মানুষ ও তার সৃষ্টিরহস্য, আত্মপরিচিতি (২য় পর্ব)

0 1,167

ghorani negar (7)

মো. আলী নওয়াজ খান
সৃষ্টিতত্ত্বের রহস্য বা আত্মপরিচিতি সংক্রান্ত জ্ঞান প্রতিটি ব্যক্তির জন্য একটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য বিষয়। কেননা প্রতিটি ব্যক্তি তার নিজের অবস্থান, ক্ষমতা, সূচনা এবং শেষ পরিণতি বা গন্তব্য সম্পর্কে জ্ঞান না রাখলে সে নিজের কল্যাণ ও অকল্যাণ সম্পর্কেও কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। অপরিচিত বস্তুর ব্যবহার প্রণালীও তার কাছে অপরিচিত থেকে যাবে। তাই ঐ অপরিচিত বস্তু সম্পর্কে কোন ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হলে তার সর্বপ্রথম দায়িত্ব হল তার সম্বন্ধে যথাযথ জ্ঞান লাভ করা।
আত্মপরিচিতির গুরুত্ব সকল পরিচিতির শীর্ষে কেননা যে নিজের সম্পর্কে কোন ধারণাই রাখে না সে কিভাবে অন্যসব অস্তিত্বের পরিচিতি লাভ করবে ? আদৌ সম্ভব নয়। কারণ প্রতিটি ব্যক্তির সর্বাধিক নিকটতম জিনিস হল সে নিজেই তাই যে তার সবচেয়ে কাছের জিনিসকেই চেনে না সে কিভাবে তার থেকে যেসব বস্তু দূরে অবস্থান করছে তাদের যথার্থ ধারণা লাভ করবে ? শুধু তাই নয় প্রতিটি বস্তু সম্পর্কে যেকোন ধারণা লাভের ক্ষেত্রে দুটি মাধ্যম কাজ করে থাকে যার একটি হল সে নিজে আর অপরটি হল অপরিচিত বস্তু তাই যার মাধ্যমে ‘আমি’ জিনিসটা জানতে চাচ্ছ্ িসেটাই যদি অজানা থাকে তাহলে ঐ অপরিচিত বস্তুর পরিচিয় আমাদের কাছে ভ্রান্ত রূপধারণ করবে।
আত্মপরিচিতির মুল লক্ষ্য হল খোদা পরিচিতি লাভ করা কেননা পবিত্র হাদিসে বলা হয়েছে : মহানবী (স.) বলেন : যেব্যক্তি তার নিজ সত্তার পরিচিতি লাভ করতে পেরেছে সে মহান প্রভুকে চিনতে পেরেছে।’
অতএব উক্ত হাদীসের সারমর্ম হচ্ছে : আত্মপরিচিতির মধ্যে খোদা পরিচিতি লুকিয়ে রয়েছে। উল্লেখিত প্রসিদ্ধ হাদিসের কথাই পবিত্র কুরআনে সুরা হাশরের ১৯ নম্বর আয়াতে ভিন্ন ভঙ্গিতে মহান স্রষ্টা ব্যক্ত করেছেন। মহান প্রভু বলেন : ‘তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে ফলে আল্লাহ্ তাদেরকে আত্মবিস্মৃত করে দিয়েছেন।’
এ কথার অর্থ হল আল্লাহকে ভুলে যাওয়া সমান নিজ সত্তাকে ভুলে যাওয়া। আসলে কি মানুষ নিজ সত্তাকে ভুলে যায় ?! পৃথিবীতে কি এমন কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ আছেন যে নিজকে ভুলে গেছেন বলে বিশ্বাস করবেন ? হয়ত এমন কোন বুদ্ধিজীবি বা আধুনিক জ্ঞানে পন্ডিত পাওয়া যাবে না যে, ‘মানুষ তার আত্মপরিচিতি ভুলে যায়’ মতবাদে বিশ্বাস করবেন। কিন্তু পবিত্র কুরআনের ভাষায় এমন অনেক মানুষ আছেন যারা নিজ সত্তাকে নিজের আত্মপরিচয়কে ভুলে পৃথিবীতে অবস্থান করছেন।
