বাই‘আত সম্বন্ধে বিশিষ্ট ছাহাবীদের মূল্যায়ন
ক) ফায্ল্ ইবনে আব্বাস বানী হাশেম হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর লাশের গোসল ও কাফন-দাফনের কাজে ব্যস্ত ছিলেন, এমতাবস্থায় সংবাদ এলো যে, বানূ সা‘এদাহ্র সাক্বীফায় আবু বকরের অনুকূলে বাই‘আত অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ খবর শোনার পর এ ব্যাপারে বানী হাশেমের প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে ইয়াকুবী লিখেছেন১ ঃ তাঁরা ঘর থেকে বের হবার পর ফায্ল্ ইবনে আব্বাস দাঁড়িয়ে গেলেন এবং বললেন ঃ “হে কুরাইশের লোকেরা! প্রতারণা ও কারচুপির মাধ্যমে খেলাফত তোমাদের হবে না; আমরাই খেলাফতের উপযুক্ত, তোমরা নও। আমরা ও আমাদের নেতা তোমাদের চেয়ে খেলাফতের অধিকতর উপযুক্ত।”খ) আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস আবু বকরের অনুকূলে বাই‘আত প্রশ্নে ওমরের সাথে স্বীয় কথোপকথন সম্বন্ধে আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস বলেন ঃ২ ওমর আমাকে বললেন ঃ “ওহে আব্বাসের বেটা! তুমি জান কি মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর পর তোমাদের অনুকূলে বাই‘আত হওয়া থেকে কোন্ জিনিস লোকদেরকে ফিরিয়ে রেখেছে?” যেহেতু আমি এ প্রশ্নের জবাব দিতে চাই নি তাই বললাম ঃ “আমি যদি অবগত না থাকি তো আমীরুল মু’মিনীন আমাকে অবগত করবেন।” ওমর বললেন ঃ “লোকেরা এটা দেখার জন্যে প্রস্তুত ছিল না যে, নবুওয়াত ও খেলাফত উভয়ই তোমাদের ভাগে পড়ুক আর তার বদৌলতে তোমরা অন্যদের সামনে শ্রেষ্ঠত্ব ও গৌরব প্রদর্শন করো। এ কারণে কুরাইশরা খেলাফতকে নিজেদের জন্যে নির্ধারণ করে নিয়েছে এবং স্বীয় লক্ষ্য হাসিল করেছে।” আমি বললাম ঃ “হে আমীরুল মু’মিনীন! আপনি যদি অনুমতি দেন এবং আমার ওপর ক্ষিপ্ত না হন তাহলে আমিও কিছু বলতে চাই।” বললেন ঃ “বলো, হে আব্বাসের পুত্র!” বললাম ঃ “আপনি যে বললেন, কুরাইশরা খেলাফতকে নিজেদের জন্যে নির্ধারণ করে নিয়েছে ও তারা এর উপযুক্ত ছিল এবং এতে সফল হয়েছে; কিন্তু কুরাইশরা যদি আল্লাহ্ তাদের জন্যে যাকে মনোনীত করেছেন তাঁকেই বেছে নিতো তাহলে না তাদের অধিকার হাতছাড়া হতো, না তাদের প্রতি কেউ ঈর্ষা পোষণ করতো। আর এই যে বললেন, তারা পসন্দ করে নি যে, নবুওয়াত ও খেলাফত একই জায়গায় একত্রিত হোক, তাহলে জেনে রাখুন, মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ্ তা‘আলা কোরআনে এ ধরনের জনগোষ্ঠীর পরিচয় দিয়েছেন এভাবে ঃ “এটা এজন্য যে, আল্লাহ্ যা নাযিল করেছেন তারা তা অপসন্দ করেছে; এ কারণে তাদের নেক আমল সমূহ বিনষ্ট হয়ে গেছে।”৩ ওমর বললেন ঃ “আফসোস! আল্লাহ্র শপথ, ইবনে আব্বাস! তোমার সম্পর্কে আমার কাছে যে সব খবর এসেছিল আমি তা বিশ্বাস করতে চাই নি যাতে আমার কাছে তোমার যে অবস্থান আছে তা তোমার হাতছাড়া হয়েযায়।” বললাম ঃ “তা কী খবর এসেছে? আমি যদি সত্য বলে থাকি তাহলে আপনার কাছে আমার অবস্থান নড়বড়ে হয়ে যাওয়া উচিৎ নয়, আর যদি ভুল বলে থাকি তাহলে আমার মতো লোকের মত হচ্ছে এই যে, ভুলকে বিদূরিত করবো।” জবাবে ওমর বললেন ঃ “আমার কাছে খবর এসেছে যে, তুমি বলছো ঃ আমাদের ওপর যুলুম করে এবং ঈর্ষা বশতঃ আমাদের কাছ থেকে খেলাফত নিয়ে গেছে।” বললাম ঃ “এই যে বললেন যে, আমি বলেছি, যুলুম করেছে; এটা জ্ঞানী ও অজ্ঞ নির্বিশেষে সকলের কাছে সুস্পষ্ট। কিন্তু এই যে বললেন, ঈর্ষা করেছে – এটা কোন নতুন ব্যাপার নয়। ইবলীস আদমের প্রতি ঈর্ষা করেছিল; আমরাও সেই আদমের সন্তান, তাই ঈর্ষার শিকার হয়েছি।”গ) সালমান ফারসী আবু বকর জাওহারী রেওয়াইয়াত করেছেন ঃ সালমান, যুবাইর ও আনছাররা চাচ্ছিলেন রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর পরে আলীর অনুকূলে বাই‘আত হবেন। কিন্তু আবু বকর যখন লোকদের নিকট থেকে বাই‘আত গ্রহণ করলেন তখন সালমান বললেন ঃ “তোমরা সামান্য কল্যাণের অধিকারী হয়েছো, কিন্তু কল্যাণের খনি হাতছাড়া করেছো।” সেদিন তিনি বলেন ঃ “বৃদ্ধ ব্যক্তিকে বেছে নিয়েছে এবং স্বীয় রাসূল (সাঃ)-এর আহ্লে বাইতকে ফেলে দিয়েছে। খেলাফতকে যদি রাসূল (সাঃ)-এর আহ্লে বাইতকে প্রদান করতো তাহলে এমন কি দুই জন লোকের মধ্যেও পারস্পরিক মতপার্থক্য সৃষ্টি হতো না এবং এ বৃক্ষের ফল থেকে যত বেশী সম্ভব ও সর্বোত্তমভাবে উপকৃত হত।”