মহানবীর (সা.) ইন্তেকালের পর বিভিন্ন রকম দুঃখ-কষ্ট হযরত ফাতেমার অন্তরে প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করেছিল এবং বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহ তাঁর জীবনটাকে তিক্ত ও অসহ্য করে তুলেছিল। তিনি তাঁর সম্মানিত পিতাকে অত্যন্ত ভালবাসতেন এবং কখনো তাঁর বিচ্ছেদকে সহ্য করতে পারতেন না। একদিকে তাঁর জন্যে পিতার বিয়োগ ব্যথা অত্যন্ত বেদনাদায়ক ছিল। অপরদিকে আমিরুল মুমিনীনের খেলাফতের বিরুদ্ধে চক্রান্তকারীদের আচরণ হযরত ফাতিমা আয যাহরার রুহ্ ও দেহে সাংঘাতিক ক্ষতের সৃষ্টি করে।
আর এ মুছিবত ও দুঃখ কষ্ট ছাড়াও অন্যান্য ব্যথা বেদনা তাঁকে জর্জরিত করেছিল -যার অবতারণা থেকে এখানে বিরত থাকছি- এসকল কারণেই।
হযরত ফাতেমা (আ.) পিতার ইন্তেকালের পর সর্বদা ক্রন্দনরত ও শোকার্ত ছিলেন। তিনি কখনো কখনো তাঁর পিতার কবর যিয়ারতে গিয়ে অনেক কাঁদতেন।[1] আবার কখনো শহীদদের কবরের পাশে গিয়ে আহাযারী করতেন।[2] আর নিজ গৃহে কান্না ও শোক পালন ব্যতীত অন্য কিছুই করতেন না। তাঁর ক্রন্দন ও রোনাজারীর ব্যাপারে মদীনাবাসীরা প্রতিবাদ করলে আমিরুল মুমিনীন আলী (আ.) তাঁর জন্যে ‘জান্নাতুল বাকী’ কবরস্থানের এক প্রান্তে একটি ছোট্ট ঘর তৈরী করে দেন যা পরবর্তীতে ‘বাইতুল আহ্যান’ বা ‘শোকের ঘর’ নামে আখ্যায়িত হয়েছে। হযরত যাহরা (আ.) প্রতিদিন সকালে হাসানাইন তথা ইমাম হাসান ও ইমাম হুসাইনকে সাথে নিয়ে সেখানে চলে যেতেন আর রাত পর্যন্ত কবরগুলোর পাশে কান্নাকাটি করতেন। রাত্রি হলেই আমিরুল মুমিনীন আলী (আ.) তাঁকে কবরস্থান থেকে বাড়িতে নিয়ে আসতেন। আর এ কাজ তাঁর অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।[3] রাসূল (সা.)-এর সাথে বিচ্ছেদে হযরত যাহরার ব্যথা বেদনা ও দুঃখ কষ্ট এত মাত্রায় বৃদ্ধি পায় যে নবী (সা.)-এর যে কোন স্মৃতিই তাঁকে কান্নায় জর্জরিত ও অস্থির করে তুলতো। হযরত রাসূল (সা.)-এর মুয়াযযিন হযরত বেলাল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, নবী (সা.)-এর তিরোধানের পর আর কোনদিন কারো জন্যে আযান দিবেন না। একদিন হযরত যাহরা (আ.) বললেন: “আমার পিতার মুয়াযযিনের কণ্ঠে আযান শুনতে মন চায়”। এ সংবাদ হযরত বেলালের কর্ণগোচর হলে তিনি তড়িৎ গতিতে এসে হযরত ফাতেমার সামনে আযান দিতে দাঁড়িয়ে যান। যখন হযরত বেলালের কণ্ঠে আল্লাহু আকবারের ধ্বনি উচ্চারিত হলো তখন হযরত ফাতেমা আর কান্না ধরে রাখতে পারলেন না। আর যখন হযরত বেলালের আযান ‘আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লাহ্’-তে পৌঁছায় তখন হযরত ফাতেমা যাহরা (আ.) উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। উপস্থিত লোকজন হযরত বেলালকে বললেন: “থামুন! রাসূলের কন্যা মারা যাচ্ছেন।” তারা মনে করেছিলেন যে, হযরত ফাতেমা ইহলোক ত্যাগ করেছেন। হযরত বেলাল আযান অসম্পূর্ণ রেখে ক্ষান্ত হলেন। যখন হযরত ফাতেমার চৈতন্য ফিরে আসলো তখন হযরত বেলালকে আযান সম্পূর্ণ করার জন্যে বললেন। কিন্তু হযরত বেলাল তাঁর খেদমতে আরজ করলেন: “হে নারীদের নেত্রী! আমার আযানের ধ্বনি শ্রবণের ফলে আপনার প্রাণনাশের আশংকা করছি।”[4]
অবশেষে হযরত ফাতেমা (আ.)-এর অসহনীয় মর্মপীড়া এবং তাঁর উপর আরোপিত দুঃখ-কষ্ট তাঁকে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই শয্যাশায়ী করে ফেললো। পরিশেষে এ আঘাত ও দুঃখ-কষ্টের কারণে একাদশ হিজরীর জামাদিউল উলার তের তারিখে, কারো মতে জামাদিউসসানী মাসের তৃতীয় দিনে অর্থাৎ হযরত নবী করীমের তিরোধানের মাত্র পঁচাত্তর অথবা পঁচানব্বই দিনের ব্যবধানে তিনি চিরদিনের জন্যে এ নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় গ্রহণ করেন। তিনি তাঁর শাহাদাতের মাধ্যমে তাঁর অনুসারীদের অন্তরসমূহকে চিরদিনের জন্যে শোকের সাগরে ভাসিয়ে গেছেন।[5]
[1] বাইতুল আহ্যান, মুহাদ্দীসে কোম্মী, পৃ. ১৩৭; মুনতাহাল আমাল, পৃ. ১৬৩; কানযুল ফাওয়ায়েদ, কারাচেকী, পৃ. ৩৬০।
[2] বাইতুল আহ্যান, পৃ. ১৪১; মুনতাহাল আমাল, পৃ. ১৬৪; আমালী, সাদুক, পৃ. ১২১; কাশফুল গুম্মাহ্, ২য় খণ্ড, পৃ. ৬০।
[3] বিহারুল আনওয়ার, ৪৩তম খণ্ড, পৃ. ১৭৭, ১৭৮; বাইতুল আহ্যান, পৃ. ১৩৮।
[4] বিহারুল আনওয়ার, ৪৩তম খণ্ড, পৃ. ১৫৭; বাইতুল আহ্যান, পৃ. ১৪০, ১৪১।
[5] এ গ্রন্থ সংক্ষিপ্ত হওযার কারণে ঐ সব ঘটনাবলী বর্ণনা থেকে বিরত থেকেছি যা রাসূল (সা.) ওফাতের পর সংঘটিত হয়েছিল। দৃষ্টান্তস্বরূপ: হযরত ফাতেমার গৃহে অগ্নি সংযোগ, এ মহিয়সী রমণীর মসজিদে নববীতে গমন এবং সেখানে জনগণের চিন্তা-চেতনা পরিশুদ্ধতার লক্ষ্যে বক্তৃতা করা আর বেলায়েতের সীমানা রক্ষায় প্রতিরোধ গড়ে তোলা। তদ্রুপ ফাদাক বাগানের ঘটনা, অসিয়ত ও শাহাদাতের বিবরণী এবং তাঁর শাহাদাতের পর অনুষ্ঠান ইত্যাদি। পাঠক মহোদয়গণ ঐ সমস্ত হৃদয় বিদারক অথচ গঠনমুলক ও তথ্য উম্মোচক ঘটনাবলীর বিস্তারিত বিবরণ সম্বন্ধে অন্যান্য গ্রন্থ যেমন মুহাদ্দীসে কোম্মী রচিত ‘বাইতুল আহ্যান’ গ্রন্থ পাঠে অবহিত হতে পারেন।
সংগ্রহ:হযরত ফাতিমা (আ.)