সর্বশ্রেষ্ঠ সমাজ সংস্কারক

0 658

সমাজ সংস্কার ও ঐক্য প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে রাসুল (সা.) এর কর্ম-কৌশল:রাসুল (সা.) যখন মদীনায় পৌঁছলেন সেখানকার অধিবাসীদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও প্রচুর মতপার্থক্য ছিল। তাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্যও এক ছিল না। তারা একত্রিত হত নিজ নিজ গন্ডিতে। তাদের মধ্যে মতবিরোধ ছিল পুরাতন উত্তরাধিকার সূত্রে। কিছু কিছু নতুন মতবিরোধও ছিল।

 

 মদীনার অধিবাসীরা ছিল মূলত তিনভাগে বিভক্তঃ

ক)-মুসলমান: আউস, খাজরাজ ও মুহাজেরদেরদের সমন্বয়ে। খ)-মুশরিক: আউস, খাজরাজ ও যারা ইসলামে প্রবেশ করেনি তাদের সমন্বয়ে। গ)-ইহুদী: তারা কয়েকটি গোত্রে বিভক্ত ছিলএদের মধ্যে বনু কাইনুকা ছিল খাজরাজ গোত্রের মিত্র। বনু নযীর ও বনু কুরাইযাহ এ দুগোত্র ছিল আওস গোত্রের মিত্র। আউস ও খাজরাজ গোত্রের মধ্যে কঠিন বিরোধ ছিল। মধ্যযুগে তাদের মধ্যে অনেক যুদ্ধ হয়েছে। সর্বশেষ তাদের মধ্যে বুয়াসের যুদ্ধ হয়েছিল। তার কিছু ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া তখনও তাদের মধ্যে চলমান ছিল। রাসুল (সা.) তার মহান কৌশল তার সুন্দর কুটনীতি দ্বারা এই সমস্ত সমস্যা সুন্দর ও স্থায়ীভাবে সমাধান করতে লাগলেন। এই সমস্ত অবস্থার সমাধান ও সংশোধন এবং মুসলমানদের চিন্তা চেতনা একত্রিত করার কার্যক্রম ছিল এ রকমঃ মসজিদ তৈরী এবং সেখানে একত্রিত হওয়া: এই প্রথম কাজটি পরস্পরবিরোধী অন্তরগুলোকে একত্রিত করে দিল। সংশোধন এবং ঐক্য স্থাপনের ব্যাপারে প্রথম কাজ করলেন রাসুল (সা.) মসজিদে নববী প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। এবং সকল মুসলমান তা নির্মাণের কাজে অংশ গ্রহণ করল। তাদের নেতৃত্বে ছিলেন তাদের ইমাম মুহাম্মদ (সা.)। এটাই ছিল প্রথম সেবা ও সহযোগিতা মূলক কাজ যা সমস্ত অন্তরকে এক সুতোয় গেঁথে দিল। এবং কর্মের সাধারণ ল্য স্পষ্ট করল। নবী (সা.) মদীনায় আগমণের পূর্বে প্রত্যেক গোত্রে লোকদের মিলিত হওয়ার জন্য জন্য আলাদা এক একটি নির্দিষ্ট স্থান ছিল। তারা সেখানে রাত্রে বসে গল্প করত। রাতে জাগ্রত থাকত। কবিতা পাঠ করত। আর এ অবস্থা তাদের অনৈক্যেরই প্রমাণ ছিল ও অনৈক্য বিস্তারে সহায়ক ছিল। যখন মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হল, তখন তা সমস্ত মুসলমানদের কেন্দ্র হয়ে গেল ও তাদের সমবেত হওয়ার স্থান হিসেবে গণ্য হল। সব সময় তারা সেখানে সমবেত হত। তারা রাসুল (সা.)