বার্ষিক পবিত্র মিলনমেলা

0 291

মুসলমানদের সবচেয়ে বড়ো বার্ষিক সমাবেশ বা মিলনমেলা হলো হজ্জ্ব। হজ্জ্বের আধ্যাত্মিক দিক তো রয়েছেই,তার বাইরেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও প্রান্ত থেকে আসা বিচিত্র বর্ণ আর সংস্কৃতির মানুষের মাঝে পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে তোলা এবং পরস্পরের সাথে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ ও আন্তরিক যোগাযোগ গড়ে তোলার জন্যে সুবর্ণ এক সুযোগ সৃষ্টি করে এই হজ্জ্ব। হজ্জ্বের অর্জন অসীম। এর পবিত্র ঝর্ণাধারা সদা বহমান। সেজন্যেই ইসলামের ইবাদাতগুলোর অন্যতম একটি স্তম্ভ হলো হজ্জ্ব। হজ্জ্ব তাই হাজ্বীদের অন্তরে অপূর্ব এক স্মৃতির রেখা টেনে যায়,যেই স্মৃতি তাদের অন্তরে স্থায়ী এক পরিবর্তন এনে দেয়।

সম্প্রতি এক ইউরোপীয় মহিলা মক্কা ভ্রমণ করে একটি বই লিখেছেন। বইটির নাম দিয়েছেনমক্কা ভ্রমণমহিলার নাম হলো স্ফোর হাজার। স্ফোর হাজার একজন নও মুসলিম। জার্মানীর নাগরিক তিনি। ইউরোপীয় নও মুসলিম এই ভদ্র মহিলার মক্কা ভ্রমণ কাহিনীটি জনাব মোহাম্মাদ আখগারি ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় কাবাঘর যিয়ারতের ওপর অসংখ্য বই,প্রতিবেদন,প্রবন্ধ-নিবন্ধ আর ভ্রমণ কাহিনী শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে লেখা হয়েছে। তারপরও প্রফেসর অন ম্যরি শিমাল এ বইটির ভূমিকায় লিখেছেন, এই ভ্রমণকাহিনীর সাথে ইতোপূর্বে লেখা অপরাপর ভ্রমণ কাহিনীর পার্থক্য রয়েছে। কারণটা হলো তরুণ এই লেখক নতুন মুসলমান হয়েছেন। সেজন্যে তিনি গভীর আকর্ষণ এবং অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে মক্কা ভ্রমণের সবকিছু লক্ষ্য করার চেষ্টা করেছেন। ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর অন্তরে হজ্জ্বের এতোবেশী প্রভাব পড়েছে যে, তাঁকে আর তাঁর নিজস্ব বিশ্বাস এবং ঈমান থেকে দূরে সরানো সম্ভব নয়।
স্ফোর হাজার ভ্রমণের বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, আমার মাথায়-মুখে ঘাম। ক্লান্ত,তবু প্রশান্ত মনে মর্মর পাথরের একটি থামের সাথে হেলান দিয়েছিলাম। মৃদু বাতাস প্রবাহিত হচ্ছিল। আমার চারদিকে যিয়ারতকারীদের ভিড়। আমি জার্মানীর বিভিন্ন শহর এবং হল্যান্ডের মোট ৪০ জন মুসলমানের সাথে ঝুঁকিপূর্ণ এই সফরটি শুরু করেছিলাম। ফ্রেইবুর্গ এবং শোয়ার্যওয়ার্ল্ড থেকে আমার ভাই-বোনেরাও আমার সাথে এই সফরে সঙ্গী হয়েছেন। কেবল প্রাচ্যেই নয় বরং সমগ্র বিশ্বের মধ্যেই মক্কা ভূখণ্ডের একটা বিশেষ মর্যাদা ও খুবই উচ্চ আসন রয়েছে। প্রতি বছরই কয়েক মিলিয়ন মানুষ কাবা তথা খোদার ঘরের উদ্দেশ্যে মক্কার পথে পা বাড়ায়। যিয়ারতকারীগণ যখন মক্কায় প্রবেশ করে,তখন ৭ বার কাবা ঘরটিকে প্রদক্ষিণ করে। হাজার হাজার মানুষ খালি পায়ে হেরেম শরীফের সাদা মর্মর পাথরের ওপর দিয়ে অগণিত মুসলিম নারী-পুরুষের মাঝে খোদার ঘর তাওয়াফ করে। মনে হয় যেন আল্লাহর রহমতের অসীম সমুদ্রে এসে নিমজ্জিত হচ্ছে তারা,মিশে যাচ্ছে বিচিত্র বিন্দু অভিন্ন সমুদ্রজলে। বিন্দুগুলোর মাঝে ব্যাপক বৈচিত্র্য রয়েছে,অথচ সেই পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তারা নিজেদের এক এবং অভিন্ন ভাবছে,তাদের মাঝে যেন কোনো ভেদাভেদ নেই।

