ইসলামের নবী

0 494

ইসলামের নবী : একটি সংক্ষিপ্ত জীবনালোচনা

পূর্ববর্তী নবিগণ তাঁদের আসমানী কিতাবসমূহে বর্ণিত বৈশিষ্ট্যসমূহ উল্লেখ করে তাঁদের উম্মতদেরকে মহানবী (সা.)-এর আগমনের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। কোরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে :
الَّذِيْنَ آتَيْنَاهُم الْكِتَابَ يَعْرِفُوْنَهُ كَمَا يَعْرِفُوْنَ أَبْنَاءَهُمْ وَ إِنَّ فَرِيْقًا مِنْهُمْ لَيَكْتُمُوْنَ الْحَقَّ وَ هُمْ يَعْلَمُوْنَ
“আমি যাদেরকে কিতাব দান করেছি, তারা তাকে চেনে, যেমন করে চেনে নিজেদের পুত্রদেরকে। আর নিশ্চয়ই তাদের একটি সম্প্রদায় জেনে-শুনে সত্যকে গোপন করে।” (সূরা বাকারাহ্ : ১৪৬)
পৃথিবীর সেই দুঃসময়ে বহু ঈশ্বরবাদ, মূর্তিপূজা ও এর শাখা-প্রাশাখা বিস্তার লাভের পাশাপাশি সমগ্র বিশ্ব নৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধঃপতনে নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিল। সময়ের বিবর্তনে পৃথিবীর ঐশী ধর্ম অনুসারীদের মধ্যে আমূল পরিবর্তন এসেছিল; তারা মানব জাতিকে হেদায়েত করার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছিল। শুধু তা-ই নয়, তাদের সৃজনশক্তিরও অবনতি ঘটেছিল। তাদের বদ্ধ ধমনীতে নতুন করে রক্ত সঞ্চালন করে জীবনীশক্তি জাগিয়ে তোলার কোনো সম্ভাবনা ছিল না।
ঐশী ধর্ম অনুসারীরা তখন ব্যাপক বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব ও একজন ঐশী ব্যক্তিত্বের আবির্ভাবের জন্য প্রতীক্ষা করছিল যিনি তাদেরকে ক্ষয়িষ্ণু চিন্তাধারা থেকে উদ্ধার করে নতুন প্রগতিশীল চিন্তার সন্ধান দেবেন।
সকল বিশৃঙ্খলা ও অশান্তির মধ্যে পৃথিবী তার ধৈর্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল। মানুষ বিদ্যমান বিষাক্ত পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক নতুন পরিবেশের জন্য অধীরভাবে অপেক্ষা করছিল। তারা অপেক্ষায় ছিল যে, অদৃষ্টের আস্তিন থেকে সাহায্যের হাত বেরিয়ে আসবে; পুরাতন ভঙ্গুর সমাজ কাঠামোকে ধ্বংস করবে এবং ধ্বংসস্তুপের ওপর নতুন সমাজ গড়ে তুলবে।
সে সময়ের পরাক্রমশালী দেশ ও জাতিসমূহের প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলায় পতিত হয়েছিল। আরব জাতি পরাশক্তিসমূহের মধ্যবর্তী ভূমিতে বাস করত এবং তাদের বিশাল মাতৃভূমি দিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কাফেলা যাতায়াত করত। শক্তিশালী প্রতিবেশী দেশের তুলনায় নিজেদের দুর্বলতা ও অক্ষমতা তাদেরকে প্রতিনিয়ত যন্ত্রণা দিত। সুসংগঠিত রাজনৈতিক কাঠামোর অভাব ও প্রতিবেশী সাম্রাজ্যবাদীদের শক্তির কারণে আরব জাতির চূড়ান্ত বিলুপ্তির আশংকা দেখা দিয়েছিল যা যে কোনো দূরদর্শী ব্যক্তির কাছে সহজবোধ্য।
এরূপ পরিস্থিতিতে সেই প্রতিশ্রুত মহামানব হযরত মুহাম্মদ (সা.) হিজরী সনের তেপ্পান্ন বছর পূর্বে ১৭ রবিউল আউয়াল, ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে সুবহে সাদিকের সময় আরব উপদ্বীপের মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। দিনটি ছিল শুক্রবার।

 

 
আরব উপদ্বীপ ছিল ভয়াবহ দমন-নির্যাতনের ভূমি, অসুস্থ ও সৃজনীশক্তিহীন সমাজের প্রতীকÑ যেখানে মূর্খতা সক্রিয় ও শক্তিশালী ছিল। এটি ছিল বদ্ধ জলাভূমির মতো যেখানে নৈতিকতার প্রবাহ থেমে গিয়ে অনৈতিকতার আবর্জনা স্থির হয়েছিলÑ যেখানে মনুষ্যত্বের কবর রচিত হয়েছিল।
এ আরব উপদ্বীপেই মহানবী (সা.) প্রথম পৃথিবীর দিকে তাকালেন, আর তাঁর উজ্জ্বল দীপ্তি মানব জাতির নব জীবনের দিগন্তে আলো ছড়িয়ে দিল। মানুষের চিন্তার পরিপূর্ণতা আনার দায়িত্ব নিয়ে আগত এ মহামানব এ স্থানেই মানব জাতির মধ্যে নতুন কর্মচাঞ্চল্য ও অফুরান প্রাণশক্তি আনলেন।
মহানবী (সা.)-এর আগমনে সকলের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছিল, আর চারিত্রিক গুণাবলীর উৎকর্ষে তাঁর সমকক্ষ কেউ ছিল না। এমন এক সময়ে তাঁর আবির্ভাব যখন সমাজ তাঁকে বরণ করার জন্য প্রস্তুত ছিল; কেননা তাঁকে সমাজের প্রয়োজন ছিল। শুধু আরব উপদ্বীপ নয়; বরং সমগ্র বিশ্ব তাঁর আগমনের জন্য প্রস্তুত ছিল; এই প্রাচীন পৃথিবী তার সমস্ত জীবজগৎ নিয়ে একজন মানুষের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলÑ যিনি পৃথিবীকে দুর্দশা থেকে মুক্তি দেবেন এবং চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত করবেন।
মহাকাশের গ্রহ-উপগ্রহসমূহ তাদের সুদীর্ঘ বিরামহীন আবর্তনকালে কখনোই তাঁর মতো খাঁটি ও নিখুঁত সৃষ্টি অবলোকন করতে পারে নি। তিনি সকল অসম্পূর্ণতা থেকে মুক্ত ও অমলিন ছিলেন।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, সকল ধর্মের মধ্যে সর্বাধিক পবিত্র ও সৃজনশীল, সবচেয়ে গভীর ও ব্যাপক প্রেরণাদানকারী ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য এ আশীর্বাদপুষ্ট শিশুর আগমন ঘটেছিল মা আমিনার কোলে, যাঁর মহিমা পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে গিয়েছিল। আর এ ধর্ম প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল জ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার অনুশীলন।
সম্রাট ও ক্ষমতাশীলদের তোষামোদনীতি ও গোলামী বাতিল করে দিয়ে মহানবী (সা.) ঘুমন্ত মানুষকে জাগিয়ে তুললেন, জ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার অনুশীলনের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করলেন।
তিনি মানুষের শ্রদ্ধার প্রবেশস্থল থেকে প্রতিমা সরিয়ে দিলেন। প্রতিমাপূজার পরিবর্তে তিনি তাদেরকে খোদায়ী একত্বের রহস্যের দিকে পথ নির্দেশ করলেন, শিক্ষা দিলেন কীভাবে মর্যাদার সাথে জীবন যাপন ও মৃত্যুবরণ করতে হয়।
তাঁর শিক্ষার ফলে মূর্তিপূজার বদলে একেশ্বরবাদ ও একমাত্র সত্যিকার স্রষ্টার প্রার্থনা শুরু হলো, অজ্ঞতার স্থানে জ্ঞান, শত্রুতা, বিদ্বেষ ও অনৈক্যের স্থানে ভ্রাতৃত্ব, সমবেদনা ও অন্যান্য মানবিক গুণাবলী প্রতিষ্ঠিত হলো। যারা অজ্ঞতা ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতিতে বেড়ে উঠেছিল তারা মনুষ্যত্বের সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসাবে পরিগণিত হলো।
মহানবী (সা.)-এর পিতা আবদুল্লাহ্ হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর বংশধর ছিলেন। তাঁর অন্তর ছিল ভালবাসা, বিশ্বস্ততা ও করুণার আধার। আমিনাকে বিবাহ করার পর তিনি বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে কাফেলা নিয়ে মক্কা থেকে সিরিয়া অভিমুখে রওয়ানা হন। আমিনা গর্ভবর্তী ছিলেন এবং স্বামীর ফিরে আসার প্রতীক্ষায় ছিলেন। কিন্তু আবদুল্লাহ্ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং স্বদেশ থেকে বহু দূরে মৃত্যুবরণ করেন।
আমিনা ও তাঁর অনাগত সন্তানকে আর কখনোই দেখতে না পারার যন্ত্রণা নিয়ে আবদুল্লাহ্ পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। কিছুদিন পরে আমিনা জানলেন যে, মাত্র ষোল বছর বয়সে তিনি এক নবজাতক শিশু নিয়ে বিধবা ও নিঃসঙ্গ হয়ে গেছেন।
শ্বশুর আবদুল মুত্তালিব আমিনা ও তাঁর শিশুকে নিজ গৃহে নিয়ে এলেন। তিনি মরুভূমির সতেজ হাওয়ায় বেড়ে ওঠার জন্য নবজাতক পৌত্রকে বনু সা’দ গোত্রের নিকট পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।
মহানবীর জন্মের চার মাস পর বনু সা’দ গোত্রের ধাত্রীরা মক্কায় উপস্থিত হলে তাদের মধ্যে থেকে ‘হালীমাহ্’ নামের পবিত্র স্বভাবের এক মহিলা ইয়াতীম মুহাম্মদ (সা.)-কে স্তন্যপান করানোর দায়িত্ব নিতে রাজি হলেন।২
স্তন্যপান ত্যাগ করার পূর্ব পর্যন্ত বনু সা’দ গোত্রে অবস্থান করার জন্য হালীমাহ্ শিশুটিকে নিয়ে মরুভূমিতে ফিরে গেলেন। কিন্তু পিতামহ আবদুল মুত্তালিব পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত তাঁকে এ গোত্রের নিকট রেখে দিলেন। এ পাঁচ বছর ধরে হালীমাহ্ সযতেœ শিশুটির লালন-পালন করতে থাকলেন। মহানবী (সা.) আরবী ভাষার সেরা স্থানীয় উচ্চারণ শিখলেন এবং এ ভাষার সবচেয়ে বেশি অলংকার রীতি আয়ত্ত করলেন। এ সময় হালীমাহ্ তাঁকে দু’তিনবার মায়ের সাথে দেখা করানোর জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন এবং শেষবারে তিনি তাঁকে তাঁর মায়ের হাতে তুলে দেন। এক বছর পার হওয়ার পর মাতৃকূলের স্বজনদের সাথে পরিচিত করানোর জন্য আমিনা পুত্রকে নিয়ে মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী একটি গ্রামের উদ্দেশে মক্কা ত্যাগ করেন। পূর্ণ আনন্দ ও তৃপ্তির সাথে আমিনা পিত্রালয়ে পৌঁছলেন; কিন্তু মক্কা ফিরে আসা তাঁর ভাগ্যে ছিল না।
মক্কায় ফিরে আসার জন্য রওয়ানা হলে পথেই তিনি ইন্তেকাল করেন এবং সেখানেই তাঁকে দাফন করা হয়। ছয় বছরের ইয়াতীম শিশুপুত্রকে কবরের পাশে একা রেখে তিনি পৃথিবী ত্যাগ করলেন।৩
তিনি কখনোই পিতাকে দেখেন নি। আর মায়ের স্নেহ-ভালবাসা ও মমত্ববোধও পুরোপুরি উপভোগ করতে পারেন নি। মায়ের সান্নিধ্যে আসার কিছুদিন পরেই নিয়তি তাঁর মাকে ছিনিয়ে নিল, আর তাঁকে মরুভূমির ভয়ঙ্কর বিস্তৃতির মধ্যে একাকী ফেলে দিয়ে গেল। যে বয়সে আত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠতে শুরু করে সে বয়সে মহানবী মাকে হারালেন। পিতামহ আবদুল মুত্তালিব তাঁর ভগ্ন হৃদয়ের সান্ত্বনা পুত্র আবদুল্লাহ্র একমাত্র স্মৃতি শিশু মুহাম্মদকে লালন-পালন করার দায়িত্ব নিলেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত আন্তরিকতার সাথে তিনি এ দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