কে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন করত। তিনি তাদেরকে শিক্ষা দিতেন,পথ প্রদর্শন করতেন, দিকনির্দেশনা দিতেন। এর মাধ্যমে সমস্ত আলাদা বৈঠকস্থলগুলো এক হয়ে গেল। সমস্ত মহল্লা এক জায়গায় চলে আসল। গোত্রগুলো কাছাকাছি আসল। উপদলগুলো ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হল। অনৈক্য ঐক্যের দ্বারা পরিবর্তিত হয়ে গেল। মদীনায় কোন একাধিক দল থাকল না। বরং সকল দল একটি দলে পরিণত হল। অনেক নেতা থাকল না। বরং নেতা এজনই হয়ে গেল। তিনি হলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)। তিনি তার প্রভুর নিকট থেকে আদেশ নিষেধ প্রাপ্ত হন এবং তার উম্মতকে শিক্ষা দেন। মুসলমানরা এক কাতারের ন্যায় হয়ে গেল। সমস্ত সত্তা ও চিন্তা-চেতনার পথগুলো মিলে গেল একটি মোহনায়। তাদের ঐক্য শক্তিশালী হল। আত্মাগুলো শক্তিশালী বন্ধনে আবদ্ধ হল। শরীরগুলো একে অপরকে সাহায্য করল। মসজিদ শুধু পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের জায়গা ছিল না, বরং সেটি ছিল একটি বিশ্ববিদ্যালয়। মুসলমানরা সেখানে ইসলামের শিক্ষা ও দিকনির্দেশনা গ্রহণ করতো। সেখানে একত্রিত হতো, বিভিন্ন গোত্রের লোকজন পরস্পরে মিলিত হতো। যদিও জাহেলী যুগের যুদ্ধ বিগ্রহ, ঝগড়া তাদের মধ্যে অনেকদিন পর্যন্ত ঘৃণার পরিবেশ তৈরী করে রেখেছিল। মসজিদকে তারা ঘাঁটি বানিয়ে নিয়েছিল সমস্ত কাজ পরিচালনার জন্য। সেখান থেকেই সব বিষয় প্রচার করা হত। পরামর্শ মূলক ও সিদ্ধান্তমূলক কাজের বৈঠকের স্থান ছিল মসজিদ। এই জন্যই মদীনায় রাসুল (সা.) যেখানেই অবস্থান করেছেন, প্রথমে সেখানে মসজিদ তৈরী করছেন। যেখানে মুমিনগণ একত্রিত হবে। যখন কুবায় অবস্থান করেছেন সেখানে মসজিদ বানিয়েছেন। জুমার নামাজ আদায় করেছেন বনী সালেম বিন আউফে, যা কুবা ও মদীনার মধ্যখানে নিচু জাগায় (রানুনা) নামক স্থানে অবস্থিত। মদীনায় পৌঁছে প্রথমে মসজিদ তৈরী করলেন। ইহুদীদেরকে প্রজ্ঞাপূর্ণ কথা দ্বারা ইসলামের দাওয়াত দিলেন: সংস্কার ও ঐক্যের ঘাটি থেকে -যা নবী (সা.) মদীনায় প্রবেশ করার পর বিণির্মান করেছিলেন- ইহুদীদের সাথে আব্দুল্লাহ বিন সালামের মাধ্যমে যোগাযোগ শুরু করলেন এবং তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিতে লাগলেন। আনাস রা. বর্ণনা করেন, ‘আব্দুল্লাহ বিন সালামের কাছে রাসুল (সা.) মদীনায় আসার সংবাদ পৌঁছল। তিনি রাসুলের নিকট এসে বললেনআমি আপনাকে তিনটি বিষয়ে প্রশ্ন করতে চাই। যার উত্তর নবী ব্যতীত আর কেউ দিতে পারবে না। কেয়ামতের প্রথম নিদর্শন কি? জান্নাতবাসী প্রথমে কি খাবার খাবেন? সন্তান কেন তার পিতা অথবা মাতার মত হয়ে থাকে? রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘এ প্রশ্নগুলি সম্পর্কে এখনই জিব্রারাঈল আমাকে সংবাদ দিয়েছেন। ইবনে সালাম বললেন, ফেরেশতাদের মধ্যে ইনিই তো ইহুদীদের শত্রু।রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, কেয়ামতের প্রথম আলামত হল, আগুন আসবে এবং পূর্ব পশ্চিমের মানুষকে একত্রিত করবে। প্রথম খাদ্য যা জান্নাতবাসীরা গ্রহণ করবে তা হল মাছের কলিজার অতিরিক্ত অংশ। আর সন্তান পিতা বা মাতার মত এই কারণে যে, পুরুষ যখন নারীর সাথে মিলিত হয় কখনও পুরুষের বীর্য আগে প্রবেশ করে, তখন সন্তান তার মত আকৃতি ধারণ করে। আর যদি নারীর বীর্য আগে প্রবেশ করে তবে সন্তান তার আকৃতি ধারণ করেআব্দুল্লাহ বিন সালাম বললেন, ‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই এবং আপনি আল্লাহর রাসুল। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! ইহুদীরা মিথ্যারোপকারী জাতি। আপনি তাদেরকে আমার সম্পর্কে প্রশ্ন করার পূবে যদি তারা আমার ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে জানতে পারে তা হলে আপনার নিকট আমার সম্পর্কে মিথ্যা বলবে রাসুল (সা.) তাদেরকে ডেকে পাঠালেন, তারা রাসুলের নিকট আসল। রাসুল (সা.) তাদেরকে বললেন, হে ইহুদী জাতি! তোমাদের ধংস হোক। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। ঐ আল্লাহর শপথ যিনি ব্যতীত আর কোন মাবুদ নেই। তোমরা জান আমি আল্লাহর সত্য রাসূল। আমি তোমাদের কাছে সত্য নিয়ে এসেছি। তোমরা ইসলামে প্রবেশ কর তারা বলল, এ সম্পর্কে আমরা কিছু জানিনা এ কথা তারা তিনবার বলল। রাসুল (সা.) তাদেরকে বললেন, ‘আব্দুল্লাহ বিন সালাম তোমাদের মধ্যে কেমন লোক? তারা বলল, সে তো আমাদের নেতা। আমাদের নেতার সন্তান। আমাদের মধ্যে বড় আলেম-বিদ্বান। আমাদের বড় আলেমের সন্তান রাসুল (সা.) বললেন, সে ইসলাম গ্রহণ করলে তোমরা কি করবে?’ তারা বলল, ‘আল্লাহর আশ্রয়! সে ইসলাম গ্রহণ করতে পারে না রাসূল (সা.) আবার বললেন, সে ইসলাম গ্রহণ করলে তোমরা কি করবে? তারা বলল, ‘আল্লাহর আশ্রয়! সে ইসলাম গ্রহণ করতে পারে না রাসূল (সা.) আবার বললেন, সে ইসলাম গ্রহণ করলে তোমরা কি করবে? তারা বলল, ‘আল্লাহর আশ্রয়! সে ইসলাম গ্রহণ করতে পারে না রাসুল (সা.) বললেন, হে ইবনে সালাম! তাদের সামনে বের হও? ইবনে সালাম বের হয়ে বললেন, হে ইহুদী সমপ্রদায়! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। ঐ আল্লাহর শপথ যিনি ব্যতীত আর কোন মাবুদ নেই, তোমরা জান তিনি আল্লাহর রাসুল, তিনি সত্য নিয়ে এসেছেন। তারা সকলে বলল, ‘তুমি মিথ্যা বলেছ। তুমি আমাদের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট এবং সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তির ছেলে এবং তারা সকলে তার উপর আঘাত করল।