পবিত্র আশুরা ও মহররম-৭

0 428

আশুরা উপলক্ষে ওস্তাদ আয়াতু্ল্লাহ মিসবাহ তাকী ইয়াযদীর সপ্তম বক্তব্য

শহীদানের নেতা হযরত আবা আব্দিল্লাহ্ আল্-হোসাইনের (আঃ) শোকাবহ ম্মৃতিময় দিনগুলোর আগমনে হযরত ইমাম মাহ্দী (আল্লাহ্ তাঁর আবির্ভাব ত্বরান্বিত করুন), মহান রাহ্বার, মহান মার্জা’এ তাক্বলীদগণ ও হোসাইনী আদর্শের ভক্ত অনুসারীদের সকলের প্রতি শোক ও সমবেদনা জানাচ্ছি। আশা করি মহান আল্লাহ্ তা’আলা এ দুনিয়ায় ও পরকালে হযরত আবা আব্দিল্লাহ্ আল্-হোসাইনের সাথে আমাদের সম্পর্ককে কখনো দুর্বল হতে দেবেন না।
বিগত কয়েকটি আলোচনায় আমরা আশূরা ও হযরত আবা আবদিল্লাহ্ আল্-হোসাইন (আঃ)-এর অভু্যত্থান প্রসঙ্গে কয়েকটি প্রশ্ন উপস্থাপন করেছি এবং মজলিসের শ্্েরাতাদের প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ্য রেখে আমার পক্ষে যতখানি সম্ভব হয়েছে সে সব প্রশ্নের ওপর আলোকপাত করেছি।
ইতিহাসের নযীর বিহীন এ মহান অভু্যত্থান সম্বন্ধে যে সব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপিত হয় তার মধ্যে অন্যতম একটি প্রশ্ন এমন যে, অতীতে তা বহু বার উত্থাপন করা হয়েছে এবং তার জবাবও দেয়া হয়েছে। সে প্রশ্নটি হচ্ছে, এ অভু্যত্থানের পিছনে হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর লক্ষ্য কী ছিলো? এ প্রশ্নের যে জবাব দেয়া হয়েছে তা আমাদের সকলেরই জানা আছে। তা হচ্ছে ঃ দ্বীনের পুনরুজ্জীবন, উম্মাতের সংশোধন ও এ ধরনের আরো কতগুলো সাধারণ বিষয়। কিন্তু আমাদের তরুণ ও যুবকদের অনেকের মনেই এ প্রাসঙ্গিক প্রশ্নটি জাগ্রত হয় যে, হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) যে এ পদক্ষেপ নিলেন এর ফলে উম্মাতের মধ্যে কী সংশোধন সংঘটিত হয়েছিলো? এটা কী ধরনের আম্র্ বিল্ মা’রূফ্ ছিলো যার দায়িত্ব এভাবেই পালন করা প্রয়োজন ছিলো? এ পন্থায় কীভাবে দ্বীন পুনরুজ্জীবিত হলো? হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) কি তাঁর লক্ষ্য অর্জনে সফল হয়েছিলেন? তিনি যে কাজ করতে চাচ্ছিলেন অর্থাৎ ইসলামী হুকুমাতের সংশোধন করবেন এবং ইসলামী উম্মাহ্কে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনবেন, পাপাচার ও দুর্নীতি-অনাচার প্রতিহত করবেন এবং এ ধরনের অন্যান্য কাজ; তা কি সম্পাদিত হয়েছিলো? আমাদের যুবকদের অনেকের মনেই এ প্রশ্নগুলো জাগ্রত হচ্ছে। অনেক সময় তারা এ প্রশ্নগুলো উত্থাপন করে।

আমরা প্রথমে দেখবো যে, স্বয়ং সাইয়েদুশ শুহাদা হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) তাঁর এ অভু্যত্থানের লক্ষ্য সম্বন্ধে কী বলেছেন। আমরা প্রথমে তাঁর বক্তব্য উদ্ধৃত করবো এবং এরপর তার কোনো কোনো অংশের ব্যাখ্যা পেশ করবো। তিনি তাঁর ভাই মুহাম্মাদ হানাফিয়্যাহ্র উদ্দেশে যে অছিয়্যাত করেন তাতে উলি্লখিত সেই বিখ্যাত বাক্যগুলো আপনারা বহু বার শুনেছেন। তিনি বলেন ঃ “আমি পর্যটন বা বিনোদন বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি বা যুলুম করার উদ্দেশ্য বহির্গত হই নি।” অর্থাৎ তিনি যে মদীনা থেকে বেরিয়ে আসেন তার উদ্দেশ্য এ জাতীয় কিছু ছিলো না। এরপর তিনি তাঁর বহির্গমনের উদ্দেশ্য তুলে ধরেন ঃ “বরং আমি আমার নানার উম্মাতের সংশোধনের সন্ধানে বহির্গত হয়েছি।”
তিনি বলেছেন : অর্থাৎ ‘সংশোধনের সন্ধানে’। এ কথাটি আমাদের মনে একটি বিষয় জাগ্রত করে দিতে পারে। তাই এ কথাটি নিয়ে আমাদের গভীরভাবে তলিয়ে চিন্তা করা প্রয়োজন। তিনি বলেন নি যে, “আমি আমার নানার উম্মাতের সংশোধনের লক্ষ্যে বহির্গত হয়েছি।” বরং বলেছেন, “আমি আমার নানার উম্মাতের সংশোধনের সন্ধানে বহির্গত হয়েছি।”
তিনি ওলামা ও শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের উদ্দেশে যে বক্তৃতা করেন সেখানেও তিনি এ ধরনের কথা বলেছিলেন। তিনি সে বক্তৃতার শেষে যে দো’আ করেন তাতে আল্লাহ্ তা’আলাকে আত্মনিবেদন করে বলেন ঃ “বরং আমরা তোমার দ্বীনের নিদর্শনাদি দেখাতে চাই এবং তোমার ভূখণ্ডে সংশোধনকে সুস্পস্ট করতে চাই।” অর্থাৎ আমাদের এ তৎপরতার উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য।
এখানে স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) এমন এক সময় এ বক্তৃতা করেন যখন তাঁর মদীনা থেকে বহির্গমনের প্রশ্ন ছিলো না, তখন ইয়াযীদ ও তার অনুগতদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কোনো ব্যাপারও ছিলো না। তিনি এ মুনাজাতে আল্লাহ্ তা’আলার নিকট তাঁর অন্তরের ঐকান্তিকতা তুলে ধরে বলেন, তুমি তো জানো যে, আমরা তোমার দ্বীনের মানদণ্ড সমূহ তুলে ধরতে চাই; তুলে ধরতে চাই যে, দ্বীন কী এবং তার নিদর্শনাদিই বা কী? আমরা তুলে ধরতে চাই, কেউ দ্বীনদার হলে তাকে কেমন হতে হবে এব এবং কেমন হলে বুঝা যাবে যে, সে দ্বীনদার নয়। কষ্টিপাথরের সাহায্যে পরীক্ষা করলে যেভাবে বুঝা যায় যে, কোন্টি খাঁটি স্বর্ণ আর কোনটি ভেজাল ঠিক সেভাবেই যে সব মানদণ্ডের সাহায্যে দ্বীনদারী ও ধর্মহীনতাকে চিহ্নিত করা হয় সে সব মানদণ্ডের সাহায্যে লোকদের সামনে তুলে ধরবো এবং তাদেরকে বুঝিয়ে দেবো যে, দ্বীন কোথায়, আর ধর্মহীনতা কোথায়। এটাই আমাদের লক্ষ্য। “আর তোমার ভূখণ্ডে সংশোধনকে সুস্পস্ট করতে চাই।” আমরা তোমার ভূখণ্ডে সংশোধনকে এতখানি উচ্চ মাত্রায় সুস্পষ্ট করতে চাই যে, কারো কাছে যেন এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্র অস্পষ্টতা না থাকে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এখানে সুস্পষ্টকরণের মানে কী? এর দুই ধরনের তাৎপর্য হতে পারে। অর্থাৎ সুস্পষ্ট করে তুলে ধরবো যে, সংশোধন বা সংস্কার কী, অথবা সংশোধন বা সংস্কারকে বাস্তবে কার্যকর করবো এবং পাপাচার ও দুর্নীতি-অনাচারের ওপর তাকে বিজয়ী করবো।
এ কথার মাধ্যমেই হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) তাঁর কর্মতৎপরতার, বিশেষ করে তিনি যে অভু্যত্থানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তার লক্ষ্যকে তুলে ধরেন। এ কথাই তিনি তাঁর এ অছিয়্যাতে লিখে যান এবং তাঁর ভাষণ সমূহে তুলে ধরেন। এখানে আরো অনেক কথা আছে; হয়তো অন্য কোনো উপযুক্ত উপলক্ষ্যে সে সব কথা বলবো। তবে এখানে আমি ‘ইছ্লাহ্’ অর্থাৎ ‘সংশোধন’ বা ‘সংস্কার’ কথাটির ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করতে চাই। কারণ, এটা হচ্ছে এমন একটি পরিভাষা আমাদের রাজনৈতিক সাহিত্যে যা অনেক বেশী ব্যবহৃত হচ্ছে। আর বিগত জুম্’আ নামাযের খোতবায় সম্মানিত রাহ্বার এ পরিভাষাটির উল্লেখ করেছেন। আমি তাঁর পথনির্দেশনার ধারায় অগ্রসর হয়ে এ ব্যাপারে অধিকতর ব্যাখ্যা উপস্থাপন করতে চাই। এ ব্যাপারে প্রথমে আমি এ পরিভাষাটির তাৎপর্য এবং কোরআন মজীদ ও রেওয়াইয়াতে এর ব্যবহারকে তুলে ধরবো। এরপর এর ব্যবহারিক দিকগুলো উপস্থাপন করবো।
‘ইছ্লাহ্’ (اصلاح) একটি আরবী শব্দ যার মূল শব্দ ‘ছোয়াদ্’ (ص), ‘লাম্’ (ل) ও ‘হে’ (ح) বর্ণ দ্বারা গঠিত। তাৎপর্যগত দিক থেকে এর দু’টি উৎস নির্দেশ করা হয়েছে। একটি হচ্ছে ‘ছুল্হ্’ (صُلح) এবং অপরটি হচ্ছে ‘ছালাহ্’ (صَلاح)।
