হযরত আলী (আ.)-এর খেলাফত ও তার প্রশাসনিক পদ্ধতি

0 819

হিজরী ৩৫ সনের শেষ ভাগে হজরত আলী (আ.)-এর খেলাফত কাল শুরু হয়প্রায় ৪ বছর ৫ মাস পর্যন্ত এই খেলাফত স্থায়ী ছিলহযরত আলী (আ.) খেলাফত পরিচালনার ব্যাপারে হযরত রাসুল (সা.)-এর নীতির অনুসরণ করেন[1] তাঁর পূর্ববর্তী খলিফাদের যুগে যেসব (ইসলামী নীতি মালার) পরিবর্তন ঘটানো হয়েছিল, তিনি সেগুলোকে পুনরায় পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আসেনখেলাফত

প্রশাসনে নিযুক্ত অযোগ্য লোকদের তিনি দায়িত্ব থেকে অপসারণ করেন[2] তাঁর এসব পদক্ষেপে প্রকৃতপক্ষে এক বৈপবিক আন্দেলন ছিল, যা পরবর্তিতে প্রচুর সমস্যারও সৃষ্টি করেছেহযরত ইমাম আলী (আ.) খেলাফতের প্রথম দিনে জনগণের উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দিয়ে ছিলেন সেখানে তিনি বলেনঃ হে জনগণ! জেনে রেখো নবুয়াতের যুগে যে সমস্যায় তোমরা ভুগেছিলে আজ আবার সেই সমস্যাতেই জড়িয়ে পড়লেতোমাদের মধ্যে একটা ব্যাপক পরির্বতন ঘটবেযে সকল মহ ব্যক্তিরা এতদিন পিছিয়ে ছিলেন তাঁরা এখন সামনের সারিতে চলে আসবেনএকইভাবে যেসব অযোগ্য লোক এতদিন সামনের সারিতে অবস্থান নিয়েছিল আজ তারা পিছনে চলে যাবে। (সত্য ও মিথ্যা বিদ্যমান এবং এতদুভয়ের প্রত্যেকেরই অনুসারীও রয়েছেতবে সবারই উচিত সত্যকে অনুসরণ করা) মিথ্যার পরিমাণ যদি অধিকও হয়, সেটা এমন নতুন কিছু নয়সত্যের পরিমাণ যদি কমও হয়, হোক না! অনেক সময় কমওতো সবার চেয়ে অগ্রগামী হয়ে থাকেআর উন্নতির আশাও এতে রয়েছেতবে এমনটি খুব কমই দেখা যায় যে, যা একবার মানুষের হাতছাড়া হয়ে গেছে তা পুনরায় তার কাছে ফিরে এসেছে[3]

এ ভাবে হযরত আলী (আ.) তাঁর বৈপবিক প্রশাসনকে অব্যাহত রাখেনকিন্তু বৈপবিক আন্দোলন সমূহের ¯^vfvweK পরিণতি হচ্ছে, এই আন্দোলনের ফলে যাদের ¯^v_© বিঘ্নিত হয়, তারা এ ধারার বিরোধী হয়ে ওঠেআমরা দেখতে পাই হযরত আলী (আ.)-এর খেলাফতের বৈপবিক নীতি বহু ¯^v‡_©‡š^lx মহলকে আঘাত করেছিলতাই শুরুতেই সারা দেশের যত্রতত্র থেকে আলী (আ.)-এর খেলাফতের বিরোধী সূর বেজে ওঠেবিরোধীরা তৃতীয় খলিফার রক্তের প্রতিশোধের ষড়যন্ত্র মুলক শ্লোগানের ধুঁয়ো তুলে বেশ কিছু রক্তাক্ত যুদ্ধের অবতারণা করেএ জাতীয় গৃহযুদ্ধ হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর সমগ্র খেলাফতকালব্যাপী অব্যাহত ছিলশীয়াদের দৃষ্টিতে ব্যক্তিগত ¯^v_© উদ্ধার ছাড়া এসব যুদ্ধের সূচনাকারীদের অন্য কোন উদ্দেশ্যই ছিল না

