সুরা বাকারার তাফসির তৃতীয় অংশ (১০৩-১৫২ নম্বর আয়াত)

0 8,106

 

সুরা বাকারার তাফসির তৃতীয় অংশ

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরা বাকারাহ’র ১০৩ নম্বর আয়াতে বলেছেন-
وَلَوْ أَنَّهُمْ آَمَنُوا وَاتَّقَوْا لَمَثُوبَةٌ مِنْ عِنْدِ اللَّهِ خَيْرٌ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ (103

“যদি তারা ঈমান আনত এবং খোদাভীরু হতো, তবে আল্লাহর কাছ থেকে উত্তম প্রতিদান পেত। যদি তারা জানত।” (২:১০৩)
এর আগের পর্বে আমরা বলেছিলাম ইহুদীরা তাওরাত ও অন্যান্য ঐশি গ্রন্থ অনুসরণের পরিবর্তে যাদুবিদ্যা সংক্রান্ত তথ্য অনুসন্ধান করত। তারা এ ব্যাপারে যুক্তি দেখিয়ে বলত, হযরত সোলায়মান (আ.) যাদুর উৎস। কিন্তু পবিত্র কোরআন হযরত সোলায়মান (আ.) সম্পর্কে ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছে৷ এই আয়াতে বলা হয়েছে, ইহুদীরা যদি প্রকৃত বিশ্বাসী হতো ও এ ধরনের ভুল ধারণা থেকে মুক্ত থাকত তাহলে তাদের জন্যই কল্যাণকর হতো৷ কারণ শুধু ঈমান বা বিশ্বাস স্থাপন করা যথেষ্ট নয়; খোদাভীরুতা ও আত্মসচেতনতাও জরুরী৷ খোদাভীরুতা বা তাকওয়ার অর্থ শুধু মন্দ বা খারাপ কাজ থেকেই দূরে থাকা নয়, এটা হল এমন এক অভ্যন্তরীণ শক্তি যা মানুষকে নোংরা তৎপরতা যেমন, মিথ্যা বলার মত মন্দ কাজ থেকে দূরে রাখার পাশাপাশি তাদেরকে ভালো কাজ করতেও উৎসাহিত করে৷ ভালো কাজ বলতে নামাজ পড়া, অন্যায়-অবিচার প্রতিরোধ প্রভৃতি ভালো কাজকে বোঝানো হয়েছে৷

এরপর ১০৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا لَا تَقُولُوا رَاعِنَا وَقُولُوا انْظُرْنَا وَاسْمَعُوا وَلِلْكَافِرِينَ عَذَابٌ أَلِيمٌ (104)

“হে বিশ্বাসীগণ রাসূল (সাঃ)-এর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ‘রায়েনা’ শব্দটি বল না, বরং ‘উনজুরনা’বল এবং শুনে রাখ অবিশ্বাসীদের জন্য ভয়াবহ শাস্তি রয়েছে৷” (২:১০৪)

ইসলামের প্রাথমিক যুগে রাসূল (সাঃ) যখন বক্তৃতা দিতেন বা কোরআনের আয়াত পড়ে শোনাতেন তখন মুসলমানরা রাসূল (সাঃ)এর বক্তব্যকে ভালোভাবে উপলদ্ধির জন্য রাসূলের কাছে আবেদন করতেন-যাতে রাসূল(সাঃ) তাদের অবস্থা দেখে বক্তব্য রাখেন৷ তারা তাদের এই আবেদন জানাতেন ‘রায়েনা’ নামক শব্দটি ব্যবহার করে৷ আরবীতে রায়েনা শব্দের অর্থ ‘অন্যকে রক্ষা করা বা দেখা-শোনা করা’৷ কিন্তু হিব্রু ভাষায় এই শব্দের অর্থ হলো ‘বোকা’৷ ইহুদীরা মুসলমানদের পরিহাস করে বলতো তোমরা নিজেদেরকে বোকা বা আহাম্মক করার জন্য তোমাদের নবীর কাছে আবেদন জানাচ্ছো। আর এ জন্যে কোরআনের আয়াতে এ নির্দেশ দেয়া হয় যে, রায়েনার পরিবর্তে মুসলমানরা যেন উনযুরনা বলে-যাতে শত্রুরা অপব্যাখ্যার সুযোগ না পায় ৷ ‘উনযুরনা’ শব্দের অর্থ হলো ‘আমাদের দিকে লক্ষ্য করুন’৷ এ শব্দটি ব্যবহার করলে শত্রুরা মুসলমান ও তাদের নবীকে উপহাস করার সুযোগ পাবে না৷ এ আয়াতের মূল বক্তব্য হল শত্রুরা ব্যঙ্গ বা উপহাস করতে পারে এমন কাজ থেকে বিরত থাকা। এ আয়াত থেকে বোঝা যায়, ইসলাম বড়দের সাথে ও শিক্ষকদের সাথে কথা বলার সময় উপযুক্ত শব্দ ব্যবহার এবং সম্মান প্রদর্শন ও আদব-কায়দা রক্ষার ওপর গুরুত্ব দেয়৷ একইসঙ্গে যেসব কাজ ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি উপহাস বা অবমাননার সুযোগ করে দেয় এবং শত্রুদেরকে অপব্যাখ্যার সুযোগ দেয়, সেসব কাজ থেকে মুসলমানদেরকে বিরত থাকতে হবে৷

১০৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন-
مَا يَوَدُّ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ وَلَا الْمُشْرِكِينَ أَنْ يُنَزَّلَ عَلَيْكُمْ مِنْ خَيْرٍ مِنْ رَبِّكُمْ وَاللَّهُ يَخْتَصُّ بِرَحْمَتِهِ مَنْ يَشَاءُ وَاللَّهُ ذُو الْفَضْلِ الْعَظِيمِ (105

“আহলে-কিতাব ও মুশরিকদের মধ্যে যারা কাফের,তাদের মনঃপুত নয় যে, তোমাদের পালনকর্তার পক্ষ থেকে তোমাদের প্রতি কোন কল্যাণ অবতীর্ণ হোক। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা বিশেষ ভাবে স্বীয় অনুগ্রহ দান করেন। আল্লাহ মহান অনুগ্রহদাতা।” (২:১০৫)

এই আয়াতে ঈমানদারদের প্রতি কাফের ও মুশরিকদের চরম শত্রুতা ও বিদ্বেষের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। কাফের মুশরেকরা মুসলমানদেরকে ভীষণ হিংসা করত। মুসলমানরা যে স্বতন্ত্র ঐশিগ্রন্থ এবং স্বতন্ত্র নবীর অনুসারী এটা ইহুদী-খ্রিস্টানরা মেনে নিতে চাইত না। আল্লাহ পাক এ আয়াতে বলেছেন, তিনি যার জন্য ভালো মনে করেন তাকেই অনুগ্রহ প্রদান করেন এবং যাদের জন্য দরকার মনে করেন, তাদের কাছেই নবী পাঠান৷ আর এ ক্ষেত্রে তিনি কারো এমন কোন ইচ্ছের পরোয়া করেন না ।

এরপর সূরা বাকারাহ’র ১০৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
مَا نَنْسَخْ مِنْ آَيَةٍ أَوْ نُنْسِهَا نَأْتِ بِخَيْرٍ مِنْهَا أَوْ مِثْلِهَا أَلَمْ تَعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ (106)

“আমি কোন আয়াত রহিত করলে অথবা বিস্মৃত করিয়ে দিলে তদপেক্ষা উত্তম অথবা তার সমপর্যায়ের আয়াত আনয়ন করি। তুমি কি জান না যে, আল্লাহ সব কিছুর ওপর শক্তিমান?” (২:১০৬)

প্রথম দিকে মুসলমানদের কেবলা ছিল বায়তুল মোকাদ্দাস৷ ইহুদীরা এটাকে যুক্তি দেখিয়ে বলত: মুসলমানদের তো আলাদা কোন ধর্মই নেই। আর এ জন্যেই তারা আমাদের কেবলার মুখোমুখী হয়ে প্রার্থনা করে। এ কারণেই আল্লাহ মুসলমানদেরকে বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে কেবলা মক্কায় স্থানান্তরের নির্দেশ দেন৷ কিন্তু এবার ইহুদীরা অন্য আপত্তি উত্থাপন করে বলে যে, যদি প্রথম কেবলা ঠিক ছিল-তাহলে কেন কেবলা পরিবর্তন করা হল? আর যদি দ্বিতীয় কেবলা সঠিক হয় তাহলে তোমাদের পূর্ববর্তী সব আমল নষ্ট হয়ে গেছে৷
আল্লাহ পাক এইসব বিতর্কের জবাবে বলেছেন, আমি কোন বিধান বা হুকুমকে রহিত করি না বা কোন বিধানকে বিলম্বিতও করি না-যতক্ষণ না ওই রকম কোন বিধান বা তার চেয়ে ভালো কোন বিধান তার স্থলাভিষিক্ত করি। কেবলা পরিবর্তন ও কাবাকে মুসলমানদের কেবলা হিসাবে ঘোষণা দেয়ার ক্ষেত্রে বিলম্ব করার অনেক যুক্তি ও উদ্দেশ্য রয়েছে। আর এসব বিষয় সম্পর্কে তোমরা অবগত নও৷ ইসলামী বিধান কল্যাণময় ও প্রজ্ঞাময় ৷ আর তাই স্থান, কাল ও পরিবেশ ভেদে বিভিন্ন বিষয়ের কল্যাণকর দিক পরিবর্তিত হয় বলে পূর্ববর্তী নির্দেশ বা বিধান পরিবর্তন করে তার স্থলে নতুন বিধান দেয়া হয়৷ অবশ্য খোদায়ী বিধানের মূলনীতি স্থির ও অপরিবর্তনযোগ্য৷ এই আয়াত এটাও নির্দেশ করে যে, ইসলামে কোন অচলবস্থার বা স্থবিরতার অবকাশ নেই৷ ইসলাম বিশ্বজনীন ও স্থায়ী ধর্ম বলে ইসলামের স্বার্থে এতে স্থায়ী বিধানের পাশাপাশি পরিবর্তনশীল বা অস্থায়ী বিধানও থাকতে পারে৷

সূরা বাকারাহ’র ১০৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
أَلَمْ تَعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ لَهُ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا لَكُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ مِنْ وَلِيٍّ وَلَا نَصِيرٍ (107

“তুমি কি জান না যে, একমাত্র আল্লাহর জন্যেই আসমান ও জমিনের আধিপত্য। আর আল্লাহ ছাড়া তোমাদের কোন অভিভাবক ও সাহায্যকারী নেই।” (২:১০৭)

খোদায়ী কোন কোন বিধান রহিত করার বিষয়ে আপত্তির জবাব দেয়া হয়েছে এই আয়াতে। এতে বলা হয়েছে, যারা আল্লাহর কোন বিধান রহিত করার বিষয়ে আপত্তি করছে, তারা কি আল্লাহর নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্বের বিষয়ে উদাসীন? তারা কি জানে না-আল্লাহ মানুষসহ সমস্ত সত্ত্বার ওপর কর্তৃত্বশীল এবং তিনি তার প্রজ্ঞা অনুসারে বিধান ও নির্দেশাবলীতে যে কোন ধরনের পরিবর্তন আনার অধিকার রাখেন। দুঃখজনকভাবে বনী ইসরাইলীরা আল্লাহর কর্তৃত্ব সম্পর্কে ভুল ধারণা পোষণ করত। কর্তৃত্ব বা সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে আল্লাহর হাত বাধা রয়েছে বলে বিশ্বাস করত। অথচ সৃষ্টি কর্মেই হোক বা বিধান ও নির্দেশের ক্ষেত্রেই হোক-সব কিছুর ক্ষেত্রেই আল্লাহ পরিবর্তন আনতে পারেন।

এই আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে-
এক. শুধু ঈমান বা বিশ্বাসই যথেষ্ট নয়। একই সঙ্গে তাকওয়া বা খোদাভীরুতা অবলম্বনও জরুরী।
দুই. শত্রুরা আমাদের সমস্ত তৎপরতা ও এমনকি শব্দ চয়ন পর্যন্ত ভালোভাবে লক্ষ্য করে। তাই আমাদেরকে এমন সব ধরনের তৎপরতা ও বক্তব্য থেকে দূরে থাকতে হবে যা শত্রুদেরকে ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে শত্রুতা বা অপব্যবহারের সুযোগ করে দেয়।
তিন. ইসলামের শত্রুরা চায় সব ধরনের উন্নতি ও অগ্রগতি তাদের মধ্যেই সীমিত থাকুক এবং তারা চায় না যে, মুসলমানদের কোন কল্যাণ হোক ও মুসলমানরা কোন বরকতের অধিকারী হোক। তাই তাদের দিকে তাকিয়ে না থেকে বা তাদের ওপর ভরসা না করে মুসলমানদের উচিত সম্পূর্ণ আল্লাহর ওপর নির্ভর করা।
সূরা বাকারাহ”র ১০৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন-
أَمْ تُرِيدُونَ أَنْ تَسْأَلُوا رَسُولَكُمْ كَمَا سُئِلَ مُوسَى مِنْ قَبْلُ وَمَنْ يَتَبَدَّلِ الْكُفْرَ بِالْإِيمَانِ فَقَدْ ضَلَّ سَوَاءَ السَّبِيلِ (108

“তোমরা কি তোমাদের রাসূলের নিকট সে ধরনের প্রশ্ন বা আবদার করতে চাও যেরকম পূর্বে মূসাকে করা হয়েছিল? জেনে রাখ যে, এ ধরনের বাহানা এনে বিশ্বাসের পরিবর্তে যে অবিশ্বাসকে গ্রহণ করে, সে নিশ্চিতভাবে সরল পথ হারায়৷” (২:১০৮)
কিছু দুর্বল ঈমানের অধিকারী লোক অদ্ভুত ধরনের মোজেযা বা অলৌকিক শক্তি দেখানোর জন্য নবীজীর কাছে আবদার করত, যেমন বলত আমাদের জন্য আল্লাহর কাছ থেকে একটি চিঠি নিয়ে আসুন। তাদের এ ধরনের দাবি ছিল হযরত মূসা(আ.)এর প্রতি বনী ইসরাইলের দাবির মত ৷ বনী ইসরাইল বলেছিল, আমরা আল্লাহকে দেখতে চাই, আপনি আল্লাহকে দেখানোর বন্দোবস্ত করুন, তাকে আমরা স্বচক্ষে দেখে তবেই ঈমান আনবো। মূলত: মোজেযার উদ্দেশ্য হলো নবুয়্যত প্রমাণিত করা। প্রত্যেকের ইচ্ছা পূরণ করা নবীর কাজ নয়। যেমন একজন প্রকৌশলী তার দাবির প্রমাণ হিসাবে কয়েকটি দৃষ্টান্ত পেশ করে। কিন্তু যে কেউ তাকে দালান কোঠা বানাতে বললেই সে বানায় না৷