পিতামহের তত্ত্বাবধান ও যতেœ বেড়ে ওঠার সময়টা ছিল মহানবীর আহত হৃদয়ের জন্য
সান্ত্বনা। কিন্তু এ অবস্থা বেশিদিন থাকল না। তাঁর আট বছর বয়সে আবদুল মুত্তালিব ইন্তেকাল করলেন। নতুন দুঃখ তাঁকে জর্জরিত করল; ক্রমাগত দুঃখ-যন্ত্রণার ছাপ তাঁর পবিত্র চেহারায় পরিস্ফুট হয়ে উঠল। তাঁর শক্তিশালী আত্মা সারাজীবনে কখনোই বিপদে ভেঙ্গে পড়ে নি; কিন্তু স্বজন হারানোর শোক তাঁকে ব্যাকুল করে তুলল।
এ সকল দুঃখ ও বাধা-বিপত্তি সহ্য করে এগিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি ঐশী অনুগ্রহ পেয়েছিলেন। যে ইয়াতীম একদিন মানবতাবোধের পৃষ্ঠপোষক ও পৃথিবীর সকল নির্যাতিতের জন্য স্বস্তিদাতা হিসাবে আবির্ভূত হবেন তাঁকে শৈশব থেকেই সব ধরনের বঞ্চনা ও দুঃখ-দুর্দশার সাথে পরিচিত হতে হয়েছিল। তাঁকে পর্বতের ন্যায় দৃঢ় ও প্রতিরোধ-ক্ষমতাসম্পন্ন মানসিক শক্তি অর্জন করতে হয়েছিল, অন্যাথায় ঐশী দায়িত্বের বোঝা বহন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হতো না। এর জন্য সব ধরনের সামর্থ্য অপরিহার্য ছিল। তাঁর মহিমান্বিত ও অকপট ব্যক্তিত্ব প্রমাণ করে যে, তাঁর সে সামর্থ্য ছিল।
এরপর ইয়াতীম মুহাম্মদ (সা.) তাঁর পিতার সহোদর ভাই আবু তালিবের গৃহে গমন করলেন। আবু তালিব মহৎ হৃদয়ের ব্যক্তি ছিলেন। চাচাতো ভাইদের সান্নিধ্যে স্নেহার্দ্র পরিবেশে থাকা সত্ত্বেও তিনি স্বাভাবিকভাবেই একাকী বোধ করতেন।
একদিন সকালে তিনি জানতে পারলেন যে, চাচা আবু তালিব তাঁকে রেখে সিরিয়ার উদ্দেশে রওয়ানা হতে যাচ্ছেন। তখন তিনি চাচার সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁর সহযাত্রী হওয়ার অনুমতি চাইলেন। কিন্তু আবু তালিব রাজি হলেন না, কারণ, সফরের কষ্ট সহ্য করার জন্য তাঁর বয়স তখনও খুবই কম ছিল।
যখন কাফেলা যাত্রা শুরুর উপক্রম করছিল তখন মুহাম্মদ (সা.)-এর চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল। তাঁর মুখে বেদনার প্রকাশ আবু তালিবের হৃদয় স্পর্শ করল। তিনি ভ্রাতুষ্পুত্রকে সিরিয়া ভ্রমণে সঙ্গে নিতে বাধ্য হলেন। এভাবেই বারো বছর বয়সে মহানবী (সা.) প্রথম দূরবর্তী দেশের উদ্দেশে যাত্রা করলেন।
কুরাইশদের এ কাফেলা গন্তব্যে পৌঁছার পূর্বে বসরা নগরী অতিক্রম করছিল। সেখানে ‘বুহাইরা’ নামক এক খ্রিস্টান সন্ন্যাসীর সাথে তাঁদের দেখা হয়। বুহাইরা তাঁর আশ্রমে প্রার্থনায় নিয়োজিত থেকে দিন কাটাতেন। তিনি খ্রিস্টধর্মে প্রগাঢ় পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। সকল খ্রিস্টানের কাছে তিনি ছিলেন শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি।
বুহাইরা আবু তালিবের ভ্রাতুষ্পুত্রকে দেখামাত্রই তাঁর প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হলেন। তাঁর অন্তর্ভেদী ও রহস্যময় দৃষ্টি দেখে বোঝা যাচ্ছিল যে, তিনি কোনো গুপ্ত রহস্য জানেন। অবশেষে বুহাইরা নীরবতা ভঙ্গ করলেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন যে, ছেলেটি কার পুত্র। অন্য লোকরা আবু তালিবের দিকে ইশারা করল। আবু তালিব বললেন : “এ আমার ভ্রাতুষ্পুত্র।” তখন বুহাইরা বললেন : “এ শিশুর সামনে এক উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। ইনিই সেই প্রতিশ্রুত নবী যাঁর আগমন ও নবুওয়াতের কথা আসমানী কিতাবসমূহে বর্ণিত হয়েছে এবং কিতাবসমূহে বর্ণিত সকল চি‎হ্নই আমি তাঁর মধ্যে দেখতে পাচ্ছি। ইনিই সেই সত্যিকার নবী যাঁর নাম ও পরিবার সম্পর্কে আমি পড়েছি। কোনো স্থানে জনগণের মাধ্যমে তিনি খ্যাতি লাভ করবেন এবং তাঁর মাধ্যমে প্রবর্তিত ঐশী ধর্ম কীভাবে পুরো বিশ্ব জয় করবে তা আমি জানি। যাহোক, আপনারা অবশ্যই তাঁকে ইহুদীদের দৃষ্টি থেকে লুকিয়ে রাখবেন। কেননা, তারা তাঁর সম্পর্কে সচেতন হওয়ামাত্রই তাঁকে হত্যা করবে।”৪
ঐতিহাসিকগণ একজন ঐশী নেতার জন্য মানানসই সকল বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি সমস্ত দিক থেকেই তাঁর ব্যক্তিত্বের মহৎ আধ্যাত্মিক শক্তি ও ক্ষমতা পরিষ্কারভাবে উপলব্ধি করেছেন।
মহানবী (সা.) জীবনের কোনো একটি সময়ে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক পথভ্রষ্টতা অথবা স্নায়ুবিক উত্তেজনার শিকার হয়েছেনÑ কোনো গবেষক বা পণ্ডিতই এমন কথা বলতে পারেন নি। নিকট বা সুদূর অতীতে যাঁরা ইতিহাস রচনায় ভূমিকা রেখে গেছেন, তাঁদের সকলের চেয়ে ইসলামের নবী (সা.)-এর বৈশিষ্ট্যসমূহ অধিকতর পরিষ্কার ও পরিপূর্ণভাবে জানতে পারা সত্ত্বেও ইতিহাস তাঁর চরিত্রে সূক্ষ্মতম অবাধ্যতা, বদমেজাজ বা দুষ্কৃতি, এমনকি ছোট ভুল বা পাপের চি‎‎হ্নও দেখাতে পারে নি।
ইসলামের মহিমান্বিত নবীর স্মরণীয় জীবনের সকল দিক স্বচ্ছ ও পরিপূর্ণভাবেই অবগতির মধ্যে ছিলÑ তাঁর জন্ম-পূর্ব সময়কাল, তাঁর শৈশব, তারুণ্য, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যসমূহ, ভ্রমণ, বিবাহ, যুদ্ধ এবং শান্তি স্থাপনে তাঁর ভূমিকা।
লিপিবদ্ধ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, কোনো বিকৃত বা কলুষিত বিশ্বাসের সূক্ষ্মতম অংশও তাঁর অতিশয় উজ্জ্বল দীপ্তিকে ম্লান করতে পারে নি। যদিও তিনি কোনো ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের নিকট থেকে কোনোরূপ পথনির্দেশনা পান নি, তবুও অন্ধকার যুগের পারিপার্শ্বিকতার সাথে তাঁর কোনো সংযোগ ছিল না। আর অনৈতিকতা কখনোই তাঁর চরিত্রে শিকড় গাড়তে পারে নি।
যে ধর্মীয় পরিবেশে মহানবী (সা.) বেড়ে উঠেছিলেন তা ছিল মূর্তিপূজা ও বহু ঈশ্বরবাদের মিশ্র অবস্থা। মহানবী (সা.) তাওহীদের ডাক দিলে আরবদের কঠোর প্রতিরোধ সে অবস্থাই প্রকাশ করছিল।
তিনি তাঁর প্রথম জীবনে পুরোটাই কাটিয়েছিলেন মূর্খ, অসৎ ও নির্যাতিত জনগণের মধ্যে; আর ইসলামের প্রচার শুরুর পূর্বে কেবল দু’বার ভ্রমণ করা ব্যতীত তিনি কখনোই এ পরিবেশ ছেড়ে যান নি। একবার শৈশবকালে জীবনের দ্বিতীয় দশকে চাচা আবু তালিবের সাথে সিরিয়া ভ্রমণ করেন এবং দ্বিতীয়বার তৃতীয় দশকের মাঝামাঝিতে হযরত খাদীজা (রা.)-এর পণ্যদ্রব্য নিয়ে বাণিজ্যের উদ্দেশে আরব উপদ্বীপের বাইরে গিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও তিনি যে পরিবেশে বাস করতেন তার সাথে তাঁর ব্যক্তিত্বের ন্যূনতম সম্বন্ধও খুঁজে পাওয়া যায় না।
সেই দুর্নীতিগ্রস্ত ও কলুষিত পরিবেশে তাঁর চরিত্রের যে দিকটি বিশেষভাবে মূল্যবান ছিল তা হলো সততা, বিশ্বস্ততা ও ন্যায়বিচারের অব্যর্থ বোধ এবং মানবতার সকল ধরনের অপমানের সাথে শত্রুতা।
দুর্বল ও দুর্দশাগ্রস্তদের প্রতি দয়া ও তাঁর চরিত্রের মহত্ত্ব দিয়ে তিনি সমকালীন ব্যক্তিদের হৃদয় জয় করেছিলেন। শত্রু-মিত্র সকলেই এ ব্যাপারে একমত যে, তাঁর যুগে কোনো ব্যক্তিই চারিত্রিক গুণাবলী ও আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট্যে তাঁর ধারে-কাছেও আসতে পারে নি।
উদাহরণস্বরূপ হযরত খাদীজা যায়েদ ইবনে হারিসাকে একজন ক্রীতদাস হিসাবে মহানবী (সা.)-এর হাতে অর্পণ করেছিলেন। যায়েদ তাঁর সারা জীবন মহানবীর সাথে কাটিয়েছিলেন। খুব অল্প বয়সে যায়েদ পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হন। মহানবী (সা.)-এর মালিকানায় যাওয়ার কিছুদিন পর যায়েদের বাবা তাঁকে মুক্ত করার জন্য এলে মহানবী (সা.) তাঁকে মুক্ত করে দেন। কিন্তু যায়েদ তখন রাসূল (সা.)-এর ভালবাসা, উদারতা ও মহিমার দাস হয়ে গিয়েছিলেন; তাঁর স্বভাব ও ব্যবহার যায়েদের মনকে মোহিত করে ফেলেছিল। তাই পরিবারের কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য মুক্তি পেয়েও তিনি মহানবীর সাথে থেকে তাঁর সেবা করাকে অধিকতর পছন্দ করলেন।
বাগ্মিতা ও বক্তব্যের গভীরতা, বিচারের স্বচ্ছতা, উৎকৃষ্ট শ্রেণীর বুদ্ধিমত্তা ও অনুভূতি, স্বর্গীয় স্বভাব ও চিন্তাশক্তির চমৎকারিত্বÑ এ সবই তাঁর মহৎ ব্যক্তিত্বের মধ্যে স্পষ্টত প্রতীয়মান ছিল। এ সকল বৈশিষ্ট্য তাঁর জীবনের বৈচিত্র্যপূর্ণ ঘটনাবলীতে উজ্জ্বলভাবে পরিস্ফুট হয়েছে। তাই নবুওয়াতের প্রচার শুরুর পূর্ববর্তী জীবনে তিনি ‘আল আমীন’ (বিশ্বস্ত) উপাধি পেয়েছিলেনÑ যা তাঁর আচরণের সামগ্রিক বৈশিষ্ট্যেরই স্বতঃস্ফূর্ত বর্ণনা।৫
কুরাইশদের এক ধর্মীয় উৎসবের একটি ঘটনা মূর্তিপূজারীদের কর্তৃত্বের ওপর আঘাত হানল। উৎসব চলাকালে লোকজন একটি প্রতমিার চারপাশে জড়ো হচ্ছিল, আর প্রতিমার সামনে ধূলায় কপাল ঘষছিল। এমন সময় কিছু স্বচ্ছ-মন ও পবিত্র হৃদয়ের মানুষ, যেমন ওয়ারাকাহ্ ইবনে নওফেলÑযাঁরা মক্কায় বিদ্যমান অনৈতিকতায় ব্যথিত ছিলেনÑপরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা শুরু করলেন। তাঁরা পরস্পরকে প্রশ্ন করতে লাগলেন যে, আর কতদিন এ অবস্থা চলতে থাকবে, কখন ঐশী অনুগ্রহের সময় উপস্থিত হবে? কেনো এ লোকেরা বস্তুর সামনে মাথা নত করছে, আর কেনোই বা তারা তাদের পূর্বপুরুষ হযরত ইবরাহীম (আ.)-এর ধর্মকে বিকৃত করছে?