‘ছুল্হ্’ থেকে নিষ্পন্ন ‘ইছ্লাহ্’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে আপোস বা মিলমিশ করিয়ে দেয়া। দুই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মধ্যে যখন মতবিরোধ সৃষ্টি হয়, বা তাদের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টি হয় বা ঝগড়া-বিবাদ বাধে তখন কেউ এগিয়ে এসে তাদের মধ্যকার বিরোধ দূর করে দেয় এবং তাদের মধ্য আপোসরফা ও মিলিমিশ করিয়ে দেয়। তখন বলা হয় যে, সে ‘ইছ্লাহ্’ করেছে। কোরআন মজীদে এর অন্যতম ব্যবহার হচ্ছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মিলমিশ করিয়ে দেয়া। তা হচ্ছে, স্বামী-স্ত্রীর মধে যদি মতবিরোধ দেখা দেয় তখন স্বামীর পরিবারের পক্ষ থেকে একজন ও স্ত্রীর পরিবারের পক্ষ থেকে একজন সালিস বসবেন এবং তাদের মধ্যে মিলমিশ করিয়ে দেবেন। আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন ঃ “তারা ঊভয়ই যদি মিলমিশ চায় তাহলে আল্লাহ্ তাদের উভয়ের মধ্যে মিলমিশ করিয়ে দেবেন।” এখানে ‘ইছ্লাহ্’ বা মিলমিশের বিষয়টি একটি দম্পতির মধ্যকার ব্যাপার।
কোরআনে মজীদে আপোস বা মিলমিশ করিয়ে দেয়া অর্থে ‘ইছ্লাহ্’ শব্দের অপর একটি ব্যবহার হচ্ছে অভিন্ন ধরনের দুই পক্ষের মধ্যে অর্থাৎ দুই ব্যক্তি বা দুই গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হলে তাদের মধ্যে আপোস বা মিলমিশ করিয়ে দেয়া। এরশাদ হয়েছে ঃ “আর তোমরা নিজেদের মধ্যে মিলমিশ করিয়ে দাও।” বিভিন্ন রেওয়াইয়াতেও এ কাজের জন্য অনেক ছওয়াবের কথা উল্লেখ আছে। বলা হয়েছে, যদি দুই জন মু’মিন, বা দু’টি গোষ্ঠী বা দু’টি পরিবার পরস্পরের সাথে আড়ি দেয় ও সম্পর্ক ছিন্ন করে তাহলে তাদের মধ্যে মিলমিশ করিয়ে দাও। এভাবে মিলমিশ করিয়ে দেয়ার মধ্যে ছওয়াব আছে; এ কাজের ছওয়াব বছরের পর বছর নফল ইবাদতের ছওয়াবের চেয়েও বেশী।
এভাবে দুই পক্ষের মধ্যে মিলমিশ করিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রটি অত্যন্ত সুপ্রশস্ত। ফলতঃ ইসলামী সমাজের মধ্যে দু’টি গোষ্ঠী যদি পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হয় তাহলে তাদের মধ্যেও মিলমিশ করিয়ে দিতে হবে। কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে ঃ “আর যদি মু’মিনদের দু’টি গোষ্ঠী পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হয় তাহলে তোমরা তাদের মধ্যে মিলমিশ (সন্ধি) করিয়ে দাও। অতঃপর যদি তাদের মধ্য থেকে এক গোষ্ঠী অপর গোষ্ঠীর ওপর চড়াও হয় তাহলে যে গোষ্ঠী চড়াও হলো তোমরা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করো যতক্ষণ না সে আল্লাহ্র ফয়সালার দিকে প্রত্যাবর্তন করে।” অর্থাৎ প্রথমে তাদের মধ্যে মিলমিশ করাবার জন্য চেষ্টা করতে হবে এবং তা সফল না হলে যুদ্ধ করতে হবে। অবশ্য এ যুদ্ধের বিষয়টি এখানে আমাদের আলোচ্য বিষয়ের সাথে প্রাসঙ্গিক নয়। তাই সে ব্যাপারে আলোচনায় যাচ্ছি না। আমি শুধু বলতে চাচ্ছি যে, ‘ইছ্লাহ্’ শব্দের একটি ব্যবহার হচ্ছে যু্দ্ধরত দুই পক্ষের মধ্যে মিলমিশ করিয়ে দেয়া।
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এবং দু’টি গোষ্ঠীর মধ্যে এই যে মিলমিশ করানো এ অর্থে ব্যবহৃত ‘ইছলাহ্’ শব্দটি ‘ছুল্হ্’ শব্দ থেকে নিষ্পন্ন হয়েছে। যে আয়াতে ম্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে মিলমিশ করিয়ে দেয়ার কথা বলা হয়েছে সে আয়াতেরই ধারাবাহিকতায় পরে বলা হয়েছে ঃ “আর মিলমিশই উত্তম।”
মোদ্দা কথা, এখানে ‘ইছলাহ্’ মানে মিলমিশ করিয়ে দেয়া, তা যেমন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে, তেমনি দুই ব্যক্তি বা দুই গোষ্ঠীর মধ্যে তথা মানুষের দু’টি পক্ষের মধ্যে।
কিন্তু ‘ইছলাহ্’ শব্দটির আরো একটি ব্যবহারও রয়েছে যা ‘ছালাহ্’ শব্দ থেকে নিষ্পন্ন হয়েছে, ‘ছুল্হ্’ শব্দ থেকে নয়। ‘ছালাহ্’ (صَلاح) শব্দটি হচ্ছে ‘ফাছাদ্’ (فَساد) শব্দটির বিপরীত। ‘ছালাহ্’ শব্দটিকে সাধারণতঃ ‘উপযুক্ততা’ অর্থে অনুবাদ করা হয়। ‘আমালে ছালেহ্ (عمل صالح) মানে হচ্ছে যথাযথ কাজ, উপযুক্ত কাজ, সঠিক কাজ। আর ছালেহ্ ব্যক্তি বলতে উপযুক্ত ব্যক্তিকে বুঝায়। ‘ইছলাহ্’ শব্দটি অনেক সময় এ অর্থে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ যথাযথ বা সঠিক কাজ আঞ্জাম দিন, অথবা ‘ফাছাদ্’ অপসারণ করুন। কারণ, এখানে মূল ‘ছালাহ্’ শব্দটি ‘ফাছাদ’ শব্দের বিপরীত। অতএব, ‘ছালাহ্’ থেকে নিষ্পন্ন ‘ইছ্লাহ্’ শব্দটি ‘ফাছাদ্’ থেকে নিষ্পন্ন ‘ইফ্ছাদ্’ শব্দের বিপরীত। তাই যে ব্যক্তি যথাযথ বা সঠিক কাজ সম্পাদন করতে চায় এবং ফাছাদ তথা দোষ-ত্রুটি, অনাচার, বিপর্যয় ইত্যাদি দূর করতে চায় তাকে ‘মুছ্লেহ্’ (مُصلح) বলা হয়। আর যে এর বিপরীতে সঠিক কাজকর্ম নষ্ট করে দেয় এবং সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে তাকে বলা হয় ‘মুফ্ছেদ্’ (مُفسد)। আপনারা ‘মুফছেদুন্ ফীল্ আর্দ্’ (مُفسد فی الارض) অর্থাৎ ‘ধরণীর বুকে বিপর্যয়-বিশৃঙ্খলা ও পাপাচার-অনাচার সৃষ্টিকারী’ কথাটির সাথে পরিচিত।
‘ইছ্লাহ্’ শব্দটি যখন এ প্রেক্ষাপটে ব্যবহৃত হয় তখন আর এর অর্থ দু’টি সমান সমান পক্ষের মধ্যে মিলমিশ করিয়ে দেয়া বুঝায় না, দুই ব্যক্তির মধ্যে ‘ইছ্লাহ্’ বুঝায় না তথা দু্ই ব্যক্তি বা দু’টি গোষ্ঠীর মধ্যে আপোসরফা ও মিলমিশ করিয়ে দেয়া অর্থ বহন করে না। কেউ যখন বিপর্যয়-বিশৃঙ্খলা ও পাপাচার-অনাচার দূর করতে চায় তখন সে দু’টি পক্ষ নিয়ে কাজ করে না। অন্যদিকে সে যখন তার নিজের জন্য উপযুক্ত কাজ আঞ্জাম দিতে চায় তখন সে ব্যক্তিক কাজ সম্পাদন করে।
অতএব, দেখা যাচ্ছে যে, ‘ছালাহ্’ মূল শব্দ থেকে যে ‘ইছ্লাহ্’ শব্দের উৎপত্তি তার বাস্তব দৃষ্টান্ত দু’ধরনের। একটি হচ্ছে যথাযথ কাজ সম্পাদন করা এবং আরেকটি হচ্ছে বিপর্যয়-বিশৃঙ্খলা ও পাপাচার-অনাচার দূর করা অথবা পাপাচারকে প্রতিরোধ করা। কোরআন মজীদে এ শব্দটি এ উভয় অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন, বলা হয়েছে ঃ “তারা ব্যতীত যারা তাওবাহ্ করেছে ও ‘ইছ্লাহ্’ করেছে।” এখানে اصلحوا মানে عملوا عملا صالحا অর্থাৎ যে সব ভুল ও অন্যায় কাজ বা পাপ কাজ করেছিলো তার পরিবর্তে “যথোপযুক্ত ও সঠিক কাজ সম্পাদন করেছে।” মানে নিজের কাজকে সংশোধন করে নিয়েছে ও ভালো কাজ সম্পাদন করেছে।
‘ইছ্লাহ্’ শব্দের দ্বারা প্রধানতঃ বিপর্যয়-বিশৃঙ্খলা ও পাপাচার-অনাচার দূর করা অথবা পাপাচারকে প্রতিরোধ করা বুঝায় এবং এটি মূলতঃ সামাজিক ও সামষ্টিক ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর উক্তিতে শব্দটি এ অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে এবং আজকের দিনের রাজনৈতিক ও সামাজিক সাহিত্যেও কথাটি এ অর্থেই ব্যবহৃত হয়। এটি ‘ইফ্ছাদ্’-এর বিপরীতে বিপর্যয়-বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি ও পাপাচার-অনাচার দূর করা অর্থে ব্যবহার করা হয়।
হ্যা, আমাদের কাছে এখন আরবী অভিধানের দৃষ্টিতে এবং কোরআন মজীদে ব্যবহৃত দ্বীনী পরিভাষা হিসেবে ‘ইছ্লাহ্’ শব্দের ব্যবহার সুস্পষ্ট হয়ে গেলো। কিন্তু আজকের দিনে আমরা যে ‘ইছ্লাহ্’ শব্দটি ব্যবহার করছি রাজনৈতিক পরিভাষায় তাতে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য যুক্ত হয়েছে যা ইংরেজী ‘রিফর্ম’ শব্দের অভিন্ন অর্থে ও ‘বিপ্লব’-এর বিপরীতে ব্যবহৃত হয়। সমাজে যে পরিবর্তন সৃষ্টি করা হয় তারা তাকে বলে ‘ইছ্লাহ্’। কিছু লোক সমাজে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং ক্ষেত্র বিশেষে এ পরিবর্তন ধীরে ধীরে সৃষ্টি করা হয়, বিদ্যমান পরিস্থিতির সাথে তাল মিলিয়ে ধীরে ধীরে সৃষ্টি করা হয়, একে বলা হয় ‘রিফর্ম’ বা সংস্কার। আর এ ধরনের লোকদেরকে বলা হয় ‘ইছ্লাহ্ ত্বালাব্’ বা ‘সংস্কারবাদী’ অর্থাৎ যারা ক্রমান্বয়ে বা ধীরে ধীরে পরিবর্তন সাধন করতে চায়। ইংরেজী পরিভাষায়ও যারা একবারে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটাতে চায় সেই ‘রিভোলু্যশনারী’ বা ‘বিপ্লবী’দের বিপরীতে ‘রিফর্মিস্ট্’ বা ‘সংস্কারবাদী’ পরিভাষা ব্যবহৃত হয়। এখানে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দৃষ্টান্ত হচ্ছে ইরানের ইসলামী বিপ্লব _ যাতে সহসাই এবং অত্যন্ত দ্রুত গতিতে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।
