কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে অদৃষ্টবাদ

0 584

কোরআন মজীদের দৃষ্টিতে অদৃষ্টবাদ

কোরআন মজীদে এমন কতক আয়াত রয়েছে যা থেকে মনে হতে পারে যে, আল্লাহ্ তা‘আলাই সব কিছু করেন। অদৃষ্টবাদীরা তাদের দাবীর সপক্ষে এসব আয়াতকে দলীল হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করেন। অন্যদিকে কোরআন মজীদে এমন আয়াতের সংখ্যা অনেক যা থেকে মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতার স্বাধীনতা প্রমাণিত হয়। নিরঙ্কুশ এখতিয়ারবাদে বিশ্বাসীরা এসব আয়াতকে তাদের মতের সপক্ষে দলীল হিসেবে ব্যবহার করেন। এ উভয় ধরনের ভূমিকাই একদেশদর্শী। কারণ, উভয় পক্ষই নিজ নিজ মতের সপক্ষে উপস্থাপনযোগ্য আয়াতগুলোকে দলীল হিসেবে উপস্থাপন করেন এবং অপর মতের সপক্ষে উপস্থাপনযোগ্য আয়াতগুলোকে এড়িয়ে যান। এভাবে তাঁরা পরস্পর বিরোধী দুই প্রান্তিক অবস্থান গ্রহণ করেছেন। অথচ কোরআন মজীদের তাৎপর্য গ্রহণ ও ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে অন্যতম সর্বসম্মত মূলনীতি হচ্ছে এই যে, একই বিষয়ের বিভিন্ন আয়াতকে পরস্পরের পরিপূরক বা সম্পূরক হিসেবে গণ্য করে অর্থ গ্রহণ বা ব্যাখ্যা করতে হবে।

এখানে আমরা দৃশ্যতঃ অদৃষ্টবাদ নির্দেশক, ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতার স্বাধীনতা নির্দেশক এবং শর্তাধীন সম্ভাবনা জ্ঞাপক আয়াত সমূহ থেকে দৃষ্টান্ত স্বরূপ কতক আয়াত উদ্ধৃত করবো এবং উপরোক্ত মূলনীতির আলোকে অর্থাৎ একই বিষয়ের আয়াত সমূহ পরস্পরের পরিপূরক বা সম্পূরক Ñ এ মূলনীতির আলোকে আলোচনা করে উপসংহারে উপনীত হবো।

 

দৃশ্যতঃ অদৃষ্টবাদ নির্দেশক আয়াত

আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন ঃ

و ما من دابة فی الارض الا علی الله رزقها و يعلم مستقرها و مستودعها. کل فی کتاب مبين.

(১) “ধরণীর বুকে এমন কোনো বিচরণশীল নেই যার রিয্কের দায়িত্ব আল্লাহর ওপর নয়, আর তিনি তার অবস্থানস্থল ও তার (সাময়িক) বিশ্রামস্থল সম্বন্ধে অবগত; প্রতিটি (বিষয়)ই এ সুবর্ণনাকারী গ্রন্থে নিহিত রয়েছে।” (সূরাহ্ হূদ ঃ ৬)

অনেকে এ আয়াতে উল্লিখিত مستودعها (তার সাময়িক বিশ্রামস্থল Ñ যেখানে বিশ্রামের পর পুনরায় চারণ বা পথচলা শুরু করে) কথাটির অর্থ গ্রহণ করেছেন “তার শেষ বিশ্রামস্থল” বা “যেখানে তার মৃত্যু হবে বা কবর হবে”। এর ভিত্তিতে তাঁদের যুক্তি হচ্ছে, যেহেতু আল্লাহ্ তা‘আলা প্রাণীর মৃত্যুস্থল সম্বন্ধে আগেই জানেন এবং তা কিতাবুম্ মুবীনে লিপিবদ্ধ আছে সেহেতু নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ তা‘আলা তা পূর্ব থেকে নির্ধারণ করে রেখেছেন।

প্রায় অনুরূপ অর্থজ্ঞাপক আরেকটি আয়াত ঃ

و عنده مفاتيح الغيب لا يعلمها الا هو. و يعلم ما فی البر و البحر. و ما تسقط من ورقة الا يعلمها و لا حبة فی ظلمات الارض و لا رطب و لا يابس الا فی کتاب مبين.

(২) “আর তাঁর (আল্লাহ্ তা‘আলার) নিকট রয়েছে ‘গায়ব্’-এর চাবি সমূহ যা তিনি ছাড়া অন্য কেউ অবগত নয়। আর তিনি জানেন যা রয়েছে স্থলে ও জলে। আর এমন কোনো পাতাও ঝরে পড়ে না যা তিনি অবগত নন; আর না মৃত্তিকার অন্ধকারে কোনো শস্যদানা, না কোনো আর্দ্র বস্তু, না কোনো শুষ্ক বস্তু আছে যা সুবর্ণনাকারী গ্রন্থে নিহিত নেই।” (সূরাহ্ আল্-আন্‘আম্ ঃ ৫৯)

يعلم ما بين ايدهم و ما خلفهم.

(৩) “তিনি জানেন যা আছে তাদের সামনে (বর্তমানে ও ভবিষ্যতে) এবং যা আছে তাদের পিছনে (অতীতে)।” (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ ঃ ২৫৫)

له ملک السموات و الارض. يحی و يميت.

(৪) “আসমান সমূহ ও ধরণীর রাজত্ব তাঁর (আল্লাহ্ তা‘আলার); তিনি প্রাণদান করেন এবং তিনিই মৃত্যু প্রদান করেন।” (সূরাহ্ আল্-হাদীদ ঃ ২)الله يبسط الرزق لمن يشاء من عباده و يقدر له.

(৫) “আল্লাহ্ তাঁর বান্দাহ্দের মধ্য থেকে যার জন্য চান রিয্ক্ প্রসারিত করে দেন এবং তাকে পরিমাণ করে দেন।” (সূরাহ্ আল্-‘আন্কাবুত্ ঃ ৬২)ما اصاب من مصيبة فی الارض و لا فی انفسکم الا فی کتاب من قبل ان نبرأها. ان ذالک علی الله يسير.

(৬) “ধরণীর বুকে এবং তোমাদের সত্তার মধ্যে এতদ্ব্যতীত কোনো বিপদ আপতিত হয় না যা আমরা পূর্বেই তা কিতাবে লিপিবদ্ধ করে রাখি নি। নিঃসন্দেহে আল্লাহর জন্যে তা সহজ।” (সূরাহ্ আল্-হাদীদ ঃ ২২)

و اذا اراد الله بقوم سوء فلا مرد له.

(৭) “আর আল্লাহ্ যখন কোনো জনগোষ্ঠীর অকল্যাণ চান তখন আর তার প্রতিরোধকারী থাকে না।” (সূরাহ্ র্আ-রা‘দ্ ঃ ১১)لکل امة اجل. اذا جاء اجلهم فلا يستأخرون ساعة و لا يستقدمون.

(৮) “প্রতিটি উম্মাহ্র জন্যে একটি শেষ সময় (আজাল্) রয়েছে; যখন তাদের শেষ সময় এসে যাবে তখন তারা না এক দণ্ড পিছিয়ে যেতে পারবে, না এগিয়ে আসতে পারবে।” (সূরাহ্ ইউনুস ঃ ৪৯)

و ما تشاءون الا ان يشاء الله.

(৯) “আর তোমরা ইচ্ছা করছো না (বা করবে না) যদি না আল্লাহ্ ইচ্ছা করেন।” (সূরাহ্ আদ্-দাহর ঃ ৩০)

يدخل من يشاء فی رحمته.

(১০) “তিনি যাকে চান (বা চাইবেন) স্বীয় রহমতে প্রবেশ করান (বা করাবেন)।” (সূরাহ্ আদ্-দাহর ঃ ৩০)

فلم تقتلوهم و لکن الله قتلهم و ما رميت اذ رميت و لکن الله رمی.

(১১) “অতএব, (হে মুসলমানগণ!) তোমরা তাদেরকে হত্যা করো নি, বরং আল্লাহ্ই তাদেরকে হত্যা করেছেন। আর (হে রাসূল!) আপনি যখন নিক্ষেপ করলেন তখন আপনি নিক্ষেপ করেননি, বরং আল্লাহ্ই নিক্ষেপ করেছেন।” (সূরাহ্ আল্-আন্ফাল্ ঃ ১৭)

من يضلل الله فما له من هاد.

(১২) “আর আল্লাহ্ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তার জন্য কোনো পথপ্রদর্শক নেই।” (সূরাহ্ আয্-যুমার ঃ ২৩)

ختم الله علی قلوبهم و علی سمعهم. و علی ابصارهم غشاوة.

(১৩) “আল্লাহ্ তাদের অন্তর সমূহের ওপর ও তাদের শ্রবণশক্তির (অনুধাবন ক্ষমতার) ওপর মোহর করে দিয়েছেন এবং তাদের দৃষ্টিশক্তির ওপর পর্দা রয়েছে।” (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ ঃ ৭)

قلنا يا نار کنی برداً و سلاماً علی ابراهيم.

