অদৃষ্টবাদী চিন্তাধারার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

0 658

অদৃষ্টবাদী চিন্তাধারার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

স্বাভাবিকভাবেই মানুষের বিচারবুদ্ধি যা অনুভব ও লক্ষ্য করে তা হচ্ছে এই যে, সে একটি স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মশক্তি সম্পন্ন প্রাণী। যদিও সে পুরোপুরি স্বাধীন নয়; তার কর্মের স্বাধীনতা বহু পার্থিব ও অপার্থিব উপাদানের দ্বারা বহুলাংশে নিয়ন্ত্রিত ও সীমাবদ্ধ, তবে সে স্বাধীনতাবিহীন যন্ত্রতুল্য নয়। কিন্তু মানবজাতির ইতিহাসে সব সময়ই যালেম-শোষক ও স্বৈরাচারী শ্রেণী সাধারণ মানুষকে তাদের অধিকার আদায়ের প্রচেষ্টা থেকে বিরত রাখার জন্য অদৃষ্টবাদী চিন্তাধারা ও ধ্যানধারণা প্রচার করেছে যা তারা নিজেরাই বিশ্বাস করতো না।
তারা নিজেরা কিন্তু মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতায় বিশ্বাস করতো। এ কারণে তারা কখনোই হাত-পা ছেড়ে দিয়ে বসে থাকতো না। বরং তারা সব সময়ই অত্যন্ত কর্মতৎপর থাকতো। নিজেদের বৈধ-অবৈধ স্বার্থ হাসিল ও সংরক্ষণ, অন্যদের বৈধ অধিকারের বিনাশ সাধন এবং অন্যায় বিরোধী যে কোনো চেষ্টা-সংগ্রামকে প্রতিরোধে, বরং টুটি টিপে হত্যা করার কাজে তারা খুবই সক্রিয় থাকতো। তবে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতায় তাদের সে বিশ্বাস ছিলো সৃষ্টিকর্তার নিকট জবাবদিহিতার অনুভূতি শূন্য। এমনকি তাদের অধিকাংশই ছিলো এক ও অদ্বিতীয় সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব ও পরকালীন জীবন সম্বন্ধে উদাসীন। অর্থাৎ আদৌ কোনো সৃষ্টিকর্তা আছেন কি নেই; থাকলে এক, নাকি একাধিক Ñ কোন্টি হওয়া সম্ভব এবং মৃত্যুর পরে অন্য কোনো জীবন আছে কি নেই, থাকলে সে জীবনে বর্তমান জীবনের জন্য জবাবদিহি করতে হবে কিনা Ñ এ সম্বন্ধে চিন্তা-ভাবনা ও বিচার-বিশ্লেষণ করতে এবং বিচারবুদ্ধি (‘আক্বল্)-এর আলোকে কোনো চূড়ান্ত ফয়সালায় উপনীত হতে তারা মোটেই প্রস্তুত ছিলো না।

অবশ্য তাদের পক্ষে অতিপ্রাকৃতিক শক্তির অস্তিত্ব পুরোপুরি অস্বীকার করা বা মানুষকে তা অস্বীকার করতে বাধ্য করানো সম্ভব ছিলো না। তাছাড়া সাধারণ মানুষকে অদৃষ্টবাদে বিশ্বাসী করে তোলা তাদের কায়েমী স্বার্থের জন্য অপরিহার্য ছিলো এবং অতিপ্রাকৃতিক শক্তির অস্তিত্বের অস্বীকৃতি জনসাধারণকে অদৃষ্টবাদে বিশ্বাসী রাখার জন্য অনুকূল হতো না। তাই তারা (শাসকগোষ্ঠী Ñ যারা ধনসম্পদেরও একচ্ছত্র মালিক ছিলো) স্বার্থান্বেষী দুনিয়াপূজারী যাজক-পুরোহিতদের সহায়তায় কল্পিত দেবদেবীর অস্তিত্ব প্রচার করে এবং তাদেরকেই মানুষের ভাগ্যনিয়ন্তা বলে দাবী করে।
