকে আপনার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছে।”১২
আহ্‌মাদ আমীন তাঁর কাহিনীর ধারাবাহিকতায় লিখেন ঃ “আমরা জানি যে, ইবনে সাওদা’ ছিল আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’র উপাধি। সে ছিল সান্‌‘আ-র অধিবাসী একজন ইয়াহূদী। ওসমানের শাসনামলে সে মুসলমানদের ধ্বংস করার লক্ষ্যে বাহ্যতঃ ইসলাম গ্রহণ করে। তাই সে বিভিন্ন শহরে অত্যন- ক্ষতিকর চিন-াধারার প্রচার চালায়। … যেহেতু ইবনে সাবা’ হেজায, বসরা, কূফাহ্‌, শাম ও মিসরের অনেক শহরে ভ্রমণ করে সেহেতু এর খুবই সম্ভাবনা রয়েছে যে, সে এ চিন্তাধারা ইরাকের মায্‌দাকীদের নিকট থেকে গ্রহণ করে থাকবে এবং আবু যার তাঁর মনের সরলতার কারণে তার কাছ থেকে তা শিক্ষা গ্রহণ করে থাকবে।”
আহ্‌মাদ আামীন তাঁর গ্রন্তন্থের পার্শ্বটীকায় (হাশীয়্যাহ্‌) লিখেছেন ঃ “এ ব্যাপারে তারীখে ত্বাবারীর পঞ্চম খণ্ড দেখুন।”
তিনি তাঁর এ আলোচনার ধারাবাহিকতায়১৩ এ মর্মে উপসংহার টেনেছেন যে, রাফেযীরা (শিয়ারা) তাদের ‘আক্বিদাহ্‌ মায্‌দাক ও মানীর চিন্তাধারা থেকে গ্রহণ করেছে এবং আলী ও আলে আলী (আলীর বংশধরগণ) সম্পর্কে শিয়াদের ‘আক্বিদাহ্‌ হচ্ছে সাসানী বাদশাহ্‌দের সম্পর্কে পূর্ববর্তী কালের ইরানীদের ‘আক্বিদাহ্‌র অনুরূপ। কারণ, তারা বাদশাহীর ওপর বাদশাহ্‌দের অধিকারকে এক ধরনের খোদা-দত্ত অধিকার বলে মনে করতো।
আহ্‌মাদ আমীন তাঁর গ্রন্থে১৪ ফিরকাহ্‌ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে লিখেছেন ঃ “ওসমানের খেলাফতের শেষ দিকে কয়েকটি গোষ্ঠী গোপনে সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। তারা ওসমানকে ক্ষমতাচ্যুত করা ও অন্য কাউকে শাসকের পদে বসানোর জন্যে লোকদেরকে উস্কানি দিতে থাকে। এ গোষ্ঠীগুলোর মথ্য থেকে কতক লোক আলীর পক্ষে প্রচার চালাতো যাদের মধ্যে সর্বাধিক বিখ্যাত ব্যক্তি হচ্ছে আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’ নামক একজন ইয়াহূদী যে বাহ্যতঃ ইসলাম গ্রহণ করেছিল। সে বসরা, কূফাহ্‌ ও শামে ঘুরে বেড়াতো এবং বলতো ঃ “ প্রত্যেক নবীরই অছি (উত্তরাধিকারী দায়িত্বশীল) ছিলেন আর মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর অছি হচ্ছেন আলী। রাসূলুল্লাহ্‌ (সাঃ)-এর ওয়াছিয়্যাত অনুযায়ী যে ব্যক্তি আমল করে না এবং তাঁর অছির বিপক্ষ অবলম্বন করে তার চেয়ে বড় যালেম আর কে আছে?” ইবনে সাবা’ হচ্ছে জনগণকে ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে ও তাঁকে হত্যা করতে প্ররোচণা দানকারীদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি।”
তিনি এরপর লিখেছেন১৫ ঃ “এ হচ্ছে সেই ইতিহাসের সারসংক্ষেপ যা উদ্ধৃত করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। কারণ, এর ভিত্তিতে তিনটি বড় বড় ইসলামী গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে ঃ …, শিয়া ও …।”
আহ্‌মাদ আমীন তাঁর গ্রন্থের শিয়া বিষয়ক অধ্যায়ে১৬ আরো সুস্পষ্ট ভাষায় এ কল্পকাহিনী বর্ণনা করেন। এক পর্যায়ে তিনি বলেন১৭ ঃ “ইবনে সাবা’ “প্রত্যাবর্তনের ‘আক্বিদাহ্‌” ইয়াহূদী ধর্ম থেকে নিয়ে এসেছে। কারণ, ইয়াহূদীরা বিশ্বাস করে যে, ইলিয়াস নবী আসমানে আরোহণ করেছেন এবং পুনরায় ফিরে আসবেন! … শিয়ারা এ ‘আক্বিদাহ্‌কে ইমামগণের আত্মগোপন (!) ও ইমাম মাহ্‌দীর জন্যে প্রতীক্ষার ‘আক্বিদায় পরিণত করেছে।”
তিনি এর ভিত্তিতে এই বলে গ্রন্থের উপসংহার টেনেছেন১৮ ঃ “প্রকৃত পক্ষে শিয়া মাযহাব হচ্ছে এমন একটি আশ্রয়কেন্দ্র ইসলামের ধ্বংসকামী দুশমনরা প্রতারণা মূলক উদ্দেশ্যে যেখানে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। যে কোন গোষ্ঠীই তাদের ইয়াহূদী, খৃস্টান, যরথুস্ত্রী … ধর্মাবলম্বী তাদের পূর্বসুরিদের দ্বীনী প্রচারকে ইসলামে আমদানী করতে চেয়েছে তারাই রাসূলুল্লাহ্‌র আহ্‌লে বাইতের প্রতি মহব্বতকে তাদের সামনে পর্দা হিসেবে ঝুলিয়ে দিয়েছে; এর আড়ালে তারা যা খুশী আঞ্জাম দিয়েছে। আর শিয়ারা “প্রত্যাবর্তনের ‘আক্বিদাহ্‌” ইয়াহূদীদের নিকট থেকে শিক্ষা করেছে।”১৯
তিনি তাঁর গ্রনে’ লিখেছেন২০ ঃ “ওয়েল্‌হাউসেন্‌ মনে করেন যে, পরস্য থেকে নয়, বরং ইয়াহূদী আদর্শ থেকে শিয়া মাযহাবের উৎপত্তি ঘটেছে, কারণ, এর প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’ ইয়াহূদী ছিল।”