তৃতীয় খলিফার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের শ্লোগান ছিল সম্পূর্ণরূপে গণপ্রতারণামূলক একটি রাজনৈতিক হাতিয়ারএমনকি কোন ভুল বোঝা বুঝির এখানে অবকাশ নেই[4]

হযরত আলী (আ.)-এর যুগে সংঘটিত প্রথম যুদ্ধ যা জংগে জামাল নামে পরিচিত, তা শুধুমাত্র শ্রেণী বৈষম্যগত মত পার্থক্যের জঞ্জাল বৈ আর কিছুই ছিল নাঐ মতর্পাথক্য দ্বিতীয় খলিফার দ্বারা বাইতুল মালের অর্থ বন্টনের শ্রেণীগত বৈষম্য সৃষ্টির ফলে উদ্ভত হয়েছিলহযরত ইমাম আলী (আ.) খলিফা হওয়ার পর ঐ সমস্যার সমাধান ঘটান এবং তিনি জনগণের মধ্যে সমতা ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে বাইতুল মালের অর্থের সুষম বন্টন করেন[5] আর এটাই ছিল হযরত রাসুল (সা.)-এর জীবনার্দশকিন্তু হযরত আলী (আ.)-এর এ পদক্ষেপ তালহা ও যুবাইরকে অত্যন্ত †µvavwš^Z করেছিলযার ফলে তারা হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বিরোধীতা করতে শুরু করেনতারা যিয়ারতের নাম করে মদীনা ছেড়ে মক্কায় গেলেনউম্মুল মুমেনীন হযরত আয়েশা তখন মক্কায় অবস্থান করছিলেনতারা এটা ভাল করেই জানতেন যে, ইমাম আলী (আ.)-এর সাথে উম্মুল মুমেনীন আয়েশার সর্ম্পকের টানা পোড়ন চলছেএ অবস্থাকে তারা আপন ¯^v‡_© কাজে লাগান এবং নবীপত্মী আয়েশাকে খুব সহজেই হযরত আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে নিজপক্ষে টেনে নিতে সমর্থ হনঅতঃপর তৃতীয় খলিফার হত্যার বিচারের দাবীর শ্লোগানে আন্দোলন গড়ে তোলেনঅবশেষে জংগে জামাল নামক এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনা করেন[6] অথচ এই প্রসিদ্ধ সাহাবীদ্বয় তাল্‌হা ও যুবায়ের বিপবীদের দ্বারা ওসমানের বাড়ী ঘেরাওকালীন মুহুর্তে মদীনাতেই ছিলেনকিন্তু তৃতীয় খলিফা ওসমানকে শত্রুদের হাত থেকে রক্ষার ব্যাপারে এতটুকু সাহায্যও তারা করেননি[7] এমনকি খলিফা ওসমান নিহত হওয়ার পর মুহাজিরদের পক্ষ থেকে সর্ব প্রথম তিনিই হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন[8] ওদিকে নবীপত্নী আয়েশাও ¯^qs ওসমানের বিরোধীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেনতিনি ওসমানকে হত্যার ব্যাপারে সব সময়ই বিরোধীদেরকে উদ্বুদ্ধ করতেন নবীপত্নী আয়েশা ওসমানের নিহত হওয়ার সংবাদ শোনা মাত্রই তার প্রতি অপমান সূচক শব্দ উচ্চারণ করেন এবং আনন্দ প্রকাশ করেনতৃতীয় খলিফাকে হত্যার ব্যাপারে মূলত রাসুল (সা.)-এর সাহাবীরাই জড়িত ছিলেনতারা মদীনার বাইরে বিভিন্ন স্থানে চিঠি পাঠানোর মাধ্যমে জনগণকে খলিফার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করেন