(১৪) “বললাম ঃ হে অগ্নি! ইবরাহীমের ওপর শীতল হয়ে যাও।” (সূরাহ্ আল্-আম্বিয়া’ ঃ ৬৯)

বলা হয়, এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, আগুনের কোনো দহনক্ষমতা নেই, বরং আল্লাহ্ যখন চান তখন আগুন দহন করতে পারে এবং আল্লাহ্ না চাইলে তখন আগুনের পক্ষে দহন করা সম্ভব হয় না। অন্যান্য প্রাকৃতিক উপাদানের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

قل اللهم مالک الملک تؤتی الملک من تشاء و تنزع الملک ممن تشاء و تعز من تشاء و تذل من تشاء.

(১৫) “(হে রাসূল!) বলুন, হে আল্লাহ্ Ñ (সকল) রাজ্যের অধিপতি! আপনি যাকে চান রাজ্য দান করেন ও যার কাছ থেকে চান রাজ্য ছিনিয়ে নেন এবং যাকে ইচ্ছা সম্মানিত করেন ও যাকে ইচ্ছা লাঞ্ছিত করেন।” (সূরাহ্ আলে ‘ইমরান ঃ ২৬)

فی ای صورة ما شاء رکبک.

(১৬) “তিনি তোমাকে যেমন আকৃতিতে ইচ্ছা সৃষ্টি করেছেন।” (সূরাহ্ আল্-ইনফিতার ঃ ৮)

هو الذی يصورکم فی الارحام کيف يشاء.

(১৭) “তিনিই (আল্লাহ্) যিনি যেভাবে চান তোমাদেরকে তোমাদের মাতৃগর্ভে আকৃতি প্রদান করেন।” (সূরাহ্ আলে ‘ইমরান ঃ ৬)

يهب لمن يشاء اناثا و يهب لمن يشبء الذکور.

(১৮) “তিনি যাকে ইচ্ছা কন্যা দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র দান করেন।” (সূরাহ্ আশ্-শূরা ঃ ৪২)

আমরা দৃশ্যতঃ অদৃষ্টবাদ নির্দেশক উপরোল্লিখিত আয়াত সমূহ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার পূর্বে মানুষের এখতিয়ার নির্দেশক কতক আয়াত উল্লেখ করবো। কারণ, এসব আয়াতের উল্লেখ থেকেই সুস্পষ্ট হয়ে যাবে যে, উপরোল্লিখিত আয়াত সমূহ দৃশ্যতঃ অদৃষ্টবাদ নির্দেশক মনে হলেও প্রকৃত পক্ষে তা নয়। অতঃপর বিষয়টিকে অধিকতর সুস্পষ্ট করার লক্ষ্যে পরে তা নিয়ে স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা করবো।

মানুষের এখতিয়ার নির্দেশকারী আয়াত

মানুষকে যে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে কোরআন মজীদের শত শত আয়াত থেকে তা প্রমাণিত হয়। উদাহরণ স্বরূপ এখানে তা থেকে কয়েকটি আয়াত উদ্ধৃত করা হলো ঃ

انی لا اضيع عمل عامل منکم من ذکر او انثی.

(১) “নিঃসন্দেহে আমি তোমাদের মধ্যকার কোনো কর্মসম্পাদনকারীর কর্মকে বিনষ্ট করি না, তা সে পুরুষই হোক, অথবা হোক নারী।” (সূরাহ্ আলে ‘ইমরান ঃ ১৯৫)

এখানে আল্লাহ্ তা‘আলা সুস্পষ্টতঃই মানুষকে কর্মসম্পাদনকারী বলে গণ্য করেছেন; তিনি বলেন নি, “আমি যার মাধ্যমে কর্ম সম্পাদন করি” বা “যাকে দিয়ে কর্ম সম্পাদন করাই”।

و ان ليس للانسان الا ما سعی.

(২)  “আর এই যে, মানুষ যে জন্য চেষ্টা করে তার জন্য তদ্ব্যতীত কিছু নেই।” (সূরাহ্ আন্-নাজ্ম্ ঃ ৩৯)

এখানে সুস্পষ্ট যে, মানুষ চেষ্টা-সাধনার ক্ষমতা রাখে।

منکم من يريد الدنيا و منکم من يريد الاخرة.

(৩) “তোমাদের মধ্যে এমন লোক আছে যে দুনিয়ার ইচ্ছা করে (দুনিয়ার সুখ-সম্পদ পেতে চায়) এবং তোমাদের মধ্যে এমন লোক আছে যে আখেরাতের ইচ্ছা করে (আখেরাতের সুখ-সম্পদ পেতে চায়)।” (সূরাহ্ আলে ‘‘ইমরান ঃ ১৫২)

من اراد الاخرة و سعی لها سعيها و هو مؤمن فاولئک کان سعيهم مشکوراً.

(৪) “যে ব্যক্তি আখেরাতের ইচ্ছা করলো (আখেরাতের সাফল্য কামনা করলো) এবং সে জন্য ঠিক সেভাবে চেষ্টা-সাধনা করলো যেরূপ চেষ্টা-সাধনা করা প্রয়োজন, আর সে যদি ঈমানদার হয়ে থাকে, তাহলে তাদের (এ ধরনের লোকদের) চেষ্টা-সাধনার প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখানো হবে (এর উপযুক্ত প্রতিদান প্রদান করা হবে)।” (সূরাহ্ বানী ইসরাঈল ঃ ১৯)

এখানে ইচ্ছাশক্তি ও চেষ্টা-সাধনা উভয়ই মানুষের ওপর আরোপ করা হয়েছে।

ان الله لا يغير ما بقوم حتی يغيرو ما بانفسهم.

(৫) “নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ কোনো জনগোষ্ঠীর অবস্থাকে পরিবর্তিত করে দেন না যতক্ষণ না তারা (নিজেরাই) তাদের নিজেদের ভিতরের অবস্থার পরিবর্তন সাধন করে।” (সূরাহ্ আর-রা‘দ্ ঃ ১১)

অর্থাৎ কোনো জনগোষ্ঠীর অবস্থার পরিবর্তনের জন্য স্বয়ং সে জনগোষ্ঠীকে এ পরিবর্তনের জন্য ক্ষেত্র তৈরী করতে হবে এবং তাকে এজন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।

لمن شاء منکم ان يتقدم او يتأخر. کل نفس بما کسبت رهينه.

(৬) “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি চায় সে এগিয়ে যাবে অথবা (যে চায়) সে পিছিয়ে যাবে। প্রতিটি ব্যক্তিই সে যা অর্জন করেছে সে জন্য দায়ী।” (সূরাহ্ আল্-মুদ্দাচ্ছির ঃ ৩৭ – ৩৮)

অর্থাৎ ভালো কাজ বা মন্দ কাজ করা ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছাধীন বিষয় এবং এ কারণে তার কর্মের সুফল ও কুফলের জন্য সে নিজেই দায়ী।

و لو ان اهل القری آمنوا و اتقوا لفتحنا عليهم برکات من السماء و الارض و لکن کذبوا فاخذناهم بما کانوا يکسبون.

(৭) “আর সে জনপদের অধিবাসীরা যদি ঈমান আনয়ন করতো ও তাকওয়া অবলম্বন করতো তাহলে আমরা তাদের জন্য আসমান ও যমীনের বরকত সমূহ উন্মুক্ত করে দিতাম। কিন্তু তারা (ঈমান ও তাকওয়ার পথকে) প্রত্যাখ্যান করলো। অতএব, তারা যা অর্জন করলো সে কারণে আমরা তাদেরকে পাকড়াও করলাম।” (সূরাহ্ আল্-আ‘রাফ্ ঃ ৯৬)

অর্থাৎ ঈমান আনয়ন ও তাকওয়া অবলম্বন করা অথবা কুফরীর পথ অবলম্বন করা উভয়ই ব্যক্তির ইচ্ছাধীন ব্যাপার।

انا هديناه السبيل اما شاکراً و اما کفوراً.

(৮) “অবশ্যই আমরা তাকে পথপ্রদর্শন করেছি; (অতএব,) হয় সে কৃতজ্ঞতা প্রকাশকারী হবে, অথবা অকৃতজ্ঞ হবে।” (সূরাহ্ আদ্-দাহর ঃ ৩)

কোরআন মজীদে ছালাত, ছাওম্, জিহাদ, যুদ্ধ ইত্যাদির আদেশ সম্বলিত বিপুল সংখ্যক আয়াত রয়েছে এবং আল্লাহ্ তা‘আলার অপসন্দনীয় কাজের ওপর নিষেধাজ্ঞা সম্বলিত আরো অনেক আয়াত রয়েছে। এসব আদেশ ও নিষেধ মানুষের ইচ্ছাশক্তি, কর্মক্ষমতা ও স্বাধীনতা নির্দেশ করে। মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতা না থাকলে এসব আদেশ-নিষেধ অর্থহীন হয়ে যায়। আর আল্লাহ্ তা‘আলা অর্থহীন কাজ সম্পাদনের ন্যায় ত্রুটি ও দুর্বলতা হতে প্রমুক্ত।

দৃশ্যতঃ অদৃষ্টবাদ নির্দেশক আয়াতের ব্যাখ্যা

কোরআন মজীদের যে সব আয়াত থেকে দৃশ্যতঃ প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ্ তা‘আলাই সব কিছু করেন বা করান অথবা পূর্ব থেকেই সব কিছু নির্ধারণ করে রেখেছেন এবং তদনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে সব কিছু সংঘটিত হচ্ছে, সে সব আয়াতকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখার কারণেই এরূপ প্রতীয়মান হচ্ছে। কিন্তু এটা কোরআন মজীদের আয়াতের তাৎপর্য গ্রহণের সঠিক পদ্ধতি নয়। বরং সঠিক পদ্ধতি হচ্ছে এসব আয়াতের পূর্বাপর প্রেক্ষাপট সামনে রেখে এবং কোরআন মজীদকে একটি একক ও অবিভাজ্য পথনির্দেশ গণ্য করে অর্থ গ্রহণ করা। নচেৎ কোরআন মজীদে যেখানে দৃশ্যতঃ অদৃষ্টবাদ ও এখতিয়ারবাদ নির্দেশক উভয় ধরনের আয়াত রয়েছে তখন একে স্ববিরোধী বলে মনে হবে। কিন্তু কোরআন মজীদ যে কোনো ধরনের স্ববিরোধিতারূপ দুর্বলতা থেকে মুক্ত। স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলা কাফেরদের সামনে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেছেন ঃ

افلا يتدبرون القرآن. و لو کان من عند غير الله لوجدوا فيه اختلافاً کثيراً.