পবিত্র কুরআনের ভাষায় নিজ সত্তা বলতে তার ঐশী পরিচিতিকেই বুঝানো হয়েছে না তার পাশবিক সত্তাকে। প্রতিটি মানুষের দু’ধরনের প্রকৃতি কাজ করে থাকে যার একটি তাকে কল্যাণ, নিষ্ঠা, সততা ও খোদার দিকে ধাবিত করে এ জাতীয় প্রবৃত্তি মানুষের রূহ্ বা ঐশী সত্তা থেকে উৎসরিত হয়ে থাকে। আর যে প্রবৃত্তি মানুষকে বস্তুজগতের দিকে ধাবিত করে বা পাশবিক চাহিদা নিবারণের জন্য উদ্দীপকের ভুমিকা পালন করে তাকে ‘পাশবিক সত্তা’ বা নাফস্ বলে। ফলে প্রত্যেকের বস্তু সত্তা দুনিয়ার পরিচয় বহন করে মাত্র, আর এ দুনিয়ার পরিচয়পত্র নিয়ে কখনো আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করা সম্ভব নয় ; কেবল পশুজগতে চলাফেরা করা সম্ভব।
আমাদের পরিচয়ের মূল হল আল্লাহ্ ; ‘ইন্না লিল্লাহ’ (আমরা আল্লাহ্ হতে এবং তার কাছেই প্রত্যাবর্তন করব) না পাশবিক অবকাঠামো ও অবয়ব যা দুনিয়ার রস ও গন্ধের পরিচয় বহন করে এবং তাকে এখানেই (দুনিয়ায়) রেখে পরপারে পাড়ি দিতে হবে। অতএব মানব সত্তার মূল পরিচয় হল ঐশী সত্তার বিচ্ছুরণ। তার দেশ হল ‘আল্লাহ্’ যেখান থেকে সে এসেছে। অবশেষে সেখানেই সে প্রত্যাবর্তন করবে।
যা হোক এ আলোচনাগুলো পরে আসবে তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল আত্মপরিচিতির গুরুত্ব নিঃসন্দেহে অপরিসীম । কেননা আত্মপরিচিতির সাথে খোদাপরিচিতির বন্ধন আটকে আছে। এ গুরুত্বের কথা বর্ণিত হয়েছে নিচের হাদীসে : ইমাম জাফর সাদিক (আ.) বলেন: ‘ মানুষ যদি আল্লাহ পরিচিতির ফজিলত সম্পর্কে অবগত থাকত তাহলে প্রভু তার দুশমনদেরকে পৃথিবীর জৌলুশময় উপভোগ্য দ্রব্যাদি যাকিছু দিয়েছেন তা [পাওয়া আশায়] তার প্রতি চোখ মেলে তাকাত না। তখন তাদের নিকট পৃথিবীর মুল্য হতো তাদের পায়ের নিচের ধুলার চেয়েও কম। তারা যদি মহান খোদা পরিচিতির অনুগ্রহ লাভে সক্ষম হয় তাহলে আল্লাহর বন্ধুদের সাথে তারা বেহেস্তের বাগবাগিচা হতে অফুরান্ত তৃপ্তিতে পরিতৃপ্ত হতেন। নিশ্চয় আল্লাহ্ পরিচিতি দুঃসময়ের অন্তরঙ্গ বন্ধু। এবং সকল একাকীত্ব মুহূর্তের সাথী। এবং যখন সকল আধাঁর তাকে গ্রাস করতে আসে সে সময়ের আলোকবর্তিকা। এবং যখন সকল শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায় সে মুহূর্তের পূর্ণ শক্তি দাতা। এবং সকল রোগের আরোগ্য। [মিযানুল হিকমাহ্ গ্রন্থের ৪০৮১ নম্বর হাদীস]।
আত্মপরিচিতি লাভে যারা অক্ষম পাশবিক স্তরের পরিচয় নিয়ে পৃথিবীতে চলাফেরা করে সেসব মানুষদের পারলৌকিক জীবনের অবস্থার বেশকিছু নমুনা পবিত্র কুরআনে বিভিন্নভাবে বর্ণিত হয়েছে যার কয়েকটি নমুনা এখানে উপস্থাপন করা হল :
১. তাদের কেউ কেউ তোমার কথা শোনার জন্য কান পেতে দেয় (তারা যেন কোন কিছুই শুনতে পায় না) ; তুমি কি বধিরদের কিছু শোনাতে পারবে যদি তারা উপলব্ধি না করে। আবার তাদের কেউ কেউ তোমার প্রতি চোখ মেলে তাকায় (কিন্তু তারা যেন কিছুই দেখতে পায় না) ! তুমি কি অন্ধদের পথ দেখাতে পারবে ? যদি তারা দেখতে না পায়। [সুরা ইউনুস: ৪২-৪৪ নম্বর আয়াত]