৪ আনছাবুল্ আশরাফ গ্রন্থে বলা হয়েছে, সালমান তাঁর মাতৃভাষা ফার্সীতে প্রবাদ বাক্যের ভাষায় বলেন ঃ “যা হওয়া উচিৎ নয় তা-ই হল, কিন্তু যা হওয়া উচিৎ ছিল তা হল না।” এরপর তিনি আরবী ভাষায় বলেন ঃ “তারা যদি আলীর অনুকূলে বাই‘আত হতো তাহলে অবশ্যই ওপর ও নীচ উভয় দিক থেকেই তারা বরকতপ্রাপ্ত হত।”ঘ) উম্মে মেস্তাহ্ আবু বকর জাওহারী বলেন ঃ যেহেতু আবু বকরের অনুকূলে আলীর বাই‘আত না হওয়ার বিষয় নিয়ে সর্বত্র আলোচনা হতে লাগল। সেহেতু আবু বকর ও ওমর আলী সম্পর্কে অধিকতর কঠোর নীতি অনুসরণ করতে লাগলেন। এ পরিস্থিতিতে উম্মে মেস্তাহ্ বিন্ আছাছাহ্ তাঁর ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন এবং রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর কবরের পাশে গিয়ে এ কবিতাটি আবৃত্তি করেন ঃ “(হে রাসূল!) আপনার পরে অনেক খবর ও অনেক কথা হয়েছেআপনি যদি জীবিত থাকতেন তো কথা এতো বেশী হতো নাযে জমিতে বৃষ্টি প্রবেশ করে না তা উর্বরতা হারিয়ে ফেলে, সেভাবেইআপনার কওম লাগামছাড়া হয়ে গেছে – দেখুন ও সাক্ষী থাকুন।”৫ঙ) আবু যার হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর ইন্তেকালের সময় আবু যার মদীনায় ছিলেন। আবু বকর কর্তৃক খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি মদীনায় ফিরে আসেন। তিনি আবু বকরকে বলেন ঃ “তুমি খুব সামান্য জিনিসই অর্জন করলে এবং তাতেই আত্মতৃপ্ত হলে, আর রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর আহ্লে বাইতকে হাতছাড়া করলে। তোমরা যদি রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর আহ্লে বাইত-এর নিকট এ দায়িত্ব সোপর্দ করতে তাহলে এমন দু’জন লোকও পাওয়া যেতো না যারা তোমাদের বিরোধিতা করত।”৬চ) মিক্বদাদ বিন্ ‘আম্র্ ইয়াকুবী ওসমানের বাই‘আতের ঘটনা বর্ণনা প্রসঙ্গে আবু বকরের খেলাফত গ্রহণে মিক্বদাদ বিন্ ‘আম্রের প্রতিক্রিয়া উল্লেখ করেছেন। বর্ণনাকারী বলেন ঃ একদিন আমি মসজিদুন্নবীতে এক ব্যক্তিকে (মিক্বদাদকে) দেখতে পেলাম; তিনি মাটিতে হাঁটু রেখে এমনভাবে বসে ছিলেন যে, মনে হল তিনি খুবই বেদনার্ত, যেন গোটা দুনিয়াই তাঁর ছিল, কিন্তু তিনি তাঁর সে সর্বস্ব পুরোটাই হারিয়ে ফেলেছেন। তিনি বলছিলেন ঃ “কুরাইশদের আচরণ বড়ই বিস্ময়কর; তারা তাদের দায়িত্ব তার হকদারদের কাছ থেকে অনেক দূরে নিয়ে গেছে।”৭ছ) বানূ নাজ্জারের জনৈকা মহিলা আবু বকর জাওহারী লিখেছেন ঃ আবু বকরের সাথে বাই‘আত পাকাপোক্ত হয়ে গেলে তিনি মুহাজির ও আনছার মহিলাদের নিকট বাইতুল মাল থেকে কিছু অর্থ হাদীয়া স্বরূপ পাঠােলন। তিনি বানূ ‘আদী বিন্ নাজ্জার গোত্রের জনৈকা মহিলাকে দেয় অর্থ যায়েদ বিন্ ছাবেতের মাধ্যমে পাঠালেন। যায়েদ উক্ত মহিলার নিকট এলেন এবং তাঁর নিকট তা সমর্পণ করলেন। মহিলা জিজ্ঞেস করলেন ঃ “এটা কী?” যায়েদ বললেন ঃ “আবু বকর নারীদের মধ্যে যে অংশ বণ্টন করেছেন এ তারই অংশ বিশেষ।” মহিলা বললেন ঃ “তোমরা কি উৎকোচ প্রদানের মাধ্যমে আমার নিকট থেকে আমার দ্বীন কেড়ে নিতে চাও?”৮জ) মু‘আবিয়াহ্ মু‘আবিয়াহ্ হযরত আলী (আঃ)-এর সাথে তাঁর দ্বন্দ্বে আলীর সমর্থক মুহাম্মাদ বিন্ আবু বকরকে লেখা তাঁর পত্রে বলেন ঃ “আমি ও তোমার পিতা – আমরা আবু তালিবের পুত্রের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে অবগত ছিলাম এবং আমাদের ওপর তাঁর হককে অপরিহার্য গণ্য করতাম। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর নিজের নিকট যা ছিল তাঁর রাসূলের জন্যে তা নির্ধারণ করে দিলেন এবং তাঁকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা পূর্ণ করলেন, আর তাঁর আহ্বানকে সুস্পষ্ট করে দিলেন ও তাঁর দলীলকেও সুস্পষ্ট করে দিলেন, অতঃপর তাঁর রূহ্কে (তাঁর ওপর আল্লাহ্র দরূদ বর্ষিত হোক) নিজের দিকে কবয করে নিলেন। অতঃপর তোমার পিতা ও তাঁর বন্ধু ওমর আলীর হক আত্মসাৎকারী প্রথম ব্যক্তি হলেন এবং তাঁর বিরোধিতা করলেন। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী এ দুই ব্যক্তি পরস্পরের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন, এরপর আলীকে বাই‘আতের জন্যে আহ্বান জানালেন। আলী যেহেতু বাই‘আত হওয়া থেকে বিরত থাকলেন ও অস্বীকৃতি জানালেন সেহেতু তাঁর বিরুদ্ধে অবৈধ সিদ্ধান্ত নিলেন এবং ভয়ঙ্কর ধরনের চিন্তাভাবনা করলেন। ফলে শেষ পর্যন্ত আলী তাঁর অনুকূলে বাই‘আত হলেন ও তাঁদের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। কিন্তু এ দুই ব্যক্তি কখনোই স্বীয় দায়িত্বে তাঁকে অংশীদার করতেন না এবং স্বীয় গোপন বিষয়াদি তাঁকে জানতে দিতেন না। অতঃপর আল্লাহ্ উভয়েরই জান কবয করলেন। অতএব, এখন আমি যা করছি তা যদি ভাল ও সঠিক কাজ হয়ে থাকে তাহলে প্রকৃত পক্ষে তোমার পিতাই তার ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে গেছেন এবং আমরা শুধু তাতে শরীক হয়েছি। আর তোমার পিতা যদি এমনটি না করতেন তাহলে আমরা কখনোই আবু তালিবের পুত্রের বিরোধিতা করতাম না, বরং খেলাফতের আসন তাঁকেই অর্পণ করতাম। কিন্তু তোমার পিতা আমাদের আগেই তাঁর সাথে এ আচরণ করেছেন, আর আমরা তোমার পিতার মতোই আচরণ করেছি। অতএব, তুমি হয় তোমার পিতাকেই দোষী সাব্যস্ত করো অথবা আমাদেরকে তিরস্কার করা থেকে বিরত হও। যারা তাওবাহ্ করে তাদের ওপর আল্লাহ্র দরূদ বর্ষিত হোক।”৯ঝ) খালেদ বিন্ সা‘ঈদ্ খালেদ বিন্ সা‘ঈদ বিন্ আল-‘আছ্ ইসলাম গ্রহণে অগ্রবর্তীদের অন্যতম। তিনি ইসলাম গ্রহণকারী তৃতীয়, চতুর্থ বা পঞ্চম ব্যক্তি। ইবনে কুতাইবাহ্ বলেন, খালেদ ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে আবু বকরের অগ্রবর্তী ছিলেন।১০ খালেদ ছিলেন হাবাশায় হিজরতকারীদের অন্যতম। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) তাঁকে ও তাঁর দুই ভাই আবান ও ‘আমর্-কে মায্হাজ গোত্রের যাকাত আদায়ের দায়িত্ব অর্পণ করেন। এরপর তিনি তাঁকে দায়িত্ব দিয়ে ছান্‘আয় পাঠান। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর ইন্তেকালের পর তিনি ও তাঁর দুই ভাই তাঁদের কর্মস্থল থেকে মদীনায় ফিরে এলেন। আবু বকর তাঁদেরকে জিজ্ঞেস করলেন ঃ “তোমরা কর্মস্থল ত্যাগ করলে কেন? রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) যাকে কোনো জায়গার জন্যে কোনো দায়িত্ব দিয়েছেন সেখানকার সে দায়িত্বের জন্যে তার চেয়ে যোগ্যতর কেউ নেই। অতএব, তোমরা তোমাদের কর্মস্থলে ফিরে যাও ও দায়িত্ব পালন করতে থাকো।” তাঁরা জবাব দিলেন ঃ “আমরা রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর পরে আর কারো গোলাম হবো না।”১১ খালেদ ও তাঁর ভাই আবান আবু বকরের অনুকূলে বাই‘আত হওয়ার ব্যাপারে গড়িমসি করেন। তিনি বানী হাশেমকে বলেন ঃ “আপনারা বানী হাশেম হচ্ছেন সুউচ্চ ফলবান বৃক্ষ, আর আমরা আপনাদের অনুসারী।”১২ খালেদ দুই মাস পর্যন্ত আবু বকরের অনুকূলে বাই‘আত হতে বিরত থাকেন। তিনি বলতেন ঃ “রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) আমাকে ছান্‘আর দাযিত্বশীল নিয়োগ করেছিলেন এবং তাঁর ইন্তেকালের পূর্ব পর্যন্ত আমাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেন নি।” তিনি একদিন আলী ইবনে আবি তালিব ও ওসমানের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁদেরকে বলেন ঃ “হে ‘আব্দ্ মানাফের বংশধরগণ! আপনারা নিজেদের বিষয়ের প্রতি বিমুখ হয়েছেন, আর এর ফলে অন্যরা তা হস্তগত করে নিয়েছে।” আবু বকর তাঁর এ কথায় গুরুত্ব দেন নি। কিন্তু ওমর এতে মনঃক্ষুণ্ন হন।১৩ এরপর তিনি আলীর কাছে এলেন এবং বললেন ঃ “আসুন, আমি আপনার অনুকূলে বাই‘আত হবো। আল্লাহ্র শপথ, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর স্থলাভিষিক্ত হবার জন্যে লোকদের মধ্যে আপনার চেয়ে যোগ্যতর কেউ নেই।”১৪ কিন্তু শেষ পর্যন্ত বানী হাশেম আবু বকরের অনুকূলে বাই‘আত হলে খালেদও বাই‘আত হন।১৫বাই‘আতের কাজ শেষ হলে আবু বকর যখন শামের উদ্দেশে সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন তখন খালেদকে সে বাহিনীর এক চতুর্থাংশের সেনাপতি নিয়োগ করেন। কিন্তু ওমর এর বিরোধিতা করেন এবং বলেন ঃ “আপনি এমন কাউকে সেনাপতি নিয়োগ করছেন যে অমুক অমুক কথা বলেছে।” … এবং তিনি তাঁর বিরোধিতা অব্যাহত রাখেন ও সেখানে বসে থাকেন। ফলে শেষ পর্যন্ত খালেদকে সেনাপতিত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় এবং তাঁর পরিবর্তে ইয়াযীদ বিন আবু সুফিয়ানকে সেনাপতি নিয়োগ করা হয়।