বিপ্লবের বিপরীতে এই যে ‘ইছ্লাহ্’ বা ‘সংস্কার’ শব্দের ব্যবহার করা হচ্ছে এটা শব্দটির অধিকতর বিশেষ অর্থে ব্যবহার। এর পিছনে কোনো আভিধানিক বা দ্বীনী পারিভাষিক মূল নিহিত নেই। এটা একটা নতুন রাজনৈতিক পরিভাষা যাতে ‘ইছলাহ্’ বা ‘সংস্কার’কে ‘বিপ্লব’-এর বিপরীতে ব্যবহার করা হচ্ছে। এর দ্বারা বুঝাতে চাওয়া হয় ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন সৃষ্টি; একবারে, সহসা, দ্রুতগতি ও সহিংসতা সহকারে পরিবর্তন নয়, বরং ধীরে ধীরে ও ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন সাধন। একে বলা হচ্ছে ‘ইছ্লাহ্’ বা ‘সংস্কার’। নিঃসন্দেহে এ ধরনের ‘ইছ্লাহ্’ এক নতুন ধরনের ‘ইছ্লাহ্’। কোরআন মজীদে এ অর্থে ‘ইছ্লাহ্’ শব্দ ব্যবহৃত হয় নি এবং হাদীছ ও রেওয়াইয়াতেও এ শব্দটি এ অর্থে ব্যবহৃত হয় নি।
হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)ও যখন বলেন ঃ “আমি আমার নানার উম্মাতের ‘ইছ্লাহ্’র সন্ধানে বহির্গত হয়েছি।” তখন তিনি এ বিশেষ অর্থ, এ বিশেষ ধরনের সংস্কার বুঝাতে চান নি। তিনি স্বয়ং যে তৎপরতা পরিচালনা করেন তা ধীরে ধীরে পরিচালিত কোনো পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তনের ও অহিংস পরিবর্তনের তৎপরতা ছিলো না। তা ছিলো তাঁর সেই লক্ষ্যের পথে যুদ্ধ এবং অনেকগুলো সম্মানিত মানুষের নিহত হওয়া ও আত্মোৎসর্গ করা।
আপনাদের হয়তো স্মরণ থেকে থাকবে যে, সম্মানিত রাহ্বার বলেছিলেন ঃ “আমরা যখন বলি ‘ইছ্লাহ্’ তখন তা শব্দটির সেই বিশেষ অর্থে ব্যবহার করি না যা আজকের রাজনৈতিক পরিভাষায় ব্যবহৃত হচ্ছে। এ শব্দের দ্বারা আমরা বুঝাতে চাই অন্যায়-অনাচার, পাপাচার, দুর্নীতি ও বিশৃঙখলার বিরুদ্ধে সংগ্রাম, এ সবের উৎপাটন, তা ধীরে ধীরেই হোক, বা একবারে ও বৈপ্লবিক পন্থায়ই হোক।” এ কারণে তিনি বলেন, ইরানের ইসলামী বিপ্লব স্বয়ং ছিলো সবচেয়ে বড় ‘ইছ্লাহ্’, যদিও আজকের রাজনৈতিক পরিভাষায় তাকে ‘ইছ্লাহ্’ বলা হচ্ছে না; একে বলা হয় ‘বিপ্লব’ _ যা ‘রিফর্ম’-এর বিপরীতে ব্যবহৃত হয়। তিনি এটাই বুঝাতে চেয়েছেন।
আমরা যখন ‘ইছ্লাহ্’র কথা বলি, তা কোরআনের পরিভাষা হিসেবেই হোক, অথবা হাদীছ ও রেওয়াইয়াতে ব্যবহৃত অর্থেই হোক, তা থেকে আমরা পর্যায়ক্রমিক, একবারে, বৈপ্লবিক ও দ্রুতগতি নির্বিশেষে সকল ধরনের ‘ইছ্লাহ্’কে বুঝাতে চাই এবং এ দৃষ্টিকোণ থেকে ইরানের ইসলামী বিপ্লব ছিলো সবচেয়ে বড় ‘ইছ্লাহ্’। কারণ, এ বিপ্লবের ফলে অনেক দুর্নীতি-অনাচার ও পাপাচার একবারে নির্মূল হয়েছে।
অবশ্য আমরা যখন বলি ‘একবারে’ তখন আসলে তা একটা আপেক্ষিক পরিভাষা। নচেৎ এ দুনিয়ায় কোনো কাজই সহসা একবারে সংঘটিত হয় না। দীর্ঘ পনর বছরব্যাপী আন্দোলনের পর্যায় অতিক্রান্ত হয় এবং কেবল এর পরেই আমাদের বিপ্লব বিজয়ী হয়। তবে বিপ্লবের ঘটনাটা এমন ছিলো না যে, পরিবর্তনের কাজগুলো ধীরে ধীরে শুরু করা হয়েছিলো, বরং এটা ছিলো একবারে পরিবর্তন। আগেকার সরকার ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। গোটা প্রশাসন যন্ত্র ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, আগেকার নীতিমালা অপসারিত হয়, আগেকার সংবিধান বাতিল হয়ে যায়, নতুন সংবিধান প্রণীত ও প্রবর্তিত হয়, একটি সর্বাত্মক মৌলিক বিবর্তন সাধিত হয়; এরই নাম বিপ্লব।
হ্যা, এ গেলো ‘ইছ্লাহ্’ পরিভাষা সংক্রান্ত ব্যাখ্যা। কোরআন মজীদে যে সব ক্ষেত্রে ‘ইছ্লাহ্’ পরিভাষা ব্যবহৃত হয়েছে তা হয় ‘ছুল্হ্’ শব্দ থেকে নয়তো ‘ছালাহ্’ শব্দ থেকে নিষ্পন্ন হয়েছে। এখানে ‘ছালাহ্’ শব্দ থেকে নিষ্পন্ন ‘ইছলাহ্’ পরিভাষাই আমাদের আলোচ্য বিষয়। এই ‘ছালাহ্’ হচ্ছে ‘ফাছাদ্’-এর বিপরীত শব্দ। বস্তুতঃ ‘ছালাহ্’ ও ‘ফাছাদ্’ কোরআন মজীদে ব্যবহৃত মূল্যবোধ বিষয়ক সর্বাধিক সাধারণ পরিভাষা সমূহের অন্যতম।
যেহেতু আমাদের তরুণদের অনেকেই হয়তো এসব পরিভাষার সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ তাৎপর্যের সাথে ভালোভাবে পরচিত নয়, সেহেতু এ ব্যাপারে কিছুটা ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে। আমরা বিদ্যমান বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে এসব পরিভাষা ব্যবহার করে থাকি। অনেক বিষয় সম্পর্কে আমরা বলি যে, এমনটি হওয়া উচিৎ অথবা বলি যে, এমনটি হওয়া উচিৎ নয়। এই যে বলা হয় ‘উচিৎ’ ও ‘অনুচিৎ’, এর অন্তরালে যে তাৎপর্য নিহিত থাকে তাকে বলে মূল্যবোধ সংক্রান্ত তাৎপর্য। ভালো কাজ কোন্টি? যে কাজ করা উচিৎ। মন্দ কাজ কোন্টি? যে কাজ করা অনুচিৎ। ‘ছালাহ্’ বা উপযুক্ত কাজ কী? যে কাজটি এমন যে, তা করার উপযোগী। ‘ফাছাদ্’ কী? যে কাজ প্রতিরোধ করা উচিৎ বা আঞ্জাম দেয়া অনুচিৎ।
অতএব, দেখা যাচ্ছে যে, ‘ছালাহ্’ ও ‘ফাছাদ্’ হচ্ছে দু’টি মূল্যবোধ বিষয়ক তাৎপর্য। অর্থাৎ দু’টি পরিভাষাকে বিশ্লেষণ করলে তা থেকে ‘উচিৎ’ ও ‘অনুচিৎ’ বেরিয়ে আসে। এ মূল্যবোধ বিষয়ক তাৎপর্যগুলো ক্ষেত্রবিশেষে সীমিত ও তা বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় এবং ক্ষেত্রবিশেষে অত্যন্ত প্রশস্ত যা সকল ভালো কাজকে শামিল করে অথবা সকল মন্দ কাজকে শামিল করে। যে সব তাৎপর্য সকল ভালো কাজ বা সকল মন্দ কাজের বেলা প্রযোজ্য হয় তাকে আমরা বলি মূল্যবোধ বিষয়ক সাধারণ তাৎপর্য। কোরআন মজীদে মূল্যবোধ বিষয়ক কয়েকটি সাধারণ তাৎপর্য রয়েছে। এর মধ্যে দু’টি পরিভাষা হচ্ছে ‘ছালাহ্’ ও ‘ফাছাদ্’ এবং দু’টি পরিভাষা হচ্ছে ‘মা’রূফ্’ ও ‘মুন্কার্’। ‘মা’রূফ্’ মানে যে কোনো ভালো কাজ এবং ‘মুন্কার্’ মানে যে কোনো মন্দ কাজ। ‘মা’রূফ্’ ও ‘মুন্কার্’ _ এ দু’টি পরিভাষাও মূল্যবোধ বিষয়ক, আর তা হচ্ছে সাধারণ মূল্যবোধ। ‘খায়র্’ বা ‘কল্যাণ’ ও ‘শার্’ বা ‘অকল্যাণ’ও অনুরূপ দু’টি সাধারণ মূল্যবোধ বিষয়ক পরিভাষা। এর বাইরে আরো অনেক মূল্যবোধ বিষয়ক তাৎপর্য জ্ঞাপক পরিভাষা রয়েছে। কিন্তু সেগুলো আমাদের আলোচ্য বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় বিধায় এখানে তার উল্লেখ থেকে বিরত থাকলাম।
মূল্যবোধ বিষয়ক তাৎপর্য সমূহের কোনো হুবহু প্রতিভু বা হুবহু দৃষ্টান্ত নেই। এটা মূল্যবোধ বিষয়ক তাৎপর্য সমূহের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এর মানে কী? আপনারা অনেক সময় বলেন ঃ বাতাস গরম। অথবা বলেন ঃ এ জায়গাটা উজ্জ্বল। এগুলোকে আপনারা হুবহু অভিজ্ঞতার আলোকে নির্দেশ করতে পারেন। এটা বাতি; এ জায়গা আলোকিত। আপনারা দেখতে পাচ্ছেন যে, সুইচ অফ্ করে দিলে বাতি নিভে যায়, আবার অন্ করলে বাতি জ্বলে ওঠে। এটাকে একটা হুবহু মানদণ্ডের সাহায্যে বা বাস্তব অভিজ্ঞতার দ্বারা দেখানো যেতে পারে যে, এ জায়গাটা আলোকিত _ এ কথা কি সঠিক, নাকি ভুল? হাওয়া কি গরম, নাকি গরম নয়? আপনি যদি ঘেমে যান, যদি অস্বস্তি অনুভব করেন, তাহলে বোঝা যাচ্ছে যে, হাওয়া গরম। আর যদি গরম কাপড় গায়ে না দিলে কাঁপতে থাকেন তাহলে প্রমাণ হবে যে, হাওয়া ঠাণ্ডা। এ সব ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাজাত হুবহু মানদণ্ড রয়েছে। অর্থাৎ ইন্দ্রিয়জাত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি যে, এইটি, নাকি ঐটি _ এই রকম, নাকি ঐ রকম? গরম, নাকি ঠাণ্ডা? অন্ধকার, নাকি আলোকিত?