তাঁদের আলোচনায় একটি বিষয় ছিল যে, মানুষ যে পাথরের টুকরার চারপাশে হেঁটে বেড়াচ্ছে সেটা কী? এতো এমন এক জিনিস যা শুনতে পায় না, শ্বাস নেয় না, যার কাছ থেকে উপকার পাওয়া যায় না, এমনকি এটি কোনো ক্ষতিও করতে পারে না।৬
* * *
প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর মহানবী (সা.) কিছুদিন পরপর নিয়মিত ধ্যান করার দিকে ঝুঁকে পড়লেন। গভীর আধ্যাত্মিক চিন্তার জন্য অনুপোযোগী পরিবেশ তাঁকে নির্জন স্থান খুঁজতে বাধ্য করল।
কোনো ঘটনা মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে মহানবী (সা.) কখনোই তাড়াহুড়া করতেন না এবং সম্পূর্ণভাবে নিজের ধারণা ও কল্পনার ওপর নির্ভর করতেন না। তিনি পরিষ্কারভাবে দেখতে পেলেন কেউ একজন তাঁর হাত দিয়ে প্রকৃতির পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় স্বীয় নাম খোদাই করে রেখেছেন। তাঁর এ উপলব্ধি অন্তর্ভেদী দৃষ্টিশক্তি ও উঁচু মানের চিন্তার পরিচায়ক।
মক্কার হেরা পর্বতের গুহায় সম্পূর্ণ নির্জন ও অন্ধকার পরিবেশে মহানবী (সা.) রমযান মাস কাটাতেন। মক্কার জনগণ ও তাদের পাপাচার থেকে বহুদূরে প্রার্থনায় নিয়োজিত থাকতেন। ঈমানের অস্ত্রে নিজেকে সশস্ত্র করতেন। মহামহিম আল্লাহ্র নিকট প্রার্থনা ও গভীর আধ্যাত্মিক চিন্তায় তাঁর সমস্ত সত্তা মগ্ন হয়ে থাকত। সুবহে সাদিকের সময় আস্থা ও নিশ্চয়তা, আধ্যাত্মিক উদ্যম ও বলিষ্ঠতা নিয়ে মহানবী গুহা ত্যাগ করতেন এবং দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত হয়ে যেতেন। আল্লাহ্র ভালোবাসায় তাঁর শান্ত ও শান্তিপ্রিয় মুখশ্রী দীপ্তিময় হয়ে উঠত। নিজেদের হাতে গড়া মূর্তির সামনে নিজেরা মাথা নত করার মতো মূর্খতা ও বহু ঈশ্বরবাদ তাঁকে খুবই পীড়া দিত। সমস্ত দুঃখ-কষ্ট ও পরীক্ষার সামনে অটল থেকে তিনি মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করলেন।
মহানবী (সা.) যখন চল্লিশ বছর বয়সে পদার্পণ করলেন তখন তাঁর চেহারায় উদ্বেগ ও যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠল। প্রিয়তমা স্ত্রী খাদীজাকে তিনি বললেন যে, কিছু ধ্বনি অবিরাম তাঁর কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে এবং যেন এক তীব্র আলো তাঁকে ছেয়ে ফেলবে।
মিশনের সূচনা
অবশেষে পূর্ববর্তী নবিগণ কর্তৃক বর্ণিত সেই সময় উপস্থিত হলো। চল্লিশ বছর বয়সে আবদুল্লাহ্র ইয়াতীম পুত্র মুহাম্মদ (সা.) নবুওয়াতপ্রাপ্ত হলেন।
এটি ছিল এমন এক সময় যখন পৃথিবী তাঁর দিক নির্দেশনা পাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। তাঁর যে যোগ্যতা ও গুণাবলী ছিল তা কেবল পুরো মানব জাতিকে পথ নির্দেশনা দেয়ার মতো মহান ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনের জন্যই প্রয়োজন হতে পারে। কেবল এ ধরনের বিশাল অভিযানের মাধ্যমেই সমস্ত জীবজগতের অস্তিত্বের মূল শক্তি প্রকাশিত হতে পারে। মুহাম্মদ (সা.)-এর সমস্ত সত্তা তখন নবুওয়াতের এ গুরুদায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল। তিনি যদি সর্বোত্তমভাবে প্রস্তুত না থাকতেন, তা হলে আল্লাহ্ তায়ালার বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার মূল্যবান ধর্মীয় দায়িত্ব প্রদানের জন্য দ্বিতীয় কাউকে খুঁজে পাওয়া যেত না। কেবল মুহাম্মদ (সা.)-ই পারতেন তৃষ্ণার্ত পৃথিবীকে স্বস্তি দিতে।
হেরা পর্বতের গুহায় প্রার্থনারত অবস্থায় এক মধ্যরাতে ‘হে মুহাম্মদ!’ আহ্বান শুনে মহানবী চমকে উঠলেন। তিনি কখনোই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করেন নি। তাঁর ওপর হুকুম হলো :
‘পড়–ন’। এটি ছিল ওহী প্রাপ্তির সূচনা। অনন্তের সমুদ্র হতে একটি প্রবাহ উত্থিত হলো, মহানবীর অন্তরকে প্রকম্পিত করল; তিনি অস্থির ও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন।
অদেখা জগতের আলোকচ্ছটা তাঁর সত্তাকে আবৃত করল। সেই আলো তাঁর মহৎ গুণাবলীকে আরো দীপ্তিময় করে রাতের অন্ধকারে নতুন উজ্জ্বল জীবনের উত্থান ঘটাল।
হৃদয়ে প্রবল আলোড়ন ও বেদনা, আর মানুষের জন্য সবচেয়ে কঠিন দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে মহানবী (সা.) হেরা পর্বতের গুহা ত্যাগ করে গৃহ-অভিমুখে রওয়ানা হলেন। সকল মানুষের শিক্ষক হওয়া এবং মনুষ্যত্ব অর্জনের জন্য নেতৃত্ব দেয়ার দায়িত্ব নেয়া তাঁর জন্যই নির্ধারিত ছিল।
এটি কোন্ শক্তি ছিল যা তাঁর অসীম ধৈর্য থাকা সত্ত্বেও তাঁকে অশান্ত করে তুলল, তাঁর সকল শান্তিকামী তেজ ও সাহস সত্ত্বেও তাঁকে উদ্বিগ্ন করে তুলল এবং তাঁকে আকস্মিকভাবে যন্ত্রণাদায়ক অশান্তিপূর্ণ অবস্থায় ফেলে দিল?
এরপর জিবরাঈল (আ.) বারবার এলেন, আয়াত পাঠ করলেন। গভীর জ্ঞানপূর্ণ ও অসাধারণ এ আয়াতগুলো অলংকারিক, উপাদানগত দিক বা বাগ্মিতার বিচারে কোনোভাবেই মহানবী (সা.)-এর নিজস্ব ভাষা বা সমকালীন গদ্য বা কবিতার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ ছিল না।
অন্ধকার যুগের আরবরা লিখতে বা পড়তে জানত না এবং তাদের সমাজে কোনো সাহিত্যিক, পণ্ডিত বা দার্শনিক ছিল না। কিন্তু তারা কাব্যের অসাধারণ চমৎকারিত্ব ও বাগ্মিতার জন্য খ্যাতির অধিকারী ছিল। তবে মহানবী (সা.) তাঁর নবুওয়াত প্রাপ্তির পূর্বে কখনোই কাব্যশিল্প বা বাগ্মিতা চর্চায় অংশগ্রহণ করেন নি।
মহানবী (সা.)-এর কর্ম ও কোরআন মজীদের আয়াত সাক্ষ্য দেয় যে, তিনি আল্লাহ্র বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পালনে কোনো আপস করেন নি। নিজের স্বার্থ এবং জনগণের বিশ্বাস ও ঝোঁকের সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক (মহান আল্লাহ্র) বাণী তিনি স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনভাবে মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। যে জাতি নিজেদের গড়া মূর্তির পূজা করে অধঃপতন ও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়েছিল তাদের সামনে মহানবী প্রকাশ্যে তাঁর নবুওয়াত প্রাপ্তির কথা ঘোষণা করলেন। তিনি এদেরকে বললেন, কেবল এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ্র ইবাদতের মধ্যেই তাদের মুক্তি ও সাফল্য নিহিত।
তাঁর জীবনের একটি বিশেষ সময়ে নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব হলো যে কারণে তিনি অভূতপূর্ব কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত হলেন। এটি ছিল নবুওয়াতের অসাধারণ প্রকাশÑ ঐশী বার্তা, যা গ্রহণ করার দায়িত্ব সবচেয়ে মহিমান্বিত ও যোগ্য ব্যক্তি হিসাবে তাঁর ওপর অর্পিত হয়েছিল। এ দায়িত্বপ্রাপ্তির পূর্বে তাঁর পক্ষ থেকে কোনো প্রাথমিক প্রচেষ্টা বা ঝোঁক ছিল না যা তাঁকে পরবর্তীতে পৃথিবীর আকস্মিক ও অবিস্মরণীয় সংস্কার সাধনের দিকে এগিয়ে দিতে পারত।
যে বিষয়টি মহানবীর ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে তাঁর মতো শান্ত ও চিন্তাশীল মানুষকে বৈপ্লবিক শক্তির বিস্ফোরন্মুখ উৎসে পরিণত করল, তাঁকে আরবদের অজ্ঞানতার যুগের নিকষ অন্ধকারকে মনুষ্যত্বের আলোতে রূপান্তরিত করার সক্ষমতা প্রদান করল তা আর কিছুই নয়, নবুওয়াতের শক্তি। এটি এমন এক আহ্বান ছিল যা মানুষের অন্তরের গভীরতম স্থানে প্রবেশ করেছিল, মজ্জাগত অন্যায় সংস্কারকে গলিয়ে ফেলে তাদের সকল সংগ্রামকে যথার্থতা অর্জনের পথে পরিচালিত করেছিল।
যে সকল মিথ্যা মানদণ্ডকে মানুষ মহত্ত্ব বিচারের পরিমাপক এবং মানব চরিত্র মূল্যায়ন করার একমাত্র মাধ্যম বলে মনে করত প্রকৃতপক্ষে তারা মিথ্যার আবরণে সত্যকে ঢেকে রাখত। ইসলাম প্রবর্তনের মাধ্যমে এসব মিথ্যা মানদণ্ডকে বাতিল ঘোষণা করা হলো। ইসলাম নতুন ও স্পষ্ট বিচারনীতি আনল; যে লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য মানুষের সংগ্রাম করা উচিত সেই লক্ষ্য নির্দেশ করল এবং মানুষের জীবনে সৃজনশীলতা আনল। অজ্ঞতা ও নীরবতার আচ্ছাদন ছিঁড়ে দূরে সরে গেল, মানুষ তার শক্তিকে কর্মের জন্য নিয়োগ করল, তাদের চিন্তাশক্তির উন্মেষ ঘটল, আর তাদের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরের চেতনাবোধ সৃষ্টি হলো।
আরব জাতি এতটাই মূর্খতা ও হীনতার মধ্যে ছিল যে, তুচ্ছ কারণেও তারা একে অপরকে হত্যা করতে দ্বিধা করত না। বিভিন্ন রকমের দাসত্ব করার কারণে তাদের সকল মানবিক গুণ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ইসলামের আগমন ও তাওহীদের বার্তা বিস্তার লাভের পর তারা মানবতার সত্যিকার স্তম্ভ ও মূর্তি ধ্বংসকারীতে পরিণত হলো। তাদের মনোভাব এতটাই উঁচু স্তরে পৌঁছে গিয়েছিল এবং তারা এমন এক ত্যাগী জাতিতে পরিণত হয়েছিল যে, তারা আনন্দের সাথে জীবন ও সম্পদ আল্লাহ্র পথে উৎসর্গ করে দিত। সেই প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের আত্মোৎসর্গের অবিস্মরণীয় কাহিনী চিরদিনের জন্য সত্যিকার মহত্ত্বের উদাহরণ হয়ে থাকবে।
মহানবী (সা.)-এর বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গি ছিল একজন বিশ্বনেতার। কিন্তু তিনি একত্ববাদ প্রচারের কাজটি অপেক্ষাকৃত সীমিত পরিসরে শুরু করলেন। তিনি এমন একটি বদ্ধ পরিবেশে প্রচার শুরু করলেন যেখানে গোত্রীয় শাসনব্যবস্থা খুবই প্রভাবশালী ছিল এবং প্রতিমা সবচেয়ে পবিত্র ও প্রিয় বস্তু হিসাবে পরিগণিত হতো। এটি এমন এক পরিবেশ ছিল যা কোনোভাবেই ঐশী বার্তা গ্রহণের জন্য প্রস্তুত ছিল না।
তাদের মাধ্যমে ইসলামের যে শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল তা যে কেবল তৎকালীন মূর্তিপূজারী আরব সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশ থেকে উন্নত ছিল তা নয়; বরং সে যুগের সকল মতবাদ ও সংস্কৃতির মধ্যেও তা শ্রেষ্ঠ ছিল।
যে চিন্তার পদ্ধতি ও সংস্কৃতি দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে গিয়েছিল তা সংস্কারের কর্মসূচী প্রণয়নের কাজ এমন এক ব্যক্তির দ্বারা সম্পন্ন হলো যিনি কোনোদিন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেন নি; অক্ষরজ্ঞানহীন ছিলেন এবং সে যুগের সভ্যতা ও ধর্মীয় পুস্তকাদি সম্পর্কে কিছুই জানতেন না।
প্রথমে মহানবী (সা.) তাঁর স্বজনদেরকে, তারপর মক্কার জনগণ এবং এরপর পুরো আরব উপদ্বীপের জনগণকে এক আল্লাহ্র ইবাদত করার দাওয়াত দিলেন। পরিশেষে তিনি পুরো পৃথিবীতে শেষ নবী হিসাবে তাঁর অভিযান পরিচালনা করলেন।
হযরত আলী (আ.) ছিলেন ইসলাম গ্রহণকারী প্রথম পুরুষ৭ এবং মহানবী (সা.)-এর স্ত্রী হযরত খাদীজা (রা.) ছিলেন প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী নারী। পরবর্তীতে আরো অনেকে তাঁদের নতুন ধর্ম গ্রহণের কথা ঘোষণা করেন।
হযরত আলী (আ.) বলেন : “একদিন নবী (সা.) তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের আহ্বান করলেন। তারা উপস্থিত হলে তিনি বললেন : হে আবদুল মুত্তালিবের সন্তানরা! তোমরা এ পর্যন্ত আরবদের কাছ থেকে যা পেয়েছ আমি তোমাদের জন্য তার চেয়ে উৎকৃষ্ট এক উপহার এনেছি। আমি তোমাদের জন্য উপহার হিসাবে ইহকাল ও পরকালের মুক্তির উপায় নিয়ে এসেছি। এটি এক ঐশী আদেশ যার সামনে আত্মসমর্পণ করতে আমি তোমাদেরকে আহ্বান জানাচ্ছি। তোমাদের মধ্যে কে আছে যে আমাকে সাহায্য করবে? আমার ভাই, আমার উত্তরসূরি ও উত্তরাধিকারী হবে?
