আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’র কল্পকাহিনী-2

0 505

আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’র কল্পকাহিনী

 বিগত এক হাজার বছর যাবত ঐতিহাসিকগণ “আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা” ও তার অনুসারী “সাবায়ীদের” সম্পর্কে বিস্ময়কর কাহিনী বর্ণনা করে আসছেন। প্রশ্ন হচ্ছে ঃ
 ক) আবদুল্লাহ্‌ কে ছিল এবং তারা অনুসারী সাবায়ীরা কারা ছিল?
 খ) আবদুল্লাহ্‌ কী বলেছিল এবং সে কী করেছিল?
ঐতিহাসিকদের লেখা কাহিনীর সারসংক্ষেপ
 তৃতীয় খলীফাহ্‌ হযরত ওসমানের শাসনামলে সান্‌‘আ (ইয়ামান)-এর জনৈক ইয়াহূদী ইসলাম গ্রহণের ভান করে এবং ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে। সে দেশ ভ্রমণে বের হয় এবং কুফা, বসরা, দামেশ্‌ক্‌ ও কায়রোর ন্যায় তৎকালীন বড় বড় শহরে গমন করে। সে এসব জায়গায় প্রচার করে যে, কিয়ামতের পূর্বে হযরত ঈসা (আঃ)-এর পৃথিবীর বুকে প্রত্যাবর্তনের ন্যায় রাসূলে আকরাম হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) পুনরুজ্জীবিত হবেন। সে আরো প্রচার করে যে, অন্যান্য নবী-রাসূলের (আঃ) যেমন অছি বা উত্তরাধিকার ছিলেন ঠিক সেভাবেই হযরত আলী (আঃ) হচ্ছেন হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর অছি বা উত্তরাধিকারী এবং হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) যেমন খাতামুল আম্বিয়া (শেষ নবী) তেমনি হযরত আলী (আঃ) হচ্ছেন খাতামুল আওছিয়া (শেষ অছি)। কিন্তু ওসমান তাঁর অধিকার আত্মসাৎ করেছেন এবং তাঁর প্রতি অন্যায় করেছেন। অতএব, ওসমানের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করা এবং যার অধিকার তাঁকে ফিরিয়ে দেয়া অপরিহার্য।

 ঐতিহাসিকগণ এ কাহিনীর নায়কের নাম আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’ ও তার লকব বা ডাকনাম ইবনে আমাতুস্‌ সাওদা’ (কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসীর পুত্র) বলে উল্লেখ করেছেন।
 আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’ তৎকালীন ইসলামী খেলাফতের আওতাধীন মুসলিম অধ্যুষিত শহরগুলোতে নিজের পক্ষ থেকে মুবাল্লিগ (প্রচারক) পাঠায় এবং তাদেরকে এ মর্মে নির্দেশ দেয় যে, তারা যেন ‘আম্‌র্‌ বিল্‌ মা‘রূফ্‌ ওয়া নাহী ‘আনিল্‌ মুন্‌কার্‌ (ভাল কাজের আদেশ দান ও মন্দ কাজ প্রতিরোধ)-এর নামে সমকালীন প্রশাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ও তাদেরকে হত্যা করে। এর ফলে বিপুল সংখ্যক মুসলমান তার ভক্ত হয়ে যায় এবং তার কর্মসূচী কার্যকরকরণে অংশগ্রহণ করে। শেষ পর্যন- আবু যার, ‘আম্মার বিন্‌ ইয়াসার, আবদুর রহমান বিন্‌ ‘আদীস্‌ প্রমুখ বেশ কয়েক জন শীর্ষস্থানীয় আছ্‌হাবে রাসূল (সাঃ) এবং মালেক আশ্‌তারের ন্যায় কয়েক জন শীর্ষস্থানীয় নেককার তাবে‘ঈ১ তার দলে শামিল হয়ে যান।