এরপর এই সূরার ১০৯ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَدَّ كَثِيرٌ مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ لَوْ يَرُدُّونَكُمْ مِنْ بَعْدِ إِيمَانِكُمْ كُفَّارًا حَسَدًا مِنْ عِنْدِ أَنْفُسِهِمْ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمُ الْحَقُّ فَاعْفُوا وَاصْفَحُوا حَتَّى يَأْتِيَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ إِنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ (109

“আহলে কিতাবদের কাছে সত্য প্রকাশিত হওয়ার পরও তাদের মধ্যে অনেকে হিংসার কারণে, তোমাদেরকে সত্য প্রত্যাখ্যানকারী হিসাবে পেতে চায়। কিন্তু তোমরা তাদেরকে ক্ষমা কর এবং উপেক্ষা কর, যতক্ষণ না আল্লাহ কোন নির্দেশ দেন ৷ আল্লাহ সব বিষয়ে সর্বশক্তিমান৷” (২:১০৯)

মদীনায় বসবাসরত ইহুদীরা সবসময় মুসলমানদেরকে ইসলাম থেকে সরিয়ে নেয়ার কিংবা তাদের ঈমান দুর্বল করার চেষ্টা করত। পবিত্র কোরআন এ প্রসঙ্গে মুসলমানদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেছে, এটা মনে করার কোন কারণ নেই যে তারা নিজেদেরকে সত্যপন্থী মনে করে বলেই এ কাজ করছে৷ বরং তারা ইসলাম ও কোরআনের সত্যতা উপলদ্ধি করেছে, কিন্তু তাদের হিংসা ও বিদ্বেষের কারণে তারা এ কাজ করছে। সে সময় মুসলমানদের শক্তি কম থাকায় আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছিলেন, মুসলমানরা যাতে শত্রুদের প্রবল চাপ উপেক্ষা করে চলে এবং যতক্ষণ না কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদের নির্দেশ আসে ততক্ষণ আত্ম সংশোধনে নিয়োজিত হয়। এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, শত্রুদের বিরুদ্ধে প্রথমেই কঠোর পদক্ষেপ নেয়া ঠিক নয়, বরং ইসলামী নৈতিকতা অনুযায়ী প্রথমে ক্ষমা প্রদর্শন করতে হবে যাতে তারা সঠিক পথে ফিরে আসার সুযোগ পায়৷ এরপরও তারা সঠিক পথে না এলে তাদের মোকাবেলা করতে হবে ৷

এরপর সূরা বাকারাহ’র ১১০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآَتُوا الزَّكَاةَ وَمَا تُقَدِّمُوا لِأَنْفُسِكُمْ مِنْ خَيْرٍ تَجِدُوهُ عِنْدَ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ (110

“তোমরা নামায প্রতিষ্ঠা কর এবং যাকাত দাও। তোমরা নিজের জন্যে আগে যে সৎকর্ম প্রেরণ করবে, তা আল্লাহর কাছে পাবে। তোমরা যা কিছু কর, নিশ্চয় আল্লাহ তা প্রত্যক্ষ করেন।” (২:১১০)

দুশমনরা যখন মুসলমানদের ঈমান দুর্বল করতে চায় তখন আল্লাহ মুসলমানদের ঈমান শক্তিশালী করার জন্য তাদেরকে নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর সাথে সম্পর্ক বজায় রাখার নির্দেশ দেন৷ একইসাথে যাকাতের মাধ্যমে অন্যান্য মুসলমান বিশেষ করে দুঃস্থদের সাথে সম্পর্ক জোরদারের আহবান জানান। পবিত্র কোরআনে সাধারণত নামাজের নির্দেশের পাশাপাশি যাকাতের কথাও বলা হয়েছে৷ এর কারণ সম্ভবত এটাই যে, মানুষের সেবা করা ছাড়া আল্লাহর এবাদত যথেষ্ট নয়। অপর পক্ষে শুধু মানব সেবার কথাও বলা হয়নি। কারণ আল্লাহর আনুগত্যহীন মানব সেবার ফলে জন্ম নিতে পারে অহঙ্কার, গর্ব ও অন্যকে হেয় করার প্রবণতা। মানুষের একটি সাধারণ আশঙ্কা হলো, অন্যরা বুঝি তার সেবা ও খেদমতের কথা জানাতে পারবে না এবং জানলেও কৃতজ্ঞতা স্বীকার করবে না। তাই মানুষের মধ্যে ভালো কাজের প্রবণতা কমে যায়। এ আয়াতে বলা হয়েছে, তোমরা উদ্বিগ্ন হইও না কারণ তোমরা যা কিছু কর তার সব আল্লাহ দেখতে পান এবং পুরস্কার আল্লাহর কাছে সংরক্ষিত আছে।

এবারে সূরা বাকারাহ’র ১১১ ও ১১২ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক৷ এ দুই আয়াত বলা হয়েছে-
وَقَالُوا لَنْ يَدْخُلَ الْجَنَّةَ إِلَّا مَنْ كَانَ هُودًا أَوْ نَصَارَى تِلْكَ أَمَانِيُّهُمْ قُلْ هَاتُوا بُرْهَانَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ (111) بَلَى مَنْ أَسْلَمَ وَجْهَهُ لِلَّهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ فَلَهُ أَجْرُهُ عِنْدَ رَبِّهِ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ (112

“তারা বলে ইহুদী বা খ্রিস্টান ছাড়া আর কেউ কখনও বেহেশতে প্রবেশ করবে না। এটা তাদের মিথ্যা আশা। বল, যদি তোমরা সত্যবাদী হও তাহলে প্রমাণ পেশ কর। যে ব্যক্তি সৎকর্মপরায়ণ হয়ে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে তার ফল তার প্রতিপালকের কাছে আছে এবং তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।” (২:১১১-১১২)

মুসলমানদের মনোবল দুর্বল করার জন্য ইহুদী খ্রিস্টানদের একটি অন্যতম প্রচারণা ছিল যে, তারা বেহেশতকে নিজেদের অধীন বলে দাবি করত এবং বলত, বেহেশতে যেতে চাইলে তোমাদেরকে ইহুদী কিংবা খ্রিস্টান হতে হবে। পবিত্র কোরআন তাদের এ দাবির জবাবে বলেছে, তোমাদের এ ধারণা অলীক স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়। এর পেছনে তোমাদের কোন যুক্তি প্রমাণ নেই৷ কারণ পবিত্র জান্নাত কোন গোত্র বা জাতির জন্য সীমাবদ্ধ নয়। বরং বেহেশতে প্রবেশের জন্য রয়েছে সুনির্দিষ্ট মাপকাঠি। যে কেউ ওই মাপকাঠির ভিত্তিতে বেহেশতে যেতে পারে। বেহেশতে প্রবেশের চাবি হলো- আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করা। মানুষ আল্লাহর প্রতি নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে, যদি একমাত্র তারই উদ্দেশ্যে সৎকাজ করে তাহলে সে বেহেশতে যেতে পারে। কেউ যদি আল্লাহর নির্দেশের কিছু অংশ মান্য করে এবং কিছু অংশ বাদ দেয় তাহলে সে আল্লাহর অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হবে ৷ প্রকৃতপক্ষে গোত্রীয় বিদ্বেষ ও বর্ণ-বিদ্বেষের সঙ্গে আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পনের কোন মিল নেই। দু’টি সম্পূর্ণ পরস্পর বিরোধী। ইসলাম যে সত্য ধর্ম-এটা বোঝার পরও যারা তাদের বিদ্বেষের কারণে ঈমান আনেনি, তারা বেহেশতে যেতে পারবে না। এমনকি তারা আহলে কিতাব বা পূর্ববর্তী নবীদের প্রতি আল্লাহর দেয়া কিতাবের অনুসারী হলেও কোন লাভ হবে না। এই আয়াত থেকে বোঝা যায়, যে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে সে কোন কিছুকেই ভয় পায় না। সবসময় আল্লাহকে নিজের কাছে অনুভব করে এবং তারই আশ্রয়ে নিজেকে খুঁজে পায়৷

এ কয়েকটি আয়াতের মূল শিক্ষা হচ্ছে-
এক.মানুষ আল্লাহর অলী-আউলিয়াদের কাছ থেকে অনেক সময় যেসব অবাঞ্চিত আশা বা দাবি করে আসলে তা কুফরী বা অবিশ্বাসের ক্ষেত্র সৃষ্টি করে। কারণ আল্লাহর অলীগণ মানুষের অর্থহীন দাবি পূরণ করেন না। ফলে ওই ব্যক্তির বিশ্বাস দুর্বল হয়ে যায়৷
দুই. কাফের-মুশরেকদের সাথে দৃঢ় আচরণের আগে আন্তরিক ব্যবহার ও ক্ষমা প্রদর্শন করতে হবে। এই সহৃদয় আচরণ দুর্বলতার নিদর্শন নয় বরং এ হলো তাদেরকে আকর্ষণ ও সংশোধনের উপায় ৷
তিন. আমাদের কখনই ভাবা ঠিক নয় যে, বেহেশত কোন একটি নির্দিষ্ট জাতি বা গোত্রের জন্য নির্ধারিত। আমরা মুসলমান- কেবল এ বৈশিষ্ট্যের কারণেই যে বেহেশতে যাবো তা নয়। বরং আমাদের বেহেশতে যাবার শর্ত হলো ঈমান ও সৎকাজ৷।
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সূরা বাকারাহ”র ১১৩ নম্বর আয়াতে বলেছেন-
وَقَالَتِ الْيَهُودُ لَيْسَتِ النَّصَارَى عَلَى شَيْءٍ وَقَالَتِ النَّصَارَى لَيْسَتِ الْيَهُودُ عَلَى شَيْءٍ وَهُمْ يَتْلُونَ الْكِتَابَ كَذَلِكَ قَالَ الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ مِثْلَ قَوْلِهِمْ فَاللَّهُ يَحْكُمُ بَيْنَهُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فِيمَا كَانُوا فِيهِ يَخْتَلِفُونَ (113
“ইহুদীরা বলে খ্রিস্টানদের কোন ভিত্তি নেই অর্থাৎ তারা সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয় এবং খ্রিস্টানরা বলে ইহুদীরা সত্যের অনুসারী নয়,অথচ তারা (উভয় সম্প্রদায়ই) আল্লাহর গ্রন্থ পাঠ করে। একইভাবে মূর্তি পুজারী ও মুশরিকরা যারা (আল্লাহর গ্রন্থ সম্পর্কে) কিছুই জানে না তারাও অনুরূপ কথা বলে। সুতরাং যে বিষয়ে তাদের মতভেদ রয়েছে, আল্লাহ পুনরুত্থান দিবসে তার মীমাংসা করবেন৷” (২:১১৩)
আগের পর্বে আমরা বলেছি, ইহুদী এবং খ্রিস্টানরা বেহেশতকে একমাত্র তাদের জন্য নির্ধারিত বলে মনে করে৷ এই আয়াতে তাদের এই চিন্তাধারাকে নাকচ করে দিয়ে বলা হয়েছে যে,অন্যায় বিদ্বেষ বা হিংসার কারণেই ইহুদী ও খ্রিস্টানরা পরস্পরকে বিভ্রান্ত বলে মনে করে৷ অথচ এ দুই জাতির কাছেই ঐশী গ্রন্থ নাজেল হয়েছিল এবং তারা ছিল আল্লাহর নবীদেরই উম্মত বা অনুসারী৷ কিন্তু মজার বিষয় হলো-মুশরিক ও মূর্তিপূজারীরা ঐশী বা খোদায়ী গ্রন্থের অনুসারী না হওয়া সত্ত্বেও তারা ইহুদী ও খ্রিস্টানদের মত একই দাবি করত। অর্থাৎ দাবি করত যে, একমাত্র তারাই বেহেশতে যাবে-অন্য কেউ নয়৷ আসলে হিংসা ও প্রধান্য বিস্তারের মনোভাব মানুষকে অন্ধকারে নিক্ষেপ করে৷ ফলে তারা সত্যকে মেনে নিতে পারে না, শুধু নিজেদেরকেই সত্যের অনুসারী বলে মনে করে এবং অন্যরা যাই হোক না কেন তাদের মতে সত্যের অনুসারী নয়৷ এই আয়াতে স্পষ্ট করে এটাও বলা হয়েছে যে, মানুষ যখন অন্যায়ভাবে বিদ্বেষী হয়ে পড়ে, তখন জ্ঞানীই হোক আর মুর্খই হোক সবাই একই ধরনের চিন্তা-ভাবনা করে। আহলে কিতাব বা আসমানী কিতাবের অনুসারীরা তাওরাত ও ইঞ্জিল সম্পর্কে অবহিত হওয়া সত্ত্বেও মূর্তিপূজারী ও মুশরিক-মূর্খদের মত একই কথা বলেছে এবং এরা কোন যুক্তি-প্রমাণ ছাড়াই অন্যদেরকে বাতিল বা মিথ্যার অনুসারী বলে মনে করে৷

এরপর ১১৪নং আয়াতে বলা হয়েছে-

وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ مَنَعَ مَسَاجِدَ اللَّهِ أَنْ يُذْكَرَ فِيهَا اسْمُهُ وَسَعَى فِي خَرَابِهَا أُولَئِكَ مَا كَانَ لَهُمْ أَنْ يَدْخُلُوهَا إِلَّا خَائِفِينَ لَهُمْ فِي الدُّنْيَا خِزْيٌ وَلَهُمْ فِي الْآَخِرَةِ عَذَابٌ عَظِيمٌ (114

“যে ব্যক্তি আল্লাহর মসজিদে তাঁর নাম উচ্চারণ করতে বাধা দেয় এবং সেগুলোকে উজাড় করতে চেষ্টা করে, তার চাইতে বড় জালেম আর কে হতে পারে? এদের পক্ষে মসজিদে প্রবেশ করা সঙ্গত নয়, অবশ্য ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থায়। তাদের জন্য ইহকালে লাঞ্ছনা এবং পরকালে কঠিন শাস্তি রয়েছে।” (২:১১৪)

ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় দেখা গেছে, বহুবার আল্লাহর ঘর বা মসজিদ হয় ধ্বংস করা হয়েছে নতুবা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷ কারণ মসজিদ ও উপাসনালয় সব সময়ই ঐশী ধর্ম পরিচালনার কেন্দ্র এবং ঐশী ধর্মের অনুসারীদের সংগঠিত হওয়ার ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। তাই অত্যাচারী শাসক ও বিভ্রান্ত ব্যক্তিরা সব সময়ই মসজিদের আধ্যাত্মিক ও বাহ্যিক কাঠামো বা ভিত্তি ধবংসের চেষ্টা করেছে। যেমন,মক্কার মুশরিকরা অনেক বছর ধরে মুসলমানদের জন্য কাবা ঘর বা বায়তুল হারামে প্রবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল৷ বর্তমানেও ইসলামের শত্রুরা বায়তুল মোকাদ্দাসে অবস্থিত আল-আকসা মসজিদকে ধবংসের চেষ্টা করছে। ভারতে ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদকে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা ধ্বংস করেছে। অবশ্য মসজিদ ধবংসের অর্থ শুধু মসজিদের বাহ্যিক ভিত্তি ধ্বংস করা নয়। যেমনটি মসজিদের উন্নয়নের অর্থ শুধু মসজিদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি নয়। প্রকৃতপক্ষে যেসব কাজ মসজিদের প্রভাব বা মসজিদের প্রতি আকর্ষণ কমিয়ে দেয় এবং যেসব কাজের ফলে মানুষ আল্লাহকে ভুলে যায় ও মসজিদ থেকে দূরে থাকে সেসব কাজ করাও মসজিদের ধ্বংস সাধনের শামিল। অনৈতিক ছবি,ভিডিও বা সিনেমা প্রদর্শন হচ্ছে ইসলামী বা মুসলিম দেশের যুব সমাজকে মসজিদ ও ধর্মীয় সভা থেকে দূরে রাখার লক্ষ্য সবচেয়ে বড় ষড়যন্ত্র।

এর পরের আয়াত অর্থাৎ ১১৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَلِلَّهِ الْمَشْرِقُ وَالْمَغْرِبُ فَأَيْنَمَا تُوَلُّوا فَثَمَّ وَجْهُ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ وَاسِعٌ عَلِيمٌ (115)

“পূর্ব ও পশ্চিম আল্লাহরই জন্য, অতএব তোমরা যেদিকেই মুখ ফেরাও সে দিকেই আল্লাহ বিরাজমান। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বব্যাপী, মহাজ্ঞানী ৷(২:১১৫)

আল্লাহর নির্দেশে মুসলমানরা যখন বায়তুল মোকাদ্দাসের পরিবর্তে মক্কাকে তাদের কেবলা হিসেবে নির্ধারণ করে, তখন ইহুদীরা কিছু প্রশ্ন তোলে। এসব সম্পর্কে আমরা এর আগেও আলোচনা করেছি। যেমন তারা এ প্রশ্ন তোলে যে, যদি আগের কেবলাই সঠিক ছিল, তাহলে কেন তা পরিবর্তন করা হলো? আর যদি আগের কেবলা সঠিক না হয়, তাহলে আগের ইবাদত কি সঠিক হবে? এই সন্দেহ বা প্রশ্নের উত্তরে এই আয়াতে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর কোন নির্দিষ্ট স্থান বা এলাকা নেই ৷ পূর্ব ও পশ্চিম সব দিকেই আল্লাহ আছেন। অর্থাৎ যেদিকেই মুখ ফেরানো হোক না কেন আল্লাহ সেদিকেই আছেন। যদি কাবাঘর অথবা বায়তুল মোকাদ্দাসকে কেবলা নির্ধারণ করা হয়, তাহলে তা এই অর্থে যে, নামাজ ও অন্যান্য সামষ্টিক ইবাদতের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য রয়েছে। যেসব উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টি করে এবং সব সময় মুসলমানদেরকে এইসব উদ্দেশ্যের প্রতি আকৃষ্ট করে ৷ যতদিন পর্যন্ত ইহুদীরা বায়তুল মোকাদ্দাসকে কেবলা হিসেবে গ্রহণ করার কারণে মুসলমানদের মুসলমানদেরকে কটাক্ষ করেনি ততদিন মুসলমানরা ওই দিকে ফিরে নামাজ আদায় করত। কিন্তু যখন এই কেবলাকে মুসলমানদের দুর্বল করার ও তাদেরকে হেয় করার মাধ্যমে পরিণত করা হয় তখন আল্লাহ তালা হযরত ইব্রাহীম (আ.)এর স্মৃতির নিদর্শন কাবা ঘরকে মুসলমানদের কেবলা হিসাবে নির্ধারণ করেন ৷

এরপর ১১৬ ও ১১৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-
وَقَالُوا اتَّخَذَ اللَّهُ وَلَدًا سُبْحَانَهُ بَلْ لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ كُلٌّ لَهُ قَانِتُونَ (116) بَدِيعُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَإِذَا قَضَى أَمْرًا فَإِنَّمَا يَقُولُ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ (117)

“তারা বলে, আল্লাহ সন্তান গ্রহণ করেছেন। তিনি তো এসব কিছু থেকে পবিত্র, বরং নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলে যা কিছু রয়েছে সবই তার আজ্ঞাধীন। তিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের উদ্ভাবক। যখন তিনি কোন কার্য সম্পাদনের সিন্ধান্ত নেন, তখন সেটিকে এ কথাই বলেন, ‘হয়ে যাও’ তৎক্ষণাৎ তা হয়ে যায়।” (২:১১৬-১১৭)

ঐশী গ্রন্থের অনুসারী ইহুদী ও খ্রিস্টানরা তাদের ধর্মের সত্যতা প্রদর্শনের জন্য যেসব ভুল ধারণা প্রচার করত, সেসবের মধ্যে অন্যতম হল তাদের নবীরা নাকি ছিলেন আল্লাহর সন্তান। ইহুদীরা বলতো, উজাইর ছিল আল্লাহর সন্তান। খ্রিস্টানরা বলতো, ঈসা (আ.) আল্লাহর পুত্র। মজার বিষয় হলো, মক্কার মুশরিকরাও ফেরেশতাদেরকে ‘আল্লাহর কন্যা’ বলে মনে করত। আর তাদের মতে ‘আল্লাহর কন্যারা’ নাকি আল্লাহর কাজ সম্পন্ন করত। এই আয়াতে সাধারণ জনগণের মধ্যে প্রচলিত এসব ভুল ও অযৌক্তিক ধারণাকে নাকচ করা হয়েছে এবং আল্লাহকে সন্তান-সন্ততি থেকে মুক্ত ও পবিত্র বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ যুক্তি দেখিয়ে বলছেন, আল্লাহ সমস্ত আকাশ ও জমিনের এবং সেসবের ওপর তাঁরই আধিপত্য রয়েছে। তাই আল্লাহর এমন কি কম রয়েছে যে, এই অভাব বা চাহিদা পুরণের জন্যে তাকে সন্তান গ্রহণ করতে হবে? প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ বা প্রভুর সাথে মানুষের তুলনা এবং আল্লাহকে মানুষের মত করে চিন্তা করা হচ্ছে-এমন এক ভ্রান্ত চিন্তা যে, এর ফলে মানুষ নিজের সীমাবদ্ধতা, আশা-আকাঙ্ক্ষাকে আল্লাহর সত্ত্বার বৈশিষ্ট্য বলে মনে করে। অথচ আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেছেন, কোন কিছুই আল্লাহর মত কিংবা তাঁর সমতুল্য নয়।

এ পর্বের আলোচিত আয়াত ক’টির শিক্ষণীয় দিকগুলো একে একে তুলে ধরা হলো-
এক. মসজিদ হলো-কুফর ও শিরকের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ঘাঁটি। আর এ জন্যেই ইসলামের শত্রুরা মসজিদের বাহ্যিক ও আধ্যাত্মিক ভিত্তি ধ্বংসের চেষ্টা করে। তাই আমাদেরকে এমনভাবে প্রচেষ্টা চালাতে হবে যাতে মসজিদ হয় মুসল্লিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ এবং যাতে শত্রুরা মসজিদে প্রভাব ফেলতে ভয় পায়।
দুই. বাবা-মা, অভিভাবক, মসজিদের ইমাম ও মোয়াজ্জিন সাহেব এটা মনে রাখতে হবে যে, এমন কোন আচরণ করা উচিত হবে না যাতে কিশোর বা যুবকরা মসজিদে আসতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। বরং সব সময়ই শিশু-কিশোরদেরকে মসজিদে যেতে উৎসাহিত করা তাদের দায়িত্ব।
তিন. আল্লাহ কোন বিশেষ দিকে বা স্থান জুড়ে বিরাজ করেন না। আমরা যেদিকেই মুখ ফেরাবো সেদিকেই তাকে পাব। অর্থাৎ তিনি আছেন সব দিকেই, কিন্তু কেবলার তাৎপর্য হলো ইবাদতের বৃহৎ সমাবেশ হবে একমূখী ও সমন্বিত। আর তাও হবে তৌহিদের প্রথম কেন্দ্র কাবা অভিমূখী।
চার. আল্লাহ মানুষ নন। তাই তার সন্তান ও স্ত্রীর প্রয়োজন নেই৷ তিনি সকল নারী, পুরুষ ও তাদের সন্তানদের সৃষ্টিকর্তা। কারণ তিনিই সমগ্র সত্ত্বা ও অস্তিত্বের স্রষ্টা ও সব কিছুর ওপরই কর্তৃত্বের অধিকারী৷ আমরা আল্লাহ সম্পর্কে যেসব অলীক কল্পনা করি সেসব তারই সৃষ্টি ও সেসব আমাদের স্রষ্টা নয় ৷
সূরা বাকারাহ’র ১১৮ ও ১১৯ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন-
وَقَالَ الَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ لَوْلَا يُكَلِّمُنَا اللَّهُ أَوْ تَأْتِينَا آَيَةٌ كَذَلِكَ قَالَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ مِثْلَ قَوْلِهِمْ تَشَابَهَتْ قُلُوبُهُمْ قَدْ بَيَّنَّا الْآَيَاتِ لِقَوْمٍ يُوقِنُونَ (118) إِنَّا أَرْسَلْنَاكَ بِالْحَقِّ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَلَا تُسْأَلُ عَنْ أَصْحَابِ الْجَحِيمِ (119

“যারা কিছু জানে না, তারা বলে, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে কেন কথা বলেন না? অথবা আমাদের কাছে কোন নিদর্শন কেন আসে না? এমনিভাবে তাদের পূর্বে যারা ছিল তারাও তাদেরই মত কথা বলেছে। তাদের অন্তর একই রকম। নিশ্চয় আমি প্রকৃত বিশ্বাসীদের জন্য নিদর্শনাবলী সুস্পষ্টভাবে বিবৃত করেছি।
নিশ্চয় আমি আপনাকে সত্যধর্মসহ সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে পাঠিয়েছি। দোযখবাসীদের সম্পর্কে আপনাকে কোন জিজ্ঞাসা করা হবে না।” (২:১১৮-১১৯)

অজ্ঞ ও বিদ্বেষী লোকেরা নবীজি’র কাছে যেসব আপত্তি বা প্রশ্ন উত্থাপন করত, তার মধ্যে অন্যতম আপত্তি ছিল-আল্লাহ ও তাদের মধ্যে একজন নবীকে মাধ্যম নির্বাচিত করার কি দরকার ছিল? আল্লাহ কেন সরাসরি তাদের সঙ্গে কথা বলেন না? এবং তাদের কাছে কেন আল্লাহ তার বাণী বা আয়াত নাজেল করেন না? এরকম হলেই তো আমরা আল্লাহর বাণী মেনে নিতাম।
তাদের এইসব অযৌক্তিক আবদারের জবাবে ইসলামের নবী ও মুসলমানদেরকে সান্ত্বনা দিয়ে আল্লাহ পাক পবিত্র কোরআনে বলছেন, এ ধরনের আপত্তি নতুন কিছু নয়। এদের আগেও অনেকে এ ধরনের অযৌক্তিক আবদার করেছে। কারণ এই সমস্ত একগুঁয়ে লোকদের অন্তর অন্যান্য সত্য বিরোধীদের মতই। এ ধরনের লোকেরা আল্লাহর নবীকে মেনে নেয়া বা সত্যকে উপলদ্ধি করার যোগ্য নয়। এমনকি যদি তাদের ওপরও আল্লাহর আয়াত নাজেল হতো, তবুও তারা এসব আয়াত মেনে নিত না। কারণ তারা অজুহাতের সন্ধানেই ব্যস্ত ও সত্য মেনে নিতে প্রস্তুত নয়। তবে এতে কোন সন্দেহ নেই যে, আল্লাহর বাণী প্রচার করাই নবীদের দায়িত্ব এবং তারা আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী জনগণকে পরামর্শ দেন, তারা প্রচারের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং ফলাফলের জামিনদার নয়। তাই তারা জনগণকে সত্য গ্রহণের জন্য বাধ্য করেন না। ফলে কেউ যদি বিভ্রান্ত হয় এবং দোজখে যায় তাহলে তা তার নিজেরই পছন্দের ফল। নবীরা এ জন্যে দায়ী নয়।

এর পরের আয়াত অর্থাৎ ১২০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَلَنْ تَرْضَى عَنْكَ الْيَهُودُ وَلَا النَّصَارَى حَتَّى تَتَّبِعَ مِلَّتَهُمْ قُلْ إِنَّ هُدَى اللَّهِ هُوَ الْهُدَى وَلَئِنِ اتَّبَعْتَ أَهْوَاءَهُمْ بَعْدَ الَّذِي جَاءَكَ مِنَ الْعِلْمِ مَا لَكَ مِنَ اللَّهِ مِنْ وَلِيٍّ وَلَا نَصِيرٍ (120

“ইহুদী ও খ্রিস্টানরা কখনই আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হবে না, যে পর্যন্ত না আপনি তাদের ধর্ম অনুসরণ করেন। বলে দিন, যে পথ আল্লাহ প্রদর্শন করেন, তাই হল সরল পথ। জ্ঞান প্রাপ্তির পর যদি আপনি তাদের আকাঙ্ক্ষার অনুসরণ করেন,তবে আল্লাহর পক্ষ থেকে আপনার কোন সাহায্যকারী বা অভিভাবক থাকবে না।” (২:১২০)

কেবলা পরিবর্তনের পর মুসলমানদের ওপর ইহুদীদের ক্ষোভ আরও বেড়ে যায়। অনেক মুসলমান বায়তুল মোকাদ্দাসকেই কেবলা রাখতে চেয়েছিল যাতে মদীনার ইহুদীদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ও আন্তরিক পরিবেশে জীবন-যাপন করা যায়। কিন্তু তারা এটা বুঝতে পারেনি যে, ইহুদীরা কেবলা পরিবর্তনের ঘটনাকে মুসলমানদের বিরোধিতা করার জন্য অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করেছে। ইহুদীরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণে তো প্রস্তুত ছিলই না বরং তারা চাইতো মুসলমানরা যেন ইসলাম ধর্ম ছেড়ে দিয়ে ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করে। এই আয়াতে একটি সামগ্রিক মূলনীতি তুলে ধরা হয়েছে। আর তা হলো, সত্যের পথ থেকে মুসলমানরা যতই পিছু হটবে, শত্রুরা ততই মিথ্যা ও কুফরীর দিকে তাদেরকে ধাবিত করবে। তাই কোরআন মুসলমানদেরকে ধর্মের শত্রুদের সাথে আপোষ করতে নিষেধ করেছে৷