তাদের প্রচারিত এ ধরনের চিন্তা-বিশ্বাসে আদি স্রষ্টার বিষয়টি হয় অনুপস্থিত থাকতো, নয়তো তাঁর অস্তিত্ব স্বীকার করে হলেও মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের সর্বময় ক্ষমতা তাঁর জন্য কল্পিত সন্তান-সন্ততিরূপ দেব-দেবীর বলে দাবী করা হতো। অন্যদিকে শাসকগোষ্ঠী প্রায়শঃই নিজেদেরকে তাদের কল্পিত তথাকথিত মহাশক্তিধর কোনো না কোনো দেবদেবীর বংশধর বলে দাবী করতো এবং আত্মবিক্রিত যাজক-পুরোহিতরা তাদের এ দাবীকে সত্য বলে প্রচার করতো। তারা দাবী করতো যে, দেব-দেবীদের অনুগ্রহেই তাদের বংশধর শাসকগোষ্ঠী শক্তি-ক্ষমতা ও ধনসম্পদের অধিকারী হয়েছে এবং দেব-দেবীদের ইচ্ছায়ই সাধারণ মানুষ তাদের অধীনস্থ দাস ও প্রজা হয়ে জন্মগ্রহণ করেছে। অতএব, এটাই তাদের ভাগ্যলিপি; এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে দেব-দেবীদের আক্রোশের শিকার হয়ে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে।
শাসকগোষ্ঠী স্বয়ং অদৃষ্টবাদে বিশ্বাস করতো না বলেই স্বীয় শক্তি-ক্ষমতা রক্ষা ও সম্প্রসারণের জন্য ভাগ্যের বা কল্পিত দেব-দেবীর অলৌকিক ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে বসে থাকতো না, বরং নিজেরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করতো। তারা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের রাজত্ব দখল করার বা তাদের আক্রমণ থেকে স্বীয় রাজত্ব রক্ষা করার চেষ্টা করতো। কিন্তু সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে তাদের ওপর নির্বিঘেœ শাসনকার্য চালাবার লক্ষ্যে তারা বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠীকে বিভিন্ন দেব-দেবীর বংশধর বলে এবং স্বীয় কুলদেবতাকে অন্যান্য শাসকগোষ্ঠীর কুলদেবতার চেয়ে অধিকতর শক্তিশালী বলে দাবী করতো। আর যুদ্ধে বিজয়ী পক্ষ সাধারণ জনগণকে এটাই বিশ্বাস করাতো যে, তাদের কুলদেবতা অধিকতর শক্তিশালী বিধায়ই তারা বিজয়ী হতে পেরেছে।
এর পাশাপাশি নাস্তিক লোকেরা মানুষকে নিরঙ্কুশ ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীন কর্মক্ষমতার অধিকারী বলে দাবী করতো। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা ও পরকালীন জীবনের অস্তিত্বে অবিশ্বাসের কারণে তাদের এ চিন্তাধারার পরিণতি জীবনকে উদ্দেশ্যহীন ও অর্থহীন গণ্যকরণ এবং হতাশাবাদ ছাড়া আর কিছুই ছিলো না এবং নয়।