আহমাদ আমীনের বক্তব্যের সার কথা হচ্ছে এই যে, আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’ই শিয়া মাযহাবকে প্রত্যাবর্তন ও ইমামতের ‘আক্বিদাহ্‌ শিক্ষা দিয়েছে এবং ইমামগণের নিষ্পাপ হওয়া ও প্রতিশ্রুত ইমাম মাহ্‌দীর আত্মগোপন সংক্রান- তাদের ‘আক্বিদাহ্‌ও এ উৎস থেকেই উৎসারিত হয়েছে। আর আবু যার সাম্য বা সমাজতান্ত্রিক আদর্শের প্রচার করতেন এবং তিনি তাঁর এ ‘আক্বিদাহ্‌ ইবনে সাবা’র কাছ থেকে শিক্ষা করেছিলেন। ইবনে সাবা’ প্রত্যাবর্তনের ‘আক্বিদাহ্‌ ইয়াহূদদী ধর্ম থেকে আমদানী করে এবং সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা ইরানের মায্‌দাকী চিন-াধারা থেকে গ্রহণ করে। ইসলামে শিয়া মাযহাব সে-ই তৈরী করেছে। তিনি এ-উপসংহার টেনেছেন যে, আহ্‌লে বাইতের প্রতি মহব্বত ইসলামের দুশমনদের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে এবং শিয়া মাযহাবের আশ্রয়ে ইয়াহূদী ধর্মের ও অন্যান্য ধর্মের শিক্ষা ইসলামে প্রবেশ করেছে।
আহ্‌মাদ আমীনের এসব কাল্পনিক তথ্যের ভিত্তি হচ্ছে আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’র কল্পকাহিনী যা তিনি ত্বাবারী থেকে গ্রহণ করেছেন।
যদিও আহ্‌মাদ আমীন এ কল্পকাহিনীকে গবেষণা মূলক বিশ্লেষণের ভঙ্গিতে উপস্থাপন করেছেন, কিন্তু এটা অত্যন্ত সুস্পষ্ট যে, সত্যানুসন্ধিৎসাজাত গবেষণা নয়, শিয়া বিদ্বেষই তাঁকে সত্যের সাথে সম্পর্ক রহিত এ ধরনের কাল্পনিক গালগল্প উপস্থাপনে প্ররোচিত করেছে।
৯) হাসান ইবরাহীম
সমকালীন অন্য যেসব লেখক বিশ্লেষণাত্মকভাবে এ কল্পকাহিনীকে উপস্থাপন করেছেন তাঁদের মধ্যে মিসর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য অনুষদের ইসলামের ইতিহাসের অধ্যাপক ড. হাসান ইবরাহীম অন্যতম। তিনি তাঁর “তারীখুল্‌ ইস্‌লামীস্‌ সিয়াসী” (ইসলামের রাজনৈতিক ইতিহাস) গ্রনে’ খলীফাহ্‌ ওসমানের শাসনামলের শেষ দিককার অবস্থা উল্লেখ করার পর লিখেছেন২১ ঃ
“ … আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’ ও তার অনুসারীদেরকে স্বাগত জানানো ও তার দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার জন্যে পরিবেশ পুরোপুরি প্রস’ত ছিল। রাসূলুল্লাহ্‌ (সাঃ)-এর অন্যতম ছাহাবী আবু যার গিফারী – যিনি তাকওয়া-পরহেযগারীর জন্যে খুবই বিখ্যাত ছিলেন এবং শীর্ষস্থানীয় হাদীছ বর্ণনাকারী ইমামগণের অন্যতম বলে পরিগণিত ছিলেন, তিনি ফিৎনাহ্‌র অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করলেন। তিনি সান্‌‘আ’র অধিবাসী আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’ নামক এক ব্যক্তির অনলবর্ষী বক্তব্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়েন এবং ওসমানের ও ওসমানের পক্ষ থেকে শামের শাসন ক্ষমতা পরিচালনাকারী মু‘আবিয়াহ্‌র শাসনের বিরুদ্ধে বিরোধিতা শুরু করেন। আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’ ছিল একজন ইয়াহূদী; সে ইসলাম গ্রহণ করে এবং ইসলামী শহর সমূহে পরিভ্রমণ করে। সে হেজায থেকে শুরু করে কূফাহ্‌, শাম ও মিসরে গমন করে …।”
তিনি তাঁর গ্রন্থের একই পৃষ্ঠার পার্শ্বটীকায় তাঁর লেখার তথ্যসূত্র হিসেবে ত্বাবারীর কথা উল্লেখ করেছেন।২২ এরপর তিনি তাঁর গ্রন্থে২৩ লিখেছেন ঃ “ইবনে সাবা’ হচ্ছে প্রথম ব্যক্তি যে ওসমানের বিরুদ্ধে সর্বজনীন ঘৃণা উস্কে দেয়। সে ওসমানকে ক্ষমতাচ্যুত করার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।”
তিনি তাঁর গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে চার বার পার্শ্বটীকায় তারীখে ত্বাবারীর যেসব পৃষ্ঠা থেকে এ কাহিনী গ্রহণ করেছেন তার উল্লেখ করেছেন। এছাড়া তিনি (হাসান ইবরাহীম) তাঁর গ্রন্থের ৩৫২ পৃষ্ঠা পর্যন- এ কাহিনীর জের টেনে তিনি বারো বার তাঁর লেখার একমাত্র সূত্র হিসেবে তারীখে ত্বাবারীর পৃষ্ঠা নম্বর সমূহ উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও, ত্বাবারী জঙ্গে জামাল সম্পর্কে যা লিখেছেন তিনি তা উদ্ধৃত করা থেকে বিরত থাকেন, যদিও উভয় কাহিনীতেই ইবনে সাবা’র কল্পকাহিনী রয়েছে এবং গল্পকারও অভিন্ন ব্যক্তি!