প্রতিটি মুসলমানের জন্যে বিশেষ করে আমাদের মতো নওমুসলিমের মনের সবচে বড়ো আকুতি হলো অন্তত একটিবার হলেও কাবা ঘরের যিয়ারত অর্থাৎ হজ্জের সফরে যাওয়া। হজ্জের অর্থ হলো ইসলামে পুনর্জন্ম লাভ করা। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হজ্জের মাধ্যমে মানুষের ভেতরে পরিবর্তন আনার একটি সুবর্ণ সুযোগ করে দিয়েছেন।….এই সেই কাবাঘর। ঘনক্ষেত্র আকারের সাধারণ একটি ঘর। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের লক্ষ লক্ষ মুসলমান এই ঘরটির দিকে মুখ করেই প্রতিদিন নামায আদায় করে। আমি এখন সেই সুমহান ঘরটির মাত্র কয়েক কদম দূরে অবস্থান করছি। আল্লাহু আকবার…।এই ঘরটিকে ঘিরে কেমন রহস্যময় নীরবতা বিরাজ করছে। মনে মনে ভাবলাম! আমি জার্মানীর অমুসলিম পরিবারের একটা মেয়ে বাবা-মা এবং আমার দাদার সাথে এখানে এসেছি। অমুসলিম এবং একজন মহিলা হয়ে কীভাবে তা সম্ভব হলো! সত্যি বলতে কী ! আমার বাবা-মা ও এই স্থানটি সম্পর্কে জানতো না। তাঁরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণে গেছেন কিন্তু এই কাবাঘর দেখার জন্যে সফর করেন নি। ইব্রাহীম ( আ ),মূসা ( আ ), ঈসা ( আ ) এবং মুহাম্মাদ ( সা ) এর খোদা কি আমাকে এই ঘর দেখার সৌভাগ্য দিয়েছেন ?

এখানে সবাই নিজেদেরকে সৌভাগ্যবান বলে মনে করে। আল্লাহর কাছে অশেষ কৃতজ্ঞতা জানাই এজন্যে যে হজ্জ্ব ভ্রমণের দোয়া তিনি কবুল করেছেন। কেননা এটা আমাদের জন্যে ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার। স্ফোর হাজার আরো বলেন,হেরেম শরীফ অর্থাৎ কাবাঘরের চারপাশের পবিত্র অঙ্গনে আমি বসে বসে গভীরভাবে দেখছিলাম,কাবাকে ঘিরে মানুষের ঢল,চলমান। কালো-সাদা-কফি রঙের,বৃদ্ধ,যুবক,নারী-পুরুষ-শিশু সবাই পোশাক বলতে সাদা এক টুকরো কাপড় কোমর আর ঘাড়ে ঝুলিয়ে দিয়েছে। কেউ চুপ চাপ। কেউবা আবার হা করে কাবা ঘরের দিকে তাকিয়ে আছে। কেউ কোরআন তেলাওয়াতে মশগুল,আবার অনেকেই কথাবার্তায় ব্যস্ত। এই জন সমাবেশের মধ্যে সবচে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যটি হলো এখানকার সবাই পরিতৃপ্ত এবং প্রশান্ত। কত বড়ো সৌভাগ্যের কথা যে,এই গ্রহের মানুষ এমন কারো মাঝে বাস করছে যারা ভালো এবং কল্যাণকেই খুঁজে বেড়াচ্ছে এবং তারা সৎ বন্ধুও বটে। আমি নিজেকে সকল যিয়ারতকারীর মাঝেও নিঃসঙ্গ বা একা ভাবছি না বরং নিজেকে এমন একজনের মতো ভাবছি যার সৃষ্টিকর্তা তাকে দেখছে এবং ইে সৃষ্টিকর্তা তার বান্দার অবস্থা সম্পর্কে সদাসচেতন।