 বলা হয়েছে, সাবায়ীরা যেখানেই ছিল সেখানেই তাদের নেতার পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্যে স্থানীয় প্রশাসকদের বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলে ও বিদ্রোহ সৃষ্টি করে। তারা সমকালীন সরকারের বিরুদ্ধে সমালোচনা করে প্রচারপত্র লিখতো এবং তা অন্যত্র পাঠাতো। তাদের এ প্রচারের ফল হল এই যে, এ উস্কানিতে ক্ষিপ্ত হয়ে একদল মুসলমান মদীনায় রওয়ানা হয়ে যায়। তারা খলীফাহ্‌ হযরত ওসমানকে তাঁর গৃহে অবরুদ্ধ করে এবং শেষ পর্যন্ত ঘটনা তাঁর হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত গড়ায়। এ সমস্ত কাজই সাবায়ীদের উদ্যোগে ও নেতৃত্বে সংঘটিত হয়।
 আরো বলা হয়েছে, মুসলমানরা খলীফাহ্‌ হিসেবে হযরত আলী (আঃ)-এর অনুকূলে বাই‘আত (আনুগত্য শপথ) করার পর ত্বাল্‌হা ও যুবাইর ওসমানের হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ গ্রহণ ও জঙ্গে জামালে (উটের যুদ্ধে) অংশগ্রহণের জন্যে বছরায় চলে যান। সেখানে বছরার বাইরে জঙ্গে জামালের সেনাপতি হিসেবে এক পক্ষে তাঁদের দু’জনের ও অপর পক্ষে খলীফাহ্‌ হিসেবে হযরত আলী (আঃ)-এর মধ্যে সমঝোতা ও সন্ধির উদ্যোগ নেয়া হয়। তখন সাবায়ীরা দেখল যে, এ ধরনের সমঝোতা অনুষ্ঠিত হলে সাবায়ীরাই যে ওসমান হত্যার আসল নায়ক এ তথ্য ফাশ হয়ে যাবে। ফলে তারা বিপদে পড়ে যাবে। তাই তারা রাতের বেলা সিদ্ধান- নিল যে, যে কোন পন্থায় ও যে কোন কৌশলেই হোক তারা যুদ্ধের আগুন প্রজ্জ্বলিত করবে। সিদ্ধান্ত হয় যে, গোপনে তাদের একটি দল হযরত আলী (আঃ)-এর বাহিনীতে এবং অপর একদল ত্বাল্‌হা ও যুবাইরের বাহিনীতে যোগদান করবে ও উভয় বাহিনীকেই পরস্পরের বিরুদ্ধে হামলার জন্যে এমনভাবে উস্কানি দেবে যাতে কেউ বুঝতে না পারে যে, এর পিছনে সাবায়ীদের ষড়যন্ত্র কাজ করেছে।
 তারা অত্যন- ভালভাবেই এ ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত করে। ত্বাল্‌হা ও যুবাইরের বাহিনীর মধ্যে লুকিয়ে থাকা সাবায়ীরা রাতের অন্ধকারে হযরত আলী (আঃ)-এর বাহিনীর দিকে এবং হযরত আলী (আঃ)-এর বাহিনীর মধ্যে লুকিয়ে থাকা সাবায়ীরা ত্বাল্‌হা ও যুবাইরের বাহিনীর প্রতি তীর বর্ষণ করে। ফলে উভয় বাহিনীর মধ্যেই পরস্পরের প্রতি ভয় ও সন্দেহ সৃষ্টি হয় এবং এর পরিণামে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।