হযরত আলী (আ.)-এর খেলাফতের যুগে দ্বিতীয় যে যুদ্ধটি সংঘটিত হয়েছিল, তাহচ্ছে সিফফিনের যুদ্ধদীর্ঘ দেড়টি বছর এ যুদ্ধ অব্যাহত থাকেএ যুদ্ধটি ছিল কেন্দ্রীয় খেলাফত প্রসাশন দখলের জন্যে মুয়াবিয়ার চরম লালসার ফসলতৃতীয় খলিফার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের ছলনাময়ী শ্লোগানের ছত্রছায়ায় তিনি এ যুদ্ধের অবতারণা করেনএ যুদ্ধে প্রায় এক লক্ষেরও বেশী লোক অন্যায়ভাবে নিহত হনএ যুদ্ধে মুয়াবিয়াই ছিলেন প্রথম আক্রমনকারীএটা কোন আত্মরক্ষামুলক যুদ্ধ ছিল নাবরং এটা ছিল মুয়াবিয়ার পক্ষ থেকে একটি আক্রমনাত্মক যুদ্ধকারণ, প্রতিশোধ গ্রহণমূলক যুদ্ধ কখনই আত্মরক্ষামূলক হতে পারে নাএ যুদ্ধের শ্লোগান ছিল তৃতীয় খলিফার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণঅথচ তৃতীয় খলিফা তার জীবনের শেষ দিনগুলোতে দেশের রাজনৈতিক অরাজকতা ও বিশৃংখলা দমনে মুয়াবিয়ার কাছে সাহায্য চেয়ে পাঠানমুয়াবিয়াও তার সেনাবাহিনীসহ সিরিয়া থেকে মদিনার দিকে অগ্রসর হনকিন্তু মুয়াবিয়া উদ্দেশ্যমুলক ভাবে পথিমধ্যে এত বেশী দেরী করেন যে, ততদিনে তৃতীয় খলিফা বিপবীদের হাতে নিহত হনএ সংবাদ পাওয়া মাত্রই মুয়াবিয়া তার বাহিনী সহ সিরিয়ায় ফিরে যানএর পর সিরিয়ায় ফিরে গিয়ে তিনি তৃতীয় খলিফার হত্যার বিচারের দাবীতে বিদ্রোহ শুরু করেন[9] সিফ্‌ফিন যুদ্ধের পর নাহরাওয়ান যুদ্ধ সংঘটিত হয়রাসুল (সা.)-এর বেশ কিছু সাহাবীও এ যুদ্ধে জড়িত ছিলেনএকদল লোক যারা সিফফিনের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিল, তারাই পরবর্তীতে আবার মুয়াবিয়ার প্ররোচণায় হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেতারা তদানিন্তন ইসলামী খেলাফত বা রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে থাকেতারা হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর অনুসারী বা সমর্থকদের সন্ধান পাওয়া মাত্রই তাদেরকে হত্যা করতএমন কি গর্ভবতী মহিলাদের পেট চিরে গর্ভস্থ সন্তানকে বের করে তাদের মাথা কেটে হত্যা করত[10]

সিফফিন যুদ্ধের পর মুয়াবিয়ার প্ররোচণায় সংঘটিত এ-বিদ্রোহও হযরত ইমাম আলী (আ.) দমন করেনকিন্তু এর কিছুদিন পরই একদিন কুফা শহরের এক মসজিদে নামাযরত অবস্থায় ঐসব খাওয়ারেজদের হাতেই তিনি শাহাদ বরণ করেন

 

ইমাম আলী (আ.)-এর

পাঁচ বছরের খেলাফতের ফসল

 

হযরত আলী (আ.) তাঁর ৪ বছর ৯ মাসের শাসন আমলে খেলাফত প্রশাসনের স্তুপীকৃত অরাজকতা ও বিশৃংখলাকে সম্পূর্ণরূপে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে যদিও সমর্থ হননি তবুও এ ক্ষেত্রে তিনটি মৌলিক সাফল্য অর্জিত হয়েছিল