১৬ খালেদ তাঁকে সেনাপতিত্ব থেকে বাদ দেয়ার বিষয়টিকে আদৌ গুরুত্ব দেন নি। তিনি সেনাবাহিনীর সাথে শামে গিয়ে যুদ্ধ করেন এবং সে যুদ্ধে শহীদ হন।ঞ) সা‘দ্ বিন্ ‘ইবাদাহ্ তিনি ছিলেন খাযরাজ গোত্রের প্রধান। তিনি ‘আক্বাবায় বাই‘আত হন এবং রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর সাথে সকল যুদ্ধেই শরীক হন, যদিও তাঁর বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ সম্পর্কে বিতর্ক আছে। তিনি ছিলেন ক্ষমাশীল ও দাতা। মক্কা বিজয়ের সময় আনছারদের পতাকাবাহী ছিলেন। তিনি এই বলে শ্লোগান দেন, “আজ যুদ্ধের দিন; আজ নারীরা বন্দিনী হবে।” তিনি এতে কুরাইশ নারীদের বুঝাতে চেয়েছিলেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) তাঁর নিকট থেকে পতাকা নিয়ে তাঁর পুত্র ক্বায়সের হাতে দেন।১৭ ঐতিহাসিকগণ লিখেছেন১৮ ঃ সাক্বীফাহ্র বাই‘আতের পর আবু বকর সা‘দের ব্যাপারে আপাততঃ চুপ থাকাকেই উত্তম মনে করলেন। সর্বজনীন বাই‘আতের পর একজনকে তাঁর কাছে পাঠিয়ে তাঁকে বাই‘আত হবার জন্যে আসতে বললেন। তিনি জবাবে বললেন ঃ “আল্লাহ্র কসম, তোমাকে লক্ষ্যে পরিণত করার জন্যে যতক্ষণ আমারে তুনীরে তীর আছে এবং তোমাদের রক্তের দ্বারা আমার বর্শাকে রঞ্জিত না করছি ও যতক্ষণ আমার বাহু তলোয়ার চালাতে সক্ষম ততক্ষণ তোমাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাব এবং আমার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এবং আমার গোত্রের যারা এখনো আমার আদেশ মানে তাদেরকে সাথে নিয়ে তোমাদের বিরুদ্ধে লড়ে যাব, কিন্তু বাই‘আত হবো না। আবারো আল্লাহ্র শপথ করে বলছি, জিন ও ইনসান সবাইও যদি তোমার পক্ষে যুদ্ধ করে আমি তোমার অনুকূলে বাই‘আত হবো না যতক্ষণ না আমার অবস্থার আবেদন নিয়ে আমার রবের নিকট উপস্থিত হই এবং তাঁর আদালতে তোমার সাথে আমার হিসাব-নিকাশ নিষ্পত্তি হয়।” তাঁর এ কথা আবু বকরের নিকট পৌঁছলে ওমর বললেন ঃ “বাই‘আত না হওয়া পর্যন্ত তাকে ছাড়বেন না।” কিন্তু বাশীর বিন্ সা‘দ্ বললেন ঃ “আমার মতে, এ বিষয়ে চাপাচাপি করা কল্যাণকর হবে না। কারণ সা‘দের এ বিরোধিতা জেদের কারণে। আর আমি সা‘দের চরিত্র সম্পর্কে যতটা অবগত আছি তাতে তিনি নিহত না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধ করে যাবেন। বিষয়টি এত সহজ নয়। তিনি একা নন যে, তাঁর নিহত হওয়ার ফলে বিরোধিতার অবসান ঘটবে। তাঁর গোত্র অত্যন্ত বড় এবং এখনো গোত্রের লোকদের ওপর তাঁর প্রভাব শেষ হয়ে যায় নি। তাঁর পুত্রগণ, আত্মীয়-স্বজন ও গোত্রের বেশ কিছু লোক নিহত না হওয়া পর্যন্ত সা‘দকে স্পর্শ করা যাবে না। অতএব, তাঁকে তাঁর নিজের অবস্থায় ছেড়ে দিন। তিনি একজন বৈ তো নন, অতএব এতে কোনই ক্ষতি হবে না।” বাশীরের প্রস্তাব আবু বকরের মনঃপুত হলো এবং তিনি সা‘দ বিন ‘ইবাদাহ্কে তাঁর নিজের অবস্থায় ছেড়ে দিলেন। তিনিও আবু বকরের নামাযের জামা‘আতে ও সভা-সমাবেশে আসা থেকে বিরদ থাকেন এবং হজ্বের সময় তাঁর অনুসরণ করতেন না। … এ অবস্থায় আবু বকর দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন ও ওমর খলীফাহ্ হলেন।১৯ ওমরের খেলাফত কালে একদিন মদীনার গলিতে সা‘দের সাথে ওমরের সাক্ষাৎ হল। ওমর তাঁকে ডাক দিয়ে বললেন ঃ “তুমি অমুক অমুক কথা বলেছিলে?” তিনি বললেন ঃ “হ্যা, বলেছিলাম। এখন ক্ষমতা তোমার হাতে। কিন্তু আল্লাহ্র শপথ, আমাদের কাছে আবু বকর তোমার চেয়ে অধিকতর পসন্দনীয় ছিল। আর আমি ব্যক্তিগতভাবে তোমার পাশে থাকা পসন্দ করি না।” ওমর বললেন ঃ “ যে ব্যক্তি তার প্রতিবেশীর ওপর বিরক্ত থাকে তার উচিৎ বাসস্থান পরিবর্তন করা।” সা‘দ বললেন ঃ “তোমার প্রতিবেশিত্ব খুব একটা পসন্দ করি না। অতএব, সে কাজই করবো এবং তোমার চেয়ে উত্তম লোকের প্রতিবেশী হবো।”এ সাক্ষাতের পর অচিরেই (ওমরের খেলাফতের প্রথম দিকেই) সা‘দ শামে চলে যান।