 বলা হয়েছে, জঙ্গে জামাল এভাবেই সংঘটিত হয়। নইলে দুই পক্ষের সেনাপতিদের কেউই যুদ্ধ করতে চান নি এবং তাঁরা জানতেন না এ যুদ্ধের জন্যে প্রকৃত দায়ী কে।
 এ ঘটনার মূল বর্ণনাকারী সাইফ বিন্‌ ওমর সাবায়ীদের গল্পকে এখানেই শেষ করেছে। এর পর তাদের কী হলো সে সম্পর্কে আর কোনো কথা বলে নি।
 মোটামুটি এই হলো সাবায়ীদের সংক্রান- কাহিনী। এ বর্ণনার যথার্থতা সম্বন্ধে বিস্তারিত বিশ্লেষণের আগে আমরা দেখবো যে, এতে কোন কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে সাবায়ী বলে উল্লেখ করা হয়েছে; এরপর তাঁদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরবো।
এ পর্যায়ের ব্যক্তিগণ হলেন ঃ
 ক) আবু যার
 খ) ‘আম্মার বিন্‌ ইয়াসির
 গ) মুহাম্মাদ বিন্‌ আবি হুযাইফাহ্‌
 ঘ) আবদুর রহমান বিন্‌ ‘আদীস্‌
 ঙ) মুহাম্মাদ বিন্‌ আবু বাক্‌র্‌
 চ) ছা‘ছা‘আহ্‌ বিন্‌ ছুহান্‌
 ছ) মালেক আশ্‌তার্‌।
১) আবু যার
 তাঁর মূল নাম জুন্দুব্‌ বিন্‌ জুনাদাহ্‌, ডাকনাম আবু যার গিফারী। তিনি হচ্ছেন ইসলাম গ্রহণকারী চতুর্থ ব্যক্তি। এমন কি ইসলাম গ্রহণের পূর্বেও তিনি একজন তাওহীদবাদী ছিলেন। তিনি পবিত্র মক্কা নগরীর মসজিদুল হারামে তাঁর ইসলাম গ্রহণের কথা ঘোষণা করেন। এ কারণে কুরাইশরা তাঁর ওপরে নির্যাতন চালিয়ে তাঁকে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়, কিন্তু তিনি বেঁচে যান এবং হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর নির্দেশে স্বীয় গোত্রের নিকট ফিরে যান। বদর ও উহুদ যুদ্ধের পর তিনি মদীনায় চলে আসেন এবং হযরত রাসূলুল্লাহ্‌ (সাঃ)-এর ইনে-কালের সময় পর্যন্তু তিনি সেখানেই ছিলেন।
 হযরত রাসূলুল্লাহ্‌ (সাঃ)-এর ইন্তেকালের পর আবু যারকে শামে২ (দামেশ্‌কে) পাঠানো হয়। সেখানে তিনি শামের প্রাদেশিক আমীর মু‘আবিয়ার সাথে খাপ খাওয়াতে পারেন নি। এ কারণে মু‘আবিয়া তৃতীয় খলীফাহ্‌ ওসমানের নিকট তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। তখন খলীফাহ্‌ ওসমান তাঁকে মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী রাবাযাহ্‌ নামক স্থানে নির্বাসনে পাঠান। আবু যার হিজরী ৩২ সালে সেখানেই ইন্তেকাল করেন।
 হযরত রাসূলুল্লাহ্‌ (সাঃ) কর্তৃক আবু যারের প্রশংসা সম্পর্কে বহু হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ঃ “নীল আকাশ এমন কারো ওপরে ছায়া বিস্তার করে নি এবং ধরণী এমন কারো ভার বহন করে নি যে আবু যারের চাইতে অধিকতর সত্যবাদী।”৩