এটাই রাসুল (সা.) এর ইহুদীদের নিকট থেকে সর্বপ্রথম অভিজ্ঞতা যা তিনি অর্জন করেছিলেন মদীনায় প্রবেশ করার পর। রাসুল (সা.) এর সুন্দর কৌশল এর মধ্য থেকে একটি হল, তিনি আব্দুল্লাহ বিন সালামের ইসলামের বিষয়টি গোপন করার বিষয়ে একমত হয়েছিলেন। সাথে সাথে তাদের মধ্যে তার মর্যাদার বিষয়ে প্রশ্ন করে জেনে নিলেন। যখন তারা তার প্রশংসা করল ও তার মর্যাদা উচ্চ করে তুলে ধরল। তখনই রাসুল তাকে বের হতে নির্দেশ দিলেন। তিনি বের হলেন ও ইসলাম প্রকাশ করলেন এবং ইহুদীরা নবী (সা.) এর সত্যতার ব্যাপারে যা গোপন করত তা প্রকাশ করে দিলেন। অতঃপর রাসুল (সা.) তাদেরকে ঐ অঙ্গীকারে আবদ্ধ করলেন যা পরবর্তীতে আলোচনায় আসবে। মুহাজের ও আনছারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন সৃষ্টি করা: যেমন নবী (সা.) কর্তৃক মসজিদ নির্মাণ ও ইহুদীদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার মাধ্যমে শুরু করলেন তার কর্মতৎপরতা। অনুরূপভাবে মুহাজের ও আনছারদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি করলেন। আর এটাই হল নবুওয়তী উৎকর্ষতা,সৎপথ প্রদর্শন,রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও মুহাম্মাদী প্রজ্ঞা এবং তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব তৈরী করলেন আনাস বিন মালেক রা. এর ঘরে। তারা নব্বই জন ছিলেন। অর্ধেক মুহাজের, অর্ধেক আনছার। তাদের মধ্যে সহমর্মিতার বন্ধন সৃষ্টি করলেন,মৃত্যুর পর নিকট আত্মীয় না হওয়া সত্বেও পরস্পরে একে অন্যের উত্তরাধিকারী হবেন। এ ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের এ নিয়ম চলতে থাকে বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত। যখন আয়াত অবতীর্ণ হল:  وَأُولُو الْأَرْحَامِ بَعْضُهُمْ أَوْلَى بِبَعْضٍ فِي كِتَابِ الله (الانفال 75)

এবং আল্লাহর বিধানে আত্মীয়গণ একে অন্যের অপেক্ষা অধিক হকদার। (সূরা আনফাল, ৭৫ আয়াত)।তখন থেকে শুধু আত্মীয়তার ভিত্তিতে উত্তরাধিকার ফিরে আসল। ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের কারণে উত্তরাধিকার রহিত হয়ে গেল। জাহেলী যুগের স্বজনপ্রীতি ধুয়ে মুছে গেল। শুধু ইসলামের বিধান অবশিষ্ট রইল। বংশ, বর্ণ এবং ও জাতিভেদের পার্থক্য দূর হয়ে গেল। কেহ সামনে বা পিছনে যেতে পারবে না মানুষত্ব ও তাকওয়া ব্যতীত। ভ্রাতৃত্ব, কুরবানী ও সহমর্মিতার অনুভুতিই সেখানে ছিল মুখ্য। এই ভ্রাতৃত্বের মধ্যে পরস্পরের ভালোবাসা ছিল। নতুন এই সমাজ ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণে পরিপূর্ণ ছিল। আর এই ভ্রাতৃত্বের মধ্যে ইসলামের মানবিক এবং চারিত্রিক ইনসাফের শক্তিশালী রূপ ফুটে উঠেছে। আর এই ভ্রতৃত্ব এমন অঙ্গীকার ছিল না যা শুধু কাগজে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। এমন কথাও ছিল না যা শুধু মুখে বলা হয়েছে। বরং এমনই এক ভ্রতৃত্ব ছিল যা অন্তরের পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছিল। তার প্রয়োগ হয়েছে রক্ত ও সম্পদের মাধ্যমে। শুধু মুখের কথা নয়। কথা ও কাজ, জান ও মাল,সুখ ও দুঃখের ভ্রাতৃত্ব