এই হল সাবাঈদের কল্পকাহিনী সম্পর্কে বিখ্যাত মুসলিম ঐতিহাসিকগণের বর্ণনার সারসংক্ষেপ যার সূত্র হচ্ছে তারীখে ত্বাবারী। এবার আমরা এ ব্যাপারে অমুসলিম ঐতিহাসিকগণের ভূমিকার প্রতি দৃষ্টি দেবো।
১০) ভন্‌ ফ্লোতেন্‌২৪ (১৮১৮-১৮৮৩)
অন্যতম প্রাচ্যবিশারদ ভন্‌ ফ্লোতেন্‌ তাঁর লিখিত “আরবী শাসন, শিয়া ও বানী উমাইয়াহ্‌ যুগে ইসরাঈলিয়াত্‌” গ্রন্থে২৫ শিয়া মাযহাব সম্পর্কে বলেন ঃ “কিন্তু সাবাঈরা হচ্ছে আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’র সহযোগী। সে হচ্ছে এমন এক ব্যক্তি যে ওসমানের পুরো খেলাফত কালে আলীকে খেলাফতের জন্যে অধিকতর যোগ্য বলে মনে করত।”
তিনি তাঁর গ্রন্থের ৮০ নং পৃষ্ঠার পার্শ্বটীকায় তারীখে ত্বাবারীকে তাঁর তথ্যসূত্র হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং পৃষ্ঠা সমূহের নম্বর নির্দেশ করেছেন।
১১) নিকলসন২৬ (১৮৬৮-১৯৪৫)
নিকলসন তাঁর লেখা “আরবী সাহিত্যের ইতিহাস”২৭ গ্রন্থে লিখেছেন২৮ ঃ “আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’ হচ্ছে সাবাঈ গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠাতা। সে ছিল ইয়েমেনের সান্‌‘আ’র অধিবাসী। বলা হয় যে, সে ইয়াহূদী ছিল এবং ওসমানের শাসনামলে ইসলাম গ্রহণ করে এবং পরিব্রাজক প্রচারকে পরিণত হয়। ঐতিহাসিকগণ তার সম্বন্ধে বলেন ঃ সে মুসলমানদেরকে পথভ্রষ্ট করার ও ভুলে নিক্ষেপ করার উদ্দেশ্যে সব সময় এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় সফর করে বেড়াতো। প্রথমে তাকে হেজাযে দেখা যায়। এরপর সে বসরা ও কূফায় যায়। অতঃপর সিরিয়ায় যায় এবং সেখান থেকে মিসরে গিয়ে বসবাস করতে শুরু করে। সে লোকদেরকে “প্রত্যাবর্তনের ‘আক্বিদাহ্‌” গ্রহণ করার জন্যে আহ্বান করতো।
“ইবনে সাবা’ বলতো ঃ এটা বড়ই আশ্চর্যের বিষয় যে, যে ব্যক্তি হযরত ঈসা (আঃ)-এর এ দুনিয়ায় ফিরে আসার ওপরে বিশ্বাস রাখে সেই একই ব্যক্তি কোরআনে সুস্পষ্ট ভাষায় উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর প্রত্যাবর্তনের ওপর ঈমান রাখবে না! এছাড়া হাজারো নবী এসেছিলেন এবং তাঁদের প্রত্রেকেই স্বীয় অছি ও স্থলাভিষিক্ত রেখে গেছেন; হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)ও আলীকে অছি হিসেবে রেখে গেছেন, আর যেহেতু হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) সর্বশেষ নবী সেহেতু আলী হচ্ছেন সর্বশেষ স্থলাভিষিক্ত।”
তিনি পার্শ্বটীকায় তাঁর লেখার তথ্যসূত্র হিসেবে পৃষ্ঠা নং সহ তারীখে ত্বাবারীর কথা উল্লেখ করেছেন।
১২) এন্‌সাইক্লোপেডিয়া অব্‌ ইসলাম-এর প্রাচ্যবিদ লেখকগণ
একদল প্রাচ্য বিশারদ কর্তৃক রচিত “এন্‌সাইক্লোপেডিয়া অব্‌ ইসলাম”২৯-এ এ সম্পর্কে লেখা হয়েছে ঃ
“আমরা যদি কেবল ত্বাবারী ও মাক্বরীযীর কথাকে যথেষ্ট গণ্য করি তাহলে বলতে হবে যে, আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’ লোকদেরকে যে সব বিষয়ের প্রতি দাওয়াত করতো তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মুহাম্মাদের প্রত্যাবর্তন। তেমনি আবদুল্লাহ্‌ এ তত্ত্বও – যা তার নামে পরিচিত – উপস্থাপন করে যে, সব নবীরই স’লাভিষিক্ত ছিলেন এবং আলী হচ্ছেন মুহাম্মাদের স্থলাভিষিক্ত। অতএব, প্রতিটি ঈমানদার ব্যক্তির জন্যে স্বীয় কথা ও আচরণের দ্বারা আলীর অধিকারের প্রতি সমর্থন জানানো অপরিহার্য। আবদুল্লাহ্‌ তার এ চিন্তাধারা প্রচার করার জন্যে বেশ কিছু লোককে নিয়োগ করেছিল এবং সে ছিল ঐ সব লোকদের অন্যতম যারা হিজরী ১৫ সালের শাওয়াল মাসে (মোতাবেক ৬৫৬ খৃস্টাব্দের এপ্রিল মাসে) মিসর থেকে মদীনায় রওযানা হয়ে যায় …।”
এনসাইক্লোপেডিয়া অব্‌ ইসলাম-এ ত্বাবারী থেকে যা উদ্ধৃত করা হয়েছে ওপরে আমরা তার উল্লেখ করেছি। অন্যদিকে মাক্বরীযীর সময় থেকে ঘটনার কাল আটশ’ বছর পূর্বেকার। সময়ের এ ব্যবধানের প্রশ্ন ছাড়াও মাক্বরীযী তাঁর গ্রন্থে এ ঘটনার তথ্যসূত্র উল্লেখ করেন নি। তাই তাঁর বর্ণনার ওপর নির্ভর করা যায় না। অন্যদিকে ত্বাবারী মাক্বরীযী থেকে পাঁচশ’ বছর আগেকার লোক এবং তিনি তাঁর বর্ণনার সূত্র উল্লেখ করেছেন। এ কারণে মাক্বরীযীর বর্ণনাকে ত্বাবারীর বর্ণনার সাথে এক কাতারে ফেলা যায় না। তা সত্ত্বেও আমরা এ গ্রন্থের শেষের দিকে মাক্বরীযীর বর্ণনা সম্পর্কে আলোচনা করবো।