২) ‘আম্মার বিন্‌ ইয়াসির
 তাঁর ডাকনাম আবু ইয়াক্বযান্‌। তিনি ছিলেন বানূ ছা‘লাবাহ্‌র লোক এবং তিনি বানূ মাখ্‌যূমের সাথে বন্ধুত্ব চুক্তিতে আবদ্ধ ছিলেন। তাঁর পিতার নাম ছিল ইয়াসির্‌ ও মাতার নাম ছিল সুমাইয়াহ্‌। তিনি ও তাঁর পিতামাতা ছিলেন সর্ব প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণকারীদের অন্যতম। ক্রমের বিবেচনায় তিনি ছিলেন প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণকারী সপ্তম ব্যক্তি। তাঁর পিতা ও মাতা ইসলাম গ্রহণ করলে তাঁরা তিন জনই কুরাইশদের আক্রোশের শিকার হন এবং তাঁদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়।
 ‘আম্মারের প্রশংসায় হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) থেকে বহু ছহীহ্‌ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। এর মধ্যে একটি হাদীছ হচ্ছে এই যে, হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) এরশাদ করেছেন ঃ “অবশ্যই আম্মারের সত্তা ঈমানে পরিপূর্ণ।”
 তিনি জঙ্গে জামাল ও জঙ্গে ছিফ্‌ফীনের সময় হযরত আলী (আঃ)-এর পাশে থেকে যুদ্ধ করেন। তিনি হিজরী ৩৭ সালের ৯ই সফর ৯৩ বছর বয়সে ইনে-কাল করেন।৪
৩) মুহাম্মাদ বিন্‌ আবি হুযাইফাহ্‌
 তাঁর ডাকনাম আবূল কাসেম। তিনি উৎবাহ্‌ বিন্‌ রাবি‘আহ্‌ আল-আব্‌শামী (ডাকনাম আবু হুযাইফাহ্‌)-এর সন-ান। তাঁর মায়ের নাম সাহ্‌লাহ্‌ বিনতে সুহাইল্‌ বিন্‌ ‘আম্‌র্‌ ‘আমেরিয়্যাহ্‌। তিনি হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর যুগে হাবাশায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আবু হুযাইফাহ্‌ ইয়ামামাহ্‌র যুদ্ধে শহাদাত বরণ করলে হযরত ওসমান তাঁকে নিজের কাছে নিয়ে আসেন ও লালন-পালন করেন।
মুহাম্মাদ বিন্‌ আবি হুযাইফাহ্‌ বড় হবার পর ওসমান খলীফাহ্‌ হলে তিনি খলীফাহ্‌র অনুমতি নিয়ে মিসরে গমন করেন। কিন’ তাঁর মিসরে পৌঁছার পর তিনি জনগণকে ওসমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্যে আহ্বান জানান এবং এ ব্যাপারে অন্যদের চেয়ে অগ্রবর্তী ছিলেন। হিজরী ৩৫ সালে মিসরের প্রাদেশিক প্রশাসক আবদুল্লাহ্‌ আবি সারাহ্‌ যখন মদীনায় যান এবং ‘উক্ববাহ্‌ বিন্‌ ‘আমেরকে স্বীয় সহকারী নিয়োগ করে রেখে যান তখন মুহাম্মাদ বিন্‌ আবি হুযাইফাহ্‌ মিসরের ভারপ্রাপ্ত প্রশাসক ‘উক্ববাহ্‌ বিন্‌ ‘আমেরের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করেন ও তাঁকে মিসর থেকে বের করে দেন। মিসরের জনগণ মুহাম্মাদ বিন্‌ আবি হুযাইফাহ্‌র অনুকূলে আনুগত্য শপথ গ্রহণ করে এবং তাঁর নেতৃত্বে আবদুল্লাহ্‌ আবি সারাহ্‌কে মিসরে প্রবেশে বাধা দেয়। মুহাম্মাদ বিন্‌ আবি হুযাইফাহ্‌ এরপর আবদুর রহমান বিন্‌ ‘আদীস্‌কে ছয়শ’ যোদ্ধা সহ হযরত ওসমানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে মদীনায় পাঠান।