২. যারা এ পৃথিবীতে (সত্য পরিচিতি লাভে) অন্ধ থাকবে তারা পরকালেও অন্ধ থাকবে ; [তারা] চরম বিভ্রান্ত পথিক। [সুরা বনি ইসরাইল: ৭২ আয়াত]
৩. আমার স্মরণ (পরিচিতি) থেকে যে মুখ ফিরিয়ে নেবে তার পার্থিব জীবনকে (জীবিকা) কঠিন ও সংকুচিত করে দেয়া হবে এবং আমি তাকে পরকালে অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করব। তখন সে বলবে : হে আমার প্রভু আমাকে কেন অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করলেন ? আমি [দুনিয়াতে] চক্ষুষ্মান ছিলাম। মহান আল্লাহ বলবেন : এমনি ভাবেই আমার নির্দশন সমূহও তোমার কাছে [চারপাশে] ছিল কিন্তু তুমি সেসব ভুলে ছিলে। তেমনিভাবেই আজ আমি তোমাকে ভুলে যাব। [সুরা তাহা : ১২৫-১২৭ নম্বর আয়াত]
৪. নিশ্চয় আমি জ্বীন এবং মানুষদের অনেক দলকে জাহান্নামের জন্য সৃষ্টি করেছি। তাদের অন্তর রয়েছে কিন্তু তা দিয়ে তারা বিবেচনা ও উপলব্ধি করে না; তাদের চোখ রয়েছে কিন্তু তা দিয়ে তারা দেখে না ; তাদের কান রয়েছে কিন্তু তা দিয়ে তারা শোনে না ; তারা চতুষ্পদ জন্তুর মত ; বরং তার চেয়েও নিকৃষ্টতম [কেননা এদের সকল উপকরণ থাকা সত্ত্বেও এরা পথচ্যুত বিভ্রান্ত]। প্রকৃতপক্ষে তারাই উদাসীন, গাফেল এবং শৈথিল্যপরায়ণ। [সুরা আরাফ : ১৭৯ নম্বর আয়ত]
তাদের এ জাতীয় অবস্থার মুলত: কারণ হল তারা যা জানে তা তাদের পাশবিক জীবনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তারা অর্থ সম্পদ সঞ্চয়ের হাতিয়ার মূলক কিছু বিদ্যা মুখস্ত করে রাখে মাত্র। আর সম্পদ সঞ্চয়ের পর তা উপভোগ করার নানান কৌশল তারা প্রস্তুত করে। বর্তমান বিশ্বের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা হল উপভোগের পরিধি ও গভরীতা বৃদ্ধির নিত্যনতুন সরঞ্জাম আবিষ্কার করা। এ লক্ষ্য নিয়েই বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের সকল প্রচেষ্টা। পাশ্চাত্য সভ্যতায় রেনেসাঁর পরবর্তী যুগে এসে জ্ঞানের যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তা সম্পূর্ণ ইসলামী সভ্যতার বিপরীতে অবস্থান করছে। ফ্রান্সিস বেক্যন বলতেন : শক্তিই জ্ঞান। আর মহাকবি ফেরদৌসী কাব্যিক ছন্দে বলেছেন : জ্ঞানই শক্তি। এ দুয়ের মধ্যেই সেকুলার সমাজের জ্ঞান ও ইসলামী সংস্কৃতিতে জ্ঞানের ভাবমূর্তি ফুটে উঠেছে। মহান আল্লাহ ঐ জাতীয় মানুষদের (সেকুলার বা ধর্মহীন) চিন্তার বা জ্ঞানের পরিধির পরিচয়ও পবিত্র কুরআনে দিয়েছেন। তিনি বলেন : তারা পার্থিব জীবনের বাহ্যিক দিক সম্পর্কে অবগত আছে মাত্র আর পরকাল সম্পর্কে তারা কোন জ্ঞান রাখে না। [সুরা রূম : ৭ নম্বর আয়াত]