কিন্তু যুগে যুগে নবী-রাসূলগণ (আঃ) আবির্ভূত হয়ে এ উভয় প্রান্তিক মতের অসারতা তুলে ধরেন এবং মানুষের সামনে এ ব্যাপারে ভারসাম্যপূর্ণ সঠিক ধারণা উপস্থাপন করেন Ñ যা সুস্থ বিচারবুদ্ধির কাছেও গ্রহণযোগ্য। তাঁরা মানুষকে নিয়তির হাতের অসহায় পুতুল বলে গণ্য করেন নি, বরং স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও স্বাধীন কর্মক্ষমতার অধিকারী বলে গণ্য করেছেন এবং তাদেরকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও সঠিক কর্ম সম্পাদনের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁরা লোকদেরকে সতর্ক করে দিয়েছেন যে, (যেহেতু তারা স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্ম সম্পাদনের এখতিয়ারের অধিকারী সেহেতু) তাদেরকে স্বীয় চিন্তা, কথা ও আচরণের হিসাব দিতে হবে।
তবে নবী-রাসূলগণ (আঃ) সেই সাথে তাদেরকে এ-ও জানিয়ে দিয়েছেন যে, মানুষ ও বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা তাঁর সৃষ্ট মানুষ ও এ বিশ্বজগতের ব্যাপারে উদাসীন নন। তিনি এসব কিছুকে অর্থহীনভাবে খেলাচ্ছলে সৃষ্টি করেন নি। তাই তিনি সব কিছুর প্রতি এমনভাবে দৃষ্টি রাখছেন যাতে তাঁর সৃষ্টির লক্ষ্য অবশ্যই বাস্তবায়িত হয়; মানুষ বা অন্য কোনো সৃষ্টি স্বীয় স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মের এখতিয়ারের অপব্যবহার করে সৃষ্টির লক্ষ্য বাস্তবায়ন ব্যাহত করতে উদ্যত হলে কিছুতেই তিনি তাদেরকে সে সুযোগ দেবেন না। একইভাবে তিনি ব্যক্তিমানুষদের ব্যাপারেও অমনোযোগী নন।
মুসলিম সমাজে অদৃষ্টবাদ ও নিরঙ্কুশ এখ্তিয়ারবাদ
হযরত আদম (আঃ) থেকে শুরু করে রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) পর্যন্ত সকল নবী-রাসূলই (আঃ) মানুষকে আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পিত হয়ে চলার দিকে আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁরা মানুষের নিকট প্রান্তিকতা থেকে মুক্ত ভারসাম্যপূর্ণ চিন্তা ও আচরণবিধি উপস্থাপন করেন ও তাদেরকে তা শিক্ষা দেন এবং পরিস্থিতি অনুকূল হলে তা পূর্ণ মাত্রায় বাস্তবায়িত করেন। এ ধারাবাহিকতায় সর্বশেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর মাধ্যমে আল্লাহ্র দেয়া জীবনবিধান ইসলাম পরিপূর্ণ ও চূড়ান্তরূপে নাযিল হয় এবং এ জীবনবিধান সহ মানুষের জন্য আল্লাহ্ তা‘আলার পরিপূর্ণ বাণী কোরআন মজীদকে স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলাই সামান্যতম বিকৃতি থেকেও রক্ষার নিশ্চিত ব্যবস্থা করেন (সূরাহ্ আল্-হিজ্র্ ঃ ৯)।
কোরআন মজীদ মানুষের গড়া অন্ধ আকিদা-বিশ্বাস ভিত্তিক ধর্ম ও মতাদর্শ সমূহের কঠোর সমালোচনা করেছে এবং তাদেরকে বিচারবুদ্ধি (‘আক্বল্) প্রয়োগের জন্য আহ্বান জানিয়েছে। কোরআন মজীদে বার বার বলা হয়েছে ঃ افلا تعقلون (অতঃপর তোমরা কি বিচারবুদ্ধি কাজে লাগাবে না?) আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন ঃ
ان شر الدوابّ عند الله الصم البکم الذين لا يعقلون.