 হযরত আলী (আঃ) খলীফাহ্‌ হবার পর মুহাম্মাদ বিন্‌ আবি হুযাইফাহ্‌কে মিসরের প্রশাসক পদে বহাল রাখেন। এরপর মু‘আবিয়া ছিফ্‌ফীনের পথে মুহাম্মাদ বিন্‌ আবি হুযাইফাহ্‌র দিকে অগ্রসর হলে তিনি মিসর থেকে বেরিয়ে এসে মৃ‘আবিয়াকে বাঁধা দেন এবং তাঁর ফুস্‌তাতে প্রবেশ প্রতিহত করেন। কিন্তু শেষ পর্যন- উভয়ের মধ্যে সন্ধি স্থাপিত হয় এবং সন্ধির শর্ত অনুযায়ী নিরাপত্তার আশ্বাসে মুহাম্মাদ বিন্‌ আবি হুযাইফাহ্‌ ও আবদুর রহমান বিন্‌ ‘আদীস্‌ অপর ২৯ জন সঙ্গীসাথী সহ মিসর ত্যাগ করেন। কিন’ মিসরের বাইরে এলে মু‘আবিয়া কৌশলে তাঁদেরকে বন্দী করেন ও দামেশ্‌কে নিয়ে কারাগারে নিক্ষেপ করেন। কিছুদিন পর মুহাম্মাদ বিন্‌ আবি হুযাইফাহ্‌ মু‘আবিয়ার গোলাম রুশ্‌দাইন্‌ কর্তৃক নিহত হন।
 মুহাম্মাদ বিন্‌ আবি হুযাইফাহ্‌ ছিলেন হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর সাহচর্যপ্রাপ্ত ছাহাবীদের অন্যতম।৫
৪) আবদুর রহমান বিন্‌ ‘আদীস্‌ বালাভী
 তিনি ছিলেন হুদাইবিয়ায় বৃক্ষতলে হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর হাতে আনুগত্য শপথ গ্রহণকারীদের (আহ্‌লে বাই‘আতে শাজারাহ্‌) অন্যতম। তিনি মিসর বিজয়ে অংশগ্রহণ করেন এবং সেখানে নিজ হাতে যমীন আবাদ করে তার মালিক হন। খলীফাহ্‌ ওসমানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তিনি মিসর থেকে মদীনায় আগত যোদ্ধাদের সেনাপতিত্ব করেন। মু‘আবিয়া মুহাম্মাদ বিন্‌ আবি হুযাইফাহ্‌র সাথে সন্ধি করার পর কৌশলের আশ্রয় নিয়ে মুহাম্মাদ বিন্‌ আবি হুযাইফাহ্‌, আবদুর রহমান বিন্‌ ‘আদীস্‌ ও তাঁদের অপর ২৯ জন সঙ্গী-সাথীকে বন্দী করেন। মু‘আবিয়া আবদুর রহমান বিন্‌ ‘আদীস্‌কে ফিলিসি-নে কারাগারে রাখেন। হিজরী ৩৬ সালে তিনি মু‘আবিয়ার কারাগার থেকে পলায়ন করতে সক্ষম হন, কিন’ অচিরেই পুনরায় তাঁকে বন্দী করা হয়। এরপর তাঁকে বন্দী অবস্থায় হত্যা করা হয়।৬
৫) মুহাম্মাদ বিন্‌ আবু বাক্‌র্‌
