সাইফ ও তার রেওয়াইয়াত সম্পর্কে পর্যালোচনা
ইতিপূর্বে যেমন উল্লেখ করেছি, বিগত হাজার বছর যাবত যে সব ঐতিহাসিক আবদুল্লাহ্ ইবনে সাবা’ সম্পর্কিত কল্পকাহিনী বর্ণনা করেছেন তাঁদের সকলেরই মূল তথ্যসূত্র হচ্ছে মাত্র একজন। সে হচ্ছে সাইফ্ বিন ওমর তামীমী। এখন আমরা তার অবস্থা ও তার রেওয়াইয়াত সমূহ পর্যালোচনা করব।
কে এই সাইফ?
সাইফ্ বিন্ ওমর বানূ তামীমের শাখাগোত্র বানূ উসাইয়্যাদের লোক। এ কারণে তাকে “উসাইয়্যাদী তামীমী” হিসেবে অভিহিত করা হয়। এছাড়া বানূ তামীমের অপর এক শাখাগোত্র বার্জামের সাথে বানূ উসাইয়্যাদের মৈত্রী বন্ধন থাকায় তাকে “তামীমী বার্জামী”ও বলা হয়।
সাইফ্ বিন্ ওমর কূফার অধিবাসী ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে তাকে “কূফী বংশোদ্ভূত বাগদাদী” বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
ছাফীউদ্দীন তাঁর “খুলাছাতুত্ তাহ্যীব্” গ্রন্থে সাইফের মৃত্যু হিজরী ১৭০ সালে বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু ইসমাঈল বাগদাদী তাঁর “হিদাইয়াতুল্ ‘আরেফীন্” গ্রন্থে সাইফের মৃত্যু হিজরী ২০০ সালে বলে লিখেছেন।
সাইফের রেওয়াইয়াত সমূহ
যেহেতু তৎকালে ঐতিহাসিকগণ তাঁদের বর্ণিত ঘটনাবলীর বিস্তারিত ও ধারাবাহিক সূত্র উল্লেখ করতেন সেহেতেু স্বীয় রচিত কল্পকাহিনীগুলোকে সত্যিকারের ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে বিশ্বাস করানোর লক্ষ্যে সাইফ্ একটি ঘটনাকে কয়েক ভাগে বিভক্ত করে এবং প্রতিটি ভাগের জন্যে স্বতন্ত্র ধারাবাহিক সনদ (বর্ণনাকারী পরম্পরা) তৈরী করে উপস্থাপন করে। সে এ পদ্ধতিতে দু’টি পুস্তক রচনা করে ঃ
১) আল্-ফুতূহুল্ কাবীর ওয়ার্-রিদ্দাহ্ ঃ এ পুস্তকে সে হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর ওফাতের সমসাময়িক কালের ঘটনাবলী থেকে শুরু করে ওসমানের খেলাফতের সময় পর্যন্তকার ঘটনাবলী বর্ণনা করেছে। এ পুস্তকেই সে খলীফাহ্ আবু বকর কর্তৃক মুরতাদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘটনাবলীও বর্ণনা করেছে। এরপর সে মুসলমানদের দ্বারা পূর্ব রোম সাম্রাজ্যভুক্ত এলাকা শাম ও ফিলিস্তিন এবং ইরান বিজয়ের ঘটনাবলী উল্লেখ করেছে। এসব ক্ষেত্রে সে অনেক অবাস্ত কল্পকাহিনীও পরিবেশন করেছে।
২) আল্-জামাল্ ওয়া মাসীরু ‘আয়েশাতা ওয়া ‘আলী ঃ এ পুস্তকে সে খলীফাহ্ ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও তাঁকে হত্যার এবং জঙ্গে জামালের ঘটনাবলী বর্ণনা করেছে। সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলী সম্পর্কে তার রেওয়াইয়াত সমূহ পর্যালোচনা করলে এটা অত্যন্ত সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, এ পুস্তক রচনার পিছনে তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বানূ উমাইয়্যাহ্র প্রতি সমর্থন জানানো।
উপরোক্ত দু’টি পুস্তক রচনা ছাড়াও সাইফের আরো কিছু রেওয়াইয়াত রয়েছে যা ডজন ডজন গ্রন্থের মাধ্যমে বর্তমান যুগ পর্যন্ত পৌঁছেছে এবং ঐতিহাসিকগণের নিকট তার পুস্তক দু’টি ও অন্যান্য রেওয়াইয়াত ইসলামের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দলীল হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।