সবাই নীরব থাকল। উপস্থিত সকলের মধ্যে আমার বয়স ছিল সবচেয়ে কম। আমি বললাম : হে আল্লাহ্র নবী! আমি; আমি আপনাকে সাহায্য করব। নবী বললেন : এ আমার ভাই, আমার উত্তরসূরি ও আমার উত্তরাধিকারী। তোমরা তার কথা শোনো এবং সেগুলো গ্রহণ করো।৮
নেতৃত্বের অসাধারণ যোগ্যতা ও পরিপক্ব রাজনৈতিক বোধ নিয়ে মহানবী (সা.) মানুষের ভেতরের সত্তাকে পুনর্বিন্যাস করার দিকে মনোযোগ দিলেন। তিনি সৃষ্টির রহস্যময়তার দিকে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করলেন এবং বিশ্বলোকের অসীমতার সাথে তাদের পরিচয় ঘটানোর মাধ্যমে মানুষের সহজাত সুপ্ত একেশ্বরবাদকে জাগিয়ে তোলার জন্য সংগ্রাম চালালেন।
নবী (সা.) এমন এক পরিবেশে জন্ম নিয়েছিলেন যেখানকার লোকেরা সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ও গোত্রীয় মনোভাবের কারণে অহেতুক দাম্ভিকতা প্রদর্শনে ব্যস্ত থাকত। অন্যায় সামাজিক অবস্থান ও কুসংস্কারের ভিত্তিতে সুযোগ-সুবিধা বণ্টন করা হতো। তিনি জাগরণ সৃষ্টি করলেন এবং সকল অন্যায় সুযোগ-সুবিধাকে দূরে সরিয়ে দিলেন। অন্যায় বিধি-বিধানের কাঠামোতে শ্রম, জীবন ও সামাজিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন মূল্যবোধ ও ধারণা প্রতিষ্ঠা করলেন। তিনি সম্রাট ও রাজাদের স্বেচ্ছাচারিতা থেকে নির্যাতিত মানুষকে মুক্তিদানের অভিযানে জনসাধারণকে অংশ নিতে অনুপ্রাণিত করলেন, তাদের লক্ষ্য ও চিন্তাসমূহ এই মহান অভিযানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার দিকে মনোনিবেশ করলেন।
যারা এ সকল মহান লক্ষ্যের ঐশী উৎসকে অস্বীকার করে তারাও স্বীকার করে যে, এ লক্ষ্যসমূহ মানব ইতিহাসের সবচেয়ে মহান ও মূল্যবান লক্ষ্য।
* * *
নবুওয়াত লাভের পর তিন বছর মহানবী (সা.) প্রকাশ্যে দীন প্রচারের কাজ করেন নি। তিনি গোপনে ইসলাম প্রচার করেছেন। যে তের বছর তিনি মক্কায় ধর্ম প্রচার করেছেন সে সময় মুশরিকদের নেতারা পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পেরে অন্ধভাবে তাঁর বিরুদ্ধে শত্রুতা করতে লাগল। ইসলামের মুক্তির কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিয়ে অজ্ঞতার যুগের ধর্ম ও প্রথাসমূহ রক্ষা করার জন্য তারা তাদের চূড়ান্ত পর্যায়ের শক্তি প্রয়োগ করেছিল। ইসলাম গ্রহণকারী সকল মানুষের ওপর তারা ভয়াবহ নৃশংসতা চালিয়েছিল।
ইসলাম গ্রহণ করায় নিরস্ত্র মুসলমানদেরকে বেদম প্রহার করে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো। শিকল পরিয়ে তাদেরকে ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্ত অবস্থায় মক্কার জ্বলন্ত সূর্যের নিচে তপ্ত বালুর ওপর শুইয়ে রাখা হতো। মুশরিকরা তাদের উন্মুক্ত বক্ষের ওপর ভারী পাথর চাপা দিয়ে তাদেরকে ইসলাম ত্যাগ করতে বলত।
ইয়াসির ও সুমাইয়া ইসলামের দুই যোদ্ধা সবচেয়ে বেশি বর্বরতার শিকার হয়েছিলেন। সূর্যের আগুনের মতো উত্তপ্ত মরুভূমিতে শুইয়ে রেখে প্রতিদিন তাঁদের বুকের ওপর ভারী পাথর চাপিয়ে দেয়া হতো। তাঁরা ছিলেন ইসলামের প্রথম শহীদ। নির্যাতনে স্বামী ইয়াসির মারা যান। আর স্ত্রী সুমাইয়াকে আবু জেহেল হত্যা করে।৯
এসব দমন-নির্যাতনের পন্থা ব্যবহার করে মুশরিকরা ইসলামকে তার শৈশব অবস্থাতেই শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলার চেষ্টা করে। এটি তাদের জন্য ছিল জীবন-মরণ যুদ্ধ। কারণ, মুশরিকরা জানত যে, মহানবী (সা.)-এর আহ্বানে মানুষ সাড়া দিলে অন্যায়ভাবে ভোগ করা তাদের এত দিনের সুযোগ-সুবিধা তারা চিরদিনের জন্য হারাবে। বস্তুত ইসলামের বিরুদ্ধে শত্রুতা বৃদ্ধির পেছনে ঈর্ষাও ছিল অন্যতম কারণ।
এ যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতি বহাল থাকায় মক্কা নিরস্ত্র মুসলমানদের জন্য কারাগার ও নির্যাতনের শহরে পরিণত হলো। মুশরিকরা এমনকি কোরআন মজীদের তেলাওয়াত শোনাও নিষিদ্ধ করে দিল। তারা কিছু সংখ্যক লোক নিয়োগ করল যারা শহরের বাইরে যেত এবং মক্কার দিকে আসতে কাফেলাকে সতর্ক করে দিত যাতে তারা মুসলমানদের সাথে কোনোরূপ যোগাযোগ না করে।
কুরাইশদের নিষ্ঠুরতা ও ক্রমাগত চাপের মুখে কিছু মুসলিম সিদ্ধান্ত নিলেনযে, তাঁরা মক্কা ত্যাগ করে ইথিওপিয়ায় হিজরত করবেন। উদ্দেশ্য হলো সেখানে তাঁরা নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে মুশরিকদের অপমান থেকে মুক্ত অবস্থায় ইসলাম চর্চা ও এক আল্লাহ্র ইবাদত করবেন।
তারপরও ইসলামবিরোধীরা তাদের নির্যাতন অব্যাহত রাখল। কুরাইশরা ইথিওপিয়ার সম্রাটের কাছে দু’জন প্রতিনিধি পাঠাল যাতে সম্রাট মুসলমানদেরকে আশ্রয় না দিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেন। কিন্তু সম্রাট নাজ্জাশী মুসলমানদের আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করলেন এবং তাঁদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা জোরদার করলেন। কুরাইশদের প্রতিনিধিরা ইথিওপিয়ায় পৌঁছে সম্রাটকে উপহার দিল, আর শরণার্থীদেরকে মক্কায় ফেরত পাঠানোর জন্য অনুরোধ করল। কিন্তু সম্রাট বললেন যে, যেহেতু মুসলমানরা সকল শাসকের মধ্য হতে তাঁকেই আশ্রয় চাওয়ার জন্য নির্বাচন করেছে সেহেতু তিনি মুসলমানদের ব্যাপারে অনুসন্ধান না করে তাদেরকে দেশ থেকে বহিষ্কার করতে পারেন না।
মুসলমানদের মুখপাত্র হিসাবে জাফর ইবনে আবু তালিব সম্রাটকে যিশুখ্রিস্ট সম্পর্কে ইসলামের বক্তব্য কী তা জানালেন। সম্রাট খুবই অভিভূত হলেন, তিনি বললেন : “আমি ঈশ্বরের শপথ করে বলছি, মুসলমানরা যিশুখ্রিস্ট সম্পর্কে যা বলেছে তার বাইরে তাঁর সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই।”
সম্রাটের দুর্নীতিবাজ মন্ত্রীরা তাঁর বক্তব্যে অসন্তুষ্ট হলেও সম্রাট মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসের প্রশংসা করলেন। তিনি তাঁদেরকে স্বাধীনতা দিলেন, আর কুরাইশদের আনা উপহার তাদের ফিরিয়ে দিলেন। তিনি বললেন যে, যেহেতু আল্লাহ্ তাঁকে মুসলমানদের নিরাপত্তা দানের মতো ক্ষমতা দিয়েছেন, তাই নিজের জন্য কোনো ঘুষ নেয়ার প্রয়োজন তাঁর নেই, এ ধরনের উপহার নেয়া তাঁর জন্য সমীচীন নয়।১০
এভাবেই অন্ধকারে আলোর বিজয় সূচিত হলো বহু ঈশ্বরবাদ ও অজ্ঞতার শক্তি পরাজয় বরণ করে হতাশায় ডুবে গেল।
ইসলামের শত্রুরা দেখতে পেল যে, তাওহীদী আদর্শের মোকাবিলায় তাদের শক্তি ও ক্ষমতা ভেঙ্গে পড়ছে; কুড়াল দিয়ে কাটা গাছের মতোই ইসলামের বাণীতে তাদের বস্তুগত ও মানসিক প্রতিমাগুলো মাটিতে পড়ে যাচ্ছে। এরূপ পরিস্থিতিতে তারা প্রথমে হুমকির আশ্রয় নিল। যখন তারা দেখল হুমকিতে কাজ হচ্ছে না, তখন তারা বিভিন্ন পুরস্কার ও সুযোগ-সুবিধার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নবী (সা.)-কে তাঁর পথ থেকে ফেরানোর চেষ্টা করল।
কিন্তু তাদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ প্রমাণিত হলো যখন তিনি ঐশী বার্তাবাহকের জন্য মানানসই দৃঢ়তা নিয়ে বিরক্তির সাথে ধন-সম্পদ ও ক্ষমতার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। তিনি ঘোষণা করলেন :
“আমি আল্লাহ্র শপথ করে বলছি, যদি তোমরা আমার ডান হাতে সূর্য ও বাম হাতে চাঁদ এনে দাও, তবুও সারা বিশ্বে আল্লাহ্র দীনের প্রসার ঘটার পূর্ব পর্যন্ত অথবা দীনের পথে আমার জীবন ত্যাগের পূর্ব পর্যন্ত আমি আমার পথ থেকে সরে দাঁড়াব না।”১১
ইয়াকুবী তাঁর ইতিহাসে এভাবে বর্ণনা দিয়েছেন : “কুরাইশরা আবু তালিবকে বলল যে, তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র তাদের দেব-দেবীদের সাথে নৃশংস আচরণ করছে, তাদেরকে অপ্রকৃতস্থ বলছে এবং প্রচার করে বেড়াচ্ছে যে, তাদের পূর্বপুরুষরা বিভ্রান্ত ছিল। তারা আবু তালিবকে অনুরোধ করল যাতে তিনি মুহাম্মদকে দীন প্রচার থেকে বিরত হতে বলেন। বিনিময়ে কুরাইশরা তাদের সকল সম্পত্তি মহানবীকে দিয়ে দেবে।”
মুহাম্মদ (সা.) জবাব দিলেন : “আল্লাহ্ তায়ালা আমাকে এজন্য নবী হিসাবে পাঠান নি যে, আমি এ পৃথিবীর সম্পদ পুঞ্জীভূত করব; বরং তাঁর বাণী মানব জাতির নিকট পৌঁছে দেয়ার জন্য এবং মানুষকে তাঁর দিকে আহ্বান করার জন্য তিনি আমাকে নবুওয়াতের দায়িত্ব দিয়েছেন।”১২
ইসলামের শত্রুরা পুনরায় কৌশল পরিবর্তন করল। তারা সম্ভাব্য সকল ক্ষমতা ও কৌশল প্রয়োগ করে ইসলামের নব প্রতিষ্ঠিত অট্টালিকাকে ধ্বংসের জন্য তৎপর হয়ে উঠল।
পুরাতন শত্রুরা একত্র হয়ে মহানবী (সা.)-কে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করল। তারা নবীর পবিত্র নাম কলঙ্কিত করে তাঁর সুখ্যাতি বিনষ্ট করতে প্রবৃত্ত হলো। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এ কাজের মাধ্যমে তাদের অন্তরে যে ঘৃণার আগুন জ্বলছিল তা শান্ত করা এবং তাঁর আহ্বান ও প্রচারিত দীনের শক্তিকে নিষ্ক্রিয় করে ফেলা।