“তারা কি কোরআন নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করে না? আর তা (কোরআন) যদি আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারো কাছ থেকে হতো (কোনো মানুষের রচিত হতো) তাহলে তাতে বহু স্ববিরোধিতার অস্তিত্ব থাকতো।” (সূরাহ্ আন্-নিসা’ ঃ ৮২)

কিন্তু কোরআন মজীদে দৃশ্যতঃ অদৃষ্টবাদ ও এখতিয়ারবাদ নির্দেশক ডজন ডজন আয়াত থাকা সত্ত্বেও কোরআন নাযিল কালীন বা তদপরবর্তী কালীন আরব মুশরিক, ইয়াহূদী ও খৃস্টান পণ্ডিতদের পক্ষ থেকে কোরআন মজীদে স্ববিরোধিতার একটি দৃষ্টান্তও নির্দেশ করা হয় নি। আশ্চর্যের বিষয় যে, তারা কোরআন মজীদকে মানুষের রচিত গ্রন্থ বলে দাবী করা সত্ত্বেও উক্ত চ্যালেঞ্জের মুখেও কোরআন মজীদে এমন দু’টি আয়াতও খুঁজে পায় নি যাকে পরস্পর বিরোধী বলে দাবী করা যেতে পারে। কিন্তু হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর ওফাতের পর এক শতাব্দী কালেরও কম সময়ে কতক মুসলিম মনীষী কোরআন মজীদের বিভিন্ন আয়াতকে প্রেক্ষাপট ও সামগ্রিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে এমন অর্থ গ্রহণ করতে থাকেন যার ফলে ডজন ডজন আয়াত পরস্পর বিরোধী বলে প্রতিভাত হয়। এখানে আমরা উদাহরণ স্বরূপ, দৃশ্যতঃ অদৃষ্টবাদ নির্দেশক আয়াত সমূহের মধ্য থেকে ইতিপূর্বে উল্লিখিত আয়াত সমূহ নিয়ে পর্যালোচনা করে দেখবো যে, এসব আয়াত আদৌ অদৃষ্টবাদ প্রমাণ করে না।

(১) আল্লাহ্ তা‘আলা প্রতিটি প্রাণীর অবস্থানস্থল ও সাময়িক বিশ্রামস্থল (অথবা, বেশীর ভাগ অনুবাদকের গৃহীত অর্থ অনুযায়ী, মৃত্যুস্থল) সম্বন্ধে অবগত (সূরাহ্ হূদ ঃ ৬)। এমন কোনো পাতাও ঝরে পড়ে না যা তিনি জানেন না (সূরাহ্ আল্-আন্‘আম্ ঃ ৫৯)। তিনি জানেন যা আছে লোকদের বর্তমানে ও ভবিষ্যতে (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ ঃ ২৫৫)।

কিন্তু আল্লাহ্ তা‘আলার জানা থাকা মানেই যে তা তাঁর পক্ষ থেকে পূর্বনির্ধারিত Ñ এরূপ মনে করা ঠিক নয়। কারণ, প্রথমতঃ মানুষের ও অন্যান্য প্রাণীর ভবিষ্যত নিয়ন্ত্রণে অতীতে যে সব কারণ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে সে সম্পর্কে আল্লাহ্ তা‘আলা পরিপূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী। এ কারণে আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের ভবিষ্যত সম্বন্ধে সম্যক অবগত। ব্যক্তির ভবিষ্যত নিয়ন্ত্রণের কারণ সমূহের মধ্যে প্রাকৃতিক বিধিবিধান, জেনেটিক কারণ, ব্যক্তির নিজের স্বাধীন ইচ্ছা, এখতিয়ার, মন-মেজাজ ও প্রবণতা এবং তার সাথে অন্যান্য প্রাণশীল সৃষ্টির অতীত ও বর্তমান সম্পর্ক সহ সব ধরনের কারণ সম্বন্ধেই তিনি পুরোপুরি অবগত। তাই বলে এজন্য তিনিই দায়ী এরূপ দাবী করা ঠিক নয়। অনুরূপভাবে প্রাকৃতিক বিধিবিধান, জেনেটিক কারণ এবং ব্যক্তির সাথে অন্যান্য প্রাণশীল সৃষ্টির অতীত ও বর্তমান সম্পর্ক তার ভবিষ্যত নিয়ন্ত্রণে কার্যকন ভূমিকার অধিকারী হওয়ার মানে কখনোই এটা হতে পারে না যে, এর ফলে তার স্বাধীন ইচ্ছা ও কর্মক্ষমতা একেবারেই অকার্যকর হয়ে পড়ে এবং এ ব্যাপারে কোনোই ভূমিকার অধিকারী নয়।

এ প্রসঙ্গে মানবিক জগতের দৃষ্টান্ত দেয়া যেতে পারে। যেমন ঃ একজন শিক্ষক স্বীয় অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে একজন ছাত্র সম্বন্ধে জানেন যে, সে পরীক্ষায় প্রথম হবে এবং আরেক জন ছাত্র সম্বন্ধে জানেন যে, সে অকৃতকার্য হবে। তাই বলে তাদের প্রথম হওয়া ও অকৃতকার্য হওয়ার জন্য ঐ শিক্ষককে দায়ী করা চলে না। তেমনি একটি রাস্তার মোড়ে অবস্থিত একটি উঁচু ভবনের ছাদে দাঁড়ানো কোনো ব্যক্তি যদি মোড়ের দুই দিক থেকে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে আগত দু’টি গাড়ী দেখে, গাড়ী দু’টির চালকদ্বয় রাস্তার পাশের বাড়ীঘরের কারণে একে অপরের গাড়ীকে দেখতে পাচ্ছে না লক্ষ্য করে এবং গাড়ী দু’টির গতিবেগ ও রাস্তার মোড় থেকে উভয়ের দূরত্বের ভিত্তিতে ভবিষ্যদ্বাণী করে যে, দুই মিনিট পর গাড়ী দু’টির মধ্যে সংঘর্ষ ঘটবে, আর সত্যিই যদি দুই মিনিট পর গাড়ী দু’টির মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে, তাহলে ঐ সংঘর্ষের জন্য কিছুতেই ভবিষ্যদ্বাণীকারী ব্যক্তিকে দায়ী করা যাবে না। স্মর্তব্য, এ ক্ষেত্রে গাড়ী দু’টির ভিতর ও বাইরের অবস্থা, চালকদ্বয়ের শারীরিক-মানসিক অবস্থা এবং সংশ্লিষ্ট পথের পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্বন্ধে ঐ ব্যক্তির জ্ঞান যত বেশী হবে তার পক্ষে তত বেশী নির্ভুলভাবে ও তত আগে এ দুর্ঘটনা সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করা সম্ভব হবে। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই এ দুর্ঘটনার জন্য তাকে দায়ী করা যাবে না।

দ্বিতীয়তঃ সৃষ্টি সম্বন্ধে আল্লাহ্ তা‘আলার ভবিষ্যত জ্ঞানের মধ্যে এমন কতক বিষয় রয়েছে যা দু’টি ভিন্ন ভিন্ন বা পরস্পর বিরোধী সমান সম্ভাবনার অধিকারী। এমনকি কিছু বিষয় বহু সম্ভাবনার অধিকারী থাকাও স্বাভাবিক। (এ সম্পর্কে পরে প্রমাণ উল্লেখ করা হয়েছে।)

আর ‘কিতাবুম্ মুবীন্’ (সুস্পষ্ট / সুবর্ণনাকারী গ্রন্থ) সম্পর্কে এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে, তাকে প্রতীকী বর্ণমালায় কালির হরফে কাগজের বুকে লেখা আমাদের পঠনীয় গ্রন্থ মনে করলে ভুল করা হবে। বরং এ হচ্ছে মানুষের অভিজ্ঞতা ও বস্তুলোকের উর্ধস্থিত বিষয় (মুতাশাবেহ্)। অতএব, এতে সব কিছু কী অবস্থায় নিহিত রয়েছে তা আমাদের জানা নেই। তবে এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই যে, এতে নিহিত তথ্যবিলীর মধ্যে সমান দুই সম্ভাবনা বা বহু-সম্ভাবনা বিশিষ্ট বিষয়াদিও অন্যতম।