ছিল এটি। এই বিষয়ের উত্তম উদাহরণ ইমাম বুখারী তার সহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন,রাসুল (সা.) আব্দুর রহমান বিন আউফ রা. ও সাআদ বিন রবিইর রা. মধ্যে ভাইয়ের সম্পর্ক গড়ে দিলেন। সাআদ বললেন, আনছাররা জানে যে, আমি তাদের মধ্যে বেশি ধনী। আমি আমার সম্পদ দুই ভাগে ভাগ করব। অর্ধেক থাকবে আমার,আর অর্ধেক তোমার। আমার দুইজন স্ত্রী আছে। তোমার কাছে যাকে বেশি পছন্দ হয় তাকে নিয়ে নাও। আমি তাকে তালাক দিব। যখন তার তালাকের ইদ্দত পূর্ণ হয়ে যাবে,তুমি তাকে বিবাহ করবে। আব্দুর রহমান বিন আওফ রা. বললেন, ‘আল্লাহ তোমার সম্পদে ও সন্তান সন্ততিতে বরকত দান করুন। তোমাদের বাজার কোথায়?’তারা তাকে বনু কায়নুকার বাজার দেখিয়ে দিল। তিনি বাজার থেকে ফিরলেন। তার হাতে পনির ও মাখনের কিছু অংশ ছিল। পরের দিনও তাই করলেন। এভাবে কাজ করতে থাকলেন। অতঃপর একদিন তার শরীরে মেহেদীর রং দেখা গেল। তা দেখে নবী (সা.) তাকে প্রশ্ন করলেন, তোমার কি অবস্থা? তিনি বললেন, ‘আমি আনছারদের এক মহিলাকে বিবাহ করেছি রাসুল বললেন, মোহরানা কি দিয়েছো? তিনি বললেন, খেজুরের দানার ওজন পরিমান স্বর্ণ বা খেজুরের দানা পরিমান স্বর্ণ রাসুল (সা.) বললেন, ‘অলীমা (ভৌভাতের) আয়োজন কর, একটি ছাগল দিয়ে হলেও এ ভ্রাতৃত্ব ছিল একটি কল্যাণকর কৌশল এবং সঠিক কুটনীতি। এবং অনেকগুলো সমস্যা মুসলমানরা যার সম্মুখীন হচ্ছিল তার সুন্দর সমাধান ছিল এ ভ্রাতৃত্ববন্ধন। বিচক্ষণ শিক্ষা: রাসুল (সা.) তাদেরকে শিক্ষা-দীক্ষা, আত্মশুদ্ধির বিষয়ে অঙ্গীকারাবদ্ধ করেছিলেন। সুন্দর চরিত্রের বিষয়ে উদ্বুদ্ধ করছিলেন। তাদেরকে শিষ্টাচার শিক্ষা দিচ্ছিলেন ভালোবাসা, ভ্রাতৃত্ববোধ, ইজ্জত, সম্মান, ইবাদত ও আনুগত্যের বিষয়ে। রাসুল (সা.) বলতেন, ‘হে মানবমন্ডলী! তোমরা সালামের প্রসার ঘটাও, লোকদেরকে খাবার দাও এবং রাত্রিতে নামাজ পড় যখন মানুষেরা ঘুমে থাকে তাহলে জান্নাতে নিরাপদে প্রবেশ করতে পারবে।তিনি আরো বলেন, যার প্রতিবেশী তার কষ্ট থেকে নিরাপদে থাকবে না সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না প্রকৃত মুসলমান সেই যার জিহবা ও হাত থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদে থাকে তিনি আরো বলেন, তোমাদের কেহ ততণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না যতণ না সে তার নিজের জন্য যা পছন্দ করবে তা তার ভাইয়ের জন্যও তা পছন্দ করবে তিনি বলেন, একজন মুমিন আর একজন মুমিনের জন্য প্রসাদের ন্যায় যার এক অংশ অপর অংশকে শক্তিশালী করে। এ কথা বলে রাসুল (সা.) হাতের আঙ্গুলীসমূহ একটি অপরটির মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেখিয়ে দিলেন তিনি বলেন, তোমরা পরস্পরে হিংসা করো না, গুপ্তচরবৃত্তি করো না, পরস্পরে