হযরত ফাতেমার প্রতি মহানবী (সা.)-এর মহব্বত ও ভালবাসা

0 406

যে সমস্ত বিস্ময়কর বস্তু হযরত ফাতেমার আলোকজ্জ্বল জীবনকে আরো অধিক মর্যদার করে তোলে তা হচ্ছে তাঁর প্রতি মহানবীর অত্যধিক স্নেহ ও ভালবাসাএই ভালবাসা ও স্নেহ এতই অধিক ও প্রচণ্ড আকারে ছিল যে এটাকে রাসূলে আকরামের জীবনের অন্যতম বিষয় বলে গণ্যযদি আমরা এ বিষয়ে যথেষ্ট মনোযোগের সাথে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি তবে দেখবো যে, যেহেতু ইসলামের সুমহান নবী (সা.) মহান আল্লাহ্‌র নিকট তাঁর বান্দাদের মাঝে সর্বোচ্চ মর্যাদা ও নৈকট্য লাভের অধিকারী এবং সকল বিষয়ে ন্যায় ও সত্যের মাপকাঠি ছিলেন সেহেতু নবীর সুন্নাত অর্থা তাঁর কথা ও কাজ এমনকি তাঁর নীরবতাও দীন ও শরীয়তের সনদ হিসেবে পরিগণিত যা সমানভাবে আল্লাহ্‌র কিতাবের পাশাপাশি কিয়ামতের দিন পর্যন্ত উম্মতের প্রতিটি ব্যক্তির কাজে-কর্মে আদর্শ হিসেবে গণ্যকোরআনুল কারিমের স্পষ্ট ঘোষণা হচ্ছে:

(وَ مَا يَنْطِقُ  عَنِ اْلْهَوَي ! إِنْ هُوَ  إِلاَّ وَحْىٌ يُوْحَي)

অর্থা কোন কিছুই তিনি আপন প্রবৃত্তির তাড়নায় বলেন না, তার প্রতিটি কথাই ওহী বলে গণ্য যা তার প্রতি অবতীর্ণ হয়[1]

এ সমস্ত বিষয় বিশ্লেষণ করলে হযরত ফাতেমার আধ্যাত্মিক মাকাম ও সুমহান মর্যাদার বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারি এবং এই ব্যাপারে নিঃসন্দেহে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি, যে নিষ্পাপ ইমামগণ সত্যই বলেছেন: ফাতেমা পবিত্র এবং স্বর্গীয় ব্যক্তিদের মধ্যে গণ্য

হযরত ফাতেমা ছাড়া মহানবী (সা.)-এর আরো কন্যা সন্তান ছিলযদিও তিনি তাঁর পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, সন্তানগণ এমনকি প্রতিবেশী ও অন্যদের প্রতিও দয়াপরবশ ছিলেন তবুও হযরত ফাতেমার প্রতি তাঁর বিশেষ ভালবাসা স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত ছিলমজার ব্যাপার হচ্ছে যে, তিনি বিভিন্ন সময়ে সুযোগমত এ ভালবাসার কথাটা সরাসরি ঘোষণা করেছেন এবং সাহাবাদের সামনে এ ব্যাপারে  গুরুত্বারোপ করেছেন

আর উপরোক্ত বিষয়টি এ ব্যাপারে দলীল যে, হযরত ফাতেমা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের জীবন ইসলামের ভাগ্যের সাথে সংযুক্তনবী

(সা.)-এর সাথে হযরত ফাতেমার সম্পর্ক শুধুমাত্র একজন পিতার সাথে কন্যার সম্পর্কের ন্যায় ছিল না বরং তা একটি সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অর্থা মুসলিম উম্মাহর ভবিষ্যত এবং মুসলমানদের ইমামত ও নেতৃত্ব সম্বন্ধে খোদায়ী নির্দেশাবলীর সাথে পরিপূর্ণ সম্পর্কিত

এখন আমরা হযরত ফাতেমার প্রতি মহানবী হযরত মুহাম্মদ

(সা.)-এর অসীম মহব্বত ও ভালবাসার কিছু নমুনার সাথে পরিচয় হবো এবং সেগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ  করবো:

¯  হযরত রাসূলে আকরাম (সা.)-এর রীতি এরূপ ছিল যে, যখনই কোন সফরের জন্যে প্রস্তুত হতেন তখন সর্বশেষ যার কাছ থেকে বিদায় নিতেন তিনি হলেন হযরত ফাতেমা (আ.)আবার যখন সফর থেকে ফিরে আসতেন তখন সর্বপ্রথম যার সাথে সাক্ষাত  করার  জন্যে  গমন  করতেন  তিনি হলেন হযরত ফাতেমা (আ.)[2]

¯  ইমাম বাকের ও ইমাম সাদেক (আ.) বর্ণনা করেছেন: রাসূলে খোদা (সা.) সর্বদা নিদ্রার পূর্বে ছোট্ট ফাতেমার গালে চুম্বন দিতেন এবং তাঁর মুখমণ্ডল ফাতেমার বক্ষের উপর স্থাপন করে দোয়া করতেন[3]

¯  ইমাম সাদেক (আ.)-এর নিকট থেকে বর্ণিত যে, হযরত ফাতেমা (আ.) বলেছেন: যখন

(لآ تَجْعَلُوْاْ دُعَاءَ اْلْرَّسُوْلِ بَيْنَكُمْ كَدُعَاءِ بَعْضِكُمْ بَعْضًا)

অর্থা রাসূলকে (আহ্বান করার সময়) তোমরা তোমাদের মধ্যে পরস্পরকে যেভাবে আহ্বান কর সেভাবে আহ্বান করো না (তাকে ইয়া রাসূলুল্লাহ্‌বলে আহ্বান করবে)[4]

এ আয়াতটি নাযিল হয় তখন আমি ভীত সন্ত্রস্তু হলাম যে কখনো যেন আমি ইয়া রাসূলুল্লাহ্‌এর স্থানে হে পিতাবলে আহ্বান না করে বসিঅতএব, তখন থেকে আমি আমার পিতাকে ইয়া রাসূলুল্লাহ্‌বলে সম্বোধন করা শুরু করলামপ্রথম দুই অথবা তিনবার এরূপ আহ্বান শ্রবণ করার পর নবী (সা.) আমাকে কিছু না বললেও এরপর আমার দিকে ফিরে বললেন: হে ফাতেমা! উক্ত আয়াতটি তোমার উদ্দেশ্যে অবতীর্ণ হয় নিআর তোমার পরিবার ও বংশের জন্যেও অবতীর্ণ হয় নিতুমি আমা থেকে আর আমিও তোমা থেকেএ আয়াতটি কোরাইশ গোত্রের মন্দ ও অনধিকার চর্চাকারী লোকদের জন্যে অবতীর্ণ হয়েছে যারা বিদ্রোহী ও অহংকারীতুমি পূর্বের ন্যায় আমাকে হে পিতাবলে আহ্বান করোতোমার এরূপ আহ্বান আমার হৃদয়কে পূর্বের  চেয়ে অধিক জীবন্ত এবং মহান আল্লাহ্‌কে অধিক সন্তষ্ট করে[5]

¯  রাসূল (সা.) বলেছেন: ফাতেমা আমার দেহের অংশযে তাকে আনন্দ দেবে সে আমাকে আনন্দিত করবে আর যে তাকে দুঃখ দেবে সে আমাকে দুঃখিত করবেফাতেমা আমার কাছে সবার চেয়ে বেশী প্রিয় ও সম্মানিত[6]

¯  তিনি আরো বলেছেন: “…ফাতেমা আমার দেহের অংশ, আমার অন্তরাত্মাযে তাকে অসন্তষ্ট করে সে আমাকেই অসন্তষ্ট করলোআর যে আমাকে অসন্তষ্ট করলো সে আল্লাহ্‌কেই অসন্তষ্ট করলো[7] 

¯  হযরত আমির শাবি, হযরত হাসান বাসরী, হযরত সুফিয়ান ছাওরী, মুজাহিদ, ইবনে জাবির, হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ্‌ আনসারী এবং  ইমাম বাকির (আ.) ও ইমাম সাদেক (আ.) সকলে রাসূলে আকরাম (সা.) থেকে এভাবে বর্ণনা করেছেন যে তিনি বলেছেন: নিশ্চয়ই ফাতেমা আমার দেহের অংশযে তাকে রাগান্বিত করে সে আমাকে রাগান্বিত করে

ইমাম বুখারীও এরূপ একটি হাদীস হযরত মাসুর ইবনে  মুখরিমাহ্‌ থেকে বর্ণনা করেছেনআর হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ্‌ আনসারী  থেকে এরূপ বর্ণিত আছে যে রাসূল (সা.) বলেছেন: যে ফাতেমাকে কষ্ট দেয় সে যেন আমাকে কষ্ট দেয় আর যে আমাকে কষ্ট দিল সে আল্লাহ্‌কে অসন্তষ্ট করলো