অতএব হে মানুষ পশুর মত তোমরা কোথায় ছুটে চলেছো ? পবিত্র কুরআনের আহ্বান শোন ‘এটি তো বিতাড়িত শয়তানের ভাষ্য নয়। অতএব তোমরা কোথায় চলেছো’ ?! [সুরা তাকভীর : ২৫-২৬ নম্বর আয়াত]
আমরা আমাদের আলোচনায় ফিরে আসি অতএব, কান, চোখ ও অন্তর থাকলেই যে আমরা সবকিছুর পরিচিতি লাভ করতে পারবো এমনটি নয়। কেননা তার উপর যদি পাশবিক সত্তা প্রধান্য লাভ করে তাহলে তার সকল ইন্দ্রিয়শক্তিকে পাশবিক জগতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ করে রাখবে। আর যদি তার ঐ সত্তার প্রাধান্য লাভ করতে পারে তাহলে তার সকল শক্তিকে প্রভুর দিকে ধাবিত করবে এবং তখন তার দুনিয়াও ঐশী রূপ লাভ করবে কেননা প্রসিদ্ধ হাদীসে বলা হয়েছে : পরহেজগার লোকদের জন্য ‘দুনিয়া হল পরকালে শষ্যক্ষেত্র’। অতএব, সে এখান থেকে তার নিজে জান্নাতের সরঞ্জাম নিয়ে যাবে। এদের জন্য দুনিয়া একটি বিশেষ সুযোগ এবং কল্যাণের ক্ষেত্র। আর যাদের উপর পশুসত্তা প্রাধান্য লাভ করেছে সে-ই সব দুনিয়াদার লোকেরা পৃথিবী থেকে জাহান্নামের আগুন সঞ্চয় করে সাথে নিয়ে যায় যে আগুনে সে নিজেই জ্বলবে।
সক্রেটিস (৫০০ খৃ.পূ) আত্মপরিচিতি সম্পর্কে বলেন : অহেতুক নি®প্রাণ ও শুষ্ক বস্তু পরিচিতি লাভে এত পরিশ্রম করো না বরং নিজকে জান কেননা আত্মপরিচিতি প্রকৃতির রহস্য উদ্ঘাটনের চেয়ে অধিক মুল্যবান।
মহাত্ম গান্ধী তার ‘এটাই আমার ধর্ম’ নামক গ্রন্থে বলেছেন : আমি উপনিশদ অধ্যায়ন করে তিনটি মুল বিষয় উপলব্ধি করতে পেরেছি যা আমার জীবনব্যাপী শিক্ষণীয় ছিল ।
প্রথমটি হল ; এ বিশ্বে পরম সত্যে উপনীত হওয়ার জন্য কেবল একটিই পথ রয়েছে আর তা হল আত্মপরিচিতি।
দ্বিতীয় : যে সত্যিকার অর্থে নিজেকে চিনলো সে তার প্রভুর পরিচিতিও লাভ করলো।
তৃতীয় : পৃথিবীতে প্রকৃত অর্থে মাত্র একটিই শক্তি, স্বাধীনতা ও ন্যায়নীতি রয়েছে। আর তা হল নিজকে অধীন করে নিয়ন্ত্রণ করার শক্তি, নিজকে সকল প্রকারের টান ও আসক্তি থেকে মুক্ত করা এবং সবশেষে ভারসম্যপূর্ণ জীবনে উপনীত হওয়া। তাই যে নিজকে নিজ আয়ত্বে আনলো সে সকল বস্তুকে নিজের অধীন করল।
পাশ্চাত্যের খ্যাতনামা ফিজিওলজিষ্ট আলিকসিন কার্ল বলেন : আমরা এখানে আরাম ও উপভোগের সকল সরঞ্জাম ও কর্মক্ষেত্রে গতি এবং মানুষের জীবনযাপনের উন্নতমানের সকল উপকরণ প্রস্তুত করেছি। তবে কখনোই আমরা নিজকে চিনতে পারি নি। প্রকৃতপক্ষে আমরা নিজেদের সম্পর্কে চরম উদাসীন। যার ফলে বিজ্ঞানের অগ্রগতি আমাদেরকে সাফল্যমন্ডিত করতে সক্ষম হয় নি। তাই সুক্ষ্মভাবে তাকালে আমরা দেখতে পাই আমাদের উত্তেজনা, দুশ্চিন্তা ও উৎকন্ঠাজনক অশান্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। [ ইসলাম পরিচিতি’ লেখক হাসানে কাফী, ২য় খণ্ড ৫২৯ পৃ.]