তারা সর্বত্র প্রচার করতে লাগল যে, মুহাম্মদ একজন যাদুকর, পাগল, কবি। আর তারা মূর্খ মানুষদেরকে তাঁর বিরুদ্ধে উসকে দিল। বস্তুত মহৎ ব্যক্তিদেরকে পরাজিত করা ও গোপনে ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যে সত্যের শত্রুরা সবসময়ই একই শয়তানী কৌশল অবলম্বন করেছে।
কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে যে, এ শয়তানী কৌশল শুধু ইসলামের নবীর যুগে প্রয়োগ করা হয় নি। এরশাদ হয়েছে :
كَذلِكَ مَا أَتَى الَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِهِمْ مِن رَسُوْلٍ إِلَّا قَالُوْا سَاحِرٌ أَوْ مَجْنُوْنٌ أَتَوَاصَوْا بِهِ بَلْ هُمْ قَوْمٌ طَاغُوْنَ
“এমনিভাবে তাদের পূর্ববর্তীদের কাছে যখনই কোনো রাসূল আগমন করেছে, তারা বলেছে,ন যাদুকর, না হয় উন্মাদ। তারা কি একে অপরকে এই উপদেশই দিয়ে গেছে? বস্তুত তারা দুষ্ট সম্প্রদায়।”Ñ সূরা আয যারিয়াত : ৫২-৫৩
মহানবী (সা.) কখনোই তাঁর শত্রুদের সাথে ক্রুদ্ধ আচরণ করেন নি। মুশরিকদের অন্ধ ধর্মবিদ্বেষপ্রসূত সংস্কার, অদূরদর্শিতা, অন্ধ ঐতিহ্যপ্রীতি ও তাঁর নামে মিথ্যা অপবাদ আরোপ করার মতো জঘন্য অপরাধ তাঁর জন্য অসুবিধা বৃদ্ধি করেছিল। কিন্তু মুশরিকরা কখনোই তাঁকে ক্রোধান্বিত করতে সক্ষম হয় নি। বরং তিনি সবসময়ই তাদেরকে ধর্মীয় দিক নির্দেশনা প্রদানের মাধ্যমে সত্যের পথে ফেরানোর চেষ্টা করেছেন।
কোনো প্রকার জোর-জবরদস্তি বা প্রতিশ্রুতি, বঞ্চনা বা অসুবিধা তাঁকে তাঁর সংকল্প থেকে নড়াতে পারে নি। ধূর্ত ও ভিত্তিহীন অভিযোগের প্রচার ঘটলেও তা কুরাইশদের জন্য কোনো ফল বয়ে আনে নি। এর কারণ হলো কোরআন মজীদের অকাট্য যুক্তি ও অপূর্ব রচনাশৈলীর প্রভাব এতটাই ব্যাপক ও মহিমাময় ছিল যে, যে-ই তেলাওয়াত শুনত তার মনে কোরআনের কথা রেখাপাত করত অথবা সে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করত। অনেক সময় ইসলামের শত্রুরাও কোরআন মজীদের এ অসাধারণ বৈশিষ্ট্য স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে।
তাবারসী কোরআনের ওপর মন্তব্য করতে গিয়ে লিখেছেন : “ওয়ালিদ ছিলেন আরবদের সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় জ্ঞানী ব্যক্তি। তিনি যখন মহানবী (সা.)-এর মুখে সূরা ফুস্সিলাত (হা-মীম সিজদাহ্)-এর কয়েকটি আয়াতের তেলাওয়াত শুনলেন তখন গভীরভাবে প্রভাবিত হলেন। বনু মাখযুম তাঁর চারপাশে জড়ো হলে তিনি তাদের নিকট কোরআন সম্পর্কে বললেন : এটি স্বতন্ত্র মনোহারিত্ব ও অদ্বিতীয় সৌন্দর্যের অধিকারী। এর শাখা-প্রশাখা ফলফলাদিতে পূর্ণ আর শিকড় ঐশী আশীর্বাদপ্রাপ্ত। সকল সাহিত্যের চেয়ে এর বক্তব্য অনেক বেশি উঁচু মানের। তিনি এরূপ বর্ণনা দিয়ে নিজের পথে চলে গেলেন। কুরাইশরা মনে করল যে, ওয়ালিদ মুহাম্মদ (সা.)-এর ধর্ম গ্রহণ করেছেন।”১৩
যদিও মহানবী (সা.) অসীম ধৈর্যের অধিকারী ছিলেন, তবুও তাঁর গোত্রের লোকদের নির্বোধ আচরণে তিনি ব্যথিত হতেন। তখন তিনি নিভৃতে চলে যেতেন এবং আল্লাহ্র পক্ষ থেকে আর কোনো হুকুম না আসা পর্যন্ত সেখানেই অবস্থান করতেন। কেননা, তাঁর ওপর যে ধর্মীয় ও পবিত্র লক্ষ্য অর্জনের দায়িত্ব অর্পিত ছিল তা হতে মুহূর্তের জন্যও বিরত থাকার অনুমোদন তাঁর ছিল না। তাঁকে সকল বিশ্রাম ও বিরতি উপেক্ষা করতে হয়েছিল।১৪
যে বিষয়গুলোর কারণে নবিগণ তাঁদের অভিযানে সফল হয়েছিলেন, অবিচলতা বা দৃঢ়তা ও সহিষ্ণুতা সেগুলোর অন্যতম। তাঁরা সংগ্রাম করতে গিয়ে যেসব পন্থা অবলম্বন করেছিলেন সেদিকে ইঙ্গিত করে কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :
وَ إِسْمَاعِيْلَ وَ إِدْرِيْسَ وَ ذَا الْكِفْلِ كُلٌّ مِنَ الصَّابِرِيْنَ
“আর ইসমাঈল, ইদ্রীস ও যুলকিফলের কথা স্মরণ করুন, তাঁদের প্রত্যেকেই ছিলেন সবরকারী।”Ñসূরা আম্বিয়া : ৮৫
আল্লাহ্ তায়ালার সকল নবী যখন অস্বীকৃতি ও প্রত্যাখ্যানের সম্মুখীন হয়েছিলেন তখন তাঁদেরকে দুঃখ-যন্ত্রণা ও প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়েছিল। কিন্তু আল্লাহ্র সাহায্যে তাঁদের বিজয় নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা অবিচল ছিলেন।
মক্কার অত্যাচারপূর্ণ পরিবেশে মুসলমানদের ওপর সীমাহীন নির্যাতন চলছিল। তাদেরকে সবসময়ই বন্দিত্ব, নির্যাতন ও হত্যার হুমকি দেয়া হচ্ছিল; আর মুসলিম যোদ্ধারা তখনও যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। এরূপ পরিস্থিতির কারণে আল্লাহ্ তায়ালা মুসলমানদেরকে হিজরত করার আদেশ দিলেন। মহানবী সবাইকে মক্কা ত্যাগ করে মদীনার দিকে রওয়ানা হওয়ার নির্দেশ দিলেন।
কুরাইশরা এ হিজরত যে তাদের জন্য বিপজ্জনক, তা ভালোভাবেই বুঝতে পারল। তারা নবীর সঙ্গী-সাথীদের মক্কা ত্যাগে বিরত রাখার জন্য সবরকম অপমানজনক পন্থার আশ্রয় নিল। তারা এমনকি সাহাবীদের স্ত্রীদেরকে পণবন্দী করল। কিন্তু সংকল্পের প্রতি নিষ্ঠাবান মুসলমানরা একে একে মুশরিকী অজ্ঞতা ও নির্যাতনের কেন্দ্র মক্কা নগরী ত্যাগ করতে শুরু করলেন। পিছনে পড়ে রইল তাঁদের ধন-সম্পদ ও পরিবার-পরিজন। মদীনায় পৌঁছলে সেখানকার জনগণ মুসলমানদেরকে সাদরে বরণ করে নিল।
বেশিরভাগ মুসলমান মক্কা ত্যাগ করায় মক্কা মুসলমানশূন্য হয়ে গেল। এ অস্বাভাবিক পরিস্থিতি ও মদীনা থেকে প্রাপ্ত খবরে মুশরিকরা ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন হলো।
যেহেতু মুশরিক নেতাদের পূর্ববর্তী সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছিল সেহেতু এবার তারা একটি গুরুতর ও বিপজ্জনক সিদ্ধান্ত নিল। তারা মহানবীকে হত্যা করার পরিকল্পনা করল। সিদ্ধান্ত হলো যে, রাত হওয়ার সাথে সাথে দায়িত্বপ্রাপ্ত আততায়ীরা তাদের কাজ শুরু করবে।১৫
রাতের বেলা আততায়ীরা মহানবীর গৃহ ঘিরে ফেলল। তারা অপেক্ষা করতে লাগল যে, ভোর হওয়ার সাথে সাথে নবী ঘরের সম্মুখ দরজা দিয়ে বের হবেন। তারা সারারাত নবীর গৃহ প্রহরা দিয়ে রাখল; তারা নিশ্চিত ছিল যে, নবী তাদের অবরোধ ভেঙ্গে পালিয়ে যেতে পারবেন না। পুরো শহরে তাঁর কোনো রক্ষাকারী নেই; তাঁর জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দেয়া হবে।
ইতোমধ্যে আল্লাহ্র রাসূল (সা.) হযরত আলী (আ.)-কে তাঁর বিছানায় শোবার জন্য আদেশ দিলেন। হযরত আলী ইসলামের আলোয় আলোকিত ছিলেন, তিনি আল্লাহ্ ও তাঁর নবীর জীবনের জন্য মৃত্যুবরণ করতে সদা প্রস্তুত ছিলেন। এরপর মহানবী হযরত আবু বকরকে সাথে নিয়ে গোপনে গৃহ ত্যাগ করলেন।
এমন সময় এক ব্যক্তি মহানবীর গৃহের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অপেক্ষারত মুশরিকদেরকে জিজ্ঞাসা করল যে, তারা কার জন্য অপেক্ষা করছে। তারা যখন বলল, মুহাম্মদের জন্য। তখন সেই ব্যক্তি বলল, সে তোমাদের হাত থেকে বেরিয়ে গেছে।
সুবহে সাদিক হলে তারা আশ্চর্যান্বিত হয়ে দেখতে পেল যে, হযরত আলী নবীর বিছানা থেকে উঠে এলেন।
কুরাইশরা বৃত্তাকারে নবীর গৃহ ঘিরে থাকা সত্ত্বেও তিনি কীভাবে সকলের অলক্ষ্যে আবু বকরসহ বেরিয়ে গিয়েছিলেন তা স্পষ্ট নয়। তবে বিষয়টি নিশ্চিত যে, আল্লাহ্ তাঁর প্রিয় নবীকে এসব নীচ ও হীন লোকদের কবল থেকে রক্ষা করেন।
মহানবী (সা.) মধ্যরাতে মক্কা ত্যাগ করলেন এবং গুহায় আশ্রয় নিলেন। এরপর পুনরায় তিনি ভিন্ন পথে মদীনার দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। যখন তিনি মদীনায় পৌঁছলেন তখন এটি পরিষ্কার হয়ে গেল যে, কুরাইশদের ষড়যন্ত্র তাদের নিজেদেরকেই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এবং ইসলাম ও মুসলমানরা উপকৃত হয়েছে। যে অসীম শক্তিধর হাত মহানবীকে তের বছর যাবৎ সকল ক্ষতি থেকে রক্ষা করেছে তাঁর পক্ষে এ চক্রান্ত নস্যাৎ করা খুবই সহজ ব্যাপার ছিল।
* * *
মহানবী (সা.)-এর হিজরতের পূর্বে মদীনার একদল অধিবাসী মক্কায় এসেছিলেন। তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল খাযরাজ ও আউস গোত্রের মধ্যকার গোত্রীয় যুদ্ধে কুরাইশদের সমর্থন আদায় করা। এ যুদ্ধ বছরের পর বছর ধরে আরবদের ভূমিতে নরক সৃষ্টি করে রেখেছিল। কুরাইশদের নিষেধ ও সতর্কতা সত্ত্বেও তাঁরা মহানবীর বক্তব্য শুনলেন এবং গভীরভাবে প্রভাবিত হলেন; এমনকি অনেকে নিজে নিজেই ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন। পরবর্তী সময়ে মক্কায় হজ্ব পালন করতে এসে তাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে মহানবীর নেতৃত্ব মেনে নিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। মক্কা ত্যাগ করে মদীনায় প্রত্যাবর্তন করার পর তাঁরা মদীনার জনগণের নিকট মহানবীর বার্তা পৌঁছে দিতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালালেন। তাঁরা সব শ্রেণীর জনগণের কাছে ঐশী বার্তা পৌঁছে দিয়ে মদীনার লোকজনকে আলোকিত করার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হলেন। এ ঘটনা ছিল মূর্তিপূজার ভিত্তিমূলে এক শক্তিশালী মুষ্টাঘাত।