২০ বালাযুরী লিখেছেন২১ ঃ ওমর এক ব্যক্তিকে শামে পাঠালেন এবং তাকে আদেশ দিলেন, “যে কোন প্রকারেই হোক সা‘দকে লোভ দেখাও, হয়তো এর ফলে সে বাই‘আত হবে। আর যদি বাই‘আত না হয় তাহলে আল্লাহ্র কাছে সাহায্য চাইবে এবং …।” এরপর সে ব্যক্তি রওয়ানা হয়ে গেল এবং হুরানে একটি বাগানের মধ্যে সা‘দের সাক্ষাত পেলো। সে সা‘দকে বাই‘আতের জন্যে আহ্বান জানালো। সা‘দ বললেন ঃ “আমি কখনোই কোনো কুরাইশ ব্যক্তির অনুকূলে বাই‘আত হবো না।” লোকটি বললো ঃ “বাই‘আত না হলে তোমাকে হত্যা করবো।” সা‘দ বললেন ঃ “ সেজন্য তোমাকে আমাদের সাথে যুদ্ধ করতে হবে।” সে বললো ঃ “যে বিষয়ে গোটা উম্মাহ্ মতৈক্যের অধিকারী তুমি তার বাইরে থাকবে?” সা‘দ বললেন ঃ “তোমার কথার উদ্দেশ্য যদি বাই‘আত হয়ে থাকে তাহলে, হ্যা।” তখন ঐ ব্যক্তি প্রাপ্ত আদেশ মোতাবেক সা‘দের প্রতি তীর নিক্ষেপ করে ও তাঁকে হত্যা করে।” মাস‘উদী লিখেছেন২২ ঃ সা‘দ বিন্ ‘ইবাদাহ্ বাই‘আত হন নি এবং মদীনা থেকে শামে চলে যান ও হিজরী ১৫ সালে সেখানে ইন্তেকাল করেন। ইবনে ‘আব্দি রাব্বিহ্ লিখেছেন ঃ সা‘দ বিন ‘ইবাদাহ্ তীর নিক্ষেপের শিকার হন এবং তীর তাঁর শরীরে গেঁথে যায় ও তিনি নিহত হন।২৩ ত্বাবাক্বাতে ইবনে সা‘দে বলা হয়েছে২৪ ঃ সা‘দ প্রস্রাব করার জন্যে একটি নীচু জায়গায় বসে ছিলেন; এ অবস্থায় তিনি হামলার শিকার হন ও নিহত হন। তাঁর শরীরের চামড়ার রং সবুজ হয়ে গিয়েছিল। উস্দুল্ গ্বাবায় বলা হয়েছে২৫ ঃ সা‘দ না আবু বকরের নিকট বাই‘আত হন, না ওমরের নিকট। বরং তিনি শামে চলে যান ও হূরান শহরে বসবাস করতে থাকেন। অতঃপর হিজরী ১৫ সালে দুনিয়া থেকে বিদায় নেন। তাঁকে তাঁর গৃহের পার্শ্ববর্তী রাস্তার পাশে এমন অবস্থায় পাওয়া যায় যে, তাঁর শরীর সবুজ হয়ে গিয়েছিলো – এ ব্যাপারে বিতর্ক নেই। একটি কূপের ভিতব থেকে জনৈক অদৃশ্য কথক কর্তৃক তাঁর মৃত্যুর কথা ঘোষণা করার আগে কেউই তাঁর মৃত্যুর খবর জানতো না। … আবদুল ফাত্তাহ্ লিখেছেন২৬ ঃ কতক নির্বোধ লোক বলে যে, সা‘দের হত্যার ঘটনা ছিলো জ্বিনদের কাজ। কিন্তু যিনি প্রকৃত ঘটনা অবগত আছেন বা ধারণা করছেন যে, তিনি প্রকৃত ঘটনা বুঝতে পেরেছেন – এমন এক ব্যক্তি বলেন ঃ খালেদ বিন্ ওয়ালীদ্ ও তাঁর সহযোগী তাঁর একজন বন্ধু রাতের বেলা সা‘দের জন্যে ওৎ পেতে থাকেন এবং তাঁকে হত্যা করেন। তারপর তাঁর লাশকে কূপের মধ্যে ফেলে দেন।” তাঁকে প্রশ্ন করা হয় ঃ “তাহলে আমরা যে জ্বিনের কণ্ঠ শুনতে পেলাম, সেটা কী?” জবাবে তিনি বললেন ঃ “তা ছিল খালেদের সহযোগীর কণ্ঠস্বর – যার উদ্দেশ্য ছিল নির্বোধ লোকেরা যা বলছে তাদেরকে দিয়ে তা-ই বলানো।” বালাযুরী লিখেছেন ঃ ওমর সা‘দকে হত্যার জন্যে খালেদ বিন্ ওয়ালীদ ও মুহাম্মাদ বিন্ মুসলিমাহ্কে দায়িত্ব দেন। তাঁরাও এ দায়িত্ব পালন করেন এবং দু’টি তীর নিক্ষেপ করে সা‘দকে হত্যা করেন। বালাযুরী এ ঘটনা বর্ণনার পর জনৈক আনছার কর্তৃক সা‘দের স্মরণে লিখিত শোকগাথা থেকে এ পঙক্তিগুলো উদ্ধৃত করেছেন ঃ“তারা বলে যে, জ্বিনরা সা‘দের উদরকে বিদীর্ণ করেছেজেনে রেখো কত লোকই না ধুরন্ধরীর সাথে কাজ করে থাকেসা‘দের অপরাধ এ ছিল না যে, দাঁড়িয়ে প্রস্রাব করেছিলেনবরং এই যে, সা‘দ আবু বকরের পক্ষে বাই‘আত হন নি।” হ্যা, সা‘দের জীবনেতিহাস বেশ জটিল ছিল। যেহেতু এ ঐতিহাসিক ঘটনা ইতিহাসকারদের জন্যে খুবই অস্বস্তিদায়ক ছিল সেহেতু অনেকে এ ঘটনাকে আদৌ উল্লেখ করেন নি২৭ এবং অনেকে মোটামুটি এই বলে শেষ করেছেন যে, সা‘দ বিন্ ‘ইবাদাহ্কে জ্বিনরা হত্যা করেছিল।২৮ কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, সা‘দের সাথে জ্বিনদের কী শত্রুতা ছিল তা তাঁরা উল্লেখ করেন নি।২৯ট) ওমর বিন্ খাত্তাব্ আবু বকরের অনুকূলে বাই‘আতের ক্ষেত্রে ওমরের ভূমিকা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু এ বাই‘আতের অবস্থা সম্পর্কে স্বয়ং ওমর কী ধারণা পোষণ করতেন?ওমর বলেন ঃ “আমার কাছে খবর এসেছে যে, এক ব্যক্তি বলেছে, ‘আল্লাহ্র শপথ, ওমর বিন খাত্তাব মারা গেলে আমি অমুকের অনুকূলে বাই‘আত হবো।’ কেউ যেন এ ধরনের কাজকে সঠিক মনে না করে। কারণ, আবু বকরের পক্ষে বাই‘আত ছিল একটি ত্রুটপূর্ণ ও ভুল কাজ – যা ঘটে গেছে ও অতীত হয়ে গেছে। হ্যা এমনটাই ছিল। তবে আল্লাহ্ লোকদেরকে এ ত্রুটিপূর্ণ কাজের অশুভ পরিণতি থেকে রক্ষা করেছেন …।”৩০ঠ) আবু সুফিয়ান আবু সুফিয়ান রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন, কিন্তু মক্কা বিজয়ের সময় ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর ইন্তেকালের সময় তিনি মদীনায় ছিলেন না।