মূল্যবোধ বিষয়ক তাৎপর্য সমূহ এ ধরনের নয়। বলা হয়, এ কাজটা কি ভালো, নাকি মন্দ? কোন্ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বলবো? ভালো সমূহ ও মন্দ সমূহ, ‘ছালাহ্’ সমূহ ও ‘ফাছাদ’ সমূহ, ‘মা’রূফ্’ সমূহ ও ‘মুন্কার’ সমূহ কীভাবে চেনা যায়? বলা হয়, মূল্যবোধের মানদণ্ডে বিচার করে। এসব বিষয় মূল্যবোধ ব্যবস্থার আওতাধীন। লোকেরা নিজেদের জন্য অর্থাৎ ব্যক্তিবর্গ, গোষ্ঠীবর্গ ও সমাজ সমূহ নিজেদের জন্য এক ধরনের মূল্যবোধ ব্যবস্থার অধিকারী। অর্থাৎ তারা কতগুলো কাজকে ভালো বলে জানে এবং কতগুলো কাজকে মন্দ বলে জানে। কিন্তু কতক ক্ষেত্রে কোনা একটি মূল্যবোধ ব্যবস্থা অনুযায়ী একটি কাজ ভালো বলে পরিগণিত হয়, অথচ সেই একই কাজ অন্য একটি মূল্যবোধ ব্যবস্থা অনুযায়ী মন্দ বলে পরিগণিত হয়।
এ ব্যাপারে অনেক উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। তবে সেদিকে যেতে চাচ্ছি না। কারণ, এটা একটা চারিত্রিক দর্শন ও মূল্যবোধ বিষয়ক দর্শন সংশ্লিষ্ট আলোচনা। আমি এ আলোচনায় গিয়ে আপনাদেরকে ক্লান্ত করতে চাই না। এখানে এ বিষয়টি উল্লেখের পিছনে আমার উদ্দেশ্য ছিলো এটাই তুলে ধরা যে, বিভিন্ন মূল্যবোধ ব্যবস্থা অনুযায়ী ‘ছালাহ্’ ও ‘ফাছাদ্’ সংক্রান্ত তাৎপর্যে পার্থক্য ঘটে। এমন নয় যে, সমস্ত মানুষই ‘ভালো’কে এক রকম দেখে এবং একইভাবে ‘মন্দ’কে এক রকম দেখে। অতএব, হতে পারে যে, কোনো একটি কাজ বা কোনো বিশেষ আচরণ কোনো এক সমাজে ভালো বলে পরিগণত হয়, আবার তা-ই অন্য এক সমাজে মন্দ বলে গণ্য হয়। এ ব্যাপারে অনেক দৃষ্টান্ত দেয়া যায়। যেমন ঃ সম্মান প্রদর্শন কোনো সমাজে একভাবে করা হয় এবং মনে করা হয় যে, এভাবে সম্মান প্রদর্শন করা ভালো, কিন্তু অন্য একটি সমাজে সেই একই কাজ অশোভন বলে পরিগণিত হয়। এ ব্যাপারে অনেক দৃষ্টান্ত দেয়া যায়, কিন্তু এ জন্য আপনাদের মূল্যবান সময় নিতে চাই না।
মোদ্দা কথা, যেহেতু ‘ছালাহ্’ ও ‘ফাছাদ্’ এবং তা থেকে নিষ্পন্ন ‘ইছ্লাহ্’ ও ‘ইফ্ছাদ্’ হচ্ছে দু’টি মূল্যবোধ বিষয়ক তাৎপর্য, সেহেতু তা যখন কোথাও ব্যবহৃত হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই এ প্রশ্ন জাগ্রত হয় যে, ‘ইছ্লাহ্’ কথাটি কোন্ মূল্যবোধ ব্যবস্থার ভিত্তিতে বলা হচ্ছে? আমেরিকান ‘ইছ্লাহ্’, নাকি ইসলামী ‘ইছ্লাহ্’? মহান রাহবার যে বললেন, “ইসলামী, ঈমানী ও বিপ্লবী ইছ্লাহ্ সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য, কিন্তু আমেরিকান ইছ্লাহ্ আমাদের সমাজের কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়”, কেন তিনি এভাবে বললেন? তাহলে ইসলামী ‘ইছ্লাহ্’র সাথে আমেরিকান ‘ইছ্লাহ্’র পার্থক্য কী? তারা যে এ পরিভাষাটি ব্যবহার করে তার তাৎপর্য তাদের মূল্যবোধ ব্যবস্থার ও তাদের সংস্কৃতির অনুসারী। তাই দেখতে হবে, তারা কোন্ কাজকে ‘ভালো’ মনে করে? আর কোন্ কাজকেই বা তারা মন্দ মনে করে? তারা কোন্ কাজকে উচিৎ গণ্য করে এবং কোন্ কাজকে অনুচিৎ গণ্য করে? তারা তা কিসের ভিত্তিতে করে থাকে? ভালো ও মন্দ এবং উচিৎ ও অনুচিৎ নির্ণয়ের জন্য তাদের কাছে কী মানদণ্ড রয়েছে?
অতএব, আমরা যাতে বুঝতে পারি যে, কোন্ কাজটি ভালো এবং কোন্ কাজটি মন্দ সে জন্য প্রথমে আমাদেরকে মানদণ্ড সমূহ নির্ধারণ করতে হবে। অর্থাৎ দেখতে হবে যে, আমরা কোন্ মূল্যবোধ ব্যবস্থাকে গ্রহণ করেছি।
আমরা কি ইসলামী মূল্যবোধ ব্যবস্থাকে গ্রহণ করেছি এবং তার ভিত্তিতে ‘ইছ্লাহ্’ করতে চাই? অর্থাৎ ইসলাম যা কিছুকে ভালো বলেছে আমরা তা আঞ্জাম দিতে চাই এবং ইসলাম যা কিছুকে খারাপ বলেছে তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে চাই? নাকি আমেরিকানরা যে কাজকে ভালো বলে তা আঞ্জাম দিতে চাই, এমনকি ইসলাম বিরোধী হলেও? তেমনি আমেরিকানরা যে কাজকে খারাপ বলে তা পরিত্যাগ করবো এবং তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবো, এমনকি তা ইসলাম আঞ্জাম দিতে বললেও? প্রশ্ন হচ্ছে, এ রকম কোনো ব্যাপার হতে পারে কি? হ্যা, হতে পারে।
আমাদের জীবনে এমন কতগুলো বিষয় আছে যেগুলোকে সকল মানুষ সর্বাবস্থায়ই ও সকল সংস্কৃতিতেই সঠিকভাবে বুঝতে পারে এবং স্বীকার করে যে, সেগুলো মন্দ। উদাহরণ স্বরূপ, দেখা গেলো যে, এক ব্যক্তি অপর এক ব্যক্তিকে বিনা কারণে ঘুষি মারলো, একজনকে অযথাই গালি দেলো, অথবা একজন আরেক জনকে গুপ্তহত্যা করলো, তখন সকল মানুষই বলে যে, এটা খারাপ কাজ। যখন কেউ কোনো কারণ ছাড়াই কারো বিরুদ্ধে এমন কাজ করে যে কাজের সমর্থনে কোনো আইনগত মানদণ্ড নেই, না সে লোকটি কারো ওপর কোনো যুলুম-অত্যাচার করেছিলো, তা সত্ত্বেও লোকটিকে হত্যা করলো, বা তার ধনসম্পদ ছিনিয়ে নিলো বা তার মান-ইজ্জতের হানি করলো, তখন এ ধরনের কাজ হচ্ছে যুলুম। আর তা সমস্ত সংস্কৃতির দৃষ্টিতেই খারাপ। কতগুলো কাজ হচ্ছে যুলুমের বাস্তব দৃষ্টান্ত; এগুলো সকলেই স্বীকার করে; এসব ব্যাপারে কোনোরূপ মতপার্থক্য সৃষ্টি হয় না।
অন্যদিকে এমন কতগুলো কাজ আছে যেগুলোকে সকলেই ভালো বলে মনে করে। মানুষের সুস্থতার লক্ষ্যে সেবা করা এমন একটি বিষয় যে, সকলেই বুঝতে পারে এটা ভালো কাজ। কেউ যদি একটি ওষুধ আবিষ্কার করে এবং তা মানুষের হাতে তুলে দেয়, এভাবে সে মানুষের স্বাস্থ্যের সেবা করলো। তখন সকলেই বলে যে, সে একটি ভালো কাজ করেছে। এ ব্যাপারে কোনো মতপার্থক্য সৃষ্টি হয় না।
কিন্তু ভালো-মন্দের সকল বিষয় এ ধরনের নয়। এ ব্যাপারে যে সব দৃষ্টান্ত আজকের দিনে আমাদের জন্য অত্যন্ত বেশী বিবেচ্য বিষয় তা সংস্কৃতির সাথে সংশ্লিষ্ট _ যে ব্যাপারে বিভিন্ন সমাজের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। বর্তমানে বলা হচ্ছে, সংস্কৃতির বৈশ্বিকীকরণ করতে হবে। আমেরিকা তার নিজের সংস্কৃতিকে সমগ্র বিশ্ববাসীর ওপর চাপিয়ে দিতে চায়। তারা যে সাংস্কৃতিক ঐক্যের আহ্বান জানায়, সংস্কৃতির বৈশ্বিকীকরণের কথা বলে, পাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে চায়, তা এ কারণে যে, তারা কতগুলো জিনিসকে ভালো মনে করে এবং কতগুলো জিনিসকে মন্দ মনে করে। এর ভিত্তিতে তারা অন্যদেরকে বলে, তোমাদেরও এভাবেই চিন্তা করা উচিৎ।
এ ব্যাপারে অনেক দৃষ্টান্ত দেয়া চলে। অবশ্য কতগুলো দৃষ্টান্ত অশোভন; আমি এখানে সে সব দৃষ্টান্ত উল্লেখ করতে চাই না। তবে কতগুলো বিষয় আছে যে, দৃশ্যতঃ তার পিছনে ভালো উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে। যেমন, তারা মনে করে যে, হাতকাটা, প্রহার করা, মৃতু্যদণ্ড দেয়া ইত্যাদি কঠিন শাস্তি প্রদান করা খারাপ। এ কারণে জাতিসংঘের মানবাধিকার ঘোষণায় বলা হয়েছে যে, বিশ্বর সকল দেশেরই উচিৎ সহিংসতা মূলক বা নিষ্ঠুর শাস্তি রহিত করা। এ হচ্ছে মানবাধিকার ঘোষণার অন্যতম বিষয়বস্তু। আর সহিংসতা মূলক বা নিষ্ঠুর শাস্তি মানে কোনোরূপ ব্যতিক্রম বাদে ইসলামের পুরো দণ্ডবিধি। কারো হাতকাটা, কাউকে চাবুক মারা, মৃতু্যদণ্ড দেয়া এবং তা-ও বিভিন্ন অভিনব পন্থায় _ এ সবই ইসলামের দণ্ডবিধির অন্তর্ভুক্ত এবং তা সহিংসতা মূলক বা নিষ্ঠুর শাস্তি। মানবাধিকারের ঘোষণায় বলা হচ্ছে, বিশ্বের সকল দেশেরই এ ধরনের শাস্তি রহিত করার চেষ্টা করা উচিৎ। অর্থাৎ মানবাধিকার ঘোষণার দৃষ্টিতে এ ধরনের শাস্তি এক ধরনের ‘ফাছাদ্’ বা খারাপ কাজ, অতএব, এগুলোকে ‘ইছ্লাহ্’ বা সংস্কার করতে হবে। এগুলোকে ‘ইছ্লাহ্’ বা সংস্কার করতে হবে _ এ কথার মানে কী? এ কথার মানে হচ্ছে, এ আইনগুলোকে রহিত করতে হবে। এ ব্যাপারে আমরা কী বলছি?