নিজের অনুসৃত ন্যায়পরায়ণতা ভিত্তিক জীবনাদর্শের মাধ্যমে জনগণকে এবং বিশেষ করে নতুন প্রজন্মকে মহানবী (সা.)-এর পবিত্র ও আকর্ষণীয় জীবনাদর্শের সাথে পরিচিত করেনমুয়াবিয়ার চোখ ধাঁধানো রাজকীয় জীবন যাপন পদ্ধতির সমান্তরালে তিনি জনগণের মাঝে অতি দরিদ্রতম জীবন যাপন করতেনতিনি কখনো নিজের বন্ধু-বান্ধব, পরিবার বা আত্মীয় ¯^Rb‡K অন্যায়ভাবে অন্যদের উপর অগ্রাধিকার দেননিঅথবা ধনীকে দরিদ্রের উপর বা সক্ষমকে অক্ষমের উপর কখনো তিনি অগ্রাধিকার দেননি

পর্বতসম সমস্যাকীর্ণ দিনগুলো অতিবাহিত করা সত্ত্বেও জনগণের মাঝে তিনি ইসলামের সত্যিকারের অমূল্যজ্ঞান সম্ভার বা সম্পদ রেখে গেছেন

হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর বিরোধীরা বলত, ইমাম আলী (আ.) একজন মহাবীর ছিলেনতিনি কোন রাজনীতিবিদ ছিলেন নাকেননা, তিনি বিরোধীদের সাথে সাময়িক বন্ধুত স্থাপন ও তেলমর্দনের মাধ্যমে তিনি পরিস্থিতিকে শান্ত করে, নিজের খেলাফতের ভিত্তিকে শক্তিশালী করতে পারতেনঅতঃপর সময় বুঝে তাদের দমন করতে পারতেন

কিন্তু বিরোধীরা একথাটি ভুলেগেছে যে হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর খেলাফত ছিল এক বৈপবিক আন্দোলনআর যে কোন বৈপবিক আন্দোলনকেই সব ধরণের তৈল মর্দন ও মেকী আচরণ নীতিগুলো বর্জন করতে হয়ঠিক একই পরিস্থিতি মহানবী (সা.)-এর নবুয়ত প্রাপ্তির যুগেও পরিলক্ষিত হয়মহানবী (সা.)-কে মক্কার কাফের ও মুশরিকরা বহুবার আপোষের প্রস্তাব দিয়ে ছিলতাদের প্রস্তাব ছিল, মহানবী (সা.) যেন তাদের খোদা গুলোর ব্যাপারে প্রকাশ্য বিরোধীতা না করেন, তাহলে তারাও মহানবী (সা.)-এর ইসলাম প্রচারের ব্যাপারে কোন বাধা দেবে নাকিন্তু মহানবী (সা.) তাদের এই প্রস্তাব আদৌ মেনে নেননিঅথচ নবুয়তের চরম দূর্যোগপূর্ণ সেই দিনগুলোতে তৈলমর্দন ও আপোষমুখী নীতি গ্রহণের মাধ্যমে তিনি নিজের রাজনৈতিক অবস্থানকে সুদৃঢ় করতে পারতেনঅতঃপর সময় সুযোগ মত শত্রুদের দমন করতে পারতেনকিন্তু সত্যিকারের ইসলাম প্রচার নীতি কখনই একটি সত্যকে হত্যার মাধ্যমে অন্য একটি সত্যকে প্রতিষ্ঠা বা একটি মিথ্যাকে দিয়ে অন্য একটি মিথ্যাকে অপসারণ করার অনুমতি দেয় নাএ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াত উলেখযোগ্য[11]