(২) আল্লাহ্ তা‘আলা প্রাণ দান করেন এবং মৃত্যু প্রদান করেন (আল্-হাদীদ ঃ ২)। এর মানে হচ্ছে, তিনিই জীবনের সূচনা করেন ও মৃত্যুর অমোঘ প্রাকৃতিক বিধান নির্ধারণ করেন। এছাড়া জীবনের উদ্ভব ও বিকাশের এবং মৃত্যু ঘটার কারণ সমূহ (কারণ-বিধি) তিনিই নির্ধারণ করে দিয়েছেন। অধিকন্তু তিনি জীবন ও মৃত্যুর প্রতি সদা দৃষ্টি রাখেন এবং গোটা সৃষ্টিলোক, বা মানব প্রজাতি, বা কোনো জনগোষ্ঠী অথবা কোনো ব্যক্তির কল্যাণের জন্যে যদি চান যখন ইচ্ছা তাতে হস্তক্ষেপ করেন। কিন্তু এর মানে এ নয় যে, জীবন ও মৃত্যুর ক্ষেত্রে অন্যান্য প্রাণশীল সৃষ্টি ও মানুষের ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতা এবং অন্যান্য কারণের কোনোই ভূমিকা নেই। কারণ, স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলাই মানুষের এ ধরনের ক্ষমতা ও এখতিয়ার থাকার কথা বলেছেন। যেমন ঃ আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন ঃ

من قتل نفساً بغير نفسٍ او فساد فی الارض فکانما قتل الناس جميعاً. و من احياها فکانما احيا الناس جميعاً.

“যে কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ বা ধরণীর বুকে বিপর্যয় সৃষ্টির দায়ে ব্যতীত কাউকে হত্যা করলো সে যেন সমগ্র মানব মণ্ডলীকে হত্যা করলো এবং যে তাকে জীবিত রাখলো (তার জীবন রক্ষা করলো) সে যেন সমগ্র মানব মণ্ডলীকে জীবন দান করলো।” (সূরাহ্ আল্-মায়েদাহ্ ঃ ৩২)

এ ছাড়াও কোরআন মজীদে এমন বহু আয়াত রয়েছে যাতে মানুষের হত্যা করার ক্ষমতা প্রমাণিত হয়। অতএব, মানুষের মৃত্যুর দিন-ক্ষণ, স্থান ও কারণ পূর্ব থেকে স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ হতে নির্ধারিত বলে যে ধারণা প্রচলিত রয়েছে তা ঠিক নয়। কারণ, তাহলে বলতে হবে যে, আল্লাহ্ তা‘আলাই তার ভাগ্যে তা নির্ধারণ করে রেখে ছিলেন। যদি তা-ই হতো তাহলে হত্যার জন্য ঘাতককে অপরাধী ও গুনাহ্গার গণ্য করা ঠিক হতো না। বস্তুতঃ এটা বড়ই অন্যায় ধারণা যে, আল্লাহ্ তা‘আলা একজনকে দিয়ে আরেক জনকে হত্যা করাবেন, অথচ হত্যার অপরাধে হত্যাকারীকে (যে আল্লাহর ইচ্ছা বাস্তবায়নের যান্ত্রিক হাতিয়ার বৈ নয়) শাস্তি দেবেন; তিনি এরূপ অন্যায় নীতি ও আচরণ থেকে প্রমুক্ত।

(৩) আল্লাহ্ যাকে চান রিয্ক্ প্রসারিত করে দেন (সূরাহ্ আল্-‘আন্কাবুত্ ঃ ৬২)। এ আয়াত থেকে এরূপ অর্থ গ্রহণ করা ঠিক নয় যে, আল্লাহ্ তা‘আলা মানুষকে সৃষ্টি করার পূর্বেই তার জন্য রিয্কের ধরন, পরিমাণ, সময় ও মাধ্যম নির্ধারণ করে রেখেছেন। কারণ, এ আয়াতে বর্তমান ও ভবিষ্যত কালের ক্রিয়ারূপ (ছীগ¦াহ্) ব্যবহার করা হয়েছে। ‘প্রসারিত করে দেন’ কথাটি থেকেও প্রমাণিত হয় যে, তিনি তা পূর্ব থেকে নির্ধারিত করে রাখেন নি। কারণ, পূর্বনির্ধারণের পর তাতে পরিবর্তন সাধন সীমিত জ্ঞানের অধিকারী দুর্বলমনা মানুষের বৈশিষ্ট্য: পরম জ্ঞানময় আল্লাহ্ তা‘আলা এরূপ দুর্বলতা থেকে প্রমুক্ত। বরং এ আয়াত থেকে প্রমাণিত হয় যে, কারণ-বিধির আওতায় ব্যক্তির জন্য রিয্ক্ নির্ধারিত হয়ে যায়, তবে তিনি চাইলে তাকে তা সম্প্রসারিত করে দেন, নয়তো কারণ-বিধির আওতায় তার যা প্রাপ্য তাকে তা-ই (পরিমাপ করে) প্রদান করেন।

(৪) প্রতিটি উম্মাহই একটি শেষ সময় (আজাল্) রয়েছে যা এসে গেলে আর অগ্র-পশ্চাত হয় না (সূরাহ্ ইউনুস ঃ ৪৯)। এখানে “আজাল্” শব্দের অর্থ করা হয় আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে পূর্বনির্ধারিত শেষ সময়। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে কোরআন মজীদের এ বক্তব্যের উদ্দেশ্য তা নয়। বরং এর তাৎপর্য হচ্ছে এই যে, কোনো জনগোষ্ঠী বা জাতির আয়ুষ্কাল অব্যাহত থাকা ও ধ্বংসের জন্য সুনির্দিষ্ট শর্তাবলী রয়েছে; যখন তার ধ্বংসের উপযোগী সকল শর্ত পূর্ণ হয়ে যায় তখন তার ধ্বংস অনিবার্য হয়ে যায়। উদাহরণ স্বরূপ, আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন ঃ

ذالک ان لم يکن ربک مهلک القری بظلم و اهلها غافلون.

“এটা এজন্য যে, (হে রাসূল!) আপনার রব কোনো জনপদকে তার অধিবাসীরা অসচেতন থাকা অবস্থায় অন্যায়ভাবে তাকে ধ্বংস করেন নি।” (সূরাহ্ আল্-আন্‘আম্ ঃ ১৩১)

আল্লাহ্ তা‘আলা আরো এরশাদ করেন ঃ

و ما کان ربک ليهلک القری بظلم و اهلها مصلح.

“(হে রাসূল!) আপনার রব এমন নন যে, কোনো জনপদের অধিবাসীরা যথোচিত কর্ম সম্পাদনকারী হওয়া সত্ত্বেও অন্যায়ভাবে সে জনপদকে ধ্বংস করে দেবেন।” (সূরাহ্ হূদ্ ঃ ১১৭)

অন্যত্র এরশাদ হয়েছে ঃ

يدعوکم ليغفر لکم من ذنوبکم و يوخرکم الی اجل مسمی.

“তিনি (আল্লাহ্) তোমাদেরকে আহ্বান করছেন যাতে তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের গুনাহ্ সমূহ মাফ করে দেন এবং তোমাদেরকে একটি নির্দিষ্ট সময় (আজালে মুসাম্মা) পর্যন্ত অবকাশ প্রদান করেন।” (সূরাহ্ ইবরাহীম ঃ ১০)

এ আয়াতে নবী (আঃ)-এর প্রতি ঈমান আনয়নের শর্তে আজালে মুসাম্মা পর্যন্ত শাস্তি বা ধ্বংস পিছিয়ে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কারণ, يوخرکم (তোমাদেরকে অবকাশ প্রদান করেন) কথাটির ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য (مصدر) হচ্ছে Ñتأخير যার অর্থ পিছিয়ে দেয়া। তাছাড়া এ আয়াতে যে আযাব্ বা ধ্বংস পিছিয়ে দেয়ার কথা বলা হয়েছে তা পূর্বাপর আয়াতের ধারাবাহিকতা থেকেই প্রমাণিত হয়। কারণ, কাফেররা নবী (আঃ)-কে প্রত্যাখ্যান করার পর আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে ধ্বংস করে দেন। এরশাদ হয়েছে ঃ

فاوحی اليهم ربهم لنهلکن الظالمين.