আমরা আমাদের ইসলামী সংস্কৃতি অনুযায়ী বলছি যে, কোরআন মজীদ যা কিছুর নির্দেশ দিয়েছে তা অবশ্যই কার্যকর করতে হবে। যদি তা কার্যকর করা না হয় তাহলে তা হবে ‘ফাছাদ’ বা মন্দ কাজ। আল্লাহ্র দেয়া শাস্তিবিধান পরিত্যাগ করাই ‘ফাছাদ্’, আল্লাহ্র দেয়া শাস্তিবিধান তুলে দেয়াই ‘ফাছাদ্’, তার বাস্তবায়ন ‘ফাছাদ্’ নয়। কিন্তু তারা বলে, ইসলাম নির্ধারিত এ শাস্তিবিধান কার্যকরী করাই অশোভন কাজ, নোংরা কাজ, মন্দ কাজ, অতএব, এরূপ কাজের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে এবং এ আইন তুলে দিতে হবে ও এর বাস্তবায়ন প্রতিহত করতে হবে। তাহলে সেটাই হবে ‘ইছ্লাহ্’; এ ইছ্লাহ্’ বা সংস্কার হচ্ছে পশ্চাত্য সংস্কৃতি অনুযায়ী ‘ইছ্লাহ্’ বা সংস্কার এবং মানবাধিকারের ঘোষণায় তা-ই উলি্লখিত হয়েছে। তারা যখন বলে যে, তারা সহিংসতার ও নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধ আন্দোলন করছে, এ কথার দ্বারা তারা এটাই বুঝাতে চাচ্ছে। যদিও এই সাধারণ সহিংসতাগুলো সম্বন্ধে সকলেরই জানা আছে যে, এগুলো মন্দ কাজ, যেমন ঃ অযথা কাউকে গালি দেয়া, বা কারো সাথে দুর্ব্যবহার করা। সকলেই বলে যে, এগুলো খারাপ কাজ।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে চোরের হাতকাটা কেমন কাজ? নরহত্যাকারীকে মৃতু্যদণ্ড প্রদান কেমন কাজ? বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীকে দুষকৃতকারী গণ্য করে তাকে কঠোর শাস্তি দেয়া কেমন কাজ? তারা বলে, এসব কাজ হচ্ছে ‘ফাছাদ্’ বা মন্দ কাজ, এগুলো ঘৃণ্য কাজ। আধুনিক বিশ্ব এগুলোকে গ্রহণ করে না, অতএব, এগুলোকে পরিত্যাগ করতে হবে; এগুলোর বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হবে যাতে এগুলো সংশোধিত হয়। যদি কোনো আইনসমগ্রের মধ্যে এ ধরনের বিষয় থাকে তখন সে আইনসমগ্রকে যথাযথ ও সঠিক আইনসমগ্র হিসেবে গণ্য করা হয় না। এ ধরনের আইনসমগ্র পাশ্চাত্যের সভ্য জীবনের জন্য উপযুক্ত নয়, অতএব, এগুলোকে ‘ইছ্লাহ্’ বা সংস্কার করতে হবে।
কিন্তু আমরা যখন ‘ইছ্লাহ্’র কথা বলি তখন আমরা ঠিক এর বিপরীত কথাই বলি। কোথাও যদি আল্লাহ্ তা’আলার দেয়া শাস্তিবিধান বন্ধ হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে সেখানে তা চালু করতে হবে, কার্যকর করতে হবে _ যাতে বিদ্যমান পরিস্থিতির ‘ইছ্লাহ্’ হয়, সংস্কার হয়। ইসলামী আইনের বরখেলাফ কোনো আইন থেকে থাকলে তা পরিবর্তন করতে হবে, যাতে ‘ইছ্লাহ্’ হাসিল হয়। পরিবর্তন যদি ইসলামের সাথে সঙ্গতিশীল হয় তাহলে তা ‘ইছ্লাহ্’, আর যদি ইসলাম বিরোধী পরিবর্তন সংগঠিত হয় তাহলে তা হচ্ছে ‘ইফ্ছাদ্’।
তিন্তু অনেক প্রাচীন কাল থেকেই কিছু লোকের পক্ষ থেকে এ পরিভাষাগুলোকে অদল-বদল করে অপব্যবহার করা হয়েছে, এগুলোর ব্যাপারে ভ্রমাত্মক অপযুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে। এটা ছিলো মুনাফিকদের অন্যতম কর্মনীতি।
মুনাফিকরা হচ্ছে দুই চেহারার অধিকারী লোক। তারা সব সময় এমনভাবে কথা বলে যে, বিতর্কের বা বিরোধের উভয় পক্ষের লোকদের কাছে যেন তার যৌক্তিক বা গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা দেয়া যায়। এরই নাম নিফাক অর্থাৎ দুই জায়গায় দুই চেহারা দেখানো। তারা সব সময়ই হক ও বাতিলের মধ্যবর্তী সীমান্তপথে চলাচল করে; না পুরোপুরি হকের পথে, না পুরোপুরি বাতিলের পথে। বায়ু যদি সত্যের অনুকূলে প্রবাহিত হয় তখন তারা নিজেদেরকে হক ও বাতিলের মধ্যবর্তী সীমান্তের এ পাশে নিয়ে আসে এবং বলে ঃ “আমরা কি তোমাদের সাথে ছিলাম না?” তারা বলে, আমরা তো সব সময় তোমাদের সাথে ছিলাম; আমরা তো মু’মিন। কিন্তু বায়ু যদি অপর পক্ষের অনুকূলে প্রবাহিত হয় তাহলে তারা তাদের কাছে গিয়ে বলে ঃ ‘আমরা তো ওদের সাথে থেকে কেবল ওদেরকে ঐ কাজ থেকে ফিরাবার চেষ্টা করেছি; ওদেরকে বলেছি যে, এ কাজ করো না। কিন্তু ওরা আমাদের কথা শোনে নি।’ যেমন, যুদ্ধের ব্যাপারে তারা বলেছিলো ঃ ‘আমরা বলেছি, যুদ্ধ বন্ধ করে দাও; খোর্রাম শহর উদ্ধার করেছো _ এটাই যথেষ্ট; যুদ্ধকে আর বাড়তে দেয়া ঠিক হবে না। কিন্তু ওরা আমাদের কথা শোনে নি।’
মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য সব সময়ই এ রকম যে, তারা হক ও বাতিলের মধ্যবর্তী সীমান্তরেখার ওপর দিয়ে চলাচল করে। “তারা দোদুল্যমান অবস্থার অধিকারী _ না এদিকে, না ওদিকে।”
এরা হচ্ছে সুযোগ সন্ধানী, সুবিধাবাদী। প্রকৃতপক্ষে তারা না এদেরকে পসন্দ করে, না ওদেরকে। এরা এদের স্বার্থের পিছনে ছুটছে। বর্তমান যুগে এদের দৃষ্টান্ত হচ্ছে, আজকে হাওয়া এ পক্ষের অনুকূলে প্রবাহিত হলে তারা বিপ্লবী, আবার কালকে এদেরই একটি গোষ্ঠী ‘ইছ্লাহ্’পন্থী বা সংস্কারবাদী হয়ে যায়; তখন তারা ঐ পক্ষের হয়ে যায়। এটা হচ্ছে নিফকের বৈশিষ্ট্য।
মুনাফিকদের বৈশিষ্ট্য সমূহের অন্যতম হচ্ছে এই যে, সব সময়ই তারা নিজেদেরকে সংস্কারবাদী বলে দাবী করে। “আর লোকদের মধ্যে এমন লোক রয়েছে যারা বলে ঃ আমরা আল্লাহ্ ও পরকালের ওপর ঈমান এনেছি, কিন্তু তারা ঈমানদার নয়।” কেন তারা এ রকম করে? “তারা আল্লাহ্ ও ঈমানদারদেরকে বিদ্রুপ করে, তবে প্রকৃত পক্ষে তারা নিজেদেরকে ব্যতীত কাউকে বিদ্রুপ করে না, কিন্তু তারা তা বুঝতে পারছে না।”
একদল লোক অর্থাৎ এই দুই পা-ওয়ালা পশুগুলো এসে বলে, আমরা আল্লাহ্ ও কিয়ামতের ওপর ঈমান রাখি, আমরাও দ্বীনের ওপর আছি, আমরাও ধর্মপ্রাণ মানুষ। কিন্তু আসলে তারা মিথ্যা কথা বলে। তারা যে সব কথা বলে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এই যে, “তাদেরকে যখন বলা হবে যে, ধরণীর বুকে ফাছাদ্ সৃষ্টি করো না, তখন তারা বলবে ঃ অবশ্যই আমরা ইছ্লাহ্কারী।” তাদেরকে যখন ফাছাদ করতে নিষেধ করা হয়, পাপাচার ও অপরাধে লিপ্ত হতে নিষেধ করা হয়, বলা হয় ঃ ইসলামী আইন বিরোধী কাজ করো না, লোকদের ওপর মিথ্যা অপবাদ দিয়ো না, গুপ্তহত্যা করো না, তখন তারা বলে ঃ “আমরা তো ইছ্লাহ্কারী।” তারা বলে, আমরা সংস্কারবাদী। তারা যখন ‘ইছ্লাহ্’ বা সংস্কারের কথা বলে তখন তাদের উদ্দেশ্য থাকে অন্যকিছু।
আল্লাহ্ তা’আলা যখন তাদেরকে বলেন ঃ “তোমরা ফাছাদ্ করো না।” তখন তাতে ‘ফাছাদ্’ বলতে খোদায়ী মূল্যবোধ ব্যবস্থার ভিত্তিতে যা ‘ফাছাদ্’ তাকেই বুঝানো হয়। খোদায়ী ও কোরআনী মূল্যবোধ ব্যবস্থার ভিত্তিতে তিনি যখন দেখেন যে, তারা ‘ফাছাদ্’ করছে তখন তিনি বলেন ঃ “তোমরা ফাছাদ্ করো না।” কিন্তু তারা ভিন্ন একটি মূল্যবোধ ব্যবস্থাকে গ্রহণ করেছে। আজকের দিনে আমরা বলবো, তারা আমেরিকা বা পাশ্চাত্যের মূল্যবোধ ব্যবস্থাকে গ্রহণ করেছে। সে যুগেও এক ধরনের নাস্তিক্যবাদী মূল্যবোধ ব্যবস্থা ছিলো। এতে কোনো পার্থক্য নেই। যা কিছু অনৈসলামী, নাস্তিক্যবাদী, তা হচ্ছে কুফ্র্, তা আমেরিকানই হোক, বা বৃটিশই হোক বা অন্য কোনো জাতির সাথে সংশ্লিষ্ট হোক। তা যখন ইসলাম নয় তখন কী পার্থক্য? “সকল কুফ্র্ এক অভিন্ন আদর্শ।”
কোরআন মজীদ যখন বলে ঃ “তোমরা ধরণীর বুকে ফাছাদ্ সৃষ্টি করো না।” তখন এর মানে হচ্ছে, ইসলামী মূল্যবোধ ব্যবস্থা অনুযায়ী যে সব কাজ ‘ফাছাদ্’ সে সব কাজ করো না। কিন্তু তারা বলে ঃ না, আমরা যে সব কাজ করছি সে সব কাজ হচ্ছে ‘ইছ্লাহ্’, ‘ইফ্ছাদ্’ নয়।
আসল ব্যাপার হলো, তারা মূল ভিত্তির ব্যাপারেই মতপার্থক্য পোষণ করে। আল্লাহ্ তা’আলা এক জিনিসকে ‘ইছ্লাহ্’ বলে গণ্য করেন, আর তারা অন্য জিনিসকে ‘ইছ্লাহ্’ বলে গণ্য করে। আল্লাহ্ তা’আলা এক জিনিসকে ‘ইফ্ছাদ্’ বলে গণ্য করেন, কিন্তু তারা অন্য জিনিসকে ‘ইফ্ছাদ্’ বলে গণ্য করে। এ কারণেই কোরআন মজীদ বলে ঃ “সাবধান, মনে রেখো, এরাই হলো ‘মুফছেদ্’ _ ফাছাদ্কারী।” এখানে লক্ষণীয় যে, কোরআন মজীদে বহুবচন বাচক ‘মুফছেদুন্’ (ফাছাদ্কারীদের) শব্দের পূর্বে যে ‘আলিফ্’ ও ‘লাম্’ ব্যাবহার করা হয়েছে তা দ্বারা সমগ্রতা বুঝানো হয়েছে। বলা হয়েছে ঃ “সাবধান, মনে রেখো, এরাই হলো ফাছাদ্কারী।” অর্থাৎ প্রকৃত ফাছাদ্কারী হচ্ছে এই মুনাফিকরা।
এই যারা বলছে যে, আমরা ‘ইছ্লাহ্’ করছি, সংশোধন বা সংস্কার করছি, তারা মিথ্যা বলছে। এরা যে, বলছে ঃ ‘আমরা ঈমানদার।’ এ ক্ষেত্রে আসলে তারা মিথ্যা বলছে। এরা বলছে ঃ ‘আমরা দ্বীনদার বুদ্ধিজীবী।’ কিন্তু তারা জানে না যে, দ্বীন কী জিনিস। যখন ওহী সম্পর্কে কথা ওঠে তখন তারা বলে ঃ ‘ওহী এক ধরনের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা; কোনো ব্যক্তির মধ্যে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হয় যে, তখন তাঁর মনে হয়, আল্লাহ্ তাঁর সাথে কথা বলছেন। এটাই হচ্ছে ওহী।’ যখন দ্বীন নিয়ে কথা ওঠে তখন তারা বলে ঃ ‘দ্বীন বা ধর্ম আসলে ব্যক্তিগত বিষয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট; সামাজিক বিষয়াদির সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। দ্বীনে কি অর্থনীতি আছে? কক্ষনো নয়। দ্বীনে কি রাজনীতি আছে? মোটেই না। সামাজিক বিষয়াদি আছে? মোটেই না। চারিত্রিক মূল্যবোধ আছে? না।
তারা বলে, মূল্যবোধের সাথে তো ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। কারণ, মূল্যবোধ সমূহ তো পরিবর্তনশীল। ব্যক্তিদের রুচি অনুযায়ী তা প্রতিদিন পরিবর্তিত হচ্ছে। তাহলে তা কী? ধর্ম হচ্ছে কতগুলো আপেক্ষিক আনুষ্ঠানিক আদব-রসম ও রীতিনীতি। এগুলার ভিত্তিতে ব্যক্তি তারই উপাসনা করে সে যাকে তার খোদা বলে ধারণা করে। তাই একজন হয় মূর্তিপূজক এবং একজন হয় আল্লাহ্র উপাসনাকারী, আরেক জন হয় দুই খোদার উপাসনাকারী, অপর একজন তিন খোদার উপাসনা করে। এ-ই হলো ধর্ম। এ সবের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এটা যেমন একটি সোজা পথ, তেমনি ওটাও একটা সোজা পথ। পাথর কেটে কেটে যে মূর্তি তৈরী করা হয়েছে তার পূজা করা এক ধরনের সোজা পথ। আর ইসলাম যে খোদার কথা বলে, যিনি শরীর ও শরীরী হওয়ার সম্ভাবনা থেকে প্রমুক্ত, পরম পূর্ণতার অধিকারী, তাঁর উপাসনাও একটি ধর্ম। এসবের মধ্যে কোনোই পার্থক্য নেই। পার্থক্য নেই কেন? কারণ এদের কারোই বাস্তব অস্তিত্ব নেই। তা যখন মিথ্যা, তখন কী পার্থক্য আছ যে, এই মিথ্যা, নাকি ঐ মিথ্যা?’