“নিঃসন্দেহে আল্লাহ্র নিকট নিকৃষ্টতম জন্তু হচ্ছে সেই বধির-বোবার দল যারা বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে না।” (সূরাহ্ ৮ ¬Ñ আল-আন্ফাল্ ঃ ২২)
অবশ্য কোরআন মজীদ ‘আক্বলের অগম্য ক্ষেত্রসমূহের জন্য এবং ‘আক্বলের গম্য ক্ষেত্রসমূহেও তাকে ভুল-ভ্রান্তি থেকে রক্ষা ও তাকে সহায়তা করার জন্য প্রয়োজনীয় পথনির্দেশ দিয়েছে। আর হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) ছিলেন জীবন্ত কোরআন; তিনি কোরআন মজীদের প্রচার করেছেন, লোকদেরকে সেদিকে আহ্বান করেছেন, তা শিক্ষা দিয়েছেন, প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে তার ব্যাখ্যা পেশ করেছেন এবং স্বীয় জীবনে ও সমাজে তা বাস্তবায়িত করেছেন।
হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) যে ভারসাম্যপূর্ণ চিন্তা ও আচরণ শিক্ষা দিয়ে যান তা তাঁর ওফাতের পরে খোলাফায়ে রাশেদীনের (রাঃ) যুগেও পুরোপুরি অব্যাহত থাকে। তাই এ যুগে মুসলিম সমাজে অদৃষ্টবাদ ও নিরঙ্কুশ এখতিয়ারবাদের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগের পরে ধীরে ধীরে অদৃষ্টবাদী চিন্তাধারা গড়ে উঠতে থাকে। এর আভাস পাওয়া যায় ইয়াযীদের এতদসংক্রান্ত যুক্তি উপস্থাপনের মাঝে। হযরত ইমাম হোসেন (রাঃ)-এর বোন হযরত যায়নাব (রাঃ)-এর সাথে বিতর্ককালে ইয়াযীদ তাঁকে বলেছিলো ঃ “আমরাই সত্যের ওপরে আছি; আল্লাহ্ তোমার পিতার নিকট থেকে রাজত্ব কেড়ে নিয়ে আমার পিতাকে দিয়েছেন এবং হোসেনকে লাঞ্ছিত ও আমাকে সম্মানিত করেছেন।” তার দাবী ছিলো এবং তার অনুগতরা প্রচার করতো যে, আল্লাহ্র ইচ্ছা না হলে ইয়াযীদ খেলাফতে অধিষ্ঠিত হতে পারতো না।
অবশ্য দ্বীনী বিষয়ে মানুষ যাদের কথা মেনে চলতো এবং যাদের নিকট থেকে দ্বীনী শিক্ষা গ্রহণ করতো তাঁদের মধ্যে তখনো অদৃষ্টবাদিতা প্রবেশ করে নি। কিন্তু সাধারণ জনগণের মধ্যে হতাশা ও নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতির কারণে অদৃষ্টবাদিতার প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। পরবর্তী কালে দ্বীনী চিন্তাবিদগণের কারো কারো মধ্যে এর প্রভাব কিছুটা হলেও প্রবেশ করতে থাকে। এ কারণেই দ্বীনী ব্যক্তিত্ববর্গের মধ্যে কেউ কেউ রাজনৈতিক বিষয়াদিকে সযতেœ এড়িয়ে চলার পথ বেছে নেন। অর্থাৎ দ্বীনী ব্যক্তিত্ববর্গের কতক যেখানে উমাইয়্যাহ্ বংশের শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং একাংশ অহিংস অসহযোগ নীতি অনুসরণ করে স্বাধীনভাবে দ্বীনী জ্ঞান-গবেষণা ও জনগণকে শিক্ষাদানের কাজে আত্মনিয়োগ করেন, তখন এই তৃতীয় অংশটি উক্ত উভয় পন্থা পরিহার করে ‘অরাজনৈতিক’ দ্বীনী চর্চায় মশগুল হন।
