পবিত্র আশুরা ও মহররম-৪

0 359

আশুরা উপলক্ষ্যে ওস্তাদ আয়াতু্ল্লাহ মিসবাহ তাকী ইয়াযদীর চতুর্থ বক্তব্য

88

শহীদানের নেতা হযরত আবা আব্দিল্লাহ্ আল্-হোসাইনের (আঃ) শোকাবহ ম্মৃতিময় দিনগুলোর আগমনে হযরত ইমাম মাহ্দী (আল্লাহ্ তাঁর আবির্ভাব ত্বরান্বিত করুন), মহান রাহ্বার, মহান মার্জা’এ তাক্বলীদগণ ও হোসাইনী আদর্শের অনুসারী শিয়াদের সকলের প্রতি শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছি। আশা করি মহান আল্লাহ্ তা’আলা এ দুনিয়ায় ও পরকালে হযরত আবা আব্দিল্লাহ্ আল্-হোসাইনের সাথে আমাদের সম্পর্ককে কখনো দুর্বল হতে দেবেন না।
বিগত আলোচনায় আমরা এমন কতক প্রশ্ন উপস্থাপন করেছি যা অনেক তরুণ ও যুবকের মনেই উদিত হয়ে থাকে। তা হচ্ছে, যে সব মুসলমান দ্বীনে বিশ্বাস পোষণ, নামায পড়া ও রোযা রাখা এবং জিহাদে অংশগ্রহণকারী হওয়া সত্ত্বেও _ যাদের অনেকেই বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলো এবং তাদের অধিকাংশের কথা যদি না-ও বলি তো যাদের অনেকেই বহু বছর আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলী (আঃ)-এর খোতবাহ্ শুনেছে ও তাঁর মিম্বারের সামনে অবস্থান করেছে এবং বহু যুদ্ধে তাঁর পাশে থেকে যুদ্ধ করেছিলো, এতসব সত্ত্বেও এটা কী করে সম্ভব হলো যে, তারা এত সব উত্তম বৈশষ্ট্য, ইজ্জত ও প্রিয়তার অধিকারী হোসাইনকে এরূপ নৃশংসভাবে হত্যা করলো?
আলোচ্য বিষয় যাতে অধিকতর সুস্পষ্ট হয় সে লক্ষ্যে কিছু সময়ের জন্য অতীতে ফিরে যাবো এবং ইসলামের প্রথম দিকের ইতিহাসের ওপর সংক্ষিপ্ত দৃষ্টিপাত করবো। যদিও এ বিষয়ে আলোচনার জন্য আমার যথেষ্ট যোগ্যতা নেই তথাপি মু’আবিয়ার শাসনামলে ইসলামী জাহানের অবস্থা কেমন ছিলো সেদিকে কিছুটা ইশারা করবো।

আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলী (আঃ)-এর শাহাদাতের পর থেকে ইয়াযীদের তথাকথিত খেলাফতে অধিষ্ঠিত হওয়ার সময় পর্যন্ত সময়কার অবস্থা সম্বন্ধে ইতিপূর্বে আরয করেছি। সে আলোচনার সংক্ষিপ্তসার ছিলো এই যে, তৎকালীন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ববর্গের মধ্যে মু’আবিয়াহ্ ছিলেন অত্যন্ত সতর্ক ও বুদ্ধিমান লোক। এ কারণে তাকে দা’ঈআয়ে ‘আরাব্ বা “আরবদের আশা-আকাঙ্ক্ষা” উপাধি দেয়া হয়। রাজনৈতিক কার্যকলাপ, সতর্কতা, দূরদর্শিতা ও পরিচালনা ক্ষমতার জন্য তিনি এমনই বিখ্যাত হয়ে ওঠেন যে, বলা হতো, আলী মু’আবিয়ার মতো রাজনৈতিক যোগ্যতার অধিকারী নন, নইলে তিনি মু’আবিয়াহ্র ওপরে জয়লাভ করতে পারতেন এবং শাসন ক্ষমতা তাঁর হাত থেকে মু’আবিয়ার হাতে চলে যেতো না। সম্ভবতঃ এ প্রসঙ্গেই আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলী (আঃ) বলেছিলেন ঃ “আল্লাহ্র শপথ, মু’আবিয়াহ্ সতর্কতা, সুপরিচালনা ও রাজনৈতিক গুণাবলীতে আমার চাইতে বেশী যোগ্যতার অধিকারী নয়, কিন্তু আল্লাহ্র ভয় আমাকে যা খুশী তা-ই করা থেকে বিরত রেখেছে।”
এখানে প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করতে হচ্ছে যে, এতদসত্ত্বেও সরলমনা লোকেরা অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই এরূপ চিন্তা করে যে, হযরত আলী (আঃ) যদি মু’আবিয়ার সাথে বা অন্য সকলের সাথে কিছুটা আপোস করতেন তাহলে পরিস্থিতি এতদূর গড়াতো না।
এ হচ্ছে এমন একটি বিষয় যার ভিত্তিতে আজকের দিনে অনেকে সামগ্রিকভাবে বেলায়াতের মর্যাদা এবং বিশেষভাবে হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) ও আহ্লে বাইতের মা’ছূম ইমামগণ (আঃ)-এর নিষ্পাপত্বের মর্যাদাকে দুর্বল করার ও তাঁদের আচরণে ত্রুটি নির্দেশের এবং তাঁদের মর্যাদার ব্যাপারে সংশয় সৃষ্টির চেষ্টা করছে যাতে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম তাঁদের নিষ্পাপ মর্যাদার প্রতি গভীর ঈমান পোষণ না করে এবং সকল ক্ষেত্রে তাঁদের শ্রেষ্ঠত্বকে কবুল না করে, এরপর তাদের মন-মগযে এ চিন্তা আসে যে, হয়তো এর চেয়েও উত্তম কোনো পন্থা হতে পারতো, হয়তো কোথাও কোথাও তাঁরা ভুল করেছেন। আর একবার যদি এই ‘হয়তো’র অধ্যায়ের সূচনা হয়, এ অধ্যায়ের দরযা খুলে দেয়া হয়, তাহলে সব কিছুকেই প্রশ্নবিদ্ধ করা সম্ভব হবে, যদিও তারা এখনো সে কাজ করে চলেছে।
আপনারা হয়তো এটাকে আমার দুর্বলতা মনে করবেন যে, আমি বিষয়টিকে এভাবে উপস্থাপন করছি যার ফলে হয়তো সন্দেহকেই শক্তিশালী করছি। তাই এ ব্যাপারে কিছুটা ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়োজন মনে করছি। ইনশা আল্লাহ্ পরে অধিকতর সুস্পষ্টভাবে এ সংশয়ের জবাব প্রদান করবো।
উদাহরণ স্বরূপ, তারা বলে ঃ লোকেরা যখন আলী (আঃ)-এর নিকট এলো এবং তাঁর কাছে বাই’আত হলো _ যে বাই’আত ছিলো এমনই বিস্ময়কর ও অভূতপূর্ব যে, স্বয়ং আমীরুল মু’মিনীন (আঃ)-এর ভাষায়, লোকদের ভীড়ে হোসাইনের পিষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছিলো, সে সময় তাঁর সাথে বাই’আত হওয়ার জন্য এমন সব লোকেরা এসেছিলেন যারা ছিলেন তৎকালীন আরবের শীর্ষস্থানীয় লোক। তাল্হাহ্ ও যুবাইর কোনো সাধারণ লোক ছিলেন না; তাঁরাও এসেছিলেন। দ্বিতীয় খলীফা তাঁর পরে খেলাফতের দায়িত্ব নির্ধারণের জন্য একটি ছয় সদস্যের প্রতিনিধিদল মনোনীত করে যান। তিনি ছয় সদস্যের একটি পরিষদ গঠন করেন যারা একত্রিত হয়ে নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে খলীফাহ্ মনোনীত করবেন। তালহাহ্ ও যুবাইর ছিলেন এদের মধ্যকারই দু’জন। তাঁরা নিজেরা খেলাফতের দাবীদার ছিলেন। এরা দু’জন এসে আলীর অনুকূলে বাই’আত হলেন।
কিছু লোকের কথা হলো এই যে, আলীর উচিৎ ছিলো তাঁদেরকে পক্ষে রাখা; তাঁদের সাথে আলাদাভাবে সম্পর্ক রাখা প্রয়োজন ছিলো। তাঁদেরকে উপহারাদি দেয়া প্রয়োজন ছিলো। তাঁরা একান্তে কথা বলতে চাইলে সাথে সাথেই তাঁদেরকে সময় দেয়া প্রয়োজন ছিলো। তাঁদেরকে আপ্যায়ন করা উচিৎ ছিলো। কারণ, তাঁরা বাই’আত হয়েছিলেন। তাঁদেরকে বলা যেতো ঃ ‘প্রিয় ভাইয়েরা আমার! বহুত খোশ আমদেদ। আমি আপনাদের জন্য এই এই পদগুলো নির্ধারণ করে রেখেছি; আপনারা সমর্থন করেছিলেন বলেই আমি খেলাফতে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছি। আমি আপনাদের প্রতি বহুত কৃতজ্ঞ।’