৩১ সফর থেকে ফেরার পথে তিনি মদীনা থেকে আগত এক ব্যক্তির নিকট থেকে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর ওফাতের কথা জানতে পারেন। আবু বকর খলীফাহ্ হয়েছেন শুনে জিজ্ঞেস করলেন ঃ “আলী ও আব্বাস এই দুই মযলুমের প্রতিক্রিয়া কী?” লোকটি বলল ঃ “তাঁরা ঘরে বসে আছেন।” তখন আবু সুফিয়ান বললেন ঃ “আল্লাহ্র শপথ, আমি যদি বেঁচে থাকি তো তাঁদের পা সুউচ্চ টিলার ওপরে পৌঁছে দেব।” এরপর বললেন ঃ “আমি সমাজ পরিবেশকে ধুলিময় দেখতে পাচ্ছি যা রক্তবৃষ্টি ছাড়া অন্য কোন কিছু দ্বারা দূরীভূত হবে না।” তিনি মদীনায় ফেরার পর সেখানকার গলিতে গলিতে ঘুরে এ কবিতা পাঠ করতে লাগলেন ঃ“হে বানী হাশেম! লোকদেরকে তোমাদের ওপর লোভ করতে দিও নানা (বানী) তীম বিন্ মার্রাহ্কে, না (বানী) ‘আদীকে৩২এ তো (হুকুমত) তোমাদের থেকেই, ফিরে আসবে তোমাদের কাছেই আর নহে তা আবু হাসান আলী ছাড়া অন্য কারো তরে।”৩৩ ত্বাবারী লিখেছেন৩৪ ঃ আবু সুফিয়ান এ কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসেন ঃ “আল্লাহ্র শপথ, আমি সমাজ পরিবেশকে ধুলিময় দেখতে পাচ্ছি যা রক্তবৃষ্টি ছাড়া অন্য কোন কিছু দ্বারা দূরীভূত হবে না। হে আব্দ্ মানাফের বংশধরগণ! তোমাদের ব্যাপারে আবু বকরের কী কাজ? আলী ও আব্বাস এই দুই মযলূম ও লাঞ্ছিত কোথায়?” তারপর বলেন ঃ “হে আবূল হাসান! হাত বাড়িয়ে দাও; তোমার পক্ষে বাই‘আত হবো।” কিন্তু আলী তাতে সাড়া দিলেন না। তখন আবু সুফিয়ান এই কবিতাটি পাঠ করলেন ঃ“নিঃসন্দেহে গৃহপালিত গর্দভই লাঞ্ছনা মেনে নেয়স্বাধীন ও শক্তিমান বীর পুরুষ তা উপেক্ষা করেকোন কিছুই নীচতা ও লাঞ্ছনা সহ্য করে নাকেবল প্রাণহীন দুই জিনিস চরম লাঞ্ছিত; তাঁবুর খুঁটিহাতুড়ীর আঘাতে সে বাঁকা হয়ে যায়আর সেই ভারবাহী উষ্ট্র যার তরে কাঁদে না’ক কেহ।”৩৫ আবু সুফিয়ানের এ উস্কানি মূলক কবিতা বানী আব্দ্ মানাফের বংশধরদের উত্তেজিত করণ ও ইতিহাসকে বদলে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট ছিল। কিন্তু আলী আবু সুফিয়ানের নিকট থেকে বাই‘আত গ্রহণে অস্বীকৃতি জানানোর ফলে তা আর ঘটে নি। এখানে আলীকে খলীফাহ্র আসনে বসানোর জন্যে আবু সুফিয়ানের উদগ্র আকাঙ্ক্ষা এবং আলী কর্তৃক বাই‘আতের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান অনেকের মধ্যেই বিস্ময়ের সৃষ্টি করতে পারে। কারণ, আলী আবু বকরের অনুকূলে বাই‘আত হওয়া থেকে বিরত থাকেন এবং তাঁর হক আদায়ের জন্যে তাঁর সাথে সহযোগিতা করার জন্যে আনছার ও মুহাজিরদের দ্বারে আঘাত হানেন। অথচ তিনিই আব্বাস ও আবু সুফিয়ানের পক্ষ থেকে আসা বাই‘আতের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এর কারণ কী? এর কারণ একদিকে আলী এবং অপরদিকে আব্বাস ও আবু সুফিয়ানের উদ্দেশ্যের মধ্যকার পার্থক্য।আলীর খেলাফত দাবীর কারণ দ্বীনী দৃষ্টিকোণ থেকে এটা ছিল তাঁর হক। তিনি ছিলেন আল্লাহ্ তা‘আল্লাহ্র পক্ষ থেকে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর হুকুমত ও দ্বীনী নেতৃত্বের উত্তরাধিকারী হিসেবে মনোনীত। এমন কি এ ব্যাপারে কারো দ্বিমত থাকলেও সাধারণভাবেই দ্বীনী জ্ঞান এবং সামরিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর যোগ্যতম হওয়ার ব্যাপারে কারো দ্বিমত নেই। আনছার ও মুহাজির নির্বিশেষে প্রায় সকলেরই কথা ছিল এই যে, শুরুতেই আলী খেলাফতের জন্যে এগিয়ে এলে কেউই তাঁর ব্যাপারে দ্বিমত করতেন না, কিন্তু যেহেতু তাঁরা আবু বকরের অনুকূলে বাই‘আত হয়ে গেছেন তাই এখন আর কিছু করার নেই।