ইহুদিবাদ: ফ্যাসিবাদের নতুন সংস্করণ

0 338

ফিলিস্তিন জবরদখলের মাধ্যমে ইহুদিবাদীরা ১৯৪৮ সালে ইসরাইল প্রতিষ্ঠা করে। এরপর থেকেই এই সংকট মুসলিম বিশ্বের প্রধান সংকটে পরিণত হয়েছে। ফিলিস্তিনের গণ-জাগরণ বা ইন্তিফাদা ও সশস্ত্র প্রতিরোধের প্রতি মুসলিম উম্মাহ সমর্থন জানিয়ে আসছে। মুসলিম বিশ্বের প্রধান এ সংকট প্রসঙ্গে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেছেন, ‘মুসলমানদের জীবনে এবং মুসলিম বিশ্বের কোনো সংকটই ফিলিস্তিনের মত গুরুত্বপূর্ণ নয়। সাম্প্রতিক কয়েক শতকের মধ্যে এটা মুসলমানদের ওপর চাপিয়ে দেয়া সবচেয়ে বড় দূর্যোগ। আসলে ইসরাইল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মুসলিম বা ইসলামী বিশ্বের শত্রুরা মুসলমানদেরই আবাসভূমির একটা অংশে বাংকার খুড়ে মুসলিম উম্মাহর ইচ্ছা বা স্বপ্ন-সাধ এবং তাদের তপরতাগুলো প্রতিরোধের জন্য লড়াই করছে ও মুসলমানদে বিভিন্ন সারির ওপর হামলা চালাচ্ছে।

সম্প্রতি ইসরাইল গাজা-অভিমুখী ও ত্রাণসাহায্যবাহী ফ্লোটিলা নৌ-বহরে থাকা ৪০ টি দেশের স্বেচ্ছাসেবী মানবাধিকার ও শান্তি-কর্মীদের ওপর নৃশংস হামলা চালিয়ে তাদের ২০ জনকে শহীদ করেছে এবং আহত হয় আরো ৫০ জন। এ হামলার পর বিশ্ব সমাজের দৃষ্টি আবারও ব্যাপক মাত্রায় নিবদ্ধ হয়েছে ফিলিস্তিন সংকটের দিকে।
এ প্রসঙ্গে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেছেন, ‘ফ্লোটিলা নৌ-বহর ছিল বিশ্ব-জনমত ও বিশ্ব-বিবেকের প্রতিনিধি। ইহুদিবাদ যে ফ্যাসিবাদের নতুন ও আরো ভয়ানক বা হিংস্র সংস্করণ, তা এই বর্বোরোচিত হামলায় সবার কাছে স্পষ্ট হয়েছে। স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের সমর্থক হবার দাবীদার পশ্চিমা সরকারগুলো এবং বিশেষ করে অন্য সব সরকারের চেয়ে মার্কিন সরকার ইহুদিবাদকে বেশী সহায়তা করছে।

২০০৬ সালের জানুয়ারী মাসে অনুষ্ঠিত ফিলিস্তিন স্বশাসন কর্তৃপক্ষের সংসদ নির্বাচনে ইসলামী প্রতিরোধ আন্দোলন হামাস বিজয়ী হলে গাজায় সংকট শুরু হয়। সে সময় থেকেই হামাসের প্রধান শক্তি-কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত গাজার ওপর চাপ তীব্রতর করে ইসরাইল ও তার পশ্চিমা মিত্ররা। এই চাপ ক্ষুদ্র ভূখন্ড গাজার ওপর পূর্ণাঙ্গ অবরোধে পরিণত হয়।
এ প্রসঙ্গে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী বলেছেন, ‘গাজার ১৫ লক্ষ মানুষের ওপর অবরোধ চলছে তিন বছর ধরে। সেখানে ওষুধ ও খাদ্য পাঠাতে দেয়া হচ্ছে না, তাদের খাবার পানি ও বিদ্যু সরবরাহে ব্যাঘাত সৃষ্টি করা হচ্ছে এবং যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট ধ্বংসস্তুপ সরানোর জন্য জরুরী সিমেন্ট ও নির্মাণ সামগ্রী পাঠাতে দেয়া হচ্ছে না। এসবই অত্যন্ত সহিংস ও নির্দয় আচরণ। দুঃখজনকভাবে কোনো কোনো আরব সরকারও ইসরাইলের সাথে সহযোগিতা করছে।