শত্রুতায় লিপ্ত হয়ো না, একে অন্যের পিছনে লেগে থাকবে না, একে অপরের বেচাকেনার উপর বেচাকেনা করো না। তোমরা আল্লাহর বান্দা হিসেবে সকলে ভাই ভাই হয়ে যাও। মুসলমান মুসলমানের ভাই। সে তাকে অত্যাচার করবে না। সে তাকে শত্রুর হাতে অর্পণ করবে না। সে তাকে তুচ্ছ করবে না। তাকওয়া এখানেই, এ কথা বলে বুকের দিকে তিনবার ইশারা করলেন- কোন লোকের নিকৃষ্ট হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে তার মুসলমান ভাইকে অপমান করবে। প্রত্যেক মুসলমানের রক্ত অন্য মুসলমানের জন্য নিষিদ্ধ হল। এমনিভাবে নিষিদ্ধ হল তার সম্পদ রাসুল (সা.) বলেন, কোন মুসলমানের জন্য বৈধ নয় যে, সে তার ভাইয়ের সাথে তিন রাতের বেশি সম্পর্ক ছিন্ন করে থাকবে। এটাও বৈধ নয়, যখন সাক্ষাত ঘটবে সে মুখ ফিরিয়ে নেবে বা অন্যজন মুখ ফিরিয়ে নেবে। তাদের দুজনের মধ্যে সেই উত্তম যে প্রথম সালাম দেবে রাসুল (সা.) বলেন, সোমবার বৃহস্পতিবার জান্নাতের দরজাগুলো খোলা হয়, যারা আল্লাহর সাথে শরীক করে না তাদের সকলকে আলাহ মাফ করে দেন। কিন্তু তাকে আল্লাহ মাফ করেন না, যার ভাইয়ের সাথে তার বিবাদ আছে। বলা হয়, এই দুজনকে অবকাশ দাও, যেন সংশোধিত হয়ে যায়। এই দুজনকে অবকাশ দাও, যেন সংশোধিত হয়ে যায়। এই দুজনকে অবকাশ দাও, যেন সংশোধিত হয়ে যায়রাসুল (সা.) বলেন, আমল সমূহকে পেশ করা হয় প্রত্যেক বৃহস্পতি ও সোমবার। সেদিন আল্লাহ ঐ সকল ব্যক্তিকে মা করে দেন যারা আল্লাহর সাথে কোন কিছুকে শরীক করে না। কিন্তু কোন ব্যক্তির যদি তার ভাইয়ের সাথে হিংসা থাকে, তখন বলা হবে এ দুজনকে সংশোধিত হওয়া পর্যন্ত দুরে রাখ। এ দুজনকে সংশোধিত হওয়া পর্যন্ত দুরে রাখ নবী (সা.) বলেন, তোমার ভাইকে সাহায্য কর। হোক সে অত্যাচারী বা অত্যাচারিত।অনেকে প্রশ্ন করল, হে আল্লাহর রাসুল! একে অত্যাচারিত অবস্থায় সাহায্য করব এটা আমরা বুঝলাম। কিন্তু অত্যাচারী অবস্থায় কিভাবে সাহায্য করব?’রাসুল (সা.) বললেন, ‘তাকে অত্যাচার থেকে ফিরিয়ে রাখবে,এটাই তার সাহায্যনবী (সা.) বলেন, মুসলমানের উপর মুসলমানের ছয়টি অধিকার রয়েছে। প্রশ্ন করা হল, হে আল্লাহর রাসুল সেগুলো কি?’তিনি বললেন, সাক্ষাতে তাকে সালাম দেবে, দাওয়াত দিলে গ্রহণ করবে, উপদেশ চাইলে উপদেশ দেবে, হাঁচি দেয়ার পর আলহামদু লিল্লাহ বললে তুমি তার উত্তর দেবে,অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাবে বারা ইবনে আযেব রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘আল্লাহর রাসূল (সা.) আমাদের সাতটি বিষয় গ্রহণ এবং সাতটি বিষয় বর্জনের আদেশ করেছেন। আদেশ করেছেন: রোগীর সেবা,জানাযায় অংশ গ্রহণ, হাঁচি দাতা আলহামদু লিল্লাহ বললে তার উত্তর প্রদান, নিমন্ত্রণকারীর নিমন্ত্রণ গ্রহণ, সালামের প্রসার,অত্যাচারিতের সাহায্য