 তিনি প্রথম খলীফাহ্‌ হযরত আবু বকরের পুত্র। তাঁর মায়ের নাম আস্‌মা’ বিনতে ‘আমীস্‌ খাছ্‌মিয়্যাহ্‌। আস্‌মা’ প্রথমে জা‘ফার ইবনে আবি তালিবের স্ত্রী ছিলেন; জা‘ফারের শাহাদাতের পর তিনি আবু বকরকে বিবাহ করেন। বিদায় হজ্বের সময় মক্কার পথিমধ্যে মুহাম্মাদ বিন্‌ আবু বকর জন্মগ্রহণ করেন। আবু বকরের ইনে-কালের পর মুহাম্মাদ বিন্‌ আবু বকর হযরত আলী (আঃ)-এর কাছে ও তাঁর স্নেহ-মমতায় লালিত-পালিত হন। জঙ্গে জামালের সময় তিনি হযরত আলী (আঃ)-এর পাশে থেকে যুদ্ধ করেন এবং তাঁর পদাতিক বাহিনীর সেনাপতির দায়িত্বে ছিলেন। তিনি ছিফ্‌ফীনের যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন এবং যুদ্ধের পরে হযরত আলী (আঃ) তাঁকে প্রশাসক নিয়োগ করে মিসরে পাঠান। তিনি হিজরী ৩৭ সালের ১৫ই রামাযান মিসরে প্রবেশ করেন। এমতাবস্থায় মু‘আবিয়া মিসর জয়ের জন্য ‘আম্‌র্‌ ইবনুল ‘আছের সেনাপতিত্বে সেনাবাহিনী পাঠান। হিজরী ৩৮ সালে যুদ্ধ হয় এবং তিনি ‘আম্‌র্‌ ইবনুল ‘আছের নিকট পরাজিত ও বন্দী হন। ‘আম্‌র্‌ ইবনুল ‘আছের নির্দেশে মুহাম্মাদ বিন্‌ আবু বকরকে বন্দী অবস্থায় হত্যা করা হয় এবং তাঁর লাশকে গাধার চামড়ার মধ্যে পুরে পুড়িয়ে ফেলা হয়।৭
৬) ছা‘ছা‘আহ্‌ বিন্‌ ছুহান্‌ ‘আব্‌দী
 তিনি হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)-এর যুগে ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বাচন বিশেষজ্ঞ ও বাগ্মী। তিনি জঙ্গে ছিফ্‌ফীনে হযরত আলী (আঃ)-এর পক্ষে যুদ্ধ করেন। মু‘আবিয়া কূফাহ্‌ দখল করার পর তাঁকে বাহ্‌রাইনে নির্বাসিত করেন। তিনি সেখানেই ইনে-কাল করেন।৮
৭) মালেক আশ্‌তার্‌ আন্‌-নাখা‘ঈ
 তিনি হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ)কে দেখেছেন। তবে তিনি তাবে‘্‌ঈ হিসেবে এবং অত্যন- নির্ভরযোগ্য তাবে‘ঈগণের অন্যতম হিসেবে পরিগণিত হয়ে থাকেন। মালেক আশ্‌তার্‌ ছিলেন তাঁর গোত্রের প্রধান। ইয়ারমুকের যুদ্ধে তাঁর চোখ যখম হয়, এ কারণে তাঁকে আশ্‌তার্‌ বলা হত। তিনি জঙ্গে জামালে ও ছিফ্‌ফীনের যুদ্ধে হযরত আলী (আঃ)-এর পক্ষে যুদ্ধ করেন এবং খুবই বীরত্ব প্রদর্শন করেন। হিজরী ৩৮ সালে হযরত আলী (আঃ) তাঁকে মিসরের প্রশাসক নিয়োগ করেন। তখন তিনি মিসর অভিমুখে রওয়ানা হন। কিন্তু তিনি লোহিত সাগরের নিকট পৌঁছার পর, মু‘আবিয়া স্বীয় গুপ্তচরদের কাছে বিষ মিশ্রিত মধু পাঠিয়ে তা মালিক আশ্‌তার্‌কে খাওয়াতে সক্ষম হলে তিনি ইনে-কাল করেন।৯
 এই হল উল্লিখিত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ববর্গের পরিচিতি। কিন্তু আফসোস! কীভাবে অনেক ঐতিহাসিক এই ব্যক্তিদেরকে তাঁদের নিকট অপরিচিত একজন ইয়াহূদীর অনুসারী হবার অপবাদ দিতে পারলেন!
 * * *
 আমরা আবদুল্লাহ্‌ ইবনে সাবা’ নাম দিয়ে রচিত কল্পকাহিনীর সাথে পরিচিত হলাম। এবার আমরা এ কাহিনীর উৎস অনুসন্ধান করবো এবং দেখবো এ কল্পকাহিনী কা’র রচিত এবং এর বর্ণনাকারী (রাভী) কারা।
পাদটীকা ঃ