এরপর ১২১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

الَّذِينَ آَتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَتْلُونَهُ حَقَّ تِلَاوَتِهِ أُولَئِكَ يُؤْمِنُونَ بِهِ وَمَنْ يَكْفُرْ بِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْخَاسِرُونَ (121

“যাদেরকে কিতাব দান করা হয়েছে, যারা তা সঠিকভাবে পাঠ করে, তারাই এতে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে, আর যারা তা অস্বীকার করেছে, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে ৷” (২:১২১)

ঐশি গ্রন্থের অনুসারীদের অধিকাংশেরই ইসলাম গ্রহণ করার সৌভাগ্য হয়নি,কিন্তু তাদের মধ্যে যারা সত্য সন্ধানী দৃষ্টি নিয়ে ঐশী গ্রন্থ অধ্যয়ন করবে তারা আল্লাহর নবী ও কোরআনের ওপর ঈমান আনার তওফিক লাভ করবে। এই আয়াতে স্পষ্টভাবে এটা বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে যে, কোরআনের শব্দাবলী সম্মানের সাথে তেলাওয়াত করাই যথেষ্ট নয়, পথনির্দেশ লাভ ও সৌভাগ্যের অধিকারী হতে হলে কোরআনের আয়াতের অর্থ নিয়ে চিন্তা গবেষণা করতে হবে।

এরপর সূরা বাকারাহ’র ১২২ ও ১২৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

يَا بَنِي إِسْرَائِيلَ اذْكُرُوا نِعْمَتِيَ الَّتِي أَنْعَمْتُ عَلَيْكُمْ وَأَنِّي فَضَّلْتُكُمْ عَلَى الْعَالَمِينَ (122) وَاتَّقُوا يَوْمًا لَا تَجْزِي نَفْسٌ عَنْ نَفْسٍ شَيْئًا وَلَا يُقْبَلُ مِنْهَا عَدْلٌ وَلَا تَنْفَعُهَا شَفَاعَةٌ وَلَا هُمْ يُنْصَرُونَ (123

“হে বনী-ইসরাঈল! আমার অনুগ্রহের কথা স্মরণ কর, যা আমি তোমাদের দিয়েছি। আমি তোমাদেরকে বিশ্বাবাসীর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। তোমরা ভয় কর সে দিনকে, যে দিন এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তি বিন্দুমাত্র উপকৃত হবে না, কারও কাছ থেকে বিনিময় গৃহীত হবে না, কার ও সুপারিশ ফলপ্রদ হবে না এবং তারা সাহায্য প্রাপ্তও হবে না।” (২:১২২-১২৩)

পাঠক, আপনাদের হয়তো মনে আছে যে, সূরা বাকারাহ’র ৪৭ ও ৪৮ নম্বর আয়াতেও একই ধরনের বক্তব্য এসেছে। তাই এ দুই আয়াতের ব্যাখ্যা জানার জন্য অনুগ্রহ করে ৪৭ ও ৪৮ নং আয়াতের ব্যাখ্যা পড়ে নিন।

এ পর্বে আলোচিত আয়াতগুলোর মূল শিক্ষা হচ্ছে-
“সত্যকে অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে-তা অন্যদের কাছ থেকে হলেও। আমরা যেন এমন ধারণা না করি যে, যা কিছুই ‘আমি’ ‘আমার দল’ বা ‘গোষ্ঠী’ বলবে, শুধু তাই সত্য এবং অন্যরা যা-ই বলুক না কেন তা মিথ্যা বা পরিত্যাজ্য। আল্লাহর নবীরা মানুষকে উপদেশ, পরামর্শ, ভয় প্রদর্শন ও সুসংবাদ দেয়ার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। মানুষকে জোর করে ঈমানদার করা তাদের দায়িত্ব নয়। তাই যারা বিভ্রান্ত তাদের তৎপরতার জন্য তারা নিজেরাই দায়ী। কারণ তারা নিজেরাই বিভ্রান্তির পথ বেছে নিয়েছে। অন্যদেরকে ধর্মের দিকে আহবান করতে যেয়ে ধর্মের মূলনীতি বিসর্জন দেয়া যাবে না। ন্যায় ও ইনসাফের সঙ্গে কাজ করতে হবে। এমনকি বিরোধীদের প্রতিও ন্যায় বিচার করতে হবে।
সূরা বাকারাহ”র ১২৪তম আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন-
وَإِذِ ابْتَلَى إِبْرَاهِيمَ رَبُّهُ بِكَلِمَاتٍ فَأَتَمَّهُنَّ قَالَ إِنِّي جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَامًا قَالَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِي قَالَ لَا يَنَالُ عَهْدِي الظَّالِمِينَ (124)

“যখন ইব্রাহীমকে তাঁর পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অতঃপর তিনি তা পূর্ণ করে দিলেন, তখন পালনকর্তা বললেন, আমি তোমাকে মানবজাতির নেতা করব। তিনি বললেন, হে আল্লাহ! আপনি আমার বংশধরদের মধ্য থেকেও (ইমাম) নিযুক্ত করুন। তিনি বললেন, আমার অঙ্গীকার অত্যাচারীদের পর্যন্ত পৌঁছাবে না।” (২:১২৪)
পয়গম্বরদের মধ্যে হযরত ইব্রাহীম (আ.) ছিলেন বিশেষভাবে মর্যাদাবান। তাঁর নাম পবিত্র কোরআনের ২৫টি সূরায় ৬৯ বার এসেছে এবং তাকে মহানবী (সাঃ)-এর মতোই আদর্শ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এই সূরাতেই এই আয়াত থেকে শুরু করে ১৮টি আয়াতে পবিত্র কাবাঘরের প্রতিষ্ঠাতা আল্লাহর এ নবীর কথা বলা হয়েছে। হযরত ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহর বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর ইমামত লাভ করেন। এই আয়াতে ‘কালিমাত’ বলে যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, তার মাধ্যমে হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর ওপর অর্পিত কিছু কঠিন দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে যা কিনা তিনি সফলভাবে সম্পন্ন করেছিল।

ওইসব কঠিন দায়িত্বের কয়েকটি দিক হচ্ছে, হযরত ইব্রাহীম (আ.) তার গোত্রের মধ্যে একমাত্র একত্ববাদী ছিলেন। কিন্তু তিনি একাই অসীম সাহসিকতার সাথে শিরক্‌ ও মূর্তিপূজার বিরুদ্ধে সংগ্রামে নামেন। মূর্তিগুলো যেখানে রাখা হতো একদিন সেখানে ঢুকে তিনি সমস্ত মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলেন। মূর্তি ভাঙ্গার দায়ে তাকে অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু হযরত ইব্রাহীম (আ.) দৃঢ় ঈমান ও স্থিরচিত্তে অগ্নিকুণ্ডে প্রবেশ করলেন। কিন্তু সবাই লক্ষ্য করল আল্লাহর ইচ্ছায় আগুন ঠাণ্ডা হয়ে গেল এবং তার কোন ক্ষতিই হলো না।
হযরত ইব্রাহীমের জন্য আল্লাহর আরেকটি পরীক্ষা ছিল, তার পুত্র সন্তানকে কোরবানীর নির্দেশ। দীর্ঘদিন সন্তান থেকে বঞ্চিত থাকার পর আল্লাহ তাকে পুত্র সন্তান ইসমাইলকে দান করলেন। আল্লাহর নির্দেশে বহুদিনের কাঙ্ক্ষিত পুত্র সন্তানকেই তিনি কোরবানী করতে উদ্যত হয়েছিলেন। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছায় ইসমাইলের পরিবর্তে কোরবানী হয় এক পশু। এভাবে বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার পর আল্লাহতালা তাঁকে ইমামতের মর্যাদা দান করলেন। হযরত ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহর কাছে তার বংশধরদের জন্যেও ইমামতের মর্যাদাদানের প্রার্থনা করেন৷ আল্লাহপাক তার এই প্রার্থনার জবাবে বললেন, ইমামতের এই মর্যাদা বংশানুক্রমিক নয় বরং যার যোগ্যতা আছে সেই এ মর্যাদার অধিকারী হতে পারবে।

রাসূলের দায়িত্ব হলো- আল্লাহর বাণী ও বিধি-বিধান পৌঁছে দেয়া এবং জনগণকে ভালো কাজের সুসংবাদ ও মন্দ কাজের ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়া। অপরপক্ষে ইমামের দায়িত্ব হলো সমাজে ওই বিধি-বিধান বাস্তবায়ন করা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
সূরা বাকারাহ’র এ আয়াতে স্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে যে, ইমামত আল্লাহর অঙ্গীকার ও আমানত, যা জালিম, অন্যায়কারী ও গুনাহগার ব্যক্তিরা পাবে না। এ আয়াত থেকে বুঝা যায়, যারা জীবনে গুণাহ করেছে তারা ইমামতের দায়িত্ব পেতে পারে না।

এরপর ১২৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

وَإِذْ جَعَلْنَا الْبَيْتَ مَثَابَةً لِلنَّاسِ وَأَمْنًا وَاتَّخِذُوا مِنْ مَقَامِ إِبْرَاهِيمَ مُصَلًّى وَعَهِدْنَا إِلَى إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ أَنْ طَهِّرَا بَيْتِيَ لِلطَّائِفِينَ وَالْعَاكِفِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ (125)

“(সেই সময়ের কথা স্মরণ কর) যখন কাবাঘরকে মানবজাতির সম্মিলন স্থল ও নিরাপদ কেন্দ্র করেছিলাম আর বলেছিলাম তোমরা ইব্রাহীমের দাঁড়াবার স্থানকেই নামাজের স্থান হিসাবে গ্রহণ কর৷ আর আমি ইব্রাহীম ও ইসমাইলের সাথে অঙ্গীকার করেছি যে আমার ঘর তাওয়াফকারী, এতেকাফকারী, রুকুকারী ও সেজদাকারীদের জন্য পবিত্র করে রাখবে।” (২:১২৫)

এর আগের আয়াতে হযরত ইব্রাহীমের সুউচ্চ মর্যাদা ও ইমামতের কথা বলা হয়েছে। আর এ আয়াতে হযরত ইব্রাহীমের মহান অবদান পবিত্র কাবাঘরের কথা বলা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই ঘর মানব ইতিহাসে একত্ববাদীদের মিলনস্থল। তাওয়াফ, নামাজ ও এবাদতের জন্য পবিত্র ও নিরাপদ কেন্দ্র। হজ্ব যাত্রীরা মক্কা শরীফে গিয়ে কাবাঘর তাওয়াফের পর দু”রাকাত নামাজ পড়েন। তাদের এ নামাজ পড়তে হয় মাকামে ইব্রাহীমকে সামনে রেখে। মাকামে ইব্রাহীম হলো কাবাঘর ঘেষা ওই পবিত্র স্থান যেখানে কাবাঘরের দেয়াল তৈরির সময় তিনি দাঁড়াতেন। আল্লাহপাক হযরত ইব্রাহীম (আ.)-এর কষ্টের প্রতি সম্মান দেখানোর জন্য নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে হাজীরা মাকামে ইব্রাহীমকে পেছনে রেখে নামাজ না পড়েন। হযরত ইব্রাহীম ও ইসমাইল (আ.) শুধু কাবাঘরের নির্মাতাই ছিলেন না, তারা একইসাথে ওই পবিত্র ঘরের খাদেম বা সেবকও ছিলেন। আল্লাহর নির্দেশে তারা মসজিদুল হারামকে যাবতীয় অপবিত্রতা থেকে রক্ষা করতেন যাতে আল্লাহর বান্দারা সেখানে নামাজ ও এবাদত করতে পারেন। মূলত: মসজিদ হলো আল্লাহর ঘর। আর এ ঘরের খাদেম বা সেবককেও হতে হবে পবিত্র এবং আল্লাহর অলী। যে কেউ মসজিদ দেখা শোনার মতো পবিত্র ও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের অধিকারী হতে পারে না।

এরপর ১২৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّ اجْعَلْ هَذَا بَلَدًا آَمِنًا وَارْزُقْ أَهْلَهُ مِنَ الثَّمَرَاتِ مَنْ آَمَنَ مِنْهُمْ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآَخِرِ قَالَ وَمَنْ كَفَرَ فَأُمَتِّعُهُ قَلِيلًا ثُمَّ أَضْطَرُّهُ إِلَى عَذَابِ النَّارِ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ (126)

“স্মরণ কর যখন ইব্রাহীম বলেছিল, হে আমার প্রতিপালক! একে নিরাপদ শহরে পরিণত কর আর এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করবে তাদেরকে বিভিন্নভাবে ফলের দ্বারা রিযিক দাও৷ আল্লাহপাক ইব্রাহীমের প্রার্থনার জবাবে বললেন, কাফেরদেরকেও আমি কিছু কালের জন্য জীবনোপভোগের সুযোগ দেব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি তাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি ভোগ করতে বাধ্য করবো এবং তা কত নিকৃষ্ট পরিণাম!” (২:১২৬)

হযরত ইব্রাহীম (আ.) কাবাঘর প্রতিষ্ঠার পর সেটি এবাদতের জন্য প্রস্তুত করলেন এবং একইসঙ্গে মক্কাশরীফের অধিবাসীদের জন্যে আল্লাহর কাছে দু’টি জিনিসের আবেদন জানালেন। একটি নিরাপত্তা ও শান্তি আর অপরটি হলো জীবন ধারণের জন্য রিজিকের ব্যবস্থা। যদিও ইব্রাহীম (আ.) কেবল মুমিনদের জন্য দোয়া করেছেন, কিন্তু তারপরও আল্লাহপাক জবাবে স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, তিনি বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী নির্বিশেষে সবার জন্যে বস্তুগত রিজিক দান করবেন। তিনি কাফেরদেরকে তাদের অবিশ্বাসের জন্য দুনিয়ার ধন-সম্পদ বা ঐশ্বর্য থেকে বঞ্চিত করেন না। যদিও তারা তাদের কাজের জন্য পরকালে দোজখে প্রবেশ করবে।
এ আয়াতে দু’টি বিষয় তুলে ধরা হয়েছে-
প্রথমত: মুমিনদের জন্য দুনিয়ার সুযোগ-সুবিধা ও বস্তুগত কল্যাণের প্রয়োজন আছে এবং সেজন্যেই হযরত ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহর কাছ থেকে তা চেয়েছেন ৷
দ্বিতীয়ত: কাফেররা পার্থিব ধন-সম্পদের অধিকারী হলেও তা তাদের শ্রেষ্ঠত্ব বা সৎ পথে থাকার প্রমাণ বহন করে না। বরং এ থেকে আল্লাহর কাছে পার্থিব সম্পদ যে মূল্যহীন তাই ফুটে উঠে।

এবারে সূরা বাকারাহ’র ১২৭ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক। এ আয়াতে বলা হয়েছে-

وَإِذْ يَرْفَعُ إِبْرَاهِيمُ الْقَوَاعِدَ مِنَ الْبَيْتِ وَإِسْمَاعِيلُ رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا إِنَّكَ أَنْتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ (127)