মদীনার জনগণ সুদীর্ঘ গোত্রীয় যুদ্ধে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিল। তারা মহানবীর বক্তব্যে সামাজিক সংঘাতের আগ্রাসী আগুন নির্বাপিত করার পথ খুঁজে পেল। তৎকালীন সমাজে ইসলামের মহৎ আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা এবং পাপাচার ও বিভ্রান্তি নিরসনে ইসলামের ভূমিকা বোঝার জন্য আমাদেরকে আরব উপদ্বীপের ইসলামপূর্ব পরিস্থিতির দিকে নজর দিতে হবে।
আলী (আ.) বলেছেন : “মানুষ যে বিভ্রান্তির পথে ছিল তা থেকে তাদেরকে সতর্ক করার জন্য এবং ঐশী দায়িত্ব পালনের জন্য আল্লাহ্ তায়ালা রাসূল (সা.)-কে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। হে আরবরা! সে সময় তোমরা নিকৃষ্টতম ধর্মবিশ্বাস ও প্রথার অনুসারী ছিলে এবং সকল দেশের মধ্যে তোমরা সবচেয়ে বেশি বঞ্চনার দেশে বাস করতে। তোমরা কঠিন পাথর ও বিষাক্ত সাপের মধ্যে শয়ন করতে, মদপান করতে, কোনো সুখাদ্য খেতে না, একে অপরের রক্ত ঝরাতে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করতে। তোমাদের মূর্তিপূজা ও পাপ তোমাদেরকে নির্জীব করে দিয়েছিল।”১৬
মহানবী (সা.)-এর মদীনায় হিজরতের পর থেকে ইসলামী সন গণনা শুরু হয়। কারণ, এটি ছিল ইসলামের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। এরপর থেকে বিরামহীনভাবে ইসলামী শক্তির নিকট মিথ্যা ও বাতিলের পরাজয় ঘটতে লাগল।
* * *
মদীনায় মহানবী (সা.)-এর উদ্দেশ্য সফল হলো। ঘরে ঘরে তাঁর আহ্বান পৌঁছে গেল; এক নতুন স্বচ্ছ সমাজ গড়ে উঠল। মহানবী যে শক্তিশালী যুক্তিবোধ ও সৃজনশীল চিন্তা এনেছিলেন তা মদীনার লোকদের জীবনে প্রাধান্যবিস্তারকারী প্রথাসমূহ ও পূর্ববর্তী সাংস্কৃতিক, নৈতিক ও সামাজিক কাঠামোকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল। দমন-নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতার বেড়ি ও দাসত্বের শৃঙ্খল ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল; শাসকগোষ্ঠীকে তাদের ঔদ্ধত্যের সিংহাসন থেকে টেনে নামানো হলো। মাহনবী যে চিরস্থায়ী শরীয়ত প্রবর্তন করলেন তা মানব জাতিকে এক নতুন বিচারব্যবস্থা ও অতি উন্নত সংস্কৃতি উপহার দিল, শীঘ্রই মদীনা ইসলামের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সামরিক ঘাঁটিতে রূপান্তরিত হলো।
মক্কায় মুসলমানদের অভিজ্ঞতাসমূহ, ঈমানদারদের ওপর সীমাহীন নির্যাতন ও লাঞ্ছনা, পুরাতন সম্পর্ক ছিন্ন হওয়া ও নতুন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা, আধ্যাত্মিক পরিপক্বতার গভীরতা অনবরত বৃদ্ধিÑ এ সবই হিজরতকারীদের আত্মিক উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছিল। তাই মদীনা যে কেবল আরব জাহানে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল তা-ই নয়; এটি সারা বিশ্বে ইসলামের বিকাশের ভিত্তিতে পরিণত হলো।
এ স্থান থেকেই মহানবী (সা.) বিশ্বের বিভিন্ন জাতির কাছে তাঁর বার্তা প্রেরণ করেন; তিনি সকল মানুষকে তাওহীদের পতাকার নিচে একতাবদ্ধ হতে আহ্বান জানান, তাওহীদের গুরুত্বপূর্ণ জীবনদায়ী শিক্ষা গ্রহণ করতে বলেন। মহানবীর প্রবর্তিত ধর্ম অর্ধ শতাব্দীরও কম সময়ে সে কালের প্রভাবশালী ও উন্নত জাতিসমূহকে মদীনার শাসনাধীনে নিয়ে আসে। এটি এমন ছিল যেন পীড়িত ও উদ্বিগ্ন হৃদয়সমূহের ওপর করুণা ও আশীর্বাদের বৃষ্টি বর্ষিত হয়েছিল।
যারা এ সকল ঘটনার অন্তর্নিহিত কারণ বুঝতে ব্যর্থ তাদের বক্তব্য হলো ঘটনাক্রমে ইসলামের দ্রুত প্রচার ও প্রসার ঘটেছে। প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীর বড় বড় ঘটনাগুলোর কোনোটিই আকস্মিক বা ঘটনাক্রমে ঘটে গেছেÑ এরূপ বলা যায় না; বিশেষত একটি নৈতিক, দার্শনিক ও আইনগত ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাতার উত্থানকে কোনোভাবেই কেবল ‘ঘটনাক্রমে ঘটে গেছে’ বলে অভিহিত করা যায় না।
যে ঘটনা আরবের ইতিহাসে কেবল একবার ঘটল এবং যার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ আর কোনো ঘটনাই কখনো ঘটলো না, তাকে কীভাবে ‘নিছক ঘটনাক্রমে সংঘটিত’ বলে চালিয়ে দেয়া যায়?
যদি কিছু নির্দিষ্ট সামাজিক উপাদানের কারণে আরবের ভূমিতে এ ব্যাপক আন্দোলন সংঘটিত হয়ে থাকে তবে সেই একই উপাদানের কারণে একই অঞ্চলে মহানবী (সা.)-এর সাথে তুলনীয় দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির উত্থান ঘটল না কেনো? কেনো সকল ঘটনার মধ্যে এই একটি বিশেষ ঘটনা অদ্বিতীয় ও স্বয়ংসম্পূর্ণ উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে?
কোনো সমাজে কিছু নির্দিষ্ট সামাজিক অবস্থার কারণে যদি একট বৈপ্লবিক আন্দোলন জন্ম নেয়, তবে পূর্ববর্তী অগ্রগতির সাথে কোনো সংযোগ বা পূর্বসূত্রতা ছাড়াই হঠাৎ এরূপ আন্দোলন জন্ম নেবেÑ এমন হওয়াটা অসম্ভব। বিপরীতভাবে এরূপ আন্দোলন হচ্ছে একটি তরঙ্গ যতক্ষণ না একজন নেতার উত্থান ঘটার জন্য পরিস্থিতি পুরোপুরি অনুকূলে আসে ততক্ষণ পর্যন্ত এটি বিস্তার লাভ করতে থাকে।
মহানবী (সা.) যখন ইসলাম প্রচার করেন তখন তিনি ইসলামকে কতিপয় ধারাবাহিক আদর্শগত আন্দোলনের সর্বশেষ বলে অভিহিত করেন নিÑ যা প্রতিটি সমাজেই ঘটে থাকে। তিনি যে মহান মতবাদ, মূল্যবোধ ও আদর্শ উপহার দিয়েছেন তার পেছনে কোনো ভিত্তি সমাপনকারী কর্মকাণ্ড ছিল না; আর তিনি যে পরিবেশে বেড়ে উঠেছিলেন সেখানে এমন কোনো নৈতিক ও আদর্শিক ভিত্তি ছিল না যার ওপর এরূপ মূল্যবোধ ও আদর্শ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
স্বতন্ত্রভাবে কেবল মহানবীর নিকট হতেই ইসলামের বৈপ্লবিক প্রবাহ গতি ও শক্তি অর্জন করেছিল; ইসলামের বৈপ্লবিক শক্তির কোনো প্রাথমিক উৎস ছিল না। বিষয়টি এমন ছিল না যে, মহানবী ও তাঁর সঙ্গীদেরকে কেন্দ্র করে একটি বৈপ্লবিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল; বরং এ আন্দোলন ছিল তাঁর ব্যক্তিত্বেরই বিস্তৃতি। এ আন্দোলন ছিল তাঁর ব্যক্তিত্বেরই একটি অংশ; তিনি এ আন্দোলনের অংশ ছিলেন না। এদিক থেকে ইসলামের নবীর বৈপ্লবিক আন্দোলন ইতিহাসের অন্য সকল আন্দোলন হতে ভিন্ন।
ইসলামে আমরা এমন এক ব্যাপক আন্দোলন দেখতে পাই যাতে জীবনের সকল ক্ষেত্রই অন্তর্ভুক্ত; এটি সকল মানবিক মূল্যবোধ ও আদর্শের এক ব্যাপক বিপ্লব।
ইসলামের শিক্ষা গোত্রীয় সমাজের ভিত্তি কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ইসলামের আদর্শ অন্য সব কিছুর চেয়ে বিস্তৃত ও মহৎ ছিল। কেননা, এটি তাওহীদের পতাকাতলে সকলকে একত্রিত করে বিশ্বব্যাপী একক সমাজ প্রতিষ্ঠার চেতনা ধারণ করে।
এ প্রসঙ্গে অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তি ইসলামের প্রসার সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা বিবেচনা করা যেতে পারে। যেমন সুপরিচিত ভারতীয় রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিত্ব জওহরলাল নেহেরু লিখেছেন : “এটি এক আশ্চর্যের বিষয় যে, আরব জাতি বছরের পর বছর ধরে ঘুমিয়ে ছিল এবং পৃথিবীর কোথায় কী ঘটছে তার সাথে তাদের কোনো সংযোগ ছিল না, তারা হঠাৎ জেগে উঠল এবং আশ্চর্যজনক শক্তি প্রদর্শন করে পুরো বিশ্বকে স্তম্ভিত ও নীরব করে দিল। আরবদের নিজস্ব ইতিহাস, এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার ওপর তাদের দ্রুত প্রাধান্য বিস্তার এবং এক অতি উন্নত সংস্কৃতি ও সভ্যতার বিকাশ লাভÑ এ সবই ইতিহাসের বিস্ময়।…
ইসলাম ছিল একটি নতুন শক্তি বা মতবাদ যা আরবদেরকে জাগিয়ে তুলেছিল এবং তাদেরকে পরিপূর্ণ আত্মবিশ্বাস ও প্রাণশক্তিতে ভরিয়ে দিয়েছিল। একজন নতুন নবী এ ধর্ম প্রচার শুরু করেছিলেন, তাঁর নাম মুহাম্মদ।…
