কা’বা ঐক্যের চাবি এবং আধ্যাত্মিকতার প্রতীক

0 303

বিসমিল্লাহির রহমানির রাহীম” আলহামদু লিল্লাহি রব্বিল আলামিন ওয়া সাল্লাল্লাহু আলা সাইয়িদানা মুহাম্মাদ, আল মোস্তফা ওয়া আলিহিত ত্বাইয়িবিন ওয়া আসহাবিহিল মুন্তাজাবিন।”
কাবা ঐক্য ও মর্যাদার চাবি এবং একত্ববাদ ও আধ্যাত্মিকতার প্রতীক। কাবা হজ্ব মওসুমে সারা বিশ্বের তৃষ্ণার্ত ও আশাবাদী হৃদয়গুলোর নিমন্ত্রক বা মেজবান, যে তৃষ্ণার্ত ও আশাবাদী হৃদয়গুলো মহামহিম আল্লাহর আমন্ত্রণে সাড়া দিয়েছেন এবং প্রভুর ডাকে লাব্বাইক বা উপস্থিত- এ ঘোষণা উচ্চারণ করে ছুটে গেছেন ইসলামের জন্মভূমিতে।

মুসলিম উম্মাহ এখন তার ব্যাপক-বিস্তৃত ও বিচিত্রময় অস্তিত্বের সংক্ষিপ্ত ছবি দেখতে সক্ষম। এ ছবিতে তারা দেখতে পারবেন এ সত্য ধর্মের অনুসারীদের হৃদয়ে বদ্ধমূল ঈমান কত গভীর। তারা সারা বিশ্বের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এখানে সমবেত ও তাদেরই পাঠানো লোকদের চোখ দিয়ে এ দৃশ্য বা ছবি দেখতে পারেন এবং এ অনন্য ও বিশাল সম্পদকে ভালভাবে চিনতে পারেন।
নিজেকে আবারও এভাবে চেনা বা জানার ফলে বর্তমান বিশ্বে ও আগামী দিনগুলোতে মুসলমানদের উপযুক্ত মর্যাদা সম্পর্কে উপলব্ধি করা এবং ওই লক্ষ্যপানে এগিয়ে চলাও সহজ হবে।
বর্তমান বিশ্বে ইসলামী জাগরণের ক্রমবর্ধমান জোয়ার একটি অনস্বীকার্য বাস্তবতা। এ বাস্তবতা মুসলিম উম্মাহর সুন্দর ভবিষ্যতের সুসংবাদ দিচ্ছে। শক্তিতে ভরপুর এ জাগরণ সুচিত হয়েছিল ত্রিশ বছর আগে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের বিজয় ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। মুসলিম উম্মাহ সে সময় থেকে এখনও অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে, তারা সরিয়ে দিয়েছে পথের অনেক বাধা এবং জয় করেছে অনেক ঘাঁটি ।
এইসব বিজয়ের কারণে ইসলামের প্রতি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর শত্রুতা আগের চেয়েও অনেক জটিল হয়েছে এবং তাদের প্রচেষ্টাগুলো হয়েছে আরও ব্যয়বহুল। শত্রুরা ইসলাম সম্পর্কে ভয় ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ব্যাপক প্রচার-প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে। ওরা মুসলমানদের বিভিন্ন মাজহাব বা গ্রুপের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ উশকে দেয়ার জন্য তড়িঘড়ি অনেক প্রচেষ্টায় লিপ্ত।
শিয়া মুসলমানদেরকে সুন্নি মুসলমানদের কাছে, আর সুন্নি মুসলমানদেরকে শিয়া মুসলমানদের কাছে মিথ্যা শত্রু হিসেবে তুলে ধরা, মুসলিম সরকারগুলোর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টিসহ তাদের মধ্যে মতভেদ জোরদারের এবং সেগুলোকে স্থায়ী শত্রুতায় ও নিরসন-অযোগ্য সংকটে রূপান্তরের চেষ্টা, যুব সমাজের মধ্যে ব্যভিচার, দূর্নীতি বা অনৈতিকতা সংক্রমিত করার জন্য গোয়েন্দা বা গুপ্তচর সংস্থা ব্যবহার- এ সবই জাগরণ, মর্যাদা ও মুক্তিকামীতার দিকে মুসলিম উম্মাহর নানা দৃঢ় পদক্ষেপ ও ধারাবাহিক অগ্রগতির জবাবে ওদের আতঙ্কিত ও হতচকিত কিছু প্রতিক্রিয়া।
ত্রিশ বছর আগে দখলদার ইহুদিবাদী শাসকগোষ্ঠীকে এক অপরাজেয় দানব বলে মনে করা হত, কিন্তু এখন তা অপরাজেয় নয়। বিশ বছর আগে মার্কিন ও পশ্চিমা বা পাশ্চাত্যের সরকারগুলোই ছিল মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে নানা সিদ্ধান্ত নেয়ার একমাত্র মালিক। কিন্তু এখন তাদের সে দিন নেই। দশ বছর আগেও পরমাণু প্রযুক্তিসহ অন্য কিছু অত্যাধুনিক বা জটিল প্রযুক্তি অর্জন মুসলিম জাতিগুলোর জন্য ছিল কল্পনাতীত বা রূপকথাতুল্য। কিন্তু এখন অবস্থা আর সে রকম নয়।