আবার অন্য দিকে হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর শত্রুরা তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য চরিতার্থের জন্যে যে কোন ধরণের অন্যায় অপরাধ এবং ইসলামের সুস্পষ্ট নীতিলংঘনের ব্যাপারেও কুন্ঠিত হয়নিশুধু তাই নয়, নিজেদের চারিত্রিক কলঙ্ক গুলোকে সাহাবী বা মুজতাহীদ (ইসলামী গবেষক) উপাধি দিয়ে আড়াল করার প্রয়াস পেয়েছেনঅথচ হযরত ইমাম আলী (আ.) সব সময়ই ইসলামী নীতিমালার পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসরণের ব্যাপারে ছিলেন বদ্ধ পরিকর

হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর দ্বারা বর্ণিত জ্ঞান-বিজ্ঞান, বুদ্ধিবৃত্তিক প্রজ্ঞা এবং সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ক প্রায় এগারো হাজার অমূল্য সংক্ষিপ্ত হাদীস সংরক্ষিত হয়েছে[12] তিনি ইসলামের সুগভীর জ্ঞানরাজীকে অত্যন্ত শুদ্ধ ও উন্নত অথচ প্রাঞ্জল ভাষার বক্তৃতামালায়[13] বর্ণনা করেছেন[14] তিনিই সর্বপ্রথম আরবী ভাষার ব্যাকারণ ও সাহিত্যের মূলনীতি রচনা করেনতিনিই সর্বপ্রথম ব্যক্তি যিনি ইসলামের উচ্চতর দর্শনের সুদৃঢ় ভিত্তিস্থাপন করেন এবং উন্মুক্ত যুক্তি-বিন্যাস ও যৌত্তিক প্রত্যক্ষ প্রমাণের মাধ্যমে ইসলামকে ব্যাখার নীতি প্রচলন করেনসে যুগের দার্শনিকরা তখনও যেসব দার্শনিক সমস্যার সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়ে ছিলেন, তিনি সেসব সমস্যার সমাধান দিয়ে ছিলেনএমন কি এ ব্যাপারে তিনি এতবেশী গুরুত্বারোপ করতেন যে, যুদ্ধের ভয়াবহ ডামাডোলের মাঝেও[15] সুযোগ মত ঐসব জ্ঞানগর্ভ মুলক পর্যালোচনার প্রয়াস পেতেন

হযরত ইমাম আলী (আ.) ব্যাপক সংখ্যক লোককে ইসলামী পন্ডিত ও বিশেষজ্ঞ হিসেবে গড়ে তোলেন[16] ইমাম আলী (আ.)-এর কাছে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ঐসব জ্ঞানী-পন্ডিতদের মাঝে হযরত ওয়ায়েস কারানী (রা.), হযরত কুমায়েল বিন যিয়াদ (রা.), হযরত মিসাম তাম্মার (রা.) ও রশীদ হাজারীর (রা.) মত অসংখ্য সাধুপুরুষও ছিলেনযারা ইতিহাসে ইসলামী ইরফানের (আধ্যাত্মবাদ) উ হিসেবে পরিচিতইমাম আলী (আ.)-এর শিষ্যদের মধ্যে আবার অনেকেই ইসলামী ফিকাহ (আইন শাস্ত্র), কালাম (মৌলিক বিশ্বাস সংক্রান্ত শাস্ত্র), তাফসীর, কিরাআত (কুরআনের শুদ্ধপঠন শাস্ত্র) ও অন্যান্য বিষয়ের মুল উ হিসেবে পরিচিত

 


[1] তারীখে ইয়াকুবি, ২য় খন্ড, ১৫৪ নং পৃষ্ঠা

[2] তারীখে ইয়াকুবি, ২য় খন্ড, ১৫৫ নং পৃষ্ঠামুরুযুয্‌ যাহাব, ২য় খন্ড, ৩৬৪ নং পৃষ্ঠা