নিজেকে অচেনা অজানা বলে মনে হচ্ছে। আচ্ছা এটা কি স্রষ্টার প্রতি সৃষ্টির প্রেম নাকি সৃষ্টির প্রতি স্রষ্টার? এটা বিশ্বস্রষ্টা আল্লাহর শক্তিমত্তার প্রকাশ যে, তিনি নভোমণ্ডলের প্রতিটি গ্রহ-নক্ষত্রকে নিজ নিজ কক্ষপথে পরিচালিত করছেন। এখানে যে বিষয়টি উপলব্ধি করা যায় তাহলো আল্লাহ পাক সর্বত্র এবং সবকিছুর ওপরই ক্ষমতাশীল। তাঁর রহমতের ছায়া সর্বত্র বিস্তারিত। তিনি অসীম দয়ালু। আমরা মানুষেরা তাঁর নেয়ামতের সীমাহীন সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছি। বলা যায় আমরা তাঁর মাঝে,তাঁর অসীম সত্য ও বাস্তবতার মাঝে বিলীন হয়ে গেছি। এখন তাঁর অভাবে আমাদের অস্তিত্ব থাকবে না। ছোট্ট একটি বিন্দু যেমন মহাসমুদ্রে বিলীন হয়ে চিৎকার করে বলে ওঠে-আমি আর বিন্দু নেই,আমি এখন সমুদ্র।

স্ফোর হাজার তাঁর এই ভ্রমণ কাহিনীটির অন্যত্র লিখেছেন,এরকম একটা উদ্দীপনাময় আবেগ নিয়ে মাসজিদুল হারামের পিলারের ছায়ায় ছায়ায় আমি কাবার কেন্দ্রের দিকে যাচ্ছি। হঠাৎ পরিবর্তিত এক দৃষ্টিকোণ থেকে কাবার একটি অংশকে দেখলাম। মনে হলো যেন সে ও আমাদেরকে দেখছে। আমি প্রতিরোধের শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। এক ধরনের আনন্দ যেন আমার অস্তিত্বকে ঘিরে,আমি যেন আত্মিক দিক থেকে উচ্চ এক অবস্থায় রয়েছি। আমি পায়ের জুতোগুলো খুলে ফেললাম। মাসজিদুল হারামের বি¯তৃত শ্বেত অঙ্গনে ধীরে ধীরে প্রশান্তভাবে আমার পা ফেললাম এবং যিয়ারতকারীদের তাওয়াফের বন্যায় একটি ছোট্ট বিন্দুর মতো নিজেকেও মিলিয়ে নিয়ে প্রথমবার তাওয়াফ করলাম। আল্লাহু আকবার অলিল্লাহিল হামদ…মুসলমানরা কেন হজ্জ্ব করতে যায়-এ প্রশ্নের উত্তর আমি এখন দিতে পারবো।