“অতঃপর তাদের রব তাদের নিকট ওহী করলেন যে, অবশ্যই আমরা যালেমদেরকে ধ্বংস করে দেবো।” (সূরাহ্ ইবরাহীম ঃ ১৩)

বলা বাহুল্য যে, কোনো জাতির ধ্বংসের দিনক্ষণ ও প্রেক্ষাপট যদি সৃষ্টির সূচনায়ই নির্ধারিত হয়ে থাকে তাহলে তাদেরকে ঈমান আনলে ধ্বংস পিছিয়ে দেয়া হবে বলে জানানোর কোনো অর্থ হয় না। তাছাড়া কারো ঈমান বা কুফরী যদি পূর্ব নির্ধারিত হয় তাহলে তার জন্যে ঈমান আনার শর্ত আরোপ করাও অর্থহীন। আর আল্লাহ্ তা‘আলা অর্থহীন কথা ও কাজ রূপ দুর্বলতা থেকে প্রমুক্ত।

উপরোক্ত প্রথম আয়াতে (সূরাহ্ ইবরাহীম ঃ ১০) “আজালে মুসাম্মা” মানে যে পূর্বনির্ধারিত দিন-তারিখ নয়, বরং যদ্দিন তারা নিজেদেরকে পুনরায় ধ্বংসের উপযুক্ত না করে তদ্দিন পর্যন্ত তাদেরকে অবকাশ দেয়া হবে Ñ তা-ও সুস্পষ্ট। কারণ, পূর্বনির্ধারিত সুনির্দিষ্ট দিন-তারিখ পর্যন্ত ঈমান আনার শর্তে অবকাশ প্রদানের কথা বলা স্ববিরোধিতা বৈ নয়। কেননা, অবকাশটি পূর্বনির্ধারিত হয়ে থাকলে সে অবকাশ অনিবার্য হয়ে যায়, ফলে তাকে আর ‘অবকাশ’ নামে অভিহিত করা চলে না।

অবশ্য এখানে “আজালে মুসাম্মা” বলতে কিয়ামতের দিনকে বুঝানো হয়ে থাকতে পারে। সে ক্ষেত্রেও এ সত্যই প্রমাণিত হয় যে, কোনো জাতির ধ্বংসের জন্য দিনক্ষণ পূর্বনির্ধারিত নেই, বরং তার ধ্বংসের শর্তাবলী নির্ধারিত হয়ে আছে Ñ যা পূর্ণ হলে তাকে ধ্বংস করে দেয়া হবে, আর পূর্ণ না হলে তার অস্তিত্ব অব্যাহত থাকবে এবং তাকে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত অবকাশ দেয়া হবে।

অন্য একটি আয়াত থেকেও মনে হয় যে, “আজালে মুসাম্মা” মানে কিয়ামত দিবস। এরশাদ হয়েছে ঃ

هو الذی خلقکم من طين ثم قضی اجلا. و اجل مسمی عنده.

“তিনিই (আল্লাহ্) যিনি তোমাদেরকে মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর (তোমাদের জন্য) “আজাল্”-এর অমোঘ বিধান নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আর তাঁর নিকটে রয়েছে “আজালে মুসাম্মা”।” (সূরাহ্ আল্-আন্‘আম্ ঃ ২)

এ আয়াত থেকে সুস্পষ্ট যে, প্রথমোক্ত “আজাল।” মানে ‘শেষ সময়’ বা ‘মৃত্যু’র ‘অমোঘ বিধান’ এবং দ্বিতীয়োক্ত “আজালে মুসাম্মা” মানে ‘কিয়ামত দিবস’। এ আয়াতের বক্তব্য থেকে এ-ও সুস্পষ্ট যে, মানুষের জন্য “আজাল”-এর ফয়সালা বলতে ‘শেষ সময়’ বা ‘মৃত্যু’র অনিবার্যতা বুঝানোই এখানে লক্ষ্য, সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ বুঝানো লক্ষ্য নয়। অর্থাৎ আল্লাহ্ তা‘আলা মানুষের (এবং অন্যান্য প্রাণশীল সৃষ্টির) জন্য মৃত্যুর বিভিন্ন সুনির্দিষ্ট প্রাকৃতিক কারণ নির্ধারণ করে দিয়েছেন, অতঃপর যখন কোনো না কোনো কারণে কারো জন্য মৃত্যু অবধারিত হয়ে যায় তখনই তার মৃত্যু ঘটে।

অবশ্য মৃত্যুর জন্য এই প্রাকৃতিক কারণ সমূহ ছাড়াও একটি ব্যতিক্রমী কারণও রয়েছে, তা হচ্ছে আল্লাহ্ তা‘আলার প্রত্যক্ষ ফয়সালা। অর্থাৎ সৃষ্টিলোক, মানব প্রজাতি, কোনো জনগোষ্ঠী বা স্বয়ং ব্যক্তির কল্যাণের লক্ষ্যে যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মৃত্যু বা ধ্বংস আল্লাহ্ তা‘আলার দৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় হয় তখন মৃত্যু বা ধ্বংসের জন্য প্রাকৃতিক কারণ বিদ্যমান না থাকলেও আল্লাহ্ তা‘আলার ইচ্ছায় তার মৃত্যু বা ধ্বংস অনিবার্য। (অনুরূপভাবে প্রাকৃতিক কারণে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মৃত্যু বা ধ্বংস অনিবার্য হয়ে উঠলেও সৃষ্টিলোক, মানব প্রজাতি, উক্ত জনগোষ্ঠী বা স্বয়ং ব্যক্তির কল্যাণের লক্ষ্যে আল্লাহ্ তা‘আলা তা পিছিয়ে দিতে পারেন।) আল্লাহ্ তা‘আলার ইচ্ছাক্রমে হযরত খিযির (আঃ) কর্তৃক একটি শিশুকে হত্যার ঘটনা (সূরাহ্ আল্-কাহ্ফ্ ঃ ৭৪) এ পর্যায়ের যা শিশুটি ও তার পিতামাতার জন্য কল্যাণকর বিবেচিত হয়। এ ঘটনা থেকে এ-ও প্রমাণিত হয় যে, শিশুটির মৃত্যু আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে (তার জন্মের পূর্ব থেকেই) পূর্বনির্ধারিত ও অনিবার্য ছিলো না। কারণ, তাহলে সে বড় হয়ে অবাধ্যতা ও কুফ্র্ দ্বারা পিতামাতাকে প্রভাবিত করবে বলে আল্লাহ্ তা‘আলা ও হযরত খিযির (আঃ)-এর পক্ষ থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করার (সূরাহ্ আল্-কাহ্ফ্ ঃ ৮০) কোনো কারণ থাকতো না এবং তাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়ারও প্রয়োজন হতো না।

এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, সাধারণভাবে মানুষদের মৃত্যুর দিনক্ষণ তার জন্মের পূর্বে নির্ধারিত নয় (তবে কতক ব্যতিক্রম থাকা স্বাভাবিক)।

এখানে বিচারবুদ্ধির আলোকে মানুষের ‘আয়ুষ্কাল ও প্রতিভা’র সম্ভাবনার ওপর দৃষ্টিপাত করা যেতে পারে। বিচারবুদ্ধির পর্যবেক্ষণে আমরা দেখতে পাই যে, একটি মানব সন্তান জন্মগ্রহণের সময় ‘আয়ুষ্কাল ও প্রতিভা’র বিরাট সম্ভাবনা নিয়ে আসে। কিন্তু জন্মের পর বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মানবিক কারণ তার আয়ুষ্কাল ও প্রতিভার ‘সম্ভাবনা’র বৃত্ত দু’টির আয়তনকে ক্রমান্বয়ে সঙ্কুচিত করতে থাকে। আমরা যদি তার বয়সকে একটি ক্রমপ্রসারমান নেতিবাচক বৃত্ত হিসেবে এবং তার আয়ুষ্কাল ও প্রতিভার ‘সম্ভাবনা’র বৃত্ত দু’টিকে ক্রমসঙ্কোচনরত ইতিবাচক বৃত্ত হিসেবে ধরে নেই, তাহলে তার বয়সবৃত্তের বৃদ্ধি এবং আয়ুষ্কাল ও প্রতিভার সম্ভাবনার বৃত্তদ্বয়ের সঙ্কোচন অব্যাহত থাকায় যখন তার বয়সবৃত্ত ও প্রতিভাসম্ভাবনাবৃত্ত পরস্পর মিলে যাবে তখন তার প্রতিভার বিকাশধারা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে এবং যখন তার বয়সবৃত্ত ও আয়ুষ্কালসম্ভাবনাবৃত্ত পরস্পর মিলে যাবে তখনই তার মৃত্যু ঘটবে। এর ব্যতিক্রম কেবল তখনই সম্ভব যদি আল্লাহ্ তা‘আলা তার প্রতিভাসম্ভাবনাবৃত্ত বা আয়ুষ্কালসম্ভাবনাবৃত্ত সঙ্কুচিত হয়ে যে পর্যায়ে পৌঁছেছে তা সেখান থেকে পিছিয়ে দেন তথা তার সঙ্কোচনকে (আংশিকভাবে হলেও) দূর করে দেন তথা হারিয়ে যাওয়া প্রসারতাকে (আংশিকভাবে হলেও) ফিরিয়ে দেন।

অনুরূপভাবে ব্যক্তির বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মানবিক কারণে তার প্রতিভাসম্ভাবনার অনেকগুলো দিক বা শাখার বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়ে যায় বা তার বিকাশের গতি শ্লথ হয়ে যায়, যদি না কোনো কারণে আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে তাতে প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ সংঘটিত হয়।

