পবিত্র আশুরা ও মহররম-৯

0 486

আশুরা উপলক্ষে ওস্তাদ আয়াতু্ল্লাহ মিসবাহ তাকী ইয়াযদীর নবম বক্তব্য

44
(হোসাইনিয়ায়ে শুহাদা ঃ ৩০-০১-৭৯ ফার্সী সাল/ ১৯-০৪-২০০০ খৃস্টাব্দ)

হযরত আবা আব্দিল্লাহ্ আল্-হোসাইন (আঃ) তাঁর মহান পুত্রগণ ও সঙ্গীসাথীদের শাহাদাত উপলক্ষ্যে হযরত ইমাম মাহ্দী (আল্লাহ্ তাঁর আবির্ভাব ত্বরান্বিত করুন), মহান রাহ্বার, মহান মার্জা’এ তাক্বলীদগণ ও হোসাইনী আদর্শের ভক্ত অনুসারীদের সকলের প্রতি শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছি। আশা করি মহান আল্লাহ্ তা’আলা আমাদেরকে এ দুনিয়ায় ও পরকালে ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর খাঁটি অনুসারী হবার তাওফীক দেবেন।
আশূরা ও হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর অভু্যত্থান সম্পর্কে যে সব প্রশ্ন উত্থাপন করা হয় তার মধ্য থেকে একটি প্রশ্ন সম্পর্কে বিগত আলোচনায় আলোকপাত করেছি। তাতে যে বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে গেছে তা হচ্ছে ইমাম হোসাইনের অভু্যত্থানের লক্ষ্য ছিলো উম্মাতের সংশোধনের চেষ্টা করা এবং “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”। তিনি এ কাজের জন্য যে কর্মপন্থা বেছে নিয়েছিলেন এবং যার পরিণতিতে শহীদ হয়েছিলেন তা-ই হচ্ছে ‘ইছ্লাহ্’ বা সংস্কারের মানদণ্ড এবং “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর মানদণ্ড।
যা-ই হোক, প্রশ্ন হচ্ছে, হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) তাঁর এ অভু্যত্থান ও বিপ্লবের পিছনে যে উদ্দশ্য পোষণ করছিলেন তিনি কি সে উদ্দশ্যে উপনীত হতে পেরেছিলেন?
“আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর প্রকৃত তাৎপর্যের সাথে পরিচিত হবার লক্ষ্যে বিগত আলোচনায় আমি এ সংক্রান্ত কয়েকটি আয়াত ও রেওয়াইয়াত উদ্ধৃত করে আল্লাহ্ তা’আলা যতখানি তাওফীক দিয়েছেন তদনুযায়ী তার ওপরে আলোকপাত করেছি। আয়াত ও রেওয়াইয়াতের ভিত্তিতে আমরা “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর যে তাৎপর্য বুঝতে পেরেছি এবার তার ভিত্তিতে কিছুটা বিশ্লেষণাত্মক ও টেকনিক্যাল দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করতে চাই। এর মূল আলোচনাটা অনেকের কাছে হয়তো কিছুটা কঠিন মনে হতে পারে, কিন্তু যেহেতু এ আলোচনার শ্রোতাদের একটি বিরাট অংশ হচ্ছেন ওলামায়ে কেরাম এবং আল্লাহ্র রহমতে ইসলামী বিপ্লবের বরকতে অন্যদেরও জ্ঞানগত স্তর যথেষ্ট উন্নত হয়েছে, ফলে তাঁদের সকলেই বিভিন্ন বিষয়ের ওপর বিভিন্ন স্তরের ‘ইল্মী আলোচনা ও পর্যালোচনা অনুধাবনের জন্য জ্ঞানগত প্রস্তুতির অধিকারী সেহেতু এ আলোচনা কারো জন্য খুব একটা দুর্বোধ্য হবে না বলে মনে করি। তা সত্ত্বেও আমি যতটা সম্ভব সুস্পষ্ট করে এ বিষয়ের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ তুলে ধরার চেষ্টা করবো। যদি কোথাও কোনো পরিভাষা অপরিচিত মনে হয় সে জন্য শুরুতেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

আমরা সকলেই জানি যে, “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” হচ্ছে একটি সর্বজনীন দায়িত্ব যা আমল সংক্রান্ত সকল রিসালাহ্ গ্রন্থেই উলি্লখিত হয়েছে। যারা বিভিন্ন মসলা-মাসায়েল নিয়ে আলোচনা করেন এবং শিক্ষণীয় দ্বীনী মজলিসে এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন তাঁরা যেমন উল্লেখ করেছেন তার ভিত্তিতে সুস্পষ্ট যে, এ বিষয়ের বিভিন্ন শর্ত ও স্তর রয়েছে। এর ভিত্তিতে স্বাভাবিকভাবেই এ প্রশ্ন জাগে যে, হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) যা আঞ্জাম দিলেন তা কী ধরনের “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” ছিলো? আমরা যে ধরনের “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর সাথে পরিচিত তার সাথে তো এটা মিলে না। বলা হয় যে, “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” আঞ্জাম দিতে গেলে যদি ক্ষতি হয়, এমনকি নিশ্চিত না হলেও কেবল ক্ষতি হবে বলে ভয় হয় তাহলেও আর এ দায়িত্ব পালন অপরিহার্য থাকে না। কিন্তু হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) যে “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” আঞ্জাম দেন তাতে ক্ষতি হওয়ার বিষয়টি অকাট্যভাবে নিশ্চিত ছিলো এবং হযরত ইমাম তা পূর্ব থেকেই নিশ্চিতভাবে জানতেন। তা সত্ত্বেও তিনি পদক্ষেপ নেন। এটা কী ধরনের “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”?
এ প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর তাৎপর্য ও তার প্রয়োগ বিভিন্ন রেওয়াইয়াতে যেভাবে এসেছে তার প্রতি গভীর দৃষ্টিপাত করলে আমরা দেখতে পাই যে, “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্” মানে হচ্ছে ভালো কাজ সমূহ সম্পাদনে অন্যদেরকে বাধ্য করা। কাজটি সম্পাদন যদি ফরয হয় তাহলে সে জন্য “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্”ও ফরয হবে। আর কাজটি যদি মুস্তাহাব হয় তাহলে সে জন্য “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্”ও মুস্তাহাব হবে। কিন্তু শরয়ী ফরয হিসেবে “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্” শুধু ফরয কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট। অর্থাৎ “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্” মানে লোকদেরকে তাদের ফরয কাজ সম্পাদনে বাধ্য করা। তবে এক্ষেত্রে ‘বাধ্য করা’রও কয়েকটি স্তর আছে।
আপনি যখন কাউকে কোনো কাজ আঞ্জাম দিতে বাধ্য করতে চান তখন তার কয়েকটি স্তর আছে। এ ব্যাপারে আপনারা সর্বপ্রথম যে বিষয়টির মুখোমুখি হন তা হচ্ছে বাচ্চাদেরকে ফরয আদায়ে বাধ্য করা _ সবে মাত্র যাদের ওপর শরয়ী দায়িত্ব বর্তেছে। এক্ষেত্রে মেয়েদের নয় বছর ও ছেলেদের পনর বছর বয়স পূর্ণ হবার পর। এরা হয়তো এখনো ঠিক মতো নামায পড়া শিখে নি। আপনি “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্” হিসেবে এমন একটি বাচ্চাকে নামায আদায়ে বাধ্য করতে চান। সে ক্ষেত্রে আপনার প্রথম কাজ হচ্ছে নামায পড়া শিক্ষা দেয়া। এ এক ধরনের “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্”। একে বলে “তা’লীমে জাহেল্” অর্থাৎ যে জানে না তাকে শিক্ষা দান। এরপর সে যখন নামায শিখলো তারপর সে হয়তো কখনো নামায আদায়ের ব্যাপারে আলসেমী করতে পারে। অনেক সময় তার নামায ক্বাযা হয়ে যায়। সকালে দেরীতে ঘুম থেকে ওঠে। তখন আপনি তাকে সময় মতো নামায আদায়ের জন্য উৎসাহিত করলেন। এ-ও এক ধরনের “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্”।
এ পর্যন্ত আমরা “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্”-এর দু’টি সুস্পষ্ট মানদণ্ডের সাথে পরিচিত হলাম। একটি হলো এই যে, একজন জানে না; আপনি তাকে শিক্ষা দেবেন। এ ক্ষেত্রে হতে পারে যে, সে মূল হুকুমটি সম্পর্কেই অবগত নয়, বা তার বিষয়বস্তু জানে না, অথবা কীভাবে নামায আদায় করতে হবে তা জানে না। অথবা জানে না যে, নামায আদায় করা ফরয। অবশ্য এখানে যে আমি নামাযের উদাহরণ দিলাম, এ বিষয়ের উদাহরণ হিসেবে নামাযের উদাহরণ পুরোপুরি যথাযথ উদাহরণ নয়। কারণ, নামায যে ফরয তা সকলেরই জানা। কিন্তু কতক ফরয কাজ আছে যে সম্পর্কে সকলে জানে না যে, তা ফরয। এ হলো এক ধরনের “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্”।
কিন্তু মূলগতভাবে তথা “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্” পরিভাষাটির মূল অর্থের দিক থেকে অজ্ঞদেরকে দ্বীনী দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে শিক্ষা দান এর অন্তর্ভুক্ত নয়। তবে পরিভাষাটির তাৎপর্যকে যদি সমপ্রসারিত করা হয় তখন এর মানদণ্ড সমপ্রসারিত হওয়ার কারণে অজ্ঞদেরকে দ্বীনী দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে শিক্ষা দান এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলা যে কারণে “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্” ফরয করেছেন সে মানদণ্ডের আলোকে দেখা যায় যে, যে ব্যক্তি দ্বীনী দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে অবগত নয় “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্”-এর হুকুমের মধ্যে সে-ও শামিল রয়েছে। অতএব, তাকে তা শিক্ষা দেয়া কর্তব্য। কিন্তু স্বয়ং “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্” পরিভাষার মধ্যে এটা শামিল নয়।
অন্যদিকে যে ব্যক্তি জানে যে, নামায আদায় করা ফরয, নামাযের মসলা-মাসয়েলগুলোও ঠিক মতো জানে, সে তার এ শরয়ী দায়িত্ব সম্পর্কে অবগত, নামাযের ছহীহ্ হওয়া ও না হওয়ার শর্তাবলীও অবগত, এমন ব্যািক্তকে বলা হয়, “নামায পড়ো।”
এখানে পরিবেশগত ব্যাপারটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ক্ষেত্র বিশেষে এমন এক পরিবেশ আছে যে, সেখানে নামায একটি বিরাট সামাজিক মূল্যবোধ হিসেবে পরিগণিত হয় এবং সেখানে নামায পরিত্যাগ করাকে বিরাট গুনাহ্ ও মূল্যবোধ বিরোধী আচরণ বলে মনে করা হয়। সে সমাজে কাউকে যখন ‘বেনামাযী’ বলা হয় তখন তা তার জন্য হয় অন্য যে কোনো গালির চেয়ে নিকৃষ্টতর গালি। আমার মনে পড়ছে, যখন ছোট ছিলাম তখন সমাজের লোকদেরকে যে সব গালি দিতে শুনতাম তার মধ্যে একটি ছিলো “তারেকুছ্ ছালাত্” অর্থাৎ ‘নামায ত্যাগকারী’ বা ‘বেনামাযী’। আপনারা বিশ্বাস করুন, তৎকালে সে সমাজে অন্যান্য অপরাধের বা ঘৃণ্য কাজের কথা বলে যে সব গালি দেয়া হতো, এটা তার সবগুলোর চেয়ে নিকৃষ্টতর গালি হিসেবে গণ্য হতো। ক্ষেত্র বিশেষে কোনো সমাজের পরিবেশ এমন যে, কারো সম্পর্কে যদি বলে দেয়া হতো যে, এ ব্যক্তি নামায পড়ে নি, তখন সে লজ্জায় মাথা নীচু করতো। এ কারণে তার চেহারায় বিব্রত ও কাচুমাচু ভাব ফুটে উঠতো। কারণ, সে দেখতে পাচ্ছে, অন্যরা বুঝতে পেরেছে যে, সে নামায পড়েনি। তখন সে এ কারণে এতটাই লজ্জা পেতো। আপনি যদি তার নামায ত্যাগ করার কথা উল্লেখ করেন, তখন সে ওযর পেশ করে, বলে ঃ “দুঃখিত, আমি ভুলে গিয়েছিলাম।” অথবা বলে ঃ “আমার ওযর ছিলো।”
মোদ্দা কথা, এ ধরনের পরিবেশে এ ধরনের ব্যক্তিকে আপনি যদি তার নামায ত্যাগ করার কথা বলেন, তখন তার ওপরে সে কথার প্রভাব হয়। এই উল্লেখই তার জন্য উপদেশ হিসেবে, নছিহত হিসেবে কাজ করে; সে উপদেশ গ্রহণকারী হয়। এ কারণেই সে ওযর পেশ করে।
রেওয়াইয়াতে আছে ঃ _ ক্ষেত্র বিশেষে একজন মু’মিনকে “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” করা হয়, আর সে উপদেশ গ্রহণ করে, নছিহত গ্রহণ করে এবং তা মেনে নেয়। অথবা সে অজ্ঞ _ জানে না; সে ক্ষেত্রে তাকে বললে সে শিখে নেয়।
কিন্তু ক্ষেত্র বিশেষে এমন এক পরিস্থিতির উদ্ভব হয় যে, সমাজের সাংস্কৃতিক পরিবেশ ইসলামী সংস্কৃতির পরিবেশ নয়। আপনি সেখানে যে ফরয কাজের আদেশ দিতে চাচ্ছেন সেখানে তার কোনো মূল্য আছে বলে পরিগণিত হয় না এবং তা পরিত্যাগ করা হলে তাকে মূল্যবোধ বিরোধী বলে মনে করা হয় না। সেখানে পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, আপনি যখন একজনকে বলবেন যে, “কেন অমুক কাজ করছো?” তখন সাথে সাথেই সে ধৃষ্টতার সাথে বলবে, “আমার ইচ্ছা, তাই করছি। তোমার কী? অনধিকার চর্চা করছো কেন? এটা কি কোনো শরিয়ত বিরোধী কাজ?”
ইসলামী বিপ্লব এজন্য হয়েছে যাতে শরীয়তের বিধিবিধান বাস্তবায়িত হয় এবং এজন্যই লক্ষ লক্ষ লোক শহীদ হয়েছেন। কিন্তু এ ধরনের লোকদের কথা হলো, তারা অযথাই জীবন দিয়েছে। বলে, “আমার মন এসব মানতে চায় না।” যদি কিছুটা পীড়াপীড়ি করেন তাহলে প্রকাশ্যেই ইসলামের সমালোচনা করবে। অনেকে এ রকম বলেছে ঃ “আমরা যদি ইসলামের বিধিনিষেধ মানতে না চাই তো কী? এরা ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র, ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ করে আমাদের কান ঝালাপালা করে ফেলছে। কিন্তু আমরা যদি ইসলাম না চাই তো কী হবে?”
সাংস্কৃতিক পরিবেশ এখন এমন হয়ে গেছে যে, প্রকাশ্যে ইসলামের বিরোধিতা করা এখন আর কোনো ঘৃণ্য কাজ হসেবে পরিগণিত হচ্ছে না। তাই তারা প্রকাশ্যেই বিরোধিতা করছে। এখন আর ইসলাম পালন না করার কারণে কেউ লজ্জিত হচ্ছে না। অন্ততঃপক্ষে কিছু সংখ্যক লোক এ কথা বলতে লজ্জা বোধ করে না যে, আমরা ইসলামের বিরোধী। এর চেয়েও গুরুতর ব্যাপার আছে; কখনো কখনো তা উল্লেখ করেছি; আর পুনরাবৃত্তি করতে চাই না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এরূপ ক্ষেত্রে করণীয় কী? হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) যে পরিস্থিতিতে যিন্দেগী যাপন করছিলেন তা ছিলো এ ধরনেরই পরিস্থিতি। তখন ইসলামের অকাট্য বিধিবিধান পরিত্যাগ করা হচ্ছিলো। তখন আল্লাহ্ তা’আলার নির্ধারিত দণ্ডবিধির কার্যকরিতা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিলো। এমন এক ব্যক্তি খেলাফতের জন্য প্রার্থী হয়েছিলো যে ব্যক্তি মদ্যপ ছিলো এবং তা সকলেরই জানা ছিলো। মু’আবিয়াহ্ চাচ্ছিলেন তাঁর পুত্র ইয়াযীদকে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর খলীফাহ্ করবেন। অর্থাৎ তিনি হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর অবর্তমানে এমন এক ব্যক্তিকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করতে চাচ্ছিলেন যে ব্যক্তি মদ পান করতো। তা-ও এমন নয় যে, সে একবার বা দুই বার বা কয়েক বার মদ পান করেছিলো। বরং সে নিয়মিত মদ পানে অভ্যস্ত ছিলো। আর সে তা প্রকাশ্যেই পান করতো; এটা সে গোপনে করতো না।
এ ছাড়া তখন ইসলামের অন্যান্য আহকামও একের পর এক বিতর্কিত, অস্বীকৃত ও প্রকাশ্যেই প্রত্যাখ্যাত হচ্ছিলো। তখন মুসলমানদের রক্তপাত খুবই সহজ ব্যাপারে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো। কেউ সরকারের বিরোধী হলেই খুব সহজেই তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হতো এবং হত্যা করা হতো। আর তখন সমাজে বেশীর ভাগ পাপাচার-অনাচারই সংঘটিত হতো।
এহেন পরিস্থিতিতে হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) যদি জনগণের মাঝে দাঁড়িয়ে বলতেন, “হে জনগণ! তোমরা খুম্স্ প্রদান করো, যাকাত দাও, আল্লাহ্ তা’আলার নির্ধারিত সীমারেখা মেনে চলো, মদপান করো না”, তাহলে যে ব্যক্তি মদপানের জন্য সর্বজনপরিচিত ছিলো তার ওপরে এর কী প্রভাব বর্তাতো? এতে কী লাভ হতো?
জনগণ স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে ইয়াযীদকে মদ্যপ জানা সত্ত্বেও তার অনূকুলে বাই’আত হয়েছিলো। সে শুধু মদ্যপই ছিলো না, বরং সে আরো অনেক কিছুতে অভ্যস্ত ছিলো। সে এমন সব কাজে অভ্যস্ত ছিলো যা আজকের দিনে আমাদের ইসলামী সমাজেও ফ্যাশনে পরিণত হচ্ছে। সে বানর নিয়ে খেলা করতো, কুকুর নিয়ে খেলা করতো। সে ছিলো এ ধরনের লোক। আর এ ব্যক্তিই রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর জায়গায় বসতে চাচ্ছিলো, যাতে তার হুকুম সমূহ রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর হুকুমের মতোই অবশ্য পালনীয় হয়ে যায়; খোদায়ী আহকাম বলে পরিগণিত হয়। এ কারণেই ইমাম হোসাইন (আঃ) বলেন ঃ “তোমরা যদি ইয়াযীদের মতো হও, হে মুসলমানরা, তাহলে ইসলামকে বিদায়।” কারণ, জনগণ যদি ইয়াযীদের মতো এসব কাজে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে তাহলে ইসলামের কাফন-দাফন করা ছাড়া গত্যন্তর থাকতে পারে না। কারণ, তাহলে এরপর আর ইসলাম বলতে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।
অবশ্য মু’আবিয়ার শাসনামলের শেষ দিক পর্যন্ত এসে সীমিত সংখ্যক বাহ্যিক বিষয় ছাড়া ইসলামের আর কিছুই অবশিষ্ট ছিলো না। তবে তা সত্ত্বেও পরিস্থিতি এমন ছিলো না যে, কেউ সহজেই প্রকাশ্যে পাপাচারে লিপ্ত হবে এবং জনগণ তা চুপ করে দেখে যাবে। কিন্তু যে ব্যক্তি নিজেই মদ্যপ সে ব্যক্তিই যদি মুসলমানদের খলীফাহ্ হয়ে বসে, তখন সে কি মদ্যপ লোকদের বিরুদ্ধে খোদায়ী শাস্তি বিধান কার্যকর করবে? তাকে বেত্রাঘাত করবে?
প্রশ্ন হচ্ছে এহেন পরিস্থিতিতে যিনি “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর দায়িত্ব পালন করবেন তাঁকে কী করতে হবে? হয় তাঁকে বলতে হবে যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” বন্ধ রাখতে হবে; আসলে এ অবস্থায় এ ধরনের কোনো দায়িত্বই নেই।
কিন্তু আল্লাহ্ তা’আলা বলছেন যে, সমাজে যখন কোনো হারাম কাজ সংঘটিত হয় তখন সকল জনগণই এ জন্য দায়ী। কারণ, “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” হচ্ছে একটি ফরযে কেফায়ী। যদি দশজন লোক দেখে যে, একটি পাপ কাজ সংঘটিত হচ্ছে, তখন ঐ দশজন লোকের সকলের ওপরই “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর দায়িত্ব বর্তাবে। এদের মধ্য থেকে একজন যদি “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” আঞ্জাম দেয় তাহলে তাদের দায়িত্ব পালন হয়ে যাবে। কিন্তু কেউই যদি তা আঞ্জাম না দেয় তাহলে দশজনের প্রত্যেকেই দায়ী থাকবে।
এর মানে হচ্ছে এই যে, এটা যদি নিশ্চিত ও অকাট্য ব্যাপার হয়ে থাকে যে, সমাজে প্রকাশ্যে একটি গুনাহ্ সংঘটিত হচ্ছে, তাহলে যারাই তা জানলো তাদের সকলের ওপরই “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর দায়িত্ব বর্তাবে। অবশ্য গোপনে কিছু ঘটলে _ যার সংঘটিত হওয়ার বিষয়টি অকাট্য নয়, সে ক্ষেত্রে এ দায়িত্ব নেই। কিন্তু প্রকাশ্যে কোনো কবিরাহ্ গুনাহ্ সংঘটিত হলে এবং যারা তা জানলো তাদের মধ্যে কেউই “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর দায়িত্ব পালন না করলে তাদের সকলেই জাহান্নামে যাবে।
এ ব্যাপারে আমি বিগত আলোচনায় হযরত শোয়াইব (আঃ)-এর কওমের শাস্তি সংক্রান্ত একটি রেওয়াইয়াত উদ্ধৃত করেছিলাম যাতে বলা হয়েছিলো যে, তাঁর কওমের চলি্লশ হাজার লোকের পাপাচারের কারণে এক লক্ষ লোককে আযাব দেয়া হয়েছিলো, যাদের মধ্যে ষাট হাজার লোক কেবল “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর দায়িত্ব পালন না করার অপরাধে শাস্তির সম্মুখীন হয়। এ ধরনের ঘটনা আরো বিভিন্ন কওমের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। আছহাবে সাব্তের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছিলো।
আপনারা শুনেছেন যে, আছহাবে সাব্ত্ বা শনিবারের জনগোষ্ঠী নামে পরিচিত লোকেরা ছিলো বনী ইসরাঈলেরই একটি শাখা গোত্র। তারা প্রথমে হযরত ইয়াকুব (আঃ)-এর শরীয়ত ও পরে হযরত মূসা (আঃ)-এর শরীয়তের অনুসরণ করতো। তাদের জন্য শনিবার শিকার করা হারাম করা হয়েছিলো। অবশ্য এটা পালন করে চলা বেশ কঠিন ব্যাপারই ছিলো। এখনো ইয়াহূদী ধর্মের নিষ্ঠাবান অনুসারীরা শনিবার দিন রান্নাবান্না করে না, উনুন জ্বালায় না, প্রাণী জবাই করে না, শিকার করে না। অর্থোডঙ্ ইয়াহূদীরা এখনো এ হুকুম মেনে চলে। ইরানের ইয়ায্দে আমাদের কতক ইয়াহূদী প্রতিবেশী ছিলো। আমরা দেখেছি, শনিবার দিনগুলোতে অনেক সময় মুসলান প্রতিবেশীরা তাদের জন্য খাবার নিয়ে যেতো। তারা নিজেরা খাবার রান্না করতো না। কারণ, তাদের জন্য শনিবার চুলা জ্বালানো নিষিদ্ধ ছিলো।
ইয়াহূদীদের জন্য কতগুলো কঠোর বিধান দেয়া হয়েছিলো, তার মধ্যে অন্যতম ছিলো এই যে, তারা যেন শনিবার দিন শিকার না করে; শনিবার শিকার করা তাদের জন্য হারাম করা হয়েছিলো। আসলে আল্লাহ্ তা’আলা এ বিধানের দ্বারা তাদেরকে পরীক্ষা করতে চাচ্ছিলেন। বস্তুতঃ আল্লাহ্ তা’আলার কাজ অতীব বিস্ময়কর। “আর যখন শনিবার দিন মাছেরা পানির ওপর এসে ভাসতে লাগলো।”
ইয়াহূদীদের এ জনগোষ্ঠীটি সমুদ্রের উপকূলে জীবন যাপন করতো; সমুদ্রের তীরে বা নদীর তীরে। শনিবার হলেই মাছেরা উপকূলে চলে আসতো। তখন তাদেরকে শিকার করা খুবই সহজ হতো। রবিবার দিন শিকার করা বেশ কঠিন হতো, অথচ শনিবার শিকার করা ছিলো হারাম। শেষ পর্যন্ত তারা ধৈর্য ধারণ করতে পারলো না। তারা একটা কৌশলের আশ্রয় নিলো। তারা উপকূলের কাছে কতগুলো পানির হাউয খনন করলো। তারা শনিবার দিন এর মুখ খুলে দিতো; নদীর পানির সাথে সাথে এর মধ্যে মাছ চলে আসতো, তখন তারা হাউযের মুখ বন্ধ করে দিতো। তারপর রবিবার তারা হাউযে আটকে পড়া মাছগুলোকে শিকার করতো। আল্লাহ্ তা’আলা তাদের এ কাজের কারণে তাদের চেহারা ও শরীর পরিবর্তন করে দিলেন। বস্তুতঃ কোরআন মজীদের আয়াতে যদি এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট উক্তি না থাকতো তাহলে কেবল হাদীছ ও রেওয়াইয়াতে এ কথা থাকলে মানুষের পক্ষে এত সহজে বিশ্বাস করা কঠিন হতো। আল্লাহ্ তা’আলা বলেন ঃ “অতঃপর তাদেরকে বললাম, তোমরা লাঞ্ছিত বানর হয়ে যাও।”
আল্লাহ্ তা’আলা এদেরকে বানরে পরিণত করে দেন। সকালে যখন তারা ঘুম থেকে উঠলো দেখলো যে, তারা বানরে পরিণত হয়ে গেছে। এদের মধ্যে সকলেই শনিবার আটকে রেখে পরদিন মাছ শিকার করে নি। এদের মধ্যেও সেই চলি্লশ হাজার ও ষাট হাজারের অনুপাতে, সঠিকভাবে মনে করতে পারছি না, হয়তো এক তৃতীয়াংশ ও দুই তৃতীয়াংশ অনুপাতে, যারা শিকার করে নি তারাও এ আযাবের শিকার হয়েছিলো এবং তাদের চেহারা ও শরীর পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিলো।
আছহাবে সাব্ত্-এর লোকেরা তিন ভাগে বিভক্ত ছিলো। একদল শনিবার মাছ আটকে রেখে পরদিন শিকার করতো। আরেক দল নিজেরা শিকার করতো না, কিন্তু যারা শিকার করতো তাদেরকে কিছু বলতো না; তাদের কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতো না। আর তৃতীয় দলটি নিজেরা তো শিকার করতোই না, অধিকন্তু যারা শিকার করতো তাদেরকে নিষেধ করতো, বলতো ঃ “কেন তোমরা এ কাজ করছো? এ কাজ করো না। এ কাজ গুনাহ্।”
তাদের মধ্যকার মাঝখানের যে দলটি শিকারও করতো না, শিকারকারীদের নিষেধও করতো না, তারা শেষের দলটিকে অর্থাৎ যারা “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর দায়িত্ব পালন করতো তাদেরকে বলতো ঃ “তোমরা যে এদেরকে বলছো, ‘শিকার করো না’, এতে ফায়দাটা কী? বুঝতে পারছো কী বলছি?” অর্থাৎ তাদের কথা ছিলো এই যে, যেহেতু “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” আঞ্জাম দেয়ায় কোনো লাভ হচ্ছে না সেহেতু তা আঞ্জাম দেবো না। ফায়দা না থাকা সত্ত্বেও যাদেরকে তারা “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর দায়িত্ব পালন করতে দেখতো তাদেরকে বলতো ঃ “এই যে তোমরা ওদের সাথে কথা বলছো, বিতর্ক করছো, এতে লাভ কী? ওদেরকে ওদের পথে ছেড়ে দাও।” “তাদের মধ্য থেকে একটি দল বললো ঃ কেন তোমরা তাদেরকে নছিহত করছো আল্লাহ্ যাদেরকে ধ্বংস করে দেবেন অথবা তাদেরকে কঠিন শাস্তি প্রদান করবেন?”
তাদের কথা ছিলো এই যে, আল্লাহ্ই এদেরকে ধ্বংস করুন। এদেরকে নছিহত করায় কী ফায়দা? “তারা (জবাবে) বললো ঃ তোমাদের রবের কাছে জবাবদিহিতার জন্য এবং (এ আশায় যে,) হয়তো তারা আল্লাহ্কে ভয় করবে।”
শেষোক্ত দলটি বললো, আমরা দু’টি কারণে তাদেরকে নছিহত করছি। প্রথমতঃ নছিহত করা দায়িত্ব বিধায় আমরা যেন আল্লাহ্ তা’আলার নিকট বলতে পারি যে, আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করেছি। দ্বিতীয়তঃ আমরা তো নিশ্চিত করে বলতে পারি না যে, তাদের কারো ওপরই নছিহতের প্রভাব বর্তাবে না। এমনও তো হতে পারে যে, তাদের মধ্যকার কিছু লোকের ওপর এর প্রভাব পড়বে এবং তারা এ গুনাহ্র কাজ থেকে ফিরে আসবে।
মোদ্দা কথা, এরা তিন দলে বিভক্ত ছিলো এবং এদের মধ্যে যারা “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর কাজ আঞ্জাম দেয়, যদিও তার তেমন কোনো প্রভাব হয় নি, তথাপি তারা রক্ষা পেয়ে যায়। অপর দুই দল আযাবের শিকার হয়; তারা বানরে পরিণত হয়ে যায়।
আল্লাহ্ তা’আলা এ সামাজিক দায়িত্বের ওপর অনেক গুরুত্ব আরোপ করেছেন। বিগত আলোচনায় আমি এ সংক্রান্ত কয়েকটি রেওয়াইয়াত উদ্ধৃত করেছি।
এ এক বিস্ময়কর ফরয! “এক বিরাট ফরয যার ওপর অন্য সকল ফরয দাঁড়িয়ে আছে।” অথবা ” পরিপূর্ণতম এবং শ্রেষ্ঠতম ও সর্বাধিক উত্তম ফরয কাজ।”
মোদ্দা কথা, প্রশ্ন হচ্ছে, যাদের বেলায় “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়া হলে তার কোনোই প্রভাব হবার সম্ভাবনা থাকে না তাদের বেলায় এ দায়িত্ব পালন অপরিহার্য থাকে কিনা? সবচেয়ে খারাপ অবস্থা দাঁড়ায় তখন যখন নছিহত কবুল তো করেই না, অধিকন্তু উল্টো ঘুরে দাঁড়ায় এবং “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর দায়িত্ব পালনকারী ব্যক্তির বিরুদ্ধে শত্রুতাূলক আচরণ শুরু করে; তাঁকে জ্বালাতন করে, প্রহার করে, হত্যা করে। “লোকদের মধ্য থেকে যারা ন্যায়ের আদেশ প্রদান করে তাদেরকে এরা হত্যা করে।”
শুনেছি, এ যুগে ক্বাফ্ক্বায্ বা ককেসাস পর্বতের ওপাশে একটি জায়গা আছে যেখানে এমন লোকজন আছে যারা “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর দায়িত্ব পালনকারীদেরকে প্রহার করে ও হত্যা করে।
হ্যা, প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের লোকদের বেলায় কী করতে হবে?
আপনাদের যদি স্মরণ থেকে থাকে, বিগত আলোচনায় যে দীর্ঘ রেওয়াইয়াত উদ্ধৃত করেছি তার শেষের দিকে এ বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত ইমাম বাকের (আঃ) এ রেওয়াইয়াতের শেষ দিকে বলেন যে, পরিস্থিতি এ পর্যায়ে উপনীত হলে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করা অপরিহার্য “যতক্ষণ না তারা আল্লাহ্র আদেশের আনুগত্য করে।”
এসব কথা কেন বললাম? এ জন্য বললাম যে, একদিকে “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর আওতা এতই ব্যাপক বিস্তৃতির অধিকারী হয় যে, অজ্ঞদেরকে দ্বীনী দায়িত্ব-কর্তব্য শিক্ষাদানও তার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। আপনারা যখন আপনাদের বাচ্চাদেরকে নামায শিক্ষা দিতে চান তখন তা-ও “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর অন্তর্ভুক্ত। কারণ, তা তো অজ্ঞদেরকে দ্বীনী দায়িত্ব-কর্তব্য শিক্ষাদান। তবে পারিভাষিক অর্থে তাকে “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” বলে গণ্য করা হয় না। কিন্তু রেওয়াইয়াতে আছে যে, এ-ও এক ধরনের “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”।
ওয়ায-নছিহত করা, উপদেশ দেয়া, নম্র ভাষায় বুঝানো _ এসব কাজও “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। প্রচলিত ধারণায়ও তা আছে, রেওয়াইয়াতেও আছে। বিভিন্ন আয়াত থেকেও তার সমর্থন মেলে। কিন্তু অনেক ফকীহ্র মতে, “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” হচ্ছে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করা। অর্থাৎ কেবল “এ কাজ করো না” বলে নিষেধ করা বা অনুরোধ জানানো “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” বলে গণ্য হবে না, বরং এর মানদণ্ড এমনই ব্যাপক বিস্তৃত যে, জিহাদই হয়ে দাঁড়ায় “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”।
এ ব্যাপারে ওলামায়ে কেরাম বিষয়টির প্রতি আরো গভীর ও সূক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করুন। আমাদের হাদীছ গ্রন্থাবলীতে, অতীতে আমাদের অনেক গ্রন্থেই “কিতাবুল্ আম্র্ বিল্ মা’রূফ্” নামে কোনো বিভাগ ছিলো না, বরং “কিতাবুল জিহাদ” ছিলো, আর এই “কিতাবুল জিহাদ”-এর শেষে “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” নামে একটি বাব্ বা অধ্যায় থাকতো। যে সব গ্রন্থে এ ধরনের বিন্যাস ছিলো তার মধ্যে “তাহ্যীব্” অন্যতম _ যা থেকে আমরা রেওয়াইয়াত উদ্ধৃত করেছি। কিন্তু “তাহ্যীব্” গ্রন্থে “কিতাবুল্ আম্র্ বিল্ মা’রূফ্” নামে কোনো বিভাগ নেই, “কিতাবুল জিহাদ” আছে, আর তার সর্বশেষ বাব্ হচ্ছে “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”।
অর্থাৎ “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর দুই ধরনের ব্যবহারিক তাৎপর্য আছে। একটি হচ্ছে বিশেষ পারিভাষিক তাৎপর্য, আর তা হচ্ছে বিভিন্ন রিসালাহ্ গ্রন্থে অর্থাৎ ব্যবহারিক মসলা-মাসায়েলের গ্রন্থে যা উলি্লখিত থাকে। এ পরিভাষায় জিহাদ অন্তর্ভুক্ত নয়। কারণ, এমন কোনো জিহাদের কথা চিন্তা করা যায় না যাতে ক্ষতির আশঙ্কা নেই। লোকেরা যখন তলোয়ার কোষমুক্ত করে এবং “অতঃপর তারা হত্যা করে বা নিহত হয়” , তখন এ কথার কোনো মানেই হয় না যে, বলবে ঃ জিহাদ কেবল তখনি ফরয যখন তাতে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা না থাকে। যুদ্ধের ময়দানে তো আর হালুয়া-রুটি বণ্টন করা হয় না। প্রকৃত পক্ষে জিহাদ হচ্ছে এমন কাজ যেখানে ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। বরং ক্ষেত্র বিশেষে জিহাদে ক্ষতির নিশ্চিত আশঙ্কা থাকে।
অতএব, এক ধরনের “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর মানদণ্ড যেখানে জিহাদ, সেখানে এর ক্ষেত্র এমন যে, ক্ষতির কেবল সম্ভাবনাই থাকে না, বরং নিশ্চিত সম্ভাবনা থাকে। বরং এ সম্ভাবনা ইয়াক্বীনী অর্থাৎ অকাট্য জ্ঞানের পর্যায়ভুক্ত হতে পারে। এ ক্ষেত্রে নিহত হওয়ার ব্যাপারে ইয়াক্বীন থাকতে পারে। আর এর মানদণ্ড বা দৃষ্টান্তও রয়েছে, যদিও একে “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” বলা হবে কিনা এ ব্যাপারে মতপার্থক্য রয়েছে। অজ্ঞদেরকে দ্বীনী দায়িত্ব-কর্তব্যের জ্ঞানদানও “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্”, নাকি তা অন্য কোনো অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত সে বিষয়েও মতপার্থক্য আছে। আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন, মু’মিনদের মধ্যে কমপক্ষে একটি গোষ্ঠী এমন থাকতে হবে যারা “যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে ও ভালো কাজের আদেশ দেবে।”
অনেক ফকীহ্র মতে, “কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে” বলতে অজ্ঞদেরকে দ্বীনী দায়িত্ব-কর্তব্যের জ্ঞানদানও অন্তর্ভুক্ত। কারণ, আসলে “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” কেবল এমন লোকের বেলায় প্রযোজ্য যে তার দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে অবগত আছে। যে জানে না তার বেলায় “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” নয়।
এগুলো হচ্ছে শাব্দিক বিতর্ক। এর উপসংহার কী দাঁড়ালো? “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্” হচ্ছে একটি পরিভাষা। এ পরিভাষা হচ্ছে তা-ই যা সাধারণভাবে প্রচলিত আছে এবং আমরা যার সাথে পরিচিত। এটা হচ্ছে উন্নত স্তরের কাজসমূহের অন্যতম। এটা এমন এক সমাজের ব্যাপার যেখানে ইসলামী মূল্যবোধ সমূহ প্রতিষ্ঠিত আছে, যেখানে শক্তিশালী ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠিত আছে _ যার সব কিছুর ওপর নিয়ন্ত্রণ আছে। এটা এমন এক সমাজের কথা যেখানে যদি বলা হয় যে, “তুমি অমুক নোংরা কাজটি করেছো” তখন ব্যক্তি লজ্জিত হয়, তার মাথা নীচু করে এবং ক্ষমা চায় বা ওযর পেশ করে, বা তা অস্বীকার করে বলে, “আপনি ভুল করছেন, আমি এ কাজ করি নি”।
এ ধরনের একটি ইসলামী সমাজে এহেন পরিস্থিতিতে “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” হচ্ছে সেই সাধারণ ও বহুল প্রচলিত সংজ্ঞার “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”। এর শর্তাবলীও প্রচলিত ধারণার শর্তাবলী। কিন্তু “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর বিভিন্ন পর্যায়ের মধ্যে একটি পর্যায় আছে যা এ রকম নয়। আমি আমার ইতিপূর্বেকার কোনো কোনো আলোচনায় উল্লেখ করেছি যে, অন্ততঃ আমাদের যুগে হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) ছিলেন এমন এক ব্যক্তি যিনি সুস্পষ্ট ভাষায় আমাদেরকে বলেছেন যে, “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর কোনো কোনো মানদণ্ড এমন যে, সে ব্যাপারে তাকিয়াহ্ নীতির অনুসরণের অবকাশ নেই, তাতে যা হবার তা-ই হোক। যে পরিণতিই আসুক না কেন, “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর দায়িত্ব পালন করা অপরিহার্য, এনকি তাতে যদি লক্ষ লক্ষ লোককে প্রাণ দিতে হয় তবুও। এ ধরনের বিষয়ও রয়েছে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”কে যদি সাধারণ অর্থে গ্রহণ করি তাহলে একদিকে তাতে অজ্ঞদেরকে দ্বীনী দায়িত্ব-কর্তব্য শিক্ষাদানও অন্তর্ভুক্ত হয়, অন্যদিকে তার চূড়ান্ত পর্যায় হয়ে দাঁড়ায় জিহাদ। কারণ, জিহাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে “যাতে আল্লাহ্র কালেমাহ্ সমুন্নত ও প্রাধান্যের অধিকারী হয়।”
অর্থাৎ “মা’রূফ্”-এর প্রতিষ্ঠা বা “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্”-এর এই দুইটি তাৎপর্য রয়েছে। সাইয়েদুশ শুহাদা হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) যখন বলেন ঃ “আমি এজন্য বহির্গত হয়েছি যে, আমি ভালো কাজের আদেশ দিতে এবং মন্দ ও পাপ কর্ম প্রতিহত করতে চাই।” তখন তিনি আমার ও আপনার মাথায় “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর যে বিশেষ ও সীমিত তাৎপর্য রয়েছে তা বুঝাতে চান নি। আমরা যে ধারণা পোষণ করি তাতে এ দায়িত্ব পালনের অন্যতম শর্ত হচ্ছে এতে যেন কোনোরূপ ক্ষতির আশঙ্কা না থাকে। ইমাম হোসাইন (আঃ) এ বিশেষ তাৎপর্য বুঝাতে চান নি, বরং এর সাধারণ তাৎপর্যকে বুঝাতে চেয়েছেন। কারণ, তিনি কোথাও কোথাও এ কথার পর পরই বলেন ঃ _ “আর আল্লাহ্র পথে জিহাদের জন্য যাতে অতঃপর আল্লাহ্র কালেমাহ্ সমুন্নত ও প্রাধান্যের অধিকারী হয়।”
অতএব, “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর দু’টি পারিভাষিক তাৎপর্য আছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে বিশেষ পরিভাষা যা ব্যবহারিক মসলা-মাসায়েল সংক্রান্ত রিসালাহ্ গ্রন্থাবলীতে উলি্লখিত দেখা যায়। যারা মসলা-মাসায়েল বর্ণনা করেন তাঁরা বলেন, এটা হচ্ছে এই এই ধরনের স্বাভাবিক অবস্থার আহকাম। কিন্তু কোনো কোনো সময় ব্যতিক্রমী পরিস্থিতির উদ্ভব হয় এবং পরিস্থিতি চূড়ান্ত পর্যায়ে বা শেষ সীমায় উপনীত হয়ে যায়। হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ)-এর মতে, অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদির ক্ষেত্রে “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর দায়িত্ব পালনের জন্য ঐসব শর্ত কার্যকর নয়।
অতএব, যদি প্রশ্ন করা হয় যে, এটা কী ধরনের “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” ছিলো হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) যা আঞ্জাম দিলেন এবং তা আঞ্জাম দিতে গিয়ে নিহত হলেন? এ প্রশ্ন বিশেষ করে তাদের মনে জাগ্রত হয় যারা বিশ্বাস করে যে, হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) তাঁর নিহত হওয়ার বিষয়টি পূর্ব থেকেই জানতেন; অবশ্য আমরাও এ ব্যাপারে নিশ্চিত প্রত্যয় পোষণ করি যে, তিনি তাঁর নিহত হওয়ার বিষয়টি পূর্ব থেকেই জানতেন। আমরা এখানে এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে চাচ্ছি না যে, তিনি তাঁর নিহত হওয়ার ব্যাপারে আগাম তথ্য জানতেন কিনা, তবে আমাদের অকাট্য প্রত্যয় এই যে, তিনি জানতেন তিনি নিহত হবেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যারা নিশ্চিতভাবে জানতেন না, কিন্তু অন্ততঃ মনে করতেন যে, ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর নিহত হবার সম্ভাবনা আছে, এ কারণে তাঁকে উপদেশ দেন যে, আপনি ইরাকে যাবেন না; আপনি তো দেখেছেন তারা আপনার পিতার সাথে কী আচরণ করেছে। আপনি গেলে আপনার পিতা ও ভ্রাতার ন্যায় নিহত হবেন। তাঁর চাচাতো ভাইয়েরা ও আরো কেউ কেউ তাঁকে এ মর্মে উপদেশ দেন। তিনিও বলেন, “ভাইয়েরা, তোমরা আমার কল্যাণ কামনা করে আমাকে যে পরার্শ দিয়েছো সেজন্য আল্লাহ্ তোমাদের কল্যাণ করুন। কিন্তু আমার একটি দায়িত্ব আছে যা আমাকে পালন করতে হবে।”
হ্যা, তাঁরা আশঙ্কা পোষণ করছিলেন, তাঁদের ধারণা অনুযায়ী স্বয়ং হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) হয়তো নিহত হবার আশঙ্কা পোষণ করতেন না, কিন্তু অন্ততঃ ক্ষতি হবার ভয় তো ছিলো। তিনি যদি ক্ষতির ব্যাপারে এবং তাঁর নিহত হবার ব্যাপারে পূর্বাহ্নিক জ্ঞানের অধিকারী না-ও হয়ে থাকেন, যদিও তিনি সে জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন, তথাপি এ প্রশ্ন জাগে যে, এটা কী ধরনের “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” ছিলো?
এ প্রশ্নের জবাব হচ্ছে এই যে, এ “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” হচ্ছে পরিভাষাটির অধিকতর সাধারণ তথা ব্যাপকতর তাৎপর্য ভিত্তিক। আর তা আজকের দিনে আমরা এ পরিভাষাটি থেকে যে তাৎপর্য গ্রহণ করে থাকি তা থেকে স্বতন্ত্র।
জিহাদের ক্ষেত্রেও এর দৃষ্টান্ত রয়েছে। বর্তমানে আপনি ও আমি “জিহাদ” শব্দটি শুনলে তা থেকে কী তাৎপর্য গ্রহণ করি? যারা মসলা-মাসায়েল বর্ণনা করেন এবং ফিকাহ্ শাস্ত্রের কিতাবাদি অধ্যয়ন করেছেন তাঁরা বলেন, জিহাদ তিন ধরনের। একটি হচ্ছে এই যে, প্রথমে ইমামের আদেশ সমূহ কার্যকর হতে হবে। হেদায়াতের পথ থেকে, আল্লাহ্র ওলীর সামনে থেকে বাধা সমূহ অপসারণের লক্ষ্যে এবং হুকুমাতে ইসলামী যাতে সমগ্র জাহানে বিস্তার লাভ করে সে লক্ষ্যে সত্যকে সুস্পষ্ট ভাষায় তুলে ধরতে হবে; লোকদেরকে বাধ্য করা হবে না, জোর করে কাউকে মুসলমান বানানো হবে না। হেদায়াতের পথকে উন্মুক্ত করতে হবে। “অতএব, তোমরা কাফের নেতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো।”
এ হচ্ছে প্রাথমিক পর্যায়ের জিহাদ। আরেক ধরনের জিহাদ হচ্ছে মুসলমানদের ওপর হামলা হলে তাদের প্রতিরক্ষার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ। আরেক ধরনের জিহাদ হচ্ছে এই যে, দুই দল মুসলমানের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে গেছে এবং দৃশ্যতঃ দুই পক্ষই মুসলমান। এখানে আপনারা মযলুম পক্ষকে সাহায্য করবেন, এ ছাড়া গত্যন্তর নেই। এ হচ্ছে বিদ্রোহী পক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। অথবা ইসলামী শাসক বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আদেশ দেবেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই একটি গোষ্ঠী বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে।
হ্যা, এই হলো তিন ধরনের জিহাদ যে সম্পর্কে সকলেই অবগত। প্রশ্ন হচ্ছে, আবা আবদিল্লাহ্ হোসাইন (আঃ) যখন বলেন, আমি অভু্যত্থান করেছি, আমি এখন আমার দায়িত্ব পালন করতে যাবো, জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ্ আঞ্জাম দেবো “যাতে এখানে _ ধরনীর বুকে _ আল্লাহ্র কালেমাহ্ সমুন্নত ও বিজয়ী হয়” তখন এটা কী ধরনের জিহাদ ছিলো যা তিনি কারবালায় আঞ্জাম দিলেন? এ তো কাফেরদের বিরুদ্ধে প্রাথমিক পর্যায়ের জিহাদ ছিলো না। এটা প্রতিরক্ষা যুদ্ধও ছিলো না। কারণ, প্রতিরক্ষা যুদ্ধ যে করা হয় তা-ও কাফেরদের বিরু্েদ্ধই _ যে কাফেররা মুসলমানদের ওপর হামলা চালিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। এখানে ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষা ও এ জাতীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা থেকে বিরত থাকলাম, কারণ সেগুলোকে “জিহাদ” নামে অভিহিত করা হয় না। এটা কিতালে আহ্ল্ও ছিলো না। কিতালে আহ্ল্ মানে বিদ্রোহী ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে ইসলামী শাসকের যুদ্ধ, যেমন জঙ্গে জামাল।
কিন্তু এটা কী ধরনের জিহাদ যে, এক ব্যক্তি তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের সহ এসে এক জায়গায় অবস্থান করেন _ স্ত্রী ও সন্তানদের হাত ধরে এমন এক জায়গায় এসে অবস্থান নেন যাতে তাঁর দুগ্ধপোষ্য শিশুকেও হত্যা করা হয়; এটা কী ধরনের জিহাদ?
এরও জবাব এই যে, জিহাদেরও বিভিন্ন পারিভাষিক তাৎপর্য রয়েছে। একদিকে ক্ষেত্র বিশেষে জিহাদের তাৎপর্য এমন ব্যাপক ও বিস্তৃত হয়ে দাঁড়ায় যে, এতে ধনসম্পদও শামিল হয়ে যায়। ইসলামের প্রচার, প্রসার ও প্রচলনের জন্য এবং কাফেরদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য, দুশমনদের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রতিরোধ করার জন্য অর্থ ব্যয় করা _ এ-ও জিহাদ। আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন ঃ “তোমরা জিহাদ করো তোমাদের ধনসম্পদও প্রাণের দ্বারা।”
অতএব, ধনসম্পদের দ্বারা জিহাদও এক ধরনের জিহাদ, তবে তা পরিভাষাটির সমপ্রসারিত অর্থে। অবশ্য “জিহাদ” শব্দের আভিধানিক তাৎপর্যে এর সব কিছুই শামিল হয়। কারণ, “জিহাদ” শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে চেষ্টা-সাধনা করা। এখন আমাদের এর তাৎপর্যের প্রতি গভীরভাবে দৃষ্টি নিক্ষেপ করা উচিৎ। যেহেতু আরবী ব্যাকরণ অনুযায়ী ্#১৫৮০;্#১৫৭৫;্#১৬০৭;্#১৫৮৩;্#১৬০৮;্#১৫৭৫; ক্রিয়াপদটি বাবে মুফা’আলাহ্’র ক্রিয়া যার মধ্যে দ্বিপাক্ষিকতা রয়েছে অর্থাৎ পরস্পরের মোকাবিলায় চেষ্টা-সাধনার কথা বলা হয়েছে, সেহেতু এ চেষ্টা-সাধনা হবে একজন দুশমনের মোকাবিলায় বা কোনো বাধার মোকাবিলায়; তবে এর বেশী নয়। এমন কোনো কথা নয় যে, এ বাধা অবশ্যই এমন কোনো বাধা হবে যার মোকাবিলায় অবশ্যই তলোয়ার হাতে তুলে নিতে হবে। এ বাধা হয়তো অর্থনৈতিক শত্রু হতে পারে, সাংস্কৃতিক শত্রু হতে পারে; এরূপ ক্ষেত্রেও জিহাদ কথাটি প্রযোজ্য হবে। সে ক্ষেত্রে দুশমন কী ধরনের সে অনুযায়ী ধনসম্পদ দিয়ে জিহাদ করতে হবে, বা সামাজিক তৎপরতার দ্বারা জিহাদ করতে হবে। এ-ও জিহাদ।
“তোমরা জিহাদ করো তোমাদের ধনসম্পদ ও প্রাণের দ্বারা।” অতএব, এক ধরনের জিহাদ হচ্ছে প্রাণের দ্বারা বা প্রাণের সাহায্যে তথা প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে জিহাদ। অর্থাৎ প্রাণকে নিহত হবার ঝুঁকির মুখে নিক্ষেপ করা।
আরেক ধরনের জিহাদ হচ্ছে ‘জিহাদুন্ নাফ্স্’ (جهاد النفس) তথা ব্যক্তির স্বীয় নাফ্স্ বা প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ। এর নাম দেয়া হয়েছে ‘জিহাদে আকবর’ বা শ্রেষ্ঠতম জিহাদ। “কিতাবে জিহাদে আকবার”-এ নৈতিক ও চারিত্রিক উন্নতির পন্থা সম্বন্ধে তথা নাফ্স্ বা প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে জিহাদ সম্বন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে এবং আপনারা লক্ষ্য করে থাকবেন যে, শেখ রামী (রহ্ঃ) তাঁর “রাসায়েলুশ্ শি’আহ্” গ্রন্থে জিহাদ সম্পর্কে আলোচনা করে এর পর পরই জিহাদুন্ নাফ্স্ ও চারিত্রিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করেছেন। এ গন্থে “কিতাবুজ্ জিহাদ্”-এ চারিত্রিক বিষয়াদি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, কারণ তা নাফ্সের বিরুদ্ধে জিহাদের অন্তর্ভুক্ত।
অতএব, দেখা যাচ্ছে যে, জিহাদের তাৎপর্য এত ব্যাপক ও বিস্তৃত যে, তাতে একদিকে যেমন ধনসম্পদ দিয়ে জিহাদ অন্তর্ভুক্ত, অন্যদিকে তাতে প্রচারের মাধ্যমে জিহাদ তথা কথা ও লেখার মাধ্যমে জিহাদও শামিল হয়ে যায়। নাফ্সের বিরুদ্ধে জিহাদে স্বয়ং ব্যক্তি নিজে শামিল হয়ে যায়, বরং এটা হচ্ছে জিহাদে আকবর। এভাবে জিহাদের তাৎপর্য সমপ্রসারিত হয়ে যায়। কিন্তু আমরা মসলা-মাসায়েলের বই-পুস্তকে যে জিহাদের কথা পড়ি তাতে অন্যান্য শরয়ী বিষয় এবং দ্বীনী শিক্ষা ও এ জাতীয় অন্যান্য বিষয় জিহাদের তাৎপর্যের মধ্যে শামিল নয়। সেখানে কেবল ঐ তিন ধরনের জিহাদের কথাই বলা হয়েছে যে সম্পর্কে ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি।
বস্তুতঃ অনেক ক্ষেত্রে একটি পরিভাষার দুই ধরনের তাৎপর্য হতে পারে। একটি হচ্ছে সাধারণ তাৎপর্য ও একটি হচ্ছে বিশেষ তাৎপর্য। বিশেষ তাৎপর্য এক বিশেষ পরিবেশে ও এক বিশেষ সমাজে একটি বিশেষ পরিভাষার রূপ পরিগ্রহ করে। অন্যদিকে এর সাধারণ তাৎপর্য হচ্ছে এর আভিানিক তাৎপর্য। অথবা সামাজিক বিবর্তনের কারণে পরিভাষাটি একটি নতুন মানদণ্ড পরিগ্রহণ করে এবং তার তাৎপর্যের বিস্তৃতি ঘটে।
মোদ্দা কথা, জিহাদের সাধারণ তাৎপর্য হচ্ছে চেষ্টা-সাধনা করা, অর্থাৎ আল্লাহ্র রাস্তায় কোনো দুশমনের বিরুদ্ধে চেষ্টা-সাধনা করা। “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর বেশীর ভাগ কাজই জিহাদের অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে আপনারা যদি “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”কে এর সাধারণ অর্থে গ্রহণ করেন, তাহলে দেখবেন যে, কেবল নাফ্সের বিরুদ্ধে জিহাদ ছাড়া জিহাদের অন্তর্ভুক্ত সকল কাজই “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। যেহেতু জিহাদ ও “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” _ উভয়েরই কাজ হচ্ছে অন্যদেরকে ভালো কাজ করতে ও মন্দ কাজ বর্জনে বাধ্য করা, এ কারণেই উভয়ের অন্তর্ভুক্ত কাজ সমূহের মধ্যে এত বেশী অভিন্নতা বা পারস্পরিক প্রবিষ্টতা।
এ ধরনের পরিভাষা সমূহ সম্পর্কে বলা হয় যে,_ “যখন উভয় একত্রিত হয় তখন উভয়ের তাৎপর্য পৃথক হয়ে যায়, আর যখন উভয় পৃথক থাকে তখন উভয়ের তাৎপর্য অভিন্ন হয়ে যায়।” যখন “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর কথা জিহাদের পাশাপাশি উল্লেখ করবো তখন বলবেন যে, ফুরূ’এ দ্বীন দশটি এবং এর মধ্যে একটি অর্থাৎ ছয় নম্বরটি হচ্ছে জিহাদ, আর সাত নম্বরটি হচ্ছে “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্”। অর্থাৎ “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্” জিহাদ ভিন্ন অন্য কিছু এবং এ দু’টি একত্রে অবস্থান করছে। তখন উভয়ের তাৎপর্য পরস্পর থেকে আলাদা হয়ে যায়। তখন জিহাদ আর “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্”-এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় না এবং “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্”ও জিহাদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় না। দ্বীনী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা এ কথাগুলো ব্যবহার করে থাকেন । তাঁরা বলেন,_ যখন একত্রে উল্লেখ করা হয় তখন উভয়ের তাৎপর্য পৃথক হয়ে যায়। কিন্তু_ কিন্তু যখন আলাদা আলাদা উল্লেখ করি তখন “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্”-এর তাৎপর্যের মধ্যে জিহাদও শামিল হয়ে যায় এবং জিহাদের মধ্যেও “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্” শামিল হয়ে যায়।
এ হচ্ছে এমন একটি পটভূমি মূলক তথ্য যা আপনাদের বহু ক্ষেত্রে কাজে লাগতে পারে।
হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) যে “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর কথা বলেন তখন তার তাৎপর্য কেবল আমাদের মাঝে পারিভাষিকভাবে প্রচলিত সীমিত অর্থের “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” নয় যাকে আমরা ক্ষতি না হওয়ার শর্তে পালনীয় দায়িত্ব বলে মনে করি, বরং তিনি এর ব্যাপকতর ও সাধারণ অর্থেই কথাটি বলেছেন _ যে ক্ষেত্রে এমনকি ক্ষতি সম্পর্কে নিশ্চিত জ্ঞান থাকলেও, এমনকি সে ক্ষতি নিহত হওয়ার মতো বিপদ হলেও এ দায়িত্ব পালন করা অপরিহার্য। বস্তুতঃ এটাও ফরয “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর মানদণ্ড, তবে এ পরিভাষাটি ব্যাপকতর তাৎপর্যবহ। আপনি ও আমি যে পরিভাষার সাথে পরিচিত এবং ব্যবহারিক মসলা-মাসায়েলের গ্রন্থ সমূহে যা উল্লেখ থাকে ও মসলা-মাসায়েল বর্ণনাকারীগণ যা বর্ণনা করেন, তা থেকে হযরত ইমামের (আঃ) দৃষ্টিতে যা “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” তা আলাদা। মসলা-মাসায়েল বর্ণনাকারীগণ এ প্রসঙ্গে যা বলেন তা খুবই ভালো কথা, আল্লাহ্ তাঁদেরকে হেফাযত করুন ও তাঁদের তাওফীক বৃদ্ধি করে দিন। কিন্তু তাঁরা এ বিষয়ে যা বলেন তা কিছুটা কম বলেন। জিহাদের ক্ষেত্রেও তা-ই।
যদ্দূর মনে পড়ে, আমি এর আগেও দুই-তিন বার এ বিষয়টি উল্লেখ করেছি এবং এবারও উল্লেখ করলাম। এ বছর আমাদের এ ধরনের পোশাক পরিহিতদের সংখ্যা আগের চেয়ে বেশী, তাঁদের অনেকে যিয়ারত থেকে ফিরে এসেছেন। ইনশা আল্লাহ্, আমি তাঁদের সাথে সাক্ষাত করবো। তাঁদের বরকতময় পাগড়ীগুলো এ মজলিসকে প্রায় সাদা করে ফেলেছে। তাঁদের উদ্দেশে অনুযোগ সহ পুনরায় উল্লেখ করছি যে, হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) যখন বললেন যে, “কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাকিয়াহ্ করা হারাম , তাতে যা হবার তা-ই হোক”, তেমনি তিনি ব্যবহারিক মসলা-মাসায়েল সংক্রান্ত তাঁর রিসালায় লিখেছেন যে, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সমূহে তাকিয়াহ্র কোনো অবকাশ নেই।
হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) এ ব্যাপারে কয়েকটি উদাহরণও দিয়েছেন, যেমন, তিনি বলেছেন ঃ কা’বাহ্ গৃহ যদি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মতো হুমকির সম্মুখীন হয়, দুশমন এসে যদি কা’বাহ্কে এমনকি তুলে নিয়ে যেতে চায়, তখন এ প্রশ্ন আসে না যে, যেহেতু “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্”-এর দায়িত্ব পালন করলে বিপদের আশঙ্কা আছে সেহেতু তা করবো না। এ অবস্থায় যে কোনো মূল্যের বিনিময়েই হোক না কেন, দুশমনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে, “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” করতে হবে, এমনকি সে জন্য যদি প্রাণও দিতে হয়। কারণ, কা’বাহ্ গৃহের হেফাযত কোনো সাধারণ ফরয কাজের মতো নয়। অথবা বিষয়টি যদি এমন হয় যে, একজন নবী বা একজন ইমামের জীবন বিপন্ন: দুশমন একজন নবীকে আটক করলো ও তাঁকে হত্যা করতে চায়, তখন কি ঈমানদারগণ বলবে যে, “আমরা এগিয়ে যেতে ভয় পাচ্ছি; হয়তো আমাদের শরীর যখম হবে, আমাদেরকে মার খেতে হবে, অতএব, এ অবস্থায় আমাদের এগিয়ে যাওয়া হারাম হবে, কারণ, ক্ষতির ভয় রয়েছে; অতএব, নবীকে নিহত হতে দাও।”?
ইসলাম সম্পর্কে যার সামান্য জ্ঞানও আছে সে জানে যে, এমনটা হতে পারে না। বরং ঈমানদারদের জন্য অপরিহার্য কর্তব্য হচ্ছে এই যে, নবীকে রক্ষার জন্য এগিয়ে যাবে, এমনকি হাজার হাজার ব্যক্তিকে প্রাণ দিতে হলেও তারা নবীকে উদ্ধার করবে। তেমনি হাজার হাজার ব্যক্তিকে প্রাণ দিতে হলেও তারা মা’ছূম ইমামকে উদ্ধার করবে।
হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) এখানে দু’টি উদাহরণ দিয়েছেন। এ ব্যাপারে আরো অনেক উদাহরণ দেয়া যায়। কিন্তু গড়পরতা বলে দেয়া হয় যে, এ ব্যাখ্যা সেখানেই কার্যকর হবে যেখানে মূল ইসলাম বিপন্ন হয়। আমি আমার গবেষক ও মুজতাহিদ বন্ধুদের নিরুদ্ধে অনুযোগ করেছি, কারণ, এ বিষয়ে আরো গবেষণা প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও তাঁরা তা করেন নি এবং নির্ভুলভাবে এর মানদণ্ড ও সীমারেখা চিহ্নিত করেন নি। তাঁরা নির্ধারণ করেন নি যে, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কোনগুলো। ইমাম মাত্র কয়েকটি উদাহরণ দিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত কোন্ পর্যায়ে পেঁৗছলে ক্ষতির ভয় দায়িত্ব পালনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে? এ বিষয়টি নিয়ে পর্যালোচনা হওয়া অপরিহার্য। এরপর সমকালীন সামাজিক সমস্যাবলীর প্রেক্ষাপটে এর মানদণ্ড নির্ধারণ করতে হবে। আজকের দিনে নবী ও ইমামকে হত্যা করার মানে এ নয় যে, কেউ নবী বা ইমামের ঘাড়ে তলোয়ারের আঘাত হানবে এবং তাঁদেরকে হত্যা করবে। আজকের দিনে নবী ও ইমামকে হত্যা করার ধরন হচ্ছে এই যে, ইমামত ও বেলায়াতকে হত্যা করা হচ্ছে _ ইসলামী প্রজাতন্ত্রে যিনি প্রথম কাতারের লোকদের সম্মানের পাত্র _ নবী ও ইমামের স্থলাভিষিক্ত, তাঁর ওপরে হামলা চালানো হচ্ছে।
যদি এর চাইতে বেশী কিছু বলি তাহলে ওরা লিখবে যে, রাসূলুল্লাহ্র মৃতু্যর সাথে সাথে বেলায়াতেরও পরিসমাপ্তি ঘটেছে; নবীর মৃতু্যর পর আর বেলায়াত বলে কিছু নেই। অথচ আশূরার রাতে এদেরকে ইসলামী বক্তা হিসেবে দাওয়াত করা হয় এবং এরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকদের সামনে বক্তৃতা করে। এ বছরও তা-ই করেছে। এরা হলো সেই সব লোক যারা বলে, “ওহী হচ্ছে একটি ব্যক্তিগত ব্যাপার; আমরা প্রমাণ করতে পারবো না প্রকৃতই এরূপ ব্যক্তি নবী কিনা”। তারা আরো বলে, “নবীও অন্যান্য লোকদের মতোই; এমনকি তিনি ওহীর তাৎপর্য গ্রহণে ভুল করতে পারেন।” এরা যখন এ জাতীয় কথা বলে তখন তা নবীকে হত্যা করার চেয়েও গুরুতর কাজ।
একজন নবীকে যখন হত্যা করা হয় তখন বড়জোর তাঁর প্রাণকে হত্যা করা হয়, কিন্তু তাঁর লক্ষ্য ও তাঁর আদর্শ সংরক্ষিত থাকে। ঠিক যেভাবে হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)কে হত্যা করেছে, কিন্তু তাঁর সেই রক্তের বিনিময়ে তাঁর সেই লক্ষ্য ও আদর্শ সংরক্ষিত থেকেছে। কিন্তু আজকে যেভাবে নবীকে হত্যা করা হচ্ছে তার বিরুদ্ধে যদি কথা বলি তাহলে এ আশঙ্কা রয়েছে যে, তার জবাবে কানের ওপর ঘুষি মারবে। ভয় করছি যে, এ ব্যাপারে কথা বললে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দেয়া হবে; ভয় করছি যে, আমার নামে ফাইল খোলা হবে। ভয় করছি যে, এসব কথাকে তারা বাহানা হিসেবে গ্রহণ করবে। আমাদের দ্বীনী নেতৃবৃন্দ ও সরকারী দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা এ সমস্যার কথা জানেন না। এদিক থেকে যে বিপদ সৃষ্টি হচ্ছে তা তাঁরা লক্ষ্য করছেন না, অথবা লক্ষ্য করলেও বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না।
কে না জানে যে, বিগত কয়েক বছরে আমাদের সমাজে ধীরে ধীরে দ্বীন দুর্বল হয়েছে? কে এটা না জানে? আল্লাহ্কে হাযির-নাযির জেনে বলছি, অনেক সময় আমরা যখন বিদেশে যাই তখন সেখানকার মুসলমানদের, আমেরিকা ও ইউরোপে বসবাসকারী মুসলমানদের এ সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাব দিতে পারি না। তাঁরা বলেন ঃ “আমরা গত বছর গিয়েছিলাম ইরানকে দেখেছি, এ বছরও গিয়েছিলাম ইরানকে দেখেছি; বিশ্বাস করতে পারছি না যে, এই ইরান গত বছরের সেই ইরান।” আপনারা কি বিশ্বাস করতে পারছেন যে, আমাদের সমাজে দ্বীনের অবস্থা এখনো গত বছরের পর্যায়ে আছে? না, নেই। কারো যদি এ ব্যাপারে সন্দেহ থাকে তাহলে আমি বলবো যে, সে যেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যায়।
প্রশ্ন হচ্ছে, এ অবনতির নায়ক কারা এবং এর উপাদান কী? কেন আজকে এ অবস্থা এসে দাঁড়িয়েছে? আপনারা যদি এর কারণ সমূহ নিয়ে পর্যালোচনা করেন তাহলে দুই ধরনের উপাদান ও উপকরণ দেখতে পাবেন। এক ধরনের উপাদান হচ্ছে দ্বীন থেকে বিচু্যতকারী পত্রপত্রিকা, সাময়িকী ও বই-পুস্তক এবং ইসলামী নির্দেশনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাগণ। দ্বিতীয়তঃ এ দেশে এমন কতগুলো কাজ সংঘটিত হচ্ছে যার ফলে পাপকর্মের ঘৃণ্য ও নোংরা হওয়া সংক্রান্ত অনুভূতির বিলুপ্তি ঘটছে। ফলে লোকেরা পাপ কাজে উৎসাহ পাচ্ছে এবং তাদের জন্য গুনাহে লিপ্ত হবার পথ খুলে যাচ্ছে। যুবকদেরকে গুরুত্ব দেয়ার বাহানায় তাদেরকে পাপ কাজ করার জন্য সবুজ সঙ্কেত প্রদান করে। শুধু ঘরের মধ্যে থেকে গোপনে পাপ কাজ নয়, বরং সমাজের বুকে প্রকাশ্যে তাদেরকে এসব করতে দিচ্ছে।
এছাড়া আরো যে সব উপাদান আছে আপনারা সেগুলোর খবর জানেন? অনেকে বিদেশী টেলিভিশনের অনুষ্ঠান দেখে। অনেকে সীমান্তবর্তী এলাকায় থাকার সুযোগে এসব অনুষ্ঠান দেখে। আবার অনেকে চোরাচালানের মাধ্যমে আসা ডিশ এ্যান্টেনা ব্যবহার করে এগুলো দেখে। তারা অশ্লীল ভিডিও ফিল্ম দেখছে; এর মধ্যে কতগুলো চোরাচালান হয়ে আসছে, আর কতগুলো তো স্বয়ং ইসলামী নির্দেশনা মন্ত্রণালয়ের অনুতিক্রমেই প্রবেশ করছে। সমাজে দ্বীনকে দুর্বল করার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে এমন আরো অনেক উপাদানের কথাও হয়তো আপনাদের জানা আছে। অবশ্য এর সব কিছুর জন্য ইসলামী নির্দেশনা মন্ত্রণালয় দায়ী নয়। আমরা জানি যে, আরো কোনো কোনো মন্ত্রণালয়ের কতক কর্মকর্তা আছেন যারা এ জন্য দায়িত্বশীল। অন্যান্য মন্ত্রণালয়ে এমন কতক কর্মকর্তা আছেন যারা এতে উৎসাহ যোগায়। তবে এতেও ইসলামী নির্দেশনা মন্ত্রণালয়ের অংশ আছে। কারণ, এ মন্ত্রণালয়ই সেই সব সাংস্কৃতিক ভবন প্রতিষ্ঠা করেছে যেখানে গুনাহ্র কাজের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় ও এতে উৎসাহ দেয়া হয়। তারা যে সব নাট্যাভিনয়ের আয়োজন করছে স্বয়ং মহান রাহবারের উক্তি অনুযায়ী তার মধ্যে কতগুলো পুরোপুরি ইসলাম বিরোধী। এ ধরনের আরো অনেক কিছু হচ্ছে। এগুলোর দায়-দায়িত্ব কার?
তারা আমাদেরকে বলে ঃ আপনারা যদি সরকারকে ইসলামী সরকার বলে মনে করেন তাহলে সরকারের মন্ত্রীর সালোচনা করছেন কেন? আজব ফ্যালাসি _ ভ্রমাত্মক অপযুক্তি! এ দেশের সরকার ব্যবস্থা যে ইসলামী এটা তো রাহ্বারের কারণে _ ইসলামী নেতৃত্বের কারণে। এ কারণেই পত্রপত্রিকায় বেলায়াতে ফকীহ্ সংক্রান্ত ধারণা ও এ পদের বিরুদ্ধে, বেলায়াতে ফকীহ্র ওপর ভিত্তিশীল ইসলামী হুকুমতের ওপর ও ব্যক্তিগতভাবে স্বয়ং রাহবারের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছে। আর তারা দিনের পর দিন নির্লজ্জভাবে এ ব্যাপারে ক্রমেই বেশী অগ্রসর হচ্ছে। এর কারণ কী? কারণ, তারা ইসলাম চায় না। তারা বলে, “আমরা যদি ইসলাম না চাই তো কী হবে?” আমরা দেখছি, এরাই বর্লিন কন্ফারেন্সে গিয়ে বলেছে, “ইসলাম সমকালীন গণতন্ত্রের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না _ এটা ইসলামের সমস্যা। আমরা এর সমাধান করবো।” আর কেউ তাদের এ কথার প্রতিবাদ করে নি।
আমরা কি এ ধরনের ইসলামী সরকারের, এ ধরনের মন্ত্রণালয়ের, এ ধরনের উপমন্ত্রীদের এবং এ ধরনের উপদেষ্টাদের আনুগত্য করাকে ফরয বলে মনে করবো? শয়তানের আনুগত্য কি কখনো ফরয হতে পারে? যেখানে এরশাদ হয়েছে যে, “স্রষ্টার নাফরমানী করে সৃষ্টির আনুগত্য জায়েয নেই।” সেখানে এটা কি সম্ভব যে, আল্লাহ্ তা’আলা এমন লোকদের আনুগত্যকে জায়েয করবেন যারা মানুষকে শয়তানের পথের দিকে ডাকে, নিজেরা পাপাচারে লিপ্ত হয় ও অন্যদেরকে পাপাচারের অনুমোদন দেয়? এরা গুনাহ্র কাজের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয়, এ জন্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা ও উপায়-উপকরণ সরবরাহ করে, তাদেরকে ক্রিস্টাল গ্লাসের তৈরী সী-মোরগ উপহার দেয়, ক্রিস্টাল গ্লাসের তৈরী ডলফিন উপহার দেয়। যে লোকেরা দীর্ঘ বিশ বছর যাবত ইসলাম ও ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিরোধিতা করেছে, এরা তাদেরকে দাওয়াত করে আনছে, আপ্যায়িত করছে, তাদেরকে পুরস্কার দিচ্ছে, তাদেরকে ক্রিস্টাল গ্লাসের তৈরী সী-মোরগও উপহার দিচ্ছে; একটি দুইটি নয়, সাতটি।
হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)ও এ ধরনের লোকদেরই মুখোমুখি ছিলেন যারা ইসলামের কথা বলতো, নিজেকে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর খলীফাহ্ বলে দাবী করতো। তারা ইসলমকে অস্বীকার করতো না।
এ রাষ্ট্রব্যবস্থার শীর্ষে যদি মহান রাহবার না থাকেন তাহলে এ হুকুমত আমাদের জন্য ইসলামী হুকুমত হবে না। আমরা এ রাষ্ট্রব্যবস্থার সেই সব দায়িত্বশীল র্ককর্তাদেরকে সম্মান করি যারা মহান রাহবারের স্বীকৃতি ও সন্তুষ্টির অধিকারী। হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) বলেছেন; ইমামের বাণীতে এটা আছে, তাঁর অছিয়্যাতনামায় আছে এবং “ছাহিফায়ে নূর” গ্রন্থে বেশ কয়েক জায়গায় আছে, তিনি বলেছেন, কোনো রাষ্ট্রব্যবস্থা, কোনো সরকার যদি ওলীয়ে ফকীহ্র অনুমতি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত না হয়, ওলীয়ে ফকীহ্ কর্তৃক মনোনীত হয়ে দায়িত্ব গ্রহণ না করে তাহলে তা তাগূত। তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্টও যদি ওলীয়ে ফকীহ্ কর্তৃক মনোনীত না হয় তাহলে সে তাগূত।
কেন এরা জনমতের মধ্যে সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করছে? কারণ, তারা এসব বিষয়কে বিলুপ্ত করতে চায়। তারা কেন এত বেশী বেশী জনগণের শাসন ও গণতন্ত্রের শ্লোগান দিচ্ছে? কারণ, কালকে যদি জনগণ বলে যে, আমরা ইসলাম চাই না, তাহলে জনগণের কথাই হবে মানদণ্ড, ইমামের কথা নয়। কেন তারা বার্লিন কন্ফারেন্সে গিয়ে বললো যে, খোমেইনীও ইতিহাসের জাদুঘরে স্থান নেবেন? আমেরিকান কর্মকর্তারা সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন এবং এ আশায় বসে আছেন, তাঁরা সুস্পষ্ট ভষায় বলেছেন, “ইরানের পার্লামেন্ট যদি বেলায়াতে ফকীহ্ সমস্যার সমধান করতে পারে তাহলে আমাদের কাজ সহজ হবে, ইরানের সাথে আমাদের সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।”
এরা আশায় পথ চেয়ে বসে আছে। তারা আশা করছে যে, একদিন গণভোটের নামে বেলায়াতে ফকীহ্ ব্যবস্থাকে তুলে নেয়া হবে। তারা বর্তমানে এর জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে। তারা এজন্য সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র তৈরী করছে। তাদের ওপর লা’নত যারা এর ক্ষেত্র তৈরী করছে। এরা হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর খুনকে পদদলিত করছে। বিদেশী সাহায্যে পরিচালিত ঐ সব পত্রিকাকে আপনারা জিজ্ঞেস করতে পারেন, তারা কেন এসব কথা লিখছে?
বস্তুতঃ যে কোনো সমজের আসল সমস্যা হচ্ছে অজ্ঞতা ও অসচেতনতা। তারা যে বিগত মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে এভাবে কাপুরুষসুলভ হামলা চালাতে সক্ষম হয়েছে, এর কারণ হচ্ছে এই যে, আমরা আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্যের সাথে পুরোপুরি পরিচিত নই। কতককে সহজীকরণ ও অকঠোরতার প্রশ্ন উত্থাপন করে প্রতারিত করা হয়েছে। তারা রূঢ়তার, তাদের ভাষায়, সহিংসতার সালোচনা করে, একে মূল্যবোধ বিরোধী বলে আখ্যায়িত করে জনগণকে প্রতারিত করেছে। ফলে লোকেরা কথা বলতে ভয় পাচ্ছে। ভয় পাচ্ছে যে, গুনাহ্র বিরুদ্ধে শক্ত কথা বললে তাদেরকে সহিংসতাবাদী বলে চিহ্নিত করা হবে। আর সহিংসতা মানে কবিরাহ্ গুনাহ্। অন্যদিকে অনেক ভদ্র, সম্ভ্রান্ত ও দ্বীনদার লোক ভয় করছেন যে, কথা বললে হয়তো ইসলামী হুকুমতের স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর হবে। এতে হয়তো মহান রাহ্বারের মনে উদ্বেগের সৃষ্টি হবে। এ ধরনের লোক কম ছিলেন না এবং এখনো তাঁদের সংখ্যা কম নয়।
এখনো আমরা সবাই মহান রাহবারের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। তবে আমাদের প্রস্তুতি থাকতে হবে। তিনি যদি কখনো আন্দোলনের ডাক দেন, জিহাদের ফরমন দেন, তখন শরীরের সর্বশেষ রক্তবিন্দু উৎসর্গ করা পর্যন্ত আমাদেরকে দৃঢ়তার সাথে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। এ প্রস্তুতি এক মুহূর্তের কাজ নয়। যদি ফরমান দেয়া হয় তাহলে সেই মুহূর্তে সাথে সাথেই প্রস্তুতি গ্রহণ করা সম্ভব হবে না। মানুষের মধ্যে কয়েক যুগ আগে থেকেই এ প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন। হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ) দীর্ঘ পনর বছর যাবত তাঁর হৃদয়ের রক্তক্ষরণ সহ্য করেন এবং ইসলামী বিপ্লবের জন্য সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন। তিনি কারাগারে যান, তাঁকে নির্বাসিত করা হয়, এ পথে তাঁর সন্তানকে শহীদ করা হয়, তিনি বহু কঠিন অবস্থা সহ্য করেন। এ ক্ষেত্র যদি প্রথম দিনেই তৈরী হতো তাহলে বিপ্লব পনর বছর পিছিয়ে যেতো না। স্বয়ং ইমাম দীর্ঘ পনর বছর ধরে এ ক্ষেত্র প্রস্তুত করেন। এরপর তিনি দশ বছর যাবত এ বিপ্লববৃক্ষের গোড়ায় শহীদগণের খুনের দ্বারা পানি সিঞ্চন করেন। আর আজকে ওরা চায় যে, এমনিতেই খুব সহজেই তা আমাদের কাছ থেকে নিয়ে নেবে। কিসের বিনিময়ে? বলে যে, এমন কাজ করো না যা সহিংসতার পর্যায়ে পড়ে। হ্যা, তারা চায়, তারা যে শিথিলতা ও ঢিলেঢালা নীতির প্রচলন করছে আমরা যেন তার বিরোধিতা না করি। এভাবে তারা আমাদেরকে সম্মোহিত করতে চায়।
হ্যা, নবী-রাসূলগণ (আঃ) ও আল্লাহ্র ওলীগণ যে এত তৎপরতা চালালেন, সাইয়েদুশ শুহাদা হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর খুন, বিগত দীর্ঘ তেরোশ’ বছর যাবত তার ব্যবহার, আর সাইয়েদুশ শুহাদার শোকানুষ্ঠান সমূহ _ এ সবের পরিণামেই ১৯৬৩-র ৫ই জুনের অভু্যত্থান সংঘটিত হয় এবং এরপর ১৯৭৯-র ১১ই ফেব্রুয়ারী বিপ্লব বিজয়ী হলো। দীর্ঘ তেরোশ’ বছর চেষ্টা-সাধনা করা হয়েছে, অতঃপর এ বৃক্ষ এ ধরনের ফল দিয়েছে। অতঃপর শিথিলতা ও ঢিলেঢালা নীতির সম্মোহনের মাধ্যমে সবকিছকে বরবাদ করে দিতে চাচ্ছে।
তারা যে এ ধরনের ব্যাখ্যা দিচ্ছে এটা কোত্থেকে এলো? কোত্থেকে এ দায়িত্ব _ এ ফরয নাযিল হলো যে, এর জন্য শরীয়তের সকল আহকাম নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে? “আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুন্কার্” ও জিহাদ সংক্রান্ত সকল হুকুম মানসুখ হয়ে যাবে? পাশ্চাত্য থেকে আগত এ নির্দেশের কারণেই এ শিথিলতার নীতি গ্রহণ করতে হবে?
এবার বুঝতে পারছেন পরিস্থিতিটা কোন্ পর্যায়ে গিয়ে পেঁৗছেছে? আমরা যেন মনে না করি যে, এটা কেবল পত্রপত্রিকা সংক্রান্ত সমস্যা, অপসাংবাদিকতার সমস্যা। একেক জন একেকটা কথা বলছে, কিন্তু কেউ জবাব দিচ্ছে, বা না দিচ্ছে তাতে তারা ভ্রূক্ষেপ করছে না। দেখুন, এসব কাজের মাধ্যমে কীভাবে তারা আমাদের যুবকদের বেশীর ভাগকে বিপথগামী করেছে। এ হচ্ছে তাদেরই অপচেষ্টার ফল। এ হচ্ছে এক নোংরা সাংস্কৃতিক নীতি আজকে যা এ ধরনের নোংরা ফল প্রদান করেছে। প্রথম দিনেই যদি রুখে দাঁড়ানো হতো তাহলে এসব পাপাচার ও অনাচার হতো না। অবশ্য এখনো খুব বেশী দেরী হয়ে যায় নি। আমাদের জনগণের এখনো বুঝতে পারা দরকার যে, দুশমনেরা কীভাবে চক্রান্ত করেছে, কীভাবে তাদের জন্য চক্রান্তের ফাঁদ পেতেছে এবং কীভাবে চারটা বাক্য, চারটা শব্দ ও চারটা শ্লোগানের দ্বারা শিয়া মাযহাবের তেরোশ’ বছরের চেষ্টা-সাধনার ফসলকে নস্যাৎ করে দিচ্ছে। এরা সুস্পষ্ট ভাষায় বলছে, নবীর বিদায়ের সাথে সাথে বেলায়াতও বিদায় নিয়েছে। আর অন্য এক জায়গায় তারা বলেছে যে, নবীর নবুওয়াতীর বিষয়টিও সুস্পষ্ট নয়। আরেক জায়গায় তারা বলেছে, সৃষ্টিকর্তা যে আছেন এটা প্রমাণযোগ্য নয়। এরাই বলেছে যে, আমি ও আপনারা _ আমরা সবাই অপরিপক্ব চিন্তাশক্তির অধিকারী, তাই বুঝতে পারি না তারা কী করছে।
যে কিশোরটি মাধ্যমিক স্কুলে পড়ছে, এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে, যে ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে পরিচিত নয়, যার ঈমানের ভিত্তি এখনো শক্তিশালী হয় নি, এরা এদের চাকচিক্যের দ্বারা, এদের সম্মোহনের দ্বারা তার দ্বীন ও ঈমানকে নষ্ট করে দিচ্ছে। স্বয়ং মহান রাহবার কি কিছুদিন আগে বলেন নি যে, এরা জনগণের ঈমানকে তাদের হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে? তিনি বিগত কয়েক বছর যাবত বলে আসছেন যে, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চলছে, অতর্কিত সাংস্কৃতিক হামলা চলছে। দেশের সাংস্কৃতিক বিভাগের কর্মকর্তারা কী কাজ করেছেন?
কোন্ ভাষায় বলবো? দেশের একজন নাগরিক হিসেবে সমাজে বর্তমানে প্রচলিত পরিভাষায় বলছি, যে মুসলমান দিশাহারা, যে মুসলানের মধ্যে ইসলামী মূল্যবোধ নেই, যরথুস্ত্রীরাও তো তোমাদের মতোই। দেশের একজন নাগরিক হিসেবে দেশের কর্মকর্তাদেরকে নছিহত করছি, আপনারা এই যে পথ বেছে নিয়েছেন তা আপনাদের নিজেদের স্বার্থেরও পরিপন্থী। আমাদের জনগণ বার বার প্রমাণ করেছে যে, একবার যদি বুঝতে পারে যে, তাদের দ্বীন বিপন্ন, তখন তাদের কাছে তাদের প্রাণের কোনোই মূল্য থাকবে না।
যে কর্মকর্তারা ইসলামে ঈমান পোষণ করেন, আল্লাহ্ তা’আলার অস্তিত্ব স্বীকার করেন, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)কে মানেন, তাঁরা যেন এই শয়তানদেরকে নিজেদের চারদিক থেকে বিতাড়িত করে দেয়ার চেষ্টা করেন। এদেরকে যেন দেশের প্রশাসনযন্ত্র থেকে, বিশেষ করে নীতিনির্ধারণী সংস্থা সমূহ থেকে বের করে দেন। তাঁরা যেন হযরত ইমাম খোমেইনী (রহ্ঃ)-এর নছিহত সমূহকে স্মরণ করেন। এটা যদি না হয় তাহলে তাঁরা যেন মনে রাখেন, এটা অসম্ভব নয় যে, সাইয়েদুশ শুহাদা হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর ওপর যে দায়িত্ব ছিলো যিনি তাঁর স্থলাভিষিক্ত তিনিও সে দায়িত্ব পালনের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। যারা দীর্ঘ তেরোশ’ বছর যাবত বলে আসছেন ঃ “হায় আফসোস্! আমি যদি তোমাদের সাথে থাকতাম তাহলে তোমাদের সাথে সাফল্যের অধিকারী হতাম।” তাঁরা এটাকে শাহাদাতের লক্ষ্যে উপনীত হবার জন্য বিরাট সুযোগ মনে করবেন। কর্মকর্তারা যেন সে দিনকে ভয় করেন এবং দেরী হবার আগেই নিজেদের ভুল থেকে ফিরে আসেন এবং তাঁদের ভুলের ক্ষতিপূরণ করেন। তাঁরা যদি গুনাহ্র কাজে লিপ্ত হয়ে থাকেন তাহলে যেন আল্লাহ্ তা’আলার কাছে তাওবাহ্ করেন এবং মুসলিম মিল্লাতের কাছে ও সাইয়েদুশ শুহাদার কাছে ক্ষমা চান।
পরোয়ারদেগার! সাইয়েদুশ শুহাদার মর্যাদার উছিলায় তোমার কাছে আবেদন জানাচ্ছি,
আমাদেরকে তাওবায়ে নাছূহ্ নসীব করো।
কোনো ব্যক্তি যে পোশাকে এবং যে দায়িত্বে ও যে পদেই থাকুন না কেন যারা ইসলামের খাদেম তাঁদেরকে হেফাযত করো।
ইসলামের দুশমনরা যে পদে ও যে দায়িত্বেই থাকুক না কেন তাদেরকে ধ্বংস করে দাও।
আমাদের ওপরে মহান রাহ্বারের ছায়াকে স্থায়ী করে দাও।
আমাদের পরিণতিকে শুভ পরিণতিতে পরিণত করে দাও।

Leave A Reply

Your email address will not be published.