সহীহ মুসলিমও হাফেজ আবু নাঈম রচিত হিলইয়াতুল আউলিয়াগ্রন্থদ্বয় ছাড়াও আহ্‌লে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মনীষীদের রচিত অনেক গ্রন্থে অনুরূপ বর্ণনার হাদীস বর্ণিত আছে[8]

¯  একদা রাসূল (সা.) হযরত ফাতেমাকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে আসলেন এবং (উপস্থিত জনসাধারণকে উদ্দেশ্য করে) বললেন: যে ফাতিমাকে চেনে সে তো চিনেছেইআর যে তাকে চেনে না তার জেনে রাখা উচিত যে ফাতেমা মুহাম্মদের কন্যাসে আমার শরীরের অংশ, আমার হৃদয়, আমার অন্তরাত্মাসুতরাং যে তাকে কষ্ট দেবে সে আমাকেই কষ্ট দিলআর যে আমাকে কষ্ট দিল সে আল্লাহ্‌কে কষ্ট দিল[9]

¯  রাসুলে আকরাম (সা.) বলেছেন: “…আমার কন্যা ফাতিমা পৃথিবীর প্রথম দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত সকল নারীদের নেত্রীসে আমার দেহের অংশ এবং আমার নয়নের মণিফাতেমা আমার হৃদয়ের ফসল এবং দেহের মধ্যে আমার অন্তর সমতুল্যফাতেমা মানুষরূপী একটি হুরযখন সে ইবাদতে দণ্ডায়মান হয় তখন পৃথিবীর বুকে নক্ষত্রসমূহের মত তাঁর জ্যোতি আসমানের ফেরেশতাদের জন্যে প্রজ্বলিত হয়ে ওঠেআর তখন মহান স্রষ্টা তাঁর ফেরেশতাদের বলেন: হে আমার ফেরেশতাকুল! আমার দাসী ফাতেমা, আমার অন্যান্য দাসীদের নেত্রীতাঁর প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ কর, দেখ সে আমার ইবাদতে দণ্ডায়মান এবং আমার ভয়ে তাঁর দেহ কম্পিতসে মন দিয়ে আমার ইবাদতে মশগুলতোমরা সাক্ষী থাক, আমি তাঁর অনুসারীদেরকে জাহান্নামের অগ্নি থেকে রক্ষা করবো[10]

 


[1] আন নাজম : ৩,

[2] বিহারুল আনওয়ার, ৪৩তম খণ্ড, পৃ. ৩৯, ৪০কাশফুল গুম্মাহ্‌, ২য় খণ্ড, পৃ. ৬মানাকিবে শাহ্‌রে আশুব, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১১৩

[3] বিহারুল  আনওয়ার, ৪৩তম খণ্ড, পৃ. ৪২মানাকিবে শাহ্‌রে আশুব, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১১৪

[4] আন নূর : ৬৩

[5] বিহারুল আনওয়ার, ৪৩তম খণ্ড, পৃ. ৩২, ৩৩মানাকিবে শাহ্‌রে আশুব, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১০২বাইতুল আহ্‌যান, পৃ. ১৯

[6] বিহারুল আনওয়ার, ৪৩ম খণ্ড, পৃ. ৩৯মানাকিবে শাহ্‌রে আশুব, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১১২  বাইতুল আহ্‌যান, পৃ. ১৬০

[7] কাশফুল গুম্মাহ্‌, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৪

[8] বিহারুল আনওয়ার, ৪৩তম খণ্ড, পৃ. ৩৯মানাকিবে শাহ্‌রে আশুব, ৩য় খণ্ড, পৃ. ১১২  কানযুল ফাওয়াইদ, কারাজেকি, মাকতাবাহ্‌ মুসতাফাভী, কোম, পৃ. ৩৬০, পঞ্চম অধ্যায়; রেসালাহ্‌ আত্‌ তায়াজ্জুবফুসুল আল মুখতারাহ্‌, শেখ মুফিদ, পৃ. ৫৭

[9] কাশফুল গুম্মাহ্‌, ২য় খণ্ড, পৃ. ২৪

[10] আমালী, সাদুক, পৃ. ৯৯, ১০০

Leave A Reply

Your email address will not be published.