গাদীরের হাদীস ছাড়াও অন্য যে সকল প্রমাণাদি সরাসরি সুস্পষ্টভাবে আলীর (আ.) খেলাফত ও নেতৃত্বকে প্রমাণ করে তার সংখ্যা এত বেশী যে যদি আমরা তা উল্লেখ করতে চাই তাহলে শুধু সেগুলিই একটা বড় গ্রন্থের রূপলাভ করবে। তাই এখানে সামান্য কয়েকটির উল্লেখ করেই ক্ষান্ত থাকব।
প্রথমেই বলা দরকার যে, যদিও মুসলিম সমাজ রাসূল (সা.)-এর ইন্তেকালের পর নেতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে ভ্রান্ত পথে গিয়েছিল ও রাসূল (সা.)-এর প্রকৃত খলিফাকে ২৫ বছর (পঁচিশ বছর) ধরে শাসনকার্য হতে দূরে রেখেছিল, কিন্তু এতে তাঁর সত্ত্বাগত মর্যাদার মূল্য বিন্দু পরিমাণও কমে নি; বরং তারা নিজেরাই একজন নিষ্পাপ বা মাসুম নেতা হতে বঞ্চিত হয়েছে এবং উম্মতকেও বঞ্চিত করেছে। কারণ, তাঁর মান-মর্যাদা বাহ্যিক খেলাফতের সাথে সম্পৃক্ত ছিল না, বরং খেলাফতের পদটি স্বয়ং আলীর (আ.) দায়িত্বভারের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। অর্থাৎ যখনই তিনি ব্যতীত অন্য কেউ এই পদে আসীন হয়েছেন তখনই এই পদ বা আসনটির অধঃপতন ঘটেছে। আর শুধুমাত্র তখনই তা প্রকৃত মর্যাদায় পৌঁছেছে যখন আলী (আ.) তার উপর সমাসীন হয়েছেন। বর্ণিত হয়েছেঃ
যখন আমিরুল মু’মিনীন আলী (আ.) কুফা শহরে প্রবেশ করলেন, তখন এক ব্যক্তি সামনে এসে বললেনঃ আল্লাহর কসম হে আমিরুল মু’মিনীন! খেলাফতই আপনার মাধ্যমে সুশোভিত ও সৌন্দর্য্যমন্ডিত হয়েছে, এমন নয় যে আপনি ঐ খেলাফতের মাধ্যমে। আপনার কারণেই এই পদটি মর্যাদার উচ্চ স্তরে পৌঁছেছে, এমন নয় যে আপনি ঐ পদের কারণে উচ্চস্তরে পৌঁছেছেন। খেলাফতই আপনার মুখাপেক্ষী হয়েছিল না আপনি তার প্রতি।
আহমাদ ইবনে হাম্বালের পুত্র আব্দুল্লাহ বলেছেনঃ একদিন আমার পিতার নিকট বসেছিলাম। কুফার অধিবাসী একদল লোক প্রবেশ করলো ও খলিফাদের খেলাফত সম্পর্কে আলোচনা করলো; কিন্তু আলীর খেলাফত সম্পর্কে কথা-বার্তা একটু দীর্ঘায়িত হল। আমার পিতা মাথা উঁচু করে বললেনঃ তোমরা আর কত আলী ও তার খেলাফত (শাসনকর্তৃত্ব) সম্পর্কে আলোচনা করতে চাও! খেলাফত আলীকে সুশোভিত করেনি বরং আলীই খেলাফতকে সৌন্দর্য্য দান করেছেন।
1. ইয়াওমুদ্দার’র হাদীস (প্রথম দাওয়াতের হাদীস)
রাসূল (সা.)-এর খেলাফত ও ইসলামী রাষ্ট্রের নেতৃত্বের বিষয়টি এমন কোন বিষয় ছিল না যে, রাসূল (সা.) তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এটাকে (খেলাফত) অব্যক্ত রাখবেন আর ইসলামী সমাজের দায়িত্ব-কর্তব্যকে ঐ ক্ষেত্রে স্পষ্ট করবেন না। রাসূল (সা.) যেদিন তাঁর রেসালাতের দায়িত্বকে প্রকাশ্যে ঘোষণার নির্দেশ পেয়েছেন, সেদিনই তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন স্বীয় স্থলাভিষিক্তকেও পরিচয় করিয়ে দেওয়ার।
পবিত্র কোরআনের এই আয়াত–
وَ أَنْذِرْ عَشِيرَتَكَ الْأَقْرَبِينَ