“যখন ইব্রাহীম ও ইসমাইল কাবা ঘরের ভিত্তি স্থাপন করছিল তখন তারা দোয়া করেছিলেন-হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের এ কাজ গ্রহণ কর, নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।” (২:১২৭)

হযরত আদম (আ.)এর সময় থেকেই কাবা ঘর ছিল ৷ কিন্তু হযরত ইব্রাহীম (আ.) তা পুনঃনির্মাণ করেন। কারণ মক্কায় যখন হযরত ইব্রাহীম (আ.) তার স্ত্রী সন্তানকে বসবাসের জন্য নিয়ে গেলেন তখন বললেন, হে প্রতিপালক! আমি আমার বংশধরকে এই শুষ্ক ও চাষবাসহীন এলাকায় তোমার ঘরের পাশে থাকার ব্যবস্থা করলাম৷ সুতরাং বোঝা যাচ্ছে যে, ইব্রাহীম (আ.) যখন মক্কায় আসেন তখন সেখানে আল্লাহর ঘর অর্থাৎ কাবাঘরের অস্তিত্ব ছিল৷ এছাড়াও সূরা আল ইমরানের ৯৬ নম্বর আয়াতে কাবাকে এবাদতের প্রথম ঘর বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে৷
সূরা বাকারাহ’র ১২৭ নম্বর আয়াত থেকে বোঝা যায়, যদি নিয়ত আল্লাহমুখী হয় তাহলে মিস্ত্রির কাজও এবাদত। মূলত: কাজ কি সেটা মোটেও গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং আল্লাহর দরবারে ওই কাজ কবুল হওয়াই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমরা যদি কাবা ঘরও নির্মাণ করি আর সে নির্মাণ কাজ যদি আল্লাহর দরবারে কবুল না হয় তাহলে তার কোন মূল্য নেই।

এবারে আজকের আলোচিত কয়েকটি আয়াতের মূল শিক্ষা সংক্ষেপে তুলে ধরছি।
এক. আল্লাহপাক ব্যক্তির যোগ্যতা অনুসারে আধ্যাত্মিক মর্যাদা দান করেন। দুনিয়ার নানা ঘটনা হলো আল্লাহর এক ধরনের পরীক্ষা, যাতে মানুষ সেসবের মাধ্যমে নিজেদের যোগ্যতা তুলে ধরতে পারে এবং মর্যাদাপূর্ণ স্থানে পৌঁছুতে পারে।
দুই. ইমামত ও নেতৃত্ব খোদার দেয়া একটি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান, এটি দুনিয়াবী কোন পদমর্যাদা নয়। সুতরাং ইসলামী সমাজের ওপর যে কেউ শাসন চালাতে পারে না এবং যেকারো নেতৃত্ব দেয়ার অধিকার নেই ৷
তিন. মসজিদ আল্লাহর ঘর এবং বিশেষ পবিত্রতা ও মর্যাদার অধিকারী৷ তাই সৎ ও মুত্তাকী লোকদেরকে মসজিদের তত্ত্বাবধায়ক হতে হবে ৷
চার. মক্কা হলো একটি আদর্শ ইসলামী শহরের দৃষ্টান্ত। এটি যেমন এবাদতের স্থান তেমনি নিরাপত্তার কেন্দ্র। মূলত: আল্লাহর এবাদত হতে হবে নিরাপত্তা ও শান্তির ছায়াতে। কারণ ধর্ম বৈষয়িক বিষয় থেকে আলাদা কিছু নয়।
সূরা বাকারাহ”র ১২৮ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন-
رَبَّنَا وَاجْعَلْنَا مُسْلِمَيْنِ لَكَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِنَا أُمَّةً مُسْلِمَةً لَكَ وَأَرِنَا مَنَاسِكَنَا وَتُبْ عَلَيْنَا إِنَّكَ أَنْتَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ (128)
“(হযরত ইব্রাহীম ও ইসমাইল (আ.) বলেছেন) হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের উভয়কে তোমার অনুগত কর এবং আমাদের বংশধর হতে তোমার অনুগত এক উম্মত সৃষ্টি কর। আমাদেরকে ইবাদতের নিয়ম পদ্ধতি দেখিয়ে দাও এবং আমাদের ওপর ক্ষমা পরবশ হও৷ তুমি অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।” (২:১২৮)
হযরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর সকল নির্দেশ নিষ্ঠার সাথে পালন করতেন। এটাই তাঁর সাফল্যের মূল কারণ। এর সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত হলো তিনি আল্লাহর নির্দেশের কারণে নিজের সন্তান ইসমাইলকে জবাই করতে উদ্যত হয়েছিলেন। আর এই একই লক্ষ্যে হযরত ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন যে, শুধু তিনি নিজেই নন, তাঁর সন্তান ইসমাইল ও তাঁর বংশধররাও যেন ঐশী বিধানের অনুগত হয়। কারণ সমস্ত পূর্ণতা হলো আল্লাহর দাসত্বের মধ্যে এবং তাঁর একক সত্ত্বার এবাদতের মধ্যে। অবশ্য ইবাদত বা আরাধনা হতে হবে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতিতে,সব ধরনের কুসংস্কার ও বেদআত বা কু-প্রথা থেকে মুক্ত হয়ে। আর এ জন্যেই হযরত ইব্রাহীম (আ.) আল্লাহর কাছে এই বলে প্রার্থনা করেছেন যে, হে খোদা! তোমার ইবাদতের পন্থা তুমি আমাদেরকে শিখিয়ে দাও, যাতে তুমি যেভাবে চাও সেভাবে তোমার ইবাদত করতে পারি ৷

সূরা বাকারাহ’র ১২৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

رَبَّنَا وَابْعَثْ فِيهِمْ رَسُولًا مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آَيَاتِكَ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُزَكِّيهِمْ إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ (129)

“হে পরওয়ারদেগার! তাদের মধ্যে থেকেই তাদের নিকট একজন পয়গম্বর প্রেরণ করুণ, যিনি তাদের কাছে আপনার আয়াত তেলাওয়াত করবেন, তাদেরকে কিতাব ও প্রজ্ঞা শিক্ষা দেবেন এবং তাদের পবিত্র করবেন। নিশ্চয় আপনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।” (২:১২৯)

একদিকে বংশধরদের জন্য চিন্তা ও আন্তরিকতা এবং অন্যদিকে ভবিষ্যৎ চিন্তার কারণে ইব্রাহীম (আ.) তাঁর দোয়ায় নিজের জন্য আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়ার আগে ভবিষ্যৎ বংশধরদের মুক্তি ও সৌভাগ্যের জন্য দোয়া করলেন। যেহেতু সৌভাগ্য আল্লাহর পথ-নির্দেশনা ছাড়া পাওয়া সম্ভব নয়, সেহেতু ইব্রাহীম (আ.) মানুষের জন্য একজন ঐশী পথ-নির্দেশক বা পয়গাম্বর পাঠানোর আবেদন জানান, যাতে করে তিনি তাদেরকে শিক্ষা দেয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং মানুষের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার বিকাশ ঘটান ৷

এরপর ১৩০ ও ১৩১ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

وَمَنْ يَرْغَبُ عَنْ مِلَّةِ إِبْرَاهِيمَ إِلَّا مَنْ سَفِهَ نَفْسَهُ وَلَقَدِ اصْطَفَيْنَاهُ فِي الدُّنْيَا وَإِنَّهُ فِي الْآَخِرَةِ لَمِنَ الصَّالِحِينَ (130) إِذْ قَالَ لَهُ رَبُّهُ أَسْلِمْ قَالَ أَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ (131)

“বোকা বা নির্বোধ ছাড়া আর কে ইব্রাহিমের ধর্মাদর্শ থেকে বিমুখ হবে ! নিশ্চয়ই আমি তাকে পৃথিবীতে মনোনীত করেছি এবং সে পরকালে সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হবে।
তার প্রতিপালক যখন তাকে বলেছিলেন, আত্মসমর্পণ কর তখন তিনি বলেছিলেন, বিশ্বজগতের প্রতিপালকের কাছে আত্ম-সমর্পণ করলাম।”(২:১৩০-১৩১)

এই আয়াতে হযরত ইব্রাহীম (আ.)কে আল্লাহর মনোনীত একজন আদর্শ মানুষ হিসাবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে তাঁর ধর্ম ও আদর্শ অন্য সকল মানুষের জন্য আদর্শ হতে পারে। এটা কি নির্বুদ্ধিতা নয় যে, এমন একটি পবিত্র ও বিশুদ্ধ ধর্মকে ছেড়ে দিয়ে মানুষ শির্ক ও কুফরীর মত গোমরাহীর দিকে ছুটবে? অথচ এ ধর্ম হচ্ছে মানুষের প্রকৃতি ও বুদ্ধিবৃত্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ইব্রাহীম (আ.)এর ধর্ম এত গুরুত্বপূর্ণ যে, ইসলামের নবী গর্ব করে বলেছেন, তাঁর পথ হলো ইব্রাহীমেরই পথ, যে ইব্রাহীম যুক্তি দিয়ে কাফের বা অবিশ্বাসীদের নির্বাক করেছিলেন এবং সাহসিকতার মাধ্যমে একাই সমস্ত মূর্তিকে কুঠার দিয়ে ভেঙ্গে ফেলেছিলেন৷ ইব্রাহীম(আ.) আল্লাহর আনুগত্যের ক্ষেত্রেও চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন৷ তিনি তার স্ত্রী ও সন্তানকে মক্কার উত্তপ্ত মরুতে পরিত্যাগ করেন এবং নিজের তরুণ সন্তানকে কোরবানী দিতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। এসবের মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, তার অন্তর স্ত্রী ও সন্তানের জন্য অন্ধ ছিল না বরং তার অন্তর ছিল শুধু আল্লাহর জন্য নিবেদিত। এটা স্পষ্ট যে, আল্লাহ এ ধরনের মানুষকে যোগ্যতা দিয়ে মনোনীত করেছেন এবং তাঁকে অন্যদের নবী ও নেতা হিসাবে নিযুক্ত করেছেন ৷ তাই ইব্রাহীম (আ.)এর পথ থেকে দূরে থাকা নির্বুদ্ধিতা ও অজ্ঞতা ছাড়া অন্য কিছু নয় ৷

এরপর ১৩২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَوَصَّى بِهَا إِبْرَاهِيمُ بَنِيهِ وَيَعْقُوبُ يَا بَنِيَّ إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَى لَكُمُ الدِّينَ فَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ (132)

“ইব্রাহীম ও ইয়াকুব এ সম্পর্কে তাদের পুত্রদেরকে নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন, হে পুত্রগণ, আল্লাহ তোমাদের জন্য এই ধর্ম মনোনীত করেছেন। সুতরাং তোমরা মুসলমান না হয়ে অন্য কোন অবস্থায় মৃত্যু বরণ করো না ৷” (২:১৩২)

একজন আন্তরিক ও দয়ালু পিতা শুধু সন্তানের বৈষয়িক স্বার্থ রক্ষারই চিন্তা করেন না বরং সন্তানদের চিন্তাধারার সুস্থতা ও বিচ্যূতিহীনতার দিকেই তিনি বেশী লক্ষ্য রাখেন। মৃত্যুর সময় আল্লাহর মনোনিত ব্যক্তিরা তাদের সন্তানদেরকে শুধু পার্থিব ধন-সম্পদ বন্টনের ব্যাপারেই ওসিয়ত করেননি, একইসঙ্গে তৌহিদ ও ইবাদতের ব্যাপারেও পরামর্শ দিয়েছেন।

এরপরের আয়াত অর্থাৎ ১৩৩ নং আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন-

أَمْ كُنْتُمْ شُهَدَاءَ إِذْ حَضَرَ يَعْقُوبَ الْمَوْتُ إِذْ قَالَ لِبَنِيهِ مَا تَعْبُدُونَ مِنْ بَعْدِي قَالُوا نَعْبُدُ إِلَهَكَ وَإِلَهَ آَبَائِكَ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ إِلَهًا وَاحِدًا وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ (133)

“ইয়াকুবের মৃত্যু যখন ঘনিয়ে এল, তোমরা কি তখন উপস্থিত ছিলে? সে যখন তার পুত্রগণকে জিজ্ঞাসা করেছিল আমার পরে তোমরা কিসের ইবাদত করবে? তারা তখন বলেছিল-আমরা আপনার ও আপনার পিতৃপুরুষ ইব্রাহীম, ইসমাইল ও ইসহাকের যে একক প্রভু রয়েছেন-তাঁরই উপাসনা করব এবং আমরা তারই নিকট আত্মসমর্পণকারী ৷” (২:১৩৩)

একদল ইহুদী মনে করে, ইয়াকুব মৃত্যুর সময় তাঁর সন্তানদেরকে তৎকালীন ইহুদী ধর্মের যে বিশ্বাস তা গ্রহণের সুপারিশ করেছিলেন। আল্লাহ এই দাবি অস্বীকার করে বলেছেন, তোমরা কি ইয়াকুবের মৃত্যুর সময় উপস্থিত ছিলে যে এমন দাবি করছ? বরং সে তার সন্তানদেরকে এক আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বলেছিল এবং তার সন্তানরা ওয়াদা করেছিল যে তারা শুধু এক আল্লাহরই ইবাদত বা দাসত্ব করবে৷ তৌহিদের অন্যতম যুক্তি হলো সব নবীই এক খোদার কথা বলেছেন এবং ইব্রাহীম, ইসমাইল ও ইসহাকের খোদা ছিল একই ৷ যদি অন্য কোন খোদার অস্তিত্ব থাকতো, তাহলে তারাও মানুষের পথ প্রদর্শনের জন্য নবী পাঠাতেন ও নিজেকে মানুষের মধ্যে পরিচিত করতেন ৷

আলোচিত আয়াতগুলোর কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে-
এক. মানুষ শুধু আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পণ করবে। কারণ আল্লাহর আনুগত্য ও তাঁর কাছে নিজেকে সপে দেয়ার মাধ্যমেই ইহকাল ও পরকালে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব।
দুই. দোয়া করার সময় শুধু নিজের বৈষয়িক দিকের কথা চিন্তা না করে বরং সন্তান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের সৌভাগ্যের জন্যও দোয়া করা উচিত।
তিন. অশিক্ষিত ব্যক্তিই নির্বোধ নয় বরং নির্বোধ সেই যে জ্ঞান-বুদ্ধি থাকা সত্ত্বেও বিভ্রান্তিতে নিপতিত হয়।
সূরা বাকারাহ’র ১৩৪ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন-
تِلْكَ أُمَّةٌ قَدْ خَلَتْ لَهَا مَا كَسَبَتْ وَلَكُمْ مَا كَسَبْتُمْ وَلَا تُسْأَلُونَ عَمَّا كَانُوا يَعْمَلُونَ (134)