ত্বাবারী তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে হিজরী ১১ সাল থেকে ৩৬ সাল পর্যন্তকার ঘটনাবলী বর্ণনার ক্ষেত্রে সাইফের রেওয়াইয়াত সমূহ ব্যবহার করেছেন।
তাঁর পরে ইবনে ‘আসাকেরও তাঁর ইতিহাস গ্রন্থে সাইফের রেওয়াইয়াত গ্রহণ করেছেন।
এছাড়া আরো অনেক বিখ্যাত মনীষী হরাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর কতক ছাহাবীর পরিচয় ও তাঁদের সাথে সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলী বর্ণনার ক্ষেত্রে সাইফের রেওয়াইয়াত গ্রহণ করেছেন। এদের মধ্যে রয়েছেন ঃ
ইবনে আবদুল বার্ (ওফাত ৪৩৬ হিঃ) তাঁর “আল্-ইস্তি‘আব্” গ্রন্থে।
ইবনে আছীর (ওফাত ৬৩০ হিঃ) তাঁর “উস্দুল গ্বাবাহ্” গ্রন্থে। আবু
যাহাবী (ওফাত ৭৪৮ হিঃ) তাঁর “আত্-তাজ্রীদ্” গ্রন্থে।
ইবনে হাজার ‘আস্কালানী (ওফাত ৮৫২ হিঃ) তাঁর “আল-ইছাবাতু ফী তামিযিছ্ ছাহাবাহ্” গ্রন্থে।
তাঁরা সাইফ বর্ণিত কতক কাল্পনিক ব্যক্তিকে ছাহাবী হিসেবে গণ্য করেছেন এবং সাইফের রেওয়াইয়াতের ভিত্তিতে তাদের পরিচয় উল্লেখ করেছেন। এসব গ্রন্থ পর্যালোচনা করলে সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, এদের মধ্যে এমন প্রায় দেড়শ’ ব্যক্তির আদৌ কোন অস্তিত্ব ছিল না; কেবল সাইফের কল্পনাই এদের অস্তিত্বদান করেছে। সাইফ এসব কাল্পনিক ব্যক্তিকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছে যে, সাইফের বর্ণনাকে বিশ্বাস করার কারণে এসব মনীষী ঐসব কাল্পনিক লোককে ছাহাবী হিসেবে গণ্য করেছেন।১
মুসলিম ভূগোলবিদগণও সাইফের রেওয়াইয়াত গ্রহণ করেছেন। এদের মধ্যে ইয়াকুত হামাভী তাঁর “মু‘জামুল্ বুল্দান্” গ্রন্থে এবং ছাফীউদ্দীন তাঁর “মির্ছাদুল্ ইত্তিলা‘” গ্রন্থে তার রেওয়াইয়াতের ভিত্তিতে এমন এমন শহরের বর্ণনা দিয়েছেন সাইফের মস্তিষ্ক ছাড়া বাস্তবে যার কোথাও অস্তিত্ব ছিল না।
অতএব, সাইফ্ কেবল আবদুল্লাহ্ ইবনে সাবা’ নামক একজন কল্পিত নায়ক তৈরী করে ও তার নামে কল্পকাহিনী রচনা করে বিরত থাকে নি, বরং সে ইতিহাসের নামে আরো শত শত কাল্পনিক ঘটনা ও শত শত নায়ক তৈরী করেছে।
এসব কল্পকাহিনী শত শত হাদীছ, তাফষীর, ইতিহাস, ভূগোল, সাহিত্য ও বংশধারা বিষয়ক গ্রন্থে দৃঢ়মূল হয়ে স্থান করে নিয়েছে। তাই সাইফের নির্ভরযোগ্যতা ও অনির্ভরযোগ্যতা সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া অপরিহার্য। এ ব্যাপারে প্রথমেই দেখা প্রয়োজন যে, ‘ইল্মে রিজালের গ্রন্থাবলীতে সাইফ্ সম্পর্কে কী অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে। এরপর আমরা তার রেওয়াইয়াত সমূহ নিয়ে আলোচনা করবো।
‘ইল্মে রিজালের দৃষ্টিতে সাইফ্
১) “সুনানে আবু দাউদ”-এর সংকলক আবু দাউদ (ওফাত ২৭৫ হিঃ) বলেন ঃ “মূল্যহীন; সে অনেক বেশী মিথ্যা কথা বলেছে।”
২) ইবনে আবি হাতেম (ওফাত ৩২৭ হিঃ) বলেন ঃ “তাঁরা (হাদীছ বিশেষজ্ঞগণ) তার বর্ণিত হাদীছ বর্জন করেছেন।”