(৫) এমন কোনো মুছিবত আপতিত হয় না যা পূর্ব থেকেই কিতাবে লিপিবদ্ধ নেই (সূরাহ্ আল্-হাদীদ ঃ ২২) এবং আল্লাহ্ যখন কোনো জনগোষ্ঠীর অকল্যাণ চান তখন তা কেউ রোধ করতে পারে না (সূরাহ্ আর-রা‘দ্ ঃ ১১)।

এখানে কিতাবে মুছিবত লিপিবদ্ধ থাকা মানে প্রতিটি ব্যক্তির ওপর কবে কখন কী ধরনের মুছিবত আপতিত হবে তা সৃষ্টির সূচনার পূর্বেই বা সূচনার মুহূর্তেই লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়েছিলো Ñ এমন নয়। বরং এ আয়াতে “আজাল্”-এর লক্ষ্য দু’টি সম্ভাবনার একটি। হয় এর লক্ষ্য এই যে, মুছিবত সমূহের ধরন সুনির্দিষ্ট এবং তার শর্তাবলী কারণবিধি দ্বারা সুনির্দিষ্ট রয়েছে। অতএব, এর বাইরে নতুন ধরনের কোনো মুছিবত হতে পারে না (যা আল্লাহ্ তা‘আলার জানা থাকবে না এবং তিনি চাইলে যা রোধ করতে পারবেন না)। অথবা এর লক্ষ্য এই যে, ‘বিভিন্ন কারণে’ (মানবিক, প্রাকৃতিক ও অন্যবিধ) ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর জন্য যে মুছিবত অবধারিত হয়ে গেছে যথাসময়ে তার বাস্তবায়িত হওয়া অনিবার্য; তা থেকে কেউ কিছুতেই পালাতে পারবে না।

সূরাহ্ আর-রা‘দ্-এর ১১ নং আয়াত থেকেও প্রমাণিত হয় যে, ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ওপর স্থান ও কালের আওতায় যে বিপদ আপতিত হয় তা সৃষ্টির সূচনার পূর্বে বা সূচনাকালে বা ব্যক্তির অস্তিত্বের সূচনাকালে নির্ধারিত করে রাখা হয় নি। কারণ, “আল্লাহ্ যখন চান বা চাইবেন” থেকেই প্রমাণিত হয় যে, তিনি তা সৃষ্টিলোকের সৃষ্টির বা ব্যক্তির অস্তিত্বলাভের সূচনাকালে বা তার পূর্বে নির্ধারণ করে রাখেন নি।

(৬)  আল্লাহ্ তা‘আলার ইচ্ছা ব্যতীত মানুষ ইচ্ছা করে না বা করবে না (সূরাহ্ আদ্-দাহর ঃ ৩০)। এর মানে এ নয় যে, ব্যক্তি-মানুষের প্রতিটি ইচ্ছা ও কামনা-বাসনাই আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে পূর্ব নির্ধারিত। বরং এখানে এটাই বুঝানো লক্ষ্য যে, আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর সৃষ্টি ব্যবস্থাপনায় মানুষের জন্যে স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির অবকাশ রেখেছেন বলেই মানুষ  ইচ্ছা ও আশা-আকাক্সক্ষা পোষণ করে। আল্লাহ্ তা‘আলা যদি না চাইতেন তাহলে তাদের ইচ্ছা ও আশা-আকাক্সক্ষা পোষণের কোনো ক্ষমতাই থাকতো না। তাছাড়া তিনি সর্বাবস্থায়ই বান্দাহ্র প্রতি দৃষ্টি রাখেন এবং সর্বক্ষণই বান্দাহ্কে তার ইচ্ছা ও আশা-আকাক্সক্ষা পোষণ সহকারে অস্তিত্বমান রাখছেন বলেই তার অস্তিত্ব টিকে আছে এবং সে ইচ্ছা ও আশা-আকাক্সক্ষা পোষণ করছে।

এ বিষয়টিকে একটি পথের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। দু’টি শহরের মাঝে এমন একটি রেলপথের কথা কল্পনা করা যেতে পারে যার ওপর দিয়ে মানুষ-চালক বিহীন একটি স্বয়ংক্রিয় কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত ও রোবটকর্মীর অধিকারী ট্রেন এগিয়ে চলেছে। কম্পিউটারে যেভাবে প্রোগ্রাম দেয়া আছে ঠিক সেভাবেই ট্রেনটি মধ্যপথে থামা ও মালামাল ওঠানো-নামানোর কাজ সম্পাদন করে গন্তব্যস্থলে উপনীত হয়ে থেমে যাবে। এরই পাশাপাশি দু’টি শহরের মধ্যে একটি প্রশস্ত মহাসড়ক কল্পনা করা যাক যার মাঝখানে বিভক্তিরেখা ও দুই পাশে মাঝে মাঝে পাহাড়, মরুভূমি, খাদ ও নিষ্ক্রমণ সড়ক রয়েছে এবং সড়কটিতে একজন চালক গাড়ী চালিয়ে যাচ্ছে। গাড়ীর চালক চাইলে মহাসড়কের অনুমোদিত অর্ধেকের (আমাদের দেশের নিয়ম অনুযায়ী বাম পাশের অর্ধেকের) মধ্য দিয়ে ডান দিক দিয়ে বা বাম দিক দিয়ে অথবা মাঝখান দিয়ে গাড়ী চালাতে পারে, অথবা চাইলে বিভক্তিরেখা অতিক্রম করে আইন লঙ্ঘন করতে পারে (যার ফলে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে; অবশ্য না-ও ঘটতে পারে)। তেমনি সে চাইলে সোজা চলতে পারে, বা অযথা এঁকেবেঁকে পথ চলতে পারে। সে চাইলে দ্রুত যেতে পারে, আবার আস্তেও যেতে পারে। চাইলে সে ঐ মহাসড়কে চলাচলের জন্য নির্ধারিত বৈধ গতিসীমা অতিক্রম করে যেতে পারে অথবা মাঝপথে থেমেও যেতে পারে। অন্যদিকে চালকের ইচ্ছা, অসাবধানতা বা গাড়ীর ত্র“টির কারণেও গাড়ীটি বিভক্তিরেখা লঙ্ঘন করতে পারে, খাদে পড়তে পারে, পাহাড়ে ধাক্কা খেতে পারে, মরুভূমিতে প্রবেশ করতে পারে, কর্দমাক্ত মাটিতে পড়ে আটকে যেতে পারে বা কোনো নিষ্ক্রমণ পথে প্রবেশ করে উক্ত মহাসড়ক থেকে বাইরে বেরিয়ে গিয়ে অন্য গন্তব্যে পৌঁছে যেতে পারে। অবশ্য মহাসড়কের কোনো কোনো অংশে অনতিক্রম্য রেলিং থাকতে পারে, যে কোনো প্রকার আইন লঙ্ঘন ও দুর্ঘটনা রেকর্ডের জন্য যুক্তিসঙ্গত দূরে দূরে টিভি-ক্যামেরা বা ভিডিও ক্যামেরা বসানো থাকতে পারে; মাঝে মাঝে সুনির্দিষ্ট জায়গায় বা গাড়ীতে চলা অবস্থায় পুলিশ ও বিচারক থাকতে পারেন এবং নিয়মানুযায়ী তাৎক্ষণিক শাস্তি প্রদান বা পরে বিচার করার Ñ উভয় ধরনের ব্যবস্থাই থাকতে পারে। এসব কিছুই কেবল ঐ চালকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যে এ মহাসড়কে প্রবেশ করেছে বা যাকে এতে প্রবেশ করতে দেয়া হয়েছে। অবশ্য কর্তৃপক্ষ চাইলে কাউকে এতে প্রবেশ করতে না-ও দিতে পারে, অথবা মাঝপথেই তাকে থামিয়ে দিতে পারে বা তাকে মহাসড়ক ত্যাগে বাধ্যও করতে পারে। উপরোদ্ধৃত সর্বশেষ আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলার যে ইচ্ছার কথা বলা হয়েছে তা এই দ্বিতীয়োক্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও তার ওপরে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণাধিকারের সাথে তুলনীয়, প্রথমোক্ত রেল লাইন ও ট্রেনের সাথে নয়। কারণ, মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির কথা কোরআন মজীদে বহু বার উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, এরশাদ হয়েছে ঃ

و قل الحق من ربکم فمن شاء فليؤمن و من شاء فليکفر.

“আর (হে রাসূল!) (লোকদেরকে) বলুন ঃ (এ হচ্ছে) তোমাদের রবের পক্ষ থেকে (আগত) সত্য; অতঃপর যে চায় সে ঈমান আনুক এবং যে চায় সে প্রত্যাখ্যান করুক (কাফের হয়ে যাক)।” (সূরাহ্ আল্-কাহ্ফ্ ঃ ২৯)

(৬) তিনি যাকে চান স্বীয় রহমতে প্রবেশ করান বা করাবেন (আদ্-দাহর ঃ ৩১)। এর মানে এ নয় যে, তিনি অযৌক্তিকভাবে যাকে ইচ্ছা দয়া করেন এবং যাকে ইচ্ছা বেহেশতে নেবেন। এখানে তাঁর বিশেষ রহমতের কথা বলা হয়েছে। নয়তো তাঁর সর্বজনীন রহমত সকলের জন্য সম্প্রসারিত। যেমন, আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন ঃ

عذابی اصيب به من اشاء. و رحمتی وسعت کل شيء. فساکتبها للذين يتقون و يؤتون الزکواة و الذين هم باياتنا يؤمنون.