“সেই উম্মত (দল) চলে গেছে, তারা যা অর্জন করেছে তা তাদের, তোমরা যা অর্জন করেছ তা তোমাদের, তারা যা করত সে সম্বন্ধে তোমাদেরকে প্রশ্ন করা হবে না।” (২:১৩৪)

বনী ইসরাইল বা ইহুদীরা তাদের পূর্বপুরুষদের নিয়ে গর্ব করতো৷ তাদের ধারণা ছিল, তারা নিজেরা যতই ভুল-ভ্রান্তি বা পাপ করুক না কেন, তাদের পূর্বপুরুষদের ভালো কাজের কারণে তারাও ক্ষমা লাভ করবে। তাই তারা নিজেদের সংশোধনের পরিবর্তে তাদের পূর্বপুরুষদের কাজ-কর্ম স্মরণ করতো এবং সর্বত্র বলে বেড়াত। কিন্তু এই আয়াতে তাদেরকে ও মুসলমানসহ অন্যান্যদেরকে এই বলে সাবধান করে দেয়া হয়েছে যে, প্রত্যেক মানুষ নিজে নিজের কাজের জন্য দায়ী থাকবে এবং কিয়ামত বা পুনরুত্থানের সময় পিতা, সন্তান ও আত্মীয়ের সম্পর্ক কারো কোনই কাজে আসবে না। তাই পূর্বপুরুষের ভালো কাজের জন্য যেন তারা আনন্দিত না হয়৷ আমীরুল মুমিনীন হযরত আলী (আঃ) বলেছেন, মানুষের মর্যাদা তার মহত্ব বা অধ্যবসায়ের মধ্যে নিহিত, পূর্ববর্তীদের নষ্ট হয়ে যাওয়া হাঁড়ের মধ্যে নয়।

এরপর ১৩৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

وَقَالُوا كُونُوا هُودًا أَوْ نَصَارَى تَهْتَدُوا قُلْ بَلْ مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ (135)

“তারা বলে, তোমরা ইহুদী অথবা খ্রিস্টান হয়ে যাও,তবেই সুপথ পাবে। আপনি বলুন, (কখনই নয়) বরং আমরা ইব্রাহীমের ধর্মে আছি যা সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সে মুশরিক বা অংশীবাদীদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। (২:১৩৫)

ইহুদীরা নিজেদেরকে সঠিক পথের অনুসারী বলে দাবী করে ও খ্রিস্টানদেরকে বিভ্রান্ত বলে মনে করে। অন্যদিকে খ্রিস্টানরা নিজেদেরকে সত্যের অনুসারী ও ইহুদীদেরকে বিভ্রান্ত বলে মনে করে। এভাবে তারা পরস্পরকে নিজেদের ধর্মের দিকে আহবান করত৷ কোরআন এই কর্তৃত্বকামী প্রচেষ্টার জবাবে বলেছে, মুক্তি লাভের পথ কোন দলের আনুগত্য করে পাওয়া যাবে না বরং মুক্তি পেতে হলে সত্য পথের অনুসারি হতে হবে৷ এক্ষেত্রে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) একটি আদর্শ কারণ কখনও শির্ক ও আত্মপূজায় লিপ্ত হননি।

এই আয়াত আমাদেরকে এটা শিক্ষা দেয় যে, ইহুদী হওয়া বা খ্রিস্টান হওয়া বড় কথা নয় । তৌহিদ বা একত্ববাদের অনুসরণ করাই হল গুরুত্বপূর্ণ।

এরপর ১৩৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

قُولُوا آَمَنَّا بِاللَّهِ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْنَا وَمَا أُنْزِلَ إِلَى إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ وَالْأَسْبَاطِ وَمَا أُوتِيَ مُوسَى وَعِيسَى وَمَا أُوتِيَ النَّبِيُّونَ مِنْ رَبِّهِمْ لَا نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْهُمْ وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُونَ (136)

“তোমরা বল, আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর ওপর এবং যা অবতীর্ণ হয়েছে আমাদের প্রতি এবং যা অবতীর্ণ হয়েছে ইব্রাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক, ইয়াকুব এবং তদের বংশধরের প্রতি এবং মূসা, ঈসা, অন্যান্য নবীকে পালনকর্তার পক্ষ থেকে যা দান করা হয়েছে। আমরা তাদের মধ্যে পার্থক্য করি না। আমরা তাঁরই আনুগত্যকারী।” (২:১৩৬)

পূর্ববর্তী আয়াতে ধর্ম নিয়ে ইহুদী ও খ্রিস্টানদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কথা বলা হয়েছিল৷ তারই রেশ ধরে এ আয়াতে ইহুদী ও খ্রিস্টান এবং অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের বলা হয়েছে যে, আল্লাহর পয়গম্বর বা ঐশী পথনির্দেশকদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই৷ কারণ তাঁদের সবাই এক খোদার পক্ষ থেকে এসেছেন৷ তাঁদের ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তাও এক আল্লাহর পক্ষ থেকে এসেছে৷ তাই একত্ববাদের অনুসারীদের উচিত সমস্ত ঐশী পথ প্রদর্শকদের মেনে নেয়া এবং তাঁদের ওপর যা অবতীর্ণ হয়েছে তা বিশ্বাস করা৷ শুধু নিজেদের পয়গম্বরকে মানব ও অন্যদের পয়গম্বরকে ও তাদের গ্রন্থগুলোকে অস্বীকার করব-এটা ন্যায় বিচার হতে পারে না৷ আল্লাহর নবীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মত, যারা একটা নির্দিষ্ট সময়ে মানুষকে শিক্ষাদানের দায়িত্ব পেয়েছেন এবং চিন্তার ক্ষেত্রে মানুষের অগ্রগতির সাথে সঙ্গতি রেখে আল্লাহ গ্রন্থসমূহ ও অধিকতর পূর্ণাঙ্গ আইন-বিধান নাজিল করেছেন, যাতে করে মানুষকে সুপথ প্রদর্শন করা যায়৷

এরপর ১৩৭ নং আয়াতে বলা হয়েছে।-
فَإِنْ آَمَنُوا بِمِثْلِ مَا آَمَنْتُمْ بِهِ فَقَدِ اهْتَدَوْا وَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا هُمْ فِي شِقَاقٍ فَسَيَكْفِيكَهُمُ اللَّهُ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ (137)
“তোমরা যাতে বিশ্বাস করেছ তারাও যদি একই রকম বিশ্বাস করে তবে তারা সুপথ পাবে। আর যদি মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তারাই হঠকারিতায় রয়েছে। সুতরাং এখন তাদের জন্যে আপনার পক্ষ থেকে আল্লাহই যথেষ্ট। তিনিই শ্রবণকারী, মহাজ্ঞানী।” (২:১৩৭)

এ আয়াতে মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, যদি তথাকথিত ঐশিগ্রন্থের অনুসারীরা আত্মকেন্দ্রীকতা ও বংশীয় কলহ বিদ্বিষ ছেড়ে দিয়ে মুসলমানদের মতই সমস্ত নবী ও তাদের উপর অবতীর্ণ গ্রন্থের প্রতি ঈমান আনত, তাহলে তারা সঠিক পথ খুঁজে পেত৷ কিন্তু যদি তারা নিজেদেরকে সত্যের মানদণ্ড বলে মনে করে ও অন্যান্য ধর্মের অনুসারী ও তাদের পয়গম্বরদের বিভ্রান্ত বলে মনে করে, তবে তাহলো সত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধের লক্ষণ এবং সত্যানুসন্ধানীদের দল থেকে বিচ্ছিন্ন হবার লক্ষণ৷ এই আয়াতের শেষে মুসলমানদেরকে সাহস যুগিয়ে বলা হচ্ছে যে, ধর্মের শত্রুদের ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় আল্লাহই মুসলমানদের জন্য যথেষ্ট৷ কারণ তোমাদের সম্পর্কে যা বলা হচ্ছে ও যে সব পরিকল্পনা করা হচ্ছে-সেসবই আল্লাহপাক অবগত আছেন ৷

এরপর ১৩৮ নম্বর আয়াত নিয়ে আলোচনা করা যাক ৷ এ আয়াতে বলা হয়েছে-

صِبْغَةَ اللَّهِ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ صِبْغَةً وَنَحْنُ لَهُ عَابِدُونَ (138)

“আমরা আল্লাহর রঙ গ্রহণ করেছি। আল্লাহর রঙ এর চাইতে উত্তম রং আর কার হতে পারে? আমরা তাঁরই এবাদত করি।”(২:১৩৮)

আল্লাহ হচ্ছেন সমগ্র জগতের রঙদানকারী শিল্পী৷ তিনি মানুষ সৃষ্টির শুরুতে মানুষের আত্মাকে পবিত্র স্বভাব বা প্রকৃতি দিয়ে রঙীন করেছেন৷ কিন্তু মানুষ আল্লাহর দেয়া রঙের ওপর নিজেদের ইচ্ছে মত রঙ লাগাচ্ছে। যেমন প্রবৃত্তির অনুসরণ করছে৷ আর এভাবে আল্লাহর দেয়া স্বভাবগত রঙকে নিজের অস্তিত্ব থেকে মুছে ফেলছে। ব্যক্তিগত দলীয় ও গোষ্ঠীগত বিদ্বেষ হলো এমন কিছু বৈশিষ্ট্য বা রঙ, যা মানুষের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা বা বিভেদ সৃষ্টি করে। তাই এসব গোত্রীয় ও বংশীয় সকল রঙ বা বৈশিষ্ট্য দূর করতে হবে যাতে আল্লাহর রঙ মানুষের মধ্যে ফুটে ওঠে। আল্লাহর রঙ ছাড়া সকল রঙই সময়ের পরিক্রমায় ম্লান ও ধীরে ধীরে বর্ণহীন হয়ে যায়৷ কিন্তু শুধু আল্লাহর রঙই সুদৃঢ় ও অম্লান হয়ে টিকে থাকে৷ সব রঙই বিচ্ছিন্নতা ও বিভক্তি ডেকে আনে৷ কিন্তু আল্লাহর রঙ হলো ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের মানদণ্ড এবং তা এক আল্লাহর দাসত্বের ছায়াতলে অবস্থিত৷

আজকের আলোচিত আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে ,
এক. পূর্ব পুরুষদের নিয়ে গর্ব না করে নিজেদের কাজের ব্যাপারে চিন্তা করতে হবে৷ প্রত্যেককেই তার কর্মের ফল ভোগ করতে হবে৷ অন্যরা যখন তাদের পারলৌকিক মুক্তির জন্য আপ্রাণ সচেষ্ট, তখন আমরা নিজেদের বংশ নিয়ে গর্ব মত্ত না থাকি।
দুই. আমাদেরকে সত্যপন্থী হতে হবে, দল পন্থী নয়৷ সত্যপন্থী হলে মানুষের চোখ ও কান সত্য উপলদ্ধির জন্য খোলা থাকে৷ কিন্তু যারা দলপন্থী তারা মানুষকে অন্যদের ভালো দিক ও পূর্ণতা এবং নিজেদের দূর্বলতা সম্পর্কে অজ্ঞ করে রাখে৷
তিন. অন্তরে বিশ্বাস রাখার পাশাপাশি কাজেও আনুগত্যের প্রমাণ দিতে হবে৷ একদিকে ঈমানের দাবী করা ও অন্যদিকে আল্লাহর বিধানের পরিবর্তে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করা স্ব-বিরোধিতা মাত্র ৷
সূরা বাকারাহ’র ১৩৯ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন-
قُلْ أَتُحَاجُّونَنَا فِي اللَّهِ وَهُوَ رَبُّنَا وَرَبُّكُمْ وَلَنَا أَعْمَالُنَا وَلَكُمْ أَعْمَالُكُمْ وَنَحْنُ لَهُ مُخْلِصُونَ (139)

“হে নবী, আপনি আহলে কিতাবদের বলুন, আল্লাহ সম্বন্ধে তোমরা কি আমাদের সঙ্গে বিতর্ক করতে চাও? অথচ তিনি আমাদের প্রতিপালক এবং তোমাদেরও প্রতিপালক। আমাদের কর্ম আমাদের জন্য এবং তোমাদের কর্ম তোমাদের জন্য, আমরা তাঁর প্রতি অকপট।” (২:১৩৯)
এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে, কোন কোন ধর্মের অনুসারীরা মনে করেন যে, তারা সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর কাছে বিশেষ মর্যাদা ও সম্মানের অধিকারী এবং আল্লাহ শুধু তাদের নিয়েই ভাবেন ও তাদের জন্যই পথ-প্রদর্শক পাঠিয়েছেন। তাই তারা অন্য কোন নবী বা তাদের অনুসারীদের গ্রহণ করতে চান না। অথচ আল্লাহর কাছে সকল মানুষই সমান এবং একমাত্র মানুষের আমল বা কৃতকর্মই আল্লাহর সাথে মানুষের দূরত্ব বা নৈকট্য সৃষ্টির মানদণ্ড। তবে মানুষ যে সব কাজ একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আঞ্জাম দেয় তাই সৃষ্টিকর্তার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়। এজন্য মানুষকে শির্ক বা অংশীবাদের কদর্যতা থেকে মুক্ত হতে হবে এবং ইমানের আলোয় নিজের অন্তর ও আত্মাকে আলোকিত করতে হবে।
এই আয়াত থেকে বোঝা যায় যে, মানুষ এতটাই আত্ম কেন্দ্রীক যে সৃষ্টিকর্তাকেও তারা নিজের অধিকার ভুক্ত বিবেচনা করার চেষ্টা করে। অথচ আল্লাহ কোন ধর্ম, জাতি বা সমাজের একক অধিকারভুক্ত নন। তিনি সমগ্র বিশ্ববাসীরই পালনকর্তা।

এরপর ১৪০ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

أَمْ تَقُولُونَ إِنَّ إِبْرَاهِيمَ وَإِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ وَالْأَسْبَاطَ كَانُوا هُودًا أَوْ نَصَارَى قُلْ أَأَنْتُمْ أَعْلَمُ أَمِ اللَّهُ وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنْ كَتَمَ شَهَادَةً عِنْدَهُ مِنَ اللَّهِ وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ (140)

“হে আহলে কিতাব! তোমরা কি বলতে চাও ইব্রাহীম, ইসহাক, ইয়াকুব ও তার বংশধরগণ ইহুদী কিংবা খ্রিস্টান ছিল? হে নবী, আহলে কিতাবদের বলুন, তোমরা বেশী জান,না আল্লাহ ? তার চাইতে অত্যাচারী কে, যে আল্লাহর পক্ষ থেকে তার কাছে প্রমাণিত সাক্ষ্যকে গোপন করে? তোমরা যা কর আল্লাহ তা অবগত আছেন।” (২:১৪০)