অর্থাৎ “তোমার নিকটাত্মীয়গণকে সতর্ক করে দাও” যখন তিনি নবুয়তী দায়িত্ব গ্রহণের তৃতীয় বর্ষে পদার্পণ করলেন, আলীকে ডাকলেন ও বললেনঃ “আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যেন আমি আমার নিকটাত্মীয়দেরকে ইসলামের দাওয়াত দিই। তুমি কিছু খাবার তৈরী কর ও কিছু দুধ সংগ্রহ কর এবং আব্দুল মোত্ত্বালিবের সন্তানদেরকে দাওয়াত দাও যাতে আমি আমার দায়িত্বটি পালন করতে পারি।” হযরত আলী (আ.) বলেছেনঃ আমি আব্দুল মোত্তালিব বংশের প্রায় চল্লিশজন গণ্য-মান্য ব্যক্তিকে দাওয়াত করলাম ও যে খাবার তৈরী করেছিলাম সেটা সামনে রাখলাম। তারা সে খাবার খেল এবং দুধ পান করলো; কিন্তু খাবার ও দুধ ঠিক পূর্বের পরিমাণেই অবশিষ্ট রয়ে গেল। যখন রাসূল (সা.) তাদের সাথে কথা বলতে চাইলেন, আবু লাহাব বললঃ মুহাম্মদ তোমাদেরকে যাদু করেছে, একথা বলে অনুষ্ঠান ভেঙ্গে দিল। পরের দিন তিনি আবার নির্দেশ দিলেন তাদেরকে দাওয়াত দেওয়ার জন্যে এবং খাবার ও দুধ প্রস্তুত করার জন্যে। তাদের খাদ্য গ্রহণ শেষ হওয়ার সাথে সাথেই রাসূল (সা.) মুখ খুললেন ও বললেনঃ “হে আব্দুল মোত্তালিবের সন্তানগণ! আল্লাহর কসম; এই আরবে আমি এমন কোন যুবককে দেখি নি যে, স্বীয় গোত্রের জন্য আমি যা এনেছি তার চেয়ে উত্তম কিছু নিয়ে এসেছে। আমি তোমাদের জন্য ইহকাল ও পরকালের কল্যাণ নিয়ে এসেছি এবং আমার আল্লাহ বলেছেন যেন আমি তোমাদেরকে সেই পথে আহ্বান করি। তোমাদের মাঝে কে আছে যে, এই কাজের জন্য আমাকে সাহায্য করবে। আমি (আলী) সে সময় উপস্থিতদের মধ্যে সবার চেয়ে কম বয়সী (তরুন) ছিলাম বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনাকে সাহায্য করবো। তিনি আমার ঘাড়ে হাত দিয়ে বললেনঃ তোমাদের মধ্যে এ আমার ভাই, ওসী (দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধি) ও খলিফা বা স্থলাভিষিক্ত তার কথা শোন ও তার আনুগত্য কর। তখন অনুষ্ঠানের সকলেই উঠে দাঁড়ালো ও হাসতে হাসতে আবু তালিবকে বললঃ তোমাকে নির্দেশ দিচ্ছে যে, তুমি তোমার ছেলে আলীর আনুগত্য কর।”
অপর এক বর্ণনা মতে রাসূল (সা.) তিনবার এই প্রস্তাব পুনরাবৃত্তি করেছিলেন। কিন্তু প্রত্যেকবার আলী (আ.) ব্যতীত অন্য কেউ তাঁর প্রস্তাবে সম্মতি জানায় নি।
2. মানযিলাত’র হাদীস (পদ মর্যাদার হাদীস)
অপর একটি হাদীস যেটা আলীর (আ.) খেলাফতের পক্ষে প্রমাণ বহন করে তা হচ্ছে মানযিলাতের হাদীস (পদ মর্যাদার হাদীস)। রাসূল (সা.)-এর বর্ণিত হাদীস সমূহের মধ্যে মানযিলাতের হাদীস হচ্ছে রাসূল (সা.)-এর থেকে বর্ণিত প্রসিদ্ধতম হাদীসসমূহের অন্যতম এবং অনেক সাহাবীই এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইবনে আসাকির তার “তারিখে দামেশ্ক” শীর্ষক গ্রন্থে ৩২ জন সাহাবী থেকে এ হাদীসটি সূত্র সহকারে বর্ণনা করেছেন। বর্ণনাধারা এবং পারিপার্শ্বিক প্রমাণসমূহ থেকে বোঝা যায় এই পবিত্র বাণীটি রাসূল (সা.) বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে কয়েকবার ব্যক্ত করেছেন, কিন্তু প্রসিদ্ধতম স্থান হল তাবুকের যুদ্ধের সময়।
তাবুকের যুদ্ধের সময় রাসূল (সা.) স্বয়ং সৈন্যদের নেতৃত্বের দায়িত্বভার কাঁধে নিয়ে মদিনা হতে বের হলেন ও আলীকে মদীনায় তাঁর স্থলাভিষিক্ত হিসেবে রাখলেন। এটিই একমাত্র যুদ্ধ ছিল যে যুদ্ধে আলী (আ.) রাসূলের সাথে ছিলেন না, আর সে কারণেই তাঁর জন্য মদীনায় থাকাটা একটু কঠিন হচ্ছিল। রাসূল (সা.) রণাঙ্গনের পথে যাত্রা শুরু করলেন। সৈন্যদল যখন যাত্রা শুরু করেছে ঠিক তখনই তিনি (আলী) রাসূল (সা.)-এর নিকট গিয়ে বললেনঃ আমাকে আপনি এই শিশু আর নারীদের সাথে মদীনায় রেখে যাচ্ছেন?