হিজরতের সাত বছরের মধ্যে মুহাম্মদ প্রভু হয়ে মদীনায় ফিরে এসেছিলেন। মদীনায় অবস্থানকালেই তিনি পুরো পৃথিবীর রাজা ও শাসকদের নিকট এক আল্লাহ্ ও তাঁর নবীর কর্তৃত্ব মেনে নেয়ার আহ্বান জানিয়ে পত্র প্রেরণ করেছিলেন। কনস্টান্টিনোপলের সম্রাট হিরাক্লিয়াস সিরিয়ায় অবস্থান করে পারস্যের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালানায় ব্যস্ত ছিলেন। তখন তিনি মুহাম্মদের পত্র পান। পারস্যের সম্রাটও পত্র পেয়েছিলেন এবং বলা হয় যে, চীনের তাই সুং পর্যন্ত এ পত্র পেয়েছিলেন। এ সকল রাজা ও শাসক অবশ্যই অবাক হয়েছিলেন যে, কে এই অপরিচিত ব্যক্তি যে তাঁদেরকে আহ্বান করার সাহস করল। এ বার্তা প্রেরণ থেকে আমরা তাঁর পরিচালিত অভিযান সম্পর্কে ধারণা করতে পারি। তিনি তাঁর এ আত্মবিশ্বাস ও ধর্মীয় মতবাদ তাঁর জনগণের মধ্যে সঞ্চারিত করেন, তাদেরকে উৎসাহ ও সান্ত্বনা দেন, আর এ আত্মবিশ্বাস ও ধর্মের জোরেই মরুভূমির লোকরা পূর্ববর্তী কোনো ঘটনার ফলাফল ব্যতিরেকে বিশ্বের অর্ধেক অঞ্চল জয় করেছিল।…
আত্মবিশ্বাস ও ধর্মীয় চেতনা তাদের একটি বড় সম্পদ ছিল। ইসলাম তাদেরকে ভ্রাতৃত্ববোধ শিক্ষা দিয়েছিল অর্থাৎ যারা মুসলিম তারা সকলেই সমান মর্যাদার অধিকারী। এভাবেই ইসলাম জনগণের সামনে গণতন্ত্রের মানদণ্ড স্থাপন করেছিল। সে সময়ের দুর্নীতিগ্রস্ত খ্রিস্টবাদের সাথে তুলনা করলে বোঝা যায় যে, এ ভ্রাতৃত্ববোধের কর্তা ব্যাপক আবেদন সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন। কেবল আরবদের কাছেই যে এ আবেদন ছিল তা নয়; বরং আরবরা যেখানেই গিয়েছে সেখানকার লোকদের নিকটও এ বিষয়টি গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে।”১৭
কেবল একজন মানুষের ভূমিকার কারণে মানব ইতিহােেস এ ব্যাপক ও আশ্চর্যজনক রূপান্তরের প্রক্রিয়া সংঘটিত হয়েছিল। তাঁর মালিকানায় কোনো বস্তুগত সম্পত্তি ছিল না। তিনি কখনো বৈজ্ঞানিক বা কারিগরী গবেষণা করেন নি। এমনকি অন্যদের কাছ থেকেও তিনি কোনো বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেন নি। এ বিষয়টি কোনো প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক ঘটনা হিসাবে বিবেচনা করা যায় না; বরং এ বিষয়টি সেই অসাধারণ ব্যক্তিত্বের অতি মানবীয় সক্ষমতার স্বতঃস্ফূর্ত সাক্ষ্য বা প্রমাণ।
যদি আরবে তাঁর শত্রুরা তাঁকে গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হতে বাধ্য না করত, তা হলে তিনি আরো দ্রুত ও অধিকতর জোরালোভাবে অন্যান্য জাতির নিকট ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে পারতেন। কিন্তু শত্রুর বিরামহীন আক্রমণের কারণে তিনি ইসলামের প্রতিরক্ষায় তাঁর অধিকাংশ সময় ও শ্রম ব্যয় করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
ইসলামবিরোধীরা এই বলে সমালোচনা করে থাকে যে, ইসলামের উন্নতি বা প্রসার নিশ্চিত করার জন্য সামরিক শক্তির আশ্রয় নেয়া হয়েছিল। কিন্তু আমরা দেখতে পাই যে, তিনি কখনোই কোনো দল বা জাতির বিরুদ্ধে কোনো শত্রুতামূলক উদ্যোগ নেন নিÑ হোক তারা ইহুদী বা কুরাইশ বা বাইজান্টাইন। ইতিহাস সাক্ষ্য যে, মহানবী (সা.)-এর পরিচালিত সকল যুদ্ধই ছিল আত্মরক্ষামূলক। এসব যুদ্ধে সবসময়ই উদ্দেশ্য ছিল শত্রুদের আক্রমণ প্রতিহত করা। কিছু ক্ষেত্রে মুসলমানরা নিশ্চিত হয়েছিল যে, শত্রুরা তাদের আগ্রাসন ও প্রতারণামূলক আচরণ থেকে বিরত হবে না; ফলত কেবল এসব ক্ষেত্রে মুসলমানরা আত্মরক্ষামূলক আক্রমণ চালানোর আদেশ দেয়া হয়েছিল।
কোরআন মজীদের নিম্নোক্ত আয়াতসমূহে জিহাদের আইন প্রণয়নের প্রাথমিক কারণ অর্থাৎ আগ্রাসী শক্রর আক্রমণের জবাব দেয়ার কারণ স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে।
أُذِنَ لِلَّذِيْنَ يُقَاتَلُوْنَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوْا وَ إِنَّ اللهَ عَلَى نَصْرِهِمْ لَقَدِيْرٌ الَّذِيْنَ أُخْرِجُوا مِن دِيَارِهِمْ بِغَيْرِ حَقٍّ إِلَّا أَنْ يَقُوْلُوْا رَبُّنَا اللهُ
“যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হলো তাদেরকে যাদের সাথে কাফেররা যুদ্ধ করে; কারণ, তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আল্লাহ্ তাদেরকে সাহায্য করতে অবশ্যই সক্ষমÑ যাদেরকে তাদের ঘর-বাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে শুধু এ অপরাধে যে, তারা বলে, আমাদের পালনকর্তা আল্লাহ্।”Ñসূরা হাজ্ব : ৩৯-৪০
وَ قَاتِلُوْا فِيْ سَبِيْلِ اللهِ الَّذِيْنَ يُقَاتِلُوْنَكُمْ وَ لَا تَعْتَدُوا إِنَّ اللهَ لَا يُحِبُّ الْمُعْتَدِيْنَ
“আর লড়াই কর আল্লাহ্র রাস্তায় তাদের সাথে যারা লড়াই করে তোমাদের সাথে। অবশ্য কারো প্রতি বাড়াবাড়ি করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ সীমা লঙ্ঘনকারীদেরকে পছন্দ করেন না।”
Ñসূরা বাকারা : ১৯০
وَ إِنْ نَكَثُوْا أَيْمَانَهُمْ مِنْ بَعْدِ عَهْدِهِمْ وَ طَعَنُوا فِيْ دِيْنِكُمْ فَقَاتِلُوا أَئِمَّةَ الْكُفْرِ إِنَّهُمْ لَا أَيْمَانَ لَهُمْ لَعَلَّهُمْ يَنْتَهُوْنَ
“আর যদি তারা প্রতিশ্রুতির পর তাদের শপথ ভঙ্গ করে এবং বিদ্রƒপ করে তোমাদের দীন সম্পর্কে, তবে কুফ্রের নেতৃবৃন্দের সাথে যুদ্ধ করো। কারণ, এদের কোনো শপথ নেই যাতে তারা ফিরে আসে।”Ñসূরা তাওবাহ্ : ১২
ইসলামের উষালগ্নে যখন মুশরিকরা দল বেঁধে ইসলামের বিরোধিতা শুরু করল তখন কি মুসলমানরা অস্ত্রধারণ করেছিল অথবা আল্লাহ্র দীন প্রচার ও বিকাশ করার জন্য কি মুসলমানরা কোনো যুদ্ধ আরম্ভ করেছিল?
এটি প্রত্যেকেই জানে যে, ইসলামের প্রাথমিক যুগে মুসলমানদের পক্ষে কোনো দল বা জাতিকে আক্রমণ করা তো দূরের কথা, স্বয়ং মুসলমানরাই আগ্রাসনের শিকার ছিল।
আবার যদি ধরে নেয়া হয় যে, প্রাথমিক যুগের মুসলমানরা সত্য না বুঝেই ইসলাম গ্রহণ করেছিল, তবুও এ ধর্ম অনুসরণের জন্য পরবর্তী প্রজন্মের কোনো বাধ্যবাধকতা ছিল না। প্রকৃতপক্ষে গভীর জ্ঞানপূর্ণ ঐশী শিক্ষাÑ ভালবাসা, নিজের ইচ্ছা ও স্বাধীন পছন্দের মাধ্যমে তারা তাদের অন্তরের অন্তর্নিহিত বিশ্বাসের প্রকাশ ঘটিয়েছিল।
যদি আমরা ধরে নিই যে, দমন-পীড়ন ও হুমকির মাধ্যমে জনগণের ওপর ইসলামকে চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল, তা হলে এ অনুমান হতে প্রাপ্ত অনুসিদ্ধান্ত হলো ইসলাম যখন শক্তিশালী অবস্থানে ছিল তখন প্রত্যেকের জন্য ইসলাম গ্রহণ বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু আমরা দেখতে পাই যে, ইসলাম মানুষকে স্বাধীনতা দিয়েছে, হয় সে ইসলাম গ্রহণ করবে নতুবা নিজের ধর্ম বজায় রেখেই ইসলামী শাসন ও বিচারব্যবস্থা মেনে নেবে। ইসলাম যদি মত প্রদানের স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হতো তবে কখনোই দ্বিতীয় বিকল্প পথ অবলম্বনের সুযোগ দিত না। ইসলাম কখনোই শক্তিশালী অবস্থানের সুযোগ নিয়ে মানুষকে আল্লাহ্র ধর্ম গ্রহণে জবরদস্তি করে নি।
ধর্ম ও বিশ্বাস হলো অন্তরের বিষয়। অন্তর থেকে উৎসারিত না হলে কেবল নির্যাতন ও শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে কারো অন্তরে ধর্ম বা বিশ্বাস আনা সম্ভব নয়। জনগণের ধর্মবিশ্বাস ও ধ্যান-ধারণা পরিবর্তনের জন্য নির্দেশনা দান, শিক্ষাদান, কারণ উদ্ঘাটন ও যুক্তির আশ্রয় নেয়া হয়। মানুষের অন্তরে যে বিশ্বাস শিকড় গেড়ে থাকে কেবল শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে তা দূর করা যায় না।
ইসলাম এমন এক সময় সামরিক শক্তির আশ্রয় নিয়ে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেছে যখন জনগণ চিন্তার স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত ছিল এবং তাদেরকে সঠিক পথ বেছে নেয়ার সুযোগ দানে অস্বীকৃতি জানানো হয়েছিল। নির্যাতনকারী ও স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী স্বাধীনভাবে ধর্ম প্রচারে বাধা দিচ্ছিল; তাদেরকে পরাজিত করা এবং চিন্তার স্বাধীনতা অর্জন করার উদ্দেশ্যে ইসলাম যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল; এ উদ্দেশ্য অর্জিত হলে কেবল তখনই মানুষ মুক্ত পরিবেশে থাকতে পারবেÑ পরিপূর্ণ স্বাধীনতার সাথে নিজের জীবন চলার সঠিক পথ নির্বাচনে সক্ষম হবে। ইসলাম যদি এই ভূমিকা পালন না করত, তা হলে দোলনায় থাকা অবস্থাতেই সত্যকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হতো।
যে ধর্মের লক্ষ্য হলো মানুষের সুখ-শান্তি আনা এবং মানুষের সকল বিষয়ে সংস্কার আনার মাধ্যমে যে ধর্ম এ মহান লক্ষ্য অর্জন করতে চায়, আর যেসব ব্যক্তি এ ধর্মের সংস্পর্শে এসেছে ও এ ধর্মের শিক্ষাগ্রহণ ও আত্মস্থকরণের ক্ষমতা যাদের রয়েছে সেই ধর্ম ও সে সকল ব্যক্তির জন্য বাধাহীন শাসনক্ষমতাও থাকা আবশ্যক। উপরন্তু এটি পরিষ্কার যে, কেবল ক্ষমতা দিয়েই ক্ষমতাকে পরাজিত করা সম্ভব।
দুর্নীতির ধারক-বাহকদের বিরুদ্ধে লড়াই করে সত্যের আলো ও মহিমান্বিত গভীর জ্ঞানপূর্ণ চিন্তার বিকাশের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী শয়তানী শক্তিকে ধ্বংস করার জন্য অন্য কোনো পন্থা ছিল কি?