হযরত মূসা ও হযরত ঈসা (আঃ) এর কোন কোন অনুসারী তাদের ধর্মের সত্যতা প্রমাণের জন্য দাবি করে থাকেন যে স্বয়ং হযরত ইব্রাহীম ও তার পরবর্তীকালের নবীরাও তাদের ধর্মেরই অনুসারী ছিলেন। কিন্তু হযরত ইব্রাহীম, হযরত মূসা ও হযরত ঈসা (আঃ) ও পরবর্তীকালের নবীদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, এ ধরনের দাবির পেছনে বিদ্বেষ ছাড়া গ্রহণযোগ্য কোন যুক্তি নেই। পবিত্র কোরআন সত্যের বিকৃতিকে সবচেয়ে বড় অপরাধ বলে মনে করে। কারণ সত্যের বিকৃতি বহু যুগ ধরে বিভিন্ন প্রজন্মের মানুষকে বিভ্রান্ত করে এবং এর ফলে সমাজের বিকাশ ও সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ বাধাগ্রস্থ হয়।

এরপর ১৪১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

تِلْكَ أُمَّةٌ قَدْ خَلَتْ لَهَا مَا كَسَبَتْ وَلَكُمْ مَا كَسَبْتُمْ وَلَا تُسْأَلُونَ عَمَّا كَانُوا يَعْمَلُونَ (141)

“সে সম্প্রদায় অতীত হয়ে গেছে। তারা যা করেছে, তা তাদের জন্যে এবং তোমরা যা করছ, তা তোমাদের জন্যে। তাদের কর্ম সম্পর্কে তোমাদের জিজ্ঞেস করা হবে না।” (২:১৪১)

এই আয়াতে ইহুদী ও খ্রিস্টানদের ভিত্তিহীন দাবির জবাব দেয়া হয়েছে। এখানে প্রশ্ন করা হয়েছে যে, কেন তারা তাদের ইতিহাসকে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) এর যুগ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাচ্ছে? একটি জীবন্ত বা গতিশীল সমাজের মূল্যায়ন হবে সেই সমাজের কর্ম ও বৈশিষ্ট্যের উপর। অতীত ইতিহাসের ওপর নয়। অতীতের সমস্ত নবী ও জাতি গত হয়ে গেছে। তাদের কর্ম তাদের সঙ্গেই সম্পর্কিত। তেমনি ইহুদী ও খ্রিস্টানদেরকে তাদের কাজকর্মের জন্য নিজেদেরকেই জবাবদিহিতা করতে হবে। গুণাবলী হল অর্জন করার বিষয়। আর প্রত্যেক ব্যক্তি ও সমাজকে নিজের প্রচেষ্টার মাধ্যমে তা অর্জন করতে হয়। গুণাবলী উত্তরাধিকারের মত কোন বিষয় নয় যে তা সন্তানরা বাবা-মায়ের কাছ থেকে লাভ করবে।

এরপর সূরা বাকারার ১৪২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

سَيَقُولُ السُّفَهَاءُ مِنَ النَّاسِ مَا وَلَّاهُمْ عَنْ قِبْلَتِهِمُ الَّتِي كَانُوا عَلَيْهَا قُلْ لِلَّهِ الْمَشْرِقُ وَالْمَغْرِبُ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ (142)

“নির্বোধ লোকেরা বলবে, তারা এ যাবৎ যে কেবলা অনুসরণ করে আসছিল তা থেকে কিসে তাদেরকে ফিরিয়ে দিল? বলুন, পূর্ব ও পশ্চিম আল্লাহরই, তিনি যাকে ইচ্ছা সরল পথে পরিচালিত করেন।” (২:১৪২)

এর আগেও এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে কাবা শরীফের দিকে কেবলা পরিবর্তনের বিষয়টিকে ইহুদীরা মুসলমানদের সমালোচনা করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করত। এই আয়াতে ও পরবর্তী কয়েকটি আয়াতে এ বিষয় সম্পর্কে স্পষ্ট আলোচনা এবং ইহুদীদের আপত্তির জবাব দেয়া হয়েছে। হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নবুয়্যত লাভের পর মক্কায় থাকাকালীন সময়ে অর্থাৎ দীর্ঘ ১৩ বছর ধরে বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে মুখ রেখে নামাজ পড়তেন। এর কারণ ছিল-
প্রথমত : আগে একত্ববাদীদের কেবলা ছিল বায়তুল মোকাদ্দাস এবং সমস্ত ঐশী ধর্মের কাছেই বায়তুল মোকাদ্দাস অত্যন্ত সম্মানিত স্থান হিসেবে বিবেচিত হত।
দ্বিতীয়ত : তৎকালীন মুশরিকরা কাবা ঘরকে মূর্তির ঘরে রূপান্তরিত করেছিল। এ অবস্থায় ইসলামের নবী (সাঃ) যদি কাবা ঘরের দিকে মুখ করে নামাজ পড়তেন, তাহলে বাস্তবে তা হতো মূর্তিদের দিকে মুখ ফেরানো। মদীনায় হিজরত করার পরও কয়েক মাস পর্যন্ত মুসলমানরা বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে মুখ করে নামাজ পড়তেন। আর ইহুদীরা এ বিষয়কে অজুহাত করে বলতো,মুসলমানরা তো আমাদের অনুসারী। কারণ তাদের স্বতন্ত্র কেবলা নেই। এ নিয়ে উপহাস ও বিদ্রুপ মুসলমানদের জন্য অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। এ অবস্থায় আল্লাহ তা’লা কেবলা পরিবর্তনের নির্দেশ দিলেন।

একদিন রাসূল (সাঃ) যখন মসজিদে জোহরের নামাজ আদায় করছিলেন, তখন জিব্রাইল ফেরেশতার প্রতি নির্দেশ দেয়া হলো, নামাজের মধ্যেই রাসূল (সাঃ)কে যেন কাবামুখী করা হয়। সেই থেকে ওই মসজিদ জু-কেবলাতাইন অর্থাৎ দুই কেবলার অধিকারী মসজিদ হিসাবেই খ্যাতি লাভ করে। কিন্তু বাহানাবাজ ইহুদীরা এবার নতুন আপত্তি তুলে মুসলমানদেরকে বলল, যদি আগের কেবলা সঠিক হয়, তাহলে কোন কারণে তা বাতিল করা হলো? এবং কেন এতকাল পর্যন্ত বায়তুল মোকাদ্দাসের দিকে মুখ করে নামাজ পড়া হলো? পবিত্র কোরআনে এর জবাবে বলা হয়েছে, কেবলার অর্থ এই নয় যে, আল্লাহ স্থান বা কোন অঞ্চল নিয়ে আছেন বা আল্লাহ পশ্চিম দিকে আছেন বা পূর্ব দিকে আছেন। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ পূর্ব-পশ্চিম সব দিকেই আছেন এবং সবই তার মালিকানাধীন। আল্লাহর নির্দেশ ছাড়া কোন স্থানেরই বিশেষ কোন মর্যাদা নেই। আল্লাহর নির্দেশেই আমরা কোন বিশেষ স্থানকে সম্মান করি। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আল্লাহর নির্দেশের অনুগত হওয়া। আল্লাহ যেদিকেই মুখ ফেরানোর নির্দেশ দেন, সেদিকেই আমাদের মুখ ফেরানো উচিত-তা কাবাই হোক বা বায়তুল মোকাদ্দাস হোক। তারাই আল্লাহর সহজ ও সঠিক পথে পরিচালিত হবে, যারা আল্লাহর নির্দেশের আনুগত্য করবে।
সূরা বাকারাহ’র ১৪৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন-
وَكَذَلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ وَيَكُونَ الرَّسُولُ عَلَيْكُمْ شَهِيدًا وَمَا جَعَلْنَا الْقِبْلَةَ الَّتِي كُنْتَ عَلَيْهَا إِلَّا لِنَعْلَمَ مَنْ يَتَّبِعُ الرَّسُولَ مِمَّنْ يَنْقَلِبُ عَلَى عَقِبَيْهِ وَإِنْ كَانَتْ لَكَبِيرَةً إِلَّا عَلَى الَّذِينَ هَدَى اللَّهُ وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُضِيعَ إِيمَانَكُمْ إِنَّ اللَّهَ بِالنَّاسِ لَرَءُوفٌ رَحِيمٌ (143)

“এভাবেই তোমাদেরকে মধ্যপন্থী জাতিরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছি, যাতে তোমরা মানব জাতির জন্য সাক্ষ্যদাতা হতে পার এবং রাসূল তোমাদের জন্য সাক্ষ্যদাতা হতে পারে। (হে রাসূল!) আপনি এ যাবত যে কেবলা অনুসরণ করেছিলেন, তাকে এই উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম-যাতে জানতে পারি কে রাসূলের অনুসরণ করে এবং কে ফিরে যায়। আল্লাহ যাদের সৎ পথে পরিচালিত করেছেন তারা ব্যতীত অপরের নিকট তা নিশ্চয় কঠিন। আল্লাহ এরূপ নন যে, তোমাদের বিশ্বাসকে ব্যর্থ করেন। নিশ্চয় আল্লাহ মানুষের প্রতি স্নেহশীল দয়াময়। ” (২:১৪৩)
গত পর্বে কেবলা পরিবর্তন সম্পর্কে ইহুদীদের আপত্তিগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ এ সব আপত্তির জবাবে বলেছেন, পূর্ব পশ্চিম আল্লাহরই মালিকানাধীন। আল্লাহর নির্দেশিত সরল পথে চলার মধ্যেই রয়েছে মুক্তি বা সুপথ। এমনটি ভাবার কোন কারণ নেই যে, আল্লাহ পূর্বে অথবা পশ্চিমে বিরাজ করছেন এবং শুধু সেদিকেই মুখ ফেরাতে হবে। এই আয়াতে মুসলিম জাতিকে সব ধরনের চরমপন্থা থেকে মুক্ত মধ্যপন্থী জাতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মুসলিম জাতি জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে বস্তুগত,অর্থনৈতিক,আধ্যাত্মিক,বিশ্বাসগত প্রভৃতি সব ক্ষেত্রেই ভারসাম্যের সীমানার মধ্যে রয়েছে। এ আদর্শ সমগ্র মানবজাতির জন্য উপযোগী। এটা স্পষ্ট যে, সমস্ত মুসলমান এরকম নয় এবং মুসলমানদের অনেকেই চিন্তা অথবা কাজে চরমপন্থা অবলম্বন করে থাকতে পারে। তাহলে এ আয়াতের মূল উদ্দেশ্য কি?

এই আয়াতের মূল উদ্দেশ্য এটা বোঝানো যে, ইসলামী বিধান বা ধর্ম একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও মধ্যপন্থী ধর্ম। কেউ যদি ইসলামের সমস্ত বিধান মেনে চলে, তাহলে একমাত্র সেই এমন অবস্থানে উপনীত হবে যে আল্লাহ তাকে মানুষের জন্য তার নিজের সাক্ষী হিসেবে উপস্থাপন করবেন। যেমনটি রাসূল (সাঃ)এর আহলে বাইতগণ ঐশী নির্দেশনাবলীর প্রথম বাস্তবায়নকারী ও বিশেষজ্ঞ ছিলেন এবং সত্যিকারের মুসলিম জাতির পূর্ণাঙ্গ সাক্ষী বা আদর্শ ছিলেন। তারা বলেছেন, মধ্যপন্থী জাতি বলে আল্লাহ যাদেরকে মানুষের ওপর তার নিজের সাক্ষী বলে ঘোষণা করেছেন, আমরাই হলাম সেই জাতি।
এই আয়াতের পরবর্তী অংশে বলা হয়েছে,কেবলা পরিবর্তনের নির্দেশ আল্লাহর অন্যান্য নির্দেশের মতই একটি নির্দেশ ও পরীক্ষা-যাতে এটা জানা যায় যে কারা আল্লাহর অনুগত এবং কারা নিজেদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। আর এ জন্যেই যারা আল্লাহর পথ নির্দেশনা বা হেদায়াত থেকে বঞ্চিত তাদের জন্য এ নির্দেশ পালন করা কঠিন এবং তারাই এ ক্ষেত্রে আপত্তি ও প্রশ্ন তুলছে।

এরপর ১৪৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

قَدْ نَرَى تَقَلُّبَ وَجْهِكَ فِي السَّمَاءِ فَلَنُوَلِّيَنَّكَ قِبْلَةً تَرْضَاهَا فَوَلِّ وَجْهَكَ شَطْرَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَحَيْثُ مَا كُنْتُمْ فَوَلُّوا وُجُوهَكُمْ شَطْرَهُ وَإِنَّ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ لَيَعْلَمُونَ أَنَّهُ الْحَقُّ مِنْ رَبِّهِمْ وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا يَعْمَلُونَ (144)

“নিশ্চয়ই আমি আপনাকে বার বার আকাশের দিকে তাকাতে দেখি। অতএব, অবশ্যই আমি আপনাকে সে কেবলার দিকেই ঘুরিয়ে দেব যাকে আপনি পছন্দ করেন। এখন আপনি মসজিদুল-হারামের (কাবা শরীফের) দিকে মুখ করুন এবং তোমরা যেখানেই থাক, সেদিকে মুখ কর। যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তারা অবশ্যই জানে যে, (এ ধর্মগ্রন্থ) তাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে প্রেরিত সত্য। তারা যা করে তা আল্লাহর অজানা নেই।” (২:১৪৪)

ইহুদীরা যখন মুসলমানদের এই বলে বিদ্রুপ করছিল যে, তাদের কোন স্বতন্ত্র কেবলা নেই, তখন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) কেবলা পরিবর্তনের নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। হঠাৎ জোহরের নামাজের সময় আল্লাহর রাসূলের ওপর এ নির্দেশ অবতীর্ণ হয় এবং রাসূল (সাঃ) বায়তুল মোকাদ্দাস থেকে মুখ ফিরিয়ে মক্কার দিকে মুখ করায় তার পেছনে জামাতে সমবেত মুসলমানরাও কাবামুখী হয়। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো- পূর্ববর্তী ঐশী গ্রন্থে এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে যে, ইসলামের নবী দুই কেবলার দিকে মুখ করে নামাজ পড়বেন এবং ইসলামের নবীর অন্যতম এক নিদর্শন হবে এই ঘটনা। তাই এই আয়াতে আহলে কিতাবদের হুঁশিয়ার করে বলা হয়েছে- তোমরাই যখন জান যে, এই নির্দেশ সত্য তবুও কেন প্রতিবাদ করছ?