জাবারিয়্যাহ্ ও মু‘তাযিলী চিন্তাধারার আবির্ভাব
মুসলমানদের মধ্যকার ‘অরাজনৈতিক’ দ্বীনী চর্চায় মশগুল ধারার অনুসারীদের মধ্যে পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে অদৃষ্টবাদিতা একটি মতাদর্শরূপে গড়ে ওঠে যা ‘জাবারিয়্যাহ্’ মতবাদ নামে পরিচিত। এ ধারার সর্বপ্রথম বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন হযরত হাসান বছরী (রহ্ঃ) (২১-১১০ হিজরী)। অবশ্য তাঁর সময় অদষ্টবাদী চিন্তা-বিশ্বাসের ব্যাপক বিস্তার ঘটে নি। পরবর্তী কালে আবুল হাসান আশ্‘আরীর (২৬০-৩২৪ হিজরী) মাধ্যমে অদৃষ্টবাদী চিন্তাধারার ব্যাপক বিস্তার ঘটে।
হাসান বছরীর অন্যতম শিষ্য ওয়াছেল্ বিন্ ‘আত্বা (৮০-১৩১ হিজরী) তাঁর সাথে মতপার্থক্য করে তাঁর কাছ থেকে আলাদা হয়ে যান এবং নিজস্ব চিন্তাধারা প্রচার করতে শুরু করেন। তিনি কোরআন ও হাদীছের যে সব উক্তির বাহ্যিক বা আক্ষরিক তাৎপর্য বিচারবুদ্ধির রায়ের সাথে খাপ খায় না বলে মনে করেন সে সব উক্তিকে ভাবার্থক বা রূপকার্থক বলে ব্যাখ্যা করেন। এর ভিত্তিতেই তিনি মানুষের পরিপূর্ণ স্বাধীন কর্মক্ষমতার প্রবক্তা হয়ে ওঠেন। এ চিন্তাধারা অনুযায়ী, আল্লাহ্ তা‘আলা মানুষের কাজকর্মে মোটেই হস্তক্ষেপ করেন না।
ওয়াছেল্ বিন্ ‘আত্বা তাঁর শিক্ষক হাসান বছরী থেকে ও হাসান বছরীর অন্যান্য শিষ্য থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ায় তাঁকে “মু‘তাযিলী” (বিচ্ছিন্ন হয়ে এক কোণায় চলে যাওয়া) বলে আখ্যায়িত করা হয়। এ থেকে তাঁর চিন্তাধারার অনুসারীদেরকেও “মু‘তাযিলী” নামে অভিহিত করা হয়।
ওয়াছেল্ বিন্ ‘আত্বা ও হাসান বছরীর অনুসারীদের মধ্যে একদিকে অদৃষ্টবাদ বনাম নিরঙ্কুশ এখতিয়ারবাদ নিয়ে, অন্যদিকে কোরআন মজীদের অর্থগ্রহণের পদ্ধতি নিয়ে তীব্র বিতর্ক দানা বেঁধে ওঠে। কারণ, মু‘তাযিলীদের মতের বিপরীতে, হাসান বছরীর অনুসারীরা কোরআন-হাদীছের একটিমাত্র বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করতেন। এমনকি তাঁরা কোরআন মজীদের ‘মুতাশাবেহ্’ আয়াতেরও বাহ্যিক ও আক্ষরিক তাৎপর্যের প্রবক্তা ছিলেন। উদাহরণ স্বরূপ ঃ তাঁরা আল্লাহ্ তা‘আলার হাত থাকা এবং তাঁর ‘র্আশে অধিষ্ঠান সংক্রান্ত আয়াতের আক্ষরিক তাৎপর্য গ্রহণ করতেন।
এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে যে, ওয়াছেল্ বিন্ ‘আত্বা (৮০-১৩১ হিজরী) এবং ইসলামের ইতিহাসের তিনজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ দ্বীনী ইমাম ও মনীষী হযরত ইমাম জাফর ছাদেক (রহ্ঃ) (৮৩-১৪৮ হিজরী), হযরত ইমাম আবু হানীফা (রহ্ঃ) (৮০-১৫০ হিজরী) ও হযরত ইমাম মালেক (রহ্ঃ) (৯৩-১৭৯ হিজরী) ছিলেন সমসাময়িক। আলোচ্য বিষয়ে এ তিনজন ইমামের চিন্তাধারা ছিলো ভারসাম্যপূর্ণ। অর্থাৎ তাঁরা না জাবারিয়্যাহ্ ছিলেন, না মু‘তাযিলী ছিলেন।
পরবর্তী কালে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে হানাফী মাযহাবের ব্যাপক বিস্তার ঘটে। কিন্তু হযরত ইমাম আবু হানীফা (রহ্ঃ)-এর সমপর্যায়ের দ্বীনী ইমামের অনুপস্থিতির কারণে এবং আবুল হাসান আশ্‘আরী কর্তৃক মু‘তাযিলী চিন্তাধারার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও জাবারিয়্যাহ্ চিন্তাধারা গ্রহণ করে তার প্রচার-প্রসারে সর্বাত্মকভাবে আত্মনিয়োগের ফলে তাঁর ও তাঁর চিন্তাধারা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ফলে হানাফী মাযহাবের অনুসারীরা অত্যন্ত দ্রুত গতিতে জাবারিয়্যাহ্ চিন্তাধারার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পড়ে। এভাবে এক সময় অ-হানাফী জাবারিয়্যাহ্ ‘আক্বিদাহ্ (অদৃষ্টবাদী চিন্তাধারা) বাহ্যতঃ হানাফী মাযহাবের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়। অন্যান্য মাযহাব, বিশেষতঃ হাম্বালী মাযহাবের অনুসারীরাও এ চিন্তাধারার দ্বারা কমবেশী প্রভাবিত হয়ে পড়ে।
যেহেতু জাবারিয়্যাহ্ চিন্তাধারার অনুসারীরা ‘আক্বায়েদের ক্ষেত্রে ‘আক্বল্ (বিচারবুদ্ধি) প্রয়োগের বিরোধী ছিলেন এবং এর বিপরীতে মু‘তাযিলীরা ‘আক্বল্-এর ব্যবহারের ওপর খুবই গুরুত্ব আরোপ করতেন, আর মানুষ স্বভাবতঃই যে কোনো বিষয়ে কমবেশী বিচারবুদ্ধি (‘আক্বল্) প্রয়োগ করে এবং কোরআন মজীদেও ‘আক্বলের প্রয়োগের ওপর তাকিদ করা হয়েছে, যারা ‘আক্বল্ কাজে লাগায় না তাদের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে, সেহেতু মু‘তাযিলী চিন্তাধারার উদ্ভব হওয়ার পর থেকেই এ চিন্তাধারার অনুসারীদের মোকাবিলায় জাবারিয়্যাহ্ চিন্তাধারার অনুসারীরা ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়তে থাকে। কিন্তু আবুল হাসান আশ্‘আরী কর্তৃক মু‘তাযিলী চিন্তাধারার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও জাবারিয়্যাহ্ চিন্তাধারা গ্রহণের ফলে স্রোতের গতি বিপরীতমুখী হয়ে যায়।
এখানে প্রণিধানযোগ্য বিষয় এই যে, জাবারিয়্যাহ্ চিন্তাধারা মূলগতভাবে বিচারবুদ্ধির প্রয়োগ তথা যুক্তি প্রয়োগের বিরোধী হবার দাবী করলেও বিভিন্ন যুক্তির আশ্রয় নিয়ে তারা মু‘তাযিলী চিন্তাধারা খণ্ডন ও জাবারিয়্যাহ্ চিন্তাধারার যথার্থতা প্রমাণের সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়। কিন্তু ঐতিহাসিক পরিহাস এই যে, তাদের চিন্তাধারার মধ্যকার এবং চিন্তা ও আচরণের মধ্যকার এ স্ববিরোধিতার প্রতি যথাযথভাবে দৃষ্টি প্রদান ও দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় নি।