“আমার শাস্তি (শাস্তির উপযুক্তদের মধ্যকার) যার ওপরে চাই আপতিত করি। আর আমার অনুগ্রহ (রহমত) সব কিছুকেই পরিব্যাপ্ত করে রয়েছে। অতঃপর অচিরেই আমি তা কেবল তাদের জন্যই নির্ধারণ করে দেবো যারা তাকওয়া অবলম্বন করে, যাকাত প্রদান করে এবং আমার আয়াত সমূহের প্রতি ঈমান পোষণ করে।” (সূরাহ্ আল্-আ‘রাফ ঃ ১৫৬)

এ আয়াত থেকে সুস্পষ্ট যে, সকলেই আল্লাহ্ তা‘আলার সর্বজনীন রহমতের অধিকারী এবং বিশেষ রহমত কেবল তাদের জন্যই যারা তা লাভের উপযুক্ত। অবশ্য শাস্তিযোগ্য সবাইকেই যে তিনি শাস্তি দেবেন তা নয়, বরং কিছু লোককে রেহাইও দেবেন; নিঃসন্দেহে যাদের অপরাধ গুরুতর নয়, বা কিছু আওতা বহির্ভূত কারণ তাদের অপরাধ থেকে বিরত থাকার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিকে দুর্বল করে ফেলেছিলো, তাদের শাস্তিই মওকুফ করা হবে; তিনি উদ্ধত ও ধৃষ্ট অপরাধীদের অপরাধ ক্ষমা করবেন না।

(৭) বদর যুদ্ধ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেছেন যে, দৃশ্যতঃ মুসলমানরা কাফেরদের হত্যা করলেও প্রকৃত পক্ষে আল্লাহ্ তা‘আলাই তাদেরকে হত্যা করেন এবং হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) শত্র“পক্ষকে লক্ষ্য করে যে ধুলি নিক্ষেপ করেন, প্রকৃত পক্ষে তা আল্লাহ্ তা‘আলাই নিক্ষেপ করেন (সূরাহ্ আল্-আন্ফাল্ ঃ ১৭)। এ আয়াত থেকে এরূপ অর্থ গ্রহণের অবকাশ নেই যে, সকল মানুষের সকল কাজ আল্লাহ্ তা‘আলাই করেন বা তাদের দ্বারা করিয়ে নেন। কারণ, এ আয়াতে কোনো সাধারণ নিয়ম বিবৃত হয় নি, বরং একটি বিশেষ ঘটনা বিবৃত হয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলার সৃষ্টিলক্ষ্যকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য যখনই প্রয়োজন হয় তখনই আল্লাহ্ তা‘আলা সেখানে হস্তক্ষেপ করেন।

বদর যুদ্ধে মুসলমানরা সংখ্যা ও অস্ত্রশক্তিতে শত্র“র তুলনায় দুর্বল ছিলেন, কিন্তু আল্লাহ্ তা‘আলার সৃষ্টিলক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য তাঁদেরকে বিজয়ী করা অপরিহার্য ছিলো বিধায় আল্লাহ্ তা‘আলা ফেরেশতা নাযিল করে মুসলমানদেরকে সাহায্য করেন। তেমনি হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) কর্তৃক ধুলি নিক্ষেপের ঘটনাটিও আল্লাহ্ তা‘আলার প্রত্যক্ষ ইচ্ছার প্রভাবে সংঘটিত হয়েছিলো। এ ব্যতিক্রমী ঘটনা দ্বারা মানুষকে ইচ্ছাশক্তি বিহীন যান্ত্রিক অস্তিত্ব প্রমাণ করা সম্ভব নয়। বরং উল্লিখিত আয়াতেই মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতার প্রতি সুস্পষ্ট ও অকাট্য ইঙ্গিত রয়েছে। তা হচ্ছে, স্বয়ং আল্লাহ্ তা‘আলা হস্তক্ষেপ না করলে এ যুদ্ধে কাফেররা মুসলমানদেরকে পরাভূত করে ফেলতো। কারণ, কাফের ও মুসলিম উভয় পক্ষেরই স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতা রয়েছে, এমতাবস্থায় প্রাকৃতিক কারণবিধি অনুযায়ী সংখ্যা ও অস্ত্রশক্তিতে অধিকতর শক্তিশালী কাফেরদেরই বিজয়ী হওয়া ছিলো স্বাভাবিক, কিন্তু আল্লাহ্ তা‘আলা তা হতে দিতে চান নি।

(৮) আল্লাহ্ যাকে পথভ্রষ্ট করেন তাকে কেউ হেদায়াত করতে পারে না (সূরাহ্ আয্-যুমার ঃ ২৩) এবং আল্লাহ্ কাফেরদের অন্তরে মোহর মেনে দিয়েছেন (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ ঃ ৭)। এর মানে এ নয় যে, বিনা কারণেই আল্লাহ্ তা‘আলা কাউকে গোমরাহ্ করেছেন ও কাফের বানিয়ে দিয়েছেন বা তাদের ভাগ্যে গোমরাহী ও কুফরী নির্ধারণ করে দিয়েছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন ঃ

يضل به کثيرا و يهدی به کثيرا. و ما يضل به الا الفاسقين . الذين ينقضون عهد الله من بعد ميثاقه و يقطعون ما امر الله به ان يصل و يفسدون فی الارض.

“তিনি এর (মশার মতো তুচ্ছ প্রাণীর উপমা) দ্বারা অনেক লোককে পথভ্রষ্ট করেন ও অনেক লোককে পথপ্রদর্শন করেন। আর তিনি এর দ্বারা পাপাচারী (ফাছেক্ব) ব্যতীত কাউকে পথভ্রষ্ট করেন না Ñ (এই ফাছেক্ব লোকেরা হচ্ছে তারা) যারা আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকারকে পাকাপোক্ত করে নেয়ার পর তা লঙ্ঘন করে, আর আল্লাহ্ যা সংযুক্ত রাখার জন্য আদেশ করেছেন তা (সে সম্পর্ক) ছিন্ন করে এবং ধরণীর বুকে বিপর্যয় ও বিশৃঙ্খলা (ফাছাদ) সৃষ্টি করে।” (সূরাহ্ আল্-বাক্বারাহ্ ঃ ২৬)

আল্লাহ্ তা‘আলা যে বিনা কারণে নিজের পক্ষ থেকে কাউকে গোমরাহ্ করেন না এ আয়াত থেকে তা অকাট্যভাবে প্রমাণিত। তবে এই একই বিষয় আরো অনেক আয়াত থেকেও প্রমাণিত হয়। যেমন, এরশাদ হয়েছে ঃ

ساصرف عن آياتی الذين يتکبرون فی الارض بغير الحق. و ان يروا کل آية لا يؤمنوا بها. و ان يروا سبيل الرشد لا يتخذوه سبيلا. و ان يروا سبيل الغيی يتخدوه سبيلا. ذالک بانهم کذبوا بآياتنا و کانوا عنها غافلين.

“অচিরেই আমি তাদেরকে আমার নিদর্শনাদি থেকে ফিরিয়ে দেবো যারা অন্যায়ভাবে (অনধিকারমূলকভাবে) ধরণীর বুকে স্বীয় বড়ত্ব দাবী করে (গর্ব-অহঙ্কার ও দম্ভ করে)। আর তারা যদি প্রতিটি ঐশী নিদর্শনও দেখতে পায় তবু তাতে ঈমান আনয়ন করে না এবং তারা যদি সঠিক পথ দেখতে পায় তো তাকে চলার পথ হিসেবে গ্রহণ করে না। কিন্তু তারা যদি গোমরাহীর পথ দেখতে পায় তো তাকেই চলার পথ হিসেবে গ্রহণ করে। এর কারণ হচ্ছে এই যে, তারা আমার আয়াত (নিদর্শন) সমূহকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং তা থেকে উদাসীন হয়েছে।” (সূরাহ্ আল্-আ‘রাফ্ ঃ ১৪৬)

অন্যত্র এরশাদ হয়েছে ঃ

فريقا هدی و فريقا حق عليهم الضلالة. انهم اتخذوا الشياطين اولياء من دون الله و يحسبون انهم مهتدون.