আজ ফিলিস্তিনী জাতি প্রতিরোধের বিজয়ী নায়ক, লেবাননী জাতি একাই ইহুদিবাদী শাসকগোষ্ঠীর ভীতিপ্রদ ইমেজ গুড়িয়ে দিয়ে ৩৩ দিনের যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছে। আর ইরানের মুসলিম জাতি সাফল্যের শীর্ষ চূড়াগুলোর দিকে বাধার সব প্রাচীর ভাঙ্গার অগ্রসেনানী ও পতাকাবাহকে পরিণত হয়েছে।
আজ মুসলিম বিশ্বের স্বঘোষিত অভিভাবক ও ইহুদিবাদী ইসরাইলের প্রধান মদদদাতা সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে নিজের সৃষ্ট চোরাবালিতে আটকে গেছে। ইরাকী জনগণের বিরুদ্ধে এতসব অপরাধযজ্ঞ চালানো সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র সেখানে কোনঠাসা হয়ে পড়ছে এবং সংকটপীড়িত পাকিস্তানেও যুক্তরাষ্ট্র অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশী ঘৃণিত। বর্তমানে ইসলামের শত্রু শক্তিগুলো দুইশ বছর ধরে মুসলিম সরকার ও জাতিগুলোর ওপর জুলুমসহ তাদের সম্পদের ওপর লুটতরাজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর ওইসব কর্তৃত্বকামীতার পতন বা ক্ষয় এবং তাদের বিরুদ্ধে মুসলিম জাতিগুলোর সাহসী প্রতিরোধ প্রত্যক্ষ করছে। অন্যদিকে ইসলামী জাগরণ ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে ও দিনকে দিন জোরদার হচ্ছে।

এ আশাব্যাঞ্জক পরিস্থিতির কারণে মুসলিম জাতিগুলোকে একদিকে যেমন প্রত্যাশিত ভবিষ্যতে পৌঁছার ব্যাপারে আরো আত্মবিশ্বাসী হবে, অন্যদিকে অতীতের অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাগুলোর আলোকে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশী সতর্ক থাকতে হবে। এ আহ্বান সবার জন্য প্রযোজ্য হলেও এ বিষয়ে আলেম সমাজ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, চিন্তাবিদ বা বুদ্ধিজীবী ও যুব সমাজের গুরু দায়িত্ব রয়েছে এবং তাদেরকে এসব বিষয়ে অগ্রসেনানী ও সংগ্রামী সাধক বা অধ্যবসায়ী হতে হবে।
জীবন্ত ও কার্যকরী মহাগ্রন্থ পবিত্র ক্বুরআন আমাদেরকে বলছে,
كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ
কুনতুম খাইরা উম্মাতিন উখরিজাত লিন্নাসি তামুরুনা বিল মারুফি ওয়া তানহাওনা আনিল মুনকার ওয়া তুউমিনুউনা বিল্লাহি”।
অর্থাৎ, তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, তোমাদেরকে উত্থিত করা হয়েছে এ জন্য যে তোমরা সৎ কাজের আদেশ দেবে ও অসৎ বা মন্দ কাজে বাধা দেবে এবং আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী হবে।
এ আয়াতে মুসলিম উম্মাহকে মানবজাতির জন্য উত্থিত করা হয়েছে বলে সম্মান দেয়া হয়েছে। মানবজাতির কল্যাণ ও মুক্তি নিশ্চিত করাই মুসলিম উম্মাহর আবির্ভাবের উদ্দেশ্য।
মুসলমানদের দায়িত্ব খুবই বড়! সৎ কাজের আদেশ দেয়া ও অসৎ বা মন্দ কাজে বাধা দেয়া এবং আল্লাহর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস-খুবই বড় দায়িত্ব। সাম্রাজ্যবাদী দানবীয় শক্তিগুলোর অক্টোপাস থেকে জাতিগুলোকে মুক্তি দেয়ার চেয়ে ভালো আর কোনো কাজ নেই এবং সাম্রাজ্যবাদের সেবা করা ও তাদের অধীনস্থ বা অনুগত হওয়ায় চেয়ে নিকৃষ্টতম কোনো কাজ নেই। আজ ফিলিস্তিনি জাতি ও অবরুদ্ধ গাজাবাসীকে সাহায্য করা, আফগান,পাকিস্তানী, ইরাকী ও কাশ্মিরি জাতির সহমর্মী ও সমব্যথী হওয়া, মার্কিন সরকার ও ইহুদিবাদি ইসরাইলের জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আর সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া, মুসলমানদের ঐক্য বজায় রাখা, যেসব দূষিত হাত ও শত্রুর অনুচর এই ঐক্যে আঘাত হানছে তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা, জাগরণকে ছড়িয়ে দেয়া এবং মুসলিম দেশগুলোর যুব সমাজের মধ্যে দায়িত্বশীলতার চেতনা সৃষ্টি অত্যন্ত বড় দায়িত্ব। আর এসব গুরু দায়িত্ব পালন করতে হবে সমাজের বিশেষ শ্রেণীকে।
হজ্বের উদ্দীপনাময় দৃশ্য এইসব দায়িত্ব পালনের উপযুক্ত সুযোগগুলো আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে এবং আমাদেরকে আরো বেশী সক্রিয় ও দৃঢ়-সংকল্প হবার আহ্বান জানাচ্ছে।
ওয়া আসসালামুআলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ
সাইয়েদ আলী হোসাইনী খামেনেয়ী
পয়লা জ্বিলহজ্বুল হারাম, ১৪৩১
(
ফার্সী১৭ ই অবন, ১৩৮৯) সূত্র: রেডিও তেহরান

Leave A Reply

Your email address will not be published.