এর উত্তর হলো মক্কা হচ্ছে তৌহিদের দোলনা আর এই শহর ঈমান এবং আল্লাহর একত্ববাদের উৎসভূমি। এই শহরের ইতিহাস মানব সভ্যতার ইতিহাসের সাথে সমান্তরাল। ঐশী ভাষ্য অনুযায়ী এটাই হলো সেই স্থান যে স্থানে সর্বপ্রথম আল্লাহর ইবাদাত করা হয়েছিল। এ কারণেই মক্কা-মদীনা ভ্রমণ করা মানে হলো ইসলামের অন্তরে ভ্রমণ করা। আর ইসলামের অন্তর ভ্রমণ করার মানে হলো মানবতার হৃদয়ে ভ্রমণ করা। হাদীসে কুদসিতে যেমনটি এসেছে-আকাশ কিংবা ভূমিতে আমার জায়গার সংকুলান নেই,কিন্তু মুমিন ব্যক্তির অন্তরে আমার স্থান রয়েছে।

এখন আমি আল্লাহর শোকর আদায় করছি এজন্যে যে,তিনি আমার দৃষ্টি খুলে দিয়েছেন এবং এই বরকতপূর্ণ উপত্যকা দেখার সুযোগ করে দিয়েছেন। একটি রেডিওর সাংবাদিক আমার স্বামী সেলিমকে জিজ্ঞেস করেছিলেন-ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছো কেন? সেলিম চমৎকার একটি জবাব দিয়েছে। সে বলেছে-আমি তো ইসলামে প্রবেশ করি নি,ইসলাম আমাদের মাঝে প্রবেশ করেছে। আলহামদু লিল্লাহ! আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইসলামের মাধ্যমে আমাদেরকে তাঁর নিজের ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পিত করেছেন। মিসেস হাজারের মতে-ইসলাম হলো আল্লাহর অসীম রহমতে মানুষের ব্যাকুল মনের ইচ্ছা পূরণ হওয়া। আর এটা এমন এক জিনিস যা আমি খ্রিষ্টধর্মে দেখি নি,এমনকি স্বপ্নেও না।

হজ্জ্বের আধ্যাত্মিক সফর ইসলামের ইবাদাতগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জাঁকজমকপূর্ণ। প্রতিটি হজ্জ্বযাত্রীই অল্প সময়ের জন্যে হলেও মনের গভীরে তার একটা বিশেষ প্রভাব অনুভব করে। গত আসরে আমরা জার্মানীর এক নওমুসলিম মহিলার লেখা কাবা ভ্রমণের কাহিনীতে দেখেছি যে,ইসলাম কীভাবে একজন মানুষকে আধ্যাত্মিক ও লক্ষ্যমুখী জীবন দান করে। তিনি একটা বিশেষ আকর্ষণ ও অনুভূতি নিয়ে কাবা সফরে গেছেন,যাতে তিনি হজ্জ্বের করণীয় আনুষ্ঠানিকতাগুলোর মধ্য দিয়ে আল্লাহর পথকে অনুসরণ বা অতিক্রম করতে পারেন এবং আধ্যাত্মিক জীবনের আস্বাদন লাভ করতে পারেন।