ও শপথকারীকে দায়মুক্ত করার। এবং নিষেধ করেছেন, স্বর্ণের আংটি ব্যবহার, স্বণের্র পাত্রে আহার, উটের হাওদায় রেশম বা সিল্ক ব্যবহার, কাপড়ে সিল্কের কারুকাজ, সিল্কের পোষাক পরিধান, দীবাজ এবং ইস্তিবরাক থেকে। নবী (সা.) আরো বলেন, তোমারা জান্নাতে প্রবেশ করবে না যতক্ষণ না ঈমানদার হবে। আর ঈমানদার হবে না যতণ না পরস্পরকে ভালোবাসবে। আমি কি? তোমাদের এমন বস্তুর দিকে পথ নির্দেশ করব না যা করলে তোমাদের পরস্পররের ভালোবাসা সৃষ্টি হবে? তাহল, তোমাদের মাঝে সালামের প্রসার কর।নবী কারীম (সা.) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ইসলামে কোন কাজটি উত্তম? বললেন, খাদ্য দান এবং পরিচিত ও অপরিচিত সবাইকে সালাম দেয়া তিনি আরো বলছেন, মুমিনগণের পরস্পরের বন্ধুত্ব, সহানুভূতি, সহমর্মিতার উদাহরণ হল একটি দেহের মত। যদি এর কোন একটি অঙ্গ অসুস্থ হয়ে যায় তা হলে তা পুরো শরীরে নিদ্রাহীনতা ও জ্বরের ন্যায় অনুভূত হয় নবী কারীম (সা.) বলেন, যে রহম বা অনুগ্রহ করে না সে অনুগ্রহ পায় না রাসূল (সা.)আরো বলেন, যে মানুষের প্রতি দয়া করেনা আল্লাহ তার প্রতি দয়া করেন নারাসূলুল্লাহ (সা.) আরো বলেন, মুসলমানকে গালি দেওয়া হল পাপ কাজ, তাকে হত্যা করা কুফরী আনসারদের কাছে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর এ সকল বাণী নবী (সা.) থেকে সরাসরি পৌঁছে থাক বা এর কিছু হিজরতের পূর্বে যে সব মুহাজির নবী (সা.) থেকে শ্রবণ করেছেন তাদের কাছ থেকে শ্রবণ করুক। এ সবই তার প হতে সকল সাহাবীদের জন্য শিক্ষা। এবং কেয়ামত অবধি যার কাছেই এ উদ্ধৃতি পৌঁছবে তাও নবী (সা.) কর্তৃক শিক্ষা, প্রশিক্ষণ বলে বিবেচিত হবে। অনুরূপ তার আরো অনেক বাণী যা দ্বারা তিনি সাহাবীদের শিক্ষা দিয়েছেন। যেমন তিনি তাদের দান করার প্রতি উৎসাহ দিতেন, দানের ফযিলত বর্ণনা করতেন যা তাদের হৃদয় মনকে আকৃষ্ট করতো। ভিক্ষাবৃত্তি নিষেধ করতেন, ধৈর্যের গুণ ও অল্পে তুষ্ট থাকার জন্য বলতেন। তাদের ইবাদতের প্রতি আগ্রহী করে তুলতেন; যাতে রয়েছে অনেক ফযিলত, সওয়াব, পুরস্কার এবং তাদেরকে অহীর সাথে নিবিড় সম্পর্ক করে দিতেন। তিনি তাদের পাঠ করে শুনাতেন। তারা ও তাকে পাঠ করে শুনাতো। এ সকলই ছিল নবী কারীম (সা.) এর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ। নবী কারীম (সা.) এর অবর্তমানে এগুলো হল দাঈ ও আলেম-উলামাদের দায়িত্ব। এমনিভাবে তিনি তাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়কে উন্নত করেছেন। তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন সুউচ্চ মূল্যবোধ। এতে করে তারা উপনীত হয়েছিলেন মানবীয় গুণাবলির সর্বোচ্চ শিখরে। ফলে নবী (সা.) এর পর সম্ভব হয়ে ছিল উন্নত ও আল্লাহ-ভীরু একটি ইসলামী সমাজ বিনির্মাণ যা ইতিহাসে