[3] নাহজুল বালাগা, ১৫ নং বক্তৃতা

[4] মহানবী (সা.)-এর মৃত্যুর পর হযরত আলী (আ.)-এর অনুসারী মুষ্টিমেয় কিছু সাহাবী খলিফার বাইয়াত’ (আনুগত্য প্রকাশ) গ্রহণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেনএই সংখ্যালঘু গোষ্ঠির শীর্ষে ছিলেন হযরত সালমান ফারসী (রা.), হযরত আবুযার (রা.), হযরত মিকদাদ (রা.) এবং হযরত আম্মার (রা.)একই ভাবে স্বয়ং হযরত ইমাম আলী (আ.)-এর খেলাফতের সময়ও উলেখযোগ্য পরিমাণ কিছুলোক তার বাইয়াতগ্রহণে অস্বীকৃতি জানায়এ সব বিরোধীদের মধ্যে সবচেয়ে কঠোরপন্থীরা ছিলেন, জনাব সাইদ বিন আস, ওয়ালিদ বিন উকবা, মারওয়ান বিন হাকাম, ওমর বিন আস, বাসার বিন এরাদা, সামার নিজান্দা, মুগাইরা বিন শুআবা ও আরো অনেকেখেলাফতের যুগের এ দুই বিরোধী পক্ষের লোকদের সবার ব্যক্তিগত জীবনী এবং তাদের ঐতিহাসিক কার্যকলাপ যদি আমরা সুক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা করি, তাহলে তাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য আমাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠবেপ্রথম বিরোধী পক্ষের সদস্যরা সবাই ছিলেন হযরত রাসুল (সা.)-এর বিশেষ সাহাবী বৃন্দতাঁরা সংযম সাধনা, ইবাদত, আত্মত্যাগ, খোদা ভীরুতা, ইসলামী চেতনার দিক থেকে রাসুল (সা.) এর বিশেষ প্রিয় পাত্রদের অনর্-ভূক্ত ছিলেনমহানবী (সা.) এঁদের সর্ম্পকে বলেছেনঃ মহান আল্লাহ্‌ আমাকে অবগত করেছেন যে চারজন ব্যক্তিকে তিনি ভাল বাসেনআর আমাকে আদেশ দিয়েছেন, আমিও যেন তাঁদেরকে ভাল বাসিসবাই ঐ ব্যক্তিদের নাম জিজ্ঞেস করলে, এর উত্তরে পর পর তিনবার তিনি প্রথম আলী (আ.) অতঃপর সালমান (রা.), আবুযার (রা.) ও মিকদাদের (রা.) নাম উচ্চারণ করেন” (সুনানে ইবনে মাজা, ১ম খন্ড, ৬৬ নং পৃষ্ঠা।) হযরত আয়েশা (রা.) বলেনঃ হযরত রাসুল (সা.) বলেছেনঃ ‘‘যে দুটি বিষয় আম্মারের (রা.) প্রতি উপস্থাপিত হবে, আম্মার (রা.) অবশ্যই ঐ দুক্ষেত্রে সত্যকেই বেছে নেবে’’ (ইবনে মাজা ১ম খন্ড, ৬৬ নং পৃষ্ঠা। )