জাবারিয়্যাহ্ চিন্তাধারায় নতুন প্রাণ সঞ্চার
জাবারিয়্যাহ্ চিন্তাধারায় নতুন প্রাণ সঞ্চারকারী আবুল হাসান আশ্‘আরী (২৬০ Ñ ৩২৪ হিজরী) ছিলেন সমকালীন মু‘তাযিলী শেখ আবূ আলী জুবাঈ-র (ওফাত ৩০৩ হিজরী) শিষ্য। আবুল হাসান আশ্‘আরী কর্তৃক মু‘তাযিলী চিন্তাধারার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও জাবারিয়্যাহ্ চিন্তাধারা গ্রহণের ঘটনাটি নিুরূপ ঃ
আবুল হাসান একদিন তাঁর শিক্ষক আবূ আলী জুবাঈকে জিজ্ঞেস করলেন ঃ “বান্দাহ্র কল্যাণ সাধন করা আল্লাহর জন্য অপরিহার্য কিনা?” আবূ আলী বললেন ঃ “হ্যা।” আবুল হাসান বললেন ঃ “কাফেরের সন্তান সেই তিনটি শিশু সম্বন্ধে আপনার অভিমত কী যাদের একজন বালেগ হবার পূর্বেই আল্লাহ্ তাকে মৃত্যু দিলেন এবং অপর দু’জনকে জীবিত রাখলেন, অতঃপর তাদের একজন মুসলমান ও আল্লাহ্র হুকুমের অনুগত হলো, আর অপর জন কাফের হলো ও গুনাহ্গার হলো? কিয়ামতের দিন এ তিন ভাইয়ের অবস্থা ও তাদের সম্পর্কে হুকুম কী হবে?”
জবাবে আবূ আলী বললেন ঃ “যে মুসলমান হলো সে বেহেশতে যাবে, আর যে কাফের হলো সে দোযখে যাবে এবং যে বালেগ হবার আগে মারা গেলো সে না বেহেশতে যাবে, না দোযখে যাবে।”
তখন আবূল হাসান বললেন ঃ “যে বালেগ হওয়ার আগেই মারা গেলো সে যদি বলে ঃ ‘হে আল্লাহ্! আপনি যদি আমাকে জীবিত রাখতেন তাহলে আমি আপনার প্রতি ঈমান আনয়ন করতাম এবং আজ বেহেশতে গিয়ে আপনার বেহেশতী নে‘আমতের অধিকারী হতাম।’ তখন আল্লাহ্ তাকে কী জবাব দেবেন?”
আবূ আলী বললেন ঃ “সে তো জানে না যে, হয়তো জীবিত থাকলে সে কাফের হতো এবং জাহান্নামে যেতো। আল্লাহ্ তা‘আলা জানেন যে, এতেই তার কল্যাণ নিহিত যে, সে বালেগ হওয়ার আগেই মারা যাবে।”
তখন আবূল হাসান বললেন ঃ “আল্লাহ্ তা‘আলা এ তিন জনের মধ্য থেকে এক জনের ক্ষেত্রে কেন কল্যাণ নিশ্চিত করলেন? যে কাফের হয়েছে তার ক্ষেত্রে কেন কল্যাণ নিশ্চিত করলেন না?”
আবূ আলী এ কথার কোনো জবাব দিতে পারলেন না। তখন আবূল হাসান তাঁর নিকট থেকে চলে গেলেন এবং বললেন ঃ “আল্লাহ্ তা‘আলার হুকুম (বা কাজ)কে মু‘তাযিলী চিন্তাধারার সাহায্যে পরিমাপ (বিশ্লেষণ) করা যাবে Ñ তা থেকে তিনি উর্ধে।” অতঃপর তিনি মু‘তাযিলী চিন্তাধারা খণ্ডনে আত্মনিয়োগ করলেন।

(চলবে)

Leave A Reply

Your email address will not be published.