আত্মপরিচিতির গুরুত্ব অনুধাবনের পর আত্মপরিচিতির সুফলগুলোর সাথেও আমরা সংক্ষেপে পরিচিত হব। নিঃসন্দেহে আত্মপরিচিতি অনেক সুফল রয়েছে যার বেশ কয়েকটির লক্ষ্যের কথা উল্লেখ করা হল :

আত্মপরিচিতির মূল লক্ষ্য কি ?
অত্মপরিচিতির অনেক গুলো লক্ষ্য থাকতে পারে যেমন :

১. আত্মজ্ঞান লাভ করা :
পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন স্থানে মানুষকে তার নিজের সম্পর্কে অবগত হওয়ার প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে যেমন সুরা তারিক-এর ৫ নন্বর আয়াতে বলা হয়েছে মানুষের ভেবে দেখা উচিত যে কি দিয়ে তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে ? মানুষের সৃষ্টিকার্যের মধ্যেও ঐশী নিদর্শন লুকিয়ে রয়েছে তা প্রত্যক্ষ করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। [সুরা যারিয়াত : ২১ নম্বর আয়াত]

২. নিজের প্রতিভা সম্পর্কে অবগত হওয়া : ইমাম আলী বলেন : যে ব্যক্তি নিজের পরিচিতি এবং কি লক্ষ্যে সৃষ্টি হয়েছে সেসব বিষয় জানে না সে নিজকে ধ্বংসে নিপাতিত করলো।[নাহজুল বালাগা ১৪৯ নম্বর হিকমাত মুলক বাক্য] ইমাম জাফর সাদেক (আ.) বলেন : মুমিন ব্যক্তির জন্য এটি যথাপোযুক্ত নয় যে সে নিজেকে হেয় ও অবমুল্যায়ন করবে। বর্ণনাকারী প্রশ্ন করেন : কিভাবে মানুষ নিজকে অবমুল্যায়ন করে থাকে ? তিনি বলেন : সে এমন কাজে হাত দেয় যা তার দ্বারা সম্ভব নয়।

৩. নিজকে মুল্যায়ন করা :
পবিত্র সুরা সোয়াদের ৭১ ও ৭২ নম্বর আয়াতদ্বয়ে হযরত আদম (আ.)-এর সৃষ্টিলগ্নের কথা উল্লেখ হয়েছে মহান আল্লাহ বলেন : “যখন আমি ফেরেস্তাদের বললাম: আমি মাটি থেকে মানুষ সৃষ্টি করতে চাই। তাই যখন তার রূপদান করলাম এবং আমার রূহ থেকে ফুঁকে দিলাম তখন তোমরা সকলেই তাকে সিজদা করবে।”
অতএব মানুষ এমন এক সৃষ্টি যে সৃষ্টিকে মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের বেশ কয়েকটি স্থানে নিজের সাথে সম্পর্কযুক্ত করেছেন। যেমন আমরা পূর্বে প্রত্যক্ষ করেছ যে স্রষ্টা বলেছেন, ‘আমি আমার নিজের রূহ থেকে ফুঁকে দিচ্ছি’। একথাটি যদি এভাবে আসতো যে তাকে রূহ ফুঁকে দেয়া হয়েছে তাহলে তার অর্থ ভিন্ন হত। কেননা মহান সত্তার সাথে সম্পর্ক যে কোন অস্তিত্বকে মহত্ব দান করে থাকে আর এর বিপরীতে খারাপ সত্তার সাথে সম্পর্কযুক্ত অস্তিকেও নিঃসন্দেহে নেতিবাক প্রভাব প্রতিপন্ন করবে। তাই নিঃসন্দেহে এটি একটি মহান অস্তিত্ব। যে অস্তিত্বের সৃষ্টিকার্যের ক্ষেত্রে মহান আল্লাহ ইবলিসকে সম্বোধন করে বলেছেন ‘ইবলিস তোমার এমন কি হয়েছিল যে অস্তিত্বকে ‘আমি নিজ হাতে সৃষ্টি করেছি’ তাকে সিজদা করা থেকে বিরত থাকলে ?! এখানেও কিন্তু নিজের সাথেই একটি বিশেষ সংযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। সৃষ্টিকুলের স্রষ্টার সাথে এজাতীয় সংযোগ ঐ সৃষ্টির বিশেষ অবস্থান ও মর্যাদার কথাই প্রমাণ করে। অস্তিত্ব জগতে এমন মর্যাদা আর কোন সৃষ্টিকেই দেয়া হয় নি একথা পবিত্র কুরআনে আল্লাহর রাব্বুল আলামীন এভাবে উল্লেখ করেছেন, ‘নিশ্চয় আমি আদম সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি।’ [সুরা ইসরা : ৭০ নম্বর আয়াত] । শুধু তাই নয় জমীনে যা কিছু আছে সে সবকিছু এ বিশেষ অস্তিত্বের জন্যেই মহান আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। আর জমীন ও আসমান সমূহে যা কিছু আছে সবই মানুষের অধিন করে দিয়েছেন।

৪. প্রভু ও বিশ্বের সাথে সম্পর্ক :
আত্ম পরিচিতির একটি মুল বিষয় হল তার সাথে তার স্রষ্টার সম্পর্ক অবগত হওয়া এবং পারলৌকিক জগত সম্পর্কে সে অবগত হবে। ইমাম আলী (আ.) এ প্রসঙ্গে বলেন : আল্লাহ ঐ ব্যক্তির উপর অনুগ্রহ বর্ষণ করুন যে অবগত হয়েছে কোথথেকে এসেছে কোথায় অবস্থান করছে এবং অবশেষে কোথায় ফিরে যাবে ? আত্মপরিচিতির মূল লক্ষ্য হল স্রষ্টার সাথে পরিচিত হওয়া। আর এটিই হল সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচিতি।
সৃষ্টিকুলের শ্রেষ্ঠজীব মানুষকে মহান আল্লাহ্ তায়ালা অত্যন্ত সম্মান এবং ভালবাসার পরশে সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলেন : নিশ্চয় আমি আদম-সন্তানকে অতি মর্যাদা দান করেছি। [বনি ইসরাইল : ৭০] । তিনি আরো বলেন : ‘আমি স্বহস্তে তোমাকে সৃষ্টি করেছি’ [সুরা সোয়াদ : ৭৫] এ মানুষকে পৃথিবীতে চলার সকল উপযুক্ত উপকরণ তিনি দান করেছেন। তাকে দিয়েছেন শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তি ও অন্তর। যাতে সে এ পৃথিবীতে যথাযথভাবে বসবাস করতে পারে এবং ন্যায়-অন্যায় সত্য মিথ্যাকে পৃথক করে স্রষ্টার দেখানো পথে চলতে পারে। তাই মানুষ আত্মপরিচিতির মাধ্যমে নিজ স্রষ্টার পরিচিতি লাভ করবে। এ আত্মপরিচিতি লাভের ক্ষেত্রে আমরা আমাদের আলোচনাকে দুটি ভাগে বিভক্ত করেছি যার একটি হল মানুষের বস্তুদেহের সৃষ্টি প্রনালী, আর অপরটি হল তার অবস্তুগত সত্তা রূহ সংক্রান্ত আলোচনা।
সৃষ্টিজগতে পাশবিক স্তর ও মানবিক স্তর পরস্পর পাশাপাশি অবস্থানের ফলে এবং মানুষের মধ্যে পৈশাচিক বৈশিষ্ট্যসমূহ পূর্ণভাবে উপস্থিত থাকার কারণে অনেকে মানুষকেও পশুশ্রেণীর পাণীদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এ মতাদর্শের মধ্যে বৃটিশ দার্শনিক হাবেজ এবং ডের্কাট উল্লেখযোগ্য।
তাই মানুষের সৃষ্টিপ্রক্রিয়াকে জানতে হলে তার বস্তুগত সত্তা ও অবস্তুগত সত্তাকে নিয়ে আলোচনা করা উচিত।
মানুষের বস্তুগতসত্তা হল তার বাহ্যিক রূপ বা অবয়ব যা মাতৃগর্ভ থেকে ভুমিষ্ঠ হওয়ার মাধ্যমে সে লাভ করে। মানব জাতির বস্তসত্তার সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার বিস্তার দুটিসূত্রে সংঘটিত হয়েছে (১) আদিপিতা হযরত আদম (আ.)-এর সৃষ্টি প্রক্রিয়া (২) আদম সন্তানগণের সৃষ্টিপ্রক্রিয়া।

Leave A Reply

Your email address will not be published.