এরপর ১৪৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَلَئِنْ أَتَيْتَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ بِكُلِّ آَيَةٍ مَا تَبِعُوا قِبْلَتَكَ وَمَا أَنْتَ بِتَابِعٍ قِبْلَتَهُمْ وَمَا بَعْضُهُمْ بِتَابِعٍ قِبْلَةَ بَعْضٍ وَلَئِنِ اتَّبَعْتَ أَهْوَاءَهُمْ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَكَ مِنَ الْعِلْمِ إِنَّكَ إِذًا لَمِنَ الظَّالِمِينَ (145)

“হে নবী জেনে রাখুন যাদের গ্রন্থ দেয়া হয়েছে আপনি যদি তাদের কাছে সমস্ত দলীল পেশ করেন তবুও তারা আপনার কেবলার অনুসারী হবে না এবং আপনিও তাদের কেবলার অনুসারী নন এবং যেমনটি তাদের কেউ কেউ অন্য কারো কেবলার অনুসারী হবে না। আপনার কাছে জ্ঞান আসার পরও আপনি যদি তাদের বাসনার অনুসরণ করেন, তবে নিশ্চয়ই আপনি হবেন অত্যাচারীদের অন্তর্ভূক্ত।” (২:১৪৫)

এই আয়াতে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)কে সান্ত্বনা দিয়ে বলা হচ্ছে-যদি আহলে কিতাব আপনার কেবলাকে গ্রহণ না করে, তবে আপনি দুঃখিত হবেন না। কারণ হিংসা তাদেরকে সত্য গ্রহণের সুযোগ দেবে না। তাই আপনি যত যুক্তিই দেখান না কেন, তারা কিছুতেই যুক্তি গ্রহণ করবে না। কিন্তু তারা গ্রহণ না করলেও আপনি যেন আপনার কেবলা সম্পর্কে নীরব না হন বরং দৃঢ়তার সাথে এটা ঘোষণা করবেন যে, আমরা এসব হৈ-চৈ বা আপত্তিতে নত হব না এবং আমাদের অবস্থান থেকে মোটেই পিছু হটব না। ইসলাম ধর্মে সবার জন্য একই বিধান থাকায় আল্লাহ তার নবীকেও হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন, আপনি নিজেও যদি তাদের প্রচারণায় প্রভাবিত হয়ে নিজের সঠিক কেবলার অনুসরণ না করেন তাহলে আপনি নিজের উম্মতের ওপর বড় ধরনের জুলুম করার দায়ে দোষী হবেন।

এরপর ১৪৬ ও ১৪৭ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে-

الَّذِينَ آَتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَعْرِفُونَهُ كَمَا يَعْرِفُونَ أَبْنَاءَهُمْ وَإِنَّ فَرِيقًا مِنْهُمْ لَيَكْتُمُونَ الْحَقَّ وَهُمْ يَعْلَمُونَ (146) الْحَقُّ مِنْ رَبِّكَ فَلَا تَكُونَنَّ مِنَ الْمُمْتَرِينَ (147)

“আমি যাদেরকে গ্রন্থ দিয়েছি, তারা তাকে সেরূপ জানে, যেরূপ জানে আপন সন্তানগণকে এবং তাদের একদল জেনে শুনে সত্যকে গোপন করে। সত্য তোমার প্রতিপালকের, সুতরাং তুমি সন্দিহানদের অন্তর্ভুক্ত হইও না।” (২: ১৪৬-১৪৭)

তাওরাত ও ইঞ্জিল গ্রন্থে শেষ নবীর বৈশিষ্ট্য ও লক্ষণ সম্পর্কে বর্ণনা এসেছে। আর তাই আহলে কিতাবগণ নবী (সাঃ) কে চিনত কিন্তু বিদ্বেষ ও একগুঁয়েমীর কারণে তারা এই সত্যকে অন্যদের কাছে গোপন রাখত বা সত্যকে বিকৃত করত। অবশ্য আহলে কিতাব রাসূল (সাঃ) এর বৈশিষ্ট্য দেখে তার প্রতি ঈমান এনেছিল। এইসব শারীরিক ও আত্মিক বৈশিষ্ট্য পূর্ববর্তী গ্রন্থে এমনভাবে উল্লেখিত হয়েছিল যে, কোরআনের বর্ণনা অনুযায়ী তারা নবী (সাঃ)কে নিজের সন্তানের মতই চিনত। শেষের এই আয়াতে যে বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ বলে জোর দেয়া হয়েছে তা হলো, আল্লাহর পক্ষ থেকে যা নাজেল হয়েছে একমাত্র তাই সত্য। মানুষের বিরোধিতা এমনকি অধিকাংশ মানুষও যদি বিরোধিতা করে তাহলেও ঐশী নির্দেশের সত্যতার ব্যাপারে বিন্দুমাত্রও সন্দিহান হওয়া উচিত নয়।

এবারে সূরা বাকারার ১৪৩ থেকে ১৪৭ নম্বর আয়াতগুলোর শিক্ষণীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যাক-
এক. কেবলায় একদিকে যেমন রয়েছে স্বাধীনতার রহস্য, তেমনি এটি আত্মসমর্পনেরও নিদর্শন। স্বাধীনতা বলতে কর্তৃত্বকামী সকল ধর্ম ও জাতি থেকে মুসলমানরা আলাদা বা স্বতন্ত্র। আত্মসমর্পন বলতে বোঝায়, আল্লাহ যে নির্দেশই দেন না কেন নির্দ্বিধায় কোন প্রশ্ন ছাড়াই তা মেনে নেয়া।

দুই. ইসলাম হলো ভারসাম্যপূর্ণ ও মধ্যপন্থী ধর্ম। যদি মুসলমানরা আল্লাহর নির্দেশিত সঠিক পথে চলে তাহলে তারা অন্যান্য জাতির জন্য আদর্শ ও তাদের জন্য সাক্ষী হতে পারে।
তিন. গোঁয়ার্তুমী ও বিদ্বেষ সব ধরনের যুক্তি, বিদ্বেষ ও সত্য অনুসন্ধানের বিরোধী। আর তাই ধর্ম এই দাম্ভিক মনোভাবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে।
সূরা বাকারাহ’র ১৪৮ নং আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন-
وَلِكُلٍّ وِجْهَةٌ هُوَ مُوَلِّيهَا فَاسْتَبِقُوا الْخَيْرَاتِ أَيْنَ مَا تَكُونُوا يَأْتِ بِكُمُ اللَّهُ جَمِيعًا إِنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ (148)

“প্রত্যেকের জন্যে একটি দিক আছে যেদিকে সে মুখ করে দাঁড়ায়, অতএব তোমরা সৎ কাজের দিকে এগিয়ে যাও। তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, আল্লাহ তোমাদের সকলকে একত্রিত করবেন, আল্লাহ সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।” (২:১৪৮)
কোরআনের আলোর গত পর্বে আমরা বলেছিলাম, কেবলা কোন দিকে তা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়। কারণ ইতিহাসে দেখা যায়, অতীতেও একেক ঐশি ধর্মের জন্য কেবলার দিক ভিন্ন ভিন্ন ছিল। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আল্লাহর বিধানের কাছে আত্মসমর্পন করা। তাই ধর্মের মূল নীতি নয়, এমন বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করতে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহর কাছে তারাই প্রিয় যারা সৎকাজ করে। অর্থাৎ আল্লাহর নৈকট্য লাভের মানদণ্ড হচ্ছে-সৎকাজ। মানুষকে অবশ্যই এ ক্ষেত্রে বেশি মনোযোগী হতে হবে এবং তর্ক-বিতর্কে না গিয়ে কাজে প্রমাণ দিতে হবে। প্রতিযোগীতা এমন একটি বিষয় যা প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কখনও খেলাধুলার ক্ষেত্রে কখনও জ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে মানুষ। কিন্তু পবিত্র কোরআন বিশেষ কোন ক্ষেত্রের কথা উল্লেখ না করে যা কিছু মানুষ ও সমাজের জন্য কল্যাণকর সেসব বিষয়ে প্রতিযোগিতা করতে বলেছে এবং এ ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করতে বলেছে। তবে এই প্রতিযোগীতা যেন লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে না হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। এই প্রতিযোগিতার লক্ষ্য হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন।

এরপর ১৪৯ ও ১৫০ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

وَمِنْ حَيْثُ خَرَجْتَ فَوَلِّ وَجْهَكَ شَطْرَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَإِنَّهُ لَلْحَقُّ مِنْ رَبِّكَ وَمَا اللَّهُ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ (149) وَمِنْ حَيْثُ خَرَجْتَ فَوَلِّ وَجْهَكَ شَطْرَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَحَيْثُ مَا كُنْتُمْ فَوَلُّوا وُجُوهَكُمْ شَطْرَهُ لِئَلَّا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَيْكُمْ حُجَّةٌ إِلَّا الَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْهُمْ فَلَا تَخْشَوْهُمْ وَاخْشَوْنِي وَلِأُتِمَّ نِعْمَتِي عَلَيْكُمْ وَلَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ (150)
“হে নবী, যেখানেই আপনি বের হন, আপনার মুখমন্ডল (নামাজের সময়) কাবা শরীফের দিকে ফেরান। এটা নিশ্চয় আপনার প্রতিপালকের কাছ থেকে পাঠানো সত্য। (হে মুসলমানরা!) তোমরা যা কর সে সম্পর্কে আল্লাহ উদাসীন নন।
হে নবী! (পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি) আপনি যেখান থেকেই বের হন (মাসজিদুল হারাম) পবিত্র মসজিদের দিকে মুখ ফেরাবেন এবং (তোমরা মুসলমানরা) যেখানেই থাক না কেন ওই মসজিদের দিকে মুখ ফেরাও যাতে তাদের মধ্যে সীমালঙ্ঘনকারী ছাড়া অন্য কেউ তোমাদের সাথে বিতর্ক না করে। অতএব তাদেরকে ভয় কর না, শুধু আমাকেই ভয় কর। যাতে আমি তোমাদের জন্যে আমার অনুগ্রহ পূর্ণ করে দেই এবং তাতে যেন তোমরা সরলপথ প্রাপ্ত হও। (২:১৪৯-১৫০)

এই দুই আয়াতে পুনরায় মক্কার কাবা ঘরকে কেবলা হিসেবে উল্লেখ করে ইসলামের নবী ও মুসলমানদের কাছে এর বিভিন্ন যুক্তি থাকার কথা বলা হয়েছে।
প্রথমতঃ ইহুদীদের ঠাট্টা ও বিদ্রুপের ভয়ের কারণে কেবলা পরিবর্তনের নির্দেশ মেনে চলা অনেক মুসলমানের জন্য কঠিন ছিল।
দ্বিতীয়তঃ ঐশীগ্রন্থ অনুসরণের দাবিদাররা তাদের গ্রন্থে এটা পড়েছিল যে ইসলামের নবী দুই কেবলার দিকে নামাজ পড়বেন। যদি এই বিষয়টি বাস্তবায়িত না হতো, তাহলে তারা বলত আসমানী গ্রন্থগুলোতে শেষ নবীর যেসব লক্ষণ বা নিদর্শনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে এই নবীর মধ্যে সেসব নেই।

‌এরপর ১৫১ নং আয়াতে আল্লাহ পাক বলেছেন-

كَمَا أَرْسَلْنَا فِيكُمْ رَسُولًا مِنْكُمْ يَتْلُو عَلَيْكُمْ آَيَاتِنَا وَيُزَكِّيكُمْ وَيُعَلِّمُكُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَيُعَلِّمُكُمْ مَا لَمْ تَكُونُوا تَعْلَمُونَ (151)

“(হে মুসলমানরা, আমি আমার সম্পদ বা নেয়ামত তোমাদেরকে পূর্ণভাবে দান করেছি ও তোমাদের মুক্তি বা পথ প্রদর্শনের মাধ্যমগুলো দিয়েছি)-যেমন আমি তোমাদের মধ্য হতে তোমাদের নিকট একজন রাসূল পাঠিয়েছি, যে আমার আয়াত সমূহ তোমাদের কাছে পাঠ করে, তোমাদের পবিত্র করে, গ্রন্থ ও বিজ্ঞান শিক্ষা দেয় এবং তোমরা যা জানতে না তা শিক্ষা দেয়।” (২: ১৫১)

মহান আল্লাহ পূর্ববর্তী আয়াতে কেবলা পরিবর্তনের অন্যতম যুক্তি হিসেবে মুসলমানদেরকে আল্লাহর নেয়ামত পূর্ণভাবে দান করা ও তাদেরকে পথ প্রদর্শনের কথা উল্লেখ করেছেন। আর এই আয়াতে বলা হয়েছে-মহান আল্লাহ মুসলমানদেরকে আরও অনেক বড় নেয়ামত উপহার দিয়েছেন। আর সেসবের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেয়ামত হলো মানুষকে সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য নবী পাঠানো। এই নবীরা ছিলেন জনগণের শিক্ষক। তাঁরা মানুষকে আল্লাহর আয়াত ও বিধান শিক্ষা দিতেন এবং একজন আন্তরিক প্রশিক্ষক হিসেবে মানুষের সংশোধন ও উন্নয়নের চিন্তা করতেন। নবীরা শুধুমাত্র নৈতিকতা ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রেই মানুষের পরিচালক ছিলেন না, একইসঙ্গে সমাজের চিন্তা ও জ্ঞানের বিকাশেও নেতৃত্ব দিয়েছেন। অবশ্য ঈমান ও বিশ্বাসের ছায়াতেই তারা জ্ঞান প্রচার করতেন।

এই সূরার ১৫২ নং আয়াতে বলা হয়েছে-

فَاذْكُرُونِي أَذْكُرْكُمْ وَاشْكُرُوا لِي وَلَا تَكْفُرُونِ (152)

“অতএব তোমরা আমাকেই স্মরণ কর, আমিও তোমাদের স্মরণ করব, তোমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও এবং আল্লাহর বিরুদ্ধাচারী হইও না।” (২:১৫২)

আল্লাহ মানুষকে এত নেয়মত ও কল্যাণ দান করেছেন যে তা হিসাব করে শেষ করা যাবে না। ফলে এসব নেয়ামত তিনি যেভাবে ব্যবহার করলে সন্তষ্ট হন সেভাবেই ব্যবহার করা উচিত। যদি মানুষ আল্লাহকে ভুলে যায়-তাহলে তার প্রতি আল্লাহর অসংখ্য অনুগ্রহের কথাও তার মনে থাকে না, এই অবস্থায় আল্লাহও তাকে তার নিজের অবস্থার ওপর ছেড়ে দেন। আল্লাহকে স্মরণ করা বলতে শুধু মুখে মুখে স্মরণ করা বোঝায় না বরং আন্তরিক চিত্তে বাস্তবে তাকে স্মরণ করা বোঝায়। মানুষ যখন পাপে লিপ্ত হবার উপক্রম হয়, তখন সে আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় তা থেকে দূরে থাকে। অনুরূপভাবে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ বলতে শুধু মুখে মুখে কৃতজ্ঞতা প্রকাশকে বোঝায় না। আল্লাহর প্রতি বাস্তবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হলে আল্লাহর সমস্ত নেয়ামতকে যথাযথ ক্ষেত্রে এবং যে লক্ষ্যে ওইসব নেয়ামত দেয়া হয়েছে ঠিক সে লক্ষ্যেই ব্যবহার করতে হবে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.