এই লোকেরা দ্বীনদারীর দাবী করে। না, তারা শুধু দ্বীনদারীর দাবীই করছে না, তারা বলছে, ‘আমরা পথপ্রদর্শক, আমরা নেতা; আমরা অন্যদেরকে পথ দেখাচ্ছি, তাদেরকে দ্বীন শিক্ষা দিচ্ছি।’ এরপর এ ধরনের লোকেরাই এসে নিজেদেরকে ‘ইছ্লাহ্’পন্থী বলে, সংস্কারবাদী বলে দাবী করে। তারা কোন্ মূল্যবোধ ব্যবস্থার ভিত্তিতে নিজদেরকে ‘ইছ্লাহ্’পন্থী বা সংস্কারবাদী বলে দাবী করে?
তারা নিজেরাই বলছে ঃ ‘এ দুনিয়ার বুকে কোনো স্থায়ী মূল্যবোধের অস্তিত্ব নেই এবং থাকতে পারে না।’ ইসলামী আহকাম নিয়ে যখন আলোচনা হয় তখন লোকদেরকে প্রতারণা করার লক্ষ্যে আলোচনার একদম শেষে গিয়ে তারা বলে ঃ ‘হ্যা, এগুলো ইসলামের বিষয়। কিন্তু এগুলো ১৪০০ বছর আগেকার জিনিস। এখন পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। ইসলাম তো গতিশীল ধর্ম; প্রতিদিনই রূপ পরিবর্তন করে।’
ইসলাম যদি থেকে থাকে এবং আমরা যদি ইসলামের সমর্থক হয়ে থাকি এবং যদি চাই যে, ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হোক এবং সেজন্যই আমরা ইসলামী বিপ্লব করেছি, তাহলে প্রশ্ন এই যে, আমরা কোন্ ইসলামের কথা বলছি? আমরা কি ১৪০০ বছর আগেকার ইসলামের কথা বলছি, নাকি তোমরা আমেরিকা থেকে যে ইসলাম আমদানী করেছো তার কথা? যারা ইসলামী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য লক্ষ লক্ষ শহীদ উৎসর্গ করলেন তাঁরা কি সেই ইসলাম চাচ্ছিলেন তোমরা যার কথা বলছো? তোমরা যে কুফ্রের নাম রেখেছো ইসলাম তাঁরা কি সেটাই চাচ্ছিলেন? তোমরা এই যে ‘ইফ্ছাদ্’-এর নাম দিয়েছো ‘ইছ্লাহ্’, তাঁরা কি তা-ই চাচ্ছিলেন? তোমরা যে হিজাব অপসারণ করেছো, নারীরা নগ্ন হয়ে তোমাদের সভা-মজলিসে আসছে, তোমরা যে মদপান করাকে অবাধ করে দিয়েছো, এই যে ছেলে ও মেয়েরা একত্রে রাস্তায় নাচানাচি করছে, তাঁরা কি এগুলো চাচ্ছিলেন?
আমাকে বলা হয়েছে ঃ ‘আপনি এখানে এসব কথা বলছেন কেন?’ যদি এখানে না বলবো তাহলে কখন কোথায় এগুলো বলা হবে? সকল মানুষ তো আর দৈনিক পত্রিকা পড়ে না।
এই জনাবেরা এগুলোকেই বলেন ‘ইছ্লাহ্’ বা সংস্কার। তারা আড়াই হাজার বছর আগেকার কুফরী ঐতিহ্য পুনরুজ্জীবিত করতে চায়; এরই নাম সংস্কার। তারা খোদায়ী আহকাম বন্ধ করে দেবে, কোরআনের আইনকে পরিবর্তন করবে _ এগুলোকে এরা বলছে ‘ইছ্লাহ্’ বা সংস্কার। “তাদেরকে যখন বলা হবে যে, ধরণীর বুকে ফাছাদ্ সৃষ্টি করো না, তখন তারা বলবে ঃ অবশ্যই আমরা ইছ্লাহ্কারী।” আল্লাহ্ বলেন ঃ “সাবধান, মনে রেখো, এরাই হলো ফাছাদ্ সৃষ্টিকারী।” এগুলোরই নাম ‘ফাছাদ’।
এবার দেখুন, সাইয়েদুশ শুহাদা হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) কী জন্য অভু্যত্থান করেছিলন? তিনি কি জনগণের ওপর নিজের মনগড়া একটা শাসন ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়ার জন্য অভু্যত্থান করেছিলেন? এটাই কি ছিলো তাঁর কাঙ্ক্ষিত ‘ইছ্লাহ্’ বা সংস্কার? নাকি তিনি বলেছিলেন ঃ ‘আমার নানা যে আহ্কাম নিয়ে এসেছেন তোমরা তার ভিত্তিতে আমল করো।’? তিনি যখন দেখতে পান যে, খেলাফতের দাবীদার ব্যক্তি মদ্যপ এবং সে মাতাল অবস্থায় নামায পড়ে, তখন কি তিনি বলেছিলেন ঃ ‘আহ্লান্ সাহ্লান্ _ খোশ আমদেদ।’? তিনি কি একে ‘ইছ্লাহ্’ বলেছিলেন? নাকি তিনি বলেছিলেন ঃ ‘মদ্যপকে সরিয়ে দিতে হবে এবং তার ওপর ইসলামী দণ্ডবিধি কার্যকর করতে হবে।’?
যারা মদ্যপদেরকে সবুজ সঙ্কেত দেয়, তারা যখন কোনো কোনো জায়গায় এসে বিদেশী অতিথিদেরকে বলে ঃ ‘আপনাদের যদি হুইস্কির প্রয়োজন থাকে তাহলে আপনাদের জন্য তার ব্যবস্থা করবো।’ দেশের কোনো কোনো সরকারী সংস্থার পক্ষ থেকে এর নামকরণ করা হয় ‘ইছ্লাহ্’। কেন? তারা বলে ঃ ‘বিপ্লবের পর লোকেরা খুব বেশী কড়াকড়ি করেছে; বিদেশী অতিথিদেরকে আসতে দেয় নি। আমাদের এ সব কিছুকে ‘ইছ্লাহ্’ করতে হবে। এগুলো বিদেশী অতিথিদের জন্য আসুক, তাহলে পাশাপাশি আমরাও এগুলো ভোগ করতে পারবো। বিদেশী অতিথিরা আসুক; তারা তাদের ব্যাগে করে হুইস্কি ও এ জাতীয় জিনিস নিয়ে আসুক।
এসব কথা বাদ দিলাম। প্রশ্ন হচ্ছে ‘ইছ্লাহ্’ মানে কী? হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) যে বললেন ঃ “আমি আমার নানার উম্মাতের সংশোধনের সন্ধানে বহির্গত হয়েছি।” এখানে দেখতে হবে যে, এ কথা বলতে তিনি কী বুঝাতে চেয়েছিলেন। এখানে আমি তাঁর উক্তি থেকে আরেকটি উদ্ধৃতি দিতে চাই; সম্ভবতঃ এ থেকে তাঁর উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যাবে। তিনি কারাবালায় যাওয়ার পথে যে সব ভাষণ দেন এ উক্তিটি তারই মধ্যকার একটি ভাষণের অংশ।
আপনারা অবশ্যই হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর এ উক্তিটি শুনে থাকবেন। তা সত্ত্বেও যেহেতু আমি ‘ইছ্লাহ্’ সম্পর্কে আলোচনা করছি, সেহেতু প্রাসঙ্গিক বিধায় আমি এখানে তার পুনরুক্তি করছি। তিনি বলেন ঃ “রাসূলুল্লাহ্ (ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহে ওয়া আলেহ্) এরশাদ করেন ঃ কেউ যখন কোনো অত্যাচারী আধিপত্যকারীকে দেখতে পায় যে ব্যক্তি আল্লাহ্র নির্ধারিত হারামকে হালাল করেছে, আল্লাহ্পন্থীদের অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে, আল্লাহ্র রাসূলের সুন্নাতের বিরোধিতা করেছে এবং আল্লাহ্র বান্দাহ্দের মধ্যে পাপাচার ও খোদাদ্রোহিতা সহকারে আচরণ করে, অথচ সে (যে তা দেখতে পেলো) কাজ বা কথার দ্বারা তাকে পরিবর্তিত করে দিলো না, তখন আল্লাহ্র জন্য এটা অবধারিত হয়ে যায় যে, তিনি এই ব্যক্তিকে তার (অর্থাৎ খোদাদ্রোহী ব্যক্তির) প্রবশদ্বার দিয়ে প্রবেশ করাবেন।”
এখানে “সুলতানে যায়ের্” বা ‘অত্যাচারী আধিপত্য’ মানে হচ্ছে জোর করে বা শক্তি প্রয়োগে ক্ষমতা দখলকারী এবং ‘আল্লাহ্পন্থীদের অঙ্গীকার’ মানে আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর বান্দাহ্দের কাছ থেকে সাধারণভাবে তাঁর বান্দাহ্ হিসেবে চলার যে অঙ্গীকার গ্রহণ করেছেন। আল্লাহ্ বলেন ঃ “হে আদম-সন্তানগণ! আমি তোমাদের কাছ থেকে কি এ মর্মে অঙ্গীকার গ্রহণ করি নি যে, তোমরা শয়তানের দাসত্ব করবে না, কারণ, সে তোমাদের সুস্পষ্ট দুশমন, এবং (এ মর্মেও কি আদেশ দেই নি যে,) তোমরা আমার দাসত্ব করো? আর এটাই হচ্ছে সুপ্রতিষ্ঠিত সরল পথ।”
এটাই হচ্ছে আল্লাহ্ তা’আলার গৃহীত অঙ্গীকার। কেউ যদি দেখতে পায় যে, অমুক ব্যক্তি তার ক্ষমতার বদৌলতে আল্লাহ্র গোলামী থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর আদেশ-নিষেধ সমূহের বিরোধিতা করছে, হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) যা এরশাদ করেছেন তদনুযায়ী আমল করছে না, আর আর জনগণের সাথে তার আচরণ হচ্ছে পাপাচার ও খোদাদ্রোহিতা সহকারে, কেউ যদি এমন কোনো শক্তিধরকে দেখার পরেও স্বীয় কথা ও আচরণের দ্বারা ঐ শক্তিধরকে পরিবর্তিত করে না দেয় অর্থাৎ তার মোকাবিলায় কিছু না করে অথবা কথা বা কাজের মাধ্যমে তাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা না করে, কোনো মুসলমান এটা দেখার পরেও যদি তাকে খারাপ পথ থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য কিছু না করে, তাহলে এটা আল্লাহ্র অধিকার যে, এই ব্যক্তিকেও ঐ যালেমের সাথে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন, তার সঙ্গী করে দেবেন। কারণ, ঐ যালেম এসব কাজ করছে এবং এই ব্যক্তি নীরব থেকেছে, আর অন্যায় কাজের মোকাবিলায় নীরব থাকা মানে কার্যতঃ সে কাজে সম্মতি দেয়া এবং এ কারণেই তাকে ঐ ব্যক্তির সঙ্গী হতে হবে।
হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) এরপর বলেন ঃ “সাবধান, মনে রেখো, এরা শয়তানের আনুগত্যকে শিরোধার্য করে নিয়েছে।” অর্থাৎ আমি যাদের মুখোমুখি হয়েছি _ এই বনী উমাইয়্যাহ্ _ এরা শয়তানের আনুগত্যকে নিজেদের জন্য অবধারিত করে নিয়েছে, অথচ শয়তানের আনুগত্য পরিত্যাগের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কারণ, আল্লাহ্ তা’আলা বনী আদমের কাছ থেকে অঙ্গীকার গ্রহণকালে বলেছেন ঃ “তোমরা শয়তানের দাসত্ব করবে না, কারণ, সে তোমাদের সুস্পষ্ট দুশমন।” কিন্তু এরা তার বিপরীত কাজ করছে; তারা শয়তানের আনুগত্য করছে, আল্লাহ্র আনুগত্য করছে না।