সুপরিচিতি লাভ করেছিল। এবং যে সমাজ পতিত ছিল বর্বরতা, মূর্খতা ও কুসংস্কারের গহীন অন্ধকারে সে সমাজ পেয়েছিল তার থেকে একটি সমাধান। অতঃপর তা পরিণত হয়েছিল এমন এক সমাজে যা মানবীয় সকল গুণাবলির দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছিল। আর এটা সম্ভব হয়েছিল একমাত্র আল্লাহর রহমতে তারপরে এ নবী (সা.) এর অনুগ্রহে। তাই আল্লাহর দিকে আহবানকারীদের কর্তব্য হল তারা তার পথ অনুসরণ করবে এবং তার দেখানো পথেই তারা হেদায়েত অনুসন্ধান করবে। ৫- মুহাজির ও আনসারদের প্রতিজ্ঞা এবং ইহুদীদের সন্ধি: রাসূল (সা.) মুহাজির ও আনসারদের মাঝে ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর একটি চুক্তি সম্পাদন করেন যার মাধ্যমে জাহেলী শেওলা এবং গোত্রীয় ঝগড়াবিবাদ বন্ধ হয়। জাহেলী তাকলীদ বা অন্ধানুকরণ করার আর কোন অবকাশ রইল না। এবং পরস্পরের এ চুক্তির মধ্যে, মুহাজির ও আনসারদের জন্য মদীনায় অবস্থানরত ইহুদীদের প্রতি সংহতি প্রদর্শনের অঙ্গীকারও ছিল। এ চুক্তি ও অঙ্গীকার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলেহি ওয়া সাল্লামের সমাজ সংস্কার এবং সমাজ বিনির্মাণে এক উলেখযোগ্য প্রচেষ্টা। যা বিশ্বের ইতিহাসে মদীনা সনদ নামে পরিচিত। রাসূল (সা.) মুহাজির ও আনসারদের মাঝে একটি চুক্তি করলেন। তাতে ইহুদীদের সাথেও শত্রুতা ছেড়ে সন্ধি করা হয়েছিল। ইহুদীদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল। তাদের সম্পদের স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল এবং উভয় পরে কল্যাণে কতিপয় শর্ত ঘোষণা করা হয়েছিল।এ অঙ্গীকার ছিল বিচক্ষণ ও শ্রেষ্ঠ রাজনীতির পরিচায়ক এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলেহি ওয়া সাল্লামের পর থেকে পূর্ণ এক বিজ্ঞানময় সিদ্ধান্ত। যা মদীনার সকল মুসলিম ও ইহুদীদের একত্র করেছিল। তারা একটি জোটে পরিণত হয়েছিল। মদীনার উপর আক্রমনকারী যে কোন শত্রুর মোকাবেলায় দাঁড়াতে তারা সম ছিল । এ পাঁচটি পরিকল্পনা: মসজিদ নির্মাণ, ইসলামের দিকে ইহুদীদেরকে আহবান, মুমিনদের পরস্পর ভ্রাতৃত্ব, তাদের প্রশিক্ষণ ও চুক্তি সম্পাদন। এ পরিকল্পনার মাধ্যমে নবী (সা.) আল্লাহর অনুগ্রহে সমাধান করেছিলেন মদীনায় বসবাসরত জনগোষ্ঠীর একটি তিক্ত বিরোধের। এবং প্রাচীন সকল প্রভাব, বিবাদ অপসারণ করেছেন। মুসলমানের হৃদয়ে মিলন সৃষ্টি করেছেন এবং এ কর্মপরিকল্পনার মাধ্যমে মদীনায় নিখুত একটি শাসন ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। অতঃপর এ শাসনব্যবস্থা এবং আল্লাহর দিকে আহবান মদীনা হতে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল। (তথ্যসূত্র: তাকরিব ই মাজাহিব)

 

Leave A Reply

Your email address will not be published.