মহানবী (সা.) বলেছেনঃ ‘‘আকাশ ও পৃথিবীর মাঝে আবুযারের (রা.) চেয়ে অধিকতর সত্যবাদী আর কেউ নেই’’ (ইবনে মাজা, ১ম খন্ড, ৬৮ নং পৃষ্ঠা।) এদের কারও জীবন ইতিহাসেই শরীয়ত বিরোধী একটি কাজের উল্লেখ পাওয়া যায় নাএরা কেউ অন্যায়ভাবে কোন রক্তপাত ঘটাননিঅন্যায়ভাবে কারও অধিকার কখনও হরণ করেননিকারও অর্থসম্পদ কখনও ছিনিয়ে নেননিজনগণের মাঝে তারা কখনই দূর্নীতি ও পথ ভ্রষ্টতার প্রসারে লিপ্ত হননিকিন্তু দ্বিতীয় বিরোধী পক্ষের ব্যক্তিদের জঘণ্য অপরাধ ও ধ্বংসাত্বক কর্মকান্ডের অসংখ্য সাক্ষীতে ইতিহাস পরিপূর্ণইতিহাসে অন্যায়ভাবে প্রচুর রক্তপাত তারা ঘটিয়েছেনমুসলমানদের ধনসম্পদ লুন্ঠন করেছেনএতসব লজ্জাকর কান্ড তারা ঘটিয়েছেন যে, তা গুনে শেষ করাও কঠিনতাদের ঐ সব ঐতিহাসিক অপরাধের আদৌ কোন যুক্তিপূর্ণ অজুহাত খুঁজে পাওয়া যায় নাতাদের ঐ সব কুকর্মের মোকাবিলায় শুধুমাত্র এটা বলেই সান্তনা দেয়া হয় যে, তারা যত অপরাধই করুক না কেন, আল্লাহ্‌ তো তাদের প্রতি সন্তুষ্ট (রাদিয়াল্লাহু আনহু)কুরআন বা সুন্নায় উল্লেখিত ইসলামী আইন অন্যদের জন্য, ওসব সাহাবীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়!!

[5] মুরুযুয্‌ যাহাব, ২য় খন্ড, ৩৬২ নং পৃষ্ঠানাহজুল বালাগা, ১২২ নং বক্তৃতাতারীখে ইয়াকুবী, ২য় খন্ড, ১৬০ নং পৃষ্ঠাশারহু্‌ ইবনি আবিল হাদীদ, ১ম খন্ড, ১৮০ নং পৃষ্ঠা

[6] তারীখে ইয়াকুবী, ২য় খন্ড, তারীখে আবিল ফিদা, ১ম খন্ড, ১৭২ নং পৃষ্ঠামুরুযুয্‌ যাহাব, ২য় খন্ড, ৩৬৬ নং পৃষ্ঠা

[7] তারীখে ইয়াকুবী, ২য় খন্ড, ১৫২ নং পৃষ্ঠা

[8] মুরুযুয্‌ যাহাব, ২য় খন্ড, ৩৬২ নং পৃষ্ঠানাহজুল বালাগা, ১২২ নং বক্তৃতাতারীখে ইয়াকুবী, ২য় খন্ড, ১৬০ নং পৃষ্ঠাশারহু্‌ ইবনি আবিল হাদীদ, ১ম খন্ড, ১৮০ নং পৃষ্ঠা

[9] তৃতীয় খলিফা যখন বিপ্লবীদের দ্বারা নিজ বাড়ী ঘেরাও অবস্থায় কাটাচ্ছিলেনতখন এ অবস্থার নিরসন কল্পে সাহায্য চেয়ে তিনি মুয়াবিয়ার কাছে পত্র পাঠানমুয়াবিয়া উক্ত পত্র পেয়ে প্রায় বারো হাজার সৈনের একটি সেনাবাহিনীকে অস্ত্রেশস্ত্রে সুসজ্জিত করেনতিনি ঐ সেনাবাহিনী সহ সিরিয়া থেকে মদীনার দিকে রওনা দেনকিন্তু এর পরই তিনি আপন সেনাবাহিনীকে সিরিয়া সীমান্তে অবস্থান করার নির্দেশ দেনঅতঃপর সেনাবাহিনী ঐ অবস্থায় রেখে তিনি একাই মদীনায় গিয়ে তৃতীয় খলিফার সাথে সাক্ষাত করেন এবং খলিফাকে সাহায্যের জন্যে তার প্রয়োজনীয় সামরিক প্রসতী চুড়ান্তের প্রতিবেদন পেশ করেনতৃতীয় খলিফা এর প্রত্যুত্তরে বলেনঃ তুই উদ্দেশ্য-মুলকভাবে সেনাবাহিনীর অভিযান থামিয়ে রেখে এসেছিস, যাতে করে আমি নিহত হই আর আমার হত্যার প্রতিশোধের বাহানায় তুই বিদ্রোহ করার সুযোগ পাসতাই নয় কি? (তারীখে ইয়াকুবী, ২য় খন্ড, ১৫২ নং পৃষ্ঠামুরুযুয যাহাব, ৩য় খন্ড ২৫ নং পৃষ্ঠাতারীখে তাবারী, ৪০২ নং পৃষ্ঠা’)