ইমাম (আঃ) এরপর বলেন ঃ “আর তারা ‘ফাছাদ্’-এর বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। বস্তুতঃ আমার আলোচ্য বিষয়ের লক্ষ্য ছিলো এটাই। এরা ‘ফাছাদ্’-এর বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে, এরা সমাজে ‘ফাছাদ’-এর আবির্ভাব ঘটিয়েছে। তারা কী করেছে? এরই ব্যাখ্যা স্বরূপ ইমাম (আঃ) বলেন ঃ “তারা হুদুদ্ _ খোদায়ী দণ্ডবিধি বন্ধ করে দিয়েছে।” যেখানে চোরের হাত কাটা উচিৎ, তারা তা করে নি। ব্যভিচারকারী নারী ও পুরুষকে যেখানে চাবুক মারা উচিৎ ছিলো, তারা তাদেরকে চাবুক মারছে না। আল্লাহ্ তা’আলার অন্যান্য আহকামও যেখানে কার্যকর করা উচিৎ ছিলো, তারা তা করছে না। এগুলোই হচ্ছে ‘ফাছাদ্’; হোসাইনী সংস্কৃতিতে এগুলো হচ্ছে ‘ফাছাদ্’। তিনি আরো বলেন ঃ বাইতুল মালকে যেমন খুশী ব্যবহার করছে। তারা বাইতুল মালের সম্পদকে নিজেদের ও তাদের অত্মীয়-স্বজন ও অনুগতদের জন্য নির্দিষ্ট করে নিয়েছে। যে বাইতুল মাল সমস্ত মুসলমানের জন্য ব্যয়িত হওয়া উচিৎ, যেসব উপায়-উপকরণ ও সুযোগ-সুবিধা সমানভাবে সকলকে দেয়া উচিৎ এরা তা কেবল তাদের নিজস্ব লোকদের মাঝে বণ্টন করছে। ইমাম বলেন (আঃ) ঃ “আর আল্লাহ্র হারামকে বৈধ করেছে।” অর্থাৎ আল্লাহ্ তা’আলা যে সব জিনিসকে হারাম করেছেন, এরা বলছে যে, এগুলোতে কোনো দোষ নেই। এই পরিমাণে হলে দোষ নেই; ইসলাম গতিশীল ধর্ম। আমরা গতিশীল ফিকাহ্ চাই; গতকাল হারাম ছিলো, আজকে হালাল।
তারা এমন কাজ করেছে যে, আমাদের আত্মীয়-স্বজনের মধ্য থেকে দ্বীনদার ছেলেরা আমাকে টেলিফোন করে বলে, অমুক! নাচ কখন জায়েয হবে? এখনো কি জায়েয হয় নি? বয়-ফ্রেন্ড গ্রহণ ও গার্ল-ফ্রেন্ড গ্রহণ কখন জায়েয হবে? এখনো কি আলেমগণ এর এজাযত দেন নি? আমি বলি ঃ না, এখনো দেন নি; আল্লাহ্ যা হারাম করেছেন তা সব সময়ই হারাম। তারা বলে ঃ না, এমন অনেক জিনিসই আছে যা আগে হারাম ছিলো, কিন্তু এখন হালাল হয়ে গেছে; এগুলো কখন হালাল হবে? তারা অত্যন্ত খোলা মনে, অত্যন্ত সরল মনে এসব প্রশ্ন করে।
ওরা গতিশীল ফিকাহ্ কথাটির এ ধরনের সংজ্ঞা প্রদান করছে। অর্থাৎ তাদের মতে, এক সময় খোদায়ী আহকামও পরিবর্তিত হয়ে যায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কে তা পরিবর্তন করবে? ক্ষমতাশীন শক্তি?
এখন এই রকম অবস্থা দাঁড়িয়েছে। হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) কি বলেন নি যে, যারা এ ধরনের আচরণকে পরিবর্তিত করিয়ে না দেবে তাদেরকে জাহান্নামে এদের সাথে সঙ্গী হতে হবে? ইমাম হোসাইন (আঃ) বলেন যে, এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটানোর লক্ষ্যে অভু্যত্থানের জন্য আমার চেয়ে অধিকতর উপযুক্ত আর কে আছে? তিনি বলেন ঃ “এ ব্যাপারে আমি অন্যদের চেয়ে অধিকতর উপযুক্ত।” এ অবস্থার পরিবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণের জন্য আমিই যোগ্যতম ব্যক্তি। তাই আমি এ জন্যই তৎপরতা শুরু করেছি। তিনি যে বলেছেন ঃ “আমি আমার নানার উম্মাতের ‘ইছ্লাহ্’ করতে চাই।” এর মানে এগুলোই; ‘ইছ্লাহ্’র প্রতিভূ হচ্ছে এসব বিষয়।
অর্থাৎ খোদায়ী দণ্ডবিধিকে ফিরিয়ে আনতে হবে, মুসলমানদের বাইতুল মালে সকলের জন্য সমান অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। জনগণের সকলে সমানভাব অর্থনৈতিক, সরকারী অফিসের ও আইনগত সকল সুযোগ-সুবিধা ব্যবহারের অধিকারী হবে; কেবল নিজেদের, নিজেদের গোত্রের লোকদের, অনুগতদের, দলীয় লোকদের, ও অভিন্ন রাজনৈতিক ধারা ও ফ্রন্টের লোকদের জন্য নির্ধারণ করে দেয়া যাবে না; এগুলোই হলো ‘ফাছাদ্’। এসব ফাছাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে, অভু্যত্থান করতে হবে। এসব ফাছাদের উৎপাটনের জন্যই ইমাম হোসাইন (আঃ) অভু্যত্থান করেছিলন। কেউ যদি ‘ইছলাহ্’ বা সংস্কার বলতে এটা বুঝিয়ে থাকেন, তাহলে সম্মানিত রাহবার যেমন বলেছেন, সকলেই এ ধরনের সংস্কার চায়। কে এ ধরনের ‘ইছ্লাহ্’ বা সংস্কারের বিরোধী? কেউ যদি মুসলমান না হয়ে থাকে কেবল সে-ই এ ধরনের ‘ইছ্লাহ্’ বা সংস্কারের বিরোধী হতে পারে। অবশ্য এ ধরনের ‘ইছ্লাহ্’ বা সংস্কারের বিরোধী লোকও আছে, তবে তারা হচ্ছে সেই লোক যারা আল্লাহ্ তা’আলা ও তাঁর আহকামের ওপর ঈমান রাখে না; যারা মুসলমান হবার মিথ্যা দাবী করে। তারা আপনাকে-আমাকে প্রতারিত করার উদ্দেশ্যে মুসলমানিত্বের দাবী করে থাকে।
‘ইছ্লাহ্’ বা সংস্কার ভালো কাজ, কিন্তু সে ‘ইছ্লাহ্’ হতে হবে ইসলামী ব্যবস্থার ভিত্তিতে, ইসলামী মূল্যবোধ ব্যবস্থার ভিত্তিতে; আমেরিকা যাকে ‘ইছ্লাহ্’ বা সংস্কার বলে _ রিফর্ম বলে তার ভিত্তিতে নয়। অথবা অন্যান্য কুফ্রী শক্তির পক্ষ থেকে যাকে সংস্কার বলা হয়; তা আমেরিকা বলছে, নাকি অন্য কেউ বলছে তাতে আমাদের কাছে কী পার্থক্য হতে পারে? যেহেতু আমেরিকা বেশী চাপাচাপি করে, বেশী বাড়াবাড়ি করে সেহেতু আমরা আমেরিকাকে এদের নমুনা বা প্রতিভূ হিসেবে দেখছি। নয়তো আমাদের জন্য আমেরিকা বা অন্য কারো মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কারণ, সকল কাফেরই এক রকম।
যে কেউ ইসলামী মূল্যবোধের বিরোধী আমরা তার দুশমন। আমরা ইসলামী মূল্যবোধ সমূহের বাস্তবায়ন চাই। আমরা চাই যে, খোদায়ী আহকামের বাস্তবায়ন হোক। বিশ্ব বলছে, এগুলো মানবাধিকারের ঘোষণার লঙ্ঘন। আমরা বলি, তোমাদের এ ঘোষণা তোমাদের নিজেদের জন্য। আমরা এ ঘোষণার সাথে ততটুকু পর্যন্ত একমত যতটুকু ইসলামী সংস্কৃতির সাথে সঙ্গতিশীল। আমাদের দৃষ্টিতে ভালো তা-ই ইসলাম যাকে ভালো বলে। তেমনি আমাদের দৃষ্টিতে মন্দ তা-ই ইসলাম যাকে মন্দ বলে। না তোমরা, না ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, না আমেরিকান কংগ্রেস _ এ সব আমাদের জন্য অকাট্য দলীল নয়। বরং আমাদের মার্জা’এ তাক্বলীদগণ যা বলেন, কোরআন যা বলে, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর সুন্নাত যা বলে, সেগুলোই আমাদের জন্য হুজ্জাত বা অকাট্য দলীল।
হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) তাঁর অন্য এক বক্তব্যে ভিন্ন শব্দ ও বাক্যে একই কথা বলেন ঃ “নিঃসন্দেহে তারা হচ্ছে ঐ গোষ্ঠী যারা শয়তানের আনুগত্য করেছে, আর পরম মেহেরবানের আনুগত্য পরিত্যাগ করেছে, ধরণীর বুকে ‘ফাছাদ্’কে প্রতিষ্ঠিত করেছে ও খোদায়ী দণ্ডবিধিকে বাতিল করে দিয়েছে এবং নেশাকর পানীয় সমূহ পান করেছে।”
ইমাম (আঃ) যে বলেছেন, তারা খোদায়ী দণ্ডবিধিকে বাতিল করে দিয়েছে _ এ কথাটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তা হচ্ছে, বাতিল করা বন্ধ করে দেয়ার চেয়ে অধিকতর গুরুতর কাজ। এক সময় তারা বলে, বর্তমানে এমন পরিস্থিতি নেই যে, আমরা খোদায়ী দণ্ডবিধি কার্যকর করবো। আবার কখনো বলে যে, এ আইন সঠিক আইন নয়; এ আইন মানবিক মূল্যবোধের বিরোধী। এর আগে ন্যাশনাল ফ্রন্ট কিছাছের আইন সম্পর্কে যা বলতো তাদের অনুসারীরা আজ সে কথাই অধিকতর সুস্পষ্ট ভাষায় বলছে। তারা বার্লিন কন্ফারেন্সে যাচ্ছে এবং সেখানে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলামী আহকামের নিন্দা করছে এবং বলছে, এগুলোকে পরিবর্তন করতে হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, এদের মধ্যে কেউ কেউ মাথায় দুই মিটার লম্বা একটা কাপড়ও পেঁচিয়েছে এবং এ অপকর্মে শামিল হচ্ছে।
এই লোকেরা নিজেদেরকে সংবিধানের হেফাযতকারী বলে দাবী করছে। প্রথমে অন্ততঃ এই ধর্মহীন লোকগুলোর মাথা থেকে এই দুই মিটার লম্বা কাপড়টা তুলে নেয়া দরকার, এরপর এদেরকে বিচারের সম্মুখীন করা দরকার। তোমরা ইসলামের অপরিহার্য বিষয়গুলোকে অস্বীকার করেছো। তোমরা বিদেশের বুকে ইসলামের মান-ইজ্জত নষ্ট করেছো। সংবিধানের হেফাযত কি ইসলামের অপরিহার্য বিষয়গুলোর সমর্থন দাবী করে না? তা কি শুধু এটাই দাবী করে যে, আমরা কেবল পত্রপত্রিকাকে অবাধ স্বাধীনতা দেবো যাতে তারা তাদের ইচ্ছা মতো যে কোনো অপকর্ম করতে থাকবে? তারা তাদের ইচ্ছা মতো পবিত্র ব্যক্তিদের ও বিষয়াদির বিরুদ্ধে যে কোনো ধৃষ্টতা দেখাবে? এরই নাম হবে সংবিধানের হেফাযত? ন্যায়নীতি কোথায় গেলো? ভদ্রতাবোধ কোথায় গেলো?
হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) এরপর বলেন ঃ ” আমিই অগ্রগণ্য আল্লাহ্র দ্বীনকে সাহায্য করার জন্য ।” “আর তাঁর শরীয়তকে মজবুত করার জন্য।” কারণ এই লোকেরা আল্লাহ্র শরীয়তকে কোণঠাসা করে রেখেছে, হেয় করেছে, সমাজ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। যেহেতু আমি রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর সন্তান সেহেতু আল্লাহ্র শরীয়তকে মজবুত করার জন্য, সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য উত্থান করার ব্যাপারে আমি অগ্রগণ্য; এ ব্যাপারে আমিই হবো প্রথম ব্যক্তি। “আর আল্লাহ্র কালেমাকে সমুন্নত করার লক্ষ্যে জিহাদের ক্ষেত্রে।” আমাকে আল্লাহ্র রাস্তায় জিহাদ করতে হবে।
হযরত আবা আবদিল্লাহ্ আল্-হোসাইন (আঃ) তাঁর তৎপরতাকে আল্লাহ্র রাস্তায় জিহাদ বলে গণ্য করেন। আর এ জিহাদের লক্ষ্য হচ্ছে “যাতে আল্লাহ্র কালেমা সমুন্নত হয়”। আল্লাহ্র কালামকেই সর্বাগ্রগণ্য হতে হবে, সর্বশীর্ষে স্থান দিতে হবে _ কেউ যেন আল্লাহ্র কথার ওপর দিয়ে কথা বলতে না পারে। আল্লাহ্ যা কিছু বলেছেন লোকেরা যেন বিনীতভাবে তা গ্রহণ করে। কেউ যেন এমন কথা না বলে যে, আল্লাহ্ যা বলেছেন তা চৌদ্দশ’ বছর আগে খাটতো; এখন আমরা আল্লাহ্র চাইতেও ভালো বুঝি।
এবার আমি আমার বক্তব্যের উপসংহার টানতে চাই। হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ) তাঁর অছিয়্যাতনামায় যে লক্ষ্যের কথা বলেছেন তা হচ্ছে, “আমি যে বহির্গত হয়েছি” তার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে “আমার নানার উম্মাতের ‘ইছলাহ্’র সন্ধান করা”। এখানে “ত্বালাব্” শব্দটির ব্যবহার বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। এতে এদিকে ইঙ্গিত রয়েছে যে, আমি বলছি না যে, আমি এ কাজ করতে সক্ষম হবো, সমস্ত সমস্যার সমাধান করে দেবো, সকল ‘ফাছাদ্’ দূর করে দেবো, বরং আমি এ পথে সর্বাত্মক চেষ্টাসাধনা করবো। আমি এ পথে পদক্ষেপ গ্রহণ করবো, আমি আমার চেষ্টা চালিয়ে যাবো। জনগণও যদি সাহায্য করে, তাদের কর্তব্য পালন করে, তাহলে এ কাজ সংঘটিত হবে, পাপাচার-অনাচার ও দুর্নীতির সংশোধন হবে। কিন্তু জনগণ যদি সাহায্য না করে তাহলেও আমি আমার দায়িত্ব পালন করলাম।
অতএব, তাঁর লক্ষ্য ছিলো “ইছ্লাহের সন্ধান”। আর এ লক্ষ্য সর্বোত্তমভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে এক ব্যক্তির দ্বারা বা এ ধরনের লোকদের ছোট্ট একটি সমষ্টির দ্বারা। এর চাইতে বেশী সম্ভব হলে তা-ও তাঁরা করতেন। তবে তাঁরা এমন এক পরিবর্তন সৃষ্টি করে গেছেন যার ফলে দীর্ঘ চৌদ্দশ’ বছর পরেও মানুষের মধ্যে এমন উচ্ছ্বাস সৃষ্টি হচ্ছে; বিশ্বের পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত সর্বত্র মানুষ হোসাইনের জন্য ক্রন্দন করছে, বিলাপ করছে; তারা হোসাইনের স্মরণে, আল্লাহ্র দ্বীনের পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে অভু্যত্থান করছে। আর এর ফসল সমূহের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ইরানের ইসলামী বিপ্লব।
অবশ্য ইসলামের ইতিহাসে এ ধরনের ঘটনা বার বার ঘটেছে। তবে সম্ভবতঃ শৌর্যময়তার দিক থেকে এ ধরনের অন্য কোনো ঘটনাই ইরানের ইসলামী বিপ্লবের সমপর্যায়ের ছিলো না। আর এমনটি হওয়াই ছিলো স্বাভাবিক। কারণ, অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি ঘটে, আর মানুষ অতীতের ঘটনাবলী থেকে অধিক মাত্রায় শিক্ষা গ্রহণ করে। তারা ইসলাম বিরোধী শাসকগোষ্ঠীর পাপাচার-অনাচার ও প্রশাসন যন্ত্রের দুর্নীতি থেকে পূর্ববর্তীদের তুলনায় অধিকতর শিক্ষা গ্রহণ করে।
এবার শোকানুষ্ঠান অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশী ও অধিকতর ভালোভাবে হচ্ছে কেন? আপনারা আপনাদের নিজেদের শহরে দেখছেন, বিগত বছরের তুলনায় যদি দ্বিগুণ না-ও হয়ে থাকে তো মোটামুটি তার কাছাকাছি। আল্লাহ্র রহমতে অন্যান্য জিলা শহরেও এ রকমই। কেন? কারণ, হোসাইনের দুশমনরা _ এই নির্বোধরা এবার প্রকাশ্যে তাদের ভূমিকা পালন করছে। এর আগ পর্যন্ত জনগণ বিশ্বাস করতে পারে নি যে, এরা হযরত ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর দুশমন। কোনো শায়খও যদি এখানে তাদের সম্পর্কে কিছু বলতেন, তো মানুষের বিশ্বাস হতো না। লোকেরা বলতো, এটা নেহায়েতই ব্যতিক্রম ব্যাপার; এর ভিত্তিতে তাদের গোটা মহলকে সন্দেহ করা হচ্ছে। কিন্তু আপনারা দেখেছেন, এরপর তারা তাদের আসল চেহারা দেখিয়েছে। ইরানের বেশ কয়েকটি শহরে তাসূ’আ ও ‘আশূরার রাতে _ মহররমের নয় ও দশ তারিখের রাতে তারা বেশ কয়েকটি শোক প্রকাশকারী দলের ওপর হামলা চালিয়েছে। তারা রাশ্ত্ শহরে ও খোর্রামবাদ শহরে এ ধরনের হামলা চালিয়েছে। যারা জানেন না, দৈনিক পত্রিকা পড়েন না বা রেডিও শোনেন না তাঁরা জেনে রাখুন। অবশ্য হামলাকারীরা সংখ্যায় বেশী ছিলো না। কিন্তু তারা অন্যদেরকে সাহস দেয়ার জন্য, তাদেরকে ধৃষ্ট করে তোলার জন্য এ কাজ করেছে। ছোট আকারের পদক্ষেপ হলেও তারা সাইয়েদুশ শুহাদা (আঃ)-এর পবিত্রতার মর্যাদার ওপর হামলা চালিয়েছে এবং এর মাধ্যমে শোক প্রকাশকারীদের নিরাপত্তাহানি ঘটিয়েছে, যদি তা ছোট্ট একটা ফুলকি নিক্ষেপের মাধ্যমেও হয়ে থাকে।
এরা যা করেছে তা অত্যন্ত হিসাব-নিকাশ করে করেছে। ঐ লোকটা অযথাই বলে নি যে, এবার ইরানে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হবে। তারা গত বছর এর পরিকল্পনা তৈরী করেছিলো। তারা যখন দেখলো যে, ৯ই জুলাইয়ের পরিকল্পনা সফল হলো না তখন তারা তাদের পরিকল্পনার ভুল সংশোধন করে নিলো। তখন তারা আরেকটা কু দেতা করার পরিকল্পনা করলো। তারা বুঝতে পারলো যে, যতক্ষণ সংঘর্ষ না ঘটে, হতাহতের ঘটনা না ঘটে, ততক্ষণ তারা ঘোলা পানি থেকে মাছ শিকার করতে পারবে না। তাই তারা পরিকল্পনা করে যে, এ বছর এ কাজ করবে। তারা ইসফাহানে ঘোষণাপত্র প্রচার করে বলেছে, আমরা গোলযোগ সৃষ্টি করবো। রাশ্তে ও খোর্রামাবাদে বক্ষে করাঘাত হেনে শোক প্রকাশকারী দলের সাথে তারা ধৃষ্টতাপূর্ণ আচরণ করেছে। অন্য কয়েক জায়গায়ও কতক নীচ লোক মা’ছূমগণের (আঃ) প্রতি ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। এদের উদ্দেশ্য হচ্ছে তাঁদের পবিত্রতার মর্যাদার সীমারেখা লঙ্ঘন করা। তারা এই সব কাজ করে চলেছে। এরা কি ইছ্লাহ্কামী, নাকি ইফ্ছাদ্কামী? কোরআন মজীদের যুক্তি অনুযায়ী তারা কি ইছ্লাহ্কারী, নাকি ফাছাদ্ সৃষ্টিকারী? এরা কি মু’মিন, নাকি মুনাফিক? “সাবধান, মনে রেখো, এরাই হচ্ছে ফাছাদ্ সৃষ্টিকারী, কিন্তু তারা তা অনুভব করতে পারছে না।”
পরোয়ারদেগার!
তোমার নিজের ইজ্জত আর প্রতাপের উছিলায় এবং সাইয়েদুশ শুহাদা (আঃ)-এর উছিলায় ইসলাম ও মুসলমানদের ইজ্জত দিনের পর দিন বৃদ্ধি করে দাও।
আমাদেরকে আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য সম্পর্কে আরো বেশী জানার তাওফীক দাও।
আমাদেরকে আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে অধিকতর সফল করে দাও।
হযরত ইমামের ও ইসলামের শহীদগণের আত্মাকে কারবালার শহীদগণের সাথে হাশর করো।
মহান রাহবারের ছায়া আমাদের ওপর স্থায়ী করে দাও।
আমাদেরকে এ নে’আমতের শোকরগুযারী করার পথে এবং বেলায়াতে ফকীহ্র নেতৃত্বাধীন এ পবিত্র রাষ্ট্রব্যবস্থার খেদমতে অধিকতর সাফল্য প্রদান করো।
আমাদের শেষ পরিণতিকে কল্যাণময় করে দাও।
ওয়াস সালামু ‘আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ্।

Leave A Reply

Your email address will not be published.