কাবাঘরে উপস্থিত হবার পর নিজেকে সৌভাগ্যবতী বলে মনে করলেন এবং আল্লাহর প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা পোষণ করলেন। তিনি তাঁর অনুভূতিগুলো প্রকাশ করেছেন এভাবে-আমার বিশ্বাস হচ্ছে না যে আমি এখানে উপস্থিত হয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস না হলেও এটাই প্রকৃত বাস্তবতা যে,আমি পবিত্রতম স্থানে আমার পা রেখেছি।মানুষের অন্তরাত্মার বিশুদ্ধতার জন্যে হজ্জ্বের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। মিসেস হাজার হজ্জ্বকে একটি উপঢৌকন হিসেবে অন্যদেরকে উপহার দিচ্ছেন। তিনি বলেন- তুমি তোমার জীবনে কী করবে? কীভাবে জীবনটা কাটাবে? অন্তত একবারের জন্যে হলেও কাবা দর্শনে যাবার চেষ্টা করবে।সেখানে গেলে এমন একটি ঘর দেখতে পাবে যার সম্পর্কে সৃষ্টিকর্তা বলেছেন, মানুষের জন্যে সর্বপ্রথম যে ঘরটি তৈরী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা হলো মক্কার এই কাবাঘর যা অশেষ কল্যাণময় এবং সমগ্র মানব জাতির জন্যে পথপ্রদর্শক। সেখানে আল্লাহর রহমতপ্রাপ্ত সৌভাগ্যবান বহু মনীষীর মাযারও রয়েছে সেসব মাযার যিয়ারত করতে যাও। কাবা এমন একটি স্থান যার প্রতি ইঞ্চি জায়গা আল্লাহর রহমতে পরিপূর্ণ। এটা সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার যা হজ্জ্ব থেকে তোমার জন্যে আনা সম্ভব। তাই সিদ্ধান্ত নাও,হজ্জ্বে যাবার জন্যে পরিকল্পনা গ্রহণ করো। আর যখনই এই সফরে যাও,আমাদের পক্ষ থেকে,জার্মানীর মুসলমানদের পক্ষ থেকে মুহাম্মাদ ( সা ) এবং তাঁর আহলে বাইতের ওপর দরুদ ও সালাম পাঠিয়ে দিও।

হজ্জ্ব মুসলিম এই নারীর জন্যে সৌন্দর্য,পরিবর্তন এবং আধ্যাত্মিকতার শুভবার্তা নিয়ে এসেছে। তাঁর জীবনকে এই বার্তা নতুন এক রং-রূপ ও অর্থ দিয়েছে,যে অর্থ তাঁকে তাঁর অতীত জীবন থেকে আলাদা করে দিয়েছে। তিনি লিখেছেন-কাবা থেকে সামান্য দূরে চতুর্কৌণিক এই ঘরটিকে ঘিরে বৃত্তের মতো ঘুরছিলাম। অনুভব করলাম এখানে হাজরে আসওয়াদ বা কালো পাথর রয়েছে যার সামনে দাঁড়ানো যেতে পারে। চেষ্টা করছি কাবার একেবারে কাছে যেতে…আধা মিটারের মতো আর বাকি…কিন্তু হঠাৎ করে মানুষের ঢলে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। আমার জন্যে এটা এক মজার অভিজ্ঞতা যে এখানকার সবকিছুই চলমান। কিন্তু রেশমি কাপড়ের ওপর স্বর্ণালী কাজ করা গিলাফে ঢাকা কাবা শরীফ মর্যাদার সাথে দাঁড়িয়ে আছে। সে যেন তাওয়াফকারী হাজ্বীদেরকে আন্তরিক এবং প্রকৃত প্রশান্তি উপহার দিচ্ছে। নিচের দিকে তাকালে কাবার দেয়ালের পাথরগুলো দেখা যায়। এই ঘরের মালিকের সাথে নৈকট্য অনুভব করছি, ঘুরছি এবং গুণ গুণ করে পড়ছি-লাব্বাইক..আল্লাহুম্মা লাব্বাইক…..