৩) “ছহীহ্ নাসায়ী”র সংকলক নাসায়ী (ওফাত ৩০৩ হিঃ) বলেন ঃ “সে দুর্বল২; “তাঁরা (হাদীছ বিশেষজ্ঞগণ) তার বর্ণিত হাদীছ বর্জন করেছেন। সে নির্ভরযোগ্যও নয়, বিশ্বস্ত (আমানতদার)ও নয়।”
৪) ইবনে সাকান (ওফাত ৩৫৩ হিঃ) বলেন ঃ “দুর্বল।”
৫) ইবনে হাব্বান (ওফাত ৩৫৪ হিঃ) বলেন ঃ “সে নিজে যে সব হাদীছ তৈরী করেছে সেগুলোকে নির্ভরযোগ্য বর্ণনাকারীদের নামে চালিয়ে দিয়েছে।” তিনি আরো বলেন ঃ “সাইফ্কে যিন্দিক্৩ বলে অভিযুক্ত করা হয়েছে। (হাদীছ বিশেষজ্ঞগণ) বলেছেন, সে মিথ্যা হাদীছ রচনা করেছে।”
৬) দারে কুত্নী (ওফাত ৩৮৫ হিঃ) বলেন ঃ “দুর্বল। তাঁরা (হাদীছ বিশেষজ্ঞগণ) তার বর্ণিত হাদীছ বর্জন করেছেন।”
৭) “মুস্তাদরাকে হাকেম”-এর সংকলক হাকেম নিশাপুরী (ওফাত ৪০৫ হিঃ) বলেন ঃ “(হাদীছ বিশেষজ্ঞগণ) তার হাদীছকে বর্জন করেছেন। সে যিন্দিক বলে অভিযুক্ত হয়েছে।”
৮) ইয়াহ্ইয়া বিন্ মু‘ঈন্ (ওফাত ৬৩৩ হিঃ) সাইফ্ সম্পর্কে বলেন ঃ “তার বর্ণিত হাদীছ্ দুর্বল ও অনির্ভরযোগ্য।”
৯) “কামূস্” গ্রন্থের প্রণেতা ফীরূযাবাদী (ওফাত ৮১৭ হিঃ) বলেন ঃ “দুর্বল।”
১০) ইবনে হাজার ‘আস্কালানী (ওফাত ৮৫২ হিঃ) বলেন ঃ “দুর্বল।”
১১) সুয়ূতী (ওফাত ৯১১ হিঃ) বলেন ঃ “অত্যন্ত দুর্বল।”
১২) ছাফীউদ্দীন (ওফাত ৯২৩ হিঃ) বলেন ঃ “(হাদীছ বিশেষজ্ঞগণ) তাকে দুর্বল বলে গণ্য করেছেন।”
এ হলো সাইফ্ সম্পর্কে ‘ইল্মে রিজালের মনীষীগণের অভিমত। অতঃপর আমরা তার বর্ণিত রেওয়াইয়াত নিয়ে আলোচনা করবো যা থেকে সে যে মিথ্যা হাদীছ রচনাকারী এবং তার রেওয়াইয়াতের কোনই মূল্য নেই তা সুস্পষ্ট হয়ে যাবে।৪
পাদটীকা ঃ
১. যেমন, সাইফ কাউকে সেনাপতি হিসেবে উল্লেখ করেছে এবং এ কারণে মনীষীগণ তাকে ছাহাবী হিসেবে গণ্য করেছেন। কারণ, স্বয়ং সাইফও উল্লেখ করেছে যে, তৎকালে নিয়ম ছিল এই যে, কেবল ছাহাবীদেরকেই সেনাপতিত্ব করতে দেয়া হত।
২. হাদীছ শাস্ত্রের পরিভাষায় কোন বর্ণনাকারীকে দুর্বল বলা মানে তাকে ও তার রেওয়াইয়াতকে অনির্ভরযোগ্য ও অবিশ্বস্ত গণ্য করা। -অনুবাদক
৩. নাস্তিক।
৪. আবদুল্লাহ্ ইবনে সাবা’ নামক কাল্পনিক চরিত্র ও তার নামে কল্পকাহিনী রচয়িতা সাইফ্ সম্পর্কে নিম্নোক্ত সূত্র সমূহে বিস্তারিত উল্লখ করা হয়েছে ঃ ১) ফিহ্রিসে- ইবনে নাদীম, ২) ইমাম রাযীর “জার্হ্ ওয়া তা‘দীল্”, ৩য় খণ্ড, পৃঃ ২৭৮ ও ২য় খণ্ড, পৃঃ ১৩৬, ৩) আল্-ইস্তিআব্, ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ২৫২, ৪) আল্-ইছাবাতু ফী তামিযীছ্ ছাহাবাহ্, ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ১৭৫, ৫) যাহাবীর “মীযানুল ই‘তিদাল্”, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৪৩৮, ৬) ইবনে হাজারের “তাহ্যীবুত্ তাহ্যীব্”, ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ২৯৫, ৭) ছাফীউদ্দীনের “খুলাছাতুত্ তাহ্যীব্”, পৃঃ ১২৬, ৮) ইসমাঈল বাগদাদীর “হিদাইয়াতুল্ ‘আরেফীন্”, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৪১৩, ৯) হাজী খালীফাহ্র “কাশ্ফুয্ যুনূন্”, পৃঃ ১২৪, ১০) যুবায়দীর “তাজুল্ ‘আরূস্”, “সাইফ্” শব্দের ব্যাখ্যা।