আলী তাঁর দ্বীনী হক পুনরুদ্ধার করতে চাচ্ছিলেন বলেই কেবল তাঁর বংশীয় লোকদের নিয়ে অগ্রসর হতে চান নি এবং এ কারণেই বংশ-গোত্র নির্বিশেষে সকল মুসলমানের কাছে গিয়েছিলেন। অন্যদিকে আব্বাসের দৃষ্টিতে আলী ছিলেন বানী হাশেমের যোগ্যতম ব্যক্তি, আর আবু সুফিয়ানের দৃষ্টিতে আলী ছিলেন বানী আব্দ্ মানাফের যোগ্যতম ব্যক্তি। যেহেতু বানী উমাইয়াহ্ (আবু সুফিয়ান যে বংশের লোক) ও বানী হাশেম ছিল বানী আব্দ্ মানাফেরই দু’টি শাখা এবং নেতৃত্ব বানী উমাইয়াহ্র নিকট আসার কোনোই সম্ভাবনা ছিল না, সেহেতু তিনি বানী আব্দ্ মানাফের বাইরের লোক আবু বকরের নেতৃত্ব মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। আর আব্দ্ মানাফের বংশধর শাখাগোত্র সমূহের মোট জনসংখ্যা ছিল এতই বেশী যে, তারা একত্রে মাঠে নামলে আবু বকর ও ওমরের বংশের লোকেরা তাদের সামনে মোটেই দাঁড়াতে পারত না। এ কারণেই আবু সুফিয়ান আব্দ্ মানাফের নামে শ্লোগান উচ্চারণ করেন। কিন্তু আলী বংশীয় ভিত্তিতে শক্তি সংহত করে তাঁর দ্বীনী হক আদায়ে প্রস্তুত ছিলেন না বলেই আবু সুফিয়ানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। বস্তুতঃ আরবরা ইসলাম গ্রহণ করলেও তখনো তাদের মধ্য থেকে গোত্রপ্রীতি দূর হয়ে যায় নি। এ গোত্রপ্রীতি আবু বকর ও ওমরের গোত্রের মধ্যেও ছিল এবং আলীকে খেলাফত থেকে বঞ্চিত করার পিছনেও এ গোত্রপ্রীতি তথা অন্য গোত্রের প্রতি বিদ্বেষ কাজ করেছিল। এ কারণেই আবু বকরের পিতা আবু কাহাফাহ্ যখন জানতে পারলেন যে, তাঁর পুত্র খলীফাহ্ হয়েছেন তখন তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন। অথচ তিনিও রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর বংশ হিসেবে এ নেতৃত্বকে বানী আব্দ্ মানাফের প্রাপ্য বলে মনে করতেন। এ কারণেই আবু বকরের খলীফাহ্ হওয়ার সংবাদ দেয়া হলে তিনি সাথে সাথে উদ্বেগের সাথে প্রশ্ন করেন ঃ “আব্দ্ মানাফের বংশধররা তার নেতৃত্ব মেনে নিতে রাযী আছে তো?” যখন জবাব দেয়া হলো ঃ “হ্যা,” তখন তিনি বললেন ঃ “আল্লাহ্ তা‘আলা যখন কাউকে কোন কিছু প্রদান করেন তখন কিছুই তাতে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না।”৩৬কেবল আলীই ছিলেন এ ধরনের গোত্রপ্রীতির উর্ধে। কিন্তু হযরত আলী (আঃ)-এর এ সঠিক অবস্থানকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে কাজে লাগানোর জন্যে মিথ্যা রেওয়াইয়াত রচনা করা হয়েছে যে, আবু সুফিয়ানের প্রস্তাবের জবাবে আলী বলেছিলেন ঃ “হে আবু সুফিয়ান! তুমি তোমার জীবনের সুদীর্ঘ কাল ইসলাম ও মুসলমানদের সাথে দুশমনীতে কাটিয়েছো, কিন্তু দ্বীনের কোনোই ক্ষতিসাধন করতে পার নি। আমরা আবু বকরকে এ দায়িত্বের জন্যে যোগ্য মনে করি।” (!) প্রথমতঃ এ রেওয়াইয়াতের সনদের৩৭ ব্যাপারে আমাদের আপত্তি আছে। কারণ এর বর্ণনাকারী এ ঘটনার কয়েক দশক পরের লোক। অন্যদিকে এসব রেওয়াইয়াতের অন্যতম বর্ণনাকারী আবু ‘আওয়ানাহ্ (মৃত্যু ১৫০ হিজরী) মিথ্যা হাদীছ রচনার জন্যে পরিচিত ছিল।৩৮ অপর এক বর্ণনাকারী মার্রাহ্ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, সে আবু বকর ও ওমরকে দেখে নি।৩৯ তাছাড়া রেওয়াইয়াতের বক্তব্যও ত্রুটিপূর্ণ। কারণ, আলী একথা বলে থাকলে আবু সুফিয়ান স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন করতেন, “তাহলে তুমি আবু বকরের অনুকূলে বাই‘আত হচ্ছো না কেন?”ইতিপূর্বে আমরা দলীল সহ উল্লেখ করেছি, আলী বলেছিলেন যে, চল্লিশ জন নিষ্ঠাবান যোদ্ধা সাথে থাকলেও তিনি অভ্যুত্থান করতেন। অতএব, বলা বাহুল্য যে, আলী আবু বকরকে যোগ্য বলেন নি। বরং আবু সুফিয়ান যে হযরত আলী (আঃ)-এর প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন আলী (আঃ) তা ইতিবাচকভাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি মু‘আবিয়াহ্কে লেখা তাঁর পত্রে বলেন ঃ “তোমার পিতা আমার অধিকারকে (হক) তোমার চেয়ে উত্তমভাবে স্বীকার করতেন। তোমার পিতা আমার অধিকারকে যতটুকু স্বীকার করতেন তুমি যদি ততটুকু স্বীকার করতে তাহলে বুঝা যেতো যে, তুমি চৈন্তিক ও বিচারবুদ্ধিগত পরিপক্কতার অধিকারী।”৪০ একদিকে আবু সুফিয়ান আলীকে যুদ্ধে উস্কানি দিয়ে হতাশ হন, অন্যদিকে সমকালীন সরকার তাঁর ব্যাপারে আতঙ্কের মধ্যে ছিল। তাই ওমর আবু বকরের নিকট গিয়ে বলেন ঃ “এই লোকটা এসেছে; ওর নষ্টামি থেকে বাঁচা সম্ভব নয়। এ কারণে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)ও সব সময়ই তার মন জয় করে রাখার চেষ্টা করতেন। তাই ওর কাছে ছাদাক্বাহ্ ও বাইতুল মালের যে অংশ রয়েছে তা ওর কাছেই অর্পণ করুন।” আবু বকর তা-ই করলেন। ফলে আবু সুফিয়ান সন্তুষ্ট হলেন এবং আবু বকরের অনুকূলে বাই‘আত হলেন।৪১ ত্বাবারীর রেওয়াইয়াত থেকে বুঝা যায় যে, সিরিয়ায় প্রেরিত সেনাবাহিনীর সেনাপতিত্ব তাঁর পুত্র ইয়াযীদ বিন্ আবু সুফিয়ানকে দেয়ার পূর্ব পর্যন্ত আবু সুফিয়ান আবু বকরের অনুকূলে বাই‘আত হন নি।