“তিনি (আল্লাহ্) একদলকে পথপ্রদর্শন করেছেন এবং একদলের ওপর গোমরাহী অবধারিত করে দিয়েছেন। (কারণ,) অবশ্যই তারা (শেষোক্ত দল) আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে শয়তানদেরকে বন্ধু, অভিভাবক ও শাসক হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে এবং (এতদসত্ত্বেও) মনে করছে যে, তারা সঠিক পথে রয়েছে।” (সূরাহ্ আল্-আ‘রাফ্ ঃ ৩০)

এ আয়াতে লক্ষণীয় যে, আল্লাহ্ তা‘আলা কাফেরদের সম্পর্কে বলেন নি যে, তিনি তাদেরকে গোমরাহ্ করেছেন, বরং বলেছেন যে, তাদের ওপর ‘গোমরাহী অবধারিত করে দিয়েছেন’; এজন্য ব্যবহৃত “হাক্কা” (حَقَّ) ক্রিয়াপদ থেকে বুঝা যায় যে, এটাই তাদের হক্ব বা পাওনা হয়ে গিয়েছিলো। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের ওপর তা অবধারিত হবার কারণ বর্ণনা করেছেন।

আরো লক্ষণীয় বিষয় এই যে, হেদায়াত ও গোমরাহীর পথ সুস্পষ্ট থাকা সত্ত্বেও কেবল কুপ্রবৃত্তি বশে ও পূর্বপুরুষদের অন্ধ অনুসরণ বশতঃ মুশরিকরা তাওহীদের পক্ষে প্রাপ্ত বিচারবুদ্ধির রায়কে প্রত্যাখ্যান করে এবং এ ব্যাপারে অদৃষ্টবাদী কূটযুক্তি উপস্থাপন করে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন ঃ

و قالوا لو شاء الرحمان ما عبدناهم. ما لهم بذالک من علم. ان هم الا يخرصون. ام اتيناهم کتابا من قبله فهم مستمسکون. بل قالوا انا وجدنا اباءنا علی امة و انا علی آثارهم مهتدون.

“আর তারা বলে ঃ “পরম দয়াবান (আল্লাহ্) যদি (অন্যথা) চাইতেন তাহলে আমরা তাদের (ফেরেশতাদেরকে দেবী কল্পনা করে তাদের) উপাসনা করতাম না।” এ ব্যাপারে তাদের কোনো জ্ঞান নেই; তারা তো কেবল অনুমান ভিত্তিক কথা বলছে। আমি কি তাঁর [রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর আবির্ভাবের] পূর্বে তাদেরকে এমন কোনো কিতাব দিয়েছিলাম (যাতে কল্পিত দেবদেবীদের উপাসনার নির্দেশ ছিলো) এবং তারা তা আঁকড়ে ধরে আছে? বরং তারা বলে ঃ অবশ্যই আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে একটি আদর্শিক (বা ধর্মীয়) পথের অনুসরণকারী রূপে পেয়েছি এবং অবশ্যই আমরা তাদের পদাঙ্ক অনুসরণকারী।” (সূরাহ্ আয্-যুখরুফ ঃ ২০-২৩)

আল্লাহ্ তা‘আলা আরো এরশাদ করেন ঃ

و قال الذين اشرکوا لو شاء الله ما عبدنا من دونه من شيء نحن و لا آباؤنا و لا حرمنا من دونه من شيء. کذالک فعل الذين من قبلهم. فهل علی الرسل الا البلغ المبين.

“আর যারা র্শিক্ করেছে তারা বলে ঃ “আল্লাহ্ যদি (অন্যথা) চাইতেন তাহলে আমরা তাঁকে ছাড়া আরো কোনো কিছুরই ইবাদত করতাম না Ñ না আমরা, না আমাদের পূর্বপুরুষরা এবং আমরা তাঁর (হারামকৃত জিনিসগুলো) ব্যতীত কোনো কিছুকে হারাম করতাম না।” তাদের পূর্ববর্তীরাও এরূপই করেছিলো। এমতাবস্থায় রাসূলগণের ওপর সুস্পষ্টভাবে (সত্যকে) পৌঁছে দেয়া ছাড়া আর কোনো দায়িত্ব থাকে কি?” (সূরাহ্ আন্-নাহল: ৩৫)

(৯) আল্লাহ্ তা‘আলা হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর ওপর শীতল ও শান্তিদায়ক হবার জন্য আগুনকে নির্দেশ দেন (সূরাহ্ আল্-আম্বিয়া’ ঃ ৬৯) বলে আগুন তাকে পোড়াতে পারে নি। এ থেকে প্রমাণিত হয় না যে, আগুনের দহনক্ষমতা নেই এবং আল্লাহ্ যখন (প্রতি বার) তার মধ্যে দহনক্ষমতা সৃষ্টি করেন তখন সে দহন করে। বরং এ আয়াত থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, আগুনের দহনক্ষমতা রয়েছে। অর্থাৎ আল্লাহ্ তা‘আলা আগুনের মধ্যে দহনক্ষমতা দিয়েছেন এবং স্বাভাবিকভাবে দহন করাই তার কাজ। এ কারণেই, যেহেতু আল্লাহ্ তা‘আলা চান নি যে, হযরত ইবরাহীম (আঃ) অগ্নিদগ্ধ হোন, সেহেতু তিনি এখানে হস্তক্ষেপ করেন এবং আগুনকে (বিশেষভাবে কেবল) হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর ওপর শীতল হওয়ার জন্য নির্দেশ দেন। আগুনের মধ্যে যদি দহনক্ষমতা না থাকতো এবং প্রকৃত ব্যাপার যদি এমন হতো যে, আল্লাহ্ তা‘আলা কোনো জিনিসকে পোড়াতে চাইলে কারো হাতকে আগুন ধরাতে বাধ্য করেন অথবা কারো হাতের মাধ্যমে আগুন ধরান এবং এরপর আগুনের মধ্যে দহনক্ষমতা সৃষ্টি করেন, তাহলে হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর ওপর শীতল হওয়ার জন্য আগুনকে নির্দেশ দেয়ার প্রয়োজন হতো না। আগুন তার স্বভাবধর্ম অনুযায়ী হযরত ইবরাহীম (আঃ)কে পুড়িয়ে ফেলতো বিধায়ই আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে এ ক্ষেত্রে শীতল হবার নির্দেশ দেন।

(১০) আল্লাহ্ তা‘আলা কর্তৃক রাজ্য দান ও ছিনিয়ে নেয়া এবং সম্মানিত করা ও লাঞ্ছিত করার কাজটি কোনোরূপ কারণ ছাড়াই সংঘটিত হয় এরূপ মনে করার পিছনে কোনো অকাট্য দলীল নেই। যদিও চূড়ান্ত পর্যায়ে প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা‘আলার কল্যাণমূলক হস্তক্ষেপও একটি কারণ বটে। এ কাজ কোনোরূপ কারণ ছাড়াই সংঘটিত হলে যে সব আয়াতে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য মুসলমানদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে তা অর্থহীন হয়ে যেতো। শুধু তা-ই নয়, সংশ্লিষ্ট আয়াতের ধারাবাহিকতায় এরশাদ হয়েছে ঃ لا يتخذ المؤمنون الکافرين اولياء من دون المؤمنين.  Ñ “মু’মিনগণ যেন অন্য মু’মিনদেরকে বাদ দিয়ে কাফেরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে।” (সূরাহ্ আলে ‘ইমরান ঃ ২৮) এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, মু’মিনদের (এবং সকল মানুষেরই) স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ও কর্মক্ষমতা আছে; তাদের সকল কাজকর্ম আল্লাহ্ তা‘আলা পূর্ব থেকে নির্ধারণ করে রাখেন নি বা উপস্থিতভাবে প্রতি মুহূর্তে নির্ধারণ করে দেন না।

এখানে উল্লেখ্য যে, আলোচ্য আয়াতটিতে (সূরাহ্ আলে ‘ইমরান ঃ ২৬) মূলতঃ হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর মাধ্যমে মু’মিনদেরকে আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে সংশ্লিষ্টতা সৃষ্টি ও তাঁর ওপর নির্ভরতার (তাওয়াক্কুল) শিক্ষা দেয়া হয়েছে যা তাদের জন্য আল্লাহ্ তা‘আলার সাহায্য ও পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্তির সম্ভাবনাকে বৃদ্ধি করে।

(১১) সব শেষে উদ্ধৃত তিনটি আয়াতে আল্লাহ্ তা‘আলা কর্তৃক মাতৃগর্ভে মানুষের আকৃতি নির্ধারণ ও ছেলে বা মেয়ে হওয়ার বিষয়টি নির্ধারণ সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তাতে মানব শিশুর জন্মের ক্ষেত্রে পিতামাতা ও প্রাকৃতিক কার্যকারণ সমূহকে অস্বীকার করা হয় নি, কেবল এ ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তা‘আলার হস্তক্ষেপের ভূমিকা তুলে ধরা হয়েছে। তবে বিশেষ করে আকৃতি নির্ধারণের বিষয়টি আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া  প্রবর্তনের মাধ্যমেও হতে পারে। এভাবে প্রতিটি মানুষের আকৃতিতে, বিশেষতঃ চেহারায় অন্য মানুষ থেকে কিছু না কিছু পার্থক্য থাকেই যার ফলে তাদেরকে পরস্পর পৃথক করে চেনা যায়। কিন্তু এসব আয়াত থেকেও প্রমাণিত হয় না যে, আল্লাহ্ তা‘আলা সৃষ্টিকর্মের সূচনাকালে বা প্রতিটি মানুষের মাতৃগর্ভে আসার পর তার ভবিষ্যত ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এমনকি সংশ্লিষ্ট আয়াতে বর্তমান কাল বাচক ক্রিয়াপদ ব্যবহার থেকে এ-ও প্রমাণিত হয় যে, ছেলে সন্তান ও মেয়ে সন্তানের বিষয়টি আল্লাহ্ তা‘আলা সৃষ্টিকর্মের সূচনায় নির্ধারণ করে রাখেন নি।

images/stories/jabr.jpg

Leave A Reply

Your email address will not be published.