[10] মুরুযুয যাহাব, ২য় খন্ড ৪১৫ নং পৃষ্ঠা

[11] পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্‌ বলেছেনঃ তাদের কতিপয় বিশিষ্ট ব্যক্তি একথা বলে প্রস্থান করে যে, তোমরা চলে যাও এবং তোমাদের উপাস্যদের পুজায় দৃঢ় থাক’’(-সুরা আস্‌ সোয়াদ, ৬ নং আয়াত।)

আল্লাহ্‌ আরও বলেছেনঃ ‘‘আমি আপনাকে দৃঢ়পদ না রাখলে আপনি তাদের প্রতি প্রায় কিছুটা ঝুকে পড়তেন’’(-সুরা আল ইসরা, ৭৪ নং আয়াত।)

মহান আল্লাহ্‌ বলেছেনঃ ‘‘তারা চায় যে, তুমি নমনীয় হও, তাহলে তারাও নমনীয় হবে’’(সুরা আল কালাম, ৯ নং আয়াত।) উপরোক্ত আয়াত গুলোর হাদীস ভিত্তিক তাফসির দ্রষ্টব্য

[12] কিতাবুল গারার ওয়াদ দারার আমাদি, ও মুতাফাররিকাতু জাওয়ামিউ হাদীস

[13] মুরুযুয্‌ যাহাব২য় খন্ড, ৪৩১ নং পৃষ্ঠাশারহু ইবনি আবিল হাদীদ১ম খন্ড, ১৮১ নং পৃষ্ঠা

[14] আশবাহ্‌ ও নাযাইরু সুয়ুতী ফিন্‌ নাহু ২য় খন্ডশারহু ইবনি আবিল হাদীদ ১ম খন্ড ৬ নং পৃষ্ঠা

[15] নাহ্‌জুল বালাগা দ্রষ্টব্য

[16] শারুহু ইবনি আবিল হাদীদ, ১ম খন্ড, ৬-৯ নং পৃষ্ঠাজঙ্গে জামালেরযুদ্ধে জনৈক বেদুইন ব্যক্তি হযরত আলী (আ.)-কে বললো: হে আমিরুল মুমিনীন!আপনার দৃষ্টিতে আল্লাহ্‌ কি এক? পার্শ্বস্থ সবাই ঐ ব্যক্তিকে আক্রোমণ করে বললো:ঃ হে বেদুইন এ দূর্যোগমুহুর্তে তুমি কি ইমাম আলী (আ.)-এর অরাজক মানসিক পরিসিতি লক্ষ্য করছো না! জ্ঞান চর্চার আর কোন সময় পেলে না”?

ইমাম আলী (আ.) তাঁর সাথীদের লক্ষ্য করে বললেনঃ ঐ ব্যক্তিকে ছেড়ে দাওকেননা, মৌলিক বিশ্বাস ও ইসলামী মতাদর্শের সংশোধন এবং ইসলামের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যকে সুস্পষ্ট করার জন্যেই তো আজ আমি এ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিঅতঃপর তিনি ঐ বেদুইন আরব ব্যক্তির প্রশ্নের বিস্তারিত ব্যাখ্যা সহ উত্তর দিয়ে ছিলেন। (বিহারুল আনোয়ার, ২য় খন্ড, ৬৫ নং পৃষ্ঠা।)

ইসলাম ও শিয়া মাযহাব

Leave A Reply

Your email address will not be published.