৪২পাদটীকা ঃ১. ২য় খণ্ড/ ১০৩; শার্হে নাহ্জুল্ বালাগ্বাহ্, ৬ষ্ঠ খণ্ড/ ২৮৭-এ অধিকতর বিস্তারিত রেওয়াইয়াত রয়েছে।২. ত্বাবারী, ৩য় খণ্ড, সীরাতে ওমর প্রসঙ্গে; ইবনে আবিল হাদীদ ঃ “লিল্লাহি বিলাদুন্ ফুলানূন্”-এর ব্যাখ্যায়, দ্বাদশ খণ্ড/ ৪৯ ও ৫১।৩. সূরাহ্ মুহাম্মাদ ঃ ৯।৪. শার্হে নাহ্জুল্ বালাগ্বাহ্, ২য় খণ্ড/ ১৩১ ও ৬ষ্ঠ খণ্ড/ ১৭ (জাওহারীর সাক্বীফাহ্ থেকে উদ্ধৃত)।৫. শার্হে নাহ্জুল্ বালাগ্বাহ্, ২য় খণ্ড/ ১৩১-১৩২ ও ৬ষ্ঠ খণ্ড/ ১৭ (জাওহারীর সাক্বীফাহ্ থেকে উদ্ধৃত)।৬. শার্হে নাহ্জুল্ বালাগ্বাহ্, ৬ষ্ঠ খণ্ড/ ৫ (জাওহারীর সাক্বীফাহ্ থেকে উদ্ধৃত); তারীখে ইয়াকুবী, আবু যারের সমালোচনা প্রসঙ্গ।৭. তারীখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড/ ১১৪।৮. শার্হে নাহ্জুল্ বালাগ্বাহ্, ২য় খণ্ড/ ১৩৩ (জাওহারীর সাক্বীফাহ্ থেকে উদ্ধৃত); ত্ববাক্বাত, ২য় খণ্ড, ক্বাফ ২/ ১২৯।৯. মাস‘উদী ঃ মুরুজুয্ যাহাব, ২য় খণ্ড/ ৬০; শার্হে নাহ্জুল্ বালাগ্বাহ্, ২য় খণ্ড/ ৬৫; নাছ্র্ বিন্ মুযাহিম ঃ ছিফফীন, পৃঃ ১৩৫।১০. আল-মা‘আরিফ, পৃঃ ১২৮।১১. আল্-ইস্তি‘আব, ১ম খণ্ড/ ৩৯৮; আল-ইছাবাহ্, ১ম খণ্ড/ ৪০৬; উসদুল্ গ্বাবাহ্, ২য় খণ্ড/ ৯২; শার্হে নাহ্জুল্ বালাগ্বাহ্, ৬ষ্ঠ খণ্ড/ ১৩।১২. উসদুল্ গ্বাবাহ্, ২য় খণ্ড/ ৯২; শার্হে নাহ্জুল্ বালাগ্বাহ্, ২য় খণ্ড/ ১৩৫।১৩. ত্বাবারী, ২য় খণ্ড/ ৫৮৬; ইবনে ‘আসাকের ঃ তাহ্যীব, ৫ম খণ্ড/ ৪৮; আনছাবুল আশরাফ, ১ম খণ্ড/ ৫৮৮।১৪. তারীখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড/ ১০৫।১৫. উসদুল্ গ্বাবাহ্, ২য় খণ্ড/ ৯২; শার্হে নাহ্জুল্ বালাগ্বাহ্, ২য় খণ্ড/ ১৩৫।১৬. ত্বাবারী, ২য় খণ্ড/ ৫৮৬; ইবনে ‘আসাকের ঃ তাহ্যীব, ৫ম খণ্ড/ ৪৮; আনছাবুল আশরাফ, ১ম খণ্ড/ ৫৮৮।১৭. ইস্তি‘আব, ২য় খণ্ড/ ৪৩; আল্-ইছাবাহ্, ২য় খণ্ড/ ২৭।১৮. ত্বাবারী, ২য় খণ্ড/ ৪৫৯; ইবনে আছীর, ২য় খণ্ড/ ২৪৪; কানযুল ‘উম্মাল্, ৩য় খণ্ড/ ১৩৪, হাদীছ নং ২২৯৬ ও আরো অনেক সূত্র।১৯. আর-রিয়াউন্ নায্রাহ্, ১ম খণ্ড/ ১৬৮ এবং ইতিপূর্বে উল্লিখিত সূত্রসমূহ।২০. ত্বাবাক্বাত, ৩য় খণ্ড, ক্বাফ ২/ ১৪৫; ইবনে ‘আসাকের ঃ তাহ্যীব, ৬ষ্ঠ খণ্ড/ ৯০; কানযুল ‘উম্মাল, ৩য় খণ্ড/১৩৪, হাদীছ নং ২২৯৬; সীরাতে হালাবী, ৩য় খণ্ড/ ৩৯৭।২১. ‘ইক্বদুল ফারীদ, ৩য় খণ্ড, ৬৪; আনছাবুল্ আশরাফ, ১ম খণ্ড/ ৫৮৮।২২. মুরূজুয্ যাহাব, ১ম খণ্ড/ ৪১৪, ২য় খণ্ড/ ১৯৪।২৩. ‘ইক্বদুল ফারীদ, ৩য় খণ্ড/ ৬৪।২৪. ৩য় খণ্ড, ক্বাফ ২/ ১৪৫; ইবনে কুতাইবাহ্ ঃ আল্-মা‘আরেফ, পৃঃ ১১৩।২৫. উস্দুল গ্বাবাহ্, সা‘দ্ বিষয়ক আলোচনা; ইস্তি‘আব, ২য় খণ্ড/ ৩৭।২৬. আল্-ইমাম ‘আলী বিন্ আবী ত্বালিব, ১ম খণ্ড/ ৭৩।২৭. যেমন ঃ ত্বাবারী, ইবনে আছীর ও ইবনে কাছীর।২৮. যেমন ঃ মুহিব্বুদ্দীন ত্বাবারী তাঁর “রিয়াযুন্ নায্রাহ্” গ্রন্থে ও ইবনে আব্দুল্ বার তাঁর “আল্-ইস্তি‘আব্” গ্রন্থে। ২৯. সা‘দ যে আবু বকরের অনুকূলে বাই‘আত হন নি এ ঘটনা ইবনে সা‘দ, ইবনে জারীর, ইবনে কুতাইবাহ্, বালাযুরী, ইবনে হাজার, ইবনে আছীর, ইবনে আবদু রাব্বিহ্, ইবনে আবদুল্ বার, ইবনে আবদুল হাদীদ প্রমুখ ১৪ জন বিখ্যাত ইতিহাসকার উল্লেখ করেছেন।৩০. ত্বাবারী, ইবনে আছীর ও ইবনে কাছীর কর্তৃক সাক্বীফাহ্র ঘটনার বর্ণনা দ্রষ্টব্য।৩১. তাঁর সফরের বিবরণ দেখুন ঃ ‘ইক্বদুল্ ফারীদ,৩য় খণ্ড/ ৬২; শার্হে নাহ্জুল্ বালাগ্বাহ্, ২য় খণ্ড/ ১৩০।৩২. বানী তীম্ বিন্ মার্রাহ্ আবু বকরের গোত্র ও বানী ‘আদী ওমরের গোত্র।৩৩. তারীখে ইয়াকুবী, ২য় খণ্ড/ ১০৫; শার্হে নাহ্জুল্ বালাগ্বাহ্, ৬ষ্ঠ খণ্ড/ ৭।৩৪. ২য় খণ্ড/ ৪৪৯।৩৫. শার্হে নাহ্জুল্ বালাগ্বাহ্, ২য় খণ্ড/ ১৩০ (জাওহারীর সাক্বীফাহ্ থেকে উদ্ধৃত)।৩৬. আনছাবুল আশরাফ, ১ম খণ্ড/ ৫৮৯/; শার্হে নাহ্জুল্ বালাগ্বাহ্, ১ম খণ্ড/ ৫২।৩৭. ত্বাবারী, ৩য় খণ্ড/ ২০২।৩৮. লিসানুল মীযান, ৪র্থ খণ্ড/ ৩৮৪ ও অন্যান্য সূত্র।৩৯. তাহ্যীবুত্ তাহ্যীব্, ১০ম খণ্ড/ ৮৯।৪০. ছিফফীন, পৃঃ ৪৯; আল্-‘ইক্বদুল ফারীদ, ৩য় খণ্ড/ ১৩; শার্হে নাহ্জুল্ বালাগ্বাহ্, ২য় খণ্ড/ ২২১।৪১. আল্-‘ইক্বদুল ফারীদ, ৩য় খণ্ড/ ৬২।৪২. ২য় খণ্ড/ ৪৪৯।