১৩) ডুওয়াইট এম. ডোনাল্ডসন্‌ ৩০
ডোনাল্ডসন তাঁর “শিয়া ‘আক্বিদাহ্‌”৩১ গ্রন্থে বলেন ঃ “প্রাচীনতম বর্ণনা সমূহ আমাদেরকে এ উপসংহারে উপনীত করে যে, আলী যে খেলাফতের দাবী করেন তা তাঁর বন্ধুদের ও শিয়াদের দৃষ্টিতে কেবল রাজনৈতিক বিষয়ই ছিল না, বরং তা ছিল এক ঐশী অধিকার। ইসলামের ইতিহাসে যে রহস্য জনক ব্যক্তির চিন্তা, শিক্ষা ও চক্রান্ত ছিল এ ‘আক্বিদাহ্‌র পিছনে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। ওসমানের খেলাফত কালে আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’ নামে এক ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে; সে এ ব্যাপারে ব্যাপক প্রচারের আশ্রয় নেয়। সে সকল ইসলামী শহর চষে বেড়ায়। ত্বাবারী যেমন বলেন, তার লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের ধ্বংস সাধন …।”
উক্ত গ্রন্থের ৫৯ নং পৃষ্ঠার পাদটীকা থেকে মনে হয় গ্রন্থকার সরাসরি ত্বাবারী থেকে উদ্ধৃত করেন নি। বরং তিনি দু’টি গ্রন্থ থেকে এ কাহিনী গ্রহণ করেছেন। গ্রন্থ দু’টি হচ্ছে ঃ
১) প্রাচ্যবিদগণের রচিত এন্‌সাইক্লোপেডিয়া অব্‌ ইসলাম ঃ “আবদুল্লাহ্‌ বিন্‌ সাবা” শীর্ষক আলোচনা। এ গ্রন্থ সম্বন্ধে পূর্বে অলোচনা করা হয়েছে।
২) নিকলসন রচিত “আরবী সাহিত্যের ইতিহাস”৩২। এ সম্পর্কেও পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে।
পূর্বে যেমন উল্লেখ করা হয়েছে, এ উভয় সূত্রই আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’ সংক্রান্ত কাহিনী তারীখে ত্বাবারী থেকে গ্রহণ করেছে।
১৪) ওয়েল্‌হাউসেন৩৩ (১৮৪৪-১৯১৮)
ওয়েলহাউসেন তাঁর “আরব রাজত্ব ও তার পতন”৩৪ গ্রন্থে বলেন ঃ “সাবাঈরা ইসলামকে পরিবর্তিত করে দেয়। কোরআনের বিপরীতে তারা বিশ্বাস করতো যে, আল্লাহ্‌র আত্মা রাসূলের দেহে প্রবেশ (হুলূল্‌) করেছে এবং রাসূলের ওফাতের পরে আলীর ও আলীর বংশধরদের দেহে প্রবেশ করেছে। তাদের দৃষ্টিতে, আলী আবু বকর ও ওমরের সমপর্যায়ভুক্ত খলীফাহ্‌ ছিলেন না। বরং তারা ঐ দুই জনকে অন্যায়ভাবে তাঁর অধিকার জবর দখলকারী বলে গণ্য করতো এবং বিশ্বাস করতো যে, পবিত্র রূহ্‌ আলীর ভিতরে প্রবেশ করেছে।”
এরপর তিনি বলেন ঃ “সাবাঈরা ইবনে সাবা’র সাথে সম্পর্কিত। ইবনে সাবা’ নিজে ছিল ইয়েমেনের অধিবাসী একজন ইয়াহূদী।”
ওয়েলহাউসেন এখানে তাঁর তথ্যসূত্র উল্লেখ করেন নি। তবে গ্রন্থের এক জায়গায় ৩৫ তিনি বিষয়টি আরো বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন ঃ “সাবাঈরা শুরু থেকেই ছিল দুর্বৃত্ত ও নেতিবাচক চিন্তাধারার অধিকারী। তারা ওসমানকে হত্যা করে এবং মুসলমানদের জন্যে বিশৃঙ্খলা ও গৃহযুদ্ধের দরযা খুলে দেয়। তাদের বেশীর ভাগই মাওয়ালী (মুক্তিপ্রাপ্ত ক্রীতদাস) ও অনারব ছিল।
“সাবাঈরা ইবনে সাবা’র অনুসরণে বিশ্বাস করতো যে, রাসূলুল্লাহ্‌র আত্মা প্রত্যাবর্তন করে ও তাঁর আহ্‌লে বাইতের সদস্যদের শরীরে প্রবেশ করে। নবী-কন্যা ফাতেমার গর্ভে ও আলীর ঔরসে জন্মগ্রহণকারীগণ ইসলাম ও তাঁদের আরব বংশধারা থেকে হাত গুটিয়ে নেন নি; তাঁরা সাবাঈদের বিতাড়িত করেন। কিন্তু সাবাঈরা আলীর অপর সন্তান মুহাম্মাদ বিন্‌ আল-হানাফীয়্যাহ্‌র সাথে যোগ দেয়। তাঁর পুত্র আবু হাশেম – যিনি তাঁর পিতার মতোই মর্যাদা বঞ্চিত ছিলেন – তাদের ইমামে পরিণত হন। আবু হাশেম তাঁর পরবর্তী অছি হিসেবে মুহাম্মাদ বিন্‌ আলী আব্বাসীকে মনোনীত করে যান এবং এখান থেকেই (তাদের) খেলাফত বানূ আব্বাসের নিকট হস্তান্তরিত হয়। সাইফের বর্ণনা অনুযায়ী বানূ আব্বাসের অভিযান সাবাঈদের অভিযানেরই অনুরূপ ছিল। উভয় গোষ্ঠীরই দাওয়াতের কেন্দ্র ছিল কূফাহ্‌ ও অনুসারীরা ছিল ইরানী; উভয় গোষ্ঠীই আরব মুসলমানদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়।”