কুরাইশ নেতারা তাদের অবস্থানে অনড় ছিল। তারা জনগণের অজ্ঞতা ও দুর্বলতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে তাদের জান-মাল ও মান-মর্যাদার ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে চাইল, আর মূর্খতা হতে উৎসারিত যে রীতি-প্রথা তাদের বংশগত শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল তা চিরস্থায়ীভাবে টিকিয়ে রাখার জন্য তারা তৎপর হয়ে উঠল। তখন পর্যন্ত ব্যাপকতা লাভ না করা সত্ত্বেও ইসলাম ধর্মের প্রভাব তাদের টুটি চেপে ধরেছিল এবং ঔদ্ধত্য ও আত্মপূজার সিংহাসন থেকে তাদের টেনে নামানোর মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল, এ বিষয়টি তারা মেনে নিতে পারল না। তারা পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারল যে, ইসলামের প্রসার তাদের প্রাচীন, ক্ষয়িষ্ণু রীতি-প্রথা ও সমস্ত পার্থিব জাঁকজমককে পুরোপুরি ধ্বংস করবে। এ কারণে তারা সর্বস্ব নিয়ে এ ধর্ম ও এ ধর্মপ্রণীত আইনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হলো। এ সংগ্রামের উদ্দেশ্য ছিল তাদের পুরুষানুক্রমিক রীতি, ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত প্রভুত্ব ও শাসনক্ষমতা রক্ষা করা।
শুধু যুক্তি ও প্রমাণ দিয়ে এরূপ চিন্তাধারা ও প্রতিরোধ মোকাবিলা করা কি ইসলামের পক্ষে সম্ভব ছিল? যদি একদল লোক হাতে অস্ত্র তুলে নেয় এবং সর্বত্র জ্বালাও-পোড়াও করার মাধ্যমে সরকারকে অসুবিধায় ফেলার চেষ্টা করে, তবে সেই সরকারের পক্ষে কি সামরিক শক্তির আশ্রয় গ্রহণ ব্যতীত অন্য কোনো উপায়ে নিজেকে রক্ষা করা সম্ভব? আর কোনো উপায়ে কি এরূপ সরকার দুষ্কৃতকারীদের পরাজিত করতে পারে?
এ বিষয়ে কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :
وَ قَاتِلُوهُم حَتَّى لَا تَكُوْنَ فِتْنَةٌ وَ يَكُوْنَ الدِّيْنُ لله فَإِن انْتَهَوْا فَلَا عُدْوَانَ إِلَّا عَلَى الظَّالِمِيْنَ
“আর তাদের সাথে লড়াই কর যে পর্যন্ত না বিপর্যয়-বিশৃঙ্খলার অবসান হয় এবং আল্লাহ্র দীন প্রতিষ্ঠিত হয়। অতঃপর যদি তারা নিবৃত্ত হয়, তা হলে কারো প্রতি কোনো জবরদস্তি নেই।” Ñ সূরা বাকারাহ্ : ১৯৩
কেউই অস্বীকার করতে পারবে না যে, এরূপ পরিস্থিতিতে অস্ত্র তুলে নেয়াই সর্বশেষ উপায়। কেননা বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি ও সহিংসতার সমাপ্তি তখনই ঘটবে যখন তলোয়ারের আলো ঝলসে উঠবে এবং দুষ্কৃতকারীদের হাত ছিন্ন করা হবে।
ইসলাম যুদ্ধ ও সহিংসতার ধর্ম নয়। আর আল্লাহ্র রাসূল (সা.) এমন কোনো ব্যক্তি ছিলেন না যিনি অন্য উপায় থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধ করে শত্রুকে ধ্বংস করার অভিপ্রায় পোষণ করতেন।
ইসলাম গ্রহণের অপরাধে মক্কার মুসলমানরা যখন লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত হচ্ছিল সে সময় ওহী নাযিল হওয়ার মাধ্যমে তাদের ওপর দায়িত্ব অর্পিত হলো। এ দায়িত্ব ছিল সামরিক শক্তির মাধ্যমে নির্যাতিত জনগণকে নিষ্ঠুর স্বৈরাচারীদের হাত থেকে মুক্ত করা এবং সে অঞ্চল থেকে সর্বপ্রকার দাসত্ব ও শোষণ অপসারণ করা। কেবল এ পন্থার মাধ্যমেই ইসলামী সমাজের পক্ষে স্বাধীনভাবে বিকাশ লাভ করা সম্ভব ছিল।
কোরআন মজীদে এরশাদ হয়েছে :
وَ مَالَكُمْ لَا تُقَاتِلُوْنَ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ وَ الْمُسْتَضْعَفِيْنَ مِنَ الرِّجَالِ وَالنِّسَاء وَالْوِلْدَانِ الَّّذِيْنَ يَقُوْلُوْنَ رَبَّنَا أَخْرِجْنَا مِنْ هذِهِ الْقَرْيَةِ الظَّالِمِ أَهْلُهَا وَ اجْعَلْ لَنَا مِن لَدُنْكَ وَلِيَّا واجْعَلْ لَنَا مِنْ لَدُنْكَ نَصِيْراً
“আর তোমাদের কি হলো যে, তোমরা আল্লাহ্র পথে যুদ্ধ করছ না দুর্বল করে রাখা সেই পুরুষ, নারী ও শিশুদের পক্ষে, যারা বলে, হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদেরকে এ জনপদ থেকে বের করে নাও যার অধিবাসীরা অত্যাচারী। আর তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য পক্ষাবলম্বনকারী নির্ধারণ করে দাও এবং তোমার পক্ষ থেকে আমাদের জন্য সাহায্যকারী নির্ধারণ করে দাও।”Ñ সূরা নিসা : ৭৫
এখানে যে যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে তা সেই নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধ যারা আল্লাহ্র বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, যারা অবাধে মানুষের ওপর নির্যাতনে লিপ্ত ও আল্লাহ্র ধর্মের ন্যায়বিচার ও দীপ্তি থেকে যারা মানুষকে বঞ্চিত করে। ইতিহাসের অন্যান্য পরাক্রমশালীদের দ্বারা পরিচালিত যুদ্ধের সাথে এ যুদ্ধের তুলনা করলে অবশ্যই এ দাবি করা যাবে না যে, সব পরাক্রমশালী ন্যায়বিচার, সমান মানবাধিকার ও সমগ্র মানব জাতির সুখ-সমৃদ্ধির জন্য যুদ্ধ করেছিল।
কোনো জাতি যখন তাদের জীবন ও মর্যাদা রক্ষা করার চেষ্টা করত এবং অবমাননা মেনে নিতে অস্বীকার করত তখন কি এ বিশ্ববিজয়ী যোদ্ধারা সহিংসতার আশ্রয় নেয় নি এবং হত্যাযজ্ঞ ও লুণ্ঠনের আদেশ দেয় নি?
মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর বংশধরদের কি একই উদ্দেশ্য ছিল? তিনি কি নিজের খেয়াল-খুশি চরিতার্থ করার জন্য রক্তপাতে নিয়োজিত ছিলেন যার ফলে মানুষ তাঁর শক্তি ও প্রাচুর্যের সামনে মাথা নত করবে এবং তিনি তাঁর নিজের ব্যবহারের জন্য জনগণের সম্পত্তি দখল করবেন?
তাঁদের বিজয়সমূহ কি তাঁদের ঔদ্ধত্য ও আত্মপূজা বাড়িয়ে দিয়েছিল? তাঁরা কি স্বীয় রাজ্যকে সমৃদ্ধ করার জন্য গনীমতের মাল (যুদ্ধে বিজয়লব্ধ সম্পদ) ব্যবহার করেছিলেন? যাহোক কেউই ইসলামের নবীর ওপর এরূপ কোনো দোষারোপ করতে পারবে না।
মহানবী (সা.) ও তাঁর বংশধরদের পরিচালিত যুদ্ধ ছিল র্শিকের বিরুদ্ধে তাওহীদের পক্ষে পরিচালিত যুদ্ধ। এটি ছিল অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর সংগ্রাম। বিভ্রান্তির ধ্বংসসাধন এবং মূল্যবোধ ও ন্যায়বিচারের বিকাশ লাভের শেষ আশ্রয়। তিনি ছিলেন একজন সংস্কারক যিনি মানুষকে সত্যিকার জীবনের পথে নেয়ার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন এবং তাঁর মহান লক্ষ্যের দিকে অপ্রতিরোধ্যভাবে অগ্রসর হয়েছিলেন।
যখন মহানবী (সা.) প্রথম তাঁর অভিযানের কথা ঘোষণা করলেন তখন আরবের সকল গোত্র তাঁর শাসন মেনে নিতে এবং তাঁকে সর্বপ্রকার সুযোগ-সুবিধা দিতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু তিনি দৃঢ়তার সাথে তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। তাঁর অভিপ্রায় ছিল মানব জাতির সকলকে মূল্যবোধ ও ঐশী ঐক্যের পতাকাতলে একত্র করা, একটি যুক্তিনির্ভর ও দীনদার সরকার প্রতিষ্ঠা করা এবং মানুষকে চিরন্তন সৌভাগ্যের পথে পরিচালিত করা।
আজ চৌদ্দ শতকেরও অধিক কাল পরে রাসূল (সা.)-এর বিজয় পরিপূর্ণভাবে প্রতীয়মান। তাঁর ওপর নাযিল হওয়া কিতাবÑযাতে অন্য সব ধর্মগ্রন্থের মূলকথা অন্তর্ভুক্ত আছেÑমানুষের সৌভাগ্যের নিশ্চয়তা দিচ্ছে এবং এ মহান ব্যক্তিত্বের পবিত্র নাম কোটি কোটি মানুষের মুখে সম্মানের সাথে উচ্চারিত হচ্ছে। তাঁর নাম বিশ্বের সকল মিনার হতে মহান আধ্যাত্মিক গৌরবের সাথে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে এবং সবসময়ই এরূপ হতে থাকবে, আল্লাহ্র দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সকাল ও সন্ধ্যায় তাঁর নাম মানুষের অন্তরে প্রবেশ করবে এবং তাদের হৃদয়কে আলোকিত করবে। মহান আল্লাহ্ কোরআন মজীদে বলেছেন :
وَ رَفَعْنَا لَكَ ذِكْرَكَ
“আমি আপনার আলোচনাকে সমুন্নত করেছি।”Ñ সূরা আল ইনশিরাহ্ : ৪
পাদটীকা
১. এ প্রবন্ধটি ড. হামিদ আলগার কর্তৃক ফার্সী থেকে ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে এবং তেহরান থেকে প্রকাশিত আল তাওহীদ সাময়িকীর মুহররম-রবিউল আউয়াল, ১৪১১ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। প্রবন্ধটি ইংরেজি হতে বাংলায় অনূদিত হলো।
২. ইবনে হিশাম, সীরাতে রাসূলুল্লাহ্ (সা.), ১ম খণ্ড, পৃ. ১৬২।
৩. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৭৯।
৪. তাবারসী, তারিখুর রাসূল ওয়াল মূল্ক, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৩-৩৪।
৫. প্রাগুক্ত, ২য় খণ্ড, পৃ. ১১৩৮।
৬. ইবনে হিশাম, প্রাগুক্ত, ১ম খণ্ড।
৭. আল মাসউদী, মুরুজুয যাহাব, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪০০।
৮. তাবারসী, প্রাগুক্ত, ২য় খণ্ড, পৃ. ১১৭২; ইবনে আসীর, আল কামিল ২য় খণ্ড, পৃ. ৪০।
৯. সীরাতে হালাবী, পৃ. ৩৩৪।
১০. ইবনে হিশাম, প্রাগুক্ত, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৩৮।
১১. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৭৮।
১২. আল ইয়াকুবী, তারিখ, ২য় খণ্ড, পৃ. ১৭।
১৩. তাবারসী, মাজমাউল বায়ান, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৮৭।
১৪. সূরা আল মুদ্দাস্সির : ১-৪।
১৫. ইবনে হিশাম, প্রাগুক্ত, ১ম খণ্ড, পৃ. ৪৮০।
১৬. নাহজুল বালাগাহ্, (ফাইজুল ইসলাম কর্তৃক সম্পাদিত), পৃ. ৮৩।
১৭. জওহরলাল নেহেরু, Glimpses of World History ১৯৪৮, পৃ. ১৪২।

Leave A Reply

Your email address will not be published.