এদের কথা হলো, এভাবে কথা বললে, তাঁদেরকে কিছুটা তোয়াজ করে কথা বললে এমন কী দোষ হতো! তারপর তিনি তাঁদের জন্য খানাপিনার আয়োজন করতে পারতেন। তিনি তো জানতেন যে, তাঁরা কী চান। তিনি ইমামতের কারণে এ ব্যাপারে অকাট্য জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন এমন কথা যদি না-ও বলি তো তিনি অন্ততঃ এ সম্ভাবনার ধারণা তো পোষণ করতেন। অন্ততঃ তিনি তো এদেরকে চিনতেন এবং জানতেন যে, তাঁরা কী ধরনের লোক ছিলেন। তিনি তো এ সম্ভাবনার কথা জানতেন যে, তাঁদের সাথে আপোস না করলে তাঁরা তাঁর বিপক্ষে চলে যাবেন এবং জঙ্গে জামালের ন্যায় যুদ্ধ বাঁধিয়ে দেবেন। তিনি সম্ভাবনার কথা তো জানতেন। এমতাবস্থায় যাতে এ রকম না ঘটে, এত সব রক্তপাত না হয়, এত যুদ্ধ না ঘটে এবং এত সব সৈন্য নিহত হওয়া এড়ানোর জন্য তিনি আপোস করতে পারতেন। এর পরিবর্তে দেশের পুনর্গঠনের লক্ষ্যে, অর্থনৈতিক অগ্রগতি হাসিলের লক্ষ্যে তিনি বলতে পারতেন ঃ ‘আসুন, বসুন, পরস্পরের সাথে সহযোগিতা করি। আপনারা পরিকল্পনা নিয়ে আসুন, আমরা তা পর্যালোচনা করে দেখি। আর মোদ্দা কথা, দেশের একটা অংশের এখতিয়ার আপনাদের হাতে থাকবে; আপনারা তা পরিচলনা করবেন। আপনি কুফার শাসন ক্ষমতা চান? বেশ তো। আর আপনি বসরার শাসন ক্ষমতা চান? বেশ তো। শামের কর্তৃত্ব চান? মিসরের কতর্ৃত্ব চান? আপত্তি নেই। আসুন, আমরা পরস্পর সহযোগিতা করিা।’ তাঁর উচিৎ ছিলো এভাবে কথা বলা। তারপর বাইতুল মাল থেকে তাঁদেরকে একটা অংশ দেয়া উচিৎ ছিলো। তাঁদের দুই হাত উন্মুক্ত রাখা উচিৎ ছিলো। বেশ তো, তাঁরা যদি বাইতুল মালের অংশবিশেষের অপব্যবহার করতেন তা বাইতুল মাল থেকে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ যুদ্ধের জন্য ব্যয় হবার তুলনায় এবং এত রক্তপাতের তুলনায় তো অনেক ভালো ছিলো।
এ হলো আমাদের যুগের রাজনীতি কেন্দ্রিক চিন্তাধারা। সে যুগেও কিছু লোক আলীর বিরুদ্ধে এ অনুযোগই করতো; তারা বলতো যে, ‘আলী রাজনীতি বোঝেন না; রাজনীতি সম্পর্কে মু’আবিয়াহ্ আলীর চেয়ে অনেক ভালো বোঝেন।’ আর এই লোকেরাই আলীর অন্তঃকরণকে দগ্ধীভূত করতো। তিনি তাঁর বন্ধুদেরকেই সন্তুষ্ট করতে পারেন নি; মু’আবিয়াহ্ ও অন্যদের ব্যাপার তো দূরের কথা।
হ্যা, তিনি জানতেন যে, মু’আবিয়াহ্ কেবল নোংরা মানসিকতার লোক এবং এ-ও জানতেন যে, মু’আবিয়াহ্ কোন্ নীতি-কৌশল নিয়ে এগোচ্ছেন, কীভাবে লোকদেরকে নিজের মুঠোর মধ্যে নিয়ে নিচ্ছেন, কীভাবে জনগণের ঘাড়ে সওয়ার হয়েছেন। তিনি জানতেন কীভাবে মু’আবিয়াহ্ মুসলিম জনগণের ধনসম্পদ ও বাইতুল মালের সম্পদ কুক্ষিগত করে এভাবে উদার হস্তে খরচ করতেন; কীভাবে একে-ওকে হাজার হাজার দীনার, লক্ষ লক্ষ দীনার এমনকি কখনো কখনো মিলয়ন মিলিয়ন দীনার দান করতেন এবং কীভাবে তাদের সাথে আপোস করতেন।
কতক লোকের মতে, এ অবস্থায় আলী (আঃ) যদি আপোস করতেন তাহলেই ভালো হতো; তাহলে এসব ঘটনা ঘটতো না। আপনারা কি আজকেও এ ধরনের কথা শুনতে পাচ্ছেন না হযরত ইমাম সম্পর্কে, মহান রাহ্বার সম্পর্কে? বলা হয় যে, অমুক ব্যক্তির ক্ষেত্রে কিছুটা নমনীয়তা দেখানো উচিৎ ছিলো; তার সাথে আপোস করলে পরিস্থিতি এ পর্যায়ে এসে দাঁড়াতো না। আপনারা কি শুনতে পাচ্ছেন না যে, আজকেও একই কথা বলা হচ্ছে? আজকেও আলীর নীতি সম্পর্কে সমালোচনা হচ্ছে।
হ্যা, এর একটা জবাব হচ্ছে এই যে, তিনি ইমামতের ‘ইল্মের অধিকারী ছিলেন, ইল্হামের অধিকারী ছিলেন; আল্লাহ্ তা’আলা তাঁকে হুকুম দিয়েছিলেন যে, ‘তুমি এই রকম এই রকম করো অথবা চাও তো আমার হুকুম অমান্য করো।’ বেশ, এ হলো একটি বিশ্বাস ভিত্তিক জবাব; যারা ইমামের প্রতি খোদায়ী ইল্হামে বিশ্বাসী তাদের জন্য এ জবাব যথেষ্ট। আমরা বিশ্বাস করি যে, ইমাম হচ্ছেন মা’ছূম _ নিষ্পাপ; তিনি গুনাহ্ ও ভুল থেকে মুক্ত। ইনশা আল্লাহ্ আমাদের এ বিশ্বাস টিকে থাকবে যে, ইমাম হচ্ছেন নিষ্পাপ; তিনি ভুল করেন না। আল্লাহ্ যা আদেশ করেন তিনি তদনুযায়ী আমল করেন। এটাই ছিলো তাঁর কর্তব্য এবং তিনি তাঁর কর্তব্য ঠিক মতো পালন করেছেন।
এ জবাব এ পর্যন্ত আমাদের জন্য সন্তোষজনক। কিন্তু আজকের তরুণরা যারা ইতিপূর্বে উলি্লখিত সংশয়ের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে তাদের জন্য এ ধরনের জবাব সন্তোষজনক নয়। তাই তাদের জন্য এক ধরনের অধিকতর সুস্পষ্ট জবাব দিতে হবে।
এখানে এসে আমি আমার নিজের পোশাকের বিরুদ্ধে অনুযোগ করছি যে, এ ধরনের বিষয় সম্পর্কে যে ধরনের আলোচনা-পর্যালোচনা করা উচিৎ ছিলো আমরা তা করি নি। আমরা এসব প্রশ্নের এমন জবাব প্রস্তুত করে রাখি নি যে, যে কেউ প্রশ্ন করার সাথে সাথে তার সামনে সে জবাব তুলে ধরা যাবে এবং সে তা যথাযথভাবে বুঝতে, হযম করতে ও গ্রহণ করে নিতে পারবে। আমরা এ ধরনের জবাব তৈরী করি নি বা তৈরী করে থাকলেও তা প্রকাশ ও প্রচার করি নি। তাই তা আমাদের তরুণ ও যুবকদের কাছে পেঁৗছে নি।
আমাদেরকে একটি সুস্পষ্ট জবাব দিতে হবে যে, বিষয়টা কী ছিলো; কেন আলী তথাকথিত হাসিমুখের নীতি ও আপোসের নীতি গ্রহণ করেন নি; কেন তিনি নমনীয়তার রাজনীতি অনুযায়ী কাজ করেন নি? কেন তিনি এত কঠোর হয়েছিলেন? তিনি বলেছিলেন ঃ “আমি একদিনের জন্যও মু’আবিয়াকে দায়িত্বে অধিষ্ঠিত থাকার অনুমতি দেবো না। আমি যদি খলীফাহ্ হয়ে থাকি তাহলে সে এসব কাজ করার অধিকার রাখে না।” এরপর সেদিনই তিনি মু’আবিয়াকে পদচু্যত করেন। কেন তিনি এমন কাজ করলেন?
আর তালহাহ্ ও যুবাইরের ব্যাপার। তালহাহ্ ও যুবাইর্ তো আর শিশু ছিলেন না। তাঁরা ছিলেন ইসলামী জাহানের দু’জন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব; এক সময় তাঁরা খেলাফতের প্রার্থী ছিলেন। এরা আলীর মেহমান হলেন। তখন সেখানে যে বাতি জ্বলছিলো, আলী তা নিভিয়ে দিয়ে আরেকটি বাতি জ্বালালেন। ব্যাপারটা লক্ষ্য করুন। এখানে দুইটি বাতির মধ্যে পার্থক্য কী?
হ্যা, পার্থক্য আছে। ‘এটা ছিলো বাইতুল মালের বাতি; আমি বাইতুল মালের হিসাব করছিলাম; বাতিও ছিলো বাইতুল মালের। তোমরা আমার সাথে ব্যক্তিগত ও একান্ত কথাবার্তা বলতে চাও; যেহেতু বাতিটা বাইতুল মালের সেহেতু আমার অধিকার নেই বাইতুল মালের বাতি ব্যবহার করার।’
তিনি কয়েক মিনিটের জন্যও নিজের কাজে বাইতুল মালের বাতি ব্যবহার করতে প্রস্তুত নন। ‘তা আমরা তো এসেছি মুসলমানদের বিষয়াদি নিয়ে তার সাথে কথা বলতে।’ তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিটা ছিলো এ ধরনের ঃ ‘আমরা দু’জন বিরাট ইসলামী ব্যক্তিত্ব; আমরা দেশের কল্যাণ সম্পর্কে কথাবার্তা বলতে এসেছি। কিন্তু এ ব্যক্তি তো এ কাজে কয়েক মিনিটের জন্যও বাইতুল মালের বাতি ব্যবহার করতে প্রস্তুত নয়। তাহলে এর সাথে কী মিলেমিশে চলা যাবে?’
তাঁরা পূর্ববর্তী খলীফার শাসনামলে সব রকম সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়েছিলেন। কতই না ধনসম্পদ তাঁরা জমা করেছিলেন! কত ছিলো তাঁদের গোলাম ও দাসী! তাঁদের এসব নিয়ে বহু কাহিনী প্রচলিত আছে। আর এখন তাঁরা এ ধরনের পরিস্থিতির মুখোমুখি; তাঁরা আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলী (আঃ)-এর এবং তাঁর কঠোর নীতির মুখোমুখি। আপনাদের দৃষ্টিতে এর জবাব কী? এর জবাব কি এ ছাড়া অন্য কিছু যে, যেহেতু আলী (আঃ) মা’ছূম ছিলেন এবং যে কোনো কাজই করতেন তা আল্লাহ্ তা’আলার নির্দেশ অনুযায়ী করতেন?
একজন যুবককে সন্তুষ্ট করার জন্য এর চেয়ে সুস্পষ্টতর কোন্ জবাব আমরা দিতে পারবো? আমার মনে যে জবাবটি এসেছে তা পেশ করলাম; আপনারা এ নিয়ে চিন্তা করুন এবং কারো কাছে যদি এর চেযে অপেক্ষাকৃত উত্তম জবাব থাকে তাহলে তাঁর উচিৎ তা উপস্থাপন করা। কারো কাছে এ ধরনের জবাব থাকলে তিনি যেন তা আমাকে লিখে দেন, তাহলে আমি পরবর্তী আলোচনায় তা পেশ করবো এবং তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো।
আমার মনে এসব প্রশ্নের যে জবাব এসেছে তা হচ্ছে, আলী যা করেন নি এবং তাঁর করা উচিৎ ছিলো বলে অনেকে মনে করেছেন, তিনি যদি তা-ই করতেন তাহলে আমরা কী করে আলীকে চিনতে পারতাম?
আমাদের কাছে যখন এ ঘটনা বর্ণনা করা হতো যে, এক রাতে তালহাহ্ ও যুবাইর খলীফাহ্ আলীর খেদমতে এলেন এবং রাষ্ট্রীয় বিষয়াদি নিয়ে আলাপ-আলাচনা করলেন, অতঃপর সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যে, তাঁদের একজনের ওপর ইরাকের শাসনভার অর্পণ করা হবে এবং সেখানকার হুকুমত তাঁকে দেয়ার ব্যাপারে ফরমান জারী করা হলো, আর উদাহরণ স্বরূপ, ইতিহাসে লিখিত থাকতো যে, অপর জনকে মিসরের হুকুমত অর্পণ করা হয়, তাহলে আমার ও আপনার কাছে আলী এবং তালহাহ্ ও যুবাইরের মধ্যে কী পার্থক্য ধরা পড়তো? আমরা মু’আবিয়াহ্ ও ‘আম্র্ ইবনুল ‘আছ্ এবং আলীর মধ্যে কী পার্থক্য দেখতে পেতাম?
কয়েক জন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ছিলেন; তাঁরা এক জায়গায় বসতেন, পরস্পর পরামর্শ করতেন ও একটি কাজ সম্পাদন করতেন। একদিন তাঁরা একজনের হাতে বাই’আত হন, আরেক দিন আলী (আঃ) নামে আরেক জন ব্যক্তিত্বের হাতে বাই’আত হন। এক সময় তাঁরা বসে পরামর্শ করলেন এবং তৎকালীন খলীফাহ্ মু’আবিয়াকে শামের গভর্নর করলেন। এরপর দ্বিতীয় পরবর্তী খলীফাহ্ তাঁকে সেখানেই বহাল রাখলেন। সেই লোকেরাই আলী (আঃ)-এর কাছে এলেন এবং বসে পরামর্শ করে তালহাহ্ ও যুবাইরকে কুফাহ্ ও বসরার গভর্নর মনোনীত করলেন। এরূপ ঘটলে তার অনিবার্য পরিণতি হতো এই যে, আজকে আমরা কয়েক কোটি শিয়া মুসলমান সহ বিশ্বের মোট একশ’ কোটিরও বেশী সংখ্যক মুসলমান আলী এবং তালহাহ্ ও যুবাইরের মধ্যে কোনো পার্থক্যই খুঁজে পেতাম না। বরং আমরা আলী ও মু’আবিয়ার মধ্যেও পার্থক্য খুঁজে পেতাম না।
এটা কোনো নতুন ব্যাপার নয়। আজকে যে আপনি ও আমি এখানে বসেছি এবং এবং আমরা জানি যে, আলীর আরেকটি মর্যাদা ছিলো, প্রকৃত পক্ষে তাঁর একটি স্বতন্ত্র চেহারা ছিলো, এটা এ কারণে যে, এখন থেকে তেরোশ’ বছর আগে ওলামায়ে ইসলাম প্রাণপাত করে আপনার ও আমার জন্য এ সমস্যার সমাধান দিয়ে গেছেন। তাঁরা শৈশব কাল থেকেই আমাদের কানে, আমাদের পিতা-মাতাদের কানে এ কথাগুলো বলে গেছেন, আমাদেরকে শিক্ষা দিয়ে গেছেন। কিন্তু ইতিহাস যদি এমন হতো যে, কয়েক ব্যক্তি এক জায়গায় বসে সব কাজকর্ম ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিয়েছিলেন তাহলে আমরা তাঁদের মধ্যে কী পার্থক্য দেখতে পেতাম? আমরা বড়জোর বলতাম যে, আলী তাঁদের চেয়ে কিছুটা ভালো ছিলেন। অতএব, এটা কোনো নতুন ব্যাপার নয়।
স্বয়ং আলী (আঃ) এ কারণে বিলাপ করেছিলন যে, তাঁকে মু’আবিয়ার সাথে তুলনা করা হচ্ছিলো। সে যুগেও হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর একদল ছাহাবী _ যারা বহু বছর হযরত আলী (আঃ)-এর পাশে ছিলেন, আলীর মিম্বারেও বসতেন, তাঁরা বলতেন ঃ মু’আবিয়ারও অনেক ভালো গুণ আছে; তিনি অত্যন্ত দানশীল, তিনি সুদক্ষ পরিচালক, তিনি একটি ইসলামী দেশকে পরিচালনা করছেন।
এভাবে এক সময় তাঁরা আলীর বিরুদ্ধে অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠেন এবং মু’আবিয়ার কাছে চলে যান। এমনকি অনেক সময় আলীর ঘনিষ্ঠ জনদের মধ্য থেকেও কতক লোক তাঁর ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে ওঠেন, কারণ, তাঁরা আলীর কাছে যা চাইতেন আলী তা দিতে অস্বীকার করেন। তখন তাঁরা মু’আবিয়ার কাছে চলে যেতেন এবং তাঁর দলে শামিল হয় যেতেন, অবশ্য স্বীকার করতেন যে, আলীর মর্যাদা কিছুটা বেশী এবং তাঁর ইবাদত-বন্দেগীর পরিমাণও বেশী।
আলী যদি তাঁদের কথা মতো কাজ করতেন এবং আপোস করতেন তাহলে আজকে আপনি ও আমি আলীকে কী রকম দেখতাম? আমরা যদি ইসলাম থেকে এ তাৎপর্যই গ্রহণ করতাম ও আলীকে এভাবে পেতাম এবং একেই একজন ইসলামী খলীফার আচরণ বলে গণ্য করতাম, তাহলে ইসলামী খেলাফত এবং পার্থিব রাষ্ট্রসমূহ, যেমন ঃ খসরু ও কায়সারের শাসন ব্যবস্থার মধ্যে কী পার্থক্য থাকতো? তাঁরা তো এসব কাজই করে থাকেন। তাঁরা যখন দেখেন যে, একটি সংঘাতের পরিস্থিতি উপস্থিত হয়েছে যা সামাল দেয়া সম্ভব হবে বলে মনে হয় না তখন তাঁরা প্রতিপক্ষের সাথে আপোসরফা করে নেন; তাঁরা আলোচনার টেবিলে মুখোমুখি বসেন, পরস্পরের উদ্দেশে মৃদু হাস্য করেন এবং পরস্পরের সাথে খাপ খাইয়ে নেন যাতে যুদ্ধ না হয়, রক্তক্ষয় না হয়, সহিংসতাকে এড়িয়ে যাওয়া যায়। বিশ্বে কি এটাই চলছে না? আলীও যদি তা-ই করতেন তাহলে আলীর হুকুমাত এবং ক্লিন্টন ও অন্যদের হুকুমাতের মধ্যে কী পার্থক্য হতো?
আমরা যে আজ ইসলামের প্রকৃত রূপের সাথে পরিচিত, শিয়া মাযহাব যে আছে, এটা আলীর কর্মনীতির বরকতেই আমরা পেয়েছি। সন্দেহ নেই যে, আলী মু’আবিয়াকে পরাজিত করার ও নিশ্চিহ্ন করার ব্যাপারে সফল হন নি, কিন্তু তিনি আমাদের নিকট এ চিন্তা ও এ কর্মসূচী পেঁৗছে দিয়ে গেছেন এবং জানিয়ে দিয়ে গেছেন যে, এটাই ইসলামের কর্মসূচী। তা হচ্ছে, ইসলাম তার মূলনীতি সমূহ ও তার ভিত্তি সমূহ নিয়ে লেনদেন করার অনুমতি দেয় না। ইসলামের পথে হয়তো ব্যক্তিগত স্বার্থ ও অধিকার উৎসর্গ হয়ে যাবে, হয়তো সামগ্রিক ও বৃহত্তর স্বার্থে গৌণ স্বার্থ উৎসর্গ হয়ে যাবে, কিন্তু মূলনীতি সমূহ ও ভিত্তি সমূহকে কখনোই পরিত্যাগ করা যাবে না। মূলনীতি ও ভিত্তি সমূহে যেন সূচ্যগ্র পরিমাণ ত্রুটিও প্রবেশ না করে।
আলী যদি এ কাজ না করতেন তাহলে আপনি ও আমি কোত্থেকে জানতাম যে, রাষ্ট্রের জন্য ইসলামেরও নিজস্ব পরিকল্পনা আছে, যে পরিকল্পনা ইসলামী রাষ্ট্রে পাশ্চাত্য গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ দেয় না, বরং বলে যে, আল্লাহ্র আদেশ-নিষেধকে বাস্তবায়ন করতে হবে?
লোকেরা যখন আলীর হাতে বাই’আত হয় তখন তারা বলেছিলো ঃ আগেকার খলীফাগণ যেভাবে আচরণ করেছেন আপনিও সেভাবে আচরণ করবেন। তাঁরা কি মুসলমান ছিলেন না? তাঁরা কি রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর খলীফাহ্ ছিলেন না? তাঁরা কি রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর শ্বশুর বা জামাতা ছিলেন না? সকল মুসলমান কি তাঁদের অনুকূলে বাই’আত হন নি? তাঁরা যেভাবে আচরণ করেছেন আপনি সেভাবেই আচরণ করবেন।
আলী বললেন ঃ আমি সে ধরনের আচরণ করবো না। তোমরা যদি আমার হাতে বাই’আত হতে চাও তাহলে আমি কিতাব ও সুন্নাত অনুযায়ী এবং রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর সীরাত অনুযায়ী আমল করবো। অন্যদের মতামতে আমার কোনোই প্রয়োজন নেই। আল্লাহ্ তা’আলার হুকুম থেকে যা প্রমাণিত সে ব্যাপারে তোমাদের মতামতেরও আমার কাছে গুরুত্ব নেই। তোমরা সকলে মিলেও যদি বিরোধিতা করো তাহলেও আমি আল্লাহ্র হুকুম বাস্তবায়ন করবো।
পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের মূলনীতি সমূহের সাথে এটা খাপ খায় না। আলী যদি এমনটি না করতেন তাহলে আজ আমরা বলতে পারতাম না যে, ইসলামের নিজস্ব রাষ্ট্রব্যবস্থা আছে, নিজস্ব মূলনীতিমালা আছে, বিভিন্ন মৌলিক ভিত্তি আছে এবং সেগুলো বাস্তবায়িত হতে হবে।
ইসলাম যদি স্রোতের টানে ভেসে চলা একটা ধর্ম হতো যা বিভিন্ন রুচির অনুবর্তী হতো, বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যার অনুবর্তী হতো, যদি এমন হতো যে, অমুকের ব্যাখ্যা প্রথম খলীফার ব্যাখ্যা, অমুকের ব্যাখ্যা দ্বিতীয় খলীফা ব্যাখ্যা, আর এটা আলীর ব্যাখ্যা, তাহলে তাতে কী পার্থক্য ঘটতো? তাহলে আমরা কী করে বলতে পারতাম যে, আলীর ব্যাখ্যাই সঠিক এবং ঐ সব ব্যাখ্যায় ত্রুটি আছে; সেগুলো নিয়ে চিন্তা-গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার অবকাশ আছে? আমরা কোত্থেকে জানতাম ও বলতাম যে, আমাদের কাছে ইসলামের এমন একটি সংস্করণ আছে যা নিষ্পাপ ব্যক্তিদের সংস্করণ, অতএব, সকলের তা-ই অনুসরণ করা উচিৎ? কী করে বলতাম যে, মা’ছূমগণের মতামতের মোকাবিলায় মত প্রদান করা অনুচিৎ? তাহলে তো বলা হতো, তোমরা দেখতে পাচ্ছো না যে, প্রথম খলীফাহ্ এক ধরনের আচরণ করেছেন, দ্বিতীয় খলীফাহ্ আরেক ধরনের, আর আলীও ভিন্ন আরেক ধরনের আচরণ করেছেন? অতএব, তিনিও অন্যদের মতোই। আমরা কী করে বুঝবো যে, তাঁর মতামত অন্যদের মতামত থেকে অধিকতর উত্তম ছিলো? তাঁরা নিজেদের স্বার্থে, বিশেষ করে ঝামেলা এড়ানোর জন্য কাজ করেছিলেন। তাঁরা মু’আবিয়াকে শামে পাঠিয়েছিলেন এবং আলীও তাকে সেখানেই বহাল রেখেছেন। দ্বিতীয় খলীফাহ্ নিয়োগ দিলেন, পরবর্তী খলীফাও তাঁকে বহাল রাখলেন, আর আলীও একই কাজ করলেন; এতে পার্থক্য কোথায়? কী করে বুঝবো যে, এটা ছিলো মা’ছূমের মত, আর অমুক মত ছিলো গায়রে মা’ছূমের মত তথা এটা সঠিক ছিলো আর ঐটা ভুল ছিলো? আর আমরা যদি এর বিপরীত দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে চাই এবং সেজন্য এসব দৃষ্টান্ত সামনে রাখি তাহলে বলতে হবে যে, পূর্ববর্তীদের সিদ্ধান্ত অধিকতর সঠিক ছিলো। কারণ, তাঁরা যে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তার ফলে শাম ও ইরাকে রক্তক্ষয় এড়ানো সম্ভবপর হয়। অতএব, শান্তি ও সন্ধিতেই কল্যাণ নিহিত। অতএব, ইসলাম হচ্ছে দয়া, অনুগ্রহ, শান্তি, সন্ধি, আপোস, মৃদু হাস্য করণ ও আপোসরফার ধর্ম। অতএব, আলী জঙ্গে জামালে তাঁর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, নাহ্রাভানে যুদ্ধ করে ও সিফ্ফীনে যুদ্ধ করে ভুল কাজ করেছেন। অথচ আলী চার বছর ও নয় মাস হুকুমত পরিচালনা করেছেন, কিন্তু তাঁর পুরো সময়টাই কেটেছে যুদ্ধে। অতএব, ইসলাম সম্পর্কে আলীর ব্যাখ্যা সঠিক ছিলো না।
কিন্তু হযরত আলী (আঃ) কেবল তাঁর নিজের যুগের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে চান নি। তিনি কিয়ামত পর্যন্ত লোকদের সামনে ইসলামের স্থায়ী পরিকল্পনা উপস্থাপন করতে চাচ্ছিলেন। ইসলাম হচ্ছে সুবিচারের সমর্থক। শান্তি, সন্ধি ও আপোসের মাধ্যমে যদি সুবিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় তাহলে আলী সবার আগে তা-ই করতেন; তিনি কারো নাক থেকেও এক ফোঁটা রক্ত ঝরতে দিতেন না, কারো প্রতি সামান্যতম অবমাননাও হতে দিতেন না।
আলী হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যখন দেখলেন যে, একজন ইয়াহূদী বা যরথুস্ত্রী বালিকার পা থেকে একটি নূপুর খুলে নেয়া হয়েছে তখন তিনি বললেন ঃ “এ কারণে আফসোসে যদি কোনো মুসলমানের প্রাণ বেরিয়ে যায় বা সে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলে তো সেটা যথার্থ হবে।”
একজন ইয়াহূদী বা যরথুস্ত্রী বালিকার পা থেকে একটি নূপুর খুলে নেয়া হবে এটা দেখার জন্য আলী প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু তিনিই তলোয়ারের মুখে সত্তর হাজার মানুষের প্রাণ চলে যাওয়া দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলেন।
আপনি ও আমি যদি আজকের চিন্তাধারা নিয়ে তখন সেখানে উপস্থিত থাকতাম তাহলে হয়তো বলতাম যে, আলী একজন রূঢ় ও নিষ্ঠুরহৃদয় ব্যক্তি যিনি রাজনীতি বোঝেন না, ইত্যাদি। এর বেশী ধৃষ্টতা দেখাতে সাহস পাচ্ছি না। কিন্তু আলী কেবল তাঁর নিজের যুগের প্রতি দৃষ্টি রাখেন নি; তিনি কেবল তাঁর নিজের হুকুমাতের চিন্তা করেন নি। তাঁর জন্য ইসলামী হুকুমতের একটি আদর্শ, একটি মডেল উপস্থাপন করা প্রয়োজন ছিলো, কিয়ামত পর্যন্ত যে কেউ ইসলামী হুকুমাত প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে যেন তাকে অনুকরণীয় আদর্শ রূপে গ্রহণ করতে পারে।
হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) যখন প্যারিসে ছিলেন তখন সারা দুনিয়া থেকে সাংবাদিকরা এসে তাঁর কাছে সমবেত হন। তাঁরা প্রশ্ন করেন ঃ “আপনি যদি বিজয়ী হন, শাহ্ যদি সরে যান তখন ইরানে কী ধরনের রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবেন?” তিনি বলেন ঃ “আলীর রাষ্ট্রব্যবস্থা। আমাদের আদর্শ হচ্ছে আলীর হুকুমাত।” এরপর তিনি বলেন ঃ “আমরা যত কষ্ট করেছি তা এ কারণে যে, এখনো ইসলামের আভাস পাচ্ছি। তবে আদর্শ বিন্দু হচ্ছে ঐটি এবং আমরা ঐদিকে যাবো। পরিস্থিতি যতটা সুযোগ দেবে এবং জনগণ যদি সহায়তা করে তো আমরা ঐ রকম হতে চাই।” তিনি বলেন নি ঃ “আমাদের আদর্শ হচ্ছে ইউরোপের বা আমেরিকার গণতন্ত্র।” তিনি বলেন নি ঃ “আমাদের আদর্শ প্রথম খলীফার বা দ্বিতীয় খলীফার বা খোলাফায়ে রাশেদীনের খেলাফত অথবা আলীর হুকুমাত।”
হযরত আলী (আঃ) ইসলামী হুকুমাতের সংজ্ঞা দিয়ে গেছেন, তবে শুধু কথায় নয়, প্রায় পাঁচ বছর বাস্তবে হুকুমাত পরিচালনার মাধ্যমে।
ইতিপূর্বে মু’আবিয়ার যে সব কৌশলের কথা উল্লেখ করেছি, হযরত আলী (আঃ)-এর শাহাদাতের পর মু’আবিয়াহ্ সেই সব কৌশলের আশ্রয় নিয়ে ও ইসলামী সমাজে বিদ্যমান দুর্বলতা সমূহের অপব্যবহার করে ইসলামী হুকুমাতের এ সঠিক সংজ্ঞাকে বিকৃত করার ও জনগণের মধ্যে ভিন্ন চিন্তার বিস্তার ঘটানোর চেষ্টা করেন। তিনি লোকদের মগয ধোলাই-এর জন্য আরেকটি পরিকল্পনা তৈরী করেন এবং এ লক্ষ্যে তিনি তাঁর রাজনৈতিক কৌশল সমূহ প্রয়োগ করেন।
মু’আবিয়াহ্ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ও গোত্রপতিদেরকে অর্থকড়ি দিয়ে খরিদ করে নেন। তিনি অঢেল পরিমাণে অর্থ ব্যয় করে তাদের সকলকেই খরিদ করে ফেলেন। অন্যান্য লোক তথা সাধারণ জনগণ ছিলো তাদের গোত্রপতিদের অনুগত; গোত্রপতি যেদিকে যেতো তারা তার পিছনে সেদিকেই যেতো। আর যাদেরকে এভাবে পক্ষে আনা সম্ভব হয় নি মু’আবিয়াহ্ তাদের ব্যাপারে ভীতি ও হুমকি প্রদর্শনের আশ্রয় নেন।
এভাবে মু’আবিয়াহ্ দীর্ঘ বিশ বছর যাবত এমন কাজ করেন যার ফলে জনগণের সকলেরই গলায় রশি লাগাতে সক্ষম হন। তিনি একদিকে কতককে দান ও উপঢৌকনের মাধ্যেমে পক্ষে আনেন, আরেক দিকে অন্যদেরকে গুপ্তহত্যা, নিষ্ঠুরতা ও প্রকাশ্য হত্যার মাধ্যমে দমন করেন। তিনি বাছার্ বিন্ ‘ইর্তাব্কে পাঠান, সামারাহ্ বিন্ জুন্দুবকে পাঠান; তারা সীমাহীন রক্তপাত ঘটায়, তারা লোকদের মান-ইজ্জতের দিকে হাত বাড়ায়, নারীদের বেইজ্জত করে, লোকদের চোখ তুলে নেয়। এর ফলে কারো পক্ষে আর মু’আবিয়ার বিরোধিতা করার মতো সাহস দেখানো সম্ভব হয় নি।
কয়েক ব্যক্তি ছিলেন যারা ইসলামী জাহানে, বিশেষ করে ইরাকে ও হেজাযে ‘হাওয়ারীয়ে আলী’ বা আলীর সহচর হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন। তাঁরা জনগণের নিকট খুবই সম্মানের পাত্র ছিলেন। এমনকি যাদের নিজেদের মধ্যে দুর্বলতা ছিলো, যারা টাকা-পয়সাকে ভালোবাসতো, তারাও এই ব্যক্তিত্ববর্গকে তাঁদের উঁচু মর্যাদার কারণে ভালোবাসতো। আমরা নিজেরাও তো কমবেশী এ রকমই; কখনো কখনো গুনাহে লিপ্ত হয়ে পড়ি, কিন্তু যে সব লোক তাকওয়ার অধিকারী তাঁদেরকে আমরা ভালোবাসি। সন্দেহ নেই যে, অনেক সময় ধনসম্পদের ক্ষেত্রে আমরা সতর্কতার পরিচয় দেই না, কিন্তু যখন দেখি যে, একজন লোক অত্যন্ত পুতচরিত্র ও নেককার এবং তিনি বাইতুল মালের অর্থ ব্যয় করার ক্ষেত্রে খুবই সতর্কতার পরিচয় দিচ্ছেন তখন আমাদের ভালো লাগে এবং আমরা তাঁকে ভালোবাসি। যদিও আমাদের নিজেদের সে হিম্মত নেই, কিন্তু আমরা যখন ভালো লোকদের দেখতে পাই তখন আমাদের ভালো লাগে।
হ্যা, কয়েক ব্যক্তি ছিলেন ‘হাওয়ারীয়ে আলী’ অর্থাৎ আলীর সহচর এবং তাঁরা এ নামেই সুপরিচিত ছিলেন; ইতিহাসেও তাঁদেরকে এ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত আলী (আঃ) এদের মধ্য থেকে মালেক আশতারকে মিসরের গভর্নর নিয়োগ করে পাঠিয়েছিলেন। তিনি এবং মুহাম্মাদ বিন্ আবু বকর ছাড়াও আরো কয়েক জন ছিলেন; এরা সামাজিক পদমর্যাদা ছাড়াও আধ্যাত্মিক মর্যাদারও অধিকারী ছিলেন। তাঁরা যুহ্দ্ ও তাকওয়ার ক্ষেত্রে খুবই উঁচু স্তরের ছিলেন। তাঁরা ভবিষ্যত শুভাশুভ জ্ঞান রাখতেন; খোদায়ী ইল্হামের বদৌলতে তাঁরা গায়েবী খবর দিতেন _ সেই ধরনের খবর যে সম্পর্কে অনেক সময় আমরা সন্দেহ পোষণ করি। যেমন ঃ আমরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পতিত হই যে, সত্যি সত্যিই হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) কি তাঁর শাহাদাতের খবর আগে থেকেই জানতেন?
হযরত আলী (আঃ)-এর কতক সহচর ছিলেন যারা নিজেদের ও অন্যদের শাহাদাতের খবর আগে থেকেই জানতেন। এদের মধ্যে চার ব্যক্তি ছিলেন খুবই বিখ্যাত ও শীর্ষস্থানীয়। এরা হলেন হাজার্ বিন্ ‘আদী, ওমর বিন্ হামাক্ব খাযা’ঈ, রাশীদ হাজারী ও মাইছাম্ বিন্ তাম্মার। এদেরকে কোনো মূল্যের বিনিময়েই খরিদ করা সম্ভব ছিলো না। মু’আবিয়াহ্ তাঁদেরকে সম্মান প্রদর্শন, খোশামোদ, প্রশংসা ও অন্য যে কোনো ভাবেই বশে আনার যতই চেষ্টা করেন, তাঁরা কিছুতেই বশে এলেন না, নমনীয়তা দেখালেন না। তাঁরা হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)কে চিনতেন, হযরত আলী (আঃ)কে ভালোবাসতেন। তাঁদের সম্পর্কে বলতে হয় যে, তাঁদের গোটা সত্তাই হযরত আলী (আঃ)-এর মর্যাদা ও গুণাবলী বর্ণনায় ব্যয়িত হতো। মু’আবিয়াহ্ তাঁদেরকে বশে আনতে ব্যর্থ হলেন। তাই তিনি তাঁদেরকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
এরপর মু’আবিয়াহ্ একদিকে হাজার বিন্ ‘আদীকে এবং অন্যদিকে ওমর বিন্ হামাক্ব খাযা’ঈকে হত্যা করেন। মু’আবিয়াহ্ ওমর বিন্ হামাক্ব খাযা’ঈকে হত্যা করে তাঁর মাথা তাঁর স্ত্রীর নিকট পাঠিয়ে দেন। তখন ওমর বিন্ হামাক্ব খাযা’ঈর স্ত্রী মু’আবিয়ার নিকট এমন একটি বাণী পাঠান যা মু’আবিয়াকে এতখানি অপমানিত ও লাঞ্ছিত করে যে, তিনি সে জ্বালা সহ্য করতে না পেরে ঐ মহিলাকে ইসলামী রাষ্ট্রের সীমারেখার মধ্য থেকে বহিষ্কার করার জন্য নির্দেশ দেন।
ওমর বিন্ হামাক্ব খাযা’ঈ একবার আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলী (আঃ)-এর খেদমতে এসে বলেছিলেন ঃ “হুজুর, আপনি যেহেতু আমার নেতা ও পদমর্যাদার অধিকারী এবং আপনার হাতে অনেক উপায়-উপকরণ আছে, সে কারণে আমি আপনার নিকট আসি নি, আমি এ কারণে আপনার নিকট এসেছি যে, আল্লাহ্ তা’আলা আপনার আনুগত্য আমার ওপর ফরয করেছেন, আমার ওপর আপনার জন্য বিরাট অধিকার তৈরী করে দিয়েছেন। হে আলী! আপনি যদি হুকুম করেন যে, সবগুলো পাহাড়কে স্থানান্তরিত করবো এবং আমার যদি অনুরূপ শক্তি থাকে তাহলে আমি তা-ই করবো, আপনি যদি সমুদ্রের সমস্ত পানি তুলে আনতে বলেন আমার শক্তিতে কুলোলে আমি তা-ই করবো, যদি সারা জীবন তলোয়ার হাতে নিয়ে আপনার শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বলেন তাহলে তা-ই করেবো, কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও আমার ওপরে আপনার যে অধিকার রয়েছে তা আদায় হবে না। আপনার অধিকার এর চেয়েও অনেক বড়।” তখন আমীরুল মু’মিনীন (আঃ) খুশী হন এবং তাঁর জন্য দো’আ করেন। এরপর তিনি বলেন ঃ “হায়! মুসলমানদের মধ্যে যদি তোমার মতো একশ’ জন লোকও থাকতো!”
হ্যা, তাঁর মতো ঈমানের অধিকারী বেহেশতী গোলাপ আরো দু’একজন ছিলেন।
হাজার্ বিন্ ‘আদী ও ওমর বিন্ হামাক্ব খাযা’ঈ _ এই দুই মহান ব্যক্তিকে মু’আবিয়াহ্ অত্যন্ত নির্মমভাবে হত্যা করেন। মু’আবিয়াহ্ যতই পর্যালোচনা করেন দেখতে পান যে, তাঁদেরকে হত্যা করলে সে জন্য বিরাট মূল্য দিতে হবে। কারণ, তিনি মুসলমানদের মধ্যে নিজের জন্য দুর্নাম সৃষ্টি করতে চাচ্ছিলেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি এ ছাড়া আর কোনো পথ খুঁজে পান নি। কারণ, তিনি দেখলেন যে, এরা দু’জন কোনো মূল্যের বিনিময়েই তাঁর নিকট আত্মসমর্পণ করছেন না ও করবেন না। এ কারণে তিনি এদেরকে নীরব করে দেন। কারণ, কিছুতেই তিনি তাঁদেরকে শান্ত করতে পারছিলেন না, তাঁদেরকে খরিদ করা সম্ভব হচ্ছিলো না।
এরপর তাঁদের মধ্য থেকে দু’জন থাকলেন ঃ একজন রাশীদ হাজারী এবং অপর জন মাইছাম্ বিন তাম্মার। শামে মু’আবিয়ার মৃতু্য হলে মাইছাম্ বিন তাম্মার তাঁর বন্ধুদেরকে এ খবর জানান ও বলেন ঃ “আমি অনুভব করছি যে, ঝড় আসছে।”
অনেকে তাঁকে ভালোভাবে চিনতেন; তাঁরা বুঝতে পারলেন যে, তিনি চিন্তাভাবনা না করে কোনো কথা বলেন না। এরপর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ওবায়দুল্লাহ্ বিন্ যিয়াদ এলো ও কুফার গভর্নর হলো। তারপর সে যা করলো তা আপনাদের জানা আছে।
মাইছাম্ নিজের কাজে মশগুল ছিলেন। তিনি হযরত আলী (আঃ)-এর মর্যাদা বর্ণনা করতেন এবং লোকদেরকে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর আহ্লে বাইতের অনুসরণ করার জন্য আহ্বান জানাতেন। ওবায়দুল্লাহ্ মাইছামকে এ কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য বহু চেষ্টা করে, কিন্তু কিছুতেই তিনি তাঁর কর্তব্য পালন থেকে বিরত হলেন না।
তখন হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর ইরাকে প্রবেশের আর মাত্র অল্প কয়েক দিন বাকী ছিলো। এটা ছিলো সেই সময় যখন মুসলিম ইবন ‘আক্বীল্ কুফায় ছিলেন এবং ওবায়দুল্লাহ্ তাঁকে হত্যা করার চেষ্টা করছিলো।
বর্ণিত হয়েছে ঃ একদিন মাইছাম্ একটি ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিলেন এবং হাবীব বিন্ মাযাহেরও একটি ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিলেন। তাঁরা পরস্পরের কাছাকাছি পেঁৗছলেন এবং এত কাছে পেঁৗছলেন যে, তাঁদের ঘোড়ার মাথা একটির নীচে আরেকটি পেঁৗছে গেলো। তাঁরা পরস্পরের কানের কাছে মুখ নিয়ে কথা বলতে লাগলেন। তাঁরা পরস্পরের সাথে রসিকতা করছিলেন। মাইছাম বিন্ তাম্মার হাবীব বিন্ মাযাহেরকে বললেন ঃ “আমি এমন একজন লাল চুলওয়ালা লোকের কথা জানি যার মাথার দুই পাশ থেকে দুই গুচ্ছ চুল নেমে গেছে; রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর সন্তানের প্রতি সমর্থন জানানোর দায়ে কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি নিহত হবেন।” এভাবে তিনি স্বয়ং হাবীবকে তাঁর শাহাদাতের আগাম খবর দিলেন। তখন হাবীব বলেন ঃ “আমিও এমন এক ব্যক্তিকে চিনি যার মাথার সামনের দিকের চুল ঝরে গেছে, আর তাঁর পেটটা একটু উঁচু; এই ব্যক্তিকে খেজুর গাছের খুঁটির সাথে ফাঁসি দেয়া হবে।” এভাবে হাবীব মাইছামের শাহাদাতের আগাম খবর দিলেন।
পরদিন ওবায়দুল্লাহ্র নির্দেশে হাবীব বিন্ মাযাহেরকে মুখে লাগাম পরিয়ে দেয়া হয় যাতে তিনি কথা বলতে না পারেন। এরপর তাঁর জিহ্বা কেটে ফেলা হয় ও তার পেটে বর্শা দিয়ে আঘাত করা হয়। তৃতীয় দিনে তাঁর পেট কেটে ফেলা হয়।
তাঁরা দু’জন যখন পরস্পরের ভবিষ্যত সম্পর্কে পরস্পরকে জনাচ্ছিলেন তখন তাঁদের একজন ভক্ত সেখানে ছিলেন এবং তাঁদের এ কথাবার্তা শোনেন। এরপর তিনি রাশীদ বিন্ হাজারীর কাছে গিয়ে বলেন ঃ আমি আজ এ ধরনের একটি ঘটনা দেখেছি; মাইছাম হাবীব বিন্ মাযাহেরকে বলেন, “আমি এমন একজন লাল চুলওয়ালা লোকের কথা জানি যার মাথার দুই পাশ থেকে দুই গুচ্ছ চুল নেমে গেছে; রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর সন্তানের প্রতি সমর্থন জানানোর দায়ে কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি নিহত হবেন।” তখন রাশীদ বিন্ হাজারী বললেন ঃ “আল্লাহ্ তা’আলা মাইছামের ওপর রহমত করুন। তবে তিনি একটি কথা বলেন নি। তা হচ্ছে, এরপর তাঁর মাথা কেটে শাসকের কাছে পাঠানো হবে আর যে ঐ মাথাটি নিয়ে যাবে তার বেতন একশ’ দেরহাম বৃদ্ধি করা হবে।”
হ্যা, আলী (আঃ) এ ধরনের লোক তৈরী করেছিলেন।
এরপর ওবায়দুল্লাহ্ মাইছাম্ বিন্ তাম্মার্ ও রাশীদ হাজারীকেও শহীদ করে। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন? কারণ তাঁরা আত্মসমর্পণ করতে প্রস্তুত ছিলেন না।
প্রসঙ্গতঃ আবারো অনুযোগ করছি আমাদের নিজেদের পোশাকের বিরুদ্ধে। ঐতিহাসিকগণ ও হাদীছ শাস্ত্রবিদগণ বর্ণনা করেছেন; সম্ভবতঃ এ প্রসঙ্গে বহু রেওয়াইয়াত পাওয়া যাবে; তাঁরা বর্ণনা করেছেন যে, হযরত আলী (আঃ) মাইছামকে বললেন ঃ “তখন কেমন হবে তোমার অবস্থা যখন তোমাকে খেজুর গাছের খুঁটির সাথে ফাঁসি দেয়া হবে? আর তার আগে যখন তোমার জিহ্বা কেটে ফেলা হবে, পেটে বর্শা দিয়ে আঘাত করা হবে ও পেট কেটে ফেলা হবে তখন তোমার অবস্থা কেমন হবে?” মাইছাম্ প্রশ্ন করলেন ঃ “সে অবস্থায় কি আমি মুসলমান থাকবো?” হযরত আলী বললেন ঃ “হ্যা।” মাইছাম বললেন ঃ “তাহলে আমি আনন্দিত হবো।” তখন আলী বললেন ঃ “তাহলে শোনো, তোমাকে আমি পরামর্শ দিচ্ছি, তুমি আমার সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দাও এবং বলো যে, আমি আলীর ওপর অসন্তুষ্ট। তুমি এ কাজ করবে?” মাইছাম্ বললেন ঃ”আল্লাহ্র শপথ, যতক্ষণ শ্বাস আছে এ কাজ করবো না।” তখন আলী (আঃ) তাঁকে এই বলে সুসংবাদ দেন যে, “তুমি বেহেশতে আমার সথে থাকবে।”
আমি আমার অভিন্ন পোশাকধারী বন্ধুদের বিরুদ্ধে যে জন্য অনুযোগ করতে চাচ্ছি তা হলো এই যে, আমরা যে আম্র্ বিল্ মা’রূফ ওয়া নাহি ‘আনিল্ মুন্কার্ অর্থাৎ ভালো কাজের আদেশ দান ও মন্দ কাজে বাধা দানের দায়িত্ব পালন করে থাকি, তখন এতে যদি জীবন যাবার আশঙ্কা দেখা দেয় তখন আমাদের আর সে কাজের দায়িত্ব থাকে না। মাইছাম বোধ হয় জানতেন না যে, জীবন বাঁচানো ফরয, অতএব, জীবনের ঝুঁকি এলে আলীর সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দিতে হবে, তাকিয়্যাহ্ করতে হবে।
ঠিক একই ঘটনা হাজার বিন্ ‘আদী, রাশীদ বিন্ হাজারী, ওমর বিন্ হামাক্ব ও অন্যদের বেলায় এবং সা’ঈদ বিন্ যুবাইর ও অনেক বুযুর্গ ছাহাবীর ক্ষেত্রেও ঘটেছিলো।
হাজ্জাজ বিন্ ইউসুফ সা’ঈদ্ বিন্ যুবাইরকে তার কাছে আনতে বলে এবং তাঁকে আনা হলে হাজ্জাজ তাঁকে বলে ঃ “বলো যে, আলীর সাথে তোমার কোনো সম্পর্ক নেই।” তখন সা’ঈদ বললেন ঃ “কক্ষনো বলবো না।” অতঃপর তাঁর জিহ্বা বেটে ফেলা হয় ও তাঁকে শহীদ করা হয়। হাজ্জাজ এখানেই থেমে থাকে নি।
আর ওবায়দুল্লাহ্ বিন্ যিয়াদ রাশীদ বিন্ হাজারীর দুই হাত ও দুই পা কেটে ফেলে। রাশীদ বলেন ঃ “আমি আমার নেতা আলীর কাছ থেকে শুনেছি, তিনি বলেছেন ঃ তারা তোমার দুই হাত ও দুই পা কেটে ফেলবে, এরপর তোমার জিহ্বা কেটে ফেলবে।” ওবায়দুল্লাহ্ বললো ঃ “আলীর কথা যাতে মিথ্যা প্রমাণিত হয় সে জন্য তোমার জিহ্বা কাটবো না।” এমতাবস্থায় হাত-পা কাটা থাকা সত্ত্বেও রাশীদ হযরত আলী (আঃ)-এর প্রতি মহব্বত সহকারে তাঁর মর্যাদা বর্ণনা করতে শুরু করেন। তখন ওবায়দুল্লাহ্ বিন্ যিয়াদ আর সহ্য করতে না পেরে একজন হাজামকে রাশীদের জিহ্বা কেটে ফেলার জন্য নির্দেশ দেয়। ইবনে যিয়াদ চাচ্ছিলো না যে, তাঁর জিহ্বা কাটবে; সে চাচ্ছিলো আলী (আঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণীকে মিথ্যা প্রমাণ করতে। কিন্তু না চাইলেও শেষ পর্যন্ত তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী সত্য প্রমাণিত হয়।
আমি আমার সাথে অভিন্ন পোশাকধারী বন্ধুদের বিরুদ্ধে যে অনুযোগ করতে চাচ্ছিলাম তা হচ্ছে, কেন আমরা এসব বিষয় নিয়ে চিন্তাগবেষণা করি না? আমাদের বলতে হবে যে, প্রাণের ভয়ে ইমামের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দেয়া ও এরূপ ক্ষেত্রে তাকিয়াহ্ নীতির আশ্রয়গ্রহণের বৈধতার প্রমাণ কোথায়? তাকিয়াহ্র পরিস্থিতিতে কোন্ হারাম কাজটি সম্পাদন বৈধ হয়ে যায়? এমন কোনো দৃষ্টান্ত আছে কি যে, তাকিয়াহ্ কর্তব্য কাজ থেকে বিরত রাখতে পারে? কোথায় তার দৃষ্টান্ত? এসব বুযুর্গানে দ্বীন যে পরহেযগারীর দিক থেকে শীর্ষ পর্যায়ে অবস্থান করছিলেন, তাঁরা মর্যাদাগত দিক থেকে মা’ছূমগণের কাছাকাছি ছিলেন, তাঁরা তাঁদের ভবিষ্যত শুভাশুভের জ্ঞান রাখতেন, কেন তাঁরা নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য ইমামের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষণা দেন নি?
তাঁরা যদ্দিন বেঁচে ছিলেন তদ্দিন মানুষকে সঠিক দ্বীনী শিক্ষা প্রদান করেন। কিন্তু যখন নিহত হলেন তার পর আর তো শিক্ষা দিতে পারেন নি। তাঁদের পক্ষে যখন আর দায়িত্ব পালন করা সম্ভব ছিলো না তখন এটাই তো ভালো ছিলো যে, তাঁরা তাকিয়াহ্র আশ্রয় নিতেন ও বেঁচে থাকতেন; কেন তাঁরা তা করলেন না? এ ব্যাপারে তাঁদের নিকট শরয়ী দলীল কী ছিলো? তাঁরা কি মসলা-মাসায়েল জানতেন না? আলী (আঃ) যখন তাঁদেরকে তাঁদের নিহত হওয়ার ব্যাপারে আগাম খবর দেন তখন কেন তিনি তাঁদেরকে এ নির্দেশ দেন নি যে, তারা যখন তোমাদের কাছ থেকে চাইবে যে, তোমরা আমাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করো তখন তোমরা আমাদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করে প্রাণ বাঁচিয়ো?
আমরা এ ব্যাপারে খুব কমই গবেষণা করেছি। যিনি এ ব্যাপারে সর্বোত্তম কাজ সম্পাদন করেছেন তিনি সম্ভবতঃ হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ)। তাঁর সর্ব প্রথম সুস্পষ্ট ফতোয়া ছিলো এই যে, এখানে তাকিয়াহ্ করা হারাম, তাতে যা হবার তা-ই হোক। অন্যরা এ ধরনের ফতোয়া দেন নি। কারণ, তাঁরা এ ব্যাপারে অনুসন্ধান ও গবষণা করেন নি এবং এ ধরনের ফতোয়া দেয়ার মতো সাহস সঞ্চয় করতে পারেন নি। কারণ, এ ব্যাপারে খুব কম গবেষণা হয়েছিলো। হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) একদিকে যেমন এ ধরনের সাহসের অধিকারী ছিলেন, তেমনি গবেষণাও করেছিলেন। আর তিনি এমন সাহসের অধিকারী ছিলেন যে, প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, এমনকি যদি তোমাদের জীবন বিপদাপন্ন হয়, এমনকি যদি শত শত ও হাজার হাজার লোক নিহত হয় তথাপি ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
যারা ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করতে চায়, ইসলামী আকিদা-বিশ্বাস ও ইসলামী মূল্যবোধকে বিলুপ্ত করতে চায় তাদরকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে হবে। এখানে তাকিয়াহ্ হারাম, তাতে তার পরিণতি যা আসার তা আসুক না কেন। এ হলো ইমামের কথা। কিন্তু আমরা যারা তাঁর শিষ্য; আসলে আমরা তাঁর শিষ্যদের শিষ্য বলে পরিগণিত; আমাদের সে যোগ্যতা নেই যে, নিজেদেরকে ইমামের শিষ্য বলে গণ্য করবো। মোদ্দা কথা, আমরা কর্তব্যে অবহেলা করেছি এবং তাঁর দেখানো সে পথে চলি নি।
আমাদের উচিৎ ফিকাহ্র ভিত্তি সমূহকে সঠিকভাবে তুলে ধরা যে, তাকিয়াহ্ কোথায় জায়েয আর কোথায় ফরয। আমাদের গবেষণা করে দেখতে হবে যে, এমন ক্ষেত্র কি আছে যেখানে তাকিয়াহ্ করা জায়েয হলেও তা পরিত্যাগ করাই অগ্রাধিকার রাখে?
এসব বিষয় কমবেশী উপস্থাপিত হয়েছে। কিন্তু অধমের আবেদন এই যে, এসব বিষয়ের চর্চা ব্যাপকতর হোক এবং এ জ্ঞান সকল মানুষের কাছে পেঁৗছে দেয়া হোক। এগুলো কি দ্বীনী আহ্কাম নয়? আমাদের এ যুগে কি আমরা এ ধরনের আহ্কামের মুখাপেক্ষী ছিলাম না? আমরা কি এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে, ভবিষ্যতে আমরা এ আহ্কামের মুখাপেক্ষী হবো না?
আমরা যদি এ হুকুমগুলোকে সঠিকভাবে তুলে না ধরি তাহলে শয়তানরা আসবে, তারা উদাসীনতা ও ঢিলেমির বিস্তার ঘটাবে আর তাকে ইসলামের নামে চালিয়ে দেবে। আর তারা ইসলাম থেকে সাহসিকতা কেড়ে নেবে। তারা মুসলমানদের মধ্যে সন্দেহ ও দ্বিধাদ্বন্দ্ব প্রবেশ করাচ্ছে। কিন্তু যেহেতু এই শাসন ব্যবস্থার নাম ইসলামী শাসন ব্যবস্থা, সেহেতু সব কিছুকেই ইসলামের নিকট সমর্পণ করতে হবে।
প্রতিটি শহর ও অঞ্চলের হুকুমাতের শীর্ষে ছিলেন গভর্নরগণ। তাঁরা অন্যায় করলে লোকেরা এসে অভিযোগ করতো। আপনারা হয়তো এ ঘটনাটি শুনে থাকবেন ঃ একবার আলী যখন নামায শুরু করতে যাচ্ছিলেন। তিনি ইক্বামত বলেছিলেন, এরপর নামায শুরু করার জন্য তাকবীরে তাহ্রীমা “আল্লাহু আকবার” বলতে যাচ্ছিলেন। এ সময় একজন নারী সেখানে এসে পেঁৗছলো _ যে অনেক দূর থেকে এসেছিলো। সে বললো ঃ “হে আলী! তোমার সাথে কথা আছে।” হযরত আলী (আঃ) নামায শুরু করলেন না, বললেন ঃ “বলো, কী কথা তোমার?” নারী বললো ঃ “তুমি আমাদের শহরে যে গভর্নর পাঠিয়েছো সে আমাদের ওপর যুলুম করছে।”
এ কথা শুনে হযরত আলী (আঃ)-এর দুই চোখে অশ্রু এসে গেলো। তিনি তখন নামাযের জন্য প্রস্তুত ছিলেন; তিনি বললেন ঃ “হে আল্লাহ্, তুমি জানো যে, আমি চাই নি এদের ওপর যুলুম হোক।” তিনি কাগজ-কলম আনার জন্য হুকুম দিলেন এবং তখনি তাকে পদচু্যত করার ফরমান লিখে ফেললেন। তিনি বলেন নি, “যেহেতু আলীর হুকুমাত ইসলামী হুকুমাত সেহেতু তার সব কিছু মেনে নিতে হবে।”
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই, কেউ একজন বলেছে যে, অমুক কর্মকর্তা আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম বিরোধী কাজ করছে _ স্বয়ং রাহ্বার যে কর্মকর্তা সম্পর্কে বলেছেন যে, সে ইসলামের জন্য একটি কাজও করে নি; আমি নিজে রাহ্বারের মোবারক যবান থেকে শুনেছি যে, তিনি বলেছেন ঃ “এরা যে সব কাজ করছে তা শতকরা একশ’ ভাগ ইসলাম বিরোধী।” অথচ তারা আমাদেরকে বলে ঃ “যেহেতু হুকুমত হচ্ছে ইসলামী সেহেতু তার খাতিরে প্রতিবাদ করবেন না।”
কার কথা এটা? তাহলে আম্র্ বিল্ মা’রূফ ওয়া নাহি ‘আনিল্ মুন্কার্ কোথাকার ব্যাপার? আমরা যখন দেখতে পাই যে, ইসলাম নিয়ে খেলা হচ্ছে, তখন কেন আমরা চুপ করে থাকবো? হ্যা, এরা দাবী করে ঃ “আমরা জনগণের চিন্তা-চেতনার অুনসারী।” ধরে নিলাম যে, তাদের এ যুক্তি সঠিক, যদিও আসলে তা নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এই লোকেরা _ এই প্রতিবাদকারীরা কি জনগণ নয়? কী করে চারজন উচ্ছৃঙ্খল যুবক-যুবতী রাস্তার মাঝে এসে একত্রে নাচতে পারে, পরস্পরকে চুম্বন করতে পারে? তখন এই জনগণের কি অধিকার নেই যে, তারা এসে বলবে আমরা এ সবের বিরোধী? একথা বললে নাকি নিরাপত্তার লঙ্ঘন হয়! তাহলে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব কি এই নয় যে, তাঁরা দেশের সংবিধানের হেফাযত করবেন? সংবিধানে কি বলা হয় নি যে, ইসলামের নীতিমালার বিরুদ্ধে ও গণচরিত্রের অবনতি ঘটাবার মতো কিছু লেখার অধিকার সংবাদপত্রের নেই?
বিগত কয়েক বছর যাবত আমাদের সংবাদপত্রে এ কথা লেখা হয় নি যে, যারা দেশের সংবিধানের হেফাযত করবেন বলে শপথ নিয়েছিলেন তাঁরা কথা বলছেন না কেন? এই বাহানায় তাঁরা কথা বলছেন না যে, সংবিধান সংবাদপত্রকে স্বাধীনতা দিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সংবিধান কোথায় নিরঙ্কুশ স্বাধীনতা দিয়েছে? এই সংবিধানেই তো আমাদেরকে এ ব্যাপারে পরিস্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে, ইসলামের নীতিমালার বিরুদ্ধে ও গণচরিত্রের অবনতি ঘটাবার মতো কিছু লেখার অধিকার সংবাদপত্রের নেই। অতএব, এদের শাস্তি হওয়া প্রয়োজন।
সাংস্কৃতিক বিপ্লবের পরিষদের প্রণীত আইনে বলা হয়েছে ঃ “সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের ও সংবাদপত্রের সকল কাজের জন্য ইসলামী নির্দশনা মন্ত্রী দায়িত্বশীল। তাহলে কেন তিনি এসব কাজের প্রতি দৃষ্টি দেন না? হায়! তিনি যদি শুধু দৃষ্টি না দিয়েই ক্ষান্ত থাকতেন! কেন তিনি তাদেরকে সবুজ সঙ্কেত দিচ্ছেন? কেন তিনি তাদেরকে সাহায্য করেন; তাদেরকে সুযোগ-সুবিধা ও উপায়-উপকরণ সরবরাহ করেন যাতে তারা সুস্পষ্টভাবে ইসলামের পবিত্র ব্যক্তিত্ব ও বিষয়াদির বিরুদ্ধে ধৃষ্টতা দেখাতে সাহস পাচ্ছে? কী করে তারা সাইয়েদুশ শুহাদা হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর ব্যক্তিত্বের প্রতি ধৃষ্টতা দেখাতে সাহস পাচ্ছে?
এটা হচ্ছে হুকুমাতে ইসলামী। আমাদের রাহবার, আমাদের নয়নের জ্যোতি (আমাদের প্রাণ তাঁর জন্য উৎসর্গ হোক) হচ্ছেন মুজতাহিদ শাসক _ শুধু এ কারণেই এমনি এমনি সব কিছু সংশোধন হয়ে যাবে না, সব কিছু স্বীকৃতিযোগ্য হবে না। তাই যেখানেই ইসলামের বরখেলাফ কিছু দেখা যাবে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে হবে।
যখনই ঐ গোষ্ঠীটি তাদের চিন্তার বরখেলাফ কিছু দেখতে পায় অমনি সংস্কারবাদীরা সংস্কারের আওয়াজ তোলে। “যখন তাদেরকে বলা হবে যে, তোমরা বিপর্যয় ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করো না, তখন তারা বলবে ঃ অবশ্যই আমরা সংশোধনকারী। সাবধান! মনে রেখো, অবশ্যই এরাই হলো বিপর্যয় ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী।”
কেবল নাম পরিবর্তন করলেই কি বিপর্যয়-বিশৃঙ্খলা সংস্কার ও সংশোধনে পরিণত হয়ে যায়? এই সংশোধন তো তাদের রুচির সাথে খাপ খায় না। কালকে হয়তো চারজন ধর্মহীন মাতাল ফালতু লোক রাস্তায় নেমে আসবে, বিক্ষোভ করবে, কিন্তু কেউ তাদেরকে বাধা দেবে না।
বলা হয় জনগণের দাবী-দাওয়া, যুবকদের দাবী-দাওয়া; তাহলে এই এরা কি যুবক নয়? এই মজলিসগুলোতে যারা অংশগ্রহণ করে তাদের মধ্যে শতকরা আশি ভাগই হচ্ছে যুবক। আমরা সকলে শ্লোগান দেবো যে, আমরা যুবকদেরকে সমর্থন করি। তোমরা এই যুবকদের জন্য কী করছো? এই যুবকরা দ্বীন চায়, তারা হোসাইনকে চায়।
ঐ যারা নিজেদেরকে সংশোধনকারী বা সংস্কারবাদী বলে দাবী করে, দেশের সংবিধানের সমর্থক বলে দাবী করে, পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের সমর্থক বলে দাবী করে, তারা যদি সঠিক কথা বলে থাকে, তাদের মধ্যে যদি সত্যবাদিতা থেকে থাকে, তাহলে তারা দেখুক এই জনগণ কিসের ভিত্তিতে কাজ করতে চায়। তারা কি বলছে না যে, জনগণ যা চায় তার ভিত্তিতে কাজ করবো? এরা কি জনগণ নয়? কেবল চারজন যুবক _ যারা আমেরিকার প্রচার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে _ ভিডিও ফিল্ম যাদের চরিত্র নষ্ট করে দিয়েছে, কেবল তারাই যুবক? কেবল তাদের উদ্দেশেই মৃদু হাস্য করতে হবে? বুদ্ধিমান ও চালাক-চতুরের সার্টিফিকেট দিতে হবে?
আর এই এরা কি যুবক নয়, এরা কি পুরুষ নয়? সংবিধান কি বলে না যে, এদের প্রয়োজন পূরণ করো, এদের দাবী মেনে নাও? সংবিধান কি বলে না যে, পাপাচারকে রুখে দাও? বলে না কি যে, ইসলামী আহকাম ও ইসলামী মূল্যবোধ সমূহের লঙ্ঘন প্রতিরোধ করো? তোমরা যদি তোমাদের দাবীতে সত্যবাদী হয়ে থাকো তাহলে এসব বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দিচ্ছো না কেন? কেন কেবল উল্টো দিকে গড়িয়ে যাচ্ছো? এই যুবকদের কথাও কিছুটা শোনো।
আমি নিজে অবশ্য সেখানে উপস্থিত ছিলাম না, কিন্তু শুনেছি যে, কিছুদিন আগে কোনো কোনো পত্রিকার বক্তব্যের বিরুদ্ধে জনগণ কী প্রতিবাদই না করেছে! তারা বিস্ময়কর ধরনের অবস্থান ধর্মঘট করেছিলো। হযরত আয়াতুল্লাহ্ ওযমা মেশকীনী এলেন, হযরত আয়াতুল্লাহ্ জাওয়াদী এলেন, হযরত আয়াতুল্লাহ নূরী এলেন; তাঁরা জনগণের এ অবস্থান ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন জানালেন। কী করেছেন তাঁরা? মাত্র তো কয়েক মাস আগের ঘটনা। এই মারজা’এ তাক্বলীদগণ কি জনগণের অংশ নন? তাঁদের কথাকে কি গুরুত্ব দেয়া উচিৎ নয়?
পরে ওরা বললো ঃ তোমাদের অবস্থান ধর্মঘট বেআইনী। প্রাদেশিক গভর্নরগণ বললেন ঃ ১৪ই জুলাইর বিক্ষোভ বেআইনী। কিন্তু কোন্ আইনের দৃষ্টিতে বেআইনী ছিলো? দশজন গভর্নর বিক্ষোভের অনুমতি দিতে অস্বীকার করলেন। জনগণ তা মেনে নিলো। জনগণ দ্বীন মানে। তারা যখন অনুভব করে যে, তাদের দ্বীন বিপন্ন তখন তারা এসব কথা শোনে না; আর শোনা উচিৎও নয়। তবে মহান রাহ্বার যদি কোনো কাজের নির্দেশ দেন তো জনগণ তা শিরোধার্য করে নেয়। কারণ, তাঁর আদেশ মান্য করা মা’ছূম ইমামের আদেশ মান্য করার সমতুল্য। তিনি যদি কোনো কাজে নিষেধ করেন তাহলে তা-ও শিরোধার্য। কিন্তু তিনি কখন বলেছেন যে, তোমরা তোমাদের কথা বলো না, প্রতিবাদ করো না, সমালোচনা করো না?
আমাদের জনগণ যদি এই বিরাট সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আইনসঙ্গত সমালোচনা করতো, শান্তিপূর্ণ সমালোচনা করতো, তাহলে অবস্থা এ পর্যায়ে এসে দাঁড়াতো না। কিন্তু ওরা প্রথমে আমাদের ঘুম পাড়িয়ে দেয়, নেশাগ্রস্ত করে দেয়। ওরা বলে, এটা ইসলামী রাষ্ট্র, অতএব, আনুগত্য করো। এ হচ্ছে অপযুক্তি _ ফ্যালাসি। কেবল ইসলামী রাষ্ট্র হবার কারণেই যে কোনো কর্মকর্তার আনুগত্য করা ফরয নয়। যে কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোই হারাম নয়। কাউকে যখন সীমালঙ্ঘন করতে দেখা যায় তখন অবশ্যই প্রতিবাদ করতে হবে, চীৎকার দিতে হবে, বিশ্বকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে, আমরাও জনগণ।
বিদেশী রেডিও-টেলিভিশনগুলো এমনভাবে কথা বলে যে, মনে হয়, এই গুটি কয় উচ্ছৃঙ্খল পাশ্চাত্যপন্থী ও ইসলাম থেকে পলায়নকারী লোক বাদে ইরানে আর কোনো মানুষ নেই। তাই আমাদের দেখিয়ে দিতে হবে যে, আমরাই হলাম জনগণ, আর ওরা হচ্ছে ক্যান্সারের টিউমার। ওরা হচ্ছে রোগগ্রস্ত।
যারা বিপ্লব করেছে, বিপ্লবের বোঝাকে কাঁধে তুলে নিয়েছে তারা হলো এই জনগণ। তারা হোসাইনী পতাকা হাতে নিয়ে বিপ্লব করেছে। তারা ইসলামী আহকাম পুনরুজ্জীবনের জন্য শহীদ উপহার দিয়েছে। অথচ দেখুন, কিছু লোক এখন ইসলামী আহকাম নিয়ে জঘন্যতম খেলা খেলছে।
আপনারা চুপ করে বসে থাকবেন না। কারণ, এ হচ্ছে দ্বীনের প্রশ্ন। এ হচ্ছে আল্লাহ্ সংক্রান্ত প্রশ্ন। আর এটাই হচ্ছে ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর পথ। দেশের সংবিধান আমাদেরকে এটাই বলেছে। মারজা’এ তাক্বলীদগণ আমাদেরকে এটাই বলেছেন।
কোন্ দ্বীন এমন কথা বলেছে? কোন্ গণতন্ত্র এ কথা বলে? তোমাদের ইঞ্জিল তো মানবাধিকার, তোমাদের কোরআন তো সংবিধান; বেশ তো, তাহলে এই গণতন্ত্র অনুযায়ী কাজ করো। এই পাশ্চাত্য গণতন্ত্র অনুযায়ী কাজ করো। প্রকৃত ব্যাপার হলো এই যে, ইরানী জনগণের শতকরা নব্বই ভাগই ইসলামী আহকামের বাস্তবায়ন চায়, অতএব, এটাই গণতন্ত্রের দাবী। তোমরা নিজেদেরকে প্রতারণা করো না। আল্লাহ্র শপথ, এ জনগণ অত্যন্ত ভদ্র; কেবল এ কারণে তারা নিজেরা আইন হাতে তুলে নিচ্ছে না যে, তারা জানে, রাহবার এটা পসন্দ করবেন না।
আমি খোরাসানের এক শহরে বক্তৃতা করলাম। আমার বক্তৃতা শেষ হলে একজন উচ্চশিক্ষিতা মহিলা আমার কাছে এসে কিছু কথা বলতে চাইলেন এবং এজন্য পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। বন্ধুদের অনেকে জানতেন না যে, এ হিজাবী মহিলা কী বলতে চান। তাঁরা বললেন ঃ “আসতে দাও; কী বলেন শুনি।” মহিলা বললেন ঃ “আমি একটা কথা বলতে চাই; আপনি আমার এ কথাটা মহান রাহ্বারকে জানাবেন।” বললাম ঃ “ইনশা আল্লাহ্, যদি সম্ভব হয় তো অবশ্যই বলবো।” মহিলা বললেন ঃ “মহান রাহ্বারকে বলবেন, আল্লাহ্র কসম, কেবল আপনার প্রতি সম্মান দেখানোর খাতিরে না হলে আমরা নারীরা কাফন পরিধান করে বেরিয়ে পড়তাম এবং অমুককে ও অমুককে তাদের নিজেদের জায়গায় বসিয়ে দিতাম। আমরা কেবল আপনার সম্মানার্থে তা করছি না, কারণ, আপনি হয়তো কাজটা পসন্দ করবেন না।”
আমাদের জনগণ রাহ্বারের সম্মানার্থে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখার স্বার্থে সহ্য করে যাচ্ছে। নইলে কেউই সহ্য করতো না যে, এ দেশে ইসলাম মারা যাবে। প্রিয় শ্রোতাদের প্রতি আমার পরামর্শ এই যে, আপনারা আইনসঙ্গত পন্থায় ও যুক্তিসঙ্গতভাবে কর্মকর্তাদের কাছে আপনাদের প্রতিবাদ জানাবেন। আপনারা ফরিয়াদ করে বলবেন যে, আমরা এসব চাই না। এ ধরনের প্রতিবাদ তো আর অপরাধ নয়, বিশৃঙ্খলা নয়, সন্ত্রাস নয়।
আমি আপনার এ আচরণের, আপনার এ নীতির, অথবা অমুক কর্মকর্তাদের বিরোধী, তার আচরণের বিরোধী, কেবল এ কারণেই কি এটা হবে সন্ত্রাস? এ হবে সহিংসতাকামী? যদি এমনই হতো তাহলে আপনারা হযরত আলী (আঃ)-এর আচরণের কীভাবে ব্যাখ্যা দেবেন? স্বয়ং হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর আচরণকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) দশ বছরে ছোটবড় সত্তরটি যুদ্ধ করেছেন। আর হযরত আলী (আঃ) পাঁচ বছরেরও কম সময় রাষ্ট্র পরিচালনা কালে তিনটি বড় বড় যুদ্ধ করছেন যাতে এক লক্ষ মুসলমান নিহত হয়েছিলো। উদাসীনতা ও শিথিলতার নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলে এগুলোকে আপনারা কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
তারা আমাদের যুবকদের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে, তারপর এই কাপুরুষরা, এই বে-দ্বীনরা অমনি লিখে যে, “খোমেইনীকে ইতিহাসের জাদুঘরে পাঠিয়ে দিতে হবে; ইসলাম তো বিদায় নিয়েছে। এ হচ্ছে ইসলামের সমস্যা যে, গণতন্ত্রের সাথে খাপ খাওয়াতে পারে না।”
আপনারা আমাকে ক্ষমা করুন। আজকের রাত ছিলো কারবালার মুছিবতের রাত। আমি দুঃখিত যে, আমি সাইয়েদুশ শুহাদা হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর মর্সিয়া পাঠকারীদের মধ্যে পরিগণিত হতে পারি নি। কিন্তু আল্লাহ্র কাছে আবেদন করছি, তিনি যেন আমাদেরকে সাইয়েদুশ শুহাদার মর্সিয়া পাঠকারীদেরকে যারা ভালোবাসে তাদের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। আপনারা যারা হোসাইনের জন্য শোক প্রকাশ করছেন তিনি আমাদেরকে তাঁদের মধ্যে শামিল করে নিন।
হে আল্লাহ্! এ দেশের ওপর থেকে, এ ইসলামী দেশের ওপর থেকে হোসাইনের ছায়া সরিয়ে নিয়ো না।
হোসাইনী পতাকার ছায়াতলে আমাদের রাহ্বারকে সমস্ত রকমের বিপদাপদ ও অকল্যাণ থেকে রক্ষা করো।
আমাদের পরিণতিকে শুভ পরিণতিতে পরিণত করে দাও।
ইমাম ও শহীদগণের রূহকে কারবালার শহীদগণের সাথে হাশর করো।

Leave A Reply

Your email address will not be published.