এই হল ওয়েলহাউসেন কর্তৃক সাইফ থেকে উদ্ধৃত বর্ণনার সংক্ষিপ্তসার। তিনি তাঁর লেখায় দুই বার সাইফের নাম উল্লেখ করেছেন। তিনি তাঁর গ্রনে’র ভূমিকায় সাইফের প্রশংসা করেছেন যা থেকে সুস্পষ্ট বুঝা যায় যে, ওয়েলহাউসেন তাঁর বর্ণিত কাহিনী তারীখে ত্বাবারী থেকে গ্রহণ করেছেন।
বুঝা যায় যে, আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’র কল্পকাহিনী বিস্ময়কর খ্যাতি লাভ করেছিল। আমরা এ পর্যন্ত দেখতে পেলাম যে, কাহিনীটি সকলেই কোন মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি বা একটিমাত্র মাধ্যম হয়ে ত্বাবারী থেকে উদ্ধৃত করেছেন। অবশ্য কতক ঐতিহাসিক ও লেখক কোনরূপ সূত্র উল্লেখ না করেই এ কাহিনী বর্ণনা করেছেন। কিন্তু যে ক্ষেত্রেই মোটামুটিভাবে (এজমালীভাবে) তথ্যসূত্রের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেখানেই ত্বাবারী বা তাঁর গ্রন্থের কথা অথবা ত্বাবারী থেকে গ্রহণ করেছেন এমন কোন গ্রন’কারের গ্রন্থের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
১৫) মীর্‌খান্দ্‌
যদিও আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’র কল্পকাহিনী ব্যাপকভাবে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, যে কোন লেখকই এ কাহিনী হয় সরাসরি ত্বাবারী থেকে গ্রহণ করেছেন অথবা ত্বাবারীর তথ্য ব্যবহারকারী গ্রন’ থেকে গ্রহণ করেছেন। তবে কোন কোন লেখক তাঁদের গ্রনে’ আদৌ কোন তথ্যসূত্রের কথা উল্লেখ করেন নি। কিন্তু গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয় যে, তাঁরাও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ত্বাবারী থেকেই এ কাহিনী গ্রহণ করেছেন। এ ধরনের একজন লেখক হলেন মীর্‌খান্দ্‌ যিনি তাঁর গ্রন’ “রাওযাতুছ্‌ ছাফা”য় আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’র কল্পকাহিনী উদ্ধৃত করেছেন। তিনি তাঁর গ্রনে’ সূত্রের উল্লেখ করেন নি, কিন্তু গবেষণায় প্রমাণিত হয় যে, তিনি ত্বাবারী থেকেই এ কল্পকাহিনী গ্রহণ করেছেন।
১৬) গিয়াসুদ্দীন (ওফাত ৯৪০ হিঃ/ ১৪৫৫ খৃঃ)
গিয়াসুদ্দীন হচ্ছেন মীর্‌কান্দের পুত্র। তিনি তাঁর গ্রন’ “হাবীবুস্‌ সায়র্‌”-এ আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’র কল্পকাহিনী তুলে ধরেছেন। গ্রন্থের ভূমিকার উল্লেখ অনুযায়ী তিনি তাঁর পিতার লেখা “রাওযাতুছ্‌ ছাফা” থেকে এ কাহিনী গ্রহণ করেছেন।
ওপরের আলোচনা থেকে সুস্পষ্ট যে, সকল গ্রন্থকারই আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’র কাহিনী তারীখে ত্বাবারী থেকে গ্রহণ করেছেন এবং এ কাহিনীর উল্লেখ সম্বলিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে তারীখে ত্বাবারী হচ্ছে প্রাচীনতম গ্রন্থ – যাতে তথ্যসূত্র সহকারে এ কাহিনী বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
এবার আমরা দেখবো ত্বাবারী কার কাছ থেকে এ কল্পকাহিনী গ্রহণ করেছেন।
১৭) ত্বাবারী ও তাঁর তথ্যসূত্র
আবু জা‘ফার মুহাম্মাদ বিন্‌ জারীর ত্বাবারী (ওফাত ৩১০ হিঃ) তাঁর লেখা গ্রন্থ “তারীখুল্‌ উমাম্‌ ওয়াল্‌-মুলূক্‌”-এ শুধু সাইফ্‌ বিন্‌ ওমর তামীমী কূফী থেকে আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’ সংক্রান্ত কাহিনী বর্ণনা করেছেন। তিনি হিজরী ৩০ সালের ঘটনা সম্পর্কে লিখেছেন ঃ
“এ বছরই অর্থাৎ হিজরী ৩০ সালে মু‘আবিয়াহ্‌র সাথে আবু যারের ঘটনা এবং মু‘আবিয়াহ্‌ কর্তৃক আবু যারকে মদীনায় পাঠিয়ে দেয়ার ঘটনা সংঘটিত হয়। এ ব্যাপারে বহুবিধ ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু আমি সেগুলো উদ্ধৃত করা পসন্দ করছি না। তবে যারা এ ব্যাপারে মু‘আবিয়াহ্‌র সপক্ষে ছাফাই গেয়েছেন তাঁরা এ সম্পর্কে একটি কাহিনী উল্লেখ করেছেন। সারী আমার নিকট তা লিখে পাঠিয়েছেন; তাতে তিনি লিখেছেন ঃ শু‘আইব সাইফের উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁর নিকট বর্ণনা করেছেন যে, সাইফ বলেছেন, … ইবনে সাওদা’ যখন শামে পৌঁছে তখন সে আবু যারের সাথে সাক্ষাৎ করে এবং বলে ঃ হে আবু যার! তুমি দেখতে পাচ্ছ মু‘আবিয়াহ্‌ কী সব কাজ করছে?”