একটা অবর্ণনীয় ব্যাপার। লক্ষ লক্ষ মানুষ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে এখানে সমবেত হয়েছে,কী চাচ্ছে তারা,কাকেই বা চাচ্ছে! আমি চোখ বুজি। অন্যদের সাথে নিজেকে মেলাতে পেরে এক ধরনের আনন্দ বোধ করলাম। তারপর সাফা-মারওয়ায় গিয়ে ইব্রাহীম ( আ ) এর স্ত্রী হাজেরা ( সা ) এর কাজটির পুনরাবৃত্তি করলাম। তিনি পানির সন্ধানে ৭ বার সাফা এবং মারওয়ার মাঝখানে দৌড়ে ছিলেন। তাঁর স্মরণে আমিও তাই করলাম। ভাবলাম,মক্কা শহরটি তো যমযম পানির কুপ আবি®কৃত হবার কারণেই গড়ে উঠেছে,আর একজন নারী সেই কূপটির আবিষ্কর্তা। সৌভাগ্যক্রমে তাঁর নামের সাথে আমার নামের মিল রয়েছে। হাজেরা ছিলেন ইব্রাহীম ( আ ) এর স্ত্রী এবং ইসমাঈল ( আ ) এর মা। তিনি ছিলেন একজন খোদাপ্রেমী। আল্লাহর ওপর তাঁর ছিল অগাধ বিশ্বাস ও নির্ভরশীলতা। মনের ভেতর এ রকম একটা অনুভূতি লালন করে চমৎকার একটি দিন কাটালাম।

মিসেস স্ফোর তাঁর ভ্রমণকাহিনীর অন্যত্র নবীজীর শহর মদীনার বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন,মসজিদে নববীর বারান্দার নিচে মর্মর পাথরের ওপর হাঁটতে হাঁটতে থমকে দাঁড়াই। এই মসজিদের সম্মান এবং মর্যাদাই মানুষকে ভাবিয়ে তোলে। আমিও ভাবলাম-আমি এমন নেতার যিয়ারতে এসেছি যিনি সূর্যের মতো আলো বিলিয়েছেন মানুষের মাঝে,ফলে আমার উচিত ওযু করে নেওয়া। হঠাৎ কানে ভেসে এলো এক মিষ্টি মধুর ধ্বনি,আযানের ধ্বনি। মুয়াযযিন অপেক্ষমান মুসল্লিদের সুরেলা কণ্ঠে আহ্বান জানায়। তাঁর ঐ আযানের ধ্বনি শূণ্যে ঘুরপাক খেয়ে বেড়ায়। এ ধরনের সুরেলা আযানের ধ্বনি কেবল মদীনাতেই শুনতে পাওয়া যায়। আযান শোনার পর মুসল্লিরা দলে দলে এসে নামায আদায়ের জন্যে সমবেত হয়। সেদিন থেকে যেখানেই যখন আযানের ধ্বনি শুনতে পাই, তখনই নবীজীর পূণ্যভূমি মদীনার স্মৃতি আমার মনে ভেসে ওঠে আর অজান্তেই আমার দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্র”,সেটা আনন্দের নাকি আবেগের-কে জানে।
জার্মান এই মুসলিম মহিলা আরো বলেন,আমি কিছুই জানতাম না মদীনার কোথায় যাবো,ঠিক কোন জায়গাটাকে ইবাদাতের জন্যে বেছে নেবো। যাই হোক ওজু করার পর ভালো লাগছিল,পুরো পৃথিবীটাকে অন্যরকম মনে হচ্ছিল। এই প্রথমবারের মতো আমি মদীনায় নামায পড়ছি। এই নামায কতো প্রশান্তিদায়ক। কেবলি মনে হচ্ছিল যেন রাসুলে খোদা আমাকে দেখছেন। মদীনার দিনগুলো আমার এতো বেশি স্মৃতিময় যে কখনোই তা ভোলা যাবে না। আমাদের কাফেলার আলেম বলেছেন-অধিকাংশ যিয়ারতকারীই জানে না যে মদীনায় প্রতি মুহূর্তে ৭০ হাজার ফেরেশতা যাওয়া-আসা করে। কেননা এখানে বিশ্রাম নিচ্ছেন এমন এক মহান ব্যক্তিত্ব যাঁর গঠনমূলক ও উন্নত শিক্ষা পেয়ে বিশ্ব আমূল পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। সকল নবীই মানুষকে খোদার সাথে পরিচয় করানো এবং তাদের ভেতর খোদার প্রেম জাগানো অর্থাৎ আল্লাহর পথে পরিচালিত করার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। সত্যি বলতে কী,যে-কেউ এক বারের জন্যে হলেও মদীনায় আসে এবং নবীজীর রওযার সামনে দাঁড়ায়,তার মাঝে সেই প্রেমবোধ অনুভূত হয়।