১. যে ঈমানদার ব্যক্তি কোন না কোন ছাহাবীর সাক্ষাৎ পেয়েছেন।
২. তৎকালীন শাম বা বৃহত্তর সিরিয়ার অন-র্ভুক্ত ছিল বর্তমান সিরিয়া, জর্দান, ফিলিসি-ন ও লেবানন।
৩. ত্বাবাকাতে ইবনে সা‘দ, ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ১৬১-১৭১; মুসনাদে আহ্‌মাদ, ২য় খণ্ড, পৃঃ ১৬৩, ১৭৫, ২৬৩; ৫ম খণ্ড, পৃঃ ১৪৭, ১৫৫, ১৫৯, ১৬৫, ১৬৬, ১৭২, ১৭৪, ৩৫১, ৩৫৬; ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃঃ ৪৪২; ছহীহ্‌ বুখারী, ছহীহ্‌ মুসলিম ও ছহীহ্‌ তিরমিযী, কিতাবুল মানাক্বিব; সুনানে ইবনে মাজাহ্‌, ভূমিকা, ১১তম বাব্‌; মুসনাদে ত্বাইয়ালিসী, হাদীছ নং ৪৫৮, ত্বাবারী ও ইবনে আছীর (তাবুক যুদ্ধ প্রসঙ্গ); আল-ইছাবাতু ফী তামিযিছ্‌ ছাহাবাহ্‌ ও উস্‌দুল্‌ গ্বাবাহ (আবু যার-এর পরিচয়) ।
৪. সূত্র ঃ ছহীহ্‌ বুখারী, কিতাবুল জিহাদ, ১৭তম বাব্‌; ছহীহ্‌ মুসলিম, কিতাবুল ফিতান্‌; সুনানে ইবনে মাজাহ্‌, ভূমিকা, ১১তম বাব্‌,; সুনানে তিরমিযী, ভূমিকা, ৩৩তম বাব্‌; মুসনাদে ত্বাইয়ালিসী, হাদীছ নং ১১৭, ৬০৩, ৬৪৩, ৬৪৯, ১১৫৬, ১৫৯৮, ২১৬৮, ২২০২; আল-ইস্‌তি‘আব্‌, ‘আইন্‌ হরফ্‌, ২য় খণ্ড/ ৪৬৯; উস্‌দুল্‌ গ্বাবাহ্‌ ৪র্থ খণ্ড/ ৪৩; আল-ইছাবাহ্‌, ২য় খণ্ড/৫০৫; মাস্‌‘উদীর মুরুজুয্‌ যাহাব, ২য় খণ্ড, ২১ ও ২২; ত্বাবারী ও ইবনে আছীর (হিজরী ৩৬-৩৭ সালের ঘটনাবলী); বালাযূরীর আন্‌ছাবুল্‌ ইশরাফ্‌, ৫ম খণ্ড, পৃঃ ৪৮-৮৮; ত্বাবাকাতে ইবনে সা‘দ, তৃতীয় খণ্ড, ক্বাফ ঃ ১, ১৬৬-১৮৯; মুসনাদে আহ্‌মাদ্‌, ১ম, ২য়, ৩য়, ৪র্থ, ৫ম ও ৬ষ্ঠ খণ্ড (মূলে ২৬টি হাদীছের উল্লেখ আছে; সংক্ষেপণের স্বার্থে উল্লেখ করা হল না।) ।
৫.  ত্বাবারী ও ইবনে আছীর, হিজরী ৩০ থেকে ৩৬ সাল পর্যন-কার ঘটনাবলীর বর্ণনা; আল-ইছাবাহ্‌, মীম্‌ হরফ, ক্বাফ ঃ ১, ৩য় খণ্ড/ ৫৪; উস্‌দুল্‌ গ্বাবাহ্‌. ৪র্থ খণ্ড/ ৩১৫; আল-ইস্‌তি‘আব্‌, ৩য় খণ্ড/ ৩২১-৩২২।
৬. ত্বাবারী ও ইবনে আছীর. হিজরী ৩০ থেকে ৩৬ সাল পর্যন-কার ঘটনাবলীর বর্ণনা;আল-ইছাবাহ্‌, ৪র্থ খণ্ড/ ১৭১, ‘আইন হরফ, ক্বাফ ঃ ১; আল-ইস্‌তি‘আব্‌, ‘আইন হরফ।
৭. ত্বাবারী ও ইবনে আছীর. হিজরী ৩৭ থেকে ৩৮ সাল পর্যন-কার ঘটনাবলীর বর্ণনা; আল-ইছাবাহ্‌, ৩য় খণ্ড/ ৪৫১, মীম হরফের বর্ণনা, ক্বাফ ঃ ২; আল-ইস্‌তি‘আব্‌, ৩য় খণ্ড/ ৩২৮ ও ৩২৯।
৮. আল-ইছাবাহ্‌, ৩য় খণ্ড/ ১৯২, ছ্বাদ্‌ হরফ; আল-ইস্‌তি‘আব্‌, ২য় খণ্ড/ ১৮৯।
৯. আল-ইস্‌তি‘আব্‌, ৩য় খণ্ড/ ৩২৭; আল-ইছাবাহ্‌, ৩য় খণ্ড/ ৪৫৯, মীম্‌ হরফ; ত্বাবারী, হিজরী ৩৬ থেকে ৩৮ সাল পর্যন-কার ঘটনাবলীর বিবরণ।

Leave A Reply

Your email address will not be published.