এরপর ত্বাবারী শুধু সাইফ থেকে ইবনে সাবা’র কাহিনী বর্ণনা করেন এবং এ বাক্যটির মাধ্যমে আবু যারের ঘটনার সমাপ্তি টানেন ঃ
“অন্যরা এ ব্যাপারে (আবু যারের নির্বাসনের ব্যাপারে) অনেক অপসন্দনীয় বিষয় বর্ণনা করেছেন – যা বর্ণনা করা আমি পসন্দ করছি না।”
তিনি যখন হিজরী ৩০ থেকে ৩৬ সাল পর্যন্তকার ঘটনাবলী বর্ণনা করেন তখন তিনি সাইফ থেকে খলীফা ওসমানের নিহত হওয়া ও জঙ্গে জামালের ঘটনা প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’ ও সাবাঈদের কাহিনী বর্ণনা করেন এবং এ ক্ষেত্রে তিনি একমাত্র সাইফ ছাড়া অন্য কোন তথ্যসূত্রেরই উল্লেখ করেন নি।
ত্বাবারী তাঁর গ্রন্থে নিম্নোক্ত দু’টি সূত্রক্রম (সানাদ্‌) থেকে সাইফের রেওয়াইয়াত উদ্ধৃত করেছেন ঃ
১) ওবাইদ্‌ বিন্‌ সা‘দ্‌ যুহ্‌রী, তিনি তাঁর চাচা ইয়াকুব্‌ বিন্‌ ইবরা  যে সব রেওয়াইয়াত উদ্ধৃত করেছেন ওবাইদ্‌ সেগুলো শুনেছেন এবং “হাদ্দাছানী” (আমাকে জানিয়েছেন) বা “হাদ্দাছানা” (আমাদেরকে জানিয়েছেন) বাক্যাংশ যোগে বর্ণনা করেছেন।
 ২) সারী বিন্‌ ইয়াহ্‌ইয়া শুয়াইব্‌ বিন্‌ ইবরাহীম থেকে এবং তিনি সাইফ্‌ থেকে।
 ত্বাবারী এ সনদে সাইফের বর্ণিত রেওয়াইয়াত সমূহ “আল্‌-ফুতূহ্‌” ও “আল্‌-জামাল্‌” – এই দু’টি গ্রন্থ থেকে নিম্নোক্ত তিনটি বাক্যাংশ যোগে বর্ণনা করেছেন ঃ
 ১) “কাতাবা ইলাইয়া” (আমার নিকট লিখেছেন)।
 ২) “হাদ্দাছানী” (আমাকে জানিয়েছেন)।
 ৩) “ফী কিতাবিহি ইলাইয়া” (আমার নিকট লিখিত তাঁর পত্রে …)।
 এ হল ত্বাবারীর বিশেষ সনদ সংক্রান্ত আলোচনা।
১৮) ইবনে ‘আসাকের্‌-এর ধারাবাহিক সনদ সমূহ
 ত্ববারীর পরে এ কল্পকাহিনীর অন্য সনদও রয়েছে, তা হচ্ছে ইবনে ‘আসাকের-এর (ওফাত ৫৭১ হিঃ) সনদ।
 ইবনে ‘আসাকের তাঁর আশি খণ্ড বিশিষ্ট “তারীখু মাদীনাতি দামিশ্‌ক্‌”-এ ত্বাল্‌হা, আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’ ও অন্যদের সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে এ কল্পকাহিনী স্বীয় সনদে সাইফ্‌ থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি তাঁর সনদের বিষয়টি এভাবে উল্লেখ করেছেন ঃ
 “ইবনে ‘আসাকের আবূল কাসেম সামারকান্দী থেকে, তিনি আবূল হুসাইন নাকূর্‌ থেকে, তিনি আবু ত্বাহের মুখাল্লাছ থেকে, তিনি আবু বকর বিন্‌ সাইফ্‌ থেকে, তিনি সারী থেকে, তিনি শু‘য়াইব থেকে, তিনি সাইফ্‌ থেকে, …।”
 অতএব, দেখা যাচ্ছে যে, ইবনে ‘আসাকের-এর সনদ চারটি স্তর পার হয়ে সারী বিন্‌ ইয়াহ্‌ইয়া পর্যন্ত পৌঁছেছে এবং সারী বিন্‌ ইয়াহ্‌ইয়া হচ্ছেন ত্বাবারীর দু’টি সনদসূত্রের অন্যতম।
১৯) ইবনে বাদ্‌রান্‌ ঃ (ওফাত ১৩৪৬ হিঃ)
 ইবনে বাদ্‌রান্‌ ইবনে ‘আসাকের-এর ইতিহাসকে সংক্ষেপণ করেন এবং একে “তাহ্‌যীবু ইবনে ‘আসাকের” নামকরণ  করেন। তিনি এ গ্রন্থে বেশীর ভাগ রেওয়াইয়াতই বর্ণনাকারীর নামোল্লেখ ছাড়াই উদ্ধৃত করেছেন। তিনি এ গ্রন্থে আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’র কাহিনীও বর্ণনা করেছেন এবং এ ক্ষেত্রে কখনো বর্ণনাকারী হিসেবে সাইফের নাম উল্লেখ করেছেন এবং কখনো বর্ণনাকারীর নাম উল্লেখ ছাড়াই কাহিনী তুলে ধরেছেন। কোন কোন ক্ষেত্রে তিনি সাইফের রেওয়াইয়াত ত্বাবারী থেকে গ্রহণ করেছেন। উদাহরণ স্বরূপ, যিয়াদ বিন্‌ আবিহ্‌র কথা আলোচনা করতে গিয়ে তিনি ত্বাবারী থেকে সাইফের রেওয়াইয়াত উদ্ধৃত করেছেন।
২০) ইবনে আবি বাক্‌র্‌ ঃ (ওফাত ৭৪১ হিঃ)