মিসেস স্ফোর তাঁর মক্কা ভ্রমণ কাহিনীতে মাঝে মধ্যেই কিছু প্রশ্নের অবতারণা করেছেন এবং শীঘ্রই সেসব প্রশ্নের উত্তরও পেয়ে গেছেন। তিনি লিখেছেন এটা কি আদৌ সম্ভব যে জার্মান নাগরিক হয়ে মুসলমান হওয়া যাবে? আচ্ছা ইসলাম কি কেবল প্রাচ্যের জনগণেরই উপযুক্ত ধর্ম? ইসলাম ধর্মের যে সম্মান এবং এই ধর্মের নবীর যে উচ্চ মর্যাদা-তা প্রমাণ করে যে ইসলাম কেবল প্রাচ্যের জনগণের জন্যেই সীমাবদ্ধ নয়। সুমহান ব্যক্তিত্বের অধিকারী নবীজীর সার্বজনীন চিন্তা এবং নির্দোষ-নির্মল আচরণ ও কর্মতৎপরতা থেকে অন্তত তাই মনে হয়। মুহাম্মাদ ( সা ) আজ পর্যন্ত মানুষের জন্যে নৈতিক ও চারিত্র্যিক সৌন্দর্যের অনুসরণীয় শ্রেষ্ঠ আদর্শ। তাঁর সুন্নাত বা কর্মকাণ্ডের যে ঐতিহ্য তা কেবল একটা নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের মানুষের জন্যে সীমাবদ্ধ থাকার মতো নয় বরং তা বিশ্বজনীন। কেননা তিনি নতুন অর্থাৎ আজগুবি কোনো কিছু নিয়ে আসেন নি বরং তাঁর শিক্ষাগুলোর মধ্যে এমন কিছু চিন্তা বা বিবেকের খোরাক রয়েছে যেগুলো এর আগেও মানুষের স্বভাব-প্রকৃতিতে বিরাজমান ছিল। তিনি কেবল যথার্থ নেতৃত্ব দিয়ে চোখের ভেতর সত্যের নূর প্রজ্জ্বলিত করে দিয়েছেন এবং সবাইকে সত্য ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করেছেন।

জার্মান নওমুসলিম মহিলা মিসেস স্ফোর তাঁর মক্কা ভ্রমণকাহিনীর উপসংহারে রাসূলে খোদার সাথে তার অঙ্গিকার নবায়ন করে লিখেছেন, শেষবারের জন্যে মসজিদে নববীর দিকে যাচ্ছি তাঁকে সালাম জানাতে এবং প্রিয়নবীর কাছ থেকে বিদায় নিতে। যে দরুদ পাঠের মধ্য দিয়ে তাঁর কাছ থেকে বিদায় নেই,সেই সুর এখনো আমার অন্তরে একইভাবে বাজে। আমি জানি রাসূলে খোদার রওজা মোবারক যিয়ারত করতে পারাটা পরম এক সৌভাগ্য। এই রওজার মুহাম্মাদী নূর সকল মানষকে আলোকিত করে। যাই হোক,আমরা দোয়া করার জন্যে হাত তুললামঃ হে প্রিয় রাসূল! আল্লাহর প্রিয়তম বন্ধু এবং দূত! তুমি সবসময় সর্বত্র আমাদের সাথে থেকো। আমাদের নিঃসঙ্গ করে ছেড়ে যেও না। মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর দরবারে আমাদের জন্যে দোয়া করো যাতে অন্তত আরেকটিবার তোমার যিয়ারতে আসতে পারি। হে দোয়াকারীদের সহায়ক! হে মুমিনদের নেতা!

Leave A Reply

Your email address will not be published.