দখলদার ইসরাইল ২০০৮ সালের শেষ কয়েক দিনে গাজায় সর্বাত্মক হামলা চালায়। ফিলিস্তিনী মুজাহিদ ও জনগণের তীব্র প্রতিরোধের ফলে কোনো অর্জন ছাড়াই পিছু হটতে, এমনকি হামলা থামাতে বাধ্য হয় ইসরাইল। ২২ দিনের এ যুদ্ধে গাজার জনগণের বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধের প্রশংসা করে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেছেন, ‘ফিলিস্তিনী জনগণ ও গাজার জনগণ বিশ্বের সবচেয়ে প্রতিরোধকামী জাতিগুলোর মধ্যে অন্যতম হবার যোগ্য। গাজা কেবল একটি দেশ বা ভূখন্ডের ব্যাপার নয়। বরং এটা মানবতার ব্যাপার ও মানবিক নীতিমালার প্রতি আঁকড়ে থাকার ব্যাপারে আন্তরিকতার পরীক্ষা-স্থল।
হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল হানিয়ার কাছে লেখা চিঠিতে বলেছেন, ‘আপনাদের জিহাদ এ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র, ইহুদিবাদী ইসরাইল ও তার সহযোগী, জাতিসংঘ এবং মুসলিম উম্মাহর মোনাফেকদের কলংকিত করেছে।
মুসলিম উম্মাহর মোনাফেক বলতে তিনি কোনো কোনো আরব সরকারকে বুঝিয়েছেন যারা ফিলিস্তিনীদের সমর্থন করার ভান করলেও তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এবং এমনকি ফিলিস্তিনী জাতির ওপর দমন অভিযানে ইসরাইলের সাথে সহযোগিতা করেছে।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা গাজা-অভিমুখী ত্রাণবাহী জাহাজে ইসরাইলের সাম্প্রতিক নৃশংস হামলাকে ইসরাইলের অক্ষমতা ও চরম হতাশাগ্রস্ত অবস্থার প্রমাণ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ইহুদিবাদীরা কেন আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমায় অবস্থানরত জাহাজে হামলা চালিয়ে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে? কেন তারা সেখানে বহু লোককে আহত করেছে এবং আরো বেশী সংখ্যক শান্তি-কর্মীকে বন্দী করেছে? ইসরাইলের এই হিংস্র চরিত্রের কথা আমরা গত ত্রিশ বছর ধরে উচ্চ-কণ্ঠে বলে আসছি। মিথ্যাবাদী ও দুই-মুখো পশ্চিমারা আমাদের এই ফরিয়াদকে উপেক্ষা করেছে। আজ সারা বিশ্ব এটা দেখলো যে, এরা কত হিংস্র চরিত্রের লোক!
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা গাজা-অভিমুখী ত্রাণবাহী জাহাজে ইসরাইলী হামলা প্রসঙ্গে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের কথা তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন, খোদায়ী বিধান অনুযায়ী জালিম শক্তি তার কলংকজনক কর্তৃত্বের শেষের দিকে নিজেই নিজের পতন বা ধ্বংস ত্বরান্বিত করে। কয়েক বছর আগে লেবাননে ও এরপর গাজায় হামলা ছিল এ ধরনেরই কিছু উম্মত্ত পদক্ষেপ। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন ইহুদিবাদী সন্ত্রাসীরা নিজের চূড়ান্ত ধ্বংসকে ঘনিয়ে এনেছে। গাজা-অভিমুখী ত্রাণবাহী জাহাজে ইসরাইলী হামলা এ ধরনেরই আরো এক উম্মত্ত পদক্ষেপ।
বিশ্বের অধিকাংশ দেশ, সরকার ও জনগণ ইসরাইলের এই হামলার নিন্দা জানিয়েছে এবং ইসরাইলের অপরাধী ও অমানবিক চরিত্র আগের চেয়েও স্পষ্ট হয়েছে।
হযরত আয়াতুল্লাহিল উজমা খামেনেয়ী গাজা অভিমুখে আরো ত্রাণবাহী জাহাজ পাঠানোর ওপরও গুরুত্ব আরোপ করেছেন। গাজা-অভিমুখে ত্রাণবাহী জাহাজ পাঠানোর প্রশংসা করে তিনি বলেছেন, বিভিন্নভাবে ও বিভিন্ন পদ্ধতিতে এ ধরনের আরো জাহাজ গাজায় পাঠানো হলে ইসরাইল এবং তার সহযোগীরা, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেন বিশ্ব-বিবেকের চাপ বা গণ-জাগরণের চাপ অনুভব করতে বাধ্য হবে।
উল্লেখ্য, ইরান গাজায় ত্রাণ-সাহায্য সরবরাহের লক্ষ্যে তিনটি জাহাজ পাঠাবে বলে ঘোষণা করেছে এবং ইরান এ ধরনের ত্রাণবাহী অন্য যে কোনো দেশের জাহাজগুলোর নিরাপত্তা বিধান করতে প্রস্তুত বলে জানিয়ে দিয়েছে।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতার মতে, দখলদার ইহুদিবাদীদের মোকাবেলায় প্রতিরোধ চালিয়ে যাওয়াই ফিলিস্তিনকে স্বাধীন করার একমাত্র পন্থা। তিনি সব সময়ই এ কথা বলে এসেছেন। লেবানন ও ফিলিস্তিনে এই প্রতিরোধ এ পর্যন্ত চমকার সাফল্য অর্জন করেছে। এসব প্রতিরোধের কারণে ইসরাইল এখন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশী দূর্বল। এ প্রসঙ্গে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা বলেছেন, ‘কুদস তথা মুসলমানদের প্রথম কেবলার পথ ও ফিলিস্তিনকে মুক্ত করার পথ সংগ্রাম ছাড়া অন্য কিছু নয়। ফিলিস্তিনীদের জাগরণের প্রতি সমর্থন সরাসরি ওয়াজেব বা ফরজ এবং ইসলামের সমস্ত ফেকাহ ও মাজহাবের দৃষ্টিতে প্রতিরক্ষামূলক জিহাদের দৃষ্টান্ত। মুসলমানরা ছাড়াও অন্যান্য জাতিও ফিলিস্তিনীদের ব্যাপারে দায়িত্বশীল। মানবাধিকারের সমর্থক সব সরকারেরই উচিত ফিলিস্তিনীদের সাহায্য করা। তবে এ ব্যাপারে মুসলমানদের গুরু-দায়িত্ব রয়েছে।
সর্বোপরি ইরানের সর্বোচ্চ নেতা মহান আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাসকেই ইসরাইলের সাম্প্রতিক কয়েকটি পরাজয় ও বিপর্যয়ের মূল কারণ বলে মনে করেন এবং এই ঈমানের জোরেই ফিলিস্তিনীরা চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করবে বলে ভবিষ্যদ্বানী করেছেন।

Leave A Reply

Your email address will not be published.