তখন রাসূল (সা.) তার উত্তরে বললেনঃ
<اَمٰا تَرضیٰ أنْ تَکُونَ مِنِّی بِمَنْزِلَةِ هٰارُونَ مِنْ مُوسیٰ اِلاَّ اَنَّهُ لاٰ نَبِِیَّ بَعدی>
“আমা তারজা আন তাকুনা মিন্নি বি মানযিলাতি হারূনা মিন মুসা ইল্লা আন্নাহু লা নাবীয়্যা বা’দী।”
অর্থাৎ তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, আমার সাথে তোমার সম্পর্ক ঠিক তেমন যেমনটি মুসার সাথে হারুনের ছিল? শুধু এতটুকু পার্থক্য যে আমার পরে আর নবী আসবে না।
পবিত্র কোরআনে এভাবে বর্ণিত হয়েছে যে হযরত মুসার (আ.) সাথে হযরত হারুনের (আ.) সম্পর্ক ছিল পাঁচ দিক থেকেঃ ১. ভাই, ২. নবুয়্যতের অংশীদার, ৩. উজীর ও সাথী, ৪. সাহায্যকারী, ৫. খলিফা ও স্থলাভিষিক্ত।
সুতরাং হযরত আলীও (আ.) রাসূল (সা.)-এর সাথে এই পাঁচটি সম্পর্কের অধিকারী: কারণ তাকে ভাই হিসেবে নির্ধারণ করার পর বলেছেনঃ ইহকাল ও পরকালে তুমিই আমার ভাই, আল্লাহর বাণী পৌঁছানোর ক্ষেত্রে তাঁর অংশীদার, যেমন বলেছেনঃ আমি এবং আলী ব্যতীত কেউ যেন আমার বাণী প্রচার না করে”। তাঁর উজীর কারণ, তিনি নিজে বলেছেনঃ আলী আমার উজীর। তাঁর সাহায্যকারী যেমনঃ আল্লাহ তাঁকে আলীর (আ.) দ্বারা সাহায্য করেছেন, ও তাঁর খলিফাঃ কারণ, তিনি স্বয়ং তাকে স্থলাভিষিক্ত হিসেবে নির্বাচন করেছেন।
3. উত্তরাধিকারের ও প্রতিনিধিত্বের হাদীস
রাসূল (সা.) বলেছেনঃ
<لكلِّ نَبيٍ وَصيٌّ وَ وٰارِثٌ وَ اِنَّ عَلياً وَصيّي وَ وٰارثي>
অর্থাৎ প্রত্যেক নবীরই ওসী বা প্রতিনিধি ও উত্তরাধিকারী আছে আমার প্রতিনিধি ও উত্তরাধিকারী হল আলী।
আরো বলেনঃ
<أنٰا نَبِيُّ هٰذِهِ الاُمَّةِ وَ عَلِيٌّ وَصيّي في عِتْرَتي وَ اَهْلِ بَيتي وَ اُمَّتِي مِنْ بَعدي>
অর্থাৎ আমি এই উম্মতের (জাতির) নবী আর আলী হচ্ছে আমার ওসী বা প্রতিনিধি।
তিনি বলেনঃ
<عَليٌ أخي وَ وَزيري وَ وٰارثي وَ وَصيي وَ خَليفَتِي فِي اُمَّتِي>
অর্থাৎ আমার উম্মতের মধ্যে আলীই আমার ভাই, আমার সহযোগি উজীর, প্রতিনিধি, উত্তরাধিকারী ও আমার খলিফা।
এই হাদীস সমূহে ওসী (প্রতিনিধি) ও উত্তরাধিকারী এ দু’টি শিরোনামকে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আর ঐ দু’টির প্রত্যেকটিই আমিরুল মু’মিনীন আলীর (আ.) খেলাফতকেই প্রমাণ করে।