 ইবনে সাবা’ ও সাবাঈ সংক্রান্ত কাহিনীর অন্য সনদও রয়েছে। কতক লেখক এসব সনদকে স্বীয় বক্তব্যের ভিত্তি করেছেন। এদের মধ্যে ইবনে আবি বাক্‌র অন্যতম। তিনি তৃতীয় খলীফাহ্‌ ওসমানের নিহত হবার ঘটনাবলী সম্বলিত তাঁর লেখা “আত্‌-তাম্‌হীদ্‌” গ্রনে’ এর তথ্যসূত্রের তালিকায় সাইফের লেখা “আল-ফুতূহ্‌” পুস্তক ও তারীখে ইবনে আছীরের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’র কাহিনী কখনো সরাসরি সাইফের বরাতে উল্লেখ করেছেন এবং কখনো তারীখে ইবনে আছীর থেকে উল্লেখ করেছেন। আর আমরা জানি যে, ইবনে আছীর এ কাহিনী তারীখে ত্বাবারী থেকে গ্রহণ করেছেন।
 এ পর্যন্ত আমরা আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’ ও সাবাঈদের সম্পর্কিত কাহিণী বর্ণনার ক্ষেত্রে তিনটি সনদ ধারাবাহিকতা দেখতে পেয়েছি, তা হচ্ছে ঃ
 ১) ত্বাবারী (ওফাত ৩১০ হিঃ)
 ২) ইবনে ‘আসাকের (ওফাত ৫৭১ হিঃ)
 ৩) ইবনে আবি বাক্‌র্‌ (ওপাত ৭৪১ হিঃ)
 অনেক লেখক উপরোক্ত তিনটি সনদের কোন একটির বরাত দিয়ে লিখেছেন, কেউ দু’জনের বরাত দিয়েছেন এবং কেউ বা তিন জনের বরাত দিয়েছেন।
২১) সা‘ঈদ আফগানী ঃ
 সা‘ঈদ আফগানী তাঁর লেখা “আয়েশাতু ওয়াস্‌-সিয়াসিয়্যাহ্‌” গ্রন্থে বিভিন্ন শিরোনামে ইবনে সাবা’র কাহিনীর বিভিন্ন অংশ বর্ণনা করেছেন। এসব শিরোনামের মধ্যে রয়েছে ঃ ‘ওসমানের প্রতিবাদ’, ‘ইবনে সাবা ঃ ভয়ঙ্কর ও রহস্য জনক বীর নায়ক’, ‘সন্ধি পর্যবেক্ষণ এবং ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত’ ইত্যাদি। তাঁর লেখার তথ্যসূত্র প্রথমতঃ তারীখে ত্বাবারী; দ্বিতীয় পর্যায়ে তারীখে ইবনে ‘আসাকের ও তাঁর “তাহ্‌যীব” গ্রন্থ এবং তৃতীয় পর্যায়ে ইবনে আবি বাক্‌রের “তাম্‌হীদাত্‌” গ্রন্থ।৩৬ তিনি তাঁর গ্রনে’৩৭ পঞ্চম পৃষ্ঠায় ত্বাবারীর ওপর সর্বাধিক নির্ভর করার কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন ঃ “আমি তারীখে ত্বাবারীর ওপর সর্বাধিক আস্থা স্থাপন করেছি, কারণ, এ গ্রন্থটি অন্য যে কোন তথ্যসূত্রের তুলনায় প্রকৃত অবস্থার অধিকতর কাছাকাছি এবং এর লেখকও অন্যদের তুলনায় অধিকতর নির্ভরযোগ্য। আর তাঁর পরবর্তী সকল ঐতিহাসিকই তাঁর ওপর আস্থা স্থাপন করেছেন। … তাই আমি তাঁর ব্যবহৃত শব্দাবলী অপরিবর্তিতভাবে ব্যবহারের জন্যে সাধ্যানুযায়ী চেষ্টা করেছি।” 
২২) যাহাবী (ওফাত ঃ ৭৪৮ হিঃ/ ১২৬৩ খৃঃ)
 যাহাবী তাঁর “তারীখুল ইসলাম” গ্রন্থে এ কাহিনীর কয়েকটি অংশ উদ্ধৃত করেছেন। তিনি এ কল্পকাহিনীকে পূর্ণতর রূপে উপস্থাপনের লক্ষ্যে এর শুরুতে সাইফ্‌ থেকে এমন দু’টি রেওয়াইয়াত উদ্ধৃত করেছেন যা তারীখে ত্বাবারীতে নেই। এরপর তিনি ত্বাবারী কর্তৃক বিস্তারিতভাবে উপস্থাপিত কাহিনী সংক্ষেপে উপস্থাপন করেছেন।
 যাহাবী “তারীখুল ইসলাম” গ্রন্থে ইবনে সাবা’র কাহিনী ও অন্যান্য কাহিনী নির্বিশেষে সাইফের রেওয়াইয়াতকে ভূমিকা হিসেবে গণ্য করেছেন। তিনি তাঁর গ্রন্থের সূত্র সমূহকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন ঃ
 প্রথমতঃ যে সব গ্রন্থ থেকে এ গ্রন্থের বিভিন্ন বিষিয় ‘উদ্ধৃত’ করা হয়েছে – যা এ গ্রন্থের মূল বিষয়বস্তু। তিনি সাইফের “আল-ফুতূহ্‌” পুস্তককে এ ধরনের তথ্যসূত্রের অন্তর্ভুক্ত গণ্য করেছেন।
 দ্বিতীয়তঃ সেই সব গ্রন্থ যা থেকে কিছু বিষয় সংক্ষেপ করে গ্রহণ করা হয়েছে।
 তৃতীয়তঃ সে যব গ্রন্থ বেশী পরিমাণে ব্যবহার করা হয়েছে। তারীখে ত্বাবারী এর মধ্যে অন্যতম।
 এ থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, সাইফের লিখিত “আল-ফুতূহ্‌” পুস্তকটি যাহাবীর যুগ (হিজরী অষ্টম শতাব্দী) পর্যন্ত পাওয়া যেত এবং যাহাবীর নিকট এর কপি ছিল, আর ইবনে আবি বাক্‌রের ন্যায় তিনি সরাসরি এ পুস্তক থেকে উদ্ধৃত করেছেন। আর এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এমন রেওয়াইয়াত ত্বাবারী যা উদ্ধৃত করেন নি।
 এ অধ্যায়ে যা কিছু আলোচনা করা হল তার উপসংহার হচ্ছে এই যে, ঐতিহাসিকগণ আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’ সংক্রান্ত যে কল্পকাহিনী বর্ণনা করেছেন তার একমাত্র মূল সূত্র হচ্ছে সাইফ্‌ বিন্‌ ওমরের বর্ণনা; এ ক্ষেত্রে কোনই ব্যতিক্রম নেই। আর তাঁদের মধ্যে চার ব্যক্তি অর্থাৎ ত্বাবারী, ইবনে ‘আসাকের, ইবনে আবি বাক্‌র্‌ ও যাহাবী সাইফ্‌ থেকে সরাসরি উদ্ধৃত করেছেন।
পাদটীকা ঃ
১. স্মর্তব্য গ্রন্থটি প্রায় অর্ধ শতাব্দী কাল পূর্বে রচিত।
২. সাইয়েদ রাশীদ রেযা, আশ্‌-শি‘আতু ওয়াস্‌-সুন্নিয়্যাহ্‌, পৃঃ ৪-৬।
৩. মিসরীয় সংস্করণ, ১৩৪৮ হিঃ, পৃঃ ৫।
৪. আল-বিদাইয়্যাহ্‌ ওয়ান্‌-নিহাইয়্যাহ্‌, ৭ম খণ্ড, পৃঃ ১৬৭।
৫. প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৪৬।
৬. আল্‌-মুব্‌তাদা’ ওয়াল্‌-খাবার্‌, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৪২৫।
৭. প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৫৭।
৮. পৃঃ ১৬৮-১৬৯।
৯. পৃঃ ১০৯-১১১।
১০. সূরাহ্‌ আত্‌-তাওবাহ্‌ ঃ ৩৪-৩৫।
১১. উভয়ই হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর ছাহাবী। তাঁরা ছিলেন আনছার।
১২. আবু যার সম্পর্কে উক্ত যা কিছু বলা হয়েছে তার সবই ছিল সাইফ্‌ বিন্‌ ওমর কর্তৃক রচিত মিথ্যা কাহিনী। ধনী লোকদের সাথে আবু যারের কোন ব্যাপার ছিল না। বরং তাঁর ব্যাপার ছিল মু‘আবিয়াহ্‌ ও বনী উমাইয়ার অন্যান্য প্রশাসকদের সাথে। তাঁরা মুসলমানদের বায়তুল মালকে যথেচ্ছাভাবে ভোগ করতেন। কিন্তু কেউই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে সাহসী হন নি। কেবল আবু যার ও আম্মারের মতো কয়েক জন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আত্মত্যাগের পরিচয় দেন।
১৩. ফাজ্‌রুল্‌ ইসলাম, পৃঃ ১১২।
১৪. পৃঃ ২৫৪।
১৫. পৃঃ ২৫৫।
১৬. পৃঃ ২৬৬-২৭৮।
১৭. পৃঃ ২৭০।
১৮. পৃঃ ২৭৬।
১৯. আহ্‌মাদ আমীনের লেখা “ফাজ্‌রুল্‌ ইসলাম” গ্রন’টি বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কিত শিক্ষাদান কার্যে ব্যহৃত হয় এবং এ গ্রন্থের মাধ্যমে শিয়া মাযহাব সম্পর্কে এ মনগড়া ধারণাই দেয়া হচ্ছে।
২০. পৃঃ ২৭৭।
২১. তারীখুল্‌ ইস্‌লামীস্‌ সিয়াসী, পৃঃ ৩৪৮।
২২. তারীখে ত্বাবারী, ইউরোপে মুদ্রিত, প্রথম ভাগ, পৃঃ ২৮৫৯।
২৩. ফাজ্‌রুল্‌ ইসলাম, পৃঃ ৩৪৯।
২৪. Johannes Van Flotten (Volten)
২৫.  ড. হাসান ইবরাহীম ও মুহাম্মাদ যাকী ইবরাহীম কর্তৃক আরবী ভাষায় অনূদিত এবং ১৯৩৪ সালে মিসর থেকে প্রথম বার (আরবী অনুবাদ) প্রকাশিত। এখানে আরবী অনুবাদের ৭৯ নং পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধৃত করা হয়েছে।
২৬. Reynold Alleyne Nicholson
২৭. ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত।
২৮. পৃঃ ২১৫।
২৯.  লন্ডন থেকে প্রকাশিত, ১ম খণ্ড, পৃঃ ২৯।
৩০. Dewight M. donaldson
৩১. আরবী অনুবাদ, পৃঃ ৫৮।
৩২. আরবী অনুবাদ, পৃষ্ঠা নং ৩১৫।
৩৩. Julius Wellhousen
৩৪. আরবী অনুবাদ, পৃঃ ৫৬-৫৭।
৩৫. পৃঃ ৩৯৬-৩৯৯।
৩৬. তিনি এসব গ্রন্থের যে সব পৃষ্ঠা থেকে তথ্য গ্রহণ করেছেন তা-ও উল্লেখ করেছেন।
৩৭. পৃঃ ৫।

Leave A Reply

Your email address will not be published.