পবিত্র আশুরা ও মহররম-১০

0 470

আশুরা উপলক্ষে ওস্তাদ আয়াতু্ল্লাহ মিসবাহ তাকী ইয়াযদীর দশম বক্তব্য

33

শহীদানের নেতা হযরত আবা আব্দিলল্লাহ্ আল্-হোসাইনের (আঃ) শোকাবহ ম্মৃতিময় দিনগুলোর আগমনে হযরত ইমাম মাহ্দী (আল্লাহ তাঁর আবির্ভাব ত্বরান্বিত করুন), মহান রাহ্বার, মহান মার্জা’এ তাক্বলীদগণ ও হোসাইনী আদর্শের ভক্ত অনুসারীদের সকলের প্রতি শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছি। মহান আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে এ দুনিয়ায় ও পরকালে ইমাম হোসাইন (আঃ) এর সাথে বন্ধন অটুট রাখার তাওফিক দান করবেন- এই প্রত্যাশা করছি ।
বিগত দু’তিনটি আলোচনায় আমরা “আমর্  বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার” সম্বন্ধে কথা বলেছি। এসব আলোচনায় উপস্থাপিত একটি প্রশ্নকে কেন্দ্র করে আমরা “আমর্  বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার”-এর সংজ্ঞা ও তার পরিধি তুলে ধরেছি। এ থেকে আমাদের কাছে পরিস্কার হয়ে গেছে যে, “আমর্  বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার” সম্পর্কে আমাদের মধ্যে যে ধারণা প্রচলিত রয়েছে এবং যাতে বলা হয়েছে যে, এটা তখনি ফরয যখন তাতে ক্ষতির আশঙ্কা থাকবে না, তার সাথে হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর ঐতিহাসিক ভূমিকার কোনো মিল নেই। সহজ কথায় প্রশ্নটি হচ্ছে, তিনি যা আঞ্জাম দিলেন তা কী ধরনের “আমর্  বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার” আমরা যার অনুরূপ “আমর্  বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার”-এর কথা জানি না এবং তার আহকামও অবগত নই?
এ প্রসঙ্গে আমরা ভূমিকা স্বরূপ উল্লেখ করেছি যে, এমন কতক শব্দ বা পরিভাষা আছে যার দুই ধরনের অর্থ হতে পারে ঃ একটি সাধারণ অর্থ ও একটি বিশেষ অর্থ। আমরা কোরআন মজীদে ও রেওয়াইয়াতে “আমর্  বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার” পরিভাষার ব্যবহার থেকে এ উপসংহারে উপনীত হয়েছি যে, এ পরিভাষাটিরও দুই ধরনের অর্থ রয়েছে ঃ একটি বিশেষ অর্থ ও একটি সাধারণ অর্থ । এর বিশেষ অর্থ হচ্ছে প্রচলিত অর্থ যা ব্যবহারিক মসলা-মাসায়েলের গ্রন্থাদিতে উল্লিখিত থাকে। এতে এ দায়িত্ব পালনের জন্য কতক শর্ত উল্লেখ থাকে, যেমন ঃ ক্ষতির সম্ভাবনা না থাকে, ক্ষতি হবার ভয় না থাকে। “আমর্  বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার”-এর একটি বিস্তীর্ণ পরিধির অর্থও রয়েছে যাতে বেশকিছু নির্দেশ, অন্য কতক বিষয়বস্তু, এমনকি জিহাদের অনেক উপাদান অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। আমরা এ ব্যাপারে কিছু নমুনা পেশ করেছি যা থেকে “আমর্  বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার”-এর ব্যাপকতর অর্থে ব্যবহারের প্রমাণ মেলে। আমরা আজকের আলোচনায় এ পুরো বিষয়গুলো সুবিন্যস্ত করতে এবং এর বিধিবিধানেরও সাধ্যানুযায়ী ব্যাখ্যা পেশ করতে চাই।

সাধারণ ও বিস্তৃত অর্থে “আমর্  বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার”-এর মানে হচ্ছে ফরয কাজ আঞ্জাম দিতে ও হারাম কাজ বর্জনে অন্যকে বাধ্য করার জন্য তার ওপরে প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে যে কোনো ধরনের চেষ্টা-সাধনা। এ প্রভাব হয়তো হুকুমটি সম্পর্কে বা তার বিষয়বস্তু সম্পর্কে শিক্ষাদানের মাধ্যমে হতে পারে। অর্থাৎ কাউকে এটা শিক্ষা দেয়া যে, ইসলামে যেসকল ফরয দায়িত্বগুলো রয়েছে, অথবা এসব ফরয কাজ কীভাবে আঞ্জাম দিতে হবে। এ শিক্ষাদানও সাধারণ অর্থে “আমর্  বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার”-এর অন্যতম দৃষ্টান্ত হতে পারে। অন্যদিকে সাইয়েদুশ শুহাদা হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) যে তৎপরতা চালান এবং যার পরিণতিতে তিনি শহীদ হন তা-ও “আমর্  বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার”-এর একটি দৃষ্টান্ত হতে পারে। অতএব, আমরা “আমর্  বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার”-এর জন্য বিভিন্ন স্তর বা এর বিভিন্ন ধরনের দৃষ্টান্তের কথা চিন্তা করতে পারি।
“আমর্  বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার”-এর দৃষ্টান্ত সমূহের মধ্যে আমরা তিনটি দৃষ্টান্তকে বিবেচনায় নিতে পারি যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দ্বীনী দায়িত্ব-কর্তব্যসমূহ শিক্ষা দান করা। ক্ষেত্র বিশেষে এমন হতে পারে যে, এক ব্যক্তি দ্বীনী দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে জানে না, হয়তো বয়সের কারণে অর্থাৎ ছোট হওয়ার কারণে ও সবেমাত্র শরীয়তের দায়িত্ব পালনের বয়সে উপনীত হবার কারণে, বা পরিবেশগত কারণে অর্থাৎ ইসলামের কেন্দ্রস্থল থেকে অনেক দূরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকার কারণে, বা কালগত কারণে, যেমন ঃ কোনো ইসলামী ভূখণ্ডের ওপর কাফেরদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে ইসলামী আহকাম শিখতে পারে নি, পারিভাষিকভাবে যাকে মূর্খতাজনিত ত্রুটির শিকার বলা চলে অর্থাৎ সে ইচ্ছাকৃতভাবে ত্রুটি করে নি, কিন্তু পরিবেশ অনুকূল না থাকায় সে শিখতে পারে নি। এ ধরনের লোককে কারো না কারো পক্ষ থেকে শিক্ষাদান করা ফরয।
এখন প্রশ্ন হতে পারে যে, এ শিক্ষাদানের কাজ কার ওপর ফরয। এছাড়া শিক্ষা কয়েক ধরনের ঃ ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত বা সামাজিক, আনুষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিক ইত্যাদি _ এভাবে এর বিভাগ সমূহ অত্যন্ত ব্যাপক হয়ে দাঁড়ায়। মোটামুটিভাবে এ কাজকে বলা যায় অনিচ্ছাকৃত ত্রুটিযুক্ত মূর্খ বা অজ্ঞকে শিক্ষাদান। সে এমন অজ্ঞ যে, হয় মূল হুকুমটি সম্পর্কেই অবগত নয়, অথবা তা কীভাবে সম্পাদন করতে হবে সে সম্পর্কে জানে না, অথচ তার এ ত্রুটি ইচ্ছাকৃত নয়। এ ধরনের ব্যক্তিকে পুরোপুরি নম্রতার সাথে ও দয়াদর্্রভাবে শিক্ষা দিতে হবে। কারণ, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি কোনোরূপ ইচ্ছাকৃত ত্রুটি করে নি।
এক্ষেত্রে যাকে শিক্ষা দেয়া হবে তার বয়স, তার জীবন পরিবেশের অবস্থা, তার মেধা-প্রতিভা ও গ্রহণ ক্ষমতা অনুযায়ী বিশেষ বিশেষ শিক্ষাদান পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে যাতে সে খুব ভালোভাবে তা শিখতে পারে। যে বাচ্চাটি সবেমাত্র শরীয়তের দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের বয়সে উপনীত হয়েছে, উদাহরণ স্বরূপ ঃ নয় বছরের একটি মেয়েকে শিক্ষাদান ও ২০ বছরের একজন যুবক বা যুবতীকে শিক্ষাদানের পদ্ধতি অভিন্ন হতে পারে না। একইভাবে মানুষে মানুষে মেধা-প্রতিভা ও জ্ঞানের ক্ষেত্রে পার্থক্য আছে। এদিকে লক্ষ্য রেখেই শিক্ষা দিতে হবে। মোদ্দা কথা, শরীয়তের দায়িত্ব-কর্তব্য শিক্ষাদান এক ধরনের “আমর্  বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার”।
আপনারা বলবেন না যে, আমরা আজ পর্যন্ত এ ধরনের “আমর্  বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার”-এর কথা তো শুনি নি। কারণ, “আমর্  বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার”-এর একটি সাধারণ অর্থের মধ্যে অজ্ঞদেরকে দ্বীনী দায়িত্ব-কর্তব্য শিক্ষাদানও শামিল রয়েছে।
অন্য একটি অবস্থা হতে পারে এই যে, অজ্ঞ ব্যক্তি দোষী। কারণ, সে শিখতে পারতো; তার জন্য সে সুযোগ ছিলো, কিন্তু সে উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে বা আলসেমী করেছে। এখানেও তাকে শিক্ষা দেয়া জরুরী। এ ক্ষেত্রে যদি কেউ আপনাকে জানায় বা কেউ না জানালেও আপনি যদি জানতে পারেন যে, এ ব্যক্তি তার দ্বীনী দায়িত্ব-কর্তব্য সম্বন্ধে ওয়াকেফহাল নয় এবং সে আলসেমী করেছে বলে তা শিখতে পারে নি, তখন আপনার কর্তব্য হচ্ছে তাকে শিক্ষা দেয়ার পাশাপাশি এমন একটি পদ্ধতি অনুসরণ করা যাতে সে শেখার ব্যাপারে উৎসাহিত হয়।
প্রথমোক্ত ব্যক্তির অবস্থা ছিলো এই যে, তার জন্য শেখার মতো পরিস্থিতি বা অবস্থা ছিলো না। অন্যদিকে এই দ্বিতীয় ব্যক্তি শিখতে পারতো, কিন্তু আলসেমী করেছে। তাই সে যাতে কথা শুনতে ও শিক্ষা গ্রহণে উৎসাহী হয় সে লক্ষ্যে তার মধ্যে তা শেখার জন্য একটি উদ্দেশ্য তৈরী করতে হবে। অর্থাৎ এখানে তাকে শিক্ষা দেয়ার জন্য একটি জটিল ধরনের শিক্ষাদান পদ্ধতি কাজে লাগাতে হবে যাতে সে তার নিজের কথা বলার জন্য প্রস্তুত হয়। নচেৎ শুধু স্বীয় দায়িত্ব পালনের জন্য যদি তাকে বলা হয়, “এসো, দ্বীনী দায়িত্ব-কর্তব্য শিক্ষা করো তাহলে সে হয়তো বলে বসতে পারে যে, “শিখতে চাই না।” সে ক্ষেত্রে কিন্তু আপনি দায়িত্ব থেকে রেহাই পাবেন না।
এ ফরয দায়িত্ব যখন ব্যক্তি হিসেবে আপনার ওপরে থাকে, অথবা একটি শিক্ষা সংস্থার ওপরে থাকে তখন এতদুভয়ের পরিস্থিতির মধ্যে পার্থক্য হয়। এটা হলো যে অজ্ঞ ব্যক্তি দোষী তার ব্যাপারে “আমর্  বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার”। এ ব্যাপারে তা পালনের পদ্ধতি বেশ জটিলতর।
তৃতীয় ধরনের “আমর্  বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার” হচ্ছে উন্মুক্ত শিক্ষা দান। এটা হচ্ছে তাদের জন্য যারা নিজেদের মতো করে ফরয দায়িত্ব-কর্তব্যের হুকুম আয়ত্ত করেছে কিন্তু তাতে ভুল আছে। এ ধরনের লোকের সংখ্যা কম নয় যারা নামায আদায় করে কিন্তু নামাযের মধ্যে তারা যে কোরআন পড়ে তাতে ভুল করে, যদিও তারা নিজেরা নির্ভুল মনে করেই তা পড়ে। এটা হলো একটি সহজ-সরল উদাহরণ। অন্যদিকে অনেকেই সামাজিক দায়িত্ব ঠিক মতো পালন করছে বলে মনে করছে, কিন্তু তাতে ভুল করছে, যদিও তারা মনে করে যে, তারা সঠিকভাবেই এ দায়িত্ব পালন করছে। এমনকি স্বয়ং “আমর্  বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার”-এর ক্ষেত্রেও একই কথা।
আমার ছোটো বেলার কথা মনে পড়ে। তখন এ ধরনের অনেক কিছু দেখেছি। আজকেও হয়তো এখানে-ওখানে এ ধরনের দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে। অবশ্য আমি যখন ছোটো ছিলাম তখন ছিলো তাগূতী শাসনের যুগ। তখনকার সমাজের সাংস্কৃতিক ও দ্বীনী পরিবেশ এখনকার চেয়ে আলাদা ছিলো। তবে তা সত্ত্বেও তখন এমন কিছু লোক ছিলো যারা অত্যন্ত রূঢ়ভাবে, দাঁতমুখ খিঁচিয়ে, আক্রমণাত্মকভাবে, এমনকি অপমানাত্মকভাবে কাউকে বলতো ঃ “কেন এ কাজ করছো?” এভাবে সে মনে করতো যে, সে সঠিকভাবে তার দায়িত্ব পালন করছে। অথচ সে না জানার কারণে ফরয দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে উল্টো নিজেই গুনাহ্র কাজ করছিলো। সে এভাবে এ কাজটি করে অন্য একটি গুনাহ্ করে ফেলছিলো। তা ছিলো অপর এক ব্যক্তিকে অপমান করা। কারণ, মু’মিনকে অপমান করা হারাম, এমনকি সে মু’মিন যদি গুনাহ্গারও হয়ে থাকে।
আর এখানে গুনাহ্গারের প্রসঙ্গ নয়, বরং অজ্ঞ লোকের প্রসঙ্গ; দৃশ্যতঃ যে অজ্ঞ এবং জাহেলে মোরাক্কাব্ বা জটিল ধরনের অজ্ঞ অর্থাৎ সে জানে না কিন্তু মনে করে যে, জানে। এ ধরনের লোকদেরকে শিক্ষা দিতে হবে। তবে তার পদ্ধতি ইতিপূর্বে যে দুই ধরনের অজ্ঞ লোককে শিক্ষা দেয়ার কথা বলেছি তার পদ্ধতি থেকে আলাদা ও জটিলতর। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সাথে অত্যন্ত নম্রতা সহকারে কথা বলতে হবে যাতে সে শিক্ষা গ্রহণের জন্য ধীরে ধীরে প্রস্তুত হয়।
আমরা এখানে এমন ব্যক্তিকে শিক্ষা দেয়ার কথা বলছি, প্রথমতঃ যে মনে করছে যে, সে ভুল করছে না। যেহেতু সে মনে করছে যে, সে ঠিক মতো আমল করছে, সেহেতু সে সহজেই মেনে নেবে না যে, সে ভুল করছে _ তার আমলের পদ্ধতি ভুল। তাকে শিক্ষাদানের কাজটি এভাবে সূচনা করতে হবে যাতে তার মনে তার কাজে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা সম্পর্কে ধারণা জন্মে। সে যেন নিজেকে প্রশ্ন করে যে, তুমি কি মনে করো না যে, তুমি যে কাজ করছো তাতে ভুল থাকতে পারে?
এ ব্যাপারে একটি দৃষ্টান্তের কথা আপনারা সকলেই শুনে থাকবেন। বর্ণিত আছে যে, হযরত ইমাম হাসান (আঃ) ও হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) যখন যুবক ছিলেন তখনকার কথা; তাঁরা একদিন এক বৃদ্ধ ব্যক্তিকে দেখতে পেলেন যে, তিনি ওযূ করছেন কিন্তু তাঁর ওযূ করায় ভুল ছিলো। তাঁরা চাচ্ছিলেন তাঁকে তাঁর ভুল ধরিয়ে দেবেন, কিন্তু দেখলেন যে, লোকটি বৃদ্ধ, আর বৃদ্ধ লোকেরা অন্যদের তুলনায় অধিকতর সম্মানের পাত্র। ইসলামী আদবের দাবী ছিলো এই যে, তাঁরা এ বৃদ্ধকে অন্যদের চেয়েও বেশী সম্মান দেখাবেন। তখন তাঁরা তাঁর কাছে গেলেন ও সালাম করলেন এবং বললেন ঃ “দেখুন, আমরা দু’জন ভাই; আপনি দেখুন তো আমাদের মধ্যে কার ওযূ অন্যের ওযূর তুলনায় ভালো।”
তাঁরা বৃদ্ধকে বলেন নি যে, তাঁর ওযূ ভুল। বলেন নি যে, “কেন সঠিকভাবে ওযূ করা শিক্ষা করেন নি?” তাঁরা তাঁকে মন্দও বলেন নি, তিরস্কারও করেন নি। বরং তাঁরা তাঁকে সম্মান প্রশর্দন করেন; সালাম করেন। এরপর বললেন, আমরা ওযূ করবো; আপনি দেখুন কার ওযূ বেশী ভালো। তখন বৃদ্ধ তাঁর ওযূ করা বন্ধ রেখে তাঁদের ওযূ করা দেখতে লাগলেন যে, তাঁরা কীভাবে ওযূ করলেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে, এ দুই যুবক তাঁকে শিক্ষা দেয়ার জন্য এ পদ্ধতি অবলম্বন করেছেন। আমার স্মরণশক্তি যদি ভুল না করে থাকে তো উক্ত রেওয়াইয়াত অনুযায়ী, বৃদ্ধ বলেছিলেন ঃ “আমার পিতা-মাতা আপনাদের জন্য কোরবান হোক, আপনারা উভয়ই সুন্দরভাবে ওযূ করেছেন। বরং আমিই ভুলভাবে ওযূ করছিলাম।”
তিনটি ক্ষেত্রেই অর্থাৎ ব্যক্তি নির্দোষ অজ্ঞ হোক, দোষী অজ্ঞ হোক বা জাহেলে মোরাক্কাব বা জটিল ধরনের অজ্ঞ হোক, তার জন্য শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। অতএব, এ ধরনের লোকদেরকে শিক্ষা দিতে হবে। আর শিক্ষাদানের পদ্ধতি হবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বয়স, তার মেধা-প্রতিভা, তার সামাজিক অবস্থান ইত্যাদির প্রতি লক্ষ্য রেখে, যাতে এ কাজে সফল হওয়া যায়।
এমন নয় যে, ব্যক্তি অন্যকে তার ভুল সম্বন্ধে বললো, আর তার এতমামে হুজ্জাত হয়ে গেলো _ দায়িত্ব পালন হয়ে গেলো। ইসলামী সমাজের জন্য এমন ব্যক্তিবর্গ বা সংস্থা সমূহের প্রয়োজন রয়েছে যারা বা যে সংস্থা সমূহ শিক্ষাদানের দায়িত্ব গ্রহণ করবে।
হ্যাঁ, বলেছি যে, ব্যক্তিরা বা সংস্থা সমূহ, যেমন ঃ শিক্ষা বিভাগীয় সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানাদি এ কাজ করবে। এ উভয় ক্ষেত্রেই শর্তাবলী রয়েছে। শিক্ষাদানের দায়িত্বশীল ব্যক্তি হোন, সরাসরি কোনো ব্যক্তি হোন, মক্তবখানার পরিচালক হোন, ক্লাসে পাঠদানকারী শিক্ষক হোন, অথবা একটি প্রতিষ্ঠান হোক, তাকে এ শর্তগুলো মেনে চলতে হবে। তা হচ্ছে, শিক্ষাদানের জন্য এমন পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে যা যাকে শিক্ষা দেয়া হবে তার অবস্থার সাথে সঙ্গতিশীল হবে যাতে সে ভালোভাবে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। এখানে লক্ষ্য হচ্ছে তাকে শিক্ষাদান করা।
বিষয়টি এমন নয় যে, এক ব্যক্তি কাউকে কিছু একটা বলবে আর মনে করবে যে, বেশ, আমি আমার চুড়ান্ত দায়িত্ব পালন করেছি ।
আমরা এখানে তিন ধরনের লোককে শিক্ষা দেয়ার কথা বলেছি; এ তিনটি কাজই “আমর্  বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার”। আর তিনটিই হচ্ছে শিক্ষাদানের কাজ। তিনটিই হচ্ছে অজ্ঞ লোককে শিক্ষাদান, তবে কেউ হচ্ছে নির্দোষ অজ্ঞ, কেউ দোষী অজ্ঞ আর কেউ জাহেলে মোরাক্কাব বা জটিল ধরনের অজ্ঞ। এসব ক্ষেত্রে রূঢ় আচরণ, মারমুখী ভাব, শারীরিকভাবে মারধোর ইত্যাদির কোনো অবকাশ নেই। এখানে দায়িত্ব হচ্ছে শিক্ষাদান করা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা যাতে উত্তমভাবে শিখতে পারে সেজন্য চেষ্টা করতে হবে।
এ তিন ধরনের লোককে শিক্ষাদানের প্রসঙ্গ এখানেই শেষ করছি। এর বাইরে আরো কয়েক ধরনের “আমর্  বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার” আছে যার বাস্তব দৃষ্টান্ত হচ্ছে উপদেশ ও নছিহত। এটাও কয়েক ধরনের এবং প্রতিটি ধরনের দৃষ্টান্ত আলাদা।
আপনি জানতে পারলেন যে, এক ব্যক্তি যদিও এ মসলা সম্পর্কে অবগত যে, অমুক কাজটি গুনাহ্র কাজ, এ সত্ত্বেও সে জেনেশুনে ও স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে সে গুনাহে লিপ্ত রয়েছে। এর কয়েকটি অবস্থা হতে পারে। হতে পারে যে, সে ব্যক্তি গোপনে একা এ গুনাহ্র কাজ করেছে এবং ঘটনাক্রমে আপনি তা জেনে ফেলেছেন। সে চাচ্ছিলো না যে, কেউ বিষয়টি বুঝতে পারুক। সে গোপনে একাকী গুনাহ্র কাজ করেছে, কিন্তু ঘটনাক্রমে আপনি জেনে ফেলেছেন; যেমন ঃ আপনি জানালা দিয়ে দেখে ফেলেছেন। আপনি ঘটনাক্রমে জেনে ফেলেছেন, কিন্তু তার মন চাচ্ছিলো না যে, আপনি জানতে পারুন। আর যদি সে বুঝতে পারে যে, আপনি জেনে ফেলেছেন তাহলে সে লজ্জা পাবে।
এখানে আপনি “নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার” করবেন, “আমর্  বিল্ মা’রূফ্” করবেন। তবে আপনাকে এমনভাবে তা করতে হবে যাতে সে লজ্জা না পায়। কারণ, মু’মিনকে লজ্জা দেয়া মানে তাকে কষ্ট দেয়া, আর তা হারাম। অতএব, আপনাকে তার সাথে সুকৌশলে কথা বলতে হবে। সাধারণভাবে কথা বলতে হবে যাতে সে বুঝতে না পারে যে, আপনি তার গুনাহে লিপ্ত হবার ব্যাপারে জানেন। তার গোপন কথা অন্যদের কাছে প্রকাশ করার তো প্রশ্নই ওঠে না যার ফলে অন্যরা বলবে যে, সে গুনাহ্ করেছে।
এমনও হতে পারে যে, এক ব্যক্তি গোপনে কোনো গুনাহ্ কাজ করলো, আর আপনি তা দেখে ফেলে তাকে সরাসরি তিরস্কার করলেন। এর ফলে সে লজ্জা পেলো; এভাবে যে আপনি তাকে লজ্জা দিলেন, এটা একটা গুনাহ্র কাজ। এরপর আপনি অন্যদেরকে বললেন যে, আমি দেখেছি, অমুক ব্যক্তি অমুক গুনাহ্র কাজ করেছে। আপনি অন্যদের সামনে এমনভাবে বললেন যে, তারাও বুঝলো, ঐ ব্যক্তি অমুক গুনাহ্ করেছে। আপনি এমনভাবে অন্যদের সামনে “নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার” করলেন যার ফলে লোকেরা বুঝতে পারে যে, সে গুনাহে লিপ্ত হয়েছিলো। এখানে আপনি একটি কবীরাহ্ গুনাহ্ করলেন। সে হয়তো একটি ছগীরাহ্ গুনাহ্ করেছিলো, কিন্তু আপনি একটি ফরয দায়িত্ব পালন করতে এসে কবীরাহ্ গুনাহ্ করে ফেললেন।
অতএব, কেউ যদি গোপনে কোনো গুনাহের কাজ করে, এমনকি যদি তা কবীরাহ্ গুনাহ্ও হয় সে ক্ষেত্রে প্রথমতঃ আপনার অধিকার নেই যে আপনি তা অন্যদের সামনে ফাঁস করে দেবেন, কাউকে বলে দেবেন। এমনকি যদি বাপের সামনে ছেলে থাকে, বা মায়ের সামনে মেয়ে থাকে, তাহলেও বলা যাবে না। কারণ, তাহলে সে লজ্জা পাবে; তার ইজ্জত-আব্রুর ক্ষতি হবে। আর মু’মিনের ইজ্জত-আব্রুর ক্ষতিসাধন করা হারাম। কেবল ব্যতিক্রমী ব্যাপারের ক্ষেত্রে, যেমন ঃ পিতার কাছে, মাতার কাছে বা শিক্ষকের কাছে বলা ছাড়া যদি তাকে সংশোধনের জন্য অন্য কোনো পথ না থাকে, সে ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে। অর্থাৎ সে যদি কিছুতেই গুনাহ্ থেকে বিরত হতে প্রস্তুত না থাকে, তা যে কোনো কারণেই হোক, গুনাহ্টি তার অভ্যাসে পরিণত হওয়ার কারণেই হোক, বা সে বেপরোয়া হয়ে যাওয়ার কারণেই হোক, তাকে সংশোধনের একমাত্র পন্থা যদি হয় পিতা, মাতা বা শিক্ষকের কাছে বলা _ যিনি ধীরে ধীরে তাকে গুনাহ্ পরিত্যাগে ও তার কাজের সংশোধনে তাকে বাধ্য করবেন, তখন তাঁকে বলতে হবে।
অন্যকে জানানো যদি তাকে সংশোধনের একমাত্র পন্থা হয় কেবল সে ক্ষেত্রেই বলা জায়েয আছে। তবে যতক্ষণ সম্ভব আপনি নিজেই তাকে সংশোধনের চেষ্টা করুন, “নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার” করুন, তবে সে ক্ষেত্রে তা এমনভাবে করুন যাতে সে বুঝতে না পারে যে, আপনি তার গুনাহ্র ব্যাপারে জানেন, যাতে আপনার সামনে একজন মু’মিনের ইজ্জত-আব্রু নষ্ট না হয়। কারণ, আল্লাহ্ তা’আলা তা পসন্দ করেন না। আল্লাহ্ তা’আলা হলেন সাত্তারুল্ ‘উয়ুব্ অর্থাৎ দোষসমূহ গোপনকারী। তাই কোনো মু’মিনের দোষ অন্যদের সামনে ফাশ হলে বা তার ইজ্জত-আব্রু বিনষ্ট হলে তিনি সন্তুষ্ট হন না।
অনেক লোকই এ ব্যাপারে খুবই উদাসীন। তারা মনে করে যে, কেউ কোনো গুনাহ্ করলে, বিশেষ করে কবীরাহ্ গুনাহ্ করলে তা ফাশ করে দিতে হবে, আইন-শৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে, তাকে রাষ্ট্রীয় শাস্তির সম্মুখীন করতে হবে এবং শরয়ী শাস্তি কার্যকরযোগ্য অপরাধ হলে তার ওপর সে শাস্তি কার্যকর করাতে হবে। অথচ প্রকৃত পক্ষে তা ঠিক নয়। এমনকি শরয়ী শাস্তি কার্যকরযোগ্য অপরাধ হলেও আপনি তা জানতে পারলে আপনার তা ফাঁস করা উচিৎ নয়, যদি না ঘটনাক্রমে একত্রে চার ব্যক্তি তা দেখে ফেলে। কেবল তখনি আপনাদের জন্য তা বলা বৈধ হবে। আপনার তো জানাই আছে যে, তা শরয়ী শাস্তি কার্যকরযোগ্য অপরাধ। যদি তিনজন মু’মিন এ ব্যাপারে সাক্ষ্য দেন, কিন্তু চতুর্থ সাক্ষী না থাকে তাহলে ঐ তিন ব্যক্তির ওপর শরয়ী শাস্তি কার্যকর হতে হবে।
ইসলাম এটাই চাচ্ছে যে, লোকদের গোপন বিষয় ফাঁস না হোক, কারো ইজ্জত-আব্রু নষ্ট না হোক। কেলেঙ্কারী যদি এমন এক পর্যায়ে পেঁৗছে যে, চারজন ন্যায়বান ও সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তি তা দেখে ফেলেন এবং সে দেখা যদি এমন হয় যে, তাতে সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ না থাকে তখন অবশ্যই পাপকর্মে লিপ্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শরয়ী শাস্তি কার্যকর হতে হবে; এ ক্ষেত্রে খোদায়ী দণ্ডবিধির প্রয়োগ বন্ধ রাখা ঠিক হবে না। কিন্তু যতদূর সম্ভব চেষ্টা করতে হবে যে, লোকদের গোপন ব্যাপার যেন ফাশ না হয়, এমনকি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকেও বলা ঠিক নয় যে, আমি জানি তুমি এই কাজ করেছো। কারণ, তাহলে সে লজ্জা পাবে।
এ হচ্ছে এক ধরনের অবস্থা। এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিটি উচ্ছৃঙ্খল বা বেপরোয়া নয়। যদিও সে গোপনে একটি গুনাহ্ করেছে, কিন্তু কেউ যদি তা বুঝতে পারে তাতে তার অবস্থায় তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটে না। অন্যদিকে উচ্ছৃঙ্খল বা বেপরোয়া লোকও আছে যারা গোপনীয়তার ধার ধারে না। আপনি তাদের পাপকর্ম সম্পর্কে জেনে ফেলায় তারা মনে কষ্ট পায় না। এতদসত্ত্বেও আপনাকে এমন এক পন্থায় “নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার” করতে হবে যাতে যারা বিষয়টি জানে না অযথাই যেন তারা জেনে না ফেলে। আপনি গোপনে ব্যক্তিগতভাবে তার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলুন; অন্য লোকদের মাঝে বা অন্য কোনো ব্যক্তির কাছে তার ব্যাপারে কথা বলবেন না। এমনকি সে যদি উচ্ছৃঙ্খল বা বেপরোয়াও হয় তথাপি আপনি কেন তার নির্লজ্জতা প্রচারিত হওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করবেন?
এ হচ্ছে সেই ধরনের লোকদের কথা যারা তাদের পাপকে প্রকাশ হতে দেয় না এবং পসন্দ করে না যে, তাদের পাপের কথা প্রকাশ পাক। তাই সে গোপনে এ কাজ করেছে, অতএব, আপনিও তার গোপনীয়তা রক্ষা করুন। সেই সাথে কোনো না কোনোভাবে তাকে উপদেশ দিন; জানিয়ে দিন যে, তার এ কাজ করা অনুচিৎ হয়েছে। তবে সরাসরি তাকে লক্ষ্য করে নয়, সাধারণভাবে বলুন। যেমন ঃ এ সংক্রান্ত কোনো হাদীছ উল্লেখ করুন, কোনো কাহিনী উল্লেখ করুন যা থেকে সে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। অথবা তাকে কোনো ওয়াযের মাহফিলে নিয়ে যান। তাকে এমনভাবে উপদেশ দিন যাতে তার মান-ইজ্জতের হানি না হয়।
কিন্তু এমন লোকও আছে যে প্রকাশ্যে পাপাচার করে। অর্থাৎ সে অন্যদের সামনেই পাপাচারে লিপ্ত হয় এবং ভাব দেখায় যে, এটা কিছুই নয়। হ্যা, এ ধরনের লোকের সংশোধনের ব্যাপারটা অন্য লোকদের সংশোধনের তুলনায় বেশ কঠিন কাজ। তবে তা সত্ত্বেও তার সাথে আচরণের বিভিন্ন পর্যায় রয়েছে। এখানে তার গোপনীয়তা রক্ষা করা, বা তাকে গোপনে বলা বা এমনভাবে বলা যাতে সে বুঝতে না পারে যে, আপনি তার পাপাচারের বিষয় জানতে পেরেছেন _ তার সাথে এ ধরনের আচরণের র প্রশ্নই ওঠে না। কারণ, সে তো তার পাপকর্ম লোকদের সামনেই সম্পাদন করছে; সে নিজেই নিজের ইজ্জত-সম্ভ্রম নষ্ট করছে। আপনি এর সাথে কিছুই যোগ করেন নি। তার বিরুদ্ধে কিছু না বললেও তার ইজ্জত-আব্রু বৃদ্ধি পারে না। কারণ, সে অন্য লোকদের সামনে পাপাচারে লিপ্ত হতে দ্বিধা করে না।
তবে এ ক্ষেত্রেও আপনাকে “আমর্  বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার”-এর দায়িত্ব পালনের জন্য কয়েকটি পর্যায় অতিক্রম করতে হবে। প্রথমে আপনি ভদ্র-নম্র ভাষায় তাকে উপদেশ দিন এবং গুনাহ্র কাজ পরিত্যাগ করতে বা অমুক ফরয কাজটি আঞ্জাম দিতে বলুন। তার কাজের পার্থিব ও পারলৌকিক ফলাফলের কথা উল্লেখ করুন যাতে সে গুনাহ্ পরিত্যাগে উৎসাহী হয়। এমনকি আপনার কথায় যদি কোনো প্রভাব না হয় সে ক্ষেত্রে তাকে কথা ছাড়া অন্যভাবেও উৎসাহিত করুন।
অবশ্য এটা যে কারো কাজ নয়। কিন্তু অনেকে আছেন আর্থিক দিক থেকে বেশ সামর্থ্যবান বা অন্য কোনো বিশেষ সুবিধাজনক অবস্থা ও অবস্থানের অধিকারী; তাঁরা সংিশ্লষ্ট ব্যক্তিদেরকে আর্থিক সাহায্য দিয়ে প্রভাবিত করতে পারেন। তাকে খাওয়ার দাওয়াত দিতে পারেন, ভালোভাবে আপ্যায়িত করতে পারেন। কোথাও সফরে যাওয়ার সময় সাথে নিয়ে যেতে পারেন। এ বিষয়টি নির্ভর করে লোকটি কী ধরনের গুনাহ্ করেছে এবং যিনি “আমর্  বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার”-এর দায়িত্ব পালন করবেন তিনি তার সম্পর্কে কতটুকু কী জানতে পেরেছেন তার ওপর।
এ ক্ষেত্রে “আমর্  বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার”-এর কাজ এভাবে করতে হবে ঃ প্রথমে ধীরে ধীরে, নম্রভাবে, ভদ্রভাবে, আন্তরিকতার সাথে ও উৎসাহিত করার মাধ্যমে তাকে পথে আনার চেষ্টা করতে হবে। এতে কাজ না হলে দ্বিতীয় পর্যায়ের আশ্রয় নিতে হবে যা অপেক্ষাকৃত কঠিনতর। এ পর্যায়ে তার সামনে মুখে বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে তুলুন, গোমড়ামুখো হোন। এর আগে আপনাদের সামনে এ সংক্রান্ত যে সব রেওয়াইয়াত উল্লেখ করেছি তা স্মরণ করুন। পাপাচারীদের মধ্যকার আবেদ লোকটিকে ধ্বংস করার কারণ ছিলো এই যে, আল্লাহ্র জন্য রাগে ও ক্রোধে তার চেহারার রং পরিবর্তিত হয় নি। এটা এরূপ ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। যখন দেখলেন যে, মিষ্টি কথাকে সে কোনোই গুরুত্ব দিচ্ছে না, তখন তার সামনে গোমড়ামুখো হন, রাগ দেখান, ক্রুদ্ধ হোন এবং কঠোর ও রূঢ় আচরণ করুন। এ ক্ষেত্রেই বলা হয়েছে ঃ তাদের সাথে রূঢ় ভাষায় কথা বলুন। এখানেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সাথে কঠোরতার সাথে ও রূঢ়ভাবে আচরণ করতে হবে। তার সাথে হুকুমের ভাষায় কথা বলতে হবে। এ পর্যায়ে এসে দৃঢ়তার সাথে ও কঠোরতার সাথে পূর্ণাঙ্গ অর্থে “আমর্  বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার”-এর দায়িত্ব পালন করতে হবে।
এ পর্যায়ে নির্দেশের ভঙ্গীতে তাকে বলুন ঃ “এ কাজ করো না।” এরপরও যদি দেখতে পান যে, আপনার কথায় কাজ হচ্ছে না কেবল তখনি আপনি তাকে হুমকি দিতে পারেন যে, “যদি এ কাজ না ছাড়ো তাহলে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষকে জানাবো।” অতীতে এসব বিষয় দেখার জন্য “মুহতাসিব্” নামে আলাদা কর্তৃপক্ষ ছিলো; বর্তমানে এ দায়িত্ব আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষের। আপনি তাকে বলুন যে, সে যদি পাপাচার পরিত্যাগ না করে তাহলে তার বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিকট অভিযোগ দায়ের করবেন। তাদের কাছে অভিযোগ দায়ের করলে তারা আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবেন এবং প্রয়োজন মনে করলে তাঁরা তাকে গ্রেফতার করবেন, রাষ্ট্রীয় আইনে নির্ধারিত শাস্তি প্রদান করবেন এবং প্রয়োজনবোধে কারাগারে প্রেরণ করবেন। তার ব্যাপারে কী করতে হবে তা আইন দ্বারাই নির্ধারিত হবে।
কিন্তু প্রথমেই অর্থাৎ তাকে পাপকর্মে লিপ্ত দেখামাত্রই সাথে সাথে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করবেন এটা ঠিক নয়। বরং প্রথমে ভদ্রনম্র ভাষায় উপদেশ দিতে হবে, তাতে কাজ না হলে কঠোর ভাষা ব্যবহার করতে হবে। তাতেও কাজ না হলে তাকে এই বলে হুমকি দিতে হবে যে, তুমি এ কাজ বন্ধ না করলে তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করবো। এতেও যদি কাজ না হয় কেবল তখনি তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করুন।
অর্থাৎ এভাবে ক্রমান্বয়িক পর্যায়গুলো মেনে চলুন। অযথা কারো সাথে কঠোর আচরণ করা উচিৎ হবে না। অযথা কারো সাথে অশোভন আচরণ করা, তার সম্মানহানি ঘটানো উচিৎ নয়। তবে যে পর্যায়ে উপনীত হলে কঠোর আচরণ করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকে না সে পর্যায়ে অবশ্যই কঠোর আচরণ করতে হবে। ভুলে যাওয়া উচিৎ নয় যে, আমাদের বেশীর ভাগ সমস্যারই উদ্ভব ঘটে আচরণের ক্ষেত্রে চরম পন্থা ও শিথিল পন্থা থেকে। ক্ষেত্র বিশেষে কেউ এই দিকে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত ঝুঁকে পড়ে ও চরম পন্থার আশ্রয় নেয় এবং ক্ষেত্র বিশেষে কেউ ঐ দিকে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত ঝুঁকে পড়ে ও শিথিল পন্থার আশ্রয় নেয়। আর বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই এমনটি ঘটে পারস্পরিক প্রতিক্রিয়ার ফলে। কিছু লোক যখন খুবই শিথিলতা দেখায় তখন তার প্রতিক্রিয়ায় কিছু লোক চরমপন্থী হয়ে ওঠে। এভাবে অযৌক্তিক আচরণের ফলে প্রায়শঃই মূল কাজটি উপেক্ষিত হয়ে পড়ে।
কিন্তু ইসলাম সব কিছুকেই তার নির্দিষ্ট সীমারেখার মধ্যে স্থান দিয়েছে। তাই সম্ভব হলে নম্রতা ও আন্তরিকতার সাথে আচরণ করতে হবে, কিন্তু তাতে কাজ না হলে এবং সমাজের বৃহত্তর স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেয়া যাবে না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ভালো আচরণে সাড়া না দিলে সমাজের স্বার্থকে রক্ষা করতে হবে। ইসলামী সমাজের কখনো এরূপ হওয়া উচিৎ নয় যে, সেখানে পাপাচারের প্রতি দয়া দেখানো হবে। বরং এরূপ সমাজে অবশ্যই সামাজিক পবিত্রতার সীমারেখার হেফাযত করতে হবে। ইসলামী সমাজকে এরূপ হতে হবে যে, কেউ যদি কখনো গুনাহ্ করে ফেলে তাহলে যেন সে লজ্জিত হয়। এটা যদি মেনে চলা না হয় তাহলে পরে অন্য বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়।
মোদ্দা কথা, প্রথমে যা করতে হবে তা উপদেশ ও নছিহতের পর্যায়ভুক্ত। এরপর সব শেষে আসবে আদেশের পালা। কারণ, সে উপদেশ ও নছিহতের সীমারেখার বাইরে চলে গেছে। উপদেশ ও নছিহত মানে কাউকে কথার দ্বারা ভালো কাজ করার জন্য উৎসাহিত করা এবং তা সম্পাদনের পন্থা ও তা পরিত্যাগের ক্ষতি সমূহ তাকে জানিয়ে দেয়া। খারাপ কাজের বেলা এর বিপরীত। অন্যদিকে শিক্ষা উপস্থাপন হচ্ছে কোনো কাজের ভালো ও মন্দ পরিণাম উল্লেখ করা যাতে সে কাজটি করা বা পরিত্যাগ করা সম্বন্ধে উৎসাহিত হয়, আগ্রহী হয়। যেন তার মধ্যে একটি ঝোঁকপ্রবণতার সৃষ্টি হয় যে, ভালো কাজ সম্পাদনের মাধ্যমে সে আরো ওপরে উঠবে। কিন্তু আদেশ হচ্ছে এভাবে বলা যে, “আমি বলছি, এটা করো।”
এভাবে ব্যক্তি একজন মুসলমান হিসেবে, সমাজের একজন সদস্য হিসেবে সামাজে তার দ্বীনী দায়িত্ব পালন করবে। আমি বলছি না যে, অমুক ব্যক্তি এটা বলবে। বরং সকল মুসলমানেরই এটা বলা উচিৎ। কারণ, বিষয়টি আর এমন পর্যায়ে নেই যে, আপনি তার কাছে বসে তাকে উপদেশ দেবেন, নছিহত করবেন। এ পর্যায়ে একটি বাক্যের দ্বারা দায়িত্ব পালন করবেন। এটা হচ্ছে “আমর্  বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার”-এর অকাট্য দৃষ্টান্ত যার মধ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ওপর প্রাধান্য ও আধিপত্য খাটানোর ভাবধারা নিহিত আছে, তবে তাতে বাড়াবাড়ি থাকবে না। প্রাধান্য ও আধিপত্য খাটানোর মানে হচ্ছে এই যে, উচ্চতর অবস্থানের অধিকারী ব্যক্তি অপর পক্ষকে বলবে ঃ “এ কাজ করো।”
এসব পর্যায়ের কাজ আঞ্জাম দেয়ার পরেও যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার পাপ কাজ অব্যাহত রাখে তখন একটি নতুন পর্যায় এসে হাযির হয়। এ পর্যায়ে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয় তাতে কখনো অবস্থা এমন হতে পারে যে, ব্যক্তি তার শরীয়ত বিরোধী কাজ, ইসলামী সমাজের স্বার্থ বিরোধী কাজটিকে অত্যন্ত সহজভাবে, ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে এবং ধৃষ্টতা ও বেআদবী সহকারে আঞ্জাম দেয়, কিন্তু ক্ষেত্র বিশেষে হয়তো বিষয়টি এমন নয়। এ অবস্থায় হয়তো কাজটি অত্যন্ত জটিল পরিকল্পনার ভিত্তিতে হতে পারে। কাজটি হয়তো কোনো গোষ্ঠীর পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটেছে।
বিষয়টি এমন নয় যে, এক ব্যক্তি লোকদের সামনে বেআদবী করেছে, ধৃষ্টতা দেখিয়েছে ও গুনাহ্র কাজ সম্পাদন করেছে। বরং এর পিছনে পরিকল্পনা কাজ করেছে। কিছু লোক এ উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা তৈরী করেছে যাতে ইসলাম পরাভূত হয়, ইসলামী শাসন ব্যবস্থা পরাভূত হয় ও তার কার্যকরিতা হারিয়ে ফেলে এবং এত বেশী পরিমাণে নোংরা কাজ করা হয় যাতে জনগণের নিকট তা সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
এটা একটা পরিকল্পিত ব্যাপার। এটা এমন ব্যাপার নয় যে, এক ব্যক্তি প্রকাশ্যে পাপাচার করেছে। এর পিছনে হয়তো সমাজকে বিভিন্ন দিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত করার উদ্দেশ্য রয়েছে। আর যারা এ কাজ করে তারা ইসলামকে পসন্দ করে না। তারা হয় মুনাফিক _ যাদের অন্তরের অন্তঃস্থলে ঈমান নেই, অথবা তারা বিজাতীয়দের কাছ থেকে টাকাপয়সা খেয়ে তাদের দালাল হিসেবে কাজ করছে এবং যেকোন কারণেই হোক সমাজ থেকে ইসলামের প্রাধান্য বিলুপ্ত করতে চায়।
এ পর্যায়ে ইসলামী সমাজের ক্ষতি বিভিন্নভাবে করা হতে পারে এবং তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা অপরিহার্য। এটা হয়তো একটি সাংস্কৃতিক কাজ হতে পারে। এটা হয়তো একটি অর্থনৈতিক কাজ হতে পারে। এটা হয়তো একটা শিল্পকলার কাজ হতে পারে। এটা হয়তো একটা চারিত্রিক ব্যাপার হতে পারে অর্থাৎ বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে যা কিছু চারিত্রিক বিষয় হিসেবে পরিগণিত হতে পারে এটা তার কোনো বিষয়কে কেন্দ্র করে করা হতে পারে। এমনকি তা সামরিক ব্যাপারও হতে পারে।
এ পর্যায়ে এসে আর তা ব্যক্তিগতভাবে আঞ্জাম দেয়ার উপযোগী দায়িত্ব থাকে না, বরং তা ব্যক্তিগতভাবে আঞ্জাম দেয়ার উপযোগী সহজ ধরনের “আমর্  বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার”-এর সীমারেখার বাইরে চলে যায়। এ পর্যায়ে এসে বিভিন্ন ধরনের সংগ্রাম ফরয হয়ে যায়। এ পর্যন্ত আমরা যে সব ধরনের “আমর্  বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার”-এর সাথে পরিচিত হয়েছি এটা সে পর্যায়ের বিষয় নয়। এ বিষয়ে আচরণগত মসলা-মাসায়েলের গ্রন্থ বা রেসালায়ে ‘আমালী-তে কিছু লেখা হয় নি।
এরই নাম হচ্ছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। এটা কোনো ব্যক্তি বিশেষের কাজ নয়। এটা খুব সহজ-সরল পদ্ধতিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে “করো না” বলার মতো বিষয় নয় এবং তা বলা হলে তাতে কোনো ফল পাওয়া যাবে না। এ সাংস্কৃতিক আগ্রাসন হচ্ছে একটি জটিল ধরনের শয়তানী কাজ, পরিকল্পিত কাজ। অতএব, এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে সুচিন্তিত পরিকল্পনার ভিত্তিতে। এর বিরুদ্ধে লোকদের সংঘবদ্ধ ও সুসংগঠিত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট পাপাচারের অবস্থা অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে যাতে এ বিশ্বাসঘাতকতাকে প্রতিহত করা যেতে পারে।
এটার পিছনে হয়তো অর্থনৈতিক লক্ষ্য থাকতে পারে। আপনারা ইরানের তামাক বর্জন আন্দোলনের কথা এবং এ ধরনের আরো অনেক ঘটনা শুনেছেন। অন্য অনেক ক্ষেত্রেও এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। আমি এ ব্যাপারে উদাহরণ বৃদ্ধি করে আপনাদের সময় নিতে চাই না।
যারা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তাঁরা যদি মনে করেন যে, কোনো ঘটনার পিছনে ইসলামের দুশমনদের ষড়যন্ত্র রয়েছে যার উদ্দেশ্য হচ্ছে মুসলমানদের অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধন করা, যেমন, বর্তমান পরিস্থিতিতে যার একটি দৃষ্টান্ত হতে পারে তেলের দাম নীচে নামিয়ে আনা তখন এটাকে সে দৃষ্টিতেই দেখতে হবে।
এটা কোনো সহজ কাজ নয় যা আপনার ও আমার পক্ষে বুঝে ওঠা সম্ভব হতে পারে যে, এটা কী ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা এবং কীভাবে এর বিরুদ্ধে মোকাবিলা করা যেতে পারে। একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুনকার _ যা বৈশ্বিক ও আন্তর্জাতিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এবং ব্যাপক হিসাব-নিকাশের ভিত্তিতে তৈরী করা হয়েছে, তা এমনকি কেবল একটি দেশের পক্ষ থেকে করাও সম্ভব নয়, বরং বিভিন্ন দেশ থেকে শয়তানরা একত্রিত হয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা করেই মুসলমানদের ওপর এত বড় একটা ক্ষতি চাপিয়ে দিতে পারে।
কী করেছিলো তারা যে, আমাদের ত্রিশ ডলারের তেলের দাম কমে আট ডলারে দাঁড়ালো? তারা যদি আরো সামান্য কিছুটা কন্ট্রোল করতে পারতো তাহলে তেল বিক্রি করে তেল উত্তোলনের খরচও উঠতো না। এ-ও একটি মুনকার যার বিরুদ্ধে মোকাবিলা করা প্রয়োজন। সমাজে আমরা যে সব মুনকার দেখি তার বেশীর ভাগের তুলনায়ই এটি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এর ক্ষতির শিকার সকল মুসলমান, একটি দেশের সকল মানুষ। এটি মুসলমানদের বাজারে মুসলমানদের ওপর কাফেরদের অধিপত্য প্রতিষ্ঠা বা স্থায়ী করে দেয়। তবে “আল্লাহ্ কখনো মু’মিনদের ওপর কাফেরদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে দেবেন না।” এমনকি তা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে হলেও।
ওরা ওদের অশুভ লক্ষ্য মুসলানদের ওপর চাপিয়ে দেয়। এমতাবস্থায় কী করণীয়? এক্ষেত্রে বিষয়টি এমন নয় যে, আমি একা একটি কাজ সম্পাদনের সিদ্ধান্ত নেবো। বরং এর পরিবর্তে মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে এবং করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর তা-ও কোনো সহজ সিদ্ধান্ত নয়। এ ব্যাপারে পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রয়োজন রয়েছে, বিশেষজ্ঞ সুলভ পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে। দেখতে হবে যে, কোন কোন পথে দুশমনদের এ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে মোকাবিলা করা যেতে পারে। এ কাজের জন্য বিশেষ ধরনের বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন; তাঁরা যথেষ্ট সময় নিয়ে বসে পর্যালোচনা ও চিন্তা-গবেষণা করে এর সমাধান বের করবেন এবং তা কার্যকর করার জন্য বিস্তারিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করবেন। আর বাস্তবায়নের সময় সবাই একযোগে তা বাস্তবায়ন করবেন।
কোনো কোনো সময়, উদাহরণ স্বরূপ, হয়তো সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে যে, আমরা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক বর্জনের আশ্রয় নেবো; কোনো কোনো পণ্য বয়কট করবো। ধরুন, বলা হলো ঃ “কেউ আমেরিকান পণ্য কিনবেন না।” এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হলে তখন তা মেনে চলা সকলের জন্য ফরয। তখন আমেরিকান পণ্য ক্রয় করা হারাম হয়ে যাবে, যদিও সেই একই পণ্য অন্য কোনো দেশ থেকে দ্বিগুণ পরিমাণে কেনা হয়। এ কারণে ক্ষতিও স্বীকার করতে হতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সকল মুসলমানের জন্য ক্ষতির কারণ বিশ্বাসঘাতকতা সুলভ এ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে মোকাবিলা করার লক্ষ্যে “নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার” হিসেবে এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কাজ করা আপনাদের সকলের জন্য ফরয হয়ে যাবে। এভাবে সমাজে “নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার” এ পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে।
সামরিক বিষয়াদি তো আরো বেশী সুস্পষ্ট। শত্রুরা ষড়যন্ত্র করে, চক্রান্ত করে সীমান্তে অনুপ্রবেশ করে। তারা তাদের এজেন্টদের অনুপ্রবেশ ঘটায় এবং তারা সন্ত্রাসী হামলা চালায় ও গুপ্তহত্যার আশ্রয় নেয়। অথবা শত্রুর এজেন্টরা সশস্ত্র বাহিনী সমূহে অনুপ্রবেশ করে। হয়তো এমন হাজারো সামাজিক সমস্যা আছে যা এ অধমের মাথায়ও আসে না তা শত্রুর ষড়যন্ত্রের ফল হয়ে থাকবে; বিশেষজ্ঞগণ এ বিষয়গুলো নিয়ে পর্যালোচনা ও গবেষণা করতে পারেন।
মোদ্দা কথা, ক্ষেত্র বিশেষে এমন ধরনের গুনাহ্ রয়েছে যার মোকাবিলা করা দরকার, কিন্তু সে ব্যাপারে একমাত্র পন্থা এই নয় যে, আমি একাই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবো। এক্ষেত্রে প্রথমেই বিশেষজ্ঞগণকে বসে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করতে হবে, পরামর্শ করতে হবে এবং তা মোকাবিলার জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। এরপর ইসলামী সরকারের পক্ষ থেকে জনগণকে জানাতে হবে যে, সবাই যেন এ পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করেন। এখানে এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমল করা সকল জনগণের জন্যই ফরয। এটা একদিকে যেমন “নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার” হিসেবে ফরয, তেমনি ইসলামী সরকারের হুকুমের আনুগত্য হিসেবে তথা মুসলমানদের মুজতাহিদ শাসকের হুকুমের আনুগত্য হিসেবেও ফরয।
কিন্তু বিষয়টির অন্য একটি রূপও হতে পারে। যে সব জায়গায় অর্থনৈতিক ক্ষতি চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে বা এ জাতীয় অন্য কোনো ক্ষতি চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে, সেরূপ কোনো একটি জায়গায়, ধরুন, কোনো একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপে, যদি মুজতাহিদ শাসক বা ইসলামী সরকার না থাকে, কোনো মুসলিম সরকার না থাকে, সেখানকার জন্য এর ফয়সালাও ভিন্ন রকম হবে। তেমনি ধরুন, কোনো ইসলামী দেশে কোনো এক সময় যদি ইসলামী সরকার না থাকে, যেমন ধরুন, ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের পূর্ববর্তী ইরানের অবস্থা, তখন দেশ ইসলামী ছিলো, কিন্তু শাহ্ ছিলেন ভিন্ন ধরনের লোক, ফলে সরকার ইসলামী ছিলো না। ক্ষেত্র বিশেষে এমন অবস্থাও হতে পারে যে, সরকার ইসলামী হোক বা না হোক, যে কোনো কারণেই হোক তার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়।
অবস্থা যদি এই হয় যে, সরকার ইসলামী, অথচ শত্রুর অর্থনৈতিক ষড়যন্ত্রের মোকাবিলায় কিছু করতে পারছে না, সে ক্ষেত্রে করণীয় নির্ধারণ করা অধিকতর কঠিন ব্যাপার। আমি এ ব্যাপারে খুব বেশী খোলামেলাভাবে কিছু বলতে চাই না। ধরুন, একদল অর্থপূজারী দেশের অভ্যন্তরে অর্থনৈতিক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। তারা প্রচারের মাধ্যমে অথবা দেশের অর্থনৈতিক উৎস সমূহ, ব্যবসা-বাণিজ্য, খনিজ সম্পদ ও অন্যান্য জিনিস এবং সরকারকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শত্রুদের সিদ্ধান্ত সমূহ মেনে চলতে বাধ্য করে। এমনকি তারা সরকারী পদসমূহে পর্যন্ত অনুপ্রবেশ করে। এ ক্ষেত্রে যে মন্ত্রী সিদ্ধান্ত নেবেন, যে পরিষদ বা কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে, সেখানে শত্রুর এমন এজেন্ট আছে যাদের ইসলামের জন্য কোনো মায়া-মহব্বত নেই; তারা কেবল নিজেদের স্বার্থের চিন্তায় আছে। তারা বলে, এটা হবে না; এটা সম্ভব নয়। কিন্তু একটু চিন্তা করলেই দেখতে পাবেন যে, তারা যে কাজের কথা বলছে হওয়ার নয়, আসলে তা হওয়া সম্ভব।
যদি এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হয় যে, একটি ইসলামী দেশের বা একটি শহর বা একটি অঞ্চলের অর্থনীতির বিরুদ্ধে, সেখানকার আর্থিক বিষয়াদির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে, তখন জনগণ নিজেরাই যদি সংগ্রামের পরিকল্পনা করতে পারে তাহলে তাদের জন্য এ অর্থনৈতিক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা তাদের জন্য ফরয। এখানে তো আর নরহত্যার কোনো ব্যাপার নয়; এখানে বিষয়টি হচ্ছে এই যে, সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এ অর্থনৈতিক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে মোকাবিলা করতে হবে, দুশমনকে নতজানু করিয়ে ছাড়তে হবে, তার ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দিতে হবে। এখানে ইসলামী সরকার কিছু করতে পারছে না। তা এ না পারার পিছনে কোনো কারণ আছ বা নেই _ যা-ই হোক না কেন, কিছু করতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে অবশ্য আরেক ধরনের একটি সম্ভাবনা আছে _ যা আমি এখানে বলতে চাচ্ছি না। তবে আপনারা আপনাদের সূক্ষ্ম অনুভূতিশক্তির সাহায্যে নিজেরাই হয়তো তা বুঝতে পারছেন যে, যখন কিছু করা সম্ভব তথাপি কেন তা করছে না।
আমরা ধরে নিচ্ছি যে, এ ধরনের পরিস্থিতিতে ইসলামী সমাজ থেকে বিপদ দূরীভূত করার জন্য স্বয়ং জনগণকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। তাদেরকে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে এবং গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এখানে কিন্তু জনগণের জান, মাল ও ইজ্জত-আব্রূর বিরুদ্ধে হামলা হয় নি। এটা হয়তো সমাজের জন্য একটি অর্থনৈতিক ক্ষতি নিয়ে এসেছে। এটা সাময়িক ক্ষতি হতে পারে, কিন্তু পরবর্তীকালে লাভের দ্বারা এ ক্ষতি পুষিয়ে যেতে পারে। তবে এ ক্ষতির প্রভাবে দুশমনরা লাভবান হচ্ছে। মোটের ওপরে কথা হচ্ছে, এরূপ অর্থনৈতিক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা ফরয। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় এই যে, আমরা এ ধরনের বিষয়াদি সঠিকভাবে পর্যালোচনা করি নি, এ ধরনের সমস্যাবলীকে সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করি নি। আমরা সহজ ব্যক্তিগত বিষয়াদি নিয়ে চিন্তা করাকেই যথেষ্ট মনে করেছি।
অতএব, ইসলামী সমাজের যিন্দেগীর বিভিন্ন ক্ষেত্রের মধ্যে কোনো একটি ক্ষেত্রেও যখনই ইসলামের দুশমনদের পক্ষ থেকে _ তা বৈদেশিক দুশমনই হোক বা অভ্যন্তরীণ শত্রুই হোক, ক্ষতি চাপিয়ে দেয়া হয়, তখন মুসলিম জনগণের জন্য তার বিরুদ্ধে মোকাবিলা করা ফরয। এ ক্ষেত্রে জ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞগণের জ্ঞান ও বিশেষজ্ঞত্ব এবং অভিজ্ঞ লোকদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং তার ভিত্তিতে শত্রুর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে মোকাবিলা করতে হবে, শত্রুর পরিকল্পনাকে ভণ্ডুল করে দিতে হবে।
এই ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হচ্ছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। আমরা এর নাম দিয়েছি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। অবশ্য এটা অনেকখানি আমাদের মধ্যে ও আমাদের সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন ধরনের দুর্বলতা থেকে উদ্ভূত। আমরা যেহেতু অন্যদের ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি তাই আমরা এর নাম দিয়েছি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন মানে কী?
সাংস্কৃতিক আগ্রাসন মানে হচ্ছে দ্বীনের বিরুদ্ধে আগ্রাসন। সম্মানিত রাহবার যেমন বলেছেন ঃ তারা জনগণের ঈমানকে তাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। এটা কোনো সাধারণ ব্যাপার নয়। এ হচ্ছে বিশেষজ্ঞ সুলভ বক্তব্য; এমন এক ব্যক্তির বক্তব্য যিনি এ জাতীয় সমস্যাবলী অন্য সকলের চেয়ে ভালোভাবে বুঝতে পারেন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে কি আমি বলবো যে, “আমি আমার নামায নিয়ে ব্যস্ত আছি, দার্স্ নিয়ে ব্যস্ত আছি; এসব বিষয়ে আমার কী কাজ?”? অন্য একজনও একই কথা বলবে, সরকারও এক ধরনের কথা বলবে, জাতীয়বাদীরা আরেক কথা বলবে, বিভিন্ন উপদল একেক কথা বলবে এবং কেউই এ ব্যাপারে মাথা ঘামাবে না _ এটা কি সম্ভব? ইসলামী বিপ্লবের রাহবার যতই ফরিয়াদ করছেন যে, “আপনারা সাংস্কৃতিক আগ্রাসন মোকাবিলার জন্য চিন্তা করুন; আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো ইসলামী হয় নি।” কিন্তু তা শোনার মতো কান নেই। কেউই সে কথায় কান দিচ্ছে না।
সরকার ইসলামী সরকার, মুজতাহিদ শাসকও ইসলামী প্রশাসনের শীর্ষে অবস্থান করছেন। কিন্তু তিনি একা কী করতে পারেন? একটি ফুলে তো আর বসন্ত হয় না। যাদের তাঁর আদেশ কার্যকর করার কথা তারা তা করছে না। এমতাবস্থায় মুসলমানরা কি হাতে হাত দিয়ে বসে তামাশা দেখবে? এই ভয়ে কি তারা কোনো কথা বলবে না যে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে উগ্রতার অপবাদ দেয়া হবে? তারা কি তাহলে শৈথিল্য প্রদর্শন করবে? এ বিষয়ের ওপর খুবই গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে এই বলে যে, “এ হচ্ছে অতর্কিত সাংস্কৃতিক আক্রমণ, দ্বীনী সংস্কৃতির লুণ্ঠন; ওরা আপনাদের যুব সমাজের ঈমানকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে।” এর পর আর কী বলবেন? এরপরও কি আমরা মোটেই দায়িত্ববোধ অনুভব করবো না?
আমি কয়েকটি উপমা দিচ্ছি, খোদা না করুন _ এমনটি যেন না হয়।
আপনারা আপনাদের ঘরে বসে আছেন, হঠাত শুনতে পেলেন যে, একটি মাইক থেকে আপনাদের মহল্লায় কেউ ডাক-চীৎকার দিয়ে বলছে ঃ “ভাইসব, বৈদু্যতিক তারে ক্রস কানেকশন হয়েছে, সাবধান থাকুন। কেউ যদি তার ঘরের বৈদু্যতিক তারে হাত দেয় বা সুইচ অন্ করে তাহলে আগুন লেগে যাবে। আপনারা কেউ বৈদু্যতিক তারে হাত দেবেন না।” অথবা ধরুন, মুষল ধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে; প্লাবন হয়েছে, গলি সমূহের ভিতর দিয়ে পানির স্রোত বয়ে যাচ্ছে, অনেক লোকের ঘরে পানি প্রবেশ করেছে। রাতের বেলা, তাই আপনি আপনার ঘরে উষ্ণ বিছানায় আরামে ঘুমিয়ে আছেন। হঠাত করেই শুনতে পেলেন কেউ একজন কানফাটানো চীৎকার করে বলছে ঃ “ভাইসব, আপনাদের বাড়ীঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসুন। প্লাবন এসেছে; প্লাবন আপনাদেরকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।” তখন আপনি কী করবেন? প্রথমে হয়তো আপনি অনেকটা চোখে ঘুমজড়ানো অবস্থায় উঠে বসবেন এবং বলবেন ঃ “এই মধ্য রাতে কে ডাক-চীৎকার দিচ্ছে? যাও বাবা, ঘুমাও গিয়ে।” কিন্তু দুই-তিন বার যখন তার উচ্চৈস্বরে ডাক-চীৎকার শুনতে পাবেন তখন আপনি যথেষ্ট সতর্ক হয়ে যাবেন। তখন আপনি দেখতে পেলেন যে, আপনার বিছানার নীচের দিক সঁ্যাৎসেঁতে হয়ে গেছে। অর্থাৎ পানি আপনার ঘরেও প্রবেশ করেছে; অন্য কোনো কারণে বিছানার নীচটা সঁ্যাৎসেঁতে হয় নি। তখন আপনি সমস্যাটিকে গুরুত্বের সাথে নেবেন। এরপর, যে ব্যক্তিটি ডাক-চীৎকার করছে তার কাছে হিয়ে তাঁকে ধন্যবাদ জানাবেন, বলবেন, “আপনি একটা বিরাট খেদমত করেছেন, নইলে আমাদের বাড়ীঘরগুলো ধ্বংস হয়ে যেতো। আমাদের ছেলেমেয়েরা পানির টানে ভেসে গিয়ে মারা যেতো।”
অথবা ধরুন কোনো এক মহল্লায় আগুন লেগেছে। কেউ যদি এই বলে ডাক-চীৎকার দিতে থাকে যে, “আগনি! আগুন! অগুন লেগেছে!” এভাবে চীৎকার দিয়ে সে যদি মধ্য রাতে আপনাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দেয়, এরপর আপনি বুঝতে পারেন যে, সে কত বড় খেদমত আঞ্জাম দিয়েছে, তখন কি আপনি তার কাছে গিয়ে মধ্য রাতে আপনার ঘুম ভাঙ্গানোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবেন? নাকি তাকে ধন্যবাদ জানাবেন?
কিন্তু নৈতিক বিষয়াদির ক্ষেত্রে আমাদের আচরণ এ রকম নয়। বস্তুগত বা পার্থিব বিষয়াদির ক্ষেত্রে অবশ্য আমাদের আচরণ যেরূপ উল্লেখ করলাম সে রকমই। কারণ, এ ধরনের বিষয়গুলো আমরা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারি। কেউ আমাদেরকে বুঝিয়ে দেয় যে, ভূমিকম্প হয়েছে, আগুন লেগেছে, প্লাবন এসেছে, খোদা না করুন, বোমা বর্ষণ হয়েছে। এসব সতর্ক বাণী আমাদের জন্য খুবই মূল্যবান। এ কারণে আমরা সতর্ককারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। কিন্তু কেউ যদি আমাদেরকে নৈতিক ব্যাপারে সতর্ক করে তাহলে তাকে আমরা এভাবে অভ্যর্থনা জানাই না, যদিও আমরা বুঝতে পারি যে, সে আমাদের বন্ধু, আমাদের কল্যাণকামী এবং এ কারণেই সে আন্তরিক দরদের কারণেই এভাবে ডাক-চীৎকার করছে। কিন্তু আমরা তাকে অভ্যর্থনা করি না। তাকে উল্টো বলি ঃ “এভাবে উগ্র কথাবার্তা বলছো কেন? আস্তে কথা বলো।” অথচ যখন কেউ চীৎকার দিয়ে ভূমিকম্প বা প্লাবনের কথা বলে তখন তাকে বলি না ঃ “ভাই আস্তে কথা বলুন।” কারণ, আস্তে করে বললে আপনি জেগে উঠতেন না।
অনেক বার বলা হয়েছে, অনেক বার লেখা হয়েছে, কিন্তু আপনার ও আমার কানে প্রবেশ করে নি। চীৎকার করে বললে হয়তো কিছু লোকের ওপর তার প্রভাব হবে। নচেৎ আমরা তো নৈতিক বিপদ সমূহ সম্পর্কে সংবেদনশীল নই। তখন আমরাও অর্থাৎ হিযবুল্লাহী এবং মু’মিনগণও এ ব্যাপারে কথা বলবো না। বস্তুতঃ মানুষের প্রকৃতি এমনই। মানুষ সংবেদনশীল এবং সে সংবেদনশীলতার উর্ধে এমন অনেক কিছুর সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়। সে সহজে কোনো কিছু বিশ্বাস করে না। তাদেরকে যখন বলা হয় যে, তোমাদের দ্বীনকে নিয়ে যাচ্ছে, তখন তারা বলে ঃ “কোথায়? কিছুই তো নিয়ে যায় নি।”
ধনসম্পদ নিয়ে গেলে মানুষ বুঝতে পারে। কিন্তু যদি বলা হয় যে, “তোমাদের দ্বীনকে নিয়ে গেলো”, তখন বলে ঃ “না, নামায তো পড়ছি, রোযাও তো রাখছি; আমাদের কোন্ দ্বীনকে নিয়ে গেছে?” তবে পার্থক্য এখানে যে, গত বছর ইয়াক্বীন পোষণ করতেন যে, আল্লাহ্ ও রাসূল (সাঃ) সত্য, কিন্তু এ বছর সন্দেহ পোষণ করছেন। এ বছর কোন কোন সময় আপনার মাথায় আসে যে, ‘এ রকম নয়তো যে, এগুলো মোল্লারা ঠিক মতো বুঝতে পারে নি?!’ আর এ ধরনের কথা যারা বলে তারাও মানুষ। এরা লেখাপড়া জানা মানুষ; বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছে, লন্ডন গিয়ে পড়াশুনা করেছে। অবশ্যই তাদের মাথার মধ্যে একটা কিছু আছে, এ কারণেই তারা এ ধরনের কথা বলে। নইলে তারা হয়তো মোল্লাদের চেয়েও ভালোভাবে বিষয়টি বুঝতে পেরেছে।
দ্বীন এভাবেই যায়; আস্তে আস্তে, ধীরে ধীরে। প্রথমে তার এক কোণ থেকে ক্ষয় হতে শুরু করে, তারপর এক সময় হঠাত লক্ষ্য করে যে, কিছুই আর বাকী নেই।
যে ব্যক্তি জেগে আছে সে সংবেদনশীল। তার ঘ্রাণেন্দ্রিয় অত্যন্ত শক্তিশালী। দুশমন যখন অনেক দূর থেকে আসতে শুরু করে সে তখনই তা বুঝতে পারে এবং এ-ও বুঝতে পারে যে, কী জন্য আসছে। সে দুশমনের তৎপরতার মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয়। সে বুঝতে পারে দুশমন কোন জিনিসটিকে তার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে এবং কী কাজ করে চলেছে। কিন্তু অন্যরা গাফেল _ উদাসীন। হাজার জন বললেও তাদের বিশ্বাস হয় না। তবে এই বলাটাও এক ধরনের “নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার”।
ইসলামী সমাজের ওপর যে বিপদ চাপিয়ে দেয়া হয় তা একজন লোকের পক্ষ থেকে চাপিয়ে দেয়া হয় না, অতএব, তা দূর করাও একজন লোকের কাজ নয়। আর যেহেতু অত্যন্ত জটিল পরিকল্পনার ভিত্তিতে লোকদের ওপর এ বিপদ চাপিয়ে দেয়া হয়, সেহেতু এগুলোর বিরুদ্ধে মেকাবিলার জন্যও পরিকল্পনা প্রণয়নের প্রয়োজন রয়েছে। অতএব, সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের বসে পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে এবং অন্যদেরও তাদের প্রতি সুধারণা পোষণ করতে হবে। যারা ফরিয়াদ করছেন তাঁদের ফরিয়াদকেও ভালোভাবেই স্বাগত জানাতে ও গ্রহণ করতে হবে। নচেৎ এর ধোঁয়া তাদের নিজেদের চোখেই প্রবেশ করবে। পরবর্তী সময়ে তাদের সন্তানরা বেঈমানে পরিণত হবে। তারা বেঈমান হলে তারা খারাপ চরিত্রের সকল প্রভাবই গ্রহণ কজরবে। এরপর তারা মাদক দ্রব্যে আসক্ত হবে। এরপর তারা এইডস রোগে আক্রান্ত হবে। তারপর তারা ফৌজদারী অপরাধে জড়িত হবে, চোরাচালানী গ্যাং তৈরী করবে। এ রকমই কি নয়? এমনটা হওয়া কি সম্ভব নয়? সাংস্কৃতিক বিচু্যতি এ ধরনের পরিণামই নিয়ে আসে। “আর আখেরাতের শাস্তি অবশ্যই এর চেয়ে কঠোরতর।”
এই হলো দুনিয়ার শাস্তি; পরিবার ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া _ ধ্বংস হয়ে যাওয়া, স্বামী-স্ত্রীর স্থায়ী বিরোধ, সন্তানদের ভালোভাবে গড়ে না ওঠা _ ভুল শিক্ষা লাভ করা, নোংরা অভ্যাসে অভ্যস্ত হওয়া, মাদক দ্রব্যে অভ্যস্ত হওয়া, নেশাগ্রস্ত হওয়া, সমাধানের অতীত হাজারো সমস্যায় জড়িত হয়ে পড়া যা বলার মতো নয়। ঈমান যখন চলে যায় তখন তার পরিণামে এসব চলে আসে। যদি না চান যে, এরূপ পরিণতি চলে আসুক তাহলে শুরুতেই তার গতিরোধ করুন। সাংস্কৃতিক বিষয়াদির ক্ষেত্রে সংবেদনশীল হোন। বলবেন না যে, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নতি হলে সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এসব সমস্যার অনেকগুলো এই অর্থনৈতিক উন্নতি থেকেই উদ্ভূত; ধনী লোকেরা এগুলোর প্রচলন করছে। যাদেরকে অর্থকড়ি জমানোর লোভে পেয়ে বসেছে তারা যে অর্থে তাদের জীবন কেটে যেতে পারে তার দশ গুণ ব্যয় করছে, এরপরও তারা আরো বেশী সম্পদ পুঞ্জীভূত করতে চায়। তারা এসব অপসংস্কৃতি বিস্তারের কাজে হাত দেয়।
সাংস্কৃতিক বিচু্যতির সব কিছুর জন্য দারিদ্র্য দায়ী নয়। যারা মনে করছেন যে, অর্থনৈতিক সমস্যাবলীর সমাধান হলে এসব সমস্যারও সাধান হবে তাঁরা ভুল করছেন। অবশ্য অর্থনৈতিক সমস্যাকেও তার জায়গায় যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে হবে। অনেক সময় দারিদ্র্য ও অর্থনৈতিক অনটন এসব সমস্যাকে সাহায্য করে। কিন্তু অর্থনৈতিক সমস্যা এর একমাত্র বা পূর্ণ কারণ নয় এবং এর সমাধানও কেবল অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান নয়।
অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে হবে; এ হচ্ছে ইসলামী সমাজের ইসলামী সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। তবে অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান ইসলামী সরকারের একমাত্র দায়িত্ব নয়। তার সর্বপ্রথম দায়িত্ব হচ্ছে দ্বীনের হেফাযত করা, জনগণের চরিত্রের হেফাযত করা, আত্মিকতা ও নৈতিকতার হেফাযত করা, ইসলামী মূল্যবোধ সমূহের হেফাযত করা। এরপর অন্যান্য মূল্যবোধের হেফাযত করা। তবে ‘এরপর’ মানে সময়ের বিচারে নয়, বরং গুরুত্বের দিক থেকে। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, বেশ কিছুদিন থেকে বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন বক্তৃতার মাধ্যমে, প্রবন্ধাদির মাধ্যমে প্রচার মাধ্যম সমূহ আমাদের কানের কাছে সব সময় বলে আসছে যে, অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হলে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।
না, ভাইয়েরা, এমন নয়। এদের উচিৎ নয় এভাবে নিজেদেরকে ধোঁকা দেয়া, আপনাদেরও উচিৎ নয় এদের কথায় প্রতারিত হওয়া। অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য সমস্ত সমস্যার সমাধানকারী নয়। আমি পুরোপুরি নিশ্চিত করে বলতে পারছি না, তবে মনে করা হয় যে, বিশ্বের সকল দেশের মধ্যে সবচেয়ে ধনী দেশ আমেরিকা এবং সে দেশের মাথাপিছু গড় আয় বিশ্বের অন্য যে কোনো দেশের তুলনায় বেশী। তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও অন্যদের তুলনায় বেশী।
আমি ঠিক জানি না, এ ধারণা সঠিক, নাকি ভুল; তবে যদি সঠিক না-ও হয় তথাপি আমেরিকা যে, বিশ্বের অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশ সমূহের অন্যতম তাতে অন্ততঃ সন্দেহ নেই। সেখানে কি সামাজিক ও চারিত্রিক সমস্যা নেই? সেখানে প্রতি কয়েক সেকেন্ডে একটি করে ফৌজদারী অপরাধ সংঘটিত হয়। সেখানে প্রাইমারী স্কুলের বাচ্চাদেরকে পাহারা দিয়ে স্কুলে নিয়ে যেতে হয়। সেখানকার প্রতিটি প্রাইমারী স্কুলে সশস্ত্র পুলিশ প্রহরা রয়েছে। এত কিছু সত্ত্বেও এমন দিন যায় না যে, কোনো না কোনো স্কুলে ফৌজদারী অপরাধ সংঘটিত না হয়। এ চারিত্রিক ও সামাজিক সমস্যা কি অর্থের দ্বারা সমাধান হবে? তাদের কি অর্থের অভাব আছে?
আমি অস্বীকার করি না যে, অনেক সামাজিক সমস্যাই অর্থনৈতিক সমস্যার প্রভাবে উদ্ভূত হয় অথবা এসব সমস্যার উদ্ভবের ক্ষেত্রে দারিদ্র্য সহায়তা করে। কিন্তু তাই বলে মনে করবেন না যে, অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হলে সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বরং অনেক সময় আর্থিক প্রাচুর্যের কারণে নতুন নতুন মুছিবতের সৃষ্টি হয়।
মোদ্দা কথা, অপসংস্কৃতির মোকাবিলা করাও এক ধরনের “নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার”। অতীতে দেখা গেছে, এ ব্যাপারে কিছু লোক পদক্ষেপ গ্রহণ করতো বা সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করতো অথবা সরকার ও জনগণ পরস্পরের সাথে যৌথভাবে পদক্ষেপ গ্রহণ করতো। কিন্তু সরকার যদি না পারতো বা সে ধরনের সরকার না থাকতো, তাহলে স্বয়ং মুসলিম জনগণ এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করতো এবং এসব সমস্যার সমাধান করতো; তারা দুশমনদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতো, তারা দুশমনদের ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে দিতো।
কতই না ভালো হয় এমনটি হলে! কিন্তু যদি না হয় তখন করণীয় কী? তখন এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করা মুসলিম জনগণের দায়িত্ব। কিন্তু সকল মুসলমান কি সব সময়ই দায়িত্ববোধের পরিচয় দেয়? যদি তা না হয়ে থাকে তাহলে আমাদেরকে কষ্ট করে আমাদের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করতে হবে। তাহলে আমরা দেখতে পাবো যে, এমন সময়ও গিয়েছে যখন মুসলিম জনগণ তাদের দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে শিথিলতা দেখিয়েছে। অধিকাংশ জনগণই, বলা চলে যে, প্রায় সকল জনগণই শিথিলতা দেখিয়েছে। আর এর দৃষ্টান্ত সকলেই জানা আছে।
আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলী (আঃ)-এর শাহাদাতের পর থেকে সাইয়েদুশ শুহাদা হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর শাহাদাত পর্যন্ত বিশ বছর; এ সময়টা হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) মদীনায় কী করছিলেন? ঐ সময় যারা শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলো তারা কি মূর্তিপূজারী ছিলো? তারা কি আল্লাহ্কে অস্বীকার করতো? তারা কি প্রকাশ্যে হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)কে অস্বীকার করতো? তারা দ্বীনের আহ্কাম সমূহকে অস্বীকার করতো? কক্ষনো নয়। বরং তারা নিজেদেরকে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর খলীফাহ্ বলে মনে করতো। তারা নামায পড়তো। তারা জুম্’আহ্ নামাযে ইমামতি করতো। কিন্তু এমন ঘটনাও ঘটেছে যে, কখনো কখনো বুধবার দিন জুম্’আহ্ নামায পড়েছে। কখনো কখনো মাতাল অবস্থায় ইমামতি করতো, কিন্তু তারা নামায পড়তো। আশূরার দিনেও ওমর বিন্ সা’দ্ প্রথমে নামায পড়ে তারপর সৈন্যদেরকে “হে মহান আল্লাহ্র অশ্বারোহী দল!” বলে সম্বোধন করে।
এরা নামায পড়তো, নিজেদেরকে মুসলমান বলে মনে করতো, তাদের হুকুমাতও তথাকথিত ইসলামী হুকুমাত ছিলো। অথচ হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) দীর্ঘ বিশ বছর যাবত মর্মজ্বালায় ভুগেছেন, কিন্তু বলতে পারেন নি যে, এ হুকুমাত একটি নাহক হুকুমাত। কেবল গোপনে, গৃহকোণে কোনো কোনো লোকের কাছে বলতে পারতেন। এমনকি মু’আবিয়ার মৃতু্যসংবাদ এলে হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) মদীনার গভর্নরের কাছে গিয়ে বাহ্যতঃ সমবেদনা জানান। তখন এমনই ছিলো পরিস্থিতি। অন্যান্য মা’ছূম ইমামের যুগের অবস্থাও ছিলো এ রকমই। হযরত ইমাম মূসা কাযেম (আঃ) ও অন্য ইমামগণও কি সুস্পষ্ট ভাষায় জনগণকে বলতে পেরেছেন যে, সরকার ইসলামী নয়, বরং বাতিল সরকার? না, পারেন নি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে কেন তাঁদেরকে কারারুদ্ধ করা হতো? কেন তাঁদেরকে শহীদ করা হয়? তখন যারা রাষ্ট্র চালাতো তারা কি কুফ্রের নামে রাষ্ট্র চালাতো? তারা কি আল্লাহ্কে অস্বীকার করতো? তারা প্রকৃত পক্ষে এ থরনের লোক হয়ে থাকলেও তা প্রকাশ করতো না। তারা নিজেদেরকে রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর খলীফাহ্ বলে দাবী করে হুকুমাত পরিচালনা করতো।
আপনারা এ ঘটনা শুনে থাকবেন, যারা মর্সিয়া গান তাঁদের সকলেই তাঁদের মর্সিয়ায় এ ঘটনা উল্লেখ করেন যে, হারূনুর রশীদ যখন হযরত ইমাম মূসা কাযেম (আঃ)কে গ্রেফতার করার ও কারাগারে নিক্ষেপ করার সিদ্ধান্ত নিলেন তখন তিনি হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর কবরে এসে ক্ষমা চান ও ওযর পেশ করেন এই বলে যে, সমাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার স্বার্থে, সমাজে যাতে মতভেদ সৃষ্টি না হয় সে লক্ষ্যে এ পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। এই বলে তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর নিকট ওযর পেশ করেন ও ক্ষমা চান।
এমন নয় যে, এ হুকুমাতগুলো সবই কাফের ও মোশরেকদের হুকুমাত ছিলো। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের লোকদের ব্যাপারে কী করতে হবে? কোনো কোনো সময় পরিস্থিতি এমন হয় যে, বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক তৎপরতার মাধ্যমে এবং গোপনে কাজ করে লোকদের মধ্যে মূল দ্বীনকে হেফাযত করতে হয়। এ আশায় থাকতে হয় যে, এক সময় তাদের জ্ঞানের ও তাদের সংস্কৃতির বিকাশ ঘটবে এবং তারা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ কাজ আঞ্জাম দিতে সক্ষম হবে।
হযরত ইমাম যায়নুল আবেদীন সাজ্জাদ (আঃ) তাঁর পরবর্তী ইমামগণের (আঃ) কর্মসূচী প্রায় এ রকমই ছিলো। বিভিন্ন কারণে, যেহেতু কিছু সংখ্যক মুসলমান যথাযথ প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন, হযরত সাইয়েদুশ শুহাদা (আঃ)-এর খুনের বরকতে কিছু লোক সত্যকে চিনতে পেরেছিলেন, প্রশিক্ষিত হয়েছিলেন, তাঁরা ইসলামী ভূখণ্ডের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন। ইরানের প্রত্যন্ত এলাকায়, বিশেষ করে খোরাসান ও মাযেনদারানে যে এত ইমামযাদার মাযার দেখা যায়, এরা ছিলেন সেই প্রশিক্ষিত মুসলমান। তাঁরা লোকদেরকে হেদায়াত করতেন। তাঁদের বেশীর ভাগই ছিলেন হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর আহ্লে বাইতের বংশধর।
অন্য কোনো ধরনের তৎপরতার দরযা খোলা না থাকায় এ ধরনের পরিস্থিতিতে এ ধরনের সাংস্কৃতিক তৎপরতার মধ্যে নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ রাখা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। এ ধরনের পরিস্থিতিতে একমাত্র যে কাজটি করা অপরিহার্য তা হচ্ছে, এমন কাজ করা যাতে স্বয়ং দ্বীন _ দ্বীনের মূল বিষয়টি যেন বিলুপ্ত হয়ে না যায়। ইমামগণ (আঃ) যখন এ ধরনের তৎপরতার মধ্যে নিজেদেরকে সীমাবদ্ধ রাখেন তখন তাঁরা দ্বীনের মূল বিষয়টি বিলুপ্ত না হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন।
কিন্তু হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর যে কথাগুলো ইতিপূর্বে আপনাদের খেদমতে উদ্ধৃত করেছি যা তিনি মীনায় তৎকালীন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উদ্দেশে বলেছিলেন তা স্মরণ করুন। তিনি বলেন, ‘আমি আশঙ্কা করছি, পাছে মূল সত্যই হারিয়ে না যায়। এখানে কেবল শরীয়াতের একটি বা দু’টি হুকুমের বিষয় নয়। তোমরা এ বিষয়ে চিন্তা করে দেখো, কারণ, আমি আশঙ্কা করছি যে, স্বয়ং সত্যই হারিয়ে যাবে, ফলে লোকেরা সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য করতে পারবে না; তাদের সামনে সত্য ও মিথ্যাকে আলাদা করে চেনার মতো কোনো পথ নেই।’
এ ধরনের পরিস্থিতি অন্য এক বিশেষ ধরনের কাজ দাবী করে। এ কাজ না প্রচার তৎপরতার মাধ্যমে সম্ভব, না অর্থের দ্বারা সম্ভব, না কোনো সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে তা সম্ভব। কারণ, এ কাজের পক্ষে লোক পাওয়া যাবে না। শক্তি ও ক্ষমতা হচ্ছে বিপরীত পক্ষে, অর্থসম্পদও তাদেরই হাতে। তারা এমনভাবে এবং এতই বেশী প্রচার চালিয়েছে যে, মানুষের দৃষ্টিশক্তিকে পাল্টে দিয়েছে। কারো নিঃশ্বাস ফেলার শক্তিটুকুও নেই। একের পর এক হুঙ্কার দিচ্ছে, একের পর এক গুপ্ত হত্যা চালাচ্ছে, কেউই রুখে দাঁড়াবার, সংগ্রামের উদ্দেশ্যে অভু্যত্থান করার সাহস পাচ্ছে না। না তাদের অন্য কোনো ধরনের শক্তি ও সামর্থ্য অবশিষ্ট আছে।
এমতাবস্থায় সমাজকে একটি ধাক্কা দেয়া প্রয়োজন _ একটি বিরাট ইসলামী সমাজের জন্য এক ব্যক্তি বা একটি ছোট্ট গোষ্ঠীর পক্ষে যা করা সম্ভব ছিলো। হ্যা, ফরিয়াদ করা যেতো, তাহলে বিশেষ একদল লোক তা বুঝতো। যে যুগে তো আর টেলিভিশন ছিলো না। যদি থাকতোও তাহলেও তা থাকতো বনী উমাইয়্যার হাতে; হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর হাতে থাকতো না। তখন পত্রপত্রিকা ও অন্যান্য প্রচার মাধ্যমও ছিলো না। থাকলেও তা তারা তাদের সহায়তাকারীদের ও তাদের অভিন্ন ফ্রন্টের লোকদের হাতে তুলে দিতো। এসব উপকরণ অন্যদেরকে দিতো না। অবশ্য তখন এগুলো ছিলো না।
হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর কণ্ঠে কত জোর ছিলো? তিনি কত ফরিয়াদ করতে পারতেন? সাহস করলেও তিনি কত জনের নিকট তাঁর ফরিয়াদ পেঁৗছাতে পারতেন? তাঁকে যদি তারা আপাততঃ কিছু না-ও বলতো তো দীর্ঘ বিশ বছর যাবত এভাবে ছেড়ে দিতো না। তাই তাঁর জন্য অত্যন্ত গোপনে ও শান্তভাবে তাঁর বন্ধুবান্ধব ও ভক্ত-অনুসারীদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা, দেখাসাক্ষাৎ করা ও কথা বলা অপরিহার্য ছিলো। এছাড়া আর কী কাজ করা সম্ভব ছিলো? হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) ঠিক সে কাজটিই করেছিলেন যা করা তাঁর উচিৎ ছিলো। তাঁর জন্য সমাজকে এমন একটি ধাক্কা দেয়া প্রয়োজন ছিলো যার প্রভাব, যার প্রকম্পন কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে; কখনো যা শান্ত হবে না। তাঁর জন্য এমন একটি কাজ করা প্রয়োজন ছিলো যে কাজের বিবরণ তথা যে ঘটনাকে কখনোই বিকৃত করা সম্ভব হবে না, অন্য কোনোভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে না।
তারা আশূরার ঘটনাকে কীভাবে মনগড়া ব্যাখ্যা দেবে? কোরআন মজীদের যে কোনো আয়াতকে, এমনকি “মুহ্কাম” আয়াতকে মনগড়াভাবে ব্যাখ্যা করা চলে, তার অর্থকে বিকৃত করা চলে; ভুল তাফসীর করা চলে। আর হাদীছ? ছহীহ্ হাদীছ সম্পর্কে তারা বলতে পারে যে, এ হাদীছ মিথ্যা, জাল, ইসরাঈলী। শেষ পর্যন্ত তারা বলতে পারতো, তোমরা কোরআন মজীদের এ আয়াত এভাবে পাঠ করে এ অর্থ গ্রহণ করেছো; একে অন্যভাবে পড়ে অন্য অর্থও করা যেতে পারে। শীর্ষস্থানীয় মুজতাহিদগণকেও তারা বলতে পারতো, ‘আপনারা যা বুঝেছেন তা চূড়ান্ত মনে করবেন না। এর অন্য ব্যাখ্যাও রয়েছে।’
কিন্তু হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) যে পদক্ষেপ নিলেন তা নিয়ে তাদের পক্ষে কী করা সম্ভব ছিলো? এ পদক্ষেপের একটি ছাড়া অন্য কোনো ব্যাখ্যা করা কি সম্ভব? এ একটি ব্যাখ্যা হচ্ছে ঃ একদল পুতঃপবিত্র লোক আল্লাহ্র উদ্দেশ্যে তাঁর দ্বীনের পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে নিজেদের ও তাঁদের আপন জনদের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। এ পর্যন্ত কোনো ঐতিহাসিক, কোনো ইনছাফ বোধ সম্পন্ন মানুষ কারবালার ঘটনার এ ছাড়া অন্য কোনো ব্যাখ্যা করেছেন কি?
হ্যা, আজকে হয়তো এমন লোক পাওয়া যেতে পারে যাদের কাছে কারবালার ঘটনার অন্য কোনো ব্যাখ্যা থাকতে পারে। তারা বলতে পারে, ‘হোসাইন অযথাই জীবন দিয়েছিলেন; এটা ছিলো তাঁর নানার সহিংসতার প্রতিক্রিয়া। ইয়াযীদীদের কোনো দোষ ছিলো না। কারণ, রাসূলুল্লাহ্ তাদের পূর্বপুরুষদেরকে হত্যা করেছিলেন। তাই তারাও তাঁর বংশধরদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো এবং তাঁদেরকে হত্যা করেছিলো।’
এ ধরনের ব্যাখ্যা হচ্ছে কারবালার ঘটনার সবচেয়ে জঘন্য ধরনের শয়তানী ব্যাখ্যা যা আজকের দিনে কিছু লোক করার চেষ্টা করছে _ ইতিপূর্বে যা কখনোই হতে দেখা যায় নি। এ পর্যন্ত বন্ধু ও দুশমন, মুসলিম ও কাফের নির্বিশেষে সকলেই কারবালার ঘটনার জন্যে শ্রদ্ধায় মাথা নত করেছে। শুধু তা-ই নয়, এ ঘটনার ফলে হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) যে হেদায়াতের প্রদীপ তা বাস্তবেও প্রমাণিত হলো, তিনি এমন এক প্রোজ্জ্বল প্রদীপ রূপে আবির্ভূত হলেন যা কোনোদিনই নির্বাপিত হবে না। এর মোকাবিলায় আর কোনো কিছুই করা সম্ভব ছিলো না এবং সম্ভব নয়। তাঁর দেয়া এ ধাক্কার কারণে সমাজ মুক্তি লাভ করে।
বস্তুতঃ এ-ও হচ্ছে “নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার”-এর একটি মানদণ্ড, একটি বাস্তব দৃষ্টান্ত। এটা সাধারণ ও ব্যাপক অর্থে “নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার”। তিনি বলেন ঃ “আমি আমর্  বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।” আর তিনি যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তা-ই করেছেন এবং তার সুফলও পেয়েছেন। তার সুফল কী ছিলো? তা হলো এই যে, লোকদের পক্ষে হক ও বাতিলের মধ্যে পার্থক্য করা সম্ভব হলো।
নবী-রাসূলগণ (আঃ) ও আউলিয়ায়ে কেরামের আসল দায়িত্ব হচ্ছে মানুষের হেদায়াত _ পথ প্রদর্শন। হেদায়াতের পর লোকেরা নিজেরাই যদি তাঁদের নেতৃত্ব মেনে নেয়ার জন্য প্রস্তুত হয় তখন তাঁরা হুকুমাতও প্রতিষ্ঠা করেন। তখন হুকুমাত প্রতিষ্ঠা তাঁদের দায়িত্ব হয়ে যায়। কিন্তু এ জন্য শর্ত হচ্ছে এ কাজে তাঁদেরকে সাহায্য করার জন্য জনগণকে প্রস্তুত হতে হবে। আমীরুল মু’মিনীন হযরত আলী (আঃ) যেমন “খোত্বায়ে শাক্বশাকি্বয়াহ্” নামে পরিচিত তাঁর বিখ্যাত খোতবায় বলেন ঃ “যদি না এখানে উপস্থিত ব্যক্তিগণ এখানে উপস্থিত হতেন ও সাহায্যকারীদের উপস্থিতির কারণে হুজ্জাত প্রতিষ্ঠিত হতো (তাহলে আমি খেলাফতের এ দায়িত্ব গ্রহণ করতাম না)।” তিনি বুঝাতে চান যে, যেহেতু লোকেরা হাযির হয়েছে ও সাহায্য করেছে সেহেতু আমি রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব গ্রহণের যে কর্তব্য তা পালনের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি।
হেদায়াতের দায়িত্ব তো যথাস্থানেই রয়েছে। হেদায়াত বা পথ প্রদর্শন করা নবী-রাসূরগণ (আঃ) ও আল্লাহ্র ওলীগণের এবং তাঁদের অবর্তমানে যারা তাঁদের স্থলাভিষিক্ত তাঁদের দায়িত্ব। যেহেতু “আলেমগণ নবী-রাসূলগণের উত্তরাধিকারী।” সেহেতু হেদায়াত সব সময়ই তাঁদের দায়িত্ব। এ দায়িত্ব কখনোই তাঁদের কাঁধের ওপর থেকে নামিয়ে নেয়া হয় না। যদি অন্য কোনো পথ না থাকে তাহলে শহীদ হয়ে হলেও লোকদেরকে হেদায়াত করতে হবে, লোকদেরকে বুঝাতে হবে, তাদেরকে বলতে হবে কেন তাঁরা নিহত হবার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন।
তাঁরা যদি সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে চান তাহলে তাঁরা বসুন, পর্যালোচনা করুন, চুলচেরা বিশ্লেষণ করুন, তাহলে অবশ্যই তাঁরা এ উপসংহারে উপনীত হবেন যে, হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) তাঁর দ্বীনী দায়িত্ব হিসেবে এ কাজ করেছেন। ঐ সময় মিথ্যাচারের প্রাবল্য ছিলো, ব্যাপকভাবে মিথ্যা অপবাদ দেয়া হতো। এমতাবস্থায় তাঁর পক্ষে অন্য কোনোভাবেই “নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার”-এর দায়িত্ব পালন করা সম্ভব ছিলো না। অতএব, “নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার”-এর এ-ও একটি মানদণ্ড বা দৃষ্টান্ত। তবে প্রথমতঃ এ ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়াটা একান্তই বিরল ব্যাপার, দ্বিতীয়তঃ এভাবে দায়িত্ব পালন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে কিনা তা নির্ধারণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে অবশ্যই অত্যন্ত উঁচু স্তরের দ্বীনী জ্ঞান ও সচেতনতার অধিকারী হতে হবে। এ কাজের জন্য অনেক বেশী আত্মত্যাগের প্রয়োজন। কারণ, এ ক্ষেত্রে সকল কিছু ত্যাগ করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এ কাজ করতে হলে নিজের জন্য শরয়ী ওযরের পথ খোঁজার মানসিকতা থাকলে চলবে না। “আমর্  বিল্ মা’রূফ্ ওয়া নাহ্য়ী ‘আনিল্ মুনকার” পরিত্যাগ করার জন্য কোনো বাহানা সৃষ্টি করা যাবে না।
এ ধরনের লোক খুব কমই পাওয়া যায়। তবে আল্লাহ্ তা’আলা আপনাদের জন্য তাঁর হুজ্জাত পূর্ণ করে দিয়েছেন। এ দায়িত্ব পালন করেছে এমন আর কোনো ব্যক্তির কথা যদি আপনাদের জানা না-ও থাকে তাহলে অন্ততঃ সাইয়েদুশ শুহাদা হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) যে এ দায়িত্ব পালন করেছেন তা তো অনস্বীকার্য।
আপনার ওপর সালাম হে আবা ‘আবদিল্লাহ্ হোসাইন! আপনার জন্য আমার পিতা-মাতা উৎসর্গ হোন। হে হোসাইন! আপনি তো এ দুনিয়ার বুকে হেদায়াতের প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করেছেন এবং যতদিন এ দুনিয়া টিকে থাকবে তা কখনো নিভে যাবে না; আপনার জন্য আমাদের প্রাণ, আমাদের পিতা-মাতা, আমাদের সন্তানগণ উৎসর্গিত হোক।
হে পরোয়ারদেগার! আবা আবদিল্লাহ্ হোসাইনের মর্যাদার উছিলায় তোমার কাছে আবেদন করছি,
হোসাইন সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানকে, তাঁর সম্পর্কে আমাদের বিশ্বাসকে এবং তাঁর প্রতি আমাদের ভালোবাসাকে চিরন্তন করে দাও।
আমাদের সন্তানদেরকে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত হোসাইন প্রেমিক বানিয়ে রাখো।
হযরত ইমাম খোমেইনীকে এবং ইসলামী বিপ্লবের ও চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের শহীদগণকে কারবালার শহীদগণের সাথে হাশর করো।
আমাদের ওপর মহান রাহবারের ছায়া স্থায়ী করো।
আমাদেরকে আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্যের সাথে আরো বেশী পরিচিতকরে দাও।
আমাদের পরিণতিকে শুভ পরিণতিতে পরিবর্তিত করে দাও।
ওয়াস-সালামু ‘আলাইকুম ওয়া রা হমাতুল্